মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫০
নওরিন কবির তিশা
ঘড়ির কাটায় প্রায় রাত বারোটা ছুঁই ছুঁই।নিজর দুতলা বিল্ডিং এর ছাদে বসে একের পর এক সিগারেট টানছে রাকিব। ধোঁয়া গুলো কুন্ডলী পাকিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে আকাশে।ফের নাক মুখ দিয়ে একসাথে ধোঁয়া ছাড়ছে রাকিব। নিচে জমা হয়েছে প্রায় ছয়টা বেনসনের প্যাকেট। মাথা ভর্তি দুশ্চিন্তা দূর করার এর থেকে ভালো উপায় আর জানা নেই রাকিবের।
অন্য সময় হলে হয়তো দু চারটা খু*নও করে বসতো সে। কিন্তু এখন কেন জানি খু*ন করতে গেলেই হাত কাঁপে তার। তার কারণ একটাই-সাবিহা। রাকিব নিজের হাটুর বয়সী মেয়েটাকে কি ভীষণ বাজেভাবে ভালোবেসে ফেলেছে। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে সব কিছু ছেড়ে সাবিহাকে নিয়ে এমন কোথাও চলে যেতে;যেখানে থাকবে না কোনো পাপ,কোনো হাহাকার।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কিন্তু সে উপায় আর কই। সে নিজেকে পাপের সাম্রাজ্যে এমন অতপ্রুতভাবে জড়িয়ে ফেলেছে।যে সেখান থেকে বের হওয়ার মৃ*ত্যু ভিন্ন আর কোনো উপায় নেই।আর এখন জুটেছে আরেক চিন্তা। দেশের পরিস্থিতি একদমই ভালো নয়। তারউপর সিআইডির লোকেরা যেন পাগলা কুকুরের মতো পড়ে আছে তাদের পিছনে। বিভিন্ন জায়গায় ছদ্দবেশধারী সিআইডির এজেন্টরা ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এ কারণেই দেশ ছাড়বে তাদের টিম লিডার ইকরামুল হোসেন। ইকরামুল হোসেন-পুরো বাংলাদেশের যতো কিডনাপিং সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম সবের মাথা। যদিও তার পরিচয় নিয়ে রয়েছে বহু ধোঁয়াশা। তবে দীর্ঘ ১৫ বছর এ পাপের সাথে জড়িত থাকার ফলে এই নামটাই একাধিকবার শুনেছে রাকিব। যদিও এই পরিচয় কতটা সত্য তা নিয়ে রয়েছে বহুৎ জল্পনা কল্পনা। তবুও রাকিবের জানা পরিচয় অনুসারে এই পাপের সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ইকরামুল হোসেন।
মানুষটাকে কখনো রাকিব নিজের চোখের সামনে দেখেনি শুধু কণ্ঠস্বর শুনেছে তাও মানুষটার প্রত্যেকটা কার্যক্রমের বর্ণনা যেনো কোনো হিংস্র জানোয়ারকেও হার মানায়, এই যেমন ১৯ বছর আগে ঘটা সেই ঘটনাটি!! না না সেই ঘটনার কথা বর্ণনা করতে গেলেও মানুষের শরীর হিমশীতল হয়ে আসে।
যে লোকটা এত বড় সিআইডি অফিসার কে সপরিবারে অমন নৃশংসভাবে হত্যা করতে পারে। সেই কি না, কিছু সিআইডির এজেন্টের ভয়ে দেশ ছাড়বে? ব্যাপারটা একদমই সুবিধার মনে হচ্ছে না রাকিবের। নিশ্চয়ই এর পেছনে আছে এমন কোন দাবার চাল যা হয়তো তার মতো কাঁচা খেলোয়াড়ের দৃষ্টিগত হচ্ছে না।
নিজের ভেতরের চিন্তা গুলোকে সিগারেটের ধোঁয়ায় উড়িয়ে দিতে ব্যস্ত রাকিব।সাত নাম্বার প্যাকেটের শেষ সিগারেটে আগুন ধরিয়ে প্রথম টান দিল সে। তৎক্ষণাৎ পিছনে কারো উপস্থিতি টের পেতেই ঘুরে দাঁড়ালো রাকিব। পিছনেই নাকে ওড়নার আঁচল দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সাবিহা। সিগারেটের ধোঁয়া একদমই সহ্য করতে পারে না সে।তাকে দেখে রাকিব দ্রুত সিগারেটটা নিচে ফেলে পা দিয়ে পিষে দিলো। অতঃপর সাবিহার দিকে ফিরে বলল,,
——“কিছু বলবে?”
সিগারেটের ধোঁয়া একদম মিলিয়ে যেতেই সাবিহা শেষ সিঁড়িটা পেরিয়ে ছাদে এসে রাকিবের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বলল,,
——“হুম”
রাকিব এক ঝলক তার দিকে তাকালো। সাবিহার পরনে মেরুন কালার থ্রি-পিস। ফর্সা শরীরে মেরুন কালার টা বেশ ভালোই মানিয়েছে তার। মাথায় শাড়ির আঁচলের মত করে দেওয়া ওড়নাটা বেপরোয়া বাতাসে বারবার উড়ে যেতে চাচ্ছে।
রাকিব:“কি বলবে?”
সাবিহা ওড়নার আচলটা মাথায় ঠিক করে দিতে দিতে বলল,,
——“রাত তো বেশ হয়েছে। ঘুমাবেন না?”
রাকিব আকাশের পানে চেয়ে বলল,,
——“আজ রাতে আমার ঘুম হবে না! তুমি যাও ঘুমিয়ে পড়ো!”
সাবিহা আর কোনো কথা না বলে ওড়নার আঁচল হাতের আঙ্গুলে জড়াতে লাগলো। তা দেখে রাকিব বলল,,
——“আর কিছু বলবে?”
সাবিহা ভীত কন্ঠে বলল,,
——“জ্বী!”
রাকিব:“বলো।”
সাবিহা:“আসলে আমার আপনাকে একটা জিনিস দেওয়ার ছিল!”
রাকিব:“কি জিনিস?”
সাবিহা ওড়নার আঁচলের নিচ থেকে কি যেন একটা বের করল।রাকিব একবার আড় চোখে সেদিকে তাকালো। সাবিহা কাঁপা কাঁপা হাতে জিনিসটা রাকিবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,,
——“এই নিন!”
রাকিব চোখ সরু করে বলল,,
——“কি আছে এতে?”
সাবিহা কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,,
——“ঘড়ি!”
রাকিব:“হঠাৎ ঘড়ি কেন?”
সাবিহা:“সেদিন তো আমার কারনেই আপনার অত দামি ঘড়িটা নষ্ট হয়ে গেল তাই!”
রাকিব:“তোমাকে তো বলেছিলাম থাক ব্যাপার না। তারপরও এসব কেন?”
সাবিহা:“এমনি।আমার ইচ্ছা করলো তাই। রেখে দিন না। অন্তত আমার উপহার হিসেবে কোনো একদিন পড়লেন। যদিও জিনিসটা আপনার অন্যান্য জিনিসের তুলনায় নিহাতই তুচ্ছ। অত দামি নয়।”
রাকিব ফিসফিসিয়ে,,
——“এই জিনিসটাই আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস।”
সাবিহা রাকিবের কথা ভালো করে শুনতে না পাওয়ায় ফের শুধালো,,
——“কিছু বললেন?”
রাকিব:“এটা কিনলা কবে?”
সাবিহা:“আমি তো এখানকার কিছুই চিনি না। আজকে সকালে নাফি ভাই এসেছিল ওনার কাছে টাকা দিয়েছিলাম উনিই সন্ধ্যার দিকে এনে দিয়েছে।”
রাকিব আস্তে করে বলল,,
——“ওহ”
অতঃপর সাবিহার দিকে ফিরে বলল,,
——“উপহার যেহেতু তোমার দেওয়া তাহলে তুমিই পরিয়ে দাও!”
সাবিহা তার দিকে ফিরে অবাক কণ্ঠে বললো,,
——“জ্বী আমি?”
রাকিব চোখের ইশারায় তাকে বোঝালো,,
——“হ্যাঁ তুমি।”
সাবিহা কাঁপা কাঁপা হাতে প্যাকেট থেকে ঘড়িটা বের করে রাকিবের বাঁ হাত সযত্নে পরিয়ে দিল। রাকিব তার হাতে তাকিয়ে দেখলো শ্যাম বর্ণের হাতটিতে সিলভার কালার ঘড়িটি যেন চিকচিক করছে। সেদিকে তাকিয়ে সে মুচকি হেসে বলল,,
——“Perfect.”
এক মাস পর…..
দেখতে দেখতে কেটে গেছে আরও একটি মাস। আনায়ারা হানিমুনে রোমে গেছে আজ প্রায় এক সপ্তাহ। যত দিন যাচ্ছে নাহিয়ানের আসার সময় তত এগিয়ে আসছে। তবুও দিনগুলো সহজে কাটছে না শিশিরের। বিশেষত এই এক মাস তো একদমই সহজ ছিল না তার জন্য। যেখানে প্রতিদিন তিন থেকে চারবার নাহিয়ানের সাথে কথা হতো সেখানে এই এক মাসে হয়তো সপ্তাহে তিন থেকে চারবার কথা হয়েছে নাহিয়ানের সাথে। তাও পাঁচ থেকে দশ মিনিটের বেশি নয়।
আর কাল রাত থেকে তো ফোনেই পাওয়া যাচ্ছে না তাকে। যদিও এটা শিশিরের জানা ছিল যে কিছুদিন নাহিয়ানের ফোন সুইচ অফ থাকবে। একটা মিশনেরই কারণে,তবুও শিশিরের মনটা ছেয়ে আছে বিষন্নতায়, তবে এর মাঝেও একটা সুখবর এসেছে কাল রাতেই। কাল রাত প্রায় দুটোর দিকে ইলমা সাজিদের কোল আলো করে এসেছে তাদের রাজপুত্র ইফরান সাজ্জাদ।সাজ্জাদ নামটা শিশিরের দেওয়া।আর ইফরান নামটা দিয়েছে সাজিদ।
শিশিরদের বাড়ি আছে পুরোটা ফাঁকা। নওরিফা খানম আর রোদেলা জামান কাল রাত থেকেই হাসপাতালে,শিশিরও গিয়েছিল তবে সিকদার শাহর প্রেসার ফল করায় রাতেই ফিরে এসেছিল সে। সকাল বেলা সিকদার শাহ যখন অফিসে চলে গিয়েছে তখন থেকেই শিশির রেডি হচ্ছে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য।
হিজাব বাধা শেষে যখন সে সবে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল তখন তার মনে পড়ল রোদেলা জামান কাল রাতে পই পই করে বলে দিয়েছে যেন সাজিদের ছেলের জন্য তৈরি করা স্বর্ণের চেইনটা শিশির মনে করে নিয়ে যায়।
চেইনটা ইলমা প্রেগনেন্সির খবর শোনার পরই গড়িয়ে রেখেছিলেন তিনি। কিন্তু কাল রাতে হুট করে ইলমার পেইন উঠায় তাড়াহুড়োতে সেটা নিতে ভুলে গিয়েছিলেন। শিশির সবে প্রথম সিঁড়িটাতে পা দিয়েছিল। চেইনের কথাটা মনে পড়তেই সে দ্রুত পদচারনা থামিয়ে।রোদেলা জামানের রুমের দিকে এগিয়ে গেল
কিছুক্ষণ পর…..
শিশির কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলো না চেইনের বক্সটা। শেষমেষ আলমারির শেষ কার্বাডটা টান দিতেই লক্ষ্যগত হল কাঙ্খিত বক্স টি। শিশির যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। মুচকি হেসে ডিজাইন করা বক্সটি হাতে তুলে নিল। ঠিক তখনই তার পায়ের কাছে অনুভূত হল কিছু একটা।
শিশির ভ্রু কুঁচকে নিচে তাকিয়ে দেখলো পড়ে আছে একটা ডায়েরি।বেশ পুরাতন। সে সামান্য নিচু হয়ে ডায়েরিটা হাতে তুলে দেখল ডায়েরির উপরের কভারটা নেভি ব্লু কালার একেবারে নীল অপরাজিতা রঙা। আর তার উপরে স্বর্নালী অক্ষরে লেখা ‘আমার অপরাজিতার জন্য’।
শিশির বেশ উৎসুক হয়ে ডায়েরিটা খুললো। যদিও সে খুব ভালো করেই জানে এটা ঠিক নয়। কারও ডায়েরিতে তার ব্যক্তিগত বহু জিনিস লিপিবদ্ধ। তবুও কেন জানি শিশির নিজেকে সামলাতে পারল না।ডায়েরিটা খুলতেই তার প্রথম পাতাতে একটা রঙিন চিরকুট আবিষ্কার করল শিশির যাতে গোটা অক্ষরে লেখা,,
“ওহে অপরাজিতা, তুমি কি হবে আমার প্রনয়ের পরিণিতা?”
আনমনে মুচকি হাসলো শিশির।সে যতদূর বুঝলো এটা কোনো পুরুষ তার শখের নারীকে উপহার স্বরূপ দিয়েছিলো। কিন্তু কার? অপরাজিতা নামের কাউকে তো শিশির চেনে না। শিশির পরবর্তী পাতা উল্টালো।পরবর্তী পাতাটা সম্পূর্ণ ফাঁকা।
কিন্তু তার পরের পাতায় লেখা,,
“অবশ্যই! তবে আমি শুধু আপনার প্রনয়ের না গোটা জন্মের পরিণীতা হতে চাই, যার সাথে ওই হাশরের মাঠেও হবে আপনার ঠাই!”
এটা সম্ভবত অপরাজিতার কথা। শিশিরের ব্যাপারটা বেশ লাগলো।এভাবে চিঠির মাধ্যমে হৃদয়ের অনুভূতি ব্যক্ত করার পদ্ধতি শিশিরের জানা ছিল না। তবে সে যতই পাতা উল্টাচ্ছে। ততই অপরাজিতার কথাগুলো বাড়ছে, দশম পাতা টার শেষে শিশির জানতে পারলো এই ডায়েরীটা নরশদ নামে কারো একজনের, যে তার সহধর্মিনী অর্থাৎ অপরাজিতা কে এটা উপহার স্বরূপ দিয়েছিলো।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে ডায়েরির পাতাগুলো পড়ার পর সে বুঝলো অপরাজিতা আর নরশদের নওয়ার নামক একটা মেয়েও ছিলো,যাকে নিয়ে তারা ভীষণ খুশি ছিলো। কিন্তু তারা এখন কোথায়? শিশির যখন এ সকল চিন্তায় নিমগ্ন ঠিক তখনই হঠাৎ তার লক্ষ্যগত হলো একটা ছেঁড়া চিঠি,লক্ষ্যগত বললে ভুল হবে বাতাসের ঝাপটায় ডায়েরি থেকে এক প্রকার বের হয়ে এসেছে সেটি। তবে সেটা দেখার সাথে সাথে পিলে চমকে উঠল শিশিরের!র*ক্ত! হ্যাঁ র*ক্ত*ই তো! চিঠিটার চারিধারে ফোঁটা ফোঁটা র*ক্ত!
শিশিরের ব্লাড ফোবিয়া আছে, তার মাথাটা সামান্য ঘুরে উঠল। তবুও তার দৃষ্টি আটকে গেল চিঠির উপরে লেখা তার মায়ের নাম অর্থাৎ রোদেলা জামানের নাম দেখে। চিঠিটা তে লেখা,,
রোদ আমি কিছু লেখার মতো পরিস্থিতিতে নেই। শুধু তোকে এতোটুকুই বলবো আমার নওয়ারকে আমার ফুলকে দেখে রাখিস। আর হ্যাঁ অবশ্যই ওর পরিচয়টা বদলে দিস।তবে ওর বাবার দেওয়া ডাক নামটা বদলাস না যেন। ওকে তোরা নিজেদের পরিচয় মানুষ করিস শুধু যখন একান্তে থাকবি তখনই নুয়া বলে ডাকিস।
লেখাটা এত বেশি খাপ ছাড়া যে,যেকেউ দেখলেই বুঝতে পারবে যিনি এটা লিখেছেন তিনি হয়তো অনেক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন।অনেক দ্রুততার সহিত চিঠিটা লিখেছেন তিনি। তবে শিশিরের মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো যখন সে দেখল শেষে লেখা নুয়া বলে ডাকিস।
‘নুয়া’এটা তো তার নাম। তার ডাক নাম। তবে কি শিশিরই নুয়া? তাহলে অপরাজিতা-নরশদ কে? আর অপরাজিতা নরশদ যদি নুয়া অর্থাৎ শিশিরের বাবা মা হয়। তাহলে এতদিন ধরে যাদের শিশির বাবা-মা বলে জানলো রোদেলা জামান-সিকদার শাহ তারা কারা? মাথা ঘুরে উঠলো শিশিরের। কোনো কিছু ঢুকলো না তার মাথায়। হাত থেকে ডায়েরিটা ফেলে সে ছুটে গেল রোদেলা জামানের বেড সাইট টেবিলটার দিকে।
প্রত্যেক রাতে রোদেলা জামানের ডায়েরি লেখার অভ্যাস আছে, লেখা শেষে টেবিলের ওপরেই ডাইরিটা রেখে দেন তিনি। শিশির কখনো সেটা খুলে দেখেনি তবে আজ সেটা খোলা অতীব ও জরুরী শিশিরের জন্য। তার মাথা কাজ করছিলো না দ্রুত দৌড়ে গিয়ে রোদেলা জামানের ডাইরিটা হাতে নিলো সে। অতঃপর ডায়েরির পাতাগুলো পাগলের মত উল্টাতেই শুরু করলো। কিছুদুর পাতাগুলো উল্টাতেই সে দেখতে পেল রোদেলা জামানের কাঁপা কাঁপা হাতে লেখা কথাগুলো,,
“পারলে আমায় মাফ করে দিস অপু! কিন্তু আমি তোকে দেওয়া কথা রাখতে পারিনি। আমি এখনো তোদের নুয়াকে তার আসল পরিচয় জানাতে ব্যর্থ। কিভাবে জানাবো বল? ওই তো আমার আর সিকদারের জীবনের একমাত্র উজ্জ্বল প্রদীপ। যদি কখনো সে আলোক ক্ষীণ হয়ে পড়ে?যদি কখনো সে আলো আমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়? তবে যে আমাদের দুজনের কেউই বাঁচাতে পারবো না! মাফ করে দিস আমাকে! আমি তোদের নুয়ার পরিচয় বদলে আমাদের শিশির ঠিকই দিয়েছি। তবে তাকে এখনো তার নিজের বাবা মার পরিচয় জানাতে সাহস হয়নি আমাদের।”
নিচে আরো অনেক কথা লেখা ছিল।কিন্তু সেগুলো পড়ার আগেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসলো তার। চারিধারে আঁধার ঘনিয়ে এলো।পায়ে সৃষ্টি হল মারাত্মক কম্পনের। ধীরে ধীরে সে কম্পন ছড়িয়ে পড়ল পুরো শরীর জুড়ে। সাধারণ অন্ধকারটা যেন নিকষ কালো আঁধারে পরিণত হলো। আর শিশির হার মানল সে আঁধারের মাঝে। চেতনাহীন হয়ে পড়ে রইলো শ্বেত পাথরের মেঝেটিতে।
এদিকে…..
ইরানের রাজধানী তেহরান শহরে…….
ঘড়ির কাঁটায় রাত প্রায় ২ বেজে ৩০ মিনিট। তেহরানের ব্যস্ত শহরে রাতের আঁধারে যেন আরেক রূপে জেগে উঠেছে আজ।শহরের এক নিকষ কালো প্রান্তে,জাফরান স্কোয়ারের পাশে বিলাসবহুল হোটেল ডেভিল’স টেবিল। যেন এই অন্ধকার শহরের বুকে আলোয় ঝলমল করছে। ভেতরে চলছে মধ্যপ্রাচ্যের এক রহস্যময়, উচ্চপ্রোফাইল পার্টি।যেখানে প্রবেশাধিকার কেবল আমন্ত্রিতদের।
আর এই পার্টিতেই আজ প্রবেশ করেবে এআর নাহিয়ান চৌধুরী ও তার সিআইডি অপারেশন টিম, তবে নিজে পরিচয় নয় ছদ্মবেশে।একটি আন্তর্জাতিক কিডন্যাপিং ইউনিটকে ধরার জন্য প্রায় এক মাস ধরে তেহরানে ছায়ার মতো অবস্থান করছে তারা। তাদের জানা তথ্য অনুসারে এই ইউনিটটার কাছে রয়েছে এমন একটা চিপ যাতে সংরক্ষিত রয়েছে পুরো ইন্টারন্যাশনাল কিডন্যাপিং ইস্যুর প্রতিটি দেশের মাথা দের বিভিন্ন গোপনীয় তথ্য।
আজ রাতই সেই শেষ দিন। সফল হলে, এই পার্টি থেকেই খুলে যাবে ইন্টারন্যাশনাল অপহরণ চক্রের আস্তানা। ব্যর্থ হলে, তেহরানের অন্ধকারে হারিয়ে যাবে সত্যের আলো।
হোটেলের সামনে নিজেদের ব্ল্যাক মার্সিডিস থামালো তারা। ভিতর থেকে ব্রিফকেস হাতে নেমে আসলো ছদ্দবেশী নাহিয়ান আর তার টীমের দুজন উচ্চ পর্যায়ের সদস্য। নাহিয়ান কানে হেডসেটটা ঠিকঠাক সেট আপ করে নিল।অতঃপর চারিদিকে একবার ভালোভাবে নজর বুলালো। সেখানে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইরান ইন্টেলিজেন্সের ইউনিটের সদস্যরা সাথে তার সিআইডি ইউনিটের লোকজন। যারা সবাই ওত পেতে আছে নাহিয়ানের থেকে সংকেত পাওয়ার অপেক্ষায়।
নাহিয়ান ধীরে ধীরে প্রবেশ করল ভেতরে,তার পরনে ব্ল্যাক কালার লেদার ব্লেজার,চোখে ধোঁয়া রঙের কনট্যাক্ট লেন্স, চুলগুলো জেল দিয়ে সেটআপ করা,ছদ্মবেশধারী নাহিয়ানের নাম এথানিয়েল কায়ান।
ভেতরে ঝলমলে চ্যান্ডেলিয়ারের আলোয় ছায়া ফেলে রেখেছে নিষিদ্ধতার গন্ধ।টেবিলজুড়ে ছড়িয়ে আছে দামি ম*দ, আফগানি হাশিশ, আর বিদেশি কাচের গ্লাসে ঢালা বীভৎস ঘোর।চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে দাসীতুল্য মেয়েরা আর অপার্থিব চোখের অন্ধকার।
শুরু হলো মানবতা বিরোধী নৃশংস সেই মহাসম্মেলন। সেখানে উপস্থিত মধ্যপ্রাচ্যের কুখ্যাত অপরাধজগতের নেতা,মাদকব্যবসায়ী, অস্ত্র ডিলার, এমনকি কিছু রাষ্ট্রদূতও। তবে তাদের রাষ্ট্রদূত না বলে রাষ্ট্রের ধ্বংসের বাহক বললেই বেশি ভালো হয়। সবার মাঝে চেয়ারে বসে আছে অপরাধ জগতের মধ্যমণি-ডেভিল কিং। এক বিশালদেহী মানুষ, যার মুখে ক্রূর হাসি লেগেই থাকে। তার কালো চোখের গভীরে যেন হাজারো নরকের আগুন জ্বলছে।
শুরু হলো বিভিন্ন দেশের বর্তমান কিডনাপিং ইস্যু নিয়ে কথাবার্তা। নাহিয়ান অর্থাৎ তাদের সামনে বসে থাকা এথানিয়েল কায়ান এই অপরাধ জগতে নেহাতি নতুন। সে এসেছে নতুন কিছু ডিল করতে। ডেভিল কিং তার দিকে তাকিয়ে ক্রুর হেসে বলল,,
——“It doesn’t matter if you’re new; what matters is whether you have money.”
প্রতিউত্তরে নাহিয়ান বাঁকা হেসে ব্রিফকেসটি তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,,
——“You’ll get here double what you want .But I just want…”
ডেভিল কিং ব্রিফকেস টা হাতে নিয়ে দ্রুততার সহিত সেটা খুলে টাকা গুলোর দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,,
——“তুমি যদি আমাকে ডাবল দিতে পারো তবে আমিও তোমাকে তোমার কল্পনাতীত কিছু দেব…”
জবাবে নাহিয়ান বাঁকা হাসলো কিন্তু তখনই ঘটলো এমন এক ঘটনা যা হয়তো ডেভিল কিং এর কল্পনাতীত ছিলো। হঠাৎ তার ফোনে নোটিফিকেশন আসলো একটা মেসেজের যার মানে এই যে,, এখানে ছদ্মবেশধারী কিছু সিআইডি অফিসার কে ট্রেস করা হয়েছে। আর যার সাথে ডেভিল কিং বর্তমানে কথা বলছে খুব সম্ভবত সে এ আর নাহিয়ান চৌধুরী নিজেই।
মেসেজটা দেখে চোখ কপালে উঠে গেল ডেভিল কিংয়ের। এক ঝাঁটকাই উঠে দাঁড়াই সে সহ উপস্থিত সবাই। প্রত্যেকের চোখে চোখে ভয়ে স্পষ্ট। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে ভীষণ। সিআইডির লুকিয়ে থাকা সহযোগীরা চারদিক থেকে প্রবেশ করছে ছাদ, পেছনের দরজা, প্রধান ফটক।
শুরু হলো গোলাগুলি।মুহূর্তের মধ্যে পার্টির জমকালো পরিবেশ পাল্টে গেল রণক্ষেত্রে। ডেভিল কিংয়ের গার্ডরা গুলি চালাতে শুরু করল। কাঁচের জিনিস ভেঙে পড়ার শব্দ, মানুষের চিৎকার, আর গুলির শব্দে বাতাস ভারী হয়ে উঠল।
নাহিয়ান ধোঁয়া আর ভিড়ের সুযোগ নিয়ে ডেভিল কিংয়ের দিকে এগোতে লাগল। ডেভিল কিং তখন পালানোর চেষ্টা করছে। সে দেখল ডেভিল কিং একটা গোপন দরজার দিকে দৌড়াচ্ছে। নাহিয়ান তার পিস্তল ডেভিল কিংয়ের দিকে তাক করে বলল,
——”শেষটা এত সহজে হবে না, ডেভিল কিং!”
কিন্তু ডেভিল কিং ছিল আরও দ্রুত। সে লুকানোর জন্য ঝাঁপ দিল। নাহিয়ানও তার পিছু নিল, কিন্তু হঠাৎ করেই এক পাশ থেকে এক গার্ড বেরিয়ে এসে নাহিয়ানের বুকে গুলি চালাল। তবে তখনও দমে নি নাহিয়ান।সে নিজের পিস্তল বের করে নির্ভুল নিশানায় তাকে গুলি করা গার্ড সহ আরো দু’জন গার্ডকে গুলি করল। কিন্তু তখনই হঠাৎ ছোড়া আরেকটা গুলি বেঁকে এসে বিদ্ধ করে নাহিয়ানের বুক।সে এক মুহূর্ত থেমে যায়। চোখ জুড়ে আঁধার নেমে আসে।
পিছলে পড়ে যায় রক্তমাখা শরীর। স্মৃতির মানসপটে,চোখের সামনে ভেসে ওঠে শিশিরের আলতা রঙা মুখশ্রী। ফিসফিসিয়ে বহু কষ্টে শুধু উচ্চারণ করে,,
মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৪৯
——“আমায় মাফ করো প্রাণনাশিনী, আমার প্রনয়িনী কিন্তু আমি তোমায় দেওয়া কথা রাখতে পারলাম না!”
আর কিছু উচ্চারণ করতে পারে না সে, গলা দিয়ে বের হয়ে আসে র*ক্তে*র স্রোত। আঁধার হয়ে আসে চারিধার। তবুও সে তার চারিপাশে শুধু শুনতে পায় শিশিরের হাসির রিন রিনে আওয়াজ।