মায়াকুমারী পর্ব ৫৭ (২)
মেহেরিন আনজারা
আসাদ সাহেবের রুমে ঢুকে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সোফায় বসে পড়ল ধীরাজ। চারদিক ঘিরে যেন চাপা উত্তেজনা; ভারী দেহে পায়চারি করছেন আসাদ সাহেব,ঘরের ভেতর উনার হাঁটার শব্দে মেঝে কেঁপে উঠছে। এক মুহূর্তের জন্য থেমে ছেলের দিকে তাকালেন।
“তোর আম্মা কইরে?”
মোবাইল থেকে চোখ না তুলেই বলল,”আছে কোথাও।”
সন্তুষ্ট হলেন না তিনি।
“সকাল থেকে দেখি না।”
নির্লিপ্ত রইল ধীরাজ। মোবাইলের মধ্যেই মশগুল সে। মেজাজ খারাপ হলো উনার।
“এই তোর পড়াশোনা নাই? সারাদিনের কীসের ফোন চাপোস?”
“আপনার আবার কী হয়েছে?”
কথাটা যেন ছু’রি হয়ে এসে বিঁধল আসাদ সাহেবের কানে। হঠাৎ থেমে দাঁড়ালেন তিনি। চোখে রাগের লাল রেখা টানটান। কণ্ঠে বজ্রপাতের মতো ঝড় নেমে এলো।
“আমার কী হয়েছে মানে! ফাজলামো করো তোমরা সবাই আমার সাথে?”
মাথা তুলে তাকাল ধীরাজ।
“বুঝলাম না আপনি রেগে আছেন কেন?”
“সর সামনে থেকে! অজাতকুজাত কোথাকার! একটাও মানুষ হয়নি- সবগুলো ঘাড়ত্যাঁড়া,বেয়াদব।”
হতবিহ্বল চোখে তাকায় ধীরাজ।
“আমারে মেজাজ দেখায় ছেলেরা! মুড দেখায়!”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
ক্রোধে উনার শরীর কাঁপতে লাগল। বুক থেকে বেরিয়ে এলো দম বন্ধ করা শব্দ,”সত্যি কথা বলেছি,এখন শরীর জ্বলে। কাহিনী! হারামির দলেরা! অসৎ পোলাপাইন! কুজাত!”
রুমের বাতাস হঠাৎ ভারী উঠল। ধীরাজ স্থির হয়ে বসে রইল। ঘরের কোণায় টেবিলের ওপর রাখা পানির গ্লাসটা যেন থরথর করে কেঁপে উঠল। দেয়ালের ফ্যানের ঘূর্ণনেও শীতলতা নেই,মনে হচ্ছে রাগের উত্তাপে সবকিছু দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ বাইরে থেকে পুলিশের গাড়ির সাইরেনের শব্দ ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। ধীরাজ চমকে উঠে ব্যালকনির দিকে এগোল। গাড়ি থেকে পুলিশ অফিসারদের বেরোনোর দৃশ্য তার চোখে ভেসে এলো। ধকধক করতে লাগল হৃদয়। যদিও এমন ঘটনা সে আগেই আন্দাজ করেছিল।
“ওই,কে এসেছে?”
“কেউ না,আপনি রেস্ট করুন। আজেবাজে টেনশন বাদ দিন।”
“দেমাক দেখাও আমার সাথে! কষিয়ে একটা থাপ্পড় মারব গালে যেন একমাস কানে না শোনো। অসভ্য পোলাপান। বের হ চোখের সামনে থেকে।”
রুম থেকে বেরিয়ে ধীরাজ ধ্রুবকে ফোন করে পুলিশ আগমনের কথাটি জানিয়ে নিচে নেমে তাদের দিকে এগিয়ে গেল। তাকে দেখতেই পুলিশ ধ্রুবের অবস্থান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে ধীরাজ তাদের ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে বলল।
খাওয়া-দাওয়া শেষে বিল পরিশোধ করে ডক্টর শুভ্রর কাছে নিশু এবং দ্যুতিকে রেখে দিলরুবা খাতুন আর বুশরাকে সঙ্গে নিয়ে দ্রুত বাসায় ফিরল ধ্রুব এবং পুলিশের মুখোমুখি হলো। বুশরাকে অপহরণ করার অভিযোগ করে ধ্রুবর নামে মামলা করেছেন ইফতেখার মির্জা। তাই তাকে গ্রেফতার করতে এসেছে পুলিশ। তবে ধ্রুব সব পরিস্থিতি আগেই আন্দাজ করে নিয়েছিল। সে শান্তভাবে বুশরার বিয়ের প্রমাণ এবং তার জবানবন্দি পুলিশের কাছে তুলে দিলো। পুলিশ সব শুনে স্তম্ভিত আর কিছু বলার ছিল না। ধ্রুবর ব্যবস্থা দেখে তারা আর কিছু করতে পারল না। এরপর পুলিশ ইফতেখার মির্জাকে ফোন করে ঘটনাস্থল থেকে বিষয়টি জানাতেই যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো উনার মাথায়। তেঁতে উঠেন তিনি। মাথার মধ্যে রাগের অগ্নি ছড়িয়ে পড়ল। বুশরার জবানবন্দির প্রমাণে,পুলিশ আর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারল না। তবে তারা ধ্রুব ও বুশরাকে থানায় যেতে বলল। সায় দিলো ধ্রুব। পুলিশের গাড়ি থানার দিকে এগোতে লাগল। ধ্রুব,বুশরা এবং তাদের সঙ্গে থাকা লোকজন একনিষ্ঠ দৃষ্টিতে সিটে বসে রইল। ইফতেখার মির্জার মস্তিষ্ক টগবগ করতে লাগল। বুশরার বিয়ে হয়েছে- এটি যেন বিশ্বাস করার ক্ষমতা উনার মধ্যে নেই। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো,রাগে-জিদে হাত-পা কাঁপতে লাগল। হসপিটালের বাতাসও যেন উনার ক্রোধে ঘণীভূত হয়ে উঠল। সিফাত কানে ইয়ারফোন গুঁজে গান শুনছিল। ওকে দেখতেই উনার মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেল।
“এই শালারপুত! তুই এখানে কী করিস?”
রাগে লাল চোখে,কণ্ঠে বজ্রপাতের মতো প্রশ্ন। সিফাত হকচকিয়ে উঠে দাঁড়াল।
“কী বললেন?”
“এখানে কেন তুই?”
“তো কী করব?”
“চুপ বেয়াদব! চোখের সামনে থেকে যা বলছি!”
“কই যামু?”
“জাহান্নামে গিয়ে মর! আপদ কোথাকার।”
“তাহলে আপনিও আসেন,আমার একা ভয় করছে।”
“শালারপুত,আমার সাথে মশকরা করছিস?”
“না,সত্যি বলছি।”
“দূর হ! সামনে থেকে সর।”
রাগে গজগজ করতে লাগলেন। বাঁকা চোখে তাকিয়ে সিফাত অদৃশ্য শঙ্কায় সরে গেল। ইফতেখার মির্জা দ্রুত ফোনে চ্যালাপ্যালাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন।
“এক ঘন্টার মধ্যে ওই ছেলে আর ওই খু’নি মেয়ে দুটোর লাশ দেখতে চাই!”
ফোনের ওপার থেকে গম্ভীর ও ভারী কণ্ঠে প্রতিত্তোর এলো,”হয়ে যাবে,স্যার।”
কান থেকে ফোন নামাতেই সিফাত এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়াল।
“শালারপুত,আবার আমার সামনে এলি!”
“দেশে যামু,টিকেটের টাকা নাই। টিকেট কাইটা দেন।”
“কী বললি?”
“কানে শোনেন না? বলছি প্লেন ভাড়া নাই।”
“শালারপুত,ভিক্ষা কর যা।”
“তাইলে আপনেও আসেন।”
পশ্চাৎপদে একটা লাথি মারতেই ছিঁটকে পড়ল সিফাত। ঠিক তখুনি সামনে এসে দাঁড়ালেন আদনীন ফেরদৌস। উনাকে দেখতেই আরও কয়েকগুণ মেজাজ চটল ইফতেখার মির্জার।
“একটা ছেলেমেয়েকেও মানুষ করতে পারলে না। একটা হচ্ছে বিশ্ব পাগল আরেকটা হচ্ছে বিশ্ব বেইমান।”
আদনীন ফেরদৌস কিছু বললেন না শুধু নীরব রইলেন।
ডক্টর শুভ্রর কেবিনে নিস্তব্ধ দুপুর। জানালার কাঁচে আলো হেলে পড়েছে,বাতাসে কেবল ফ্যানের ঘূর্ণন। দ্যুতির কোলে মাথা রেখে নিশ্চুপ শুয়ে আছে নিশু। দ্যুতির আঙুল আলতো করে ওর চুলের ভাঁজে বুলিয়ে যাচ্ছে। চোখে স্বপ্নজড়ানো এক শূন্যতা। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। আনমনা হয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল।
“এত সুখের মাঝেও আমাদের জীবনটা স্বাভাবিক নয় কেন রে,নিশু?”
দ্যুতির কণ্ঠে ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস। পিটপিট করে তাকায় নিশু।
“সব থাকার পরেও কেন যেন মনে হয় অদ্ভুত এক শূন্যতা আমাদের চারপাশকে ঘিরে রেখেছে।”
দ্যুতির চোখ ভিজে ওঠে। নিশু নির্বিকার।
“সব যখন ঠিক হয়ে গেল,তখনই কেন এই অমাবস্যার ছায়া নামল আমাদের জীবনে?”
নিশু কিছু বলল না। দ্যুতির কণ্ঠ জড়িয়ে আসে অশ্রুর ভারে।
“তুই-ই সুখে আছিস,নিশু। মাঝে মাঝে ভুলে যাস,মেমোরি হারিয়ে যায়.. তবু ভালো থাকতে পারিস। কত যত্ন,কত স্নেহ পাস। তোর রাজকপাল। সবার ভালোবাসা পাস।”
কণ্ঠ থেমে এলো। অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়তে লাগল জলপ্রপাতের ন্যায়।
থানার ঝামেলা সামলে উঠতে দুপুর গড়িয়ে গিয়েছিল ধ্রুবর। সব কাজ সেরে ক্লান্ত শরীরে গাড়িতে উঠল। পাশে বুশরা। নিঃশব্দে তাকিয়ে ছিল জানালার বাইরে কিন্তু চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। দু’জনেই তাড়াহুড়ো করে রওনা দিলো হাসপাতালে। হাসপাতালের সামনে পৌঁছে গাড়ি থেকে নামতেই বুকের ভিতর চাপা টান অনুভব করল ধ্রুব। শুভ্রর কেবিনে ঢুকতেই চোখে পড়ল দ্যুতির কোলে নিশ্চুপ শুয়ে আছে নিশু। যেন ছোট্ট শিশু,যার চারপাশের অশান্ত পৃথিবী সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। ধ্রুবর বুক থেকে একরাশ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো। থানায় থাকলেও সারাক্ষণ এই দুইজনকে নিয়ে তার ভিতর টেনশন কুরে খাচ্ছিল। একপলক নিশুকে দেখে ডাক্তারের কাছে গেল। ধূসর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তেমন কিছু বলল না। সে ঘুমোচ্ছে এতটুকুই।
ধূসরকে বাইরে থেকে একপলক দেখে ফিরে এলো ওদের কাছে। আনমনা হয়ে দ্যুতি এখনও ঘুমন্ত নিশুর মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। মুখে ক্লান্তি,চোখে অশ্রুর শুকনো রেখা। দ্যুতির পাশে বসল ধ্রুব। নিশুর মাথা নিজের কোলে তুলে নিয়ে ঘুমন্ত মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে ফোন বের করে বাসার জন্য লাঞ্চ অর্ডার করল। ক্রমে ক্রমে সময় বয়ে গেল। ঘড়ির কাঁটা তিনটার দিকে এগোতে লাগল। লাঞ্চ টাইম অনেক আগেই ফুরিয়েছে। অবশেষে নিশুর ঘুম ভাঙাল। একসাথে নীরবে নেমে এলো হাসপাতালের পাশের একটি রেস্তোরাঁয়। খাবার অর্ডার করল। কেউ তেমন কিছু বলল না। শুধু প্লেটের শব্দ আর একে অপরের নিঃশ্বাসে পরিবেশ ভরছিল। খাওয়া-দাওয়া সেরে রেস্তোরাঁর গেট থেকে বেরুতেই হঠাৎ চারপাশ অচেনা অন্ধকারে ঢেকে গেল। মোটরসাইকেলের গর্জন ছিঁড়ে ফেলল বিকেলের নিস্তব্ধতা। একসাথে পাঁচ-ছয়জন মুখোশধারী ঝাঁপিয়ে পড়ল ওদের দিকে। কারও হাতে ধারালো রামদা,কারও হাতে লোহার রড,কারও হাতে ক্রিকেট স্ট্যাম্প,চাইনিজ কুড়াল। দ্যুতি আতঙ্কে নিশু ও বুশরাকে আঁকড়ে ধরল।
“আজকে কেউ বাঁচাতে পারবে না!”
গর্জে উঠল এক মুখোশধারী। ধ্রুব সামনে এসে দাঁড়াল। শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় যেন আগুন লেগে গেল। দাঁত চেপে বলল,”হাত দেওয়ার চেষ্টা করবি না.. নইলে কারও হাত-পা নিয়ে ফিরতে পারবি না!”
কথা শেষ হওয়ার আগেই এক আক্রমণকারী ঝাঁপিয়ে পড়ল। ধ্রুব মুহূর্তেই বাঁ হাতে তাকে প্রতিহত করে সজোরে ধাক্কা দিলো। লোকটা রাস্তার পাশে পড়ে গড়িয়ে গেল। কিন্তু বাকিরা থামল না। লোহার রড তুলে ছুটে এলো ধ্রুবর মাথার দিকে। শেষ মুহূর্তে ঝুঁকে গিয়ে হাত দিয়ে ধরে ফেলল ধ্রুব। চোখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠল। এক ঝটকায় টেনে নিয়ে লোকটাকে মাটিতে আছাড় মারল। রাস্তার চারপাশে জমে থাকা মানুষজন ভয়ে জমে গেল। কেউ সাহায্যের জন্য এগোল না শুধু তাকিয়ে রইল স্তব্ধ হয়ে। দ্যুতি- নিশু ও বুশরাকে জড়িয়ে কাঁপতে লাগল।
এবার আরও দু’জন একসাথে এগিয়ে এলো ধ্রুবর দিকে। একজনের হাতে রামদা উঁচু হয়ে উঠল। মুহূর্তেই ধ্রুব পাশ কাটিয়ে গিয়ে তার কব্জি চেপে ধরল। লোকটা যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। অন্যজনকে পা দিয়ে লাথি মেরে দূরে ছিঁটকে দিলো। ধ্রুবর শরীরজুড়ে যেন বজ্রপাতের শক্তি। সে দাঁড়িয়ে আছে ঢালের মতো- একদিকে নিশু,দ্যুতি আর বুশরা অন্যদিকে ক্রমশ উগ্র হয়ে ওঠা আক্রমণকারীরা। বাতাসে দমবন্ধ করা উত্তেজনা। ধ্রুব একাই সব সামলাচ্ছিল। চোখে যেন অগ্নি,হাতে যেন বজ্র। একের পর এক ঘুষি,লাথি- সবার বুক কাঁপিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎই নিশুর চোখে ভেসে উঠল সেই পুরনো দৃশ্য। দ্যুতি ইট তুলে অনিকের মাথায় আঘাত করছে,রক্ত ঝরছে। নিশু হঠাৎ চিৎকার করে উঠল,”দ্যুতি.. ছেড়ে দে! মারিস না.. মারিস না! মরে যাবে! অনিক মরে যাবে!”
মায়াকুমারী পর্ব ৫৭
অথচ এখানে দ্যুতি থাকলেও তার হাতে ইট নেই,অনিক নেই- আছে কেবল ধ্রুবর ঝড়ের মতো আঘাত। তবু মস্তিষ্কের ভিতর অচেনা ভয় আঁকড়ে ধরেছে নিশুকে। থমকে গেল সবাই। ধ্রুবর হাতও মুহূর্তের জন্য থমকাল। দ্যুতি নিশুকে জড়িয়ে ধরল,কাঁপা গলায় বলল,”নিশু,আমি তো আছি! দেখ,আমি কিছু করছি না। ভয় পাবি না।”
চোখ সরিয়ে ধ্রুব আবারও ঝাঁপিয়ে পড়ল। এবার আর কারো রেহাই নেই। এক এক করে সবাইকে এমন আঘাত করল যে শেষমেশ লেজ গুটিয়ে পালাতে বাধ্য হলো ওরা। কিন্তু নিশু তখনও বলেই যাচ্ছে,”দ্যুতি,ছেড়ে দে.. মারিস না!”