মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৪৭

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৪৭
নওরিন কবির তিশা

সময় যেন অবলীলায় চলমান এক স্রোতস্বিনী, এক বৃদ্ধ যাযাবর, যে অপেক্ষা করে না কারো জন্য এইতো দেখতে দেখতে আরো ৪ টি দিন পার। হাতে আর মাত্র তিন দিন, তারপরই আনায়া আর রিদিতের বিয়ে। অবশেষে শেষ হবে তাদের অপেক্ষার প্রহর।
শ্রাবণের শেষ পূর্ণিমা আজ, অন্তরীক্ষে থালার মতো উজ্জ্বল জোৎস্নাপতিটি ছড়াচ্ছে রুপালি কিরণ। পুরো আকাশ জুড়ে প্রতিফলিত হচ্ছে সেই রূপালী আভা। আনায়াদের বাড়ির ছাদ আজ অন্যরকম অনুষ্ঠান বহুল। চারিদিকে ছোট ছোট স্ট্রি্ং লাইটের লাল-নীল আলোক রশ্মির ঝলকানি।

কাল আনায়ার হলুদ পরশু মেহেদী আর তারপর দিন বিয়ে। প্রত্যেকটা জিনিসই যেন ধারাবাহিক নিয়ম অনুযায়ী সম্পন্ন হবে। তবে আজকের রাতটা একটু বেশিই অন্যরকম।আজকেই সব আত্মীয়-স্বজনরা এসেছে আনায়াদের বাসায়, সঙ্গে তার সব কাজিনরা।তাই সবাই মিলে ঠিক করল আজকের রাতটাকে একটু বেশিই বিশেষ করে রাখার জন্য সবাই মিলে ছাদে আড্ডা দিবে,হাসি ঠাট্টা আর কিছু আনন্দময় খেলার মাধ্যমে কাটাবে মুহূর্তখানিক।
সিদ্ধান্ত অনুসারে ছাদে জমায়েত হয়েছে পুরো বাড়ির নবীনেরা। এমনকি এসেছে ফারিন আর নির্ঝররাও।সবাই ছাদে আসন পেতে গোল হয়ে বসে আছে। ফারিন আর নিঝুম বসে আছে আনায়া,ইনায়া আর শিশিরের সাথে ছাদের ডান দিকে,সাথে আছে আনায়ার কতিপয় কাজিন আর তাদের ঠিক বিপরীত দিকে বসে আছে নির্ঝর,জাহিদ, সাজিদ আর সৌজন্যে। হঠাৎই সাজিদ বলল,,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—”ভাই ‌শোন তোদের মত এত অঢেল সময় আমার নেই। আমি হলাম মিঙ্গেল মানুষ বউ আছে,সেও আবার অসুস্থ।তাই এখন আমার উচিত একজন আদর্শ স্বামীর দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করা তার খেয়াল রাখা।তাই আমি গেলাম!”
তার কথা শুনে জাহিদ তার পিঠে আলতো চাপড় দিয়ে বলল,,
—”আর কি বলতাম ভাই! এসব দিনকাল আমিও পার করে এসেছি! বউকে রেখে কোথাও যাওয়া, আর নিজেকে আগুনের গর্তে ফেলে দেওয়া একই কথা। আর এই অবস্থায় আমাদের বিবিদের যে পরিমাণ মুড সুইং হয়!”
কথাটা বলেই সে একবার ইনায়ার দিকে তাকালো। ইনায়া তখনও ফারিনের সাথে গল্পে ব্যাস্ত। তা দেখে জাহিদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,,

—”যাক বাবা শুনতে পায়নি! আজকের মতন রক্ষে!”
কথাটা বলতেই সবাই হেসে উঠল একযোগে! তখনই ইনায়া জাহিদের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলল,,
—”কি করেছ তুমি?”
জাহিদ:”নাও এবার ঠেলা সামলাও! যত দোষ জাহিদ ঘোষ!”
ফের ছাদে পড়ল হাসির রোল। তখন জাহিদ আর সাজিদ নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে বলল,,
জাহিদ:”তা ভাই নির্ঝর বিয়ে তো তুমিও করেছো। তোমার অবস্থা কি শুনি?”
নির্ঝর কিছু বলার আগেই সাজিদ বলল,,

—”আরে ভাই ওকি আর আমাদের মতো বোকা নাকি ও নিজের স্টুডেন্ট বিয়ে করেছে যাতে ওর উপরে কথা না বলতে পারে! কি ভাই নির্ঝর তাই না?”
ফারিন দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,
—”তাইতো! এই বেডা রে সবাই হাড়ে হাড়ে চেনে!”
হঠাৎ শিশির বলল,,
—”ভাইয়া তোমার আলতু ফালতু কথা শেষ হলে যাও রুমে যাও ইলমা আপুর কিছু দরকার হয় কিনা দেখো।”
সাজিদ সেখান থেকে উঠতে উঠতে বলল,,
—”এই আরেক জুটেছে ইলমার চামচী নন্দিনী! আচ্ছা শিশির তুই কি আদেও আমার বোন নাকি ইলমার বোন বলতো?”
শিশির:”আমি ইলমা আপুরই বোন এখন যাও!”
সাজিদ যেতে যেতে বলল,,

—”সেখানেই যাচ্ছিলাম এভাবে না বললেও পারতিস!”
সাজিদ চলে যেতেই শিশির বলল,,
—”জাহিদ ভাইয়া তোমরা কি কোনো গেমস স্টার্ট করবে না নাকি এসব ফালতু বকবক করবে?”
জাহিদ কিছু বলার আগেই চিলেকোঠার শেষ সিঁড়িটা অতিক্রম করে ছাদে পা রাখতে রাখতে জিসান বলল,,
—”হে গাইস আই এম হেয়ার!”
জিসানের হঠাৎ কণ্ঠে সবাই তার দিকে তাকালো। জিসান আসলে জাহিদের ছোট ভাই অর্থাৎ ইনায়ার দেবর। আনায়ার বয়সী ছেলেটা বেশ রসিক টাইপের,গায়ের বর্ণ উজ্জ্বল শ্যামলা, উচ্চতায় ৫’১০ এর কিছু বেশি সে এগিয়ে এসে সবার উদ্দেশ্যে বলল,,

—”দ্যাট ইজ নট ফেয়ার! আমার একমাত্র বিয়াইনের বিয়ের অনুষ্ঠান আমাকে ছাড়া?”
তাকে দেখে শিশির বলল,,
—”মিস্টার স্ট্যান্ড অফ কমেডিয়ান ফর ইওর কাইন্ড ইনফরমেশন এখানে কোনো বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে না এটা জাস্ট একটা আড্ডা!”
জিসান:”সেটা আমিও জানি! তবে আমাকে রেখে…নট ফেয়ার!”
জিসানের কথা শুনে ইনায়া বলল,,

—”না না ভাই তোমাকে রেখে কিছুই করা হচ্ছে না তোমার জন্যই তো অপেক্ষা করছিলাম আমরা!”
জিসান এগিয়ে গিয়ে ইনায়ার পাশে বসে বলল,,
—”এই না হলে আমার লক্ষী ভাবি!”
হঠাৎই তার চোখ গেল আনায়ার পাশে বসা একটা মেয়ের দিকে। মেয়েটাকে সে আগে কখনো দেখেনি কিন্তু এক ঝলক তার দিকে তাকাতেই নিজের নজর যেন আর সরাতে পারল না জিসান। এত সুন্দর মিষ্টি একটা মেয়ে,টানাটানা চোখ,সরু,চিকন নাক,পাতলা ঠোঁট আর অদ্ভুত সুন্দর চিকন জ-লাইন।জিসান সেদিকে তাকিয়েই ইনায়ার কাছে শুধালো,,

—”ভাবি! এই মেয়েটা কে গো?”
ইনায়া ফারিনের দিকে তাকিয়ে বলল,,
—”ও?ও শিশিরের এক রিলেটিভস!”
জিসান:”নাম কি ভাবি ওর?”
ইনায়া:”ফারিন! কিন্তু তুমি এত কিছু শুনছো কেন?”
জিসান:”না কিছু না ওই এমনি আর কি নতুন দেখলাম তো তাই!”
ইনায়া আর কিছু বলার আগেই শিশির বলল,,

—” তো মিস্টার স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান, আপনার ঝুলিতে তো সবসময় হাজারটা উল্টাপাল্টা উদ্ভট গেমের আয়োজন থাকে তা কিছু একটা বলুন সেখান থেকে! আপাতত সেটাই হোক!”
জিসান ফারিন এর দিক থেকে চোখ সরিয়ে শিশিরের দিকে তাকিয়ে বলল,,
—”অফকোর্স শালিকা! আমি আজকের জন্য একটা দারুন সুপার গেমের কথা ভেবে এসেছি…”
সে আর কিছু বলার আগে শিশির বলল,,
—”ফাইজলামি করার জায়গা পাস না! আমি তোর কোন দিকের শালিকা লাগি হ্যাঁ?”
জিসান:”কেন তোর বোনকে না আমায় দিতে চেয়েছিলি!”
শিশির:”আমি আবার কবে তোকে আমার বোন দিতে চাইলাম?”
জিসান:”চেয়েছিলিস এখন মনে করতে পারতেছিস না শা”লি ওয়াদা ভঙ্গকারী!জানিস না ওয়াদা ভঙ্গকারী শয়তানের বন্ধু!”

শিশির:”আইছে আমার হাদিসওয়ালা, ভাগ্যিস আমার কোনো বোন নেই আর বোন থাকলেও তোর সাথে বিয়ে দিতাম না!”
জিসান:”বোন তো তোমার আছে শালিকা শুধু দেখতে পারছ না!”
কথাটা বলেই সে একবার আর চোখের ফারিনের দিকে তাকালো। ফারিন তখন চেয়ে আছে তাদের দুষ্টুমির দিকে। তখনই জাহিদ বলল,,
—”এক গাট্টা খাবি বজ্জাত! যে গেমের কথা বলতেছিলি সেটাই স্টার্ট কর! আর একটাও বাজে কথা বললে এমন কানমোলা দেবোনা!”
জিসান:”উফস ভাইয়া! এই কারণেই ভাবি বলে তুমি বুড়া হয়ে গেছো রসকষের কিছু আছে তোমার ভিতরে?”
জাহিদ কিছু বলার আগে জিসান আবারও বলল,,

—”যাগগে বাদ দাও সেসব কথা! তো এবার আসল কথায় আসি আমার গেমের নিয়ম অনেকটা ট্রুথ এন্ড ডিয়ার এর মত, এখানেও একটা সিলভার রিং থাকবে আর সেটার ঘুর্নন শেষে যার দিকে পড়বে তাকে দেওয়া হবে একটি নির্দিষ্ট অক্ষর আর সেই অক্ষরটা দিয়ে তাকে গান গাইতে হবে। ওয়ান কাইন্ড অফ গানের কলি। বোঝাতে পেরেছি?”
সবাই একযোগে বলল,,
—”অবশ্যই!”
কিছুক্ষণ পর। শুরু হলো কাঙ্ক্ষিত গেমটি ‌ঘূর্ণায়মান সিলভার রিংটি প্রথমেই পরল আনায়ার দিকে। সবাই হইহই করে উঠলো, শিশির ঠোঁট চেপে হেসে বলল,,
—”তাহলে উডবি ওয়াইফ অফ রিদিত খান গান গাওয়ার জন্য প্রস্তুত তো এত কাল তো শুধু রিদিত ভাইয়ের গানই শুনলাম,আজকে যদি এখানে ভাই থাকতো তাহলে যা মজা হতো না! যাই হোক তোকে অক্ষরটা তাহলে আমিই দেই। কি বলো সবাই?”
ইনায়া বলল,,

—”তুমিই দাও তাহলে!”
তার সাথে সম্মতি জানালো সবাই। শিশির আনায়ার দিকে ফিরে বলল,,
—”আচ্ছা তাহলে তো একটা গান গাছ আর প্রথম অক্ষর “এ” দিয়ে থাকবে!”
জিসান বলল,,
—”আর হ্যাঁ রুলস অনুযায়ী গানটার প্রথম থেকে গাইতে হবে কিন্তু কেউ যদি গান না খুঁজে পায় সেক্ষেত্রে সে তার জানা গানের মাঝখান থেকেও গাইতে পারে! তবে মাঝখানের কলির প্রথম অক্ষরও যে অক্ষর টা দেওয়া হবে তাই দিয়েই হতে হবে!”
সবাই সম্মতি জানালো। আনায়া কিছুটা অপ্রস্তুত এর আগে গান কখনোই করা হয়নি তার, তাকে দেখে ফারিন বলল,,
—”আরে আপু তোমাকে তো সহজই একটা অক্ষর দেয়া হয়েছে এই নিয়ে এতক্ষণ ধরে ভাবছো আমাকে বললে কোন সময় গেয়ে দিতাম!”
জিসান তার দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,,

—”তাই নাকি? এতটাই ইজি?”
ফারিন কিছুটা ভাব নিয়ে বলল,,
—”অফকোর্স অনেক ইজি!”
জিসান:”তাহলে এরপরের টার্নের জন্য রেডি তো!”
ফারিন:”ব্যাপারটা যদি হয় গান তাহলে আমি যেকোনো সময় যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো জায়গায় প্রস্তুত! কিন্তু আমার দিকে আগে রিংটা পরুক, তারপর দেখাচ্ছি”
জিসান:”ওকে, জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ!”
অন্যদিকে নির্ঝর এক ঝলক ফারিনের দিকে তাকালো, জিসান ছেলেটাকে কেনো যেন সুবিধার মনে হচ্ছে না তার, আর তার উপর ফারিনেরইবা এত হেসে হেসে কথা বলার কি আছে? নির্ঝরের ইচ্ছা করলো তার কানের নিচে গিয়ে দুইটা লাগিয়ে দিতে! কিন্তু কিছু করতে না পেরে শুধু হাত মুষ্টিবদ্ধ করে চোয়াল শক্ত করে বসে থাকলো সে।
কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে হঠাৎই আনায়া গাইলো,,

🎶 এ প্রনয়ে অন্ধ হলাম….
প্রাণের আলো তুমি…
দুঃখ এলে ভুলে যেওনা….
বাঁচবো না তো আমি….🎶
তার গানের শেষ চরণটুকু শেষ হতে না হতেই মোবাইলের ওইপাশ থেকে রিদিত গেয়ে উঠলো,,
🎶 এ প্রনয়ে কথা দিলাম….
সূর্য চন্দ্র তারা….
সাক্ষী থেকেও মরণ যেন….
হয়না তোমায় ছাড়া….🎶
হঠাৎই রিদিতের কন্ঠে সবাই অবাক নয়নে তাকালো শুধু স্বাভাবিক থাকলো শিশির সে সবার উদ্দেশ্যে মুচকি হেসে বলল,,

—”কি কেমন দিলাম? এতক্ষণ রিদিত ভাই লাইনে ছিল, প্রত্যেকটা কথাই শুনেছে ভাই। যখনই শুনলাম আয়ু গান গাইবে আমি তৎক্ষণাৎ ভাইয়ের কাছে কল দিলাম।”
তারপর সে রিদিতের উদ্দেশ্যে বলল,,
—”ভাই জানো সবাই অবাক হয়ে গেছে তোমার গান শুনে তো তুমি কিছু বলো সবার উদ্দেশ্যে।”
রিদিত মোবাইলের ওইপাশ থেকে সবার উদ্দেশ্যে বলল,,
—”সবাই তো আমাকে রেখে বেশ ভালোই মজা করছ দেখছি! তাও আমার ছোট বোনটা আমার কথা মনে রেখেছিল! আর আয়নিন তুমি যে এত ভালো গান গাও জানতাম না তো? বিয়ের পরে কিন্তু প্রতিদিন আমাকে এভাবে গান শোনাতে হবে!”
সবার মাঝখানে রিদিতের এমন কথায় লজ্জায় মাথা নোয়ালো আনায়া। তাকে দেখে শিশির বলল,,

—”আচ্ছা ভাই রাখি তাহলে তোমার বউয়ের তো লজ্জায় মরি মরি অবস্থা!”
রিদিত মুচকি হেসে বলল,,
—”আচ্ছা বনু রাখো!”
রিদিত ফোন রেখে দিতেই জিসান সবার উদ্দেশ্যে বললো,,
—”তাহলে আবার শুরু হোক!”
ইনায়া বলল,,
—”একটু দ্রুত করো ভাই! ইরাতের ঘুম থেকে উঠে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে, আমি যদি উঠে যায় তাহলে আমার আর পাঁচ মিনিটও বসা হবে না!”
ইরাত ইনায়া আর জাহিদের মেয়ে, বয়স মাত্র ১৮ মাস। তার কথায় জিসান ফের সিলভার রিংটি ঘুরালো। আর আর ঘটনাক্রমে রিংটি গিয়ে পড়ল ইনায়ার দিকে। তা দেখে ফারিন মুচকি হেসে বলল,,
—”তাহলে আপু তোমাকে অক্ষরটা আমি দেই!”
ইনায়া অপ্রস্তুত হেসে বলল,,
—”অক্ষর তো দিবা কিন্তু আমি তো গান পারিনা! আচ্ছা দাও! না পড়লে জাহিদ তো আছে। কি বলো জাহিদ?”
জাহিদ:”সেটাইতো কাজের সময় তো আমাকে লাগবেই!”
ইনায়া:”কি বললে?”

জাহিদ:”কই কিছু নাতো! আমি তো বলেছিলাম আমার বউয়ের প্রয়োজনে সর্বদাই আমি আছি!”
তাদের এমন খুনসুটিতে সবাই মুচকি হাসলো, তবে কিছুটা মন খারাপ হলো ফারিনের, সাধারণত বিবাহিত দম্পতিরা এভাবেই খুনসুটি করে কিন্তু তার কপাল! একটু আগে রিদিত ভাইও আনায়া আপুর সাথে কত খুনসুটি করলো আর এখন ইনায়া আপু আর জাহিদ ভাই! অন্যদিকে নির্ঝরের সাথে সে কথা বলতে গেলেই যেন মনে হয় ম্যাথ ক্লাস করতে গেছে।সবসময়ের জন্য সূত্র আর পড়াশোনার বাইরে কখনো ফারিন এর সাথে একটা কথাও বলে না নির্ঝর। ফারিন কিছুটা মন খারাপ করলো। অতঃপর ইনায়ার উদ্দেশ্যে বলল,,

—”তাহলে তুমি ‘ক’ দিয়ে একটা গান গাও!”
ইনায়া ভেবেচিন্তে মুহূর্ত খানেক পর গেয়ে উঠলো,,
🎶 কথা দিলে রোদ্দুর….
কথা দিল বৃষ্টি…
কথা দিল রাস্তা…
তোমারই জন্য…
খেলাধুলার সংসার…..
আসা-যাওয়া বারবার……
রাজি হলো ইচ্ছে তোমারই জন্য…..
সঙ্গে সঙ্গে জাহিদের কন্ঠ,,
🎶 হতে পারি গল্প….
তুমি কাছে টানলে….
ইনায়া মুচকি হেসে গেয়ে উঠলো,,
🎶হতে পারি জানলা……
এ হাওয়া ও তোমারই জন্য….
তারপর দুজনে একসাথে,,
🎶শুধু তুমি চাও যদি সাজাবো আবার নদী….
শুধু তুমি চাও যদি সাজাবো আবার নদী….
এসেছি হাজার বারনে….
শুধু তোমারই জন্য……

এত সুন্দর একটা গানে সবারই সবার প্রিয় মানুষটার কথা মনে পড়ল, শিশিরের সামনে বারবার ভেসে উঠলা নাহিয়ানের মুখ, বারবার মনে পড়তে লাগলো এখানে যদি নাহিয়ান থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই এমন কোনো একটা গান গাইতো যার ফলে সবার সামনে শিশির লজ্জায় পড়ে যেত! আনমনে মুচকি হাসলো সে! আর এদিকে ফারিন একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে নির্ঝরের দিকে, যদি নির্ঝরও তার সাথে এরকম একটা গান গাইতো!তবে সেই সবই শুধু কল্পনায় সম্ভব বাস্তবে নয়।
এদিকে নিঝুমের এক ঝলক সৌজন্যের দিকে তাকালো কিন্তু সৌজন্যে দৃষ্টি তখন ইনায়া আর জাহিদের উপর নিবন্ধ, তবে কেন যেন নিঝুমের মনে হলো এতক্ষন সৌজন্য তার দিকেই তাকিয়ে ছিল!
এত কিছুর মধ্যে হঠাৎ জিসান বলে উঠলো,,
—”বাআবা সবাই দেখি রোমান্টিক সিনেমার জগতে চলে গেছে! যাই হোক ভাই আমার মত সিঙ্গেল মানুষদের জন্য একটু সিট রাইখেন সবাই!”
সবাই মৃদু হাসলো। জিসান আবারো রিং ঘোরালো। রিং এবার গিয়ে পড়লো ফারিন এর দিকে। জিসান বাঁকা হেসে বলল,,

—”তাহলে এনার অক্ষরটা আমিই দেই। কি বলো সবাই?”
নির্ঝর ভ্রু কুঁচকে তাকালো জিসানের দিকে। ফারিন কিছুটা ভাব নিয়ে বলল,,
—”এই যে মিস্টার আপনাকে আমি ভয় পাই না। যে কোনো অক্ষরই দিতে পারেন!”
জিসান:”ও বাবা তাই নাকি? তাহলে তো আপনাকে একটা হার্ডি অক্ষর দিতে হচ্ছে!”
ফারিন:”ব্যাপার না শুধু দিয়েই দেখুন!”
জিসান কিছুটা ভেবেচিন্তে বলল,,
—”তাহলে আপনার অক্ষরটি হচ্ছে ‘দ’…..”
জিসান আর কিছু বলার আগেই ফারিন নির্ঝরের দিকে এক ঝলক চেয়ে গেয়ে উঠলো,,
🎶 দেখতে বর বর…
কিন্তু আস্ত বর্বর…
একটা জুটে গেছে কপালে…
দেখতে হ্যান্ডসাম…
কিন্তু ফেলুরাম…..
ফেসে গেছি আমি অকালে…..
তার গান শুনে সবাই মুখ চেপে হাসলো,আর শিশির তো নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে শব্দ করেই হেসে দিলো! এদিকে জিসান অবাক লোচনে তাকিয়ে আছে ফারিনের দিকে, মেয়েটার গানের গলাও পারফেক্ট! এতো মনে হচ্ছে জিসানের স্বপ্নের রাজকন্যা! অন্যদিকে নির্ঝর কটমট দৃষ্টিতে চেয়ে আছে, তা দেখে ফারিন নির্ঝরের দিকে চেয়ে বাম ভ্রুটা সামান্য নাচালো।

শ্রাবণের শেষ প্রহরে, আকাশ যেন এক অশ্রুভেজা ধূপছায়া,রুপালি মেঘ ছুঁয়ে নেমে এসেছে বৃষ্টির শীতলতা।কোলাহলহীন বাড়ির অন্দরমহল, বেশ অনেক রাত পর্যন্ত এই ছাদে আড্ডা চলমান ছিল, অতঃপর সবাই যে যার মত নিজের কক্ষে ঘুমিয়ে পড়েছে। বিয়ে বাড়ি হওয়ায় এখানে কারো জন্য নির্দিষ্ট করে বরাদ্দকৃত কোন রুম নেই, যে যেই রুমেই জায়গা পেয়েছে সেখানেই ঘুমের দেশে বাড়ি জমিয়েছে।এটা বিয়ে বাড়ির একটা স্বাভাবিক দৃশ্য।
তবে কিছুটা বিভ্রান্তিতে পড়েছে বিবাহিত দম্পতিরা, ইনায়া আর জাহিদ তাদের ছোট্ট ইরাতকে নিয়ে করিডোরে পাশের ছোট্ট রুমটাতে ঘুমিয়েছে, আর তাদের রুমটা ছেড়ে দিয়েছে আত্মীয়-স্বজনদের জন্য, আনায়ার রুমে শিশির,আনায়া, নিঝুম আর আনায়ার অন্যান্য বোনেরা,ইলমা প্রেগন্যান্ট থাকায় সাজিদ আর ইলমাকে একটা বেশ খোলামেলা রুম দেওয়া হয়েছে।

এদিকে নির্ঝর আর ফারিন পড়েছে আরেক যন্ত্রণায়, তাদেরকে বেশ ছোটখাটো একটা রুম দেওয়া হয়েছে বাড়ির প্রবীনদের ভাষ্যমতে তাদের যেহেতু নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে তাই ছোট বিছানায় ঘুমাতে তাদের কোনো অসুবিধা নেই! কিন্তু তাদের সম্পর্ক তো আর অন্য পাঁচটা দম্পতিদের মতো নয়। যাইহোক বেশ কষ্ট করেই গুছিয়ে বিছানাতে শুয়েছে দুইজন।

এদিকে ফারিন আবার শান্ত হয়ে ঘুমাতে পারেনা পুরো বিছানা জুড়ে একপ্রকার ফুটবল খেলে সে ঘুমের মধ্যে। এক প্রান্ত অন্য থেকে প্রান্ত সারা প্রান্তে গড়িয়ে গড়িয়ে ঘুমানোর অভ্যাস তার। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না, ঘুমের মধ্যেই তার হাত বার বার চলে যাচ্ছে নির্ঝরের উপর, এদিকে ফারিনের এহেন কান্ডে বেশ বিপত্তিতে পড়েছে নির্ঝর।
হঠাৎই‌ নির্ঝরের শার্টটা আলতো হাতে খামছে ধরল ফারিন। নির্ঝর তার পাশ ফিরে দেখল ফারিন প্রায় তার পিঠের কাছাকাছি চলে এসেছে,কিছুটা গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে সে। মুহূর্ত খানেক আগে বৃষ্টি হয়েছে প্রচুর। সেই প্রভাবেই হয়তো ঠান্ডা লাগছে তার, নির্ঝর হাত বুলিয়ে কিছুদূরে একটা কাঁথার উপস্থিতি আবিষ্কার করল। সে ফারিনের দিকে ফিরে সামান্য উঁচু হয়ে ‌মাত্র কাঁথাটার কিনারা টেনে নিতে যাবে,কিন্তু ঠিক তখনই, ঘুমঘোরে আনমনা এক তন্দ্রাচ্ছন্নতা থেকে ফারিন নিজের শরীরটা আপন গতিতে এগিয়ে এনে রাখল নির্ঝরের বক্ষপ্রাচীরের ঠিক উপর।নির্ঝরের শার্টের উপরের বোতাম দু-একটা খুলে গিয়েছিল হয়তো ঘুমেরঘোরে অসাবধানেই,আর সেই উন্মুক্ততার ফাঁক গলে ফারিনের কপাল, ঠোঁট আর নরম নিশ্বাস গিয়ে ছুঁয়ে দিল নির্ঝরের বুকের ঠিক বাম প্রান্তে।

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৪৬

হঠাৎ দূর ল্যাম্পপোস্টের একটুখানি নিয়ন আলোর রেখা জানালার ফাঁক দিয়ে এসে পড়ল ওদের গায়ে, সাথে বইলো সামান্য দখিনা হাওয়া আর সেই উষ্ণ হওয়ার নরম স্পর্শে ফারিন যেন আরও কুঁকড়ে গিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিল নির্ঝরের বুকের ভেতর,একটা অনুচ্চারিত নিরাপত্তার মাঝে। হঠাৎই ফারিন নিজের শীতল অধরজোঁড়া আলতোভাবে ছোঁয়ালো নির্ঝরের উষ্ণ প্রশস্ত বক্ষদেশ।

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৪৭ (২)