মায়াকুমারী পর্ব ৬৬+৬৭

মায়াকুমারী পর্ব ৬৬+৬৭
মেহেরিন আনজারা

শহরের গলিটা তখন অন্ধকারে ঢাকা। হালকা কুয়াশা ঝুলে আছে বাতাসে,আর রাস্তার একপাশে ঝিমিয়ে থাকা বাতিটা মাঝেমধ্যে টিমটিম করে জ্বলছে। ধূসর আলোয় ধ্রুবর ছায়া দীর্ঘ হয়ে পড়েছে মাটিতে। তার চোখে জমে আছে ঝড়ের রং। চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে এক দল কালো মুখোশধারী। মুখে কালো কাপড়,হাতে রড,লাঠি,ছু’রি,চাইনিজ কুড়াল নিয়ে ঝলসে উঠল আলোয়। সজোরে ব্রেক কষল ধ্রুব। গভীর দৃষ্টিতে তাকাল। ধ্রুব জানে এরা ইফতেখার মির্জার লোক। তাদের পেছনে মানুষটা যে এখনও লেগে রয়েছে সেটা ঢের জানে ধ্রুব।

এই-ও জানে,যে-কোনো সময় আক্রমণ হতে পারে তাদের উপর। কোনো কথা ছাড়াই আকস্মিক একটা লোক ঘুষি ছুঁড়ল ধ্রুবকে কিন্তু সে সরে গেল একটানে। তবে সঙ্গে সঙ্গেই এমন ঘুষি মারল তার গালে যে মুখোশ খুলে ছিটকে পড়ল। রক্ত ঝরতে লাগল মুখের কোণ দিয়ে। আরেকজন ছু’রি হাতে পেছন থেকে হামলা করল কিন্তু ধ্রুব তার কব্জিটা এমনভাবে মচকে দিলো যে ছু’রিটা গড়িয়ে পড়ল নিচে। সে লোকটা যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। ধ্রুবর শ্বাস ভারি হয়ে উঠল,কপালের ঘাম গড়িয়ে পড়ছে গালে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তার চোখে একধরনের ভয়ানক স্থিরতা,যেন মানুষ নয় আগুনের তৈরি এক যোদ্ধা। আরেকজন মুখোশধারী চিৎকার করে উঠে ছুটে এসে লাঠি তুলতেই ধ্রুব তা এক হাতে ধরে এমন টান মেরে ছিনিয়ে নিলো যে লোকটা ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে গেল। তারপর লাঠিটা ঘুরিয়ে এমনভাবে আঘাত করল তার পেটে যে লোকটা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ছটফট করতে লাগল। গলিটা এখন শুধু গর্জন আর পদাঘাতের শব্দে ভরা। ধ্রুবর প্রতিটি আঘাতে হাড় ভাঙার আওয়াজ,মুখোশধারীদের আর্তনাদ। কিন্তু ধ্রুব থামছে না। সে যেন নিজের ভিতরের সমস্ত রাগ,জেদ,ক্ষোভ উগরে দিচ্ছে প্রতিটি ঘুষিতে,প্রতিটি আঘাতে। আবারও ছুটে আসতেই এবার ধ্রুব বাইক থেকে নেমে একটি লোহার চেইন টেনে নিয়ে এমন প্রহার করতে লাগল ওদের যে আকাশ-বাতাস সব কেঁপে উঠল তাদের আহাজারি,আর্তনাদ আর আর্তচিৎকারে। অবশেষে চিৎকার করে উঠল,‘পালাও! পালাও!’

একে একে ছুটে পালাতে লাগল কুয়াশার ভেতর। কেউ মুখ থুবড়ে পড়ল,কেউ হোঁচট খেয়ে উঠল না আর। ধ্রুব দাঁড়িয়ে রইল। নিঃশ্বাসের শব্দে যেন গোটা গলিটা কাঁপছে। তার বুক ওঠা-নামা করছে দ্রুত,ঠোঁটে রক্তের ফোঁটা,কপাল ভিজে গিয়েছে ঘামে আর কাদায়। ধীরে ধীরে চেইনটি গুটিয়ে নিলো হাতের মুঠোয়। চারপাশে শুধু ঝিম ধরা নীরবতা। বাইক স্টার্ট দিলো আবার। হাই স্পিডে চলতে শুরু করল। ততক্ষণে প্রায় অনেক রাত হয়েছে। ব্যালকনির রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে দ্যুতি। হঠাৎ বাইকের শব্দ শুনতেই টনক নড়ে উঠল। দ্রুত নিচের দিকে তাকাল। ব্রেক কষে দু’জন নামল।

ধূসরের হাঁটায় টলোমলো ভাব,মাথাটা একটু ঝুঁকে পড়েছে এক পাশে। ধ্রুব তাকে ধরে রেখেছে শক্ত করে। দ্যুতির বুক কেঁপে উঠল। বুঝল,কিছু একটা ঘটেছে। স্বাভাবিক নয় এই ফেরা। যদি তার বাবা-মা দেখে তাহলে ভীষণ কষ্ট পাবে। তার বাবার মাথা নিচু হয়ে যাবে। মাথা ঘুরে উঠল ভয় আর উদ্বেগে। দিলরুবা খাতুন তখনও ঘুমাননি। ভীতসন্ত্রস্ত এবং চিন্তাগ্রস্ত হয়ে লিভিং স্পেসে পায়চারি করছেন বারবার। সিলিং ফ্যান ঘুরছে অনবরত। চোখে ঘুম নেই,কপালে ভাঁজ। চিন্তায় মন উৎকণ্ঠা হয়ে আছে। ব্যালকনি থেকে বেরিয়ে হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে লিভিং স্পেসে একপ্রকার ছুটে এলো দ্যুতি। তাকে দেখতেই ভড়কালেন তিনি।

‘আম্মু,ঘুমাতে যাও।’
‘ঘুমাসনি?’
‘এখন ঘুমাতে যাব। তুমিও যাও,আম্মু।’
ভিতরে ভিতরে দ্যুতি অস্থির হলেও উপর দিয়ে স্থির রইল।
‘তোর ভাইয়েরা এখনও বাসায় ফিরেনি।’
‘একটু আগে বড়ভাইয়া ফোন করে বলছে আসছে। আর তোমাকে ঘুমিয়ে যেতে বলেছে। এখন যাও,ঘুমাও। নয়ত ভাইয়া বকাবকি করবে। আর সকালে উঠে নামাজ আদায় করতে হবে।’
‘আচ্ছা,আগে আসুক। তারপর দেখি।’
দ্যুতি কিছু না বলে উনার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল রুমে।
‘ঘুমাও,আম্মু। অহেতুক টেনশন নিও না। সব ঠিক আছে।’

দিলরুবা খাতুন অনিশ্চিত চোখে তাকালেন একবার,তারপর ধীরে ধীরে শুয়ে পড়লেন। দ্যুতি নিঃশব্দে লাইট বন্ধ করে বাইরে থেকে দরজা লক করল,যেন তিনি আপাতত বের হতে না পারেন এবং কিছু শুনতে না পান। এরপর তাড়াহুড়ো করে ছুটে গেল লিভিং স্পেসে। দরজা খুলতেই ভেতরে ঢুকল ওরা দু’জন। ধূসরের চোখ লালচে,শরীর দুলছে,ঠোঁটে অজানা কিছু অস্পষ্ট শব্দ। নিজেকে সামলে রাখতে পারছে না ধূসর। সে তখন পুরোদস্তুর মাতাল।
‘এই! লেবুর রস আন,তাড়াতাড়ি!’

ধ্রুবর কণ্ঠে তীব্র রাগ। এমন গম্ভীর,কঠোর স্বরে বলল যে কেঁপে উঠল দ্যুতি। বুকের ভিতর ধড়ফড় করে উঠল। ধ্রুবকে সে ভয় পায়- এক অদ্ভুত,শাসনমিশ্রিত ভয়। তবু কোনো কথা না বলে দ্রুত ফ্রিজ খুলে লেবু নিয়ে টুকরো করো কাঁপা হাতে রস চিপে বের করতে লাগল। ধ্রুব ততক্ষণে ধূসরকে কাঁধে ভর দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে তুলে নিচ্ছে ধীরে ধীরে। প্রতিটি ধাপ যেন একেকটা বোঝা। আশেপাশে চতুর্দিকে সর্তক দৃষ্টি বুলাল। দাদীমা-ফুপি দেখলে হায় হায় করতে পুরো বংশে ছড়িয়ে দিবে আসাদ সাহেবের ছেলেরা নেশা করে,মদ-গাঞ্জা খায়। এঁদের মুখের বেড়া নেই। তারা খুব ভালো অবস্থানে রয়েছে আর এটা অনেকেরই চোখের বিষ। এছাড়াও তার বাবা-মা জানতে পারলে চরম আঘাত পাবে। ধ্রুব চায় না কেউ জানুক ব্যাপারটা। বেডরুমের দরজায় হালকা ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। দু’ভাইকে ওরকম অবস্থায় দেখতেই থমকে গেল বুশরা। ধূসরকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল ধ্রুব।

‘এ অবস্থা কেন আপনার?’
ধূসর কিছু বলল না। শুধু ফাঁকা চোখে তাকাল তার দিকে। এক পা,দুই পা করে এগিয়ে গেল ধীরে ধীরে। বুশরার বুক ধড়ফড় করতে লাগল,সে দু’ধাপ পিছিয়ে গেল কিন্তু ধূসর থামল না। তার শরীর থেকে ভেসে আসছে তীব্র অ্যালকোহলের গন্ধ,চোখের ভিতর অচেনা অন্ধকার,ঠোঁটের কোণে শুকনো রক্তের দাগ। ধূসর চোখ কচলে তাকাল তার দিকে,যেন কারও মুখ মনে করার চেষ্টা করছে। তারপর থেমে গিয়ে,একরকম হাহাকার মেশানো কণ্ঠে বলল,‘উহুম.. এটা সেই চোখ নয়.. সেই ঠোঁট নয়.. সেই মুখ নয়!’

সে যেন কারও অস্তিত্ব খুঁজছে বুশরার মুখে। কোনো হারানো মেয়ের,কোনো অতীতের। বুশরার বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠল যন্ত্রণা। তার চোখে জল এসে গেল,গলায় কান্না আঁটকে গেল।
‘চলে যাও.. চলে যাও চোখের সামনে থেকে! চলে যাও!’
ধাক্কা দিতেই মেঝেতে পড়ে গেল বুশরা এবং মুখ থেকে চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো। বাইরে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল ধ্রুব। তার মুখে থমথমে গাম্ভীর্য,চোখে ঘন অন্ধকার। হাত মুষ্টিবদ্ধ করল।
‘এমন করছেন কেন?’
‘তুমি জানো,আমি আজ কীভাবে ফিরেছি?’

কিছু বলতে পারল না বুশরা। ধূসরকে কেমন মানসিক ভারসাম্যহীন দেখাচ্ছে।
‘সবাই ভাবে আমি মাতাল হয়েছি কিন্তু কেউ দেখে না আমি আসলে কী হারিয়েছি!’
তার কণ্ঠে এক ধরনের নরম,পাগলামি মিশ্রিত যন্ত্রণা। ঠিক তখনই লেবুর রস নিয়ে এলো দ্যুতি। ধ্রুব এসে দরজার কাছে দাঁড়াল। চোখ-মুখ এবং চোয়াল শক্ত। দ্যুতি একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে,তার চোখে ভয় আর চিন্তা। ধ্রুব দরজায় আস্তে করে হালকা টোকা দিয়ে ভেতরে ঢুকল। বাতাসে তখন ভারি এক অস্বস্তি। লেবুর টক গন্ধ,শরাবের গন্ধ আর আতঙ্কের ঘন মিশ্রণ। ধীরে,অদৃশ্যভাবে। অপ্রস্তুত হয়ে চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল বুশরা। ধ্রুব ধূসরকে ধরে বেসিনে নিয়ে গেল,জোর করে লেবুর রস পান করিয়ে দিতেই হড়বড়িয়ে বমি করতে লাগল। যেন শরীর থেকে সব বিষ বেরিয়ে যাচ্ছে। একপর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে ধূসর নিথর হয়ে পড়ল। ধ্রুব কুলকুচি করিয়ে তাকে বিছানায় এনে শোয়াল। বুশরা নীরবে একপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে,নিঃশব্দে কাঁপা চোখে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।

‘ওর দিকে খেয়াল রেখো। কোনো সমস্যা হলে জানিও। ভয় পেয়ো না,এখন ঘুমিয়ে পড়ো। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
ওরা দু’জন রুম থেকে বেরোতেই মুখোমুখি হলো দাদীমা ও ফুপির। থমকে গেল চারজনই। তবে ওরা দু’জন সন্দেহভরা চোখে তাকাল।
‘কী হয়েছে,দাদীমা?’
‘না,কিছু না।’
‘এখানে কী করছো?’
‘ওই,কীসের যেন শব্দ পেলাম।’
‘সিআইডিগিরি না করে ঘুমাতে যাও,শরীর এবং মন উভয়ের জন্য ভালো হবে।’
মলিন মুখে মাথা নেড়ে রুমের দিকে পা বাড়ালেন উনারা। বিরক্তিতে নিঃশ্বাস ফেলল ধ্রুব। কপালের চুলে হাত বুলিয়ে ধীরে ধীরে নিজের রুমের দিকে পা বাড়াল। বাড়িটা তখন পুরোপুরি নিঃস্তব্ধ। শুধু দূরে ঘড়ির টিকটিক শব্দ,আর রাতের বুকের ভেতর জমে থাকা অনুচ্চারিত কিছু কান্না। বুশরা দাঁড়িয়ে রয়েছে,নিঃশব্দে কাঁদছে। তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া জল যেন বলছে,‘কতটা ভাঙলে মানুষ এমন হয়! কতটা ভালোবাসলে মানুষ এমন পাগলামি করতে পারে তার সদ্য বিয়ে করা নবপরিণীতার সামনে! কে সেই নারী?’

সকালের হালকা রোদ জানালার ফাঁক গলে ঢুকে পড়েছে ঘরে। বাইরে বসন্তের নরম হাওয়া,আমগাছে কুঁড়ি,পাখিদের মিষ্টি কূজন অথচ ঘরটা যেন অন্য এক জগতে,ভারি আর স্তব্ধ। নাস্তা করে ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য তৈরি হলো দ্যুতি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হিজাব ঠিক করে নিলো। পরনে নীল কুর্তি,এক কাঁধে ওড়না এবং অপর কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো। ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। নিশু এখনও পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। স্লিপিং মেডিসিন নেওয়ার ফল। নিশুকে ডাকেনি অবশ্য। ঘুমাক,গাছের জন্য আজ সারাদিন শোকদিবস পালন করবে তা ঢের জানে সে। এরচেয়ে ভালো আরও কিছু ঘণ্টা ঘুমিয়ে থাকুক। আর তারও বাসায় ভালো লাগছে না।

পুরো বাসা কেমন থমথমে অবস্থা। শ্বাস আঁটকে আসছে দ্যুতির। জানে তাকে ছাড়া ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য নিশু ভীষণ রাগ,জিদ,অভিমান- সবই করবে তবুও দ্যুতি তৈরি হয়ে নিলো। পর্দা সরিয়ে জানালার বাইরে তাকাল। সূর্যের আলো পাতার ফাঁকে ফাঁকে ছায়ার খেলা করছে,রাস্তার ধারে ফুলের ঘ্রাণে বাতাস ভরে আছে অথচ এই সৌন্দর্য যেন তাকে ছুঁতে পারছে না। পুরো বাসাজুড়ে কেমন এক নিস্তব্ধতা। দেয়ালগুলোও যেন ভারি হয়ে আছে অজানা শোকের ভারে। নীরবে রুম থেকে বেরোল। বসন্ত-সকালের হালকা রোদে ধ্রুবর বাইকের ক্রোম ঝলমল করছিল। দ্যুতি পেছনে বসল,বাতাসে উড়তে লাগল তার হিজাব। রাস্তায় গাছের ছায়া পড়ছে একের পর এক,যেন সময়ও তাদের সঙ্গে এগিয়ে চলেছে। ভার্সিটির গেটের সামনে পৌঁছে বাইক থামাল ধ্রুব। দ্যুতির দিকে তাকিয়ে বলল,‘আজ আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। ধীরাজ এলে ওর সঙ্গে চলে যাস,ঠিক আছে?’

মাথা নেড়ে নীরবে সায় দিলো দ্যুতি। ধ্রুব বাইক ঘুরিয়ে চলে গেল। ধুলো উড়িয়ে দূরে মিলিয়ে গেল তার ছায়া। দ্যুতি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ,বাতাসে তার ওড়না উড়ছে,রোদে চোখ চিকচিক করছে। তারপর ধীরে ধীরে পা বাড়াল ভার্সিটির গেটের ভেতর। যেন বসন্তের এক সকালে,ফুলে ভরা রাস্তায়,একা হয়ে যাচ্ছিল একটা মেয়ের জীবন। সকালটা কেমন যেন আজ অদ্ভুতভাবে নীরব। ভার্সিটির চৌকাঠ পেরিয়ে আসতেই দ্যুতির মনে হলো,যেন এই প্রাঙ্গণও কিছু বুঝে ফেলেছে। কোথাও হাসির রোল নেই,বাতাসে হালকা গাম্ভীর্যের ছোঁয়া।

ক্লাসরুমের জানালার ধারে গিয়ে বসল। বাইরে সারি সারি কদমগাছের পাতা আলোয় ঝলমল করছে,মাঝে মাঝে পাখির ছায়া এসে পড়ে ডেস্কের ওপর। চকের ঘর্ষণের শব্দ,অধ্যাপকের মৃদু কণ্ঠ- সবকিছুই আজ যেন অনেক দূরের এক জগৎ থেকে ভেসে আসছে। দ্যুতির চোখ জানালার বাইরে অথচ দৃষ্টি চলে যাচ্ছে এক রাত আগের দিকে। ধূসরের মুখটা মনে পড়ছে- সেই লালচে চোখ,অচেনা রাগে ভরা মুখ,আর ভিতরে জমে থাকা অসহায়তার হাহাকার। বুশরার কণ্ঠের ভাঙা শব্দ,কান্না চাপা দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা- সব একসাথে বাজছে তার কানে। নিশুর কথাও মনে পড়ছে। তার কান্নাকাটি,চিৎকার-চেঁচামেচি সব। নিশুর সেই চিৎকার এখনও ঘুরে ফিরে বাজে তার ভিতরে।

কলমের আগা ডেস্কে ঠুকছিল অন্যমনস্কভাবে,যেন নিজের অস্থিরতা লুকাতে চাইছে। তারপর ধ্রুবর মুখ মনে পড়ল। সেই থমথমে গাম্ভীর্য,ঠোঁটের কোণে না বলা রাগ,চোখে জমে থাকা কষ্ট। সব মিলিয়ে গতরাত যেন এক গভীর দুঃস্বপ্নের মতো কিন্তু ঘুম ভাঙার পরও যার ছায়া থেকে যায়। বাইরে হঠাৎ একটা মৃদু বাতাস বয়ে গেল। গাছের ডাল থেকে কয়েকটা ফুল ঝরে পড়ল জানালার পাশে। দ্যুতি চেয়ে দেখল,সূর্যের আলোয় সেই ফুলগুলো ঝলমল করছে কিন্তু তাতে আনন্দ নেই,শুধু নিঃশব্দ সৌন্দর্য,যেন কোনো হারানো কিছুর স্মৃতি। হালকা করে নিঃশ্বাস ফেলল। বুকের ভিতর চাপা দীর্ঘশ্বাস গড়িয়ে এলো ঠোঁট পর্যন্ত। এই পৃথিবীটা এত সুন্দর,তবু এত ভারি কেন লাগে আজ?চোখের কোণে একফোঁটা জল জমল। দ্রুত চোখ নামিয়ে নোটবুক খুলল,যেন পড়াশোনার ভিতরে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে চায়। কিন্তু মনে মনে জানে,রাতের সেই অন্ধকার,সেই চিৎকার আর ধূসরের মুখের যন্ত্রণা এই সকালের রোদেও তাকে তাঁড়া করে ফিরবে অনেকদিন।

বেলা বারোটা বাজে ঘুম থেকে উঠল ধূসর। সঙ্গে সঙ্গে ডাক পড়ল আসাদ সাহেবের। হাত-মুখ ধুয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল ধূসর। জানে কেন ডাক পড়েছে তার। রুমের ভেতরে ঢুকে অপরাধীর ন্যায় মাথা নুয়ে দাঁড়াল। ক্ষিপ্ত চোখে তাকান আসাদ সাহেব।
‘মন্ত্রীর মেয়েকে বিয়ে করে শুনলাম তোর পাখনা গজিয়েছে- ঘটনা কি সত্যি?’
নীরব রইল ধূসর।
‘বিয়ে করতে না করতেই ওই নাকউঁচু মন্ত্রীর মতো ঘরের মধ্যেও সস্তা রাজনীতি দেখানো শুরু করে দিলি নাকি?’
ধূসর নিরুত্তর।

‘আমার বাড়িতে কোনো রাজনীতি চলবে না। তুই যেহেতু ওই নাকউঁচু মন্ত্রীর মতো সস্তা রাজনীতি দেখানো শুরু করেছিস ঘরের মধ্যে তো ওই মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে যা আমার বাড়ি থেকে।’
মাথা নুয়ে একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল ধূসর।
‘আমার মেয়েদের ফুলগাছ কাটলি কোন সাহসে?’
ধূসর স্থির। আদেও কথাগুলো কানে পৌঁছাচ্ছে কিনা কে জানে!
‘কাল সারা রাত কোথায় ছিলি উত্তর দে!’
নির্বিকার রইল ধূসর।
‘আমারে মুড দেখাস!’
বিরক্ত হলেন দিলরুবা খাতুন-
‘চিৎকার করছেন কেন?’
‘তুমি এরমধ্যে কথা বলিও না,দিলরুবা।’
‘মানুষ হাসাতে ভালো লাগে আপনার?’
‘তোমার ছেলে কাল সারা রাত বাইরে ছিল,শুধু তাই নয় ওই নাকউঁচু মন্ত্রীর সস্তা রাজনীতি প্রয়োগ করছে আমাদের ঘরের মধ্যে। এইসব বরদাস্ত করব না আমি।’

ক্লাস শেষ হলো দ্যুতির। বাইরে রোদ হালকা সোনালি,বাতাসে বসন্তের কোমল গন্ধ। ছায়া আর আলো মিশে একটি নরম,স্বপ্নময় আবহ তৈরি করেছে। ছাত্রছাত্রীরা দ্রুত নিজেদের রুটিনে ফিরে গিয়েছে,কেবল দ্যুতি একা রয়ে গিয়েছে। ক্যাম্পাসের একান্ত কোণে বসে পড়ল। চারপাশে নিস্তব্ধতা,শুধু দূরে দূরে পাখির ডাক আর পাতার নড়াচড়া। ব্যাগটি পাশে রেখে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে থাকল,যেন নিজের ভিতরের ভাবের সঙ্গে কথা বলছে। হারানো শান্তি খুঁজছে,আনমনে ভেসে থাকা অচিন্তিত চিন্তা শোনার চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণ একা বসে থাকার পর দ্যুতি উঠে দাঁড়াল। ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল ক্যাম্পাসের নরম পথ ধরে। মনের অজান্তেই তার পা এগোচ্ছে,চোখে ভেসে উঠছে গাছের ছায়া,দূরের বিলাসবহুল ভবনের রেখা,বাতাসে ভেসে আসা ফুলের নরম গন্ধ।

হাঁটতে হাঁটতে সে একরকম আনমনা হয়ে গিয়েছে- কোনো গন্তব্য নেই,শুধু পদক্ষেপের ছন্দ আর নিজের নিঃশব্দ মনকে শোনার আনন্দ। প্রকৃতির এই কোমল স্পর্শ,বিকেলের হালকা রোদ,নীরবতা- সব মিলিয়ে তাকে এক অদ্ভুত শান্তি দিয়েছে। যেন দিনের সমস্ত ব্যস্ততা,সমস্ত চিন্তা,ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। একরকম নিঃশব্দ ভ্রমণে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে,আর প্রত্যেক ধাপ যেন তার মনের বোঝা হালকা করছে। হঠাৎই একটি বাইক সজোরে ব্রেক কষল তার সমানে। চাকা হঠাৎ ব্রেক করায় ধুলো কেটে উঠে বাতাসে ভেসে গেল। ভড়কে উঠে বিস্ফোরিত নয়নে তাকাল দ্যুতি। বাইক থেমে দাঁড়াল ঠিক তার সামনে। মাথায় হেলমেট,বাইকের সাইলেন্সে কেমন এক অচেনা ভঙ্গি। চোখ বড় করে তাকাল সে। হেলমেট খুলতেই বিস্ফোরিত নয়নে চমকে উঠল।

অনিক! শুধু তার নামই নয়,এই মুহূর্তে তার উপস্থিতি যেন সময়কে থমকে দিয়েছে। মুহূর্তেই হাত-পা জমে গেল,কাঁপতে লাগল দ্যুতি। শ্বাস আঁটকে দাঁড়িয়ে রইল। অনিকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেন সরাসরি দ্যুতির রক্তের নালিকায় ঢুকে গিয়েছে। মুহূর্তেই শিরদাঁড়া বেয়ে সর্পিল গতিতে শীতল স্রোত বয়ে গেল। অনিক এমনভাবে তাকিয়ে রয়েছে যেন দ্যুতির শরীর অজান্তে বিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। অপ্রস্তুত হয়ে দ্রুত চোখ নামিয়ে ফেলল। ব্যাগের চেইন খুলে কাঁপা কাঁপা হাতে হাতড়ে মাস্ক বের করে দ্রুত পরে নিলো। এরপর শক্ত করে ব্যাগ চেপে ধরে অনিককে না দেখার ভান করে হাঁটতে লাগল। ভাবখানা এমন যেন সে অনিককে দেখেইনি। ভ্রু কুঁচকে তাকায় অনিক। দ্যুতি দ্রুত হেঁটে অনিকের চোখের আড়াল হয়ে,একটি গাছের নিচে বসে জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে লাগল। সারা শরীর কাঁপছে।

মাস্ক খুলে,টিস্যু বের করে চোখের জল মুছে নিলো। কেন জানি,ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার। কিন্তু কেন তা দ্যুতি নিজেও বুঝতে পারছে না। বাতাসে বিকেলের হালকা রোদ,পাখির কলরব- সবকিছু মিলেও তার হৃদয় অদ্ভুত এক ব্যথায় ভারি হয়ে উঠল। চোখ বুজে গাছের গায়ে হেলান দিলো। বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে গেল অনিক। বাইকের শব্দ মিলিয়ে গেল দূরের রাস্তায়। তবু শব্দটা যেন থেকে গেল দ্যুতির বুকের ভিতরে। গুঞ্জনের মতো,কাঁপন তোলা এক অনুরণন। দ্যুতি গাছের নিচে বসে রইল নিঃশব্দে। চারপাশে বিকেলের ক্লান্ত আলো,হালকা বাতাসে ঝরে পড়ছে গাছের শুকনো পাতা। পাখিরা ডাকে কিন্তু সেই ডাকে আজ কোনো সুর নেই- যেন সবকিছু নিঃশব্দ হয়ে গিয়েছে ভিতরে ভিতরে। বুকের মধ্যে কেমন একটা চাপা অস্বস্তি। হাতের তালু ঘামছে,আঙ্গুল কাঁপছে।

চোখের কোণে অজান্তেই জল এসে থমকে তারপর গড়িয়ে পড়তে লাগল গালে। বুঝতে পারছে না,কেন এত অস্থির লাগছে? অনিককে দেখে কেন মনে হলো বুকের ভিতরটা হঠাৎ ভারি হয়ে গিয়েছে?সে কি ভয় পেয়েছে,নাকি অন্য কিছু.. যা সে নাম দিতে পারছে না। নিচের দিকে তাকিয়ে মাটির উপর একটা শুকনো পাতা তুলে নিলো। আঙ্গুলের ফাঁকে ঘুরাতে লাগল,যেন পাতার ভিতর কোথাও নিজের অস্থিরতার উত্তর খুঁজছে। পাতাটি হাতে নিয়ে আবারও গাছের গায়ে হেলান দিয়ে চোখ বুজে রইল। হঠাৎ পুরুষালী বুনো সুগন্ধি পেতেই চট করে চোখ মেলে তাকাল তবে কাউকে দেখল না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে টিস্যু বের করে অশ্রু মুছতে লাগল।

তারপর দলিত-মথিত করে টিস্যুটি ছুঁড়ে ফেলল। তবুও জলপ্রপাতের ন্যায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। হঠাৎ একটি হাত টিস্যু বাড়িয়ে ধরল। সেদিক না তাকিয়ে দ্যুতি আনমনা হয়ে টিস্যু নিয়ে আবারও অশ্রু মুছে দুমড়ে-মুচড়ে ছুঁড়ে ফেলল। আবারও টিস্যু বাড়িয়ে ধরল চোখের সামনে। টিস্যু নিতে আনমনা হয়ে পাশ ফিরতেই অনিককে দেখতেই ভূত দেখার মতো ভড়কে উঠে ছিটকে সরে গেল দ্যুতি। ভ্রু কুঁচকায় অনিক। দ্যুতির বুকের ভিতর ধড়ফড় করছে। বুঝতে পারছে না অনিক নাকি তার আত্মা নাকি অনিকরুপী কোনো জ্বীন। সূর্যের আলো একটু একটু করে নরম হয়ে আসছে। আর দ্যুতির চোখেও যেন আরো ঘন অন্ধকার নেমে আসছে।

ব্যাগটা কাঁধে তুলে কম্পিত পায়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করল। কোথায় যাচ্ছে জানে না,শুধু এলোমোলো টলোমলো পায়ে হাঁটছে। প্রতিটি পদক্ষেপে মনে হচ্ছে,নিজের অতীত,ভয় আর না বলা কথাগুলোর ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সে। অনিকের এই হঠাৎ আগমন তার কাছে অবিশ্বাস্য,অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অপ্রত্যাশিত। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না দ্যুতির। মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছে আর একটু পর ঘুম ভেঙে গেলে পালিয়ে যাবে। বাস্তব আর স্বপ্নের মধ্যে আঁটকে গেল দ্যুতি। হঠাৎ চোখে-মুখে অন্ধকার দেখে মাথা ঘুরে পড়ে যেতেই তড়িৎ অনিক এসে ধরল। নিভু নিভু ঝাপসা চোখে তাকায় দ্যুতি। শ্বাস তার নাকের ডগায়।

‘এক্সকিউজ মি,আফা.. আর ইউ প্রেগন্যান্ট?’
চোখ বড় বড় করে তাকাল দ্যুতি। এমন কথা শুনবে ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি। রাগে-জিদে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ফের হাঁটতে লাগল। চোখের জলে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে উঠল,এবার মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। ভ্রু কুঁচকায় অনিক। এগিয়ে আবারও হাত ধরে তুলল!
‘আপনাকে গাইনী ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব নাকি,আফা?’
মেজাজ খারাপ হয় দ্যুতির।
‘ছাড়ুন!’
নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল দ্যুতি। তার বিরক্তিকর মুখের দিকে তাকাল। অতিরিক্ত রাগে ফর্সা মুখখানি লাল হয়ে গিয়েছে।

মায়াকুমারী পর্ব ৬৪+৬৫

‘এই মামা এদিকে আসো।’
রিকশাওয়ালা মামা এগিয়ে এলো।
‘আফা প্রেগন্যান্ট,উনাকে বাসায় পৌঁছে দিন।’
দাঁতে দাঁত চেপে রইল দ্যুতি। হাত ধরে রিকশায় তুলে দিয়ে ওড়না গুটিয়ে কোলের উপর রাখল।
‘সাবধাানে যাবেন,আফা.. নয়ত বেবি ব্যথা পাবে।’
রিকশা চলতে শুরু করল। সারা পথ কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরল দ্যুতি।

মায়াকুমারী পর্ব ৬৮+৬৯

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here