মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৪০

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৪০
নওরিন কবির তিশা

ও বউ…..
কেন আমার কাছে আসো না…
ও বউ…..
তুমি আমায় কি ভালোবাসো না….
ও বউ…..
কেন আমার কাছে আসো না…
চলো ঝগড়া মারামারি ভুলে যাই তাড়াতাড়ি…..
ইতনা গুচ্ছা কিউ….
তুমি কেন এত বোকা সাজো….
আমায় একটু বুঝো…..
শোনো না…
আই লাভ ইউ…..
ও বউ…..

শিশির এবার শব্দ করেই দরজা খুলে দেয়। নাহিয়ান তখনো দাঁড়িয়ে আছে তার দরজার বাইরে মুখে একরাশ মলিনতা আর অপরাধবোধ। তাকে দেখে শিশির রেগে গিয়ে বলে,,
—”কি দরকার আপনার এখানে?আর এরকম পাগলামি করার মানে কি!”
নাহিয়ান অপরাধী কণ্ঠে বলে,,
—”রেগে আছো বউ?”
শিশির:”রেগে থাকি বা না থাকি তাতে আপনার কি?”
নাহিয়ান:”আরে শোনো না আসলে আমি খেয়াল করিনি যে এখানে ইয়ালিনা…”
কথাটা বলতে বলতে সে ভিতরে ঢুকতে যেতেই শিশির তাকে সাবধান করে বেশ জোরে বলে,,
—”স্টপ! ওইখানেই থামুন! একদম ভেতর আসার চেষ্টা করবেন না!”
নাহিয়ান সবেমাত্র ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে একপা রেখেছিল। শিশিরের এমন কাঠ কাঠ কণ্ঠে কিছুটা পিছিয়ে যায় সে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নাহিয়ান:”এমন কেন করছেন ম্যাম বললাম তো আমি খেয়াল করিনি?”
শিশির:”খেল যখন করেনি তখন আর খেয়াল করাও লাগবে না যান গিয়ে ইয়ালিনার ডান্স দেখুন একদম জ্বালাতন করবেন না! আর তাছাড়া আমি কে আপনার হ্যাঁ যে আপনি আমাকে জ্বালাতন করছেন?”
বলতে বলতে এসে দরজা আটকে দিতে যেতে নাহিয়ান তার হাত ধরে গেয়ে ওঠে,,
“বাড়াবাড়ি মন জ্বালাতন করেছে যখনই….
আমি কোনো বার চেষ্টার সীমানা রাখিনি…
ওওও আর কি বোঝাবো বল…
বলছে ফুলের দল….
তুই আমারই….
আর কি কারণ চাস…
বলছে বন্ধু বাতাস
তুই আমারি…..”

শিশির তার হাতটা ঝটকা মেরে সরিয়ে দিতে গিয়েও পারল না। নাহিয়ানের এমন সুঠাম দেহি পেশীবহুল শরীরের কাছে তার ক্ষীণ দেহ যেন অত্যন্ত নগণ্য। তবুও চেষ্টার কোন ত্রুটি করল না সে। বের হাত-ঝটকা দিতে গেলেই নাহিয়ান তাকে একটানে নিজের বুকে ফেলে বলল,,
—”এই ক্ষীণ শরীর নিয়ে তুমি আমার থেকে জিতবে ভেবেছ? যদিও তুমি চাইলে আমি হেরে যেতেই পারি, তবে আমাকে হারাতে চাইলে এভাবে নয় বরং একবার শুধু ‌আমার চোখের দিকে এক ঝলক তাকাও। গড প্রমিস তোমার সামনে সারা জীবনের মতো আত্মসমর্পণ করে গোলাম হয়ে রয়ে যাব আমি!”
শিশির নিজেকে তার থেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল। শেষমেষ সে রেগে গিয়ে বলল,,

—”অভিনয় তো ভালোই করতে পারেন গানের গলাও খারাপ না তা আপনি সিনেমায় এক্টিং কেন করলেন না? এ
আম সিওর একটা মুভিতেই ভালো রিচ পেতেন!”
নাহিয়ান:”সেটা ঠিক! তো সিনেমার নাম কি দেওয়া যায় বলোতো?”
শিশির:”নাটক কম করে ছাড়ুন আমার!”
নাহিয়ান তাকে ছাড়লো না বরং বাঁধন আরো শক্ত করে তাকে নিজের বুকের সাথে চেপে বলল,,
—”টের পাচ্ছো না আমার বক্ষ পিঞ্জিরা কি নিদারুণ ভাবে দগ্ধ হচ্ছে, সে দহন কি তোমার হৃদয় এক অংশও টের পাচ্ছে!”

শিশির থমকে গেল। এমনিতেই নাহিয়ানীর শরীর থেকে ভেসে আসা তীব্র পুরুষালীর ঘ্রাণ তাকে মাতাল করে তুলছে, তার উপর এই কথাগুলো। আচ্ছা সে কি নাহিয়ান এর উপর রাগ করেছে? একদমই না! তার অভিমান হয়েছে! নাহিয়ান কেন বলল ইয়ালিনার ডান্স সুন্দর হ্যাঁ শিশির মানল যে নাহিয়ান দেখেনি কিন্তু তবুও কেনো বলবে কোনো মেয়ের কথা!
আচ্ছা শিশির কি জেলাস? হ্যাঁ অবশ্যই! শুধু জেলাস না তার তো ইচ্ছা করছে ওই ইয়ালিনের চুলের মুঠি ধরে ঘুরিয়ে দিতে! এভাবেই কেটে গেল কিছু মুহূর্ত কিছুক্ষণ পর নাহিয়ান এক সুরেলা কন্ঠে ডাক দিল,,
—”বউ!”
শিশির না চাইতেও তার মুখ দিয়ে অস্পষ্ট সুরে বের হয়ে আসলো,,
—”হু”
নাহিয়ান:”এখনো রেগে আছো?”

শিশির নিশ্চুপ। নাহিয়ান তাকে নিজের বুক থেকে তুলে কপালে আলতো চুমুর উষ্ণ পরশ একে দিয়ে বলল,,
—”আমি আগেও বলেছি আর এখনো বলছি সারা জীবন বলবো,’তুমিই আমার হৃদয়ের বাগানে থাকা একমাত্র গোলাপ যে প্রচন্ড শীতের রাতেও আমার জন্য ছড়িয়ে যায় গ্রীষ্মের উত্তাপ! তুমি কি জানো তুমি আমার সেই পূর্ণতা যেটা ছাড়া আমার চারিদিকে ঘিরে থাকে শুধুই শূন্যতা।!”
শিশির আর কিছু বলতে পারল না। এই পুরুষটার প্রত্যেকটা কথা তাকে অদ্ভুত রকম মুগ্ধ করে আর সেটা যদি হয় ভালোবেসে তাহলে তো আর কোনো কথাই নেই। সে বাকরুদ্ধ কি বলবে? কন্ঠ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না তার যেন‌কথাগুলো গলার কাছে এসে আটকে যাচ্ছে তার কণ্ঠটা চেপে রেখেছে কেউ শক্তভাবে! তবুও বহু কষ্টে সে ফিসফিসিয়ে বলল,,

—”দ..দ..দেখুন দরজা খোলা বাড়ি ভর্তি মানুষ কখন কে চলে আসবে!”
নাহিয়ান:”কেউ আসবে না সবাই নিচে ব্যস্ত! তুমি শুধু বলো এখনো রেগে আছো?”
শিশির কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,,
—”না!”
নাহিয়ান যেন এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। খানিকটা চিৎকার করেই সে বলল,,
—”শুকুর আলহামদুলিল্লাহ!”
নাহিয়ান এর এমন পাগলামিতে মুচকি হাসলো শিশির।

রাত প্রায় সাড়ে দশটা। একরাশ অস্থিরতা আর বিরক্ত নিয়ে দুই তলার করিডোর দিয়ে হাসনা খানের রুমের দিকে যাচ্ছিল নিঝুম। হঠাৎই সৌজন্যের রুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সে লক্ষ্য করে বিছানার উপর বসে মোবাইলে কি যেন একটা টাইপিং করছে সৌজন্য।
হঠাৎই নিঝুমের মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। সে নিঃশব্দে ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করল যাতে সৌজন্য বুঝতে না পারে। সৌজন্যের পিছনে এসে সে ভো বলে সামান্য চিৎকার করল। আর তাতেই পিলে চমকে উঠলো সৌজন্যের। কিছুটা ভড়কে সে পিছনে ঘুরতেই দেখতে পেল নিঝুম দাঁড়িয়ে ঠোঁটের কোনে দুষ্টু হাসি। তাকে দেখে সৌজন্য বলল,,
—”আরে অদ্ভুত! দেখছে না একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছি?”
নিঝুম:”কি কাজ করছেন? গার্লফ্রেন্ডের সাথে চ্যাটিং নাকি দেখি দেখি আমাকেও একটু দেখান!”
কথাটা বলে সে গলা বাড়িয়ে সৌজন্যে মোবাইল দেখতে যেতেই সৌজন্য দ্রুত সেটা অফ করে পিছনে লুকালো। তা দেখে নিঝুমের ঠোঁটের কোণের দুষ্টু হাসির রেখা প্রসারিত হলো।
নিঝুম:”কি ব্যাপার মিস্টার ইন্ট্রোভার্ট?আপনারও কি আবার গার্লফ্রেন্ড আছে নাকি? সিরিয়াসলি?”
সৌজন্য এবার নিজের মুখে গাম্ভীর্যের রেখা টেনে বলল,,

—”তোমার মাথায় কি সারাদিন এসব উদ্ভট চিন্তা ভাবনারায় ঘুরতে থাকে নাকি?”
নিঝুম ভ্রু কুঁচকে বলল,,
—”এসব উদ্ভব চিন্তাভাবনা?”
সৌজন্য:”তাছাড়া আর কি?”
নিঝুম:”এই কারণেই ঠিক এই কারণেই আমার মনে হয় যে আপনি নাটক কোনদিন কোনো মেয়েকে পছন্দ করতে পারবেন আর না তো কোনোদিন কোনো মেয়ে আপনাকে পছন্দ করবে!”
সৌজন্য:”তোমায় বলছে না? তুমি জানো আমি আমার কলেজের কতগুলো মেয়ের ক্রাশ?”
নিঝুম:”ওরা মনে হয় ঠিক করে জানেনা যে আপনি কেমন? এইজন্য!”
সৌজন্য:”তারা খুব ভালো করেই জানে আমি কি রকম?”
নিঝুম:”ও তাই নাকি! তাহলে ওই মেয়েগুলোর মাথায় সমস্যা আছে!”
সৌজন্য:”কি বললে?”
নিঝুম:”যা সত্যি তাই বললাম!”

সৌজন্য:”বাই এনি চান্স তুমি কি আমাকে অপমান করার চেষ্টা করলে?”
নিঝুম:”চেষ্টা আবার কি জিনিস অপমানই করলাম!”
সৌজন্য কিছু বলার আগেই নিচে থেকে নিঝুমের মায়ের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। তৎক্ষণাৎ নিঝুমের মনে পড়ল সে তো হাসনা খানের রুমে যাচ্ছিল তার ফোনটা নিয়ে আসতে কিন্তু সৌজন্যের সাথে ঝামেলা করতে গিয়ে একেবারেই ভুলে গেছে সেটা। মনে পড়তেই তৎক্ষণাৎ সে দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে যেতে যেতে বলল,,
—”আপনার সাথে হিসাব আমি পরে মেটাবো আগে আসল কাজটা সেরে আসি!”
বলেই এক ছুটে রুম থেকে বের হয়ে গেল নিঝুম। সৌজন্য শুধু তাকিয়ে থাকল। এই মেয়েটা আসলেও অদ্ভুত! ঝড়ের বেগে এসে সবকিছু লন্ডভন্ড করে নিজেই আবার ছুটে পালিয়ে যায়।

রাত গভীর,পুরো বাড়ি নিস্তব্ধতার চাদরে মোড়া। শুধু জেগে আছে এক জোড়া কপত-কপতি। নির্ঝরের মনোযোগ বইয়ের পাতায়, এদিকে সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুমে ঝিমুনি আসছে ফারিনের। নির্ঝর এক ঝলক সেদিকে তাকিয়ে বলল,,
—”এভাবে দাঁড়িয়ে মাতলামি করার কি মানে গিয়ে শুয়ে পড়ো!”
তাকে মাতাল বলা, মাতলামির কি করল সে? মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেল ফারিনের। কিন্তু তবুও নিজেকে শান্ত রেখে সে বলল,,
—”কোথায় ঘুমাবো?”
নির্ঝর:”হিন্দি ড্রামা সিরিয়াল দেখো নাকি?”
ফারিন জিজ্ঞেস করল কি আর নির্ঝর উত্তর দিল কি? এমনিতেই ঘুম আসছে তার উপর নির্ঝরের এসব উদ্ভট প্রশ্নে মেজাজ যেন প্রচন্ড বিগড়ে গেল তার।দাঁতে দাঁত চেপে সে প্রশ্ন করল,,

—”এসব আবার কোন ধরনের প্রশ্ন?”
নির্ঝর বইয়ের পাতায় চোখ রেখেই বলল,,
—”না মানে এগুলো তো হিন্দি সিরিয়ালই হয় তাই বলছি! বিয়ে করা বউ তুমি আমার বিছানায় শোয়ার অধিকার তোমারও আছে! তোমাকে বলবো না যে সোফায় শুতে হবে। আর না তো আমি নিজের শুব! তাই বেশি ড্রামা না করে সোজা গিয়ে শুয়ে পড়ো!”
নির্ঝরের মুখে বিয়ে করা বউ শুনে কেন জানি হঠাৎই একরাশ লজ্জা এসে আড়ষ্ট করল ফারিনকে। পরক্ষণেই সে নির্ঝরকে প্রশ্ন করে বললো,,
—”আপনি ঘুমাবেন না?”
নির্ঝর:”সেটা তোমার না জানলেও চলবে!”
ব্যাস এই কথাটাই যেন ফারিনের মনের সব রংকে একবারই ধুয়ে মুছে সাফ করে সাদা বানিয়ে দিল। সে বিড়বিড় করে বলল,,,

—”ইয়া আল্লাহ! সারা জীবন রোমান্টিক মুভি দেখার ফল কি হলো? শেষ পর্যন্ত এই খাইস্টাটারেই আমার কপালে দিলা!”
নির্ঝর:”কিছু বলছ?”
ফারিন অপ্রস্তুত হেসে বলল,,
—”ক-কই না তো কিছু না!”
নির্ঝর:”তাহলে গিয়ে শুয়ে পড়ো!”
ফারিন:”আচ্ছা!”
ফারিন বিড়বিড় করতে করতে গিয়ে শুয়ে পড়লো। নির্ঝর এক ঝলক সেদিকে তাকিয়ে এর মনোনিবেশ করল বইয়ের পাতায়।
সকাল ৯ টা

চৌধুরী আবাসনের ব্যস্ততা টা আজকে একটু বেশি। শিশিররা ফিরে যাবে ঢাকায়। সেইজন্যেই ব্যস্ত সবাই। সকালের নাস্তা সেরে সবার থেকে বিদায় জানিয়ে বের হয়ে পড়ল তারা। সবার সাথে দেখা হলেও কোথাও দেখা নেই নিঝুমের। হাসনা খান বললেন,,
—”ও মনে হয় ছাদে! দেখেছো আমার মেয়ের জ্ঞান বুদ্ধি সবাই চলে যাবে আর ও এখন গিয়ে ছাদে বসে আছে!”
নওরিফা খানম হেসে বললেন,,
—”থাক হাসু ওর মনে হয় মনটা একটু খারাপ এতদিন ছিলাম তো আজকে চলে যাচ্ছি ওকে কিছু বলিস না!”
হাসনা খান:”আরে আপা সবাই দিন দিন বড় হয় আর ও যেন দিন দিন ছোট হচ্ছে!”

নওরিফা খানম মৃদু হাসলেন। ইতিমধ্যেই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিয়েছে, একে একে বের হচ্ছে গাড়িগুলো। এদিকে গাড়ি বের হয়ে যাওয়ার শব্দে করিডোর দিয়ে নিচে তাকালো নিঝুম। একে একে বের হয়ে যাচ্ছে গাড়িগুলো। বিষন্ন মন নিয়ে সে ফিরে যাচ্ছিল তখনই দেখতে পায় জানার কাছে নামিয়ে সেখান থেকে মাথাটা বের করে সৌজন্য তাকিয়ে আছে তার দিকে। নিঝুম মলিন হেসে হাতের ইশারায় তাকে বিদায় জানালো। সৌজন্যও তাকে ইশারায় বিদায় জানালো।

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৩৯ (২)

গাড়িগুলো চলে গেল তার দৃষ্টিসীমা ছাড়িয়ে। মুখে একরাশ মলিনতা আর হৃদয়ে বিষন্নতা নিয়ে নিজের রুমে গেল নিঝুম। রুমে ঢুকতেই তার চোখ পরল ড্রেসিং টেবিলের ওপরে রাখা স্টোনের কানের দুল জোড়ার ওপর যা জানলার কাজ গলিয়ে আসা রোদ্দুরের মৃদু রশ্মির ঝলকানিতে জ্বলজ্বল করছে।
নিঝুম এগিয়ে গিয়ে দুল জোড়া হাতে নিল। সেই সাথে তার দৃষ্টিগত হলো টেবিলের উপর রাখা আরেকটা রঙিন চিরকুট। যাতে ইংরেজির গোটা অক্ষরে লেখা,,
“This was just for you Miss Talkative…”
নিঝুমের আর বুঝতে বাকি রইল না এটা কার কাজ। সে মুচকি হেসে দুলটার দিকে তাকালো।

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৪১