মায়াকুমারী পর্ব ৪৬
মেহেরিন আনজারা
সকাল গড়িয়ে প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। অথচ ধ্রুব-নিশুর কোনো সাড়া-শব্দ নেই। চিন্তায় কুঁকড়ে উঠলেন দিলরুবা খাতুন। দোনোমোনো করে দ্যুতিকে বললেন,”ওরা নাস্তা করবে না রে?”
“জানি না আম্মু।”
“অনেক বেলা হলো।”
নীরব রইল দ্যুতি।
“একটু ডাক তো।”
বারবার ডাকলেও কোনো সাড়া মেলেনি। পরিবেশ হঠাৎ ভারী হয়ে উঠল। ধূসর-ধীরাজ চুপচাপ,আসাদ সাহেব চোখ বুজে আধশোয়া হয়ে আছেন। দিলরুবা খাতুনের উৎকণ্ঠা বাড়তেই বললেন,”একটা ফোন করে দেখ না,বাবা।”
ফোন বের করে ধ্রুবকে ডায়াল করল ধূসর কিন্তু সুইচড অফ।
“সুইচড অফ।”
আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল সবার ভিতরে। আর দেরি না করে রিসিপশন থেকে অতিরিক্ত চাবি এনে কেবিনের দরজা খোলা হলো। ভেতরে ঢুকেই চমকে গেল সবাই। শুধু নিশুকে দেখা গেল বিছানায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ধ্রুব নেই!
“নিশু! নিশু!”
বাহু ধরে ঝাঁকাতে লাগল দ্যুতি কিন্তু কোনো সাড়া নেই। চারদিকে থমথমে নীরবতা। বিছানার পাশে রাখা ঘুমের ওষুধ চোখে পড়তেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল।
“হায় আল্লাহ!”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
তড়িঘড়ি ডাক্তারকে খবর দেওয়া হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক্তার এসে পৌঁছালেন। কেবিনের ভেতরে তখন অদ্ভুত নীরবতা। ডাক্তার তৎপর ভঙ্গিতে স্টেথোস্কোপ লাগালেন নিশুর বুকে। সবার দৃষ্টি উনার হাতের দিকে স্থির। নিঃশ্বাস যেন আঁটকে আসছে সবার। কয়েক মুহূর্ত পর তিনি নিশুর চোখের পাতা তুলে টর্চলাইটের আলো ফেললেন,নাড়ি পরীক্ষা করলেন। কোনো উত্তর দিলেন না সঙ্গে সঙ্গে। সবাই আরও বেশি ভয়ে কেঁপে উঠল। অবশেষে ডাক্তার মুখ তুলে গম্ভীর স্বরে বললেন,”উনি এখন গভীর সেডেটিভে আছে। বেশ অনেক ডোজ নিয়েছে মনে হচ্ছে তবে চিন্তার কিছু নেই। আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি।”
কথাটি বলেই তিনি নার্সকে ইনজেকশন আর স্যালাইনের ব্যবস্থা করতে বললেন। দিলরুবা খাতুন বুক চাপড়ে উঠলেন,”আল্লাহ! এরা কি পাগল হয়ে গেল নাকি! ধ্রুব আবার কোথায় গেল?”
কেবিনের ভেতর একদিকে নিশুর নিস্তেজ দেহ আর মেডিসিনের গন্ধ,অন্যদিকে ধ্রুবের রহস্যজনক অন্তর্ধান- সবাইকে এক অদৃশ্য আতঙ্কে বেঁধে রাখল।
দীর্ঘ সময় পর জ্ঞান ফিরল নিশুর। ধ্রুবর কথা মনে পড়তেই চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে হুহু করে কেঁদে উঠল। বিচলিত হলেন দিলরুবা খাতুন।
“নিশু,কী হয়েছে তোদের? সব তো ঠিকঠাক দেখলাম। আর ধ্রুব কই?”
“তোমার ছেলে তার প্রেমিকার কাছে চলে গিয়েছে।”
“কী!”
“হ্যাঁ,ফুপি।”
বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন তিনি। কথা আঁটকে গেল গলায়। বাকিরা নীরবে তাকিয়ে রইল।
“তোকে বলে গিয়েছে?”
“হুম।”
“কী বলেছিল?”
উনার বুকের ভিতর ধকধক করছে অজানা আতঙ্কে।
“বলল,জরুরি কাজে যাচ্ছে। জরুরি আর কী,ওর প্রেমিকার কাছেই গিয়েছে আমি শিওর।”
বলেই দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রাখল। কিছুক্ষণ শব্দ বেরোল না। শুধু দমকা কান্নায় কাঁপছিল শরীর। আবারও হু-হু করে কান্নায় ভেঙে পড়ল নিশু।
“আমি বিশ্বাস করেছিলাম তাকে। ভেবেছিলাম আমিই ওর সবকিছু অথচ আজ বুঝলাম,আমি শুধু একটা ভুল। ও আমাকে ভালোবাসতে পারেনি,ফুপি।”
কেবিনের বাতাস ভারী হয়ে উঠল। দিলরুবা খাতুন চোখ নামিয়ে রাখলেন,কিছু বলতে পারলেন না। দ্যুতি একপাশে দাঁড়িয়ে আড়াল করে চোখ মুছল। ধূসর-ধীরাজ যেন পাথর হয়ে গিয়েছিল। অবসন্ন বিষাদ মুখে বেরিয়ে আসাদ সাহেবের কেবিনে ঢুকলেন দিলরুবা খাতুন।
“নিশুর জ্ঞান ফিরেছে,দিলরুবা?”
উদ্বিগ্ন ছিলেন তিনি।
“হ্যাঁ।”
“জানতে পেরেছ কিছু?”
“হ্যাঁ। আমেরিকা গিয়েছে।”
চমকালেন।
“মানে?”
“নিশু বলল,ও নাকি ওর প্রেমিকার কাছে গিয়েছে।”
চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। দমবন্ধ গলায় ফুঁসে উঠলেন তিনি।
“দিলরুবা,তোমার ছেলেকে আমি আর ক্ষমা করব না। ও কী বোঝাতে চাইছে আমাকে?”
“আপনি উত্তেজিত হচ্ছেন কেন চুপ থাকুন!”
“আমার মান-সম্মান,আমার ইমোশন নিয়ে তোমার ছেলে খেলা করছে!”
“চুপ থাকুন,দেখি কী হয় আগে।”
“কী আর হবে! বাটপার ছেলে কোথাকার! একবার সামনে আসুক,ওকে আমি দেখে ছাড়ব।”
“ঘুমান,এত কথা বলার দরকার নেই।”
রাগে গজগজ করতে লাগলেন আসাদ সাহেব। ক্ষোভে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,”ধৃষ্টতার সীমা নেই তোমার ছেলের! ও যদি সত্যিই প্রেমিকার কাছে যায়,তাহলে আমি কসম খাচ্ছি- ওকে ছাড়ব না। ও চিনে না আমাকে।”
“শান্ত হোন। শুধু নিশুর কান্নায় ভেসে সিদ্ধান্তে আসা ঠিক নয়। ধ্রুবর আসল অবস্থান জানতে হবে আগে।”
তবু রাগ থামল না আসাদ সাহেবের। কক্ষের ভেতর যেন হঠাৎ বজ্রপাতের পর নিস্তব্ধতা নেমে এলো। নিশুর কান্নার শব্দই শুধু ভেসে আসছিল।
রাতের আঁধার ভেদ করে উড়াল দিয়েছিল ধ্রুবর ফ্লাইট। জেটের জানালায় মুখ ঠেকিয়ে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলছিল। নিশুর মুখটা বারবার ভেসে উঠছিল। কান ভরে শুধু ইঞ্জিনের গর্জন। আর বুক ভরে অস্থিরতা। বেশ কয়েক ঘন্টার ঝড়ো ভ্রমণ শেষে অবশেষে ক্যালিফোর্নিয়ার আকাশে ভেসে উঠল প্লেন। ল্যান্ডিং মুহূর্তে ধ্রুবের পা ভারী হলেও,মন-প্রাণের জোরে এগোল। এম্বুল্যান্সের হর্ন বাজতে বাজতে হাসপাতালে ছুটছে। জ্যাম,রোড,ট্রাফিক- সবকিছু যেন নীরব হয়ে ধ্রুবকে পথ দেখাচ্ছিল। মুহূর্ত কয়েকের মধ্যেই ধ্রুব হাসপাতালের হোয়াইট করিডরে প্রবেশ করল। বন্ধুরা পাশে দাঁড়িয়ে হাসপাতালের কর্মীদের সঙ্গে সমন্বয় করছে। ধ্রুব দ্রুত এগিয়ে গেল,বন্ধুদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করল। ধ্রুব জানতো,সময়ের প্রতিটি সেকেন্ড এখন অমূল্য। হাসপাতালের আলো,ডাক্তারদের দৌড়ঝাঁপ,মেশিনের বীপ- সব মিলেমিশে এক অদ্ভুত উত্তেজনা তৈরি করেছে। ডাক্তাররা দ্রুত ধ্রুবকে পরিস্থিতি জানাল।
পলিমেডিকেশন,মনোচিকিৎসা এবং পর্যবেক্ষণ জরুরি। ধ্রুব একটুও দেরি না করে সব আনুষ্ঠানিকতা মেনে হাসপাতালের কক্ষে ঢুকল। নাড়ি মেপে,ভেন্টিলেটরের শব্দ শুনে,মেডিকেল চার্টের দিকে তাকিয়ে ধ্রুব বুঝল এ মুহূর্তে শুধু তার উপস্থিতিই বুশরার জন্য শক্তি হতে পারে। পিটপিট করে তাকাল বুশরা। ধ্রুবকে দেখতেই আকস্মিক ডেকে উঠল,”ধূসর!”
থমকাল ধ্রুব। হ্যাঁ অবশ্য তারা দু’ভাই দেখতে প্রায় একইরকম। তবে সে শ্যামলা ধূসর তার মায়ের মতো ফর্সা। আর জিম করার কারণে তার বডি ফিটনেস ধূসরের চেয়েও বেশ উন্নত। মাঝেমধ্যে কণ্ঠস্বরও আলাদা করা যায় না ওদের তিন ভাইয়ের।
“আমি ধ্রুব।”
চমকে তাকায় বুশরা।
“চিন্তা করো না ঠিক হয়ে যাবে,আমি থাকব তোমার পাশে।”
টুপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
প্রায় ৩০ ঘন্টা পার হয়ে গেল অথচ বুশরার কোনো খোঁজ পেলেন না ইফতেখার মির্জা। হতাশা আর ভয়কে কাঁধে নিয়ে ছুটেছিলেন শহরের চতুর্দিকে। যেন উনার ছেলে-মেয়েরা আকাশে উড়ে গিয়েছে। এক দিকে ছেলে,অন্য দিকে মেয়ে- দুই প্রাণ যেন বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছে। পাগলের মতো খুঁজতে লাগলেন রাস্তায়,পার্কে,সেতুর ধারে কিন্তু কোথাও কোনো ইঙ্গিত নেই। পুলিশ স্টেশন ঘুরেও কোনো লাভ হলো না। ফরহাদ নিজেও ক্লান্ত,হাত-পা ভারী হয়ে আসছে দুশ্চিন্তায়। গোল্ডেন গেট ব্রিজের আশেপাশে ঘুরেও কোনো খোঁজ পেল না। হৃদয় অবিশ্বাস আর আতঙ্কে ব্যথিত,ইফতেখার মির্জার চোখের আলোও যেন নিভে গিয়েছে।
মোটামুটি সুস্থ বুশরা। ধ্রুব স্যুপ কিনে আনল। মগে ঢেলে বুশরার হাতে দিলো। ধীরে ধীরে মগে চুমুক দিতে লাগল। সু’ইসাইডের বিষয়টি পুলিশকে জানানো হয়েছিল। ধ্রুবর বন্ধুরা জানিয়েছে,আপাতত বুশরার খোঁজ কাউকে না জানানোই ভালো। অনেক সময় মেয়েরা পারিবারিক চাপের কারণে চরম হতাশায় ভুগে এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। পুলিশ সিদ্ধান্ত নিলো প্রথমে বুশরা থেকে সব তথ্য জানবে,তারপরই প্রয়োজন হলে পরিবারকে বিষয়টি বোঝানো হবে। তবে ধ্রুব আসার পর থেকে বুশরার সঙ্গে তেমন গভীর কথোপকথন হয়নি,মাত্র দু-একটি বাক্য ছাড়া। কিছুটা ফুরফুরে দেখে ধ্রুব জিজ্ঞেস করল,”এখন কেমন ফিল করছো?”
“ভালো।”
“এমনটা কেন করলে জানতে পারি? না বলতে চাইলে বলো না।”
বুশরা ইতস্তত করল পরক্ষণেই বলল,”আব্বু জোর করে বিয়ে দিচ্ছিলেন।”
“কার সঙ্গে?”
“আমার কাজিনের সঙ্গে।”
“পছন্দ না হলে বলতে পারতে।”
“তারা আমার কথা শুনতে চায়নি,কেউই। নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল।”
“বোকা মেয়ে! তাই বলে সু’ইসাইড করবে?”
“এই ছাড়া আর কিছু করার ছিল না।”
“আমার ফ্রেন্ডরা যদি না থাকতো তাহলে কী হতো!”
“কী আর হতো মরে যেতাম। এতক্ষণে হয়তো দাফনও হয়ে যেত।”
অশ্রু ঝরে পড়ল,ইমোশনাল হয়ে কাঁদতে লাগল।
“বাবা-মা কখনো সন্তানের খারাপ চায় না।”
“তাই বলে অপছন্দের মানুষের সঙ্গে জোর করে বিয়ে দিবে?”
ধ্রুব কিছু বলতে পারল না।
“মানিয়ে নিতে একসময়।”
“কীভাবে? আমি তো মন একজনকে দিয়ে দিয়েছি বহু বছর আগে আজ-কালকার নয়।”
ধ্রুবের আমেরিকা ফিরে যাওয়াটা সবাই নিশ্চিত। আসাদ সাহেবের নীরবতা এখনও অটুট,যেন ঝড়ের আগের নিঃশ্বাস নীরব,অস্থির এবং পূর্বাভাসহীন। দিলরুবা খাতুন চিন্তায় ব্যস্ত- মন অস্থির,কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার শক্তি নেই। দুটো মেয়ের অবস্থা উনাকে আরও দিশাহীন করে তুলেছে। কেন ধ্রুব এমন করল তা বোঝা উনার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘশ্বাস বেরোচ্ছে,যেন সমস্ত চাপ উনার বুক ছিঁড়ে বেরোতে চায়। নিশুও মনমরা হয়ে আছে। সে গুমরে গুমরে কাঁদছে,চোখে অশ্রু জমে জমে। কোনো সান্তনার শব্দ তার কাছে পৌঁছাচ্ছে না। কেবিনটা যেন নীরবতার সাগরে হারিয়ে গিয়েছে,আর সবাই কেবল নিজেদের অস্থিরতা ও বেদনায় ভেসে চলেছে।
“দিলরুবা,শুনছো?”
“বলুন।”
“একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম।”
“কী?”
“একজন লইয়ার ডাকো।”
“কেন?”
“এত টানা-হেঁচড়ার দরকার নেই,ডিভোর্সটা বরং হয়ে যাক।”
“পাগল হয়েছেন আপনিও কী বলেন এইসব?”
“ধূসরের সাথে নিশুকে বিয়ে দিয়ে দিবো ভাবলাম।”
“মাথা ঠিক আছে আপনার,সারা জীবন নিশুকে বড় ভাইয়ের বউয়ের চোখে দেখে এসেছে ও।”
“পরে ঠিক হয়ে যাবে।”
“একটু সময় নিন। হুটহাট কিছু করার দরকার নেই।”
“না দিলরুবা,আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না।”
“কী শুরু হয়েছে এইসব,শান্তি পাচ্ছি না আমি!”
সুস্থ হলো বুশরা এবং ডিসচার্জ পেল। বিল পে করে হসপিটাল থেকে বেরোল দু’জন।
“চলো,তোমার ভাইকে দেখে আসি।”
“না।”
“কেন?”
“সেখানে গেলে ঝামেলা হবে। মানে আমার বাবা ঝামেলা করবে এটা শিওর।”
“চিন্তা করো না,আমি আছি।”
“না। আমি আপনাকে ঝামেলায় ফেলতে চাই না।”
উবার ডাকল ধ্রুব। হাত ধরে বুশরাকে নিয়ে গাড়িতে উঠল। গাড়ি চলতে শুরু করল,শহরের আলো ফিকে হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল প্রতিটি সেকেন্ড যেন আরও চাপময় হয়ে উঠছে। ধ্রুব নিঃশব্দ আর বুশরা ভীতসন্ত্রস্ত। হসপিটালে পৌঁছতেই ওরা আইসিইউর সামনে আসতেই সিফাতকে দেখতেই হকচকিয়ে উঠল বুশরা। ধ্রুব তাকাল না; গাল বাঁকিয়ে সিফাত বিড়বিড় করে বলল,”হ্লার এটিটিউড দেখ! হ্লার এটিটিউডের মাইরে বাপ!”
শুনলেও নীরব রইল ধ্রুব। নার্স রুম থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আকস্মিক ভেতরে ঢুকে গেল সিফাত। ফোনে চার্জ নেই,অনেক কষ্টে একটা চার্জার জোগাড় করল। বুশরা ভীত,তার বাবা-মাকে দেখল না। ধ্রুব দ্রুত অনিকের স্পেশাল নার্সের সঙ্গে কথা বলে ভেতরে ঢোকার পারমিশন পেল। চার্জার হাতে নিয়ে সুইচ খুঁজতে লাগল সিফাত। একটি বিশাল বড় বোর্ডের দিকে চোখ পড়তেই ভ্রু কুঁচকাল।
“হ্লার কত সুইচ লাগাইছে রে! কারেন্ট বিল উঠতাছে সমানে। মাইরে বাপ!”
সেখান থেকে একটি লাইনের সুইচ খুলে ফোন চার্জ দিলো। তারপর ফোনে চার্জ ঠিক হচ্ছে কিনা দেখে,গান গাইতে গাইতে বেরিয়ে গেল।
“বিন্দাসে দিল! হায় মুশকিল!”
ফের সিফাতের মুখোমুখি হলো ওরা। ও বেরুতেই ভেতরে ঢুকল ওরা। রুমে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ ওরা দেখল,মেশিনগুলো অস্থিরভাবে টিকটিক করছে। লাল লাইট ঝলমল করছে,স্যালাইন পাম্প অনিয়ন্ত্রিত গতিতে কাজ করছে। অনিকের বুকের ওঠা-নামা অসম্পূর্ণ,শ্বাস ঠিকমতো যাচ্ছে না। চোখে কাঁচা আতঙ্ক। ধ্রুব ও বুশরা দু’জনেই থমকে গেল হঠাৎ। ঠিক কী হলো বুঝে উঠতে পারল না। এদিকে নার্সও কোথায় চলে গেল। দিকবিদিকশুন্য হয়ে গেল ধ্রুব। কাঁদতে লাগল বুশরা। কেন এমনটা হচ্ছে তাদের সাথে? চতুর্দিকে তাকাল ধ্রুব। হঠাৎ চোখ পড়ল সিফাতের ফোনের দিকে এবং দেখল একটি লাইনের সংযোগ খোলা। মুহূর্তের মধ্যে বুঝতে পারল কোনো সুইচ বা সংযোগ খুলে ফেলার কারণে লাইফ সাপোর্টের ফাংশন স্থগিত হয়ে গিয়েছে। মুহূর্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। দ্রুত লাইনটি তুলে লাগিয়ে দিয়ে ফোনটি আছাড় দিতেই ভেঙে গেল।
মেশিন আবারও টিকটিক করতে শুরু করল। যেন অনিকের মতো মেশিনও প্রাণ ফিরে পেল। অনিকের বুক ধীরে ধীরে স্বাভাবিকভাবে ওঠা-নামা করতে লাগল। শ্বাস ফিরতে শুরু করল। বুশরা হাত ধরে দাঁড়িয়ে,চোখে অশ্রু ধরে,বুক ভরে শ্বাস নিতে পারল না। ভেতরের প্রতিটি সেকেন্ড ছিল টানটান- মৃত্যু আর জীবনের মাঝের অদৃশ্য সীমা। ঠিক তখন রুমে ঢুকল নার্স। মেজাজ খারাপ হলেও নীরব রইল ধ্রুব। তবে নার্সের চোখে উদ্বেগের ছাপ,দ্রুত অনিকের শ্বাস পরীক্ষা করল। রুমে থাকা সকলেই বুঝল এই মুহূর্তে সাহস,দ্রুত সিদ্ধান্ত এবং ধ্রুবের উপস্থিতি ছাড়া জীবন ফিরে আসতো না। ভীতির ছাপ এখনও রুমে বিরাজ করছে কিন্তু সেই সঙ্গে এসেছে জীবনের স্পন্দন,জীবনের ছোট্ট জয়। বুশরা ধীরে ধীরে অনিকের দিকে তাকাল। মেশিনের টিকটিক,বুকের ওঠা-নামা,নার্সের দ্রুত পদক্ষেপ- সব মিলিয়ে রুমে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি আর উত্তেজনার সংমিশ্রণ বিরাজ করল। সত্যিই এমন মুহূর্তগুলোতে বোঝা যায় জীবন কতটা সংবেদনশীল এবং এক মুহূর্তের সাহস,দ্রুত সিদ্ধান্ত ও সহানুভূতি কতটা বড় শক্তি হতে পারে। মেশিনের ছন্দ আবারও স্বাভাবিক হলেও কারও বুকের ভিতর ছন্দ ফেরেনি। বুশরা অনিকের হাত শক্ত করে ধরে রইল,ঠোঁট কাঁপছে নীরব কান্নায়। ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছে মূর্তির মতো,চোখ সরু হয়ে গিয়েছে চিন্তা আর উৎকণ্ঠায়। হঠাৎ খুব সূক্ষ্মভাবে অনিকের আঙুল নড়ল। এতটাই হালকা যে মনে হচ্ছিল বাতাসের চাপের ভুলভ্রান্তি। কিন্তু বুশরার হৃদয় এক ঝটকায় কেঁপে উঠল।
“ভাইয়া.. হাত নড়ল!”
চিৎকারের মতো ফিসফিসে বেরিয়ে এলো ওর গলা থেকে। ধ্রুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আবারও অনিকের আঙুল নড়ল। এবার স্পষ্ট। নার্স তড়িঘড়ি করে এগিয়ে এলো,চোখের পলক পরীক্ষা করল,শ্বাসের হার মাপল। কয়েক সেকেন্ডের ভিতরেই অনিকের চোখের পাতায় কাঁপন দেখা দিলো। অস্থির টিকটিকের মাঝেই যেন সবার বুকের ধুকপুকানি মিশে গেল। ধীরে ধীরে চোখ ফাঁক হলো। ম্লান আলো ঢুকে পড়ল তার চেতনায়। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা কিন্তু নিস্তব্ধতা ভেঙে জীবনের ডাক শুনল চারপাশ। বুশরা হাঁপিয়ে কেঁদে উঠল,”ভাইয়া! ভাইয়া! ও ভাইয়া,তুমি শুনতে পাচ্ছ?”
অনিকের ঠোঁট কেঁপে উঠল। শুষ্ক ঠোঁটে একরাশ অস্পষ্ট শব্দ জমে রইল। শ্বাস নিতে কষ্ট হলেও বুক এবার ছন্দে উঠছে-নামছে। নার্স উৎকণ্ঠার মাঝেই হাসল।
“দেয়ার রেসপন্ডিং! স্লোওলি কমিং ব্যাক।”-(তিনি রেসপন্স করছেন! ধীরে ধীরে ফিরছেন।)
কয়েক কদম এগিয়ে অনিকের মুখোমুখি দাঁড়াল ধ্রুব। অনিকের দৃষ্টি ধীরে ধীরে স্থির হলো। ঘোলাটে চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। ঠোঁট নড়েচড়ে উঠল। কিছু একটা বলার চেষ্টা করল বোধহয় কিন্তু স্পষ্ট হলো না। তবে শব্দটা অস্পষ্ট হলেও রুম কেঁপে উঠল আবেগে। বুশরা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। তার মাথা গুঁজে দিলো ভাইয়ের বুকে। ধ্রুবের বুক থেকে চাপা নিঃশ্বাস বেরোল। সে নিজের অজান্তেই অনিকের কপালে হাত রাখল। মেশিনের টিকটিক,শ্বাসের শব্দ,কান্নার ভাঙা আওয়াজ- সব মিলে যেন মৃত্যুর অন্ধকার ভেদ করে জীবনের আলো ঝলসে উঠল সেই মুহূর্তেই। নার্স চিৎকার ডাক্তারের টিমকে ডাকল।
চারদিকে দৌড়ঝাঁপ শুরু হলো। কিন্তু অনিকের চোখে তখনও আঁটকে ছিল একটিই দৃশ্য- বোনের মুখ,অশ্রুসিক্ত অথচ ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। ফিসফিস করে আবারও কিছু বলার চেষ্টা করল,তবে না শোনা গেলেও যেন সেই অস্পষ্ট শব্দটি আইসিইউ রুমের প্রতিটি দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলল। এ যেন মৃত্যুর সাথে রক্তক্ষয়ী লড়াই শেষে জীবনের নিরঙ্কুশ জয়। খবর পেতেই একপ্রকার দ্রুত ছুটে এলো ডাক্তারের টিম। একসাথে কয়েকজন দ্রুত মেশিন চেক করতে লাগল। কারও হাতে ইনজেকশন,কারও হাতে স্টেথোস্কোপ। মুহূর্তেই কোলাহল শুরু হলো রুমের মধ্যে। একজন ডাক্তার অনিকের চোখের পাতা টেনে পরীক্ষা করলেন। তারপর দ্রুত মাথা নেড়ে বললেন,”ইয়েস! রেসপন্স ক্লিয়ার। দ্য পেশেন্ট ইজ রিকভারিং কনশাসনেস।”-(হ্যাঁ! রেসপন্স ক্লিয়ার। রোগী কনশাসনেস রিকভার করছে।”
অন্যজন স্টেথোস্কোপে শুনে বললেন,”দ্য ব্রিদিং ইন দ্য চেস্ট ইজ স্লোওলি বিকমিং স্টেডি।”-(বুকের শ্বাস ধীরে ধীরে স্টেডি হচ্ছে।”
ডাক্তারের গম্ভীর অথচ আশ্বাসদায়ী কণ্ঠ যেন সবার বুক থেকে একসাথে দীর্ঘশ্বাস টেনে নিলো। বুশরা তখনও ভাইয়ের হাত ধরে কাঁদছে। তার কান্নায় ভিজে যাচ্ছে বিছানার চাদর। ধ্রুব কাছে এসে ওর কাঁধে হাত রাখল।
“শান্ত হও। তোমার ভাই ফিরেছে। এটাই অলৌকিক।”
অনিকের চোখ আধখোলা। সে বুঝতে পারছে চারপাশের শব্দ,আলো,কণ্ঠস্বর। অচেনা অথচ প্রিয়জনদের আঙুলে স্পর্শ,বুকের ভিতর টগবগে স্পন্দন- সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত নিরাপত্তা অনুভব করল। ডাক্তার এগিয়ে এসে শান্ত কণ্ঠে বললেন,”রিমেম্বার, হি হ্যাজ ফুললি কাম আউট অফ দ্য কোমা, বাট হি নিডস টু রেস্ট। নাও, নন অফ ইউ শুড গেট এক্সাইটেড অ্যান্ড সে এনি থিং। দ্য পেশেন্ট’স বডি অ্যান্ড মাইন্ড আর বোথ উইক। স্লোওলি, এভরিথিং উইল রিটার্ন।”-(মনে রাখবেন,সে পুরোপুরি কোমা থেকে ফিরেছে কিন্তু তাকে বিশ্রাম নিতে দিতে হবে। এখন আপনারা কেউ উত্তেজিৎ হয়ে কিছু বলবেন না। রোগীর শরীর আর মন দুটোই দুর্বল। ধীরে ধীরে সবকিছু ফিরবে।)
ইনজেকশন পুশ করল নার্স। স্যালাইনের গতি নিয়ন্ত্রণ করল। মেশিনের টিকটিক তখন যেন নতুন জীবনের ঘন্টাধ্বনি হয়ে উঠেছে। অনিক ঠোঁট কাঁপিয়ে ফিসফিস করে আবারও কিছু বলার চেষ্টা করল কিন্তু পূর্বের ন্যায় অস্পষ্ট। কেঁদে ফেলল বুশরা আরও জোরে কিন্তু এবার আনন্দের কান্না।
“ভাইয়া! ও ভাইয়া! তুমি ফিরে এসেছ! আল্লাহ্র শুকরিয়া.. আমি ভেবেছিলাম তোমাকে আর পাবো না!”
অঝোরে কাঁদতে লাগল বুশরা। ধ্রুব চোখ নামিয়ে রাখল। তার ভিতরে চাপা আবেগ। অনিকের হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল,”বিশ্রাম নাও।”
অনিক চোখ বন্ধ করল কিন্তু এবার সেটা মৃত্যুর অন্ধকারে ডোবার মতো নয় বরং শান্ত ঘুমে ভেসে যাওয়ার মতো। চারপাশে অশ্রু,ভালোবাসা আর স্বস্তির নিঃশ্বাস মিলেমিশে এক আশ্চর্য প্রশান্তি এনে দিলো। ডাক্তার ইশারা দিলেন বেরিয়ে যেতে। তাই করল ওরা। রুম থেকে বেরুতেই দেখল কড়িডোরে একটি চেয়ারে বসে গান গাইছে সিফাত।
“বিন্দাস এ দিল,বড় মুশকিল
কত যে সুইট সিক্সটিন আশে-পাশে
চোখে স্বপ্ন স্বপ্ন সানগ্লাসে
ছুটে ঝিংকু মামনি আসে
তোর হটি নটি মিনি স্কার্টের ইন্তেজার..
লাভ মি,লাভ মি,লাভ মি
হা লাভমি ও ডিয়ার..”
ঝড়ের মতো এগিয়ে আকস্মিক কোমরে একটি লাথি মারতেই মুহূর্তেই চেয়ার সমেৎ ধপ করে মুখ থুবড়ে মেঝেতে পড়ল সিফাত।
“ওই কোন শ্লা রে! দিলো আমার গানের বারোটা বাজাইয়া!”
আরেকটা লাথি মারতেই গুঙিয়ে উঠল সিফাত। রাগে-জিদে-ক্ষোভে শরীর কাঁপতে লাগল সিফাত।
“ওই কোন শালা!”
সিফাতের উপর জমে থাকা ক্ষোভগুলো ধ্রুবর শরীর থেকে যেন আগুনের মতো বেরোচ্ছে। কলার ধরে টেনে তুলল। চমকে গেল সিফাত,চোখে আতঙ্ক আর অবিশ্বাস। বুশরা থরথর করে কাঁপতে লাগল। এত ভয়ংকর ধ্রুবকে সে এর পূর্বে কখনও দেখেনি। ধ্রুবর চোয়ালে উত্তেজনার শিরা টানটান হয়ে উঠেছে। চোয়ালে ঘুষি মারতেই ছিটকে ফের মেঝেতে পড়ল সিফাত।
“ওই,হ্লা পাগল হইছোস?”
ব্যথায় চিৎকার করে উঠল সিফাত। গর্জে উঠল ধ্রুব।
“আইসিইউ রুমে তোকে ঢুকতে বলল কে?”
“তাতে তোর কী?তোর বাপের কী,হ্লা?”
দাঁত খিঁচে জবাব দিলো সিফাত কিন্তু চোখে ভয়ের রেখা স্পষ্ট। আরেকটা লাথি বসিয়ে দিলো। এবার কণ্ঠ কাঁপছিল তার রাগে।
“কী বললি?”
অগ্নি স্ফূলিঙ্গ বেরুচ্ছে ধ্রুবর চোখ দিয়ে। কাঁপতে লাগল বুশরা। ধ্রুব কি সিফাতকে মেরে ফেলবে নাকি! ভীতসন্ত্রস্ত হলো। এই অগ্নি ধ্রুবকে সে-তো চিনে না!
“হ্লা,এমন রিয়েক্ট করতাছোস মনে হইতাছে আমি না জানি কোন হ্লার সানডে মানডে কোলোজ কইরা দিচি। হ্লা,পাগল!”
চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। মুষ্টিবদ্ধ করল হাত। ধ্রুবর চোখ লাল হয়ে জ্বলছে। সিফাতকে কলার ধরে টেনে তুলে ঝাঁকাতে লাগল।
“তোকে কে বলেছিল আইসিইউতে ঢুকতে?কে বলেছিল সুইচে হাত দিতে?”
“দিলে কী হইছে?”
“কী বললি?”
“কত সুইচ ওইখানে। কারেন্ট বিল উঠতাছে সমানে। বুঝোস কিছু তুই? হ্যাঁ,তুই জানোস না অপচয় করা ভালো না?”
ধ্রুবর ঠিক কেমন রিয়েক্ট করা উচিত ভুলে গেল। দাঁতে দাঁত চাপল।
“ওটা লাইফ সাপোর্টের প্লাগ।”
বিস্ফোরিত হলো সিফাত।
“কী বললি,হ্লা?”
কষিয়ে একটা থাপ্পড় মারল।
“আরে হ্লা,ফোনে চার্জ ছিল না। চার্জারটা দিয়া শুধু লাগাইতেছিলাম। কত সুইচ,কোনটা কী- বুঝি নাই তো! ভাবলাম,একটা খুলে নিলেই জায়গা হয়। আমি কি জানতাম নাকি ওইটাই লাইফ সাপোর্টের প্লাগ!”
ধ্রুবর দাঁত খিঁচিয়ে শব্দ বের হলো,”তুই না বুঝে মানুষের জীবন নিয়ে খেলবি?”
“আল্লাহর কসম! বিশ্বাস কর,হ্লা। আমার ওই রকম কোনো ইন্টেনশন ছিল না! আমি তো জানিই না,ওইটা কী মেশিনের লাইন!”
রাগ কমলো না ধ্রুবর।
“কী হচ্ছে এখানে?”
গম্ভীর স্বর শুনতেই পিছু ফিরতেই দেখল ইফতেখার মির্জা আর ফরহাদ এগিয়ে আসছে। বিস্ফোরিত হয়ে ধ্রুবর পেছনে লুকাল বুশরা। ধ্রুবকে দেখতেই ভ্রু কুঁচকালেন তিনি। মুহূর্তেই মেজাজ খারাপ হলো উনার। পরিস্থিতি মুহূর্তেই আরও ভারী হয়ে গেল। করিডরের বাতাস থমকে গেল। ধ্রুবর শরীর তখনও উত্তপ্ত,বুশরার চোখ ভিজে অশ্রুতে,আর সিফাত আতঙ্কের মাঝখানে কেমন বোকা বোকা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
“এত হৈচৈ কীসের?এটা হসপিটাল বস্তিবাসা নয়!”
আকস্মিক আইসিইউ রুম থেকে বেরোল ডাক্তার।
“কংগ্রাচুলেশনস।”
চমকে তাকায় সবাই। ডাক্তারের মুখে সন্তুষ্টির হাসি। ভ্রু কুঁচকালেন তিনি।
“হোয়াই?”
“দ্য পেশেন্ট হ্যাজ এমার্জড ফ্রম দ্য কোমা,থো রিস্ক ইজ স্টিল দ্যর।”-(রোগী কোমা থেকে ফিরেছে,তবে ঝুঁকি এখনও আছে।)
“হোয়াট!”
অবিশ্বাস্য নয়নে তাকালেন তিনি। যেন এমন কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিলেন না।
“ইয়েস,রিয়েলি!”
থরথর করে কাঁপছে বুশরা। অন্যদিকে ফিরে দাঁড়িয়ে থাকায় উনারা ভাবলেন নিশু কিংবা দ্যুতি যে-কোনো একজন। সিফাতকে ইঙ্গিত করে বলল,”বাট হি ওয়েন্ট টু চার্জ হিজ ফোন অ্যান্ড অ্যাকসিডেন্টালি আনপ্লাগড দ্য লাইফ সাপোর্ট।”-(তবে উনি ফোন চার্জ দিতে গিয়ে লাইফ সাপোর্টের প্লাগটি খুলে দিয়েছিল।)
“কী!”
বিস্ফোরিত হলেন তিনি। আমতাআমতা করল সিফাত।
“মাফ কইরা দেন,আমার ভুল হয়ে গেছে,আঙ্কেল। আমি কী জানতাম,কোন সুইচে কোন লাইন?এত তার,এত মেশিন,মাথা ঘুরতেছিল! আরে বুঝেন না ক্যা এইসব কারেন্ট অপচয় ছাড়া আর কিচ্ছু না। মানে ইচ্ছা কইরা বিল তোলে বুঝেন না ক্যা!”
“মানে,তুই হসপিটালের আইসিইউ রুমে ঢুকে,না বুঝে সুইচ টিপিস?”
মাথা চুলকাল সিফাত।
“হ। মানে,টিপছিলাম না। একটা খুলছিলাম ফোনে চার্জ দেওয়ার লাইগা।”
“এই অসৎ কোথাকার! তাই বলে তুই আমার ছেলের প্রাণ নিয়ে খেলবি?ফোন চার্জে দেওয়ার আর জায়গা পাসনি তুই?”
“ছরি আঙ্কেল।”
“শালার পুত,তোর সরি তোর কাছে রাখ। তোকে না আমি জেলে রেখেছিলাম। বের হলি কীভাবে?”
আমতাআমতা করল সিফাত।
“লাইফ সাপোর্টের সুইচ নিয়ে ছেলেখেলা?এটা কোনো মোবাইল চার্জ দেওয়ার জায়গা না,বুঝলি মূর্খ কোথাকার!”
“বুঝি নাই তো,আঙ্কেল।”
“আজ আমার ছেলের কিছু হলে আমি নিজের হাতে আইনের হাতে তুলে দিতাম তোকে। ফাঁসির দড়িতে ঝুলাতাম।”
ভীত চোখে তাকায় সিফাত।
“ছরি।”
“মনে রাখিস,সব ভুলের ক্ষমা হয় না। বিশেষ করে যে ভুলে কারও জীবন ঝুঁকিতে পড়ে।”
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল সিফাত।
“ছরি আঙ্কেল। আমি আর এমনটা করব না। বিশ্বাস করেন।”
“তুই একটা বিপদ। হাসপাতালে আসাই উচিত না তোর। মূর্খ কোথাকার! লাথি না খেতে সর সামনে থেকে। ফাজিল! অজাত!”
কোমর চেপে ধরে কাতরাতে লাগল সিফাত।
“হ্লা,লাথিটা আস্তে দিতি। জোরে পড়ছে।”
করিডরের পরিবেশ তখনও টানটান। ডাক্তার বুঝতে পারলেন এটা স্বইচ্ছায় খু’নের চেষ্টা নয়,বরং এক বোকা,দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ। করিডরে হঠাৎ এক ভৌতিক নীরবতা নেমে এলো। অনিকের রুম থেকে দূরের মেশিনের টিকটিক শব্দ যেন মৃত্যুর আর জীবনের মাঝের সীমারেখার মতো প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। সিফাত দূরে সরে কোমর চেপে ধরেছে,মুখে ফাঁকা হাসি ঝুলছে যেন নিজের বোকামো ঢাকতে চায়। আঁড়চোখে তাকাতেই হঠাৎ উনার চোখে ধরা পড়ে গেল বুশরা। বিস্ফোরিত হলো দু’জন।
“বুশরা!”
কেঁপে উঠল সে।
“তুমি!”
শ্বাস আঁটকে শক্ত করে খামচে ধরল ধ্রুবর পিঠের দিকটায়। চট করে কয়েক কদম এগিয়ে আকস্মিক বুশরার হাত চেপে ধরলেন ইফতেখার মির্জা।
“কোথায় ছিলে তুমি?”
আতঙ্কিত চোখে তাকায় বুশরা।
“উত্তর দাও।”
“বলব না।”
চোয়াল শক্ত হয়ে গেল উনার। চোখে ঝলমলানো রাগ।
“আমাকে হয়রানি করার পরিণাম ভয়াবহ খারাপ হবে তোমার। চলো,আমার সঙ্গে।”
“ছাড়ো! ছাড়ো আমাকে! কোথাও যাব না আমি!”
বুশরার কণ্ঠে ভয় আর জেদ মিশেছিল।
“তোমার ঘাড় যাবে।”
“যাব না! ছেড়ে দাও।”
বাঁধা দিলো ধ্রুব। হাত শক্ত করে ধরল বুশরার।
“কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন ওকে?”
“তোমাকে বলব কেন?”
“বলতে হবে।”
“সাট আপ!”
চোয়াল শক্ত করল ধ্রুব। বুশরা ব্যাথায় কেঁদে উঠল।
“তুমি বলার কে?”
“ওকে ছাড়ুন,ইফতেখার মির্জা।”
“ওই মুখ সামলে!”
ফরহাদ তীব্র গলায় বলল।
“তুই আমাদের মধ্যে নাক গলাবি না।”
“তাহলে তুই কেন গলাচ্ছিস?”
দাঁতে দাঁত চাপল ধ্রুব।
“ফরহাদ,বুশরাকে বাসায় নিয়ে যাও,আমি আসছি।”
টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতেই চিৎকার করে কাঁদতে লাগল বুশরা।
“ছাড়ো আমাকে! ছাড়ো! আমি কোথাও যাব না!”
মায়াকুমারী পর্ব ৪৫
আকস্মিক পেছন থেকে লাথি পড়তেই ছিটকে পড়ল ফরহাদ। ছুটে এসে ধ্রুবের পেছনে লুকাল বুশরা।
“এত বড় সাহস তোর! তুই জানিস কার গায়ে হাত তুললি?”
“ও যেতে চাচ্ছে না। জোর করছিস কেন?”