মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫৫ (২)

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫৫ (২)
নওরিন কবির তিশা

এক আদুরে শীতের সকাল। সকালের সুস্নিগ্ধ মিষ্টি রৌদ্র কিরণ শীতল ধরণীকে উত্তপ্ত করতে ব্যস্ত। ঘড়ির কাঁটায় প্রায় সকাল আটটার কিছু বেশি। মিষ্টি রৌদ্র কিরণ লাবণ্যময়ী মুখশ্রীতে এসে লাগতেই, ঘুম ভেঙে যায় শিশিরের।
দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে আটটা বেজে পাঁচ মিনিট। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা থেকে উঠে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায় সে।

কিছুক্ষণ পর ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বেড সাইড টেবিল থেকে নিজের ফোনটা হাতে নিতে গিয়েই শিশির দেখতে পায় সেখানে একটা শপিং ব্যাগ। শিশির কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে ব্যাগ হাতে নিয়ে মোড়ক উন্মোচন করতেই তার সামনে দৃশ্যমান হয় একটি Luxury Saree Box যেটার গায়ে লেখা “Anita Dongre” এবং সেই সাথে ব্র্যান্ডের সোনালি বা রূপালি এমবসড লোগো।
সকাল সকাল এমন দামি উপহারে স্তম্ভিত হয় শিশির।Anita Dongre ব্র্যান্ডের শাড়ি! যার একটারই দাম প্রায় বাংলাদেশি টাকায় ৪ লক্ষ টাকা! এত দামি উপহার? শিশির প্রথমে কিছুটা স্তম্ভিত হলেও পরক্ষণেই সে বুঝে ফেলে কাজটা নাহিয়ান ব্যতীত অন্য কারো নয়। কিন্তু যেখানে শিশির শাড়ি পরেই না সেখানে এত দামি শাড়ি দেওয়ার কি মানে?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সে যখন আনমনে এসব ভাবছিল তখনই তার লক্ষ্যগত হয় তার পায়ের নিচে পড়ে যাওয়া একটা চিরকুটের দিকে। নীলছে রঙ্গা চিরকুটটা হাতে নিয়ে সেটা খুলতেই শিশির দেখতে পায় তাতে গোটা গোটা হরফে লেখা,,
‘My Dear Linnet this is only for you. আমার পক্ষ থেকে একটা ছোট্ট উপহার তোমার জন্য। প্লিজ আজকে এই শাড়িটা পড়ো,Iam waiting for you…..আর হ্যাঁ আজ কিন্তু আমি আমার স্বর্ণকেশীকে বিক্ষিপ্ত কেশধারিণী হিসাবে দেখতে চাই!’
শিশির চিঠিটা পড়ে আনমনেই মুচকি হাসে অতঃপর দ্রুত শাড়ির বক্সটা খুলে,সঙ্গে সঙ্গে তার সামনে উন্মোচিত হয় অবর্ণনীয় সুন্দর শাড়িখানা।
শাড়িটি এক অপূর্ব নীলাভ রেশমে তৈরি—রঙটি যেন সমুদ্রের গভীরতা ছুঁয়ে আসা রাতের আকাশ যার গায়ে জড়িয়ে আছে সূক্ষ্ম রূপালি জরি-কাজ, যা পূর্ণিমার চঁন্দ্রের স্বর্ণাভ আলোক রশ্মির ন্যায় চিকচিক করছে। শাড়ির পাড়জুড়ে রয়েছে সূক্ষ্ম নকশার আঁচড়,আঁচলের প্রান্তজুড়ে ছড়িয়ে আছে হালকা গ্লিটারিং পাথর বা সিকুইনের আলোকছটা,যেন একাধারে রাজকীয় আবার আধুনিক—একটি ক্লাসিক নকশাকে নতুন যুগের ছোঁয়ায় গাঁথা।
শাড়িটির সৌন্দর্যে বিমোহিত হয় শিশির। তবে সে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ হয় তার প্রতি নাহিয়ানের ভালোবাসার কথা চিন্তা করে।

ঘড়ির কাঁটায় প্রায় সকাল ৯ টা। শিশির শাড়িটা আজ নিজের হাতেই পড়েছে, যদিও সে চেয়েছিল রোদেলা জামানের কাছ থেকে পড়তে তবে আজ সকালেই রোদেলা জামান সাজ্জাদকে দেখতে সাজিদদের বাসায় গিয়েছে।
অগত্যা ইউটিউব থেকে টিউটোরিয়াল দেখে অপটু হাতে শাড়িটা নিজেই পড়েছে শিশির।নিজেকে আজ বেশ যত্ন করে সাজিয়েছে সে ব্লু কালার শাড়িটার সাথে ঠোঁটে গাঢ় গোলাপি রঞ্জক, ফর্সা ত্বকে হালকা ব্লাশার, ডাগর ডাগর মধুরঙা চোখের পাতায় চিকন আইলাইনার।কর্ণমূলে নাহিয়ান এর পাঠানো রুবির বাহুবলী কানের দুল,নাকে ডায়মন্ডের ছোট্ট তারকাকৃতি নোলক।
সেই সাথে নাহিয়ানের কথা অনুযায়ী নিজের স্বর্ণাভ কেশরাজি বাঁধন হারা করে রেখেছে শিশির,যেখানে শোভিত হচ্ছে নাহিয়ানের পাঠানো বেলি ফুলের গাজরাটা।
সাজুগুজু শেষে আর্শীতে নিজের সুশ্রী অবয়ব টার দিকে শেষবার দৃষ্টিপাত করল শিশির। আজ তাকে একটু বেশি সুন্দর লাগছে, তবে নিজের সৌন্দর্যের দিকে বিশেষ নজর না দিয়ে,দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে শেষবার সময় সম্পর্কে অবগত হলো সে। অতঃপর ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে নিজের বেসলেটা হাতে জড়িয়ে,দ্রুত নিচে নামল শিশির।

নিচে এসেই থমকে যায় শিশির ।তার মনে পড়ে আনোয়ার সাহেব তো রোদেলা জামানকে নিয়ে গিয়েছে, আর সিকদার শাহও অফিসে গিয়েছে, অবশ্য বাকি একটা গাড়ি তার জন্য আছে কিন্তু সে তো ড্রাইভিং পারেনা, সবচেয়ে বড় কথা ঠিকানাই তো জানে না সে।
শিশির অন্যমনস্ক হয়ে যখন এসব চিন্তা নিমগ্ন তখনই বাড়ির সামনে এসে হর্ন দেয় একটি গাড়ি। শিশির দ্রুত সামনে তাকিয়ে দেখতে পায় একটা ডার্ক ব্লু কালার গাড়ি অপেক্ষমান তার সামনে। শিশির কিছুটা অবাক হয়ে সামনে এগিয়ে আসতেই গাড়ির ভেতরে থাকা বেশ বয়স্ক একটা লোক বলে,,
——“মামনি,গাড়িতে ওঠো আমায় নাহিয়ান পাঠিয়েছে!”
নাহিয়ানের নাম শুনে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয় শিশির। অতঃপর শাড়িটা ভালো করে নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে, গাড়িতে উঠে বসে সে।

প্রায় অর্ধ ঘণ্টার মাঝেই গাড়ি এসে থামে নির্দিষ্ট গন্তব্যে। গাড়ির ভেতরে থাকা মাঝ বয়সী বৃদ্ধ লোকটি বলে,,
——“এসে গেছি মামনি! এখন তুমি নামতে পারো।”
শিশির বাইরে তাকিয়ে দেখে এখনো,বেশ কিছুটা পথ বাকি। সে অবাক কণ্ঠে লোকটির দিকে তাকিয়ে বলে,,
——“কিন্তু আঙ্কেল পথ তো এখনো বেশ বাকি।”
লোকটি কিছুটা হেসে তার দিকে ফিরে বলল,,
——“আমি জানি মামনি! কিন্তু নাহিয়ান তোমাকে এখানেই নামিয়ে দিতে বলেছে।”

কি আর করার? শিশির স্বভাবসুলভ মুচকি হেসে গাড়ি থেকে নেমে গন্তব্যস্থলে দিকে পা বাড়ায়। গাড়িটা যেখানে থেমেছিল সেখান থেকে গন্তব্যস্থলে দূরত্ব মাত্র কয়েক কদমের। তবে শাড়ি পড়ে বেহাল দশা শিশিরের,দুই মিনিটের পথ ১০ মিনিটে যেতে হচ্ছে তাকে। অবশেষে সে এগিয়ে গিয়ে প্রধান গেটে হাত রাখল, সঙ্গে সঙ্গে তার সামনে দৃশ্যমান হলো এক নিখুঁত ডুপ্লেক্স বাড়ি।
বাড়িটা যেন এক স্বপ্নপুরীর প্রতিচ্ছবি। শ্বেত পাথরের মতো সাদা রঙে সেজে উঠেছে তার শরীর। প্রতিটি ইঁটে, প্রতিটি কার্নিশে লেগে আছে ইউরোপীয় স্থাপত্যের নিখুঁত ছোঁয়া। বিশাল দুটি অংশের মাঝে সুউচ্চ প্রবেশদ্বার,বড় বড় কাঁচের জানালা।

বারান্দাগুলোর কারুকার্যময় রেলিং সাক্ষী দিচ্ছে এক অমর প্রেম কাব্যের।সামনে সাজানো-গোছানো সবুজ আঙিনা, যেখানে সকালের নরম রোদ্দুর আর উষ্ণ বাতাস মিলেমিশে একাকার হচ্ছে। শিশির মুগ্ধ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো সেদিকে, অতঃপর তার দৃষ্টি আটকালো বাড়ির নাম ফলকের দিকে যেখানে স্নিগ্ধ রৌদ্র রেখায় চিকচিক করছে,“আমাদের রাতরাঙা প্রেমনিবাস”
পাশেই ব্রাকেটে ছোট করে লেখা (#মাঝরাতের_রোদ্দুর)।
শিশির কতক্ষণ যে বিমোহিত দৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে থাকল তার হিসেব নেই। তার সবচেয়ে বেশি নজরকাড়লো #মাঝরাতের_রোদ্দুর কথাটি। কি অদ্ভুত সুন্দর নাম! যার সাথে বাস্তবের কোন মিল নেই;এক অলীক প্রেম কাব্যে আঁকা প্রণয় রেখা।
অতঃপর শিশির নিজের শাড়ি সামলে ভিতরে প্রবেশ করে। সে ভিতরে ঢুকতেই তার ওপর শুরু হয় গোলাপের নরম পাপড়ির কোমল বর্ষণ। দুই তলা থেকে একাধারে তার উপর পতিত হয় শত সহস্র গোলাপের রক্তিম পাপড়ি। শিশির অবাক হয়ে উপরে তাকায়,অতঃপর একটি পরিচিত কন্ঠ তার দৃষ্টি কেড়ে নেয় সামনের দিকে।
বাড়ির ভেতরে দুই তলায় ওঠার জন্য দুই দিকে চলে গেছে দুইরকম দুইটা সিঁড়ি,আর তার ঠিক মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে নাহিয়ান বলছে,,

——“আপনাকে স্বাগতম মহারানী, আমাকে প্রেম পাগল করা একমাত্র বিমোহিনী।”
শিশির কি বলবে বুঝতে পারে না। তার পায়ের কাছে বিছানো লাল গালিচার উপর অজস্র শ্বেত গোলাপ পাপড়ি। একে একে সেগুলোকে মাড়িয়ে শিশির এগিয়ে যায় নাহিয়ানের দিকে।নাহিয়ানের পরনে আজ শিশিরের সাথে ম্যাচ করে, ব্লু কালার Tom Ford Poplin Classic Fit Shirt।
ব্লু কালারের তাকে যেন অদ্ভুত রকম সুদর্শন লাগছে। শিশিরের তো একপ্রকার ঘোর লেগে যাচ্ছে তাকে দেখে। শিশির সিঁড়ির দিকে এক এক ধাপ করে যত এগোচ্ছে ততই তার ওপর গোলাপ পাপড়ির বর্ষণ তীব্র হচ্ছে। সে এগিয়ে এসে নাহিয়ানের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে হেসে বলল,,
——“এসব কি?”
নাহিয়ান:“আমার সুহাসিনীর জন্য ছোট্ট উপহার!”
শিশির চারিদিকে একবার নজর বুলিয়ে রাজকীয় বাড়িটির সৌন্দর্য অনুভব করল অতঃপর নাহিয়ানের দিকে বলল,,
——“এগুলো ছোট্ট উপহার?”

নাহিয়ান:“তা নয় তো কি?”
শিশির আশেপাশের সৌন্দর্যে ফের অন্যমনস্ক হতেই নাহিয়ান মুচকি হেসে বলল,,
——“এত মুগ্ধ হওয়ার কিছু নেই প্রলোয়িনী, আমার হৃদয় যে ঝড় বইছে, তার সৃষ্টিকারী আপনি। আর আপনার সৌন্দর্যের কাছে এগুলো নেহাতই ক্ষীন অতিমাত্রায় নগণ্য!”
শিশির “তাই বলে এত কিছু?”
নাহিয়ান:“কোথায় এত কিছু? এখনো তো আপনাকে কিছু দেখালামই না!”
শিশির অবাক হয়ে বলল,,
——“এখনো কিছু বাকি আছে?”
নাহিয়ান কিছুটা ঝুঁকে শিশিরের কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,,
——“এখনো আমার হৃদপিণ্ড টা চিরে আপনাকে দেখানো বাকি আছে যে;সেখানে কি তীব্র বেগে তাণ্ডব চালিয়েছেন আপনি! তবে আপাতত আমার দেওয়া ছোট্ট উপহারটাকেই দেখুন!”
নাহিয়ানের প্রথম কথায় শিশির কিছুটা রেগে গেলেও পরবর্তী কথায় প্রশ্নসূচক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার পানে চেয়ে সে বলল,,

——“আবার কি?”
নাহিয়ান:“চোখটা বন্ধ করুন!”
শিশির ভ্রুদ্বয় কিঞ্চিৎ কুঁচকে বলল,,
——“আবার চোখ বন্ধ কেন?”
নাহিয়ান:“কারণ আমি বলেছি,তাই!”
শিশির নাহিয়ানের সাথে আর তর্কে জড়ালো। আলগোছে নয়নদ্বয় আলতো করে বন্ধ করলো সে। সঙ্গে সঙ্গে নাহিয়ান কোলে তুলে নিলো তাকে। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করা আঁখিজোড়া দ্রুত খুলল শিশির। তা দেখে নাহিয়ান তাকে সতর্ক করে বললো,,
——“উসস, বললাম না চোখ বন্ধ!”
শিশির কিছু বলার আগেই নাহিয়ান ফের বলল,,
——“ইউ নো ভেরি ওয়েল দ্যাট তুমি যদি আর একটা কথা বলো তাহলে কিন্তু আমি নিজেই তোমার মুখ বন্ধ করে দেবো।কি ম্যাম দিবো নাকি?”
শিশির খুব ভালো করেই জানে নাহিয়ান কি বলতে চাইছে না।সে এটাও খুব ভালো করে জানে সে যদি এখন নাহিয়ানের কথা না শোনে,তবে নাহিয়ান মুখে বলা কথাটি কে সত্য করে ছাড়বে। তাই আর কোন কথা না ফের চোখ বন্ধ করলো সে। তা দেখে মুচকি হাসলো নাহিয়ান। তারপর তাকে কোলে করে নিয়েই একের পর এক সিঁড়ি পেরিয়ে এগিয়ে গেলো ছাদের দিকে!

ডুপ্লেক্স বাড়িটির বিশাল ছাদে এসে নাহিয়ান ধীরে ধীরে অতি সাবধানে তার প্রাণনাশিনীকে কোল থেকে নামালো। অতঃপর শিশিরকে উদ্দেশ্য করে বলল,,
——“Now you can open your eyes,Linnet.”
নাহিয়ান এর কাছ থেকে অনুমতি পেয়ে শিশির ধীরে ধীরে নিজের বদ্ধ আঁখি জোড়া মেলে সামনে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয়বার প্রচন্ডরকম চমকে উঠলো সে। তার সামনেই শুভ্ররঙা ‌বিভিন্ন নাম না জানা ফুলে সজ্জিত একটা হেলিকপ্টার। যার ভেতরে বসে আছেন দুইজন ক্যাপ্টেন।
শিশির নাহিয়ানের দিকে ফিরে বলল,,
——“আপনি কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?এসব কি?”
নাহিয়ান শান্ত কণ্ঠে বলে,,

——“আমার মাথা একদম ঠিকই ছিলো! তবে তোমার এই সাজ কি আর আমাকে শান্ত থাকতে দিচ্ছে?”
শিশির:“বাজে কথা বন্ধ করুন! এসব কিসের জন্য?”
নাহিয়ান:“জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ, সবটা ক্লিয়ার হয়ে যাবে। এখন বেশি কথা না বলে চলো আমার সাথে।”
শিশিরকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নাহিয়ান একপ্রকার জোড় করেই তাকে হেলিকপ্টারে তোলে। অতঃপর পুষ্প সজ্জিত ক্যাবিনে বসে ক্যাপ্টেনকে অনুমতি দেয় হেলিকপ্টারটি উড্ডয়ন করার জন্য। ক্যাপ্টেন নাহিয়ানের কাছ থেকে অনুমতি পাওয়ার পরপরই হেলিকপ্টারটি উড্ডয়ন করল নীল আকাশে।
হেলিকাপটার চলছে…… যদিও বেশি উঁচু দিয়ে নয় তবুও নিচের ঢাকা শহরের বিশাল বিল্ডিং গুলো আস্তে আস্তে ছোট ছোট খেলনা বাড়ির আকৃতি ধারণ করছে। নাহিয়ান শক্ত করে চেপে রেখেছে শিশিরের হাত।

অতিবাহিত হয়েছে প্রায় এক ঘন্টা তিরিশ মিনিট হেলিকপ্টারটি বর্তমানে উড়ছে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের উপর দিয়ে। হঠাৎই শিশিরের দৃশ্যমান হয় বঙ্গোপসাগরের স্বচ্ছ নীল পানি। সে যখন সামুদ্রিক নীলজলের সৌন্দর্য উপভোগে ব্যস্ত ঠিক তখনই নাহিয়ান বলে,,
——“আমরা আমাদের গন্তব্যের প্রায় কাছাকাছি,কিন্তু…. তোমাকে যে আবারো নিজের ওই মোহময়ী,মরণঘাতী চোখ দুইটা বন্ধ রাখতে হবে!”
শিশির:“আবার?”
নাহিয়ান মুচকি হেসে বলে,,
——“জ্বী আবার! বাট প্রমিস এটাই লাস্ট বার!”
শিশির: “মনে থাকে যেন,এটাই লাস্ট বার কিন্তু!”
নাহিয়ান পাশ থেকে একটা সুতীক্ষ্ণ ‌মোলায়েম কাপড় দিয়ে অত্যন্ত নিপুন হাতে যত্ন করে শিশিরের চোখ দুইটা বেঁধে দেয়।

প্রায় মিনিট দশেক পর শিশির নাহিয়ান এর সাহায্যে ধীরে ধীরে নামে হেলিকপ্টার থেকে, নাহিয়ান ধীরে ধীরে শিশিরকে নিয়ে এগিয়ে যায়, সামনের দিকে। শিশির চোখে কিছু দেখতে না পেলেও অনুভব করতে পারছে একটা ভরসার হাত কি শক্তভাবে ধরে আছে তাকে।
কিছুক্ষণ পর নাহিয়ান সযত্নে শিশিরের চোখ থেকে মোলায়েম কাপড়টির বাঁধন খুলে দিলো। যদিও খুবই আলতোভাবে চোখদুটো বাধা ছিল তবুও আশপাশটা স্বচ্ছ হতে শিশিরের প্রায় দু মিনিটের মতো সময় নিলো।শিশির এবার ভালোভাবে সামনের দিকে তাকালো।
সঙ্গে সঙ্গে এক বর্ণনাহীন অনুভূতি ঘিরে রইল তার চারিপাশ;আবদ্ধ করলো তাকে। তার সমস্ত প্রকাশভঙ্গি যেন থমকে গেল! আর সামনেই,,

সেন্টমার্টিনের নির্জন প্রান্ত যখানে নীল সমুদ্রকে পেছনে রেখে সজ্জিত হয়েছে এক স্বপ্নের আসর। শুকনো মাটির ওপর বিছানো গোলাপের রক্তিম পাপড়ির পথ,যা সোজা গিয়ে মিলেছে সাদা পর্দা আর ফুলে মোড়া বিশাল কুঞ্জে।দুপাশে স্বর্ণালি স্ট্যান্ডে রাখা গোলাপ,চন্দ্রমল্লিকাসহ বিভিন্ন ফুলের বৃত্তাকার গুচ্ছ,ঢেউয়ের মৃদু গর্জন আর হালকা নোনা বাতাসে মিশে আছে গোলাপের গন্ধ।
শিশির যখন অবাক লোচনের স্থানটি বিশ্লেষণ করতে ব্যস্ত তখনই নাহিয়ান তার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,,
——“এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে?”
শিশির নাহিয়ানের কথায় তার দিকে ফিরতেই,নাহিয়ান চোখের ইশারা দিয়ে তাকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য বলে।শিশির অবাক ভঙ্গিমায় দুই হাতে মুখ চেপে এগিয়ে যায় পুষ্প সজ্জিত কুঞ্জটির দিকে।যত সামনে এগোচ্ছে ততই বঙ্গোপসাগরের দিক থেকে ধেয়ে আসা ঝিরিঝিরি বাতাস তার পরনের নীলচেরঙা শাড়ির আঁচলকে নিজের দিকে টানছে।

ফিরফিরে উড়ছে তার স্বর্ণালী এমব্রয়ডারি কৃত আঁচলখানা।সেই সঙ্গে তার বাঁধনহারা বিক্ষিপ্ত স্বর্ণাভ কেশরাজী, নাহিয়ান মুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছে তার তিলোত্তমার দিকে।তার চোখে শিশির বরাবরের মতোই এখনো দেখা দিচ্ছে ভূবন মোহিনী সৌন্দর্যের অধিকারিণী রুপে।শিশির যখন কুঞ্জটির একেবারে মাঝ বরাবর দাঁড়ালো;ঠিক তখনই নাহিয়ান পিছন থেকে একে একে বলতে শুরু করলো,,
——“আমি তোমার চোখে নিজের স্বপ্নগুলো দেখতে চাই! প্রতিদিন সকালে তোমার মিহি কন্ঠের মিষ্টি আওয়াজে নিজের ঘুম ভাঙাতে চাই,তোমার ওই স্বর্ণাভ কেশরাজির মৃদু পরশে দিন শুরু করতে চাই,তোমায় নিয়ে গোটা শহর ঘুরতে চাই, নিজের হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা তোমায় উজাড় করে দিতে চাই,দিনশেষে তোমার মুখের ওই সুস্নিগ্ধ হাসি দেখে সারাদিনের ক্লান্তি গুলোকে বিদায় জানাতে চাই!”

কথাগুলো বলতে বলতে নাহিয়ান এগিয়ে আসলো শিশিরের দিকে। শিশির এক অন্যরকম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নাহিয়ানের দিকে। কে জানে;তাতে মিশে আছে হয়তো বিস্ময় হয়তোবা মুগ্ধতা! তবে নাহিয়ান আর এক মুহূর্ত দেরি না করে শিশিরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। অতঃপর নিজের হাত শিশিরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,,
——“আমি তো নিজের হৃদয়কে সারা জীবনের জন্য তোমার নামে লিখে দিয়েছি,এখন তুমি কি;সারা জীবনের জন্য তোমার হাতটা আঁকড়ে ধরার অনুমতিটুকু আমায় দিবে? Will you be my love line?My midnight sunshine?”

শিশিরের চোখ বেয়ে ইতিমধ্যেই গড়িয়ে পড়েছে আনন্দ অশ্রুরা। তার হৃদগহিনে বারবার একটাই শব্দ বাজছে,
“একটা মানুষ এতটা ভালবাসতে পারে?”
শিশির নিজের হাত নাহিয়ান এর হাতে রেখে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।নাহিয়ানের চোখ বেয়েও গড়িয়ে পড়ল অশ্রুকনা।শেষ পর্যন্ত তার প্রাণনাশিনী তাকে মন থেকে মেনে নিয়েছে,এটা ভাবতেও তার হৃদয়ে প্রেম পরশগুলো দোলা দিয়ে যাচ্ছে।

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫৫

অন্যদিকে নাহিয়ান এর হাতের উপর শিশিরের হাতটা রাখতেই উপরের হেলিকপ্টার থেকে তাদের উপর বর্ষিত হলো অজস্র পুষ্প গুচ্ছ।শিশির হেসে মুগ্ধ নয়নে সেদিকে তাকালো।হাসির সঙ্গে সঙ্গে নাহিয়ানের দুর্বলতা টা অর্থাৎ শিশিরের বাঁ চোয়ালের টোলখানা অদ্ভুত রকম সৌন্দর্য নিয়ে দৃশ্যমান হলো।নাহিয়ান বিমোহীত দৃষ্টিতে তাকালো শিশিরের পানে। তাদের উভয়কে ছুঁয়ে গেল বঙ্গোপসাগরের মৃদুমন্দ বাতাস প্রণয়ের প্রেম পরশ।

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫৬