মায়াকুমারী পর্ব ৩৯
মেহেরিন আনজারা
দু-দিন পরের দিনের কথা। জ্ঞান ফিরলো নিশুর। মস্তিষ্ক সচল হতেই টের পেলো তার পেটে চিনচিন করে অসহনীয় ব্যথা করছে! স্পর্শ করতেই বুঝতে পারলো ব্যান্ডেজ করা। চমকায় নিশু। কী হয়েছে তার বুঝতে পারছে না তবে এইটুকু মনে আছে তাকে অ.টিতে নিয়েছিল এরপর তার সঙ্গে কী হয়েছিল মনে নেই। ধূসরকে আশেপাশে দেখা গেল না। নিভু নিভু ঝাপসা চোখে তাকায়। অন্যদিকে তাকিয়ে রয়েছে দ্যুতি। কম্পিত হাত এগিয়ে দ্যুতির হাতের উপর রাখতেই তাকায়। দ্যুতির মুখ দেখতেই চমকায়। চোখ-মুখ কেমন ফোলা এবং লাল টকটকে। আহা! কত রাত ঘুমায়নি যেন মেয়েটা। বিধস্ত দেখাচ্ছে দ্যুতিকে। মনে হচ্ছে তার উপর দিয়ে সিডর তাণ্ডব চালিয়ে গিয়েছে। উসকোখুসকো চুল,কতদিন যেন আঁচড়ায়নি। ঠোঁটের চামড়াগুলো শুকিয়ে রয়েছে। পানিও স্পর্শ করেনি বোধহয় মেয়েটা। গলার হাড়গুলো কেমন দেখা যাচ্ছে। আতঙ্কিত হয় নিশু। এই দ্যুতিকে তো সে চিনে না। ধক করে উঠলো বুকের ভেতর।
“দ্যুতি,কী হয়েছে তোর?”
মাথা নাড়ালো কিছু হয়নি।
“তোকে এমন বিধস্ত দেখাচ্ছে কেন?”
ফের মাথা নাড়ায় কিছু হয়নি। চতুর্দিকে তাকায় নিশু।
“আমরা কোথায় আছি?”
“ব্যাংকক।”
“আমার পেটে কী হয়েছে?”
“ছোট্ট একটা অপারেশন।”
“ও এসেছিল?”
“না।”
মুখটা মলিন হয়ে গেল নিশুর।
“মেজ ভাইয়া কই?”
“আছে।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
অনিককে দেখার পর বাংলাদেশ ফিরলো ধ্রুব। পুরো মাথা ন্যাড়া করা হয়েছে। আঘাতগুলো দেখে শিউরে উঠেছিল ধ্রুব। সেই থেকেই কেমন ঘাবড়ে আছে। টলছে না তার পা। আদেও অনিক বাঁচবে তো! কেমন জানি অশান্তি লাগছে ধ্রুবর। এতটা হিংস্র হয়ে আঘাত না করলেও পারতো দ্যুতি। কী যে করবে ভেবে পাচ্ছে না। পুরো বাসা কেমন নীরব,থমথমে। যেন মরা বাড়ি মরা ঘর। কেমন জানি ভারী লাগলো। রুমে ঢুকে শাওয়ার নিয়ে বেরুলো। কাউকে দেখলো না। মায়ের রুমের দিকে এগিয়ে গেল। চোখ বুজে শুয়ে রয়েছেন তিনি। কেমন দূর্বল দেখালো উনাকে। মায়ের গালে হাত রাখলো। চোখ মেলে তাকান তিনি।
“আম্মা কেমন আছো? কী হয়েছে?”
“কিছু হয়নি।”
“আব্বা কই?”
“বাইরে।”
“বাসায় কেউ নেই?”
“না।”
“নিশু-দ্যুতি ওরা কই?”
চমকালেন তিনি।
“তোর কাছেই তো গেল।”
“মানে!”
“ব্যাংকক গেল বলল।”
“কখন?”
“সেদিন রাতে।”
“কই ওরা তো সেখানে যায়নি।”
চমকালেন।
“তাহলে?”
“বুঝতে পারছি না।”
ঠিক তখন বাসায় ফিরলেন আসাদ সাহেব। গম্ভীর হয়ে রয়েছেন তিনি। মন-মেজাজ বিক্ষিপ্ত উনার।
“আব্বা,ধূসর নিশু-দ্যুতিকে নিয়ে কোথাই গেল?”
“ব্যাংকক।”
“না সেখানে যায়নি।”
“ধূসর তো তাই বলল।”
মেজাজ খারাপ হলো ধ্রুবর।
“বলতে চাচ্ছেন মিথ্যা বলছি?”
“ধূসর কখনও মিথ্যা বলে না।”
“বলছি ওরা কোথায়?”
চিন্তায় পড়ে গেলেন। একজনকেও অনলাইনে পাওয়া গেল না। সত্যি এবার চিন্তায় পড়লেন। রুমে ফিরে গেল ধ্রুব। পায়চারি করতে লাগলো ব্যালকনিতে। কোথায় যেতে পারে ওরা?এভাবে প্রায় তিন ঘন্টা অপেক্ষা করলো তবুও ওদের হদিস পাওয়া গেল না। চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়লো ধ্রুব। ইফতেখার মির্জার পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট শাফায়াতকে পার্সোনালি ফোন করে ওদের খবর জিজ্ঞেস করলেও বিশেষ সুবিধা করতে পারলো না। চিন্তায়-অস্থিরতায় মুষড়ে পড়লো ধ্রুব। কেন জানি নিশুকে নিয়ে ভীষণ ভয় হচ্ছে তার। ধূসর বারবার জিজ্ঞেস করছিল তাদের ডিভোর্স হয়েছে কিনা ইত্যাদি। খুবই ইন্টারেস্ট দেখিয়েছিল এই ব্যপারে। নিশুকে কিছু করেনি তো ধূসর?কেন জানি বারবার আজেবাজে চিন্তা মাথায় এসে সার্কেলের ন্যায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। শ্বাস আঁটকে আঁটকে আসছে।
গুনে গুনে প্রায় পুরো সাড়ে তিন দিন হতে চললো অথচ ধূসরকে দেখলো না নিশু। ছটফট করতে লাগলো। তাদের এভাবে রেখে ধূসর কোথায় গেল বুঝতে পারলো না। দ্যুতিকে জিজ্ঞেস করলেও তেমন কোনো রেসপন্স পেলো না। বিচলিত হয় নিশু। এই সাড়ে তিন দিন দ্যুতিকে ছাড়া তার আশেপাশে কাউকে দেখতে পেলো না। ধ্রুব কি আসেনি? মলিন হয়ে গেল মুখটা? সে কি তবে নীলিকে ভালোবাসে? বর্ষার ভরা বিলের মতো জলে টইটম্বুর হয়ে গেল টানাটানা মায়াবী নয়নজোড়া। তাহলে তাকে আশ্বাস দিয়ে গিয়েছিল কেন? কেন বলল সংসার করবে? নিশু যে সেই আশায় এখনও জীবিত রয়েছে। জলপ্রপাতের ন্যায় অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো সফেদ দু-গাল বেয়ে।
“মেজ ভাইয়া কই দ্যুতি?”
“আছে।”
“কোথায়?”
“বাইরে।”
“ডাক।”
দোনোমোনো করলো দ্যুতি।
“কীরে ডাক!”
“কোন দিকে গিয়েছে অনেকক্ষণ হলো।”
“কী লুকাচ্ছিস তোরা আমার কাছে বল?”
চেঁচিয়ে উঠলো নিশু। নীরব রইলো দ্যুতি। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে টান দিয়ে স্যালাইনের নল খুলে নিশু নিজেই উঠে কেবিন থেকে বেরুতে নিতেই বাঁধা দিলো দ্যুতি।
“কোথায় যাচ্ছিস?”
“সর!”
সরিয়ে দিলো। হাঁটতে হাঁটতে আশেপাশে খুঁজতে লাগলো ধূসরকে কিন্তু পেলো না। কেমন ভার হয়ে এলো হৃদয়টা। যতই হাঁটছে বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে। নিশুর মন বলছে ধূসর ভালো নেই! সবগুলো কেবিন খুঁজতেই আকস্মিক চোখ পড়লো একটি কেবিনের দিকে। সেদিকে পা বাড়াতেই হাত ধরে ফেললো নার্স।
“ছাড়ুন আমাকে!”
শক্ত করে চেপে ধরলো নিশুকে।
“ম্যাম,আপনি অসুস্থ। কেবিনে চলুন।”
“আমি ওই কেবিনে যাব।”
নিজেকে ছাড়িয়ে দ্রুত কেবিনে ঢুকতেই দেখলো শুভ্র বেডে ঘুমিয়ে রয়েছে ধূসর। কম্পিত পায়ে এগিয়ে গেল নিশু। ভেজা ঢোক গিলে হাত রাখলো চাদরের উপর দিয়ে পেটের উপর।
“ভাইয়া!”
যেন চুপিসারে ডাকলো নিশু গলার স্বর এতটাই ক্ষীণ। শ্বাস আঁটকে ফের ডাকলো,”ভাইয়া!”
সাড়াশব্দ পেলো না। বুকের উপর হাত রাখলো।
“ভাইয়া!”
নিভু নিভু ঝাপসা চোখে তাকালো ধূসর। নিশুকে দৃশ্যমান হতেই চমকে উঠলো। অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকিয়ে রয়েছে নিশু। অপ্রস্তুতবোধ করলো ধূসর।
“তুই এখানে কী করছিস?”
নার্সকে ইশারা দিলো নিয়ে যেতে। বাহু চেপে ধরতেই সরিয়ে দিলো।
“তোমার কী হয়েছে?”
“কিছু না।”
“এই অবস্থায় কেন?”
“ওকে নিয়ে যান।”
নিশু গেল না। পাতলা চাদরটা তুলতে নিতেই শক্ত করে ধরে রাখলো ধূসর।
“কী হচ্ছে এইসব?”
“তোমার কী হয়েছে?”
“রেস্ট নিচ্ছি।”
“আমি ছোট্ট বাচ্চা?”
“না আপনি আমার ভাবী। সিস্টার আমার ভাবীকে নিয়ে যান।”
কিংকর্তব্যবিমুঢ় নেত্রে তাকায় নিশু। দু’জন নার্স জোর করে নিয়ে গেল নিশুকে। ভীত চোখে তাকিয়ে রইলো দ্যুতি। চোয়াল শক্ত করলো ধূসর।
“এই এদিকে আয়!”
আতঙ্কিত চোখে তাকায়।
“তাড়াতাড়ি আয়।”
কম্পিত পায়ে এগিয়ে যেতেই কষিয়ে দুইটা থাপ্পড় মা’রলো।
“মন কোথায় থাকে?”
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মাথা নুয়ে রইলো দ্যুতি। টুপটুপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
“সামনে থেকে দূর হো!”
ধীর পায়ে কেবিন ত্যাগ করলো দ্যুতি। রাগে ফুঁসতে লাগলো ধূসর। সহ্য হচ্ছে না দুইটার একটাকেও। মেয়েরা এত গাধী হয় তা এই দুই গাধীকে না দেখলে সে জানতোই না! এক গাধী ইট দিয়ে মাথায় আঘাত করেছে এটা কেউ করে! মাথা জিনিসটা কত সেন্সেটিভ! আরেক রোগী গাধী সিসি ক্যামেরার মতো তাকে খুঁজে বের করেছে আপডেট পাওয়ার জন্য। মস্তিষ্ক টগবগ করছে! চোখ বুজে জোরে জোরে শ্বাস ফেলে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো। করিডোরে দাঁড়িয়ে বুক চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করলো দ্যুতি। তার দিকে তাকায় নিশু। ধূসর এমনটা কেন করলো? আর কী হয়েছিল তাদের দু’জনের? চিন্তায় কিছু ভালো লাগছে না নিশুর। বুকটা কেমন ফুলেফেঁপে উঠে ফেটে যাচ্ছে। চোখ বুজে শুয়ে রইলো বেডে।
“দ্যুতি শোন।”
চোখের জল মুছে এগিয়ে এলো।
“বস।”
নীরবে তাই করলো।
“তোর গালে কী হয়েছে?”
“কিছু না।”
“থাপ্পড় দিয়েছে?”
“না।”
তাকিয়ে রইলো নিশু।
“আমার জন্য তাই না?”
নিষ্প্রভ কণ্ঠ নিশুর।
“না।”
“মাফ করে দে।”
নীরব রইলো দ্যুতি।
“আমার কী হয়েছিল?”
“এক্সিডেন্ট করেছিস।”
“মানে কখন?”
“তোর মনে নেই?”
“না।”
“বিমান থেকে নামার পর হসপিটালের দিকে রওনা দিতেই রোড এক্সিডেন্ট করেছিস।”
অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো নিশু।
“মিথ্যা কথা।”
“তোর কিছু মনে পড়ছে না?”
“না।”
“আমার মনে হচ্ছে আবারও তোর মেমোরিলস হয়েছে নিশু।”
“মিথ্যা কথা আমি সুস্থ।”
নীরব রইলো দ্যুতি।
“মেজ ভাইয়ার কী হয়েছে?”
“তোরা দু’জন আমাকে বাঁচাতে গিয়ে এক্সিডেন্ট করেছিস। আর আমি বেঁচে গিয়েছি।”
“বিশ্বাস করিনি।”
নীরব রইলো দ্যুতি।
লস অ্যাঞ্জেলেস (LAX) থেকে ব্যাংকক (BKK) স্টপসহ ফ্লাইটে প্রায় দীর্ঘ ২৬-২৭ ঘন্টা জার্নি শেষে ব্যাংকক ফিরলো বুশরা। সকল ঝামেলা সামলে হসপিটালে ঢুকলো। চিৎকার দিয়ে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়লো মায়ের বুকে। মেয়ের দিকে তাকান আদনীন ফেরদৌস। কী অবস্থা হয়েছে উনার এইটুকুনি সুন্দরী মেয়েটার। যেন ঝড়-তুফান,সাইক্লোন সবই গিয়েছে তার উপর। মায়ের মুখের দিকে তাকায় বুশরা। কী অবস্থা তার মায়ের,যেন কালবৈশাখী তার তাণ্ডব চালিয়ে গিয়েছে। নিজেকে সামলে ভাইকে দেখতে গেল। অবচেতন অবস্থায় রয়েছে এখনও। ডুকরে কেঁদে উঠলো বুশরা।
“ভাইয়া! ও ভাইয়া! ওভাবে চোখ বুজে থেকো না। চোখ খুলে তাকাও।”
বোনের কান্না আদোও তার শ্রবণেন্দ্রিয়তে পৌঁছেছে কিনা কে জানে! আপসেট হয়ে পড়লো বুশরা।
“আমি এখন কার সঙ্গে ঝগড়া করবো ভাইয়া! আমি এখন কার সঙ্গে দুষ্টু-মিষ্টি খুনসুটি করবো কেউ আমায় একটু বলো!”
ভীষণ ভীষণ কান্না করতে লাগলো বুশরা। আইসিইউ রুম থেকে বেরিয়ে ফোন করলো দ্যুতিকে কিন্তু সংযোগ পেলো না। দাঁতে দাঁত চাপলো।
“তোকে আমি ক্ষমা করবো না দ্যুতি। তুই আমার ভাইয়ের খু’নি!”
রাগে-জিদে কল দিতে লাগলো কিন্তু সংযোগ বিচ্ছিন্ন। ধূসরকেও পাওয়া গেল না। মেজাজ খারাপ হলো বুশরার।
“দ্যুতি তোকে আমি ছাড়বো না! তোর ভাই আমাকে পাত্তা দেয়নি আমি কখনো খারাপ কিছু করেছি তাহলে তুই কেন করলি?”
ফোন করলো ধীরাজকে। পিক করতেই জিজ্ঞেস করলো,”দ্যুতি কই?”
“ওদের তিনজনকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না আপু।”
“মানে?”
“আজ তিন-চার দিন থেকে গায়েব ওরা।”
“কী বলছো?”
“সত্যি।”
“কোথায় গেল তাহলে?”
“আব্বুকে নাকি বলেছিল ব্যাংকক।”
“কিন্তু এখানে তো নেই।”
“আমরা সবদিকে খুঁজতেছি কিন্তু কোনো খবর পাচ্ছি না।”
আতঙ্কিত হলো বুশরা।
“এখন কীভাবে কী?”
“তুমি খোঁজ পেলে জানিও। আমরা পেলে জানাবো।”
“আচ্ছা।”
থমকে রইলো বুশরা। কোথায় গেল ওরা? পাগলের মতো হয়ে গেল এবার। চারজন মানুষই চারদিক থেকে তার ভীষণ প্রিয়,আপন। ভাই,প্রেমিক,বান্ধবী। কারো থেকে কেউ কম নয় তার জন্য। আপসেট হয়ে পড়লো বুশরা। একদিকে মা এবং ভাইয়ের অবস্থা অন্যদিকে ওদের তিনজন গায়েব। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না! দিকবিদিকশুন্য হয়ে গেল। উসকোখুসকো চেহারায় বাবার সামনে এসে দাঁড়ালো। চোখ তুলে তাকান তিনি।
“হোয়াট হ্যাপেন্ড?এনিথিং রং?”
“পাপা,নিশু-দ্যুতিকে পাওয়া যাচ্ছে না। খুঁজে বের করে দাও।”
ভীষণ বিরক্ত হলেন তিনি।
“আমি কি গায়েবী জানি?”
“পুলিশের মাধ্যমে ওদের তথ্য পাওয়া তোমার জন্য ইজি।”
“আই ডোন্ট কেয়ার।”
“আমাকে রাগিও না পাপা। আমি খুব রেগে আছি।”
নীরব রইলেন তিনি।
“পুলিশকে ফোন করে জিজ্ঞেস করো ওরা কোথায় আছে?”
“ওই খু’নি মেয়ে দুটোর খবর পুলিশ নিয়ে বসে আছে তো তাদের আর কোনো কাজ নেই।”
“মশকরা করো না।”
“মশকরা বলে মনে হচ্ছে?”
“ওদের নামে মামলা দিয়েছো ওরা পুলিশি পাহারায় রয়েছে অর্থাৎ দেশ থেকে যদি বের হয় অবশ্যই ওরা পারমিশন নিয়েই বের হয়েছে। তাই তুমি পুলিশকে কল করে জিজ্ঞেস করো।”
“পারবো না।”
করিডোরের কিনারে গিয়ে দাঁড়ালো।
“ঠিক আছে লাফ দিচ্ছি!”
“পাগল হয়েছো মাথা খারাপ মেয়ে!”
গর্জে উঠলেন তিনি।
“এক মিনিটে ইনফরমেশন বের করো।”
বিরক্তিকর চোখে তাকালেন। শাফায়াতকে ইশারা দিতেই পুলিশকে ফোন করে তথ্য জানলো।
“স্যার ব্যাংকক হসপিটালে রয়েছে।”
“হোয়াট!”
চেঁচিয়ে উঠলো বুশরা।
“হসপিটালে কেন?”
“মিসেস মেহের নিগার নিশুতির আর্জেন্ট কোনো অপারেশন ছিল।”
“কী!”
নীরব রইলো শাফায়াত। একপলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। মন্ত্রী সাহেবের ঢংগী মেয়ে!
“পাপা আমি ব্যাংকক হসপিটালে যাবো ব্যবস্থা করো।”
“কী দরকার?”
“করবে কিনা বলো নয়তো লাফ দিবো।”
অপ্রসন্ন চোখে তাকালেন। ইশারা দিলেন শাফায়াতকে। শাফায়াতের পিছু পিছু গেল বুশরা। শ্বাস আঁটকে রইলো শাফায়াত। বুশরাকে দেখলেই অস্বাভাবিকভাবে তার হৃদপিণ্ড কাঁপে! বাপের অহংকারী মেয়ে। পৃথিবীর কারো কথা না শুনলেও মেয়ের কাছে উনার সকল শক্তি নস্যি!
আর সহ্য করতে পারলো না ধ্রুব। এবার সত্যিই বাড়াবাড়ি বলে মনে হলো। সবকিছুর একটা লিমিট রয়েছে। লিভিং স্পেসে গম্ভীর হয়ে বসে রয়েছেন আসাদ সাহেব। এক কাপ মশলার চা এগিয়ে দিলেন দিলরুবা খাতুন। গটগট পায়ে এগিয়ে এসে উনাদের সামনে দাঁড়ালো ধ্রুব। তার উপস্থিতি টের পেতেই পা থেকে উপরে চোখ তুলে তাকান আসাদ সাহেব। গম্ভীর মুখে রক্তলাল চোখে তাকিয়ে রয়েছে ধ্রুব। থমকালেও নীরব রইলেন। এই তো বছর সাড়ে তিনেক আগেও ছেলেটা কেমন হ্যাংলা-পাতলা ছিল কিন্তু এখন চোখে লাগার মতো বলিষ্ঠ এবং সুঠাহ দেহের অধিকারী হয়েছে। যেন আরেকটু লম্বা,চওড়াও হয়েছে এবং পুরুষালী ভাইব এসেছে পুরো অবয়বজুড়ে। মনে হচ্ছে বয়স ৩৯-৪০ কিংবা তারও বেশি। গায়ের রঙ শ্যামলা হলেও আগের থেকে ফর্সা হয়েছে একটু। অর্থাৎ ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে ছেলের মধ্যে তদ্রূপ ব্যক্তিত্বেও। নিজের ছেলেকে নিজেই দেখে মুগ্ধ হলেন এবং গর্বে বুকটা কেমন ফুলেফেঁপে উঠলো।
“কী হয়েছে?”
কপাল কুঁচকালেন।
“ওরা কোথায়?”
“কেন?”
বাবার ত্যাঁড়া প্রশ্নে মেজাজ খারাপ হলো ধ্রুবর।
“বলেছি কোথায়?”
আসাদ সাহেব ইচ্ছে করেই ছেলের মেজাজ বিক্ষিপ্ত করার চেষ্টা করছেন।
“তুমি জেনে কী করবে?”
দায়সারা প্রতিত্তোরে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো ধ্রুবর।
“ফাজলামো করছেন আমার সাথে?”
চেঁচিয়ে উঠে টি টেবিলের মধ্যে লাথি মা’রলো।
“খবর্দার! তুমি আমার সামনে বেয়াদবি করবে না!”
গর্জে উঠলেন তিনি। হাত মুষ্টিবদ্ধ করলো ধ্রুব।
“ওরা কোথায় গিয়েছে?”
“যেখানে ইচ্ছে সেখানে তোমাকে বলবো কেন?”
আতঙ্কিত হয়ে রইলেন দিলরুবা খাতুন। একের পর এক কী সব হচ্ছে বাসায়। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললেন।
“অবশ্যই আমাকে বলতে হবে।”
“কে তুমি?”
চোয়াল শক্ত করে জিজ্ঞেস করলেন।
“নাটক করছেন আমার সঙ্গে?”
“আমি না তুমিই করছো আমাদের সঙ্গে।”
একটা ফুলদানিতে লাথি মা’রতেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। তেঁতে উঠলেন আসাদ সাহেব।
“কী হচ্ছে এইসব?”
“ধূসর নিশুকে নিয়ে কোথায় গেল?”
“তা জেনে তোমার কী লাভ?”
“ফাজলামো করছেন?”
“তুমি তো নিশুকে সহ্য করতে পারো না তাই ভাবছি ধূসরের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিবো। কারণ নিশুর সুখে-দুঃখে,অসুস্থতায় সবসময়ই ধূসরই ছিল। আর নিশুকে ধূসরই ভালো বুঝে। ওদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং ভালো।”
ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে আগুনে ঘি ঢাললেন আসাদ সাহেব। বলতে দেরি তো কাঠের টুল দিয়ে টিভি ভাঙ্গতে দেরি হলো না।
“কী হচ্ছে এইসব! কত বড় সাহস তোমার!”
“এই নাটকটা আপাতত বন্ধ করুন। আপনার ড্রামাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছি আমি। ডিভোর্স লেটার নিয়ে একবার করলেন এক কাহিনী।”
“আমি করেছি মানে তুমিই তো তোমার মাকে বললে ডিভোর্স লেটার রেডি করতে।”
“বলেছিলাম। তখন আপনি চিট করলেন কেন? চিট না করলে আমাদের পথ আলাদা থাকতো।”
“কী চিট করলাম?”
দাঁতে দাঁত চাপলো ধ্রুব।
“না জানার ভান করছেন কেন?”
“বুঝতে পারছি না।”
“নিজেকে খুব চালাক ভাবেন?”
“তুমি আমাকে জন্ম দিয়েছো আমি চালাক কীভাবে হই?”
“মশকরা করছেন?”
“সোজাসুজি বলো?”
“ওইটা আদেও আসল ডিভোর্স লেটার ছিল?”
“আমি কী জানি?”
চোয়াল শক্ত করলো ধ্রুব।
“নকল ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে মজা নিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন কিছু বুঝবো না?”
“আমি ভাবলাম তুমি এখনও ফিডার খাও।”
রাগে কাঁপতে লাগলো ধ্রুব।
“এখন দেখছি তোমার মাথায় বুদ্ধিসু্দ্ধি হয়েছে একটু।”
কপালের শিরাগুলো ফুলে নীল হয়ে উঠলো। গুরুত্ব দিলেন না আসাদ সাহেব।
“নাটকটা কেন করলেন?”
নীরব রইলেন তিনি।
“নাটকটা না সাজালে নিশু অসুস্থ হতো না। নিশুর অসুস্থতার জন্য আপনি দায়ী।”
খেঁকিয়ে উঠলেন আসাদ সাহেব।
“আমি নাটক করেছি বলে আমি দায়ী তুমি দায়ী না?”
“ফেইক পেপার দেখে সাইন করতে নিয়েও তাচ্ছিল্যতা এলো তাই আর করিনি।”
“আচ্ছা করোনি। নিশুর অসুস্থতার জন্য আমি দায়ী তাহলে সাড়ে এগারো বছরের মধ্যে কয়বার ওর খোঁজখবর নিয়েছো তুমি? এখন তো ইন্টারনেটের যুগ!”
“নিই নাই মানছি আমার অপরাধ। ও যে অসুস্থ আমাকে জানিয়েছেন?”
“আমরা কেন জানাবো? আমাদের ঠেকা পড়েছে?”
টুল দিয়ে এক্যুরিয়ামে আঘাত করতেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল।
“বেয়াদবির মাত্রা বেড়ে গিয়েছে তোমার।”
“ঠেকা না পড়লে বারবার জোরজবরদস্তি করে বিয়ে করালেন কেন?”
“সব দোষ আমার এখন তুমি ডিভোর্স দিয়ে দাও। ধূসর নিশুকে বিয়ে করবে সমস্যা কোথাই!”
অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল ধ্রুব। স্টার্ট দিলো গাড়িতে। গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন আসাদ সাহেব।
“এইসব কী শুরু করলেন আপনি?”
অসন্তুষ্ট দিলরুবা খাতুন।
“কী করলাম?”
“এত নাটকের কী দরকার ছিল?”
“মানছি সব দোষ আমার। ডিভোর্স লেটার ফেইক ছিল। কিন্তু তোমার ছেলের হাত-পা আমি আঁটকে রেখেছিলাম? ওর মুখ চেপে রেখেছিলাম?”
“ওতো এমনই অভিমানী,একগুঁয়ে আবার ঘাড়ত্যাড়াও।”
“নিজের দোষ আমার উপর চাপালেই হলো? আমি যা করেছি তাদের দূরত্ব ঘুচানোর জন্য করেছি। তোমার ছেলেই ইগো নিয়ে রইলো। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর আমাকে একটা ফোন পর্যন্ত করেনি তো আমি করবো কেন?”
নীরব রইলেন দিলরুবা খাতুন।
“নিশু অসুস্থ হয়েছে তুমি জানিয়েছো ওকে? তুমি তো ওর সঙ্গে প্রতিদিন কথা বলতে।”
“কীভাবে বলবো? ও ঠিক মতো এক মিনিটও কথা বলে না একটু বলেই ফোন রেখে দেয়।”
“তাহলে আমার দোষ দিচ্ছ কেন?”
মায়াকুমারী পর্ব ৩৮
“এখন ওরা কোথায়?”
“জানি না। ইতিমধ্যেই প্রায় ২০ লক্ষ টাকা তোলা শেষ। এত টাকা দিয়ে কী করছে তোমার ছেলে?”
“কী বললেন?”