মায়াবতীর ইচ্ছা পর্ব ২৭
ইশরাত জাহান
মিডিয়ার লোকজন চলে যাওয়ার পর রাজ ও মায়া তার অফিস রুমে ঢুকে পড়ে।মায়ার দিকে তাকিয়ে রাজ বলে,”তা হঠাৎ বরকে মিস করছো যে?”
মায়া কল করতেই রুমে খাবার বক্স নিয়ে হাজির হয় তারেক।খাবারটি দিয়েই চলে যায় সে।মায়া টেবিলে থাকা খাবারের দিকে ইশারা করে বলে,”বিয়ের দ্বিতীয় দিন আজ।স্বামী মহাশয় না হয় ব্যাস্ত মানুষ কিন্তু স্ত্রীর তো তার নিজস্ব দায়িত্ত্ব আছে।আমি আমার স্বামীর সাথে বিয়ের প্রথম দিনগুলো সুন্দরভাবে কাটাতে চাই।তাই লাঞ্চ নিয়ে এসেছি।একসাথে খাবো বলে।”
“বাই এনি চান্স মায়াবতী কি আমার প্রেমে পড়েছে?”
“কেনো নিজের স্বামীর প্রেমে পড়া কি অপরাধ?”
“একদমই না।বরং স্বামীর প্রেমে পড়া প্রত্যেক স্ত্রীর নিজস্ব এক দায়িত্ব।”
“ইয়েস।তাহলে শুরু করা যাক।”
বলেই মায়া খাবারগুলো বাড়তে থাকে।দুজনে মিলে খাওয়া দাওয়া করে একসাথে।
গাড়ির ফ্রন্ট সিটে হেলান দিয়ে পা লম্বা করে শুয়ে আছে তারেক।সাউন্ড বক্সে বাজতেছে গান।গানের তালে কল্পনা করছে পুরনো অতীত।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
গ্রামের সাদা সীদে তারেক কৃষি কাজ করছে।হাঁটু ফাঁকা রেখে লুংগি উচু করে গুটিয়ে রাখা আছে, কোমরে গামছা বেঁধে রেখেছে আর গায়ে নরমাল পাতলা সাদা গেঞ্জি। রোদ্রের তাপে পুরো শরীর ঘেমে একাকার।তারেক দেখতে এমনিতেই কালো আর এই কড়া রোদে যেনো তাকে আরো পুড়িয়ে দিচ্ছে।দুপুর বেলা না খেয়ে পরিশ্রম করতে থাকে সে।হঠাৎ দূর থেকে তার কানে ভেসে আসে একটি মধুর ডাক।তারেক তাকিয়ে দেখলো সেদিকে।পঞ্চদশী এক কন্যা সুতির কাপড়ের ফ্রগ পড়ে আছে দুই পাশে বিনুনি। পরী দূর থেকে দৌড়ে দৌড়ে বলছে,”কালাচান ও কালাচান।তোমার লাইগা খাওন আনছি।খাইবা না?”
তারেক সরল সহজ হাসি দেয় পরীর দিকে তাকিয়ে।পাশে থাকা দু একজন সঙ্গী মজা করে বলে,”ওই দেহ কালাচান তোমার হুরপুরি আইছে।যাও যাও খাইয়া আও।”
তারেক গামছাটা কোমড় থেকে খুলে হাত মুছে এগিয়ে আসে পরীর দিকে। পরী বলে,”কি এত কাম করো তুমি?খালাম্মা আমারে খালি পাঠায়।তুমি যাইতে পারো না বাসায়?”
তারেক পরীর মাথায় আলতো চাটি মেরে বলে,”তুমি যে আমারে দেখবার লাইগা ছুইটা আও এইটা আমি খুব ভালা কইরা জানি।হুদাই নাটক করা লাগতো না।”
পরী এক গাল হেসে দেয়।বলে,”খালি আমি তোমারে দেখবার চাই।তুমি চাওনা বুঝি?”
“হো চাই তো।আচ্ছা দেও খাওন দেও।আশেপাশে লোকজন দেখতাছে তোমারে।গ্রামের পোলারা শকুনের নজর দেয় তোমার দিকে দেখোনা?মাথায় কাপড় দিয়া চলবা। আর একা একা এত বাইর হবা না।”
“আইচ্ছা ঠিক আছে।নেও এবার খাইয়া লও।”
তারেক গামছা দিয়ে বাঁধা টুপ্লা খুলে দেখে তাতে গরম ভাত ও মাছের ঝোল।আরাম করে খায় সে। পরীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে,”তুমি খাইছো দুপুরে?”
“না।বাড়ি যাইয়া খামু।মা মাংস রানছে।”
“আমার মাংস কই?”
“আমাগো বাড়ির মাংস তোমারে দিমু কে?খালাম্মা যা রানছে তাই দিয়া পাঠাইছে।এগুলি খাও।”
“আমাগো মত গরীব ঘরে তোর কষ্ট হইবো হুরপুরি।তুই খাস মাংস আর আমি খাই পুটি মাছ।এটা তো আকাশ পাতাল তফাৎ।”
“হুনো কালাচান।আমি পুটি মাছ খাইয়াও থাকতে পারমু।তোমারে ভাবতে হইবো না।”
আরো কিছু কল্পনা করতে যাবে ঠিক তখনই তারেকের ফোনে ম্যাসেজের শব্দ আসে।ফোন হাতে নিয়ে দেখে,”মাই ডিয়ার ব্ল্যাক ডায়মন্ড।মিস ইউ সো মাচ আমার হবু বাবুদের আব্বু।আমি আজ দেরি করে খাবো।তুমি নিজের মতো করে খেয়ে নিও।”
ম্যাসেজটি পড়ে ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো তারেক।
শীতের সমাপ্তি আসতে চলেছে।এখন হালকা শীতের সাথে গরমের দেখা মিলে।সেই সাথে মাঝে মাঝে বয়ে যায় বাতাস।হিয়া অনুভব করছে সেই বাতাস।পরীক্ষা দিয়ে এসে ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে ছাদে দাড়িয়ে আছে হিয়া।বুকে জড়ানো উপন্যাসের বই।ছাদ থেকে দেখা যাচ্ছে দূর রাস্তায় হেঁটে চলা এক কপোত কপোতীকে।তারা একে অপরের হাতের সাথে হাত মিলিয়ে হাঁটছে রাস্তার পার দিয়ে।প্রেমিক তার প্রেমিকার হাত ধরে বুঝেশুনে রাস্তা পার করে দিচ্ছে।এইটুকু দেখেই হিয়ার মনে জাগ্রত হলো রুদ্রের করা যত্নগুলো।আনমনে রুদ্রকে নিয়ে ভাবছে আর দেখতে থাকে রাস্তায় থাকা প্রেমিক প্রেমিকাদের।
হিয়ার ভাবনার মাঝেই কেউ একজন তার সামনে এক হাত দিয়ে ধরে রেখেছে চায়ের কাপ।হাতের দিকে না তাকালেও হিয়া বুঝে নেয় এটা রুদ্র।ভ্রু কুঁচকে পাশে তাকাতে তাকাতে বলে,”সমস্যা কি আপনার রু…”
আর বলতে পারে না হিয়া।আজকে রুদ্র না আজকে চা নিয়ে এসেছে মায়া।হিয়া মায়াকে দেখে রুদ্রের নাম আর পুরোপুরি তুললো না।মায়া হিয়ার দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে বলে,”আমাকে বুঝি পছন্দ না?”
হিয়া অপ্রস্তুত হয়ে উত্তর দেয়,”এমা না ভাবী।তোমাকে আমার খুব পছন্দ।আমি তো ভেবেছিলাম অন্য কেউ।”
“এই অন্য কেউ কি তোমার কাছে খুব স্পেশাল?”
হিয়া মায়ার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে বলে,”নাহ।কোনো স্পেশাল কিছু না।”
মায়া রাস্তার দিকে ঘুরে তাকায়।হিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,”কখনও কাউকে মন থেকে ভালোবেসেছো?”
“না।”
“বেসো না।ভালোবাসা খুবই খারাপ একটা শব্দ। যার জীবনের সাথে গেঁথে যায় তার মনকে খুব করে পোড়ায়।”
“কিন্তু তুমি আর ভাইয়া তো একে অন্যের জন্য পাগল।যেভাবে এন্ট্রি নিলে আমাদের মহলে।”
“ভালোবাসা হারাতে চাই না তাই আকড়ে ধরে রাখার প্রচেষ্টা।তুমিও এমন করতে পারো যদি তোমার ভালোবাসাকে নিজের অতি নিকটে করতে চাও।”
“আমি কাউকে নিজের করে পেতে চাই না।আমি মুক্ত পাখির মত উড়তে চাই।”
“খুব ভালো ডিসিশন।তোমার ভাই আর আমি সব সময় তোমার পাশে আছি।”
“থ্যাংক ইউ ভাবী।”
“মোস্ট ওয়েলকাম।”
বলেই চলে যায় মায়া।মায়া নিচে নামতেই সিড়ির নিচে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে।কারণ সদর দরজা দিয়ে রুদ্রের সাথে প্রবেশ করেছে মোহন সরদার।মায়া ছলছল নয়নে তাকিয়ে আছে সেদিকে।মায়াকে দেখে ক্ষেপে যান মোহন সরদার।তেড়ে এসে বলে,”তুমি আমার বাড়িতে কি করো মেয়ে?”
মায়া কম কিসে।সেও তেজী সুরে বলে,”মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ।এটা আমার শ্বশুর বাড়ি।আপনার তামাশা দেখানোর জায়গা নয়।আমাকে মেয়ে নয় এই বাড়ির বড় বউ বলে সম্মান করুন।”
মোহন সরদার ভ্রু কুচকে বলেন,”কে এই বাড়ির বড় বউ?”
মাহমুদ সরদার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলেন,”মেহেরুন জাহান মায়া এই বাড়ির বড় বউ।আমাদের রাজের বউ সে।”
“রাজ কবে বিয়ে করলো?”
“কাল।”
“এই জন্যই তোমরা আমার ফোন ধরছিলে না।পুলিশ বারবার তোমাদের কল করেও পায়নি।”
সোনালী ভ্রু কুচকে বলে,”পুলিশ কেনো ফোন করবে?”
“কারণ আমাকে পরশুদিন অ্যারেস্ট করা হয়েছিলো।”
“হোয়াট!কিন্তু কেনো?”
মোহন সরদার হাত উচু করে ইশারা করে মায়ার দিকে আঙুল তাক করে।রাজ বাড়িতে তখনই প্রবেশ করে।দেখতে পায় এক বাবা তার মেয়ের দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করছে।বাবা ও মেয়ে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ানো কিন্তু দুজনের চোখেই দুজনের জন্য বিষে ভরা।মোহন সরদার বলেন,”এই মেয়ের জন্য আমি দুইটা রাত জেলে কাটিয়েছি।”
মায়া দুষ্টু হেসে বলে,”তা আমার কাকাশশুর কি এমন করেছিলেন যে সোজা জেলে যেতে হলো?”
মোহন সরদার কয়েক কদম হাঁটতে হাঁটতে বলেন,”একদম গলা উঁচিয়ে কথা বলবে না।খুন করে ফেলবো তোমাকে আমি মেয়ে।”
বলতে বলতে মায়ার কাছে এসে যেই মায়ার দিকে হাত বাড়াতে যাবে ওমনি রাজ এসে তার ডান হাত দিয়ে মোহন সরদারের হাতটি শক্ত করে ধরে নেয়।মোহন সরদার তাকিয়ে থাকে রাজের দিকে।মায়া তাকিয়ে আছে মোহন সরদারের দিকে।এই হাত এক সময় অফিস থেকে আসার পর কোলে করে আদর করতো। আর আজ এই হাত তাকে মারতে আসছে।কিন্তু মায়ার চোখে কোনো আক্ষেপ নেই মায়ার চোখে ফুটে উঠছে মোহন সরদারকে এখানেই দমন করার নেশা।রাজ মোহন সরদারের হাত ধরে বলে,”একদম আমার বউয়ের দিকে হাত বাড়াবে না।আমার বউ আমার আমানত।ওকে পেতে আমি করেছি মেহনত।ওর দিকে যে হাত বাড়াবে তার ওই হাত আমি আগুনে ছাই করে দিবো।”
মালিনী এই দৃশ্য দেখে রাজকে চিৎকার করে বলেন,”এটা কোন ধরনের বেয়াদপি রাজ?তোমার কাকা হয়।তার সাথে অসভ্য ব্যাবহার করছো এক বাইরের মেয়ের জন্য।”
মায়া কাঠিন্য চোখে পরখ করে নেয় সবাইকে।এক পাশে মালিনী সোনালী ও জারা আরেক পাশে সিয়া হিয়া ও মাহমুদ সরদার।মাঝখানে মায়া ও মোহন সরদারের মাঝে দেওয়াল হয়ে আছে রাজ আর তাদের সোজা পকেটে হাত দিয়ে দাড়িয়ে তামাশা দেখছে রুদ্র।রুদ্রের মুখেও এক রহস্যের হাসি।রাজ কিছু বলতে যাবে তার আগে মায়া বলে,”বাড়ির বউকে কিভাবে সম্মান করতে হয় এটা এই বাড়ির গুরুজনেরাই জানে না।ছোটরা কি শিখবে? আর আপনি আমার কাকাশশুর।আমার কাজ স্পয়েল করার শাস্তি তো পেলেন।এবার আমাকে মারতে আসলে তার ফল কিন্তু খুব খারাপ হবে।আমি মায়া ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী না।”
সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।জারা ফিসফিস করে সোনালীর কানে কানে বলে,”এই মেয়েকে কিভাবে আমার বেইবীর থেকে আলাদা করবে?”
“সব হবে।সময় সুযোগ একবার হলেও পাবো।ডোন্ট ওরি।”
মায়া সবার দিকে তাকিয়ে আবার বলে,”এই বাড়ি পক্ষ থেকে আমার গায়ে যদি একটা আঁচড় লাগে তো আমি তার নামে মামলা করে দিবো।সেই ক্ষমতা আমি নিজে অর্জন করে রেখেছি।”
বলেই উপরে চলে গেলো মায়া।মোহন সরদারের হাত ছেড়ে দিলো রাজ।তারপর বলে,”বউ আমার সেই ঝাজের।বেশি মাখামাখি করতে যেও না গা জলে উঠবে।”
মায়াবতীর ইচ্ছা পর্ব ২৬
কথাগুলো বলেই রাজ ঘুরে তাকালো মালিনীর দিকে।তাকে উদ্দেশ্য করে বলে,”আমি এই বাড়ির ছেলে আর মায়াবতী আমার বউ সেই সূত্রে এই বাড়ির বউ মেহেরুন জাহান মায়া।ওকে বাইরের মেয়ে নয় বরং এই বাড়ির বউ বলে সম্মান দেও।দেখবে ও তোমাদেরকে রাজার হালে রাখবে।
বলেই রাজ চলে যায় নিজের ঘরে।সিয়া ও হিয়া একে অপরের দিক চাওয়া চাওয়ি করে।রুদ্র শীষ বাজাতে বাজাতে উপরে চলে যায়।রুদ্রের শীষ বাজানোটাও যেনো বিষের মতো লাগছে মোহন সরদারের কাছে।