মায়াকুমারী পর্ব ২৯

মায়াকুমারী পর্ব ২৯
মেহেরিন আনজারা

প্রায় বিয়ের অনেকগুলো বছর চলছে উনাদের তবে কখনো মনোমালিন্য হয়নি। শ্বাশুড়ি-ননদ প্রচুর যন্ত্রণা দিলেও স্বামী ভালো ছিলেন। আসাদ সাহেব যেমন মাটির মানুষ তেমনি আবার মেজাজীও। তবে দিলরুবা খাতুনের গলায় সবসময়ই থাকতো নমনীয়তা,কোমলতা। তিনি একজন অন্ধ স্বামীভক্ত। স্বামীর মেজাজ খারাপ থাকলে কখনো ঘাটাতেন না। আসাদ সাহেব দেখতে কালো ছিলেন বলে বিয়ে করতে চাননি। তিনি ছিলেন সুন্দরী।

ওতো কালো,আবার নিজের থেকেও সতেরো-আঠারো বছরের বড় মানুষকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানান। বাবার চাপে পড়ে শেষমেশ বিয়ে হয়ে যায়। এরপর সংসার শুরু করেন। আসাদ সাহেব বুঝতেন স্ত্রী উনাকে পছন্দ করেন না। তবে উনার সাথে কখনো বাজে আচরণ করেননি। মনখারাপ থাকতো সবসময়,নীরবে কাঁদতেন। উনাকে অবাক করে দিয়ে আসাদ সাহেব একজন যোগ্য স্বামী হয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন বয়স এবং গায়ের রঙ কিছু না। এখন তো একজন আরেকজনের চোখের সুরমা! কত মায়া করে আদুরে গলায় ডাকেন দিলরুবা! বয়স হয়ে গেলেও দু’জনের মধ্যে এখনও কত ভালোবাসা। আর সেটা মুখে প্রকাশ না করলেও কাজের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। রাগ দেখিয়ে বললেন,”কাজটা কী আপনি ঠিক করলেন?”
চমকালেন আসাদ সাহেব।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“মানে!”
“ওরা হচ্ছে মেয়ে। ওদের জন্য এত সম্পত্তির কী দরকার?”
“এইসব কেমন কথা দিলরুবা?”
“ঠিকই তো বলেছি! আজীবন মেয়েদের নিয়ে ভাবলে হবে আমার ছেলেদের ভবিষ্যৎ আছে না?”
“মেয়ে বলে ওদের জন্য আরো বেশি ভাবা এবং করা উচিত,তদ্রূপ এটা প্রতিটি বাবা-মায়েরও। কারণ সমাজে ছেলেদের চাইতেও বেশি অবহেলিত,নিগৃহীত মেয়েরা। আর শোনো,আমি কাউকে ঠকাইনি। সবার জন্যই সম্পত্তি আছে। এছাড়াও আমি কখনো নিশুকে অন্যের মেয়ে ভাবিনি। জন্ম না দিলেও আমি কিন্তু ওর আরেক পিতা। পুত্রবধূর সম্পর্কটা পরে কিন্তু ওতো প্রথমে আমাদের মেয়ে হয়েই এসেছে আমাদের জীবনে। আর ওরা যেমন আমার ছেলে তেমনি ওরাও আমার মেয়ে। উভয় সমান সমান। ভুলে যেও না দিলরুবা তোমার বড় ছেলেকে কিন্তু কোটি কোটি টাকা খরচা করে পড়াশোনা করিয়েছি ইউএসএ-এর নামী-দামী ভার্সিটিতে। এছাড়াও ইউএসএতে এপার্টমেন্ট এবং সাড়ে তিন বছরে তিনটি কার কিনে দিয়েছি। আনুষাঙ্গিক খরচ তো তো বাদই দিলাম। ধূসর-ধীরাজ দুজনকেও বিদেশ পাঠিয়ে দিবো ইনশাআল্লাহ যেহেতু আমি এখন ফ্রী হয়েছি আর তোমার বড় ছেলেও এসেছে। আর ওদের আগেও অনেকবার চাপ দিয়েছিলাম বিদেশে স্টাডি কমপ্লিট করে সেটেল্ড হতে কিন্তু আমার কথা শোনেনি। কী জানি বাবা-মা,বোনদের কী হবে সে কথা ভেবে। ছেলেদের মধ্যে একজনকে স্টাবলিশ করে দিয়েছি বাকি দু’জন এবং মেয়েরা এখনও হয়নি তাই সম্পত্তিটুকু দেওয়া এতে আপত্তি করছো কেন?ছেলে-মেয়ে বলে না আমি কিন্তু সবাইকে সমান চোখে দেখেছি।”

“মেয়েদের বিয়েতে একগাদা টাকাপয়সা খরচা হবে।”
“ছেলেদের বিয়েতে হবে না?”
“আপনি অন্ধ হয়ে গিয়েছেন?”
“ছেলেদের জন্য দশগুণ আর মেয়েদের জন্য পাঁচগুণ দিয়েছি এতে কী অন্ধ হলাম?ঢের সম্পত্তি আছে তিনজনের নামে।”
মুখ গোঁজ করলেন দিলরুবা খাতুন। অসন্তুষ্ট হলেন আসাদ সাহেব।

“আমি যতদিন বেঁচে আছি এই সম্পত্তি ওদের। শোনো,মেয়েদের একটি নিজস্ব বাড়ি বা নিজের ঘর থাকা কতটা জরুরি তা কেবলমাত্র তারা নিজেরাই জানে যারা স্বামী-সন্তান,বাবারবাড়ি এবং শ্বশুরবাড়িতে অবহেলিত,নিগৃহীত,নির্যাতিত। একটা মেয়ে নিজের যে-কোনো প্রয়োজনে বাবা-ভাইয়ের কাছে যত সহজে টাকা চাইতে পারে স্বামীর কাছে তত সহজে চাইতে পারে না। কারণ অনেক সংসারে স্বামীরা স্ত্রীদের ভাত-কাপড়ের বদলে দাসী ভাবে,অনুগ্রহ করে। অনেকে আবার হাতখরচ দিলেও নিজের মালিকানা সত্ত্ব রেখে টাকা দেয় হিসাব চায়। তাই আমার মতে,প্রতিটি মেয়ের একটি বাড়ি দরকার,ঘর দরকার,স্টাবলিশ হওয়া দরকার,ইনকাম সোর্স থাকা দরকার। সে যাইহোক,এখন কোনো একদিন আমার মেয়েরা গর্ব করে বুক ফুলিয়ে বলতে পারবে তাদের নিজস্ব একটা বাড়ি আছে,ঘর আছে,সম্পত্তি আছে। স্বামী-সন্তান কিংবা শ্বশুরবাড়ির লোকদের লাথি-উষ্টা খেয়ে,নির্যাতিত এবং অবহেলিত হয়ে পড়ে থাকতে হবে না। সব মেয়েদের শখ থাকে একদিন তার নিজের একটা বাড়ি হবে,ঘর হবে,সংসার হবে। যদি কখনো এমন পরিস্থিতি আসে যে কেউ ওদের পাশে না থাকে তখন যেন মাথার উপর অন্তত একটা আশ্রয় থাকে সে ব্যবস্থা করে দিলাম। আমি কি খারাপ কিছু করেছি মেয়েদের জন্য?”

চুপসে রইলেন দিলরুবা খাতুন।
“করলেও করেছি এখন তোমরা যদি মনে করো আমি তোমাদের সাথে অন্যায় করে লছি তো আমাকে মাফ করে দিও।”
স্ত্রী সমেৎ ছেলেদের দিকে তাকালেন নীরব সবাই।
“ধ্রুব তোমার কী মতামত?”
“আমার কোনো সমস্যা নেই।”
“ধূসর?”
“সহমত।”
“ধীরাজ?”
“ভাইয়াদের সঙ্গে একমত। আমি জানি আমার আব্বা অহেতুক কিছু করবেন না। এতে আপত্তির কিছু দেখি না। আর সব আমাদের বোনদের ভবিষ্যতের জন্যই তো! ওরা ভালো থাকলে আমরাও ভালো। চোখের শান্তি বড় শান্তি! আমাদের বোনেরা সুখে-শান্তিতে আছে এটাও তো চোখের শান্তি। চোখ শান্তি মন-মগজ সব শান্তি!”
ছোট ছেলের কথায় মুগ্ধ হলেন। আদ্র হলো বুক।

“সবার সামনে ক্লিয়ার হয়ে গেল বিষয়টি। কারো কোনো আপত্তি নেই। আর করলেও আমি আমার স্থানে অনড়। কারণ এখানে শুধু আমার কষ্টের অর্জিত অর্থ কারো এক পয়সাও নেই। তাই কারো কোনো রাইট নেই আপত্তি করার। আর আমার সম্পত্তি আমি যাকে ইচ্ছে তাকে দান করতে পারি। হতে পারে সেটা সরকারি ফান্ড কিংবা কোনো মসজিদ,এতিমখানায়। সে যাইহোক,এখন আমি ছেলেমেয়ে কাউকে ঠকাইনি। বরং ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা কম পেয়েছে। তবুও শান্তি যে বেঁচে থাকাকালীন ওদের একটা আশ্রয়ের ব্যবস্থা এবং ইনকাম সোর্স করে দিয়ে যেতে পারলাম। এখন কবরে গেলেও আমি শান্তি পাবো। এখন প্রতি মাসের সকল টাকা ওদের দু’জনের একাউন্টে এসে জমা হবে। দু’জনের নিরাপত্তার কথা ভেবে দুটি একাউন্টও ওপেন করে দিয়েছি। তবে নিশু-দ্যুতির কাছে বিষয়টি হাইড থাকুক। পড়াশোনা কমপ্লিট করে নিজেদের অবস্থান মজবুত করুক।

স্টাবলিশ হোক। আমি চাই একটা পুরুষ যেমন আত্মনির্ভরশীল হয় ঠিক তেমনি একটা নারীকেও আত্মনির্ভরশীল এবং দৃঢ় মনোবলের হতে হয় নিজের জন্য হলেও! আমার মতে প্রত্যেকটি নারীর উচিত অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া কারণ এই অর্থই তার আত্নবিশ্বাস ধরে রাখে। আর আরেকটু স্পেসিফিক‍্যালি বলতে গেলে,নারীদের উচিৎ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে না করা। তা না হলে ইনসিকিউর নপুংশক স্বামী জুটলে জীবন শেষ। একজন পুরুষ যত ভালোই হোক না কেন কখনও কখনও এই টাকার বড়গলা সে করবেই। আর পুরুষেরা তাদের স্ত্রীর সাথে এমন ব্যবহার না করলে নারীরাও ঘরের বাইরে যেতে চাই তো না; স্বাবলম্বী হওয়ারও চেষ্টা করতো না। পুরুষের ব্যর্থতার জন্যই নারীরা আজ কিছু করতে চায় যাতে এমন অপমান সহ্য না করা লাগে। তাই বর্তমান সামাজিক এবং পারিবারিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট অনুযায়ী আমার মতে প্রতিটি নারীর অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া উচিৎ! যার যার ধর্মের অনুশাসন মেনে নারী স্বাবলম্বী হলে কোনো সমস্যা নেই। কে কী বলল,কী করলো তা নিয়ে পড়ে না থেকে সামগ্রিক নারীর উন্নয়ন হওয়াটা জরুরি বলে আমি মনে করি। সে যাইহোক এখন আমি চাই পড়াশোনা করে ওরা কিছু একটা করুক। তারপর কোনো একদিন ওদের জানাবো।”

নীরব রইলো সবাই।
“আরেকটা কথা নিশু-দ্যুতির জন্য পাত্র দেখতেছি। আমি বেঁচে থাকতে ওদের বিয়ে দেখে যেতে চাই। পাত্র অলরেডি আছে আরেকটু খোঁজখবর নিয়ে আগে নিশুর বিয়েটা দিতে চাই।”
ছেলের দিকে একপলক তাকিয়ে উঠে গেলেন আসাদ সাহেব। এতক্ষণ ধ্রুবর মুখ স্বাভাবিক থাকলেও শক্ত দেখালো। রুমের দিকে পা বাড়াতেই দেখলেন রিনা খালার সঙ্গে কিচেনে কাজ করছে ওরা দু’জন।
“রিনা খান তোমার সান্ডে মান্ডে কোলোজ কইরা দিমু কইতাছি!”
দ্যুতির কথায় শব্দ করে হেসে উঠলো নিশু।
“আমি আবার কিতা করলাম?”
“কাবাব মে হাড্ডি হচ্ছ যখন তখন।”

“আমার কী দোষ?হেরাই তো চিপায়-চাপায় আকাম-কুকাম করতাছিল।”
“রিনা খান আর একবার ডিস্টার্ব করবা ওদের তো বললাম না সান্ডে মান্ডে কোলোজ কইরা দিমু। তোমার জন্য একটা ব’ন্দুক কিনবো দাঁড়াও।”
“রিনা খান কও ক্যান আমারে?”
“তুমি বাস্তবের রিনা খান।”
“তোমরা আমারে ওই ঝরগাইট্টা রিনা খানের লগে মিলাইতাছো?”
“তুমি আরো ডেঞ্জারাস।”
“নামডাই পাল্টালামু।”
মুচকি হাসি ফুটে উঠলো উনার মুখে। রুমের দিকে পা বাড়ালেন। আযান হয়েছে নামাজ আদায় করবেন। উঠে গেল তিনভাই। আনমনা হয়ে বসে রইলো ধ্রুব। একপলক তাকিয়ে রুমের দিকে হাঁটা ধরলো ধূসর।

ব্রেকফাস্ট করতে বসেছে সবাই। গম্ভীর হয়ে মুখে পরোটার টুকরো পুরছে তাহমিদ। কেমন বিমর্ষ দেখাচ্ছে তাকে। অবশ্য লক্ষ্য করলেন না তাহিয়া বেগম। আজ তিনি ভীষণ খুশি! পাঁচমিশালী সবজি ভাজি তুলে দিলেন সবার প্লেটে। স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন,”তাহমিদের জন্য পাত্রী দেখেছিলাম কাল।”
“কোথায়?”
“আরে আসাদ সাহেবের বড় মেয়েকে।”
চমকালেন কামরুল সাহেব।
“ওহ।”
“জানেন মেয়েটাকে আমার এত্ত পছন্দ হয়েছে মানে কী বলবো!”
স্ত্রীর দিকে তাকালেন।
“কেমন?”
“ঠিক কেমন তা জানি না। তবে মেয়েটাকে দেখলেই চোখের দৃষ্টি শান্ত হয়ে আসে। আছে না এমন কোনো জিনিস যেটা দেখলে মস্তিষ্ক আর চোখে শীতলতা নেমে আসে।”
অবাক হলেন তিনি।
“তোমার পছন্দ হয়েছে?”
“অবশ্যই!”

“এই পর্যন্ত দুনিয়ার মেয়ে দেখা শেষ। আমার তো মনে হচ্ছে আরেকবার দেখলেই তুমি বলবে পছন্দ হয়নি। কারণ এমনটা অসংখ্যবার হয়ে আসছে।”
“বিশ্বাস করুন এটাই লাস্ট। সত্যি মেয়েটাকে আমার পছন্দ হয়েছে।”
তাসফিয়া বলল,”মারাত্মক সুন্দরী আম্মু?”
“সুন্দর কি না জানি না তবে মেয়েটাই এমন যে দেখলেই চোখের দৃষ্টি শীতল হয়ে আসে।”
উনার দিকে তাকিয়ে রইলেন কামরুল সাহেব। স্ত্রীকে ঢের চিনেন। কোনো সুন্দরী মেয়েকে দেখলেই জেলাশফিল করেন। কতশত খুঁত ধরে আর ছেলের বিয়ের জন্য রাজি হয় না। সেই মানুষ কিনা এমন বর্ননা দিলো! তবে খুশি হলেন এই ভেবে যাক ছেলের বিয়ে এখানেই নিশ্চিত। তাহিয়া বেগম টক্সিস স্বভাবের। পছন্দ হয়েছে মানে এখানে বিয়ে দিয়েই ছাড়বেন আর সেটা যেভাবেই হোক। শেষমেশ বড় ছেলে ছাঁদনাতলায় বসতে যাচ্ছে!
“কাল দেখতে গিয়েছিলাম তখন বাইরে থেকে এসেছিল। ডাকা লাগেনি নিজ থেকেই এসে হাসিমুখে সালাম দিলো। পরনে খুব সুন্দর একটি শাড়ি ছিল। মেয়েটাকে নতুন বউ বউ লাগছিল। মেয়েটার শরীরে শাড়িটা ফুটেছিল। ভালো করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। সত্যি বলতে আমার কেন জানি পছন্দ হয়ে গেছে। এরপর অন্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদেরকেও জিজ্ঞেস করেছিলাম খারাপ কোনো মন্তব্য পাইনি। সে যাইহোক,তোমরা সবাই এভাবে তাকিয়ে রইলে কেন?”

“না মানে তোমার কথা শুনছিলাম।”
“খুব শিঘ্রই কথা পাকাপাকি করে ফেলবো।”
“তাও ঠিক তোমার মত আবার কখন ঘুরে যায়।”
“এবার আর ঘুরবে না। সত্যি পছন্দ হয়েছে।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কামরুল সাহেব।
“মেয়েটাকে তো দেখতেই হয় আম্মু।”
“ওদের মেয়ে দুইটা। ছোটটা ভারি অহংকারী।”
“কী করেছে?”
“আমাদের দেখে সালাম না নিয়ে ট্যাং ট্যাং করে উপরে চলে গেল।”
“সে দেখতে কেমন?”
“মুখে মাস্ক ছিল।”
“হয়তো কোনো প্রবলেম ছিল।”
“কীসের প্রবলেম দেমাকি!”

খাবার অসমাপ্ত করে উঠে গেল তাহমিদ। কালকের সেই দৃশ্যটি দেখার পর থেকেই তার হৃদয়ে উত্তাল-পাত্তাল ঝড় বয়ে যাচ্ছে। মানতেই পারছে না নিশুকে কেউ ওইভাবে ঘনিষ্ঠভাবে ছুঁয়েছে,চেপে ধরে দেয়ালের সঙ্গে চুমু খেয়েছিল। নিশুও তখন চোখ বুজে ফিল করেছিল। দৃশ্যটি চোখের সামনে ভাসতেই কেমন শ্বাস আঁটকে আসছে। ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। শুকনো ঢোক গিলে সিগারেট ধরালো। তার মায়ের কথাগুলো মিথ্যে নয়। আসলেই মেয়েটা গর্জিয়াস সুন্দরী নয় তবে সুন্দর! যতটা সুন্দরী হলে চোখ নামানো যায় না। মেয়েটাকে দেখলে অদ্ভুত একটা মায়া এবং শান্তি লাগে আর এটা খুবই ভিন্ন রকমের এক অনুভূতি। যেই অনুভূতিটা দুনিয়ার আর কারো চেহারায় আজ পর্যন্ত খুঁজে পায়নি সে।

প্রথম যখন দেখেছিল তখন মনে হয়েছিল কোনো পৃথিবীর মানবী না স্বর্গ থেকে ভুল করে চলে এসেছে পৃথিবীতে। পিঠভরা ভেজা চুল,টানা টানা চোখ,ভীত চাহনি! নুপুরটি ধরে কাছে এগিয়ে এসে দাঁড়াতেই একটা মিষ্টি ঘ্রাণ ভেসে এসেছিল। কেমন যেন অনেকটা কমলালেবুর মতো অথবা কোথাও দূরে বাতাবিলেবুর ফুল ফুটেছে বাতাসে ভেসে আসা তার আগমনী সুগন্ধি! দ্বিতীয়বার নিচে দেখা হওয়ার পর নুপুরটি হাতে নিয়ে একটু মলিন হেসেছিল। রুগ্ন দেখালেও তার কাছে নিশুর সেই হাসি যেন কোনো বিলে শত শত কচুরীপানার ফুল আর পাপড়িতে ময়ূরকণ্ঠী রঙ নিয়ে ফুটে আছে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বুঝতে পারছে না ওই ছেলেটা কে আর ওইভাবে চুমু কেন খেয়েছিল? আর নিশু কেন কান্না করেছিল? ঝট পাকাতে লাগলো প্রশ্নগুলো।

ব্রেকফাস্টের টেবিলে বসলো সবাই। দিলরুবা খাতুনকে কিচেনে ঢুকতে দিলো না। ডাইনিংয়ে এসে চেয়ারে বসলেন। আনন্দিত হলেন এই ভেবে যে মেয়ে দুটো সাংসারিক হচ্ছে। নিশুর সঙ্গে থেকে দ্যুতিও। তিনি কখনোই নিষেধ করেন না তাদেরকে। দু’জনেই পছন্দমতো রান্নাবান্না করে,সার্ভ করে। এমন বউ-ঝি-ই তো সবাই কামনা করে। কোমরে আঁচল গুঁজে পরোটা সেঁকছে আর ডিম পোচ করছে নিশু। দেখতে ঠিক বউ বউ লাগছে! টেবিলে এনে সাজিয়ে রাখছে দ্যুতি। কাটা-বেচা,ধোয়া রিনা খালা আর জোছনা করে। একে একে ডাইনিংয়ে এলো সবাই। চেয়ার পেতে বসলো। কোমর থেকে শাড়ির আঁচল খুলে ঘাম মুছে টেবিলের দিকে পা বাড়ালো নিশু। কেমন মায়াবী লাগলো ওমন ঘর্মাক্ত মুখ। চোখ তুলে তাকাতেই দেখলো নিশু আসছে। চোখে চোখ পড়তেই অপ্রস্তুত হয়ে আড়ষ্ট হলো নিশু। চোখ দিয়ে ইশারা দিলো দ্যুতি। অস্বস্তি হলেও মনোবল রাখলো।

“আমি টায়ার্ড। নিশু সার্ভ করতো!”
“তুই বস আমি দিচ্ছি।”
এক এক করে সবার হাফ প্লেটে পরোটা তুলে দিলো নিশু। ডিম পোচ দিয়ে ভাজি তুলে দিলো। খাওয়ায় মনোযোগ দিলো সবাই। আমতা আমতা করলো নিশু। ইশারা দিলো দ্যুতি।
“ভাইয়া আপনি কি সবজি ভাজি নিবেন নাকি সুজির হালুয়া? মাংস ভুনা আর ডালও আছে কিন্তু!”
চমকিত নয়নে তাকালো সবাই। বিস্ফোরিত নয়নে তাকালো ধ্রুব। মুহূর্তেই কান গরম হয়ে গেল। বুকের ভিতর ঢিপঢিপ করছে নিশুর। এই না রাগে-জিদে ধ্রুব তাকে থাপ্পড় মা’রে! কিছু বলতে নিবেন দিলরুবা খাতুন চিমটি কাটলো দ্যুতি। স্ত্রীর দিকে তাকালেন আসাদ সাহেব।
“থাক ভাইয়া সবজি দিয়েই খান। এটা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ভালো।”
গলায় খাবার আঁটকালো ধূসরের। পানি এগিয়ে দিলো নিশু।

“তোমার আবার কী হলো ভাইয়া?”
“কিছু না।”
“ভাইয়া আপনাকে কি আরেকটা পরোটা দিবো?”
শ্বাস আঁটকে আস্তে আস্তে চিবুতে লাগলো ধ্রুব। মেয়েটা কি ইসলামিক বইপুস্তক পড়ে না স্বামীকে কীভাবে ভাই ডাকে ছিঃ!
“নিন ভাইয়া আরেকটা পরোটা নিন। এই বয়সটাই তো খাওয়া-দাওয়ার বয়স।”
নীরব রইলো ধ্রুব। নিশু তাকে ইচ্ছে করে জব্দ করছে! কিছুই বুঝতে পারছেন না আসাদ সাহেব।
“নিশুর মনে হয় আবার ডিমেনশিয়া হয়েছে ধূসর?”
“না আব্বু আমি একদম ফিট।”
তবুও উনার বিশ্বাস হলো না।
“ভাইয়া আপনি কি ব্ল্যাক কফি পছন্দ করেন নাকি চা?”
চোয়াল শক্ত করে চিবুতে লাগলো।
“ভাইয়া আপনি কি রাগ করেছেন?”

ঠোঁট টিপে হাসতে লাগলো দ্যুতি। এতদিন শুনেছিল মেয়েদের বুক ফাটে মুখ ফাটে না কিন্তু আখেরি যুগ চলায় কথাটা উল্টো হচ্ছে। তার ভাইয়ের বুক ফাটছে কিন্তু মুখ ফাটছে না।
“ছাপড়ি ভাইয়া তোমার মুড অফ কেন? নিশু তো খারাপ কিছু বলছে না!”
শক্ত চোখে তাকালো। আরেকটু জ্বালানোর জন্য নিশু বলল,”এতদিন মেজ ভাইয়া বাজার করতো আজ থেকে আপনি বাজার করবেন কেমন ভাইয়া। নাস্তা সেরে দ্রুত বাজার করে আনুন। এই নিন লিস্ট!”
শক্ত চোখে তাকালো ধ্রুব। নিশু তাকালো না।
“বাসি পঁচা সবজি একদমই আনবেন না। অল্প হলেও ফ্রেশ সবজি আনবেন। নয়তো আবার ফেরত পাঠাবো।”
দাঁতে দাঁত চাপলো ধ্রুব। মনে মনে বলল,”চান্দু তোমারে পাইছি এবার বুঝামু আমি কী!”
আসাদ সাহেব বললেন,”ঠিক বলেছিস নিশু। এখন থেকে তোর বড় ভাইয়া বাজারের দায়িত্বটা নিলে ভালো হয়।”

“জ্বী আব্বু। আমিও তো তাই বলি। কিন্তু দেখেন ভাইয়ার মুড কেমন অফ।”
“মুড অফের কিছু নেই বাজারটা মন দিয়ে করিও। নিশু আবার খুঁতখুঁতে স্বভাবের।”
নীরব রইলো ধ্রুব।
“নিশু-দ্যুতি তোদের দু’জনকে একটা প্রোগ্রামে যেতে হবে।”
“কোথায়?”
“আমাদের মেডিসিন শপটি উদ্বোধন করবো। সেখানের মেইন গেস্ট তোরা দু’জন।”
“সত্যি!”
“হুম।”
“কখন যেতে হবে?”
“আজ করার কথা থাকলে কাল করছি। কিছু জরুরি কাজ ছিল।”
“আচ্ছা।”
ছেলেদের উদ্দেশ্য বললেন,”ধ্রুব-ধূসর তোমরা বরং ওদের শপিংয়ে নিয়ে যাও। ভালো কাপড়চোপড় পরে যেতে হবে।”

পকেট থেকে একটি কার্ড বের করে ওদের সামনে রেখে উঠে গেলেন। ব্ল্যাক কফি তৈরী করে ধ্রুবর দিকে হাত বাড়িয়ে ধরলো।
“আপনি বরং আমাদেরকে শপিংয়ে নিয়ে যাবেন কেমন ভাইয়া!”
শক্ত চোখে তাকায় ধ্রুব।
“ভাইয়া আপনার কফি নিন।”
ভাইয়া ডাকতে ডাকতে কানটা জ্বালাপোড়া করে ফেললো এই মাথামোটা গাধী মেয়েটা।
“আর একবার ভাইয়া ডাকবি তো থাপ্পড় দিয়ে তোর গালের দাঁত সব ফেলে দিব বেয়াদব!”
হতভম্ব হলো নিশু।
“আমি আবার কী করলাম ভাইয়া?”
“ননসেন্স!”
“নিন ভাইয়া আপনার কফি।”
বিরক্তিকর চোখে তাকায় ধ্রুব।
“কী হলো ভাইয়া কফি নিন।”

চোয়াল শক্ত করে কফি নিতেই অসতর্কাবশত ধ্রুবর তলপেটের উপর পড়তেই আর্তনাদ করলো না বরং ঠোঁট চেপে রাখলো। চেঁচিয়ে উঠলো দ্যুতি।
“দিলি তো ভাইয়ার ফিউচার নষ্ট করে!”
হতভম্ব চোখে তাকায় সবাই। দাঁতে দাঁত চাপলো ধ্রুব।
“হায়! হায়! ভাইয়া তো আর বাবা ডাক শুনতে পারবে না। ভাইয়ার বাবার হওয়ার ফিউচার শেষ!”
কান গরম হয়ে গেল দু’জনের।
“এবার আমার ভাইয়া বাবা হবে কীভাবে নিশু! আহ! আফসোস!”
“সরি ভাইয়া আসলেই আমি বুঝতে পারিনি এভাবে আপনার ফিউচার নষ্ট করে ফেলবো!”
হাত মুষ্টিবদ্ধ করলো ধ্রুব।

মায়াকুমারী পর্ব ২৮

“ডিজগাস্টিং!”
“বললাম তো ভাইয়া সরি।”
উঠে লম্বা লম্বা কদম ফেলে চলে গেল। চেয়ারে বসলো নিশু।
“একদম দারুণ দিয়েছিস নিশু। কিন্তু ফিউচারটা অন্ধকার না করলেও পারতি! বেচারা এখনও বাসরটাও করতে পারলো না।”

মায়াকুমারী পর্ব ৩০