মায়াকুমারী পর্ব ৫৪ (২)

মায়াকুমারী পর্ব ৫৪ (২)
মেহেরিন আনজারা

ছুটে গিয়ে দ্যুতি ধ্রুবের দরজায় করাঘাত করতে লাগল।
“ভাইয়া! উঠো.. তাড়াতাড়ি!”
চোখ মেলে চমকে উঠল ধ্রুব। ঘুম এখনও পুরো কেটে ওঠেনি। ভারী চোখে দরজা খুলে দাঁড়াতেই দ্যুতির মুখ দেখতেই আঁতকে উঠল।
“কী হয়েছে?এভাবে ডাকছিস কেন?”
“মেজ ভাইয়া কেমন জানি করছে!”
“মানে?”
“শ্বাস নিতে পারছে না! বুক জ্বালাপোড়া করছে। দ্রুত আসো।”

মুহূর্তেই ধ্রুবের শরীরের ভিতর থেকে ঘুমের আস্তরণ ছিঁড়ে গেল। কানে যেন বজ্রপাত! এক মুহূর্তও দেরি না করে দ্রুত দৌঁড়ে গেল ধূসরের রুমের দিকে। রুমে ঢুকতেই স্থির হয়ে গেল ধ্রুব। ধূসর বিছানায় কাত হয়ে শ্বাস নিতে লড়ছে। বুক ওঠা-নামা করছে অস্বাভাবিক তালে,ঠোঁট নীলচে হয়ে গিয়েছে। নিশু আর বুশরা মিলে তাকে বুকে ঠেকিয়ে শ্বাস ঠিক করার চেষ্টা করছে। তারা দু’জন অসহায়ের মতো কাঁপছে।
“এই কী হয়েছে তোর!”
ধূসরের কানে আদোও পৌঁছাল কিনা বোঝা গেল না। ধ্রুব ছুটে গিয়ে ধূসরের মাথা কোলে তুলে নিলো।
“কী হয়েছে ওর?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কাঁদতে কাঁদতে নিশু বলল,”ভাইয়া বলল তার বুক ফেটে যাচ্ছে।”
ভয়ে জমে গেল ওরা। বুশরা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,”এখন কী হবে?”
“চিন্তা করো না,হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। দ্যুতি,ফোন দে।”
কম্পিত হাতে ধূসরের ফোন তুলে দিলো দ্যুতি। পাসওয়ার্ড জানে না ধ্রুব লক্ষ্য করল ফেস লক। ধূসরের মুখের সামনে ধরতেই লক খুলে গেল। স্ক্রীনে ভেসে উঠল ধূসর,নিশু,দ্যুতি আর ধীরাজের ছবি। মনে হলো ফোকাসটা নিশুর দিকেই বেশি। মিষ্টি করে হেসে রয়েছে নিশু। বেশি কিছু ভাবল না; দ্রুত অ্যাম্বুল্যান্সকে কল দিলো।
“পা..পানি!”

ঝাপসা নয়নে নিশু কাঁপা কাঁপা হাতে পানির গ্লাস এগিয়ে ধরল ধূসরের মুখের কাছে। এক ঢোক গিলতেই হঠাৎ কাশির সঙ্গে বমি ছুটে এলো এবং নিশুর গায়ে পড়ল। সারা শরীর কাঁপতে লাগল নিশুর। বুকের ভিতর ধ্বসে পড়ল আতঙ্কের পাহাড়। ওদের দিকে তাকাল ধ্রুব। নিশু কেমন কাঁপছে,কাঁদছেও। ঘেমে-নেয়ে একাকার,অস্বাভাবিক। বুশরা অনবরত কেঁদেই চলেছে রেলগাড়ির মতো। ঠোঁট চেপে চাপা স্বরে কাঁদছে দ্যুতি। ধ্রুব টিস্যু দিয়ে ধূসরের মুখ মুছে দিলো।

“কাঁদছিস কেন তোরা! ধুর.. কিছু হবে না,সব ঠিক হয়ে যাবে।”
মেয়েদের কোমল মন,ভয় আর চিন্তায় ভারাক্রান্ত,জর্জরিত। ওমন কথায় কি আর ভরসা পায়! পাঁজাকোলে তুলে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল ধ্রুব। ধূসরের নিস্তেজ দেহ যেন তার বুকে ভেঙে পড়ছে। পিছু পিছু বুশরা ও দ্যুতি নামতে লাগল। নিশু সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে,অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে রইল। বুক ছিড়েখুঁড়ে যাচ্ছে তার। নিচে নামার সঙ্গে সঙ্গে বাইরে অ্যাম্বুল্যান্সের সাইরেনের শব্দ দূরের দিকে ঘুম ভাঙানো চিৎকারের মতো ভেসে এলো। ধ্রুব- নিস্তেজ ধূসরের দেহ সামলে লম্বা লম্বা কদম ফেলে অ্যাম্বুল্যান্সের দিকে এগোল। নিভু নিভু চোখে ধূসর বাড়ির দিকে তাকিয়ে রইল। যেন এই বাড়িতে সে আর কোনোদিন ফিরবে না। এটাই বুঝি তার শেষ দেখা। ধ্রুব ধূসরকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে উঠল। সাইরেন শহরের নিস্তব্ধ ভোর ভেঙে ছুটছে। দ্যুতি আর বুশরা স্তব্ধ হয়ে বসে আছে ভেতরে। ধ্রুব ধূসরের হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে।

“চোখ বন্ধ করিস না.. শক্ত থাক।”
ধূসরের বুক ওঠা-নামা করছে অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে। চোখ অর্ধেক খোলা,দৃষ্টি ঝাপসা। ওদের বুক কেঁপে ওঠে প্রতিবার,যেন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। নিশু এখনও ওইভাবেই থমকে রইল। হঠাৎ মস্তিষ্ক ঝাপসা হয়ে গেল। শ্বাস নিতে ভুলে গেল। মস্তিষ্কের ভিতর স্মৃতিগুলো ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘূর্ণন করতে লাগল। সাইরেনের শব্দে হন্তদন্ত হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলেন দিলরুবা খাতুন। রিনাও ঘুম থেকে উঠে আতঙ্কিত হয়ে এগিয়ে এলো।
“নিশু,কী হয়েছে? অ্যাম্বুল্যান্স এলো কেন?”
নিশুর কানে শব্দ পৌঁছেছে কিনা সন্দেহ।
“এই নিশু,কী হয়েছে?”
ঘোর ভাঙল নিশুর। উনার দিকে তাকাল,চোখের পলক ফেলল।

“নিশু,কানে শুনিস না?”
নিশু তাকিয়েই রইল উনার মুখের দিকে।
“এই কী হয়েছে?”
“কোথায়?”
“হায় আল্লাহ.. কারে কী বলি!”
দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলেন দিলরুবা খাতুন। উনার পিছু পিছু গেল রিনা-ও। ততক্ষণে অ্যাম্বুল্যান্স চলে গিয়েছে। তিনি সিকিউরিটি গার্ডকে জিজ্ঞেস করলেন,”কী হয়েছে?”
“আপনার মেজ ছেলেকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে?”
“কী!”
“জি।”

বিনামেঘে বজ্রপাত হলো উনার মাথায়। শ্বাস আঁটকে এলো।
“কে… কেন? কী হয়েছে?”
সিকিউরিটি গার্ড আশ্চর্য চোখে তাকাল। নিজের ছেলের খবর নিজেই জানেন না।
“সেটা জানি না।”
ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেলেন দিলরুবা খাতুন।
“ড্রাইভারকে ডাকো। দ্রুত গাড়ি বের করো।”
সিকিউরিটি গার্ড ড্রাইভারকে ডেকে তুলল। গাড়িতে উঠে বসলেন তিনি। গাড়ি শহরের নিস্তব্ধ ভোরে ছুটতে লাগল। দিলরুবা খাতুন মুখে আঁচল ঢেকে কাঁদছেন। গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। শহরের ভোর,শান্ত বাতাস কিন্তু উনার বুকের ভিতরে অশনি সংকেত বাজছে। যেন পৃথিবীর সব নিস্তব্ধতা উনার ভয়কে আরও বড় করছে। নিশু এখনও ওইভাবেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। চোখ ফাঁকাই যেন মস্তিষ্কে কোনো বাস্তবতা নেই। সবই কেমন ভ্রম। রিনা ফিরে এলো। কণ্ঠে উত্তেজনা মেশানো ভয় নিয়ে বলল,”কী হইছে মাইজ্জা ভাইয়ের?”
নিশু তাকাল।

“মাইজ্জা ভাই কী?”
রিনা বিস্ময়ে চোখ-মুখ কুঁচকে তাকাল।
“মাইজ্জা ভাইরে চিনেন না?”
নিশু কিছুক্ষণ থমকে ভাবল। তারপর নিজের দিকে তাকাল,চোখে কিছুটা ফাঁপা দৃষ্টি।
“না.. আমি কাউকে চিনি না। কে সে?”
রিনা হতবুদ্ধি তাকিয়ে রইল। নিশু নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে বলল,”এটা কী?”
“বমি! বমি করছে কেডা?”
“বমি কী?”
রিনা আরও অবাক হয়ে তাকাল। নিশু ধীর পায়ে নিজের রুমের দিকে এগোল। চোখ ফাঁকা,মনে কোনো বাস্তবতা নেই। রুমের দরজা খুলে চতুর্দিকে তাকাল।
“ওয়াক! পুরো ঘরে গন্ধ! এখানে কি গরু থাকে!”
টেনে টেনে টেবিল থেকে সবগুলো বইখাতা ছুঁড়ে বিনে ফেলতে লাগল।

“বাজে দুর্গন্ধ!”
অ্যার্লাম ঘড়িটা নিয়ে কাঁটা ঘুরাতে লাগল। এরপর বারোটার ঘরে রাখল। এরপর ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াল। নিজেকে কতক্ষণ দেখল।
“তোকে প্রেত্নীর মতো লাগছে! তোর গায়ে গন্ধ!”
নিজেকে নিজে বলতে লাগল।
“তুই প্রেত্নী! তোর চৌদ্দ গুষ্টি প্রেত্নী।”
চোখ বড় বড় করে তাকাল।
“কী বললি!”
আকস্মিক ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় পারফিউমের বোতল ছুঁড়তেই মুহূর্তেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। দ্রুত ছুটে এলো রিনা।
“আল্লাহ গো! কী করতাছে!”
নিশু তাকায়।
“পুরো ঘর ময়লা। সাফ করো।”

গাড়ি হাসপাতালের গেটের কাছে এসে থামল। নিরাপত্তা চেকিং পেরিয়ে দ্রুত ভেতরে প্রবেশ করল। সঙ্গে সঙ্গে স্ট্রেচার নিয়ে এলো দু’জন ওয়ার্ডবয়। ধ্রুব স্ট্রেচারে রাখল না; নিজেই পাঁজাকোলে তুলে দৌঁড়াতে লাগল। ইমার্জেন্সি রুমে ঢুকে বেডে শোয়াতেই মুহূর্তের মধ্যে অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে দ্রুত নিয়ে গেল ডাক্তাররা। কানে এলো ডাক্তারদের চিৎকার,”BP দ্রুত চেক করো! IV লাইন দাও! ECG সেট করো!”

ওদের ঢুকতে দেওয়া হলো না। করিডরে থামিয়ে রাখা হলো। সাদা আলোয় ঝলমল করা দেয়াল আর ঘড়ির কাঁটা যেন স্থির হয়ে গিয়েছে। বুশরা দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। দ্যুতি ওর কাঁধে হাত রাখলেও নিজেই ভিতর থেকে ভেঙে পড়ছে। কিছুক্ষণ পর ধ্রুব বেরিয়ে এলো। কেবল স্তব্ধ চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে রইল যেন পৃথিবী তার ভাষা কেঁড়ে নিয়েছে। এরপর বারবার পায়চারি করতে লাগল। মাথার ভিতর যেন আগুন জ্বলছে। মুহূর্তেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলো এক তরুণ ডাক্তার। মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন,”পেশেন্ট ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে আছেন। শ্বাসকষ্টের কারণে ফুসফুসে চাপ তৈরি হয়েছে। আমরা সব চেষ্টা করছি.. প্রার্থনা করুন।”

মায়াকুমারী পর্ব ৫৪

শব্দগুলো যেন বজ্রপাত হয়ে আছড়ে পড়ল তাদের বুকে। দ্যুতির চোখ ঝাপসা হয়ে এলো,হাতজোড় করে ফিসফিস করল,”আল্লাহ.. আমার ভাইয়াকে বাঁচাও। আল্লাহ.. আমার ভাইয়াকে বাঁচাও।”
ফুঁপিয়ে হু-হু করে কেঁদে উঠল দু’জন। করিডর নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কেবল ভেতর থেকে আসা যন্ত্রপাতির বিপ-বিপ শব্দ আর কাঁচের ওপাশে ধূসরের নিস্তেজ শরীরের ওপর ভিড় করা ডাক্তারদের ছায়া যেন তিনজনের বুকের ভিতরে অশনি সংকেত বাজিয়ে চলল।

মায়াকুমারী পর্ব ৫৫