মায়াবতীর ইচ্ছা পর্ব ৪৯
ইশরাত জাহান
মায়ার সাথে করে তারেকের ছোট বাড়িতে গেলো মিলি।গাড়ি থেকে নেমে সোজা চলে গেলো তারেকের ঘরে।মায়া গাড়িতেই আছে।রাজ এসে বসলো মায়ার পাশে।রাজের কাধে মাথা রেখে তারেকের বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে মায়া।কলিং বেলের শব্দ বেড়েই চলেছে।না পেরে ঘুমঘুম চোখে দরজা খুলে দিলো তারেক।দরজার সামনে মিলিকে দেখে চোখ যেনো বড় বড় হয়ে গেলো।তারেককে কিছু বলতে না দিয়ে তারেকের বুকে কিল বসিয়ে দেয় মিলি।মারতে মারতে ভিতরে নিয়ে যায় তারেককে।মায়া ও রাজ এটা দেখে হেসে দেয়।
তারেককে সোফায় শুইয়ে মারতে থাকে মিলি।না পেরে মিলির হাত ধরে বসে তারেক।তারপর বলে,”মারছেন কেনো এভাবে?”
মিলি এবার চিল্লিয়ে বলে ওঠে,”কে আপনি হ্যা?আমি কি দেখতে বুড়ি নাকি তোমার সিনিয়র যে আমাকে আপনি আপনি করছ।আমাকে তুমি করে বলবে।শুধু তুমি না ‘আমার বাবুর আম্মু’ এভাবে ডাকবে।”
ভেবাচেকা খেয়ে তারেক বলে,”এহ!”
চোখ বড় বড় করে ভয় দেখিয়ে মিলি বলে,”এ না হ্যাঁ।চলো এখন।”
“কোথায়?”
“বিয়ে করব।কাজীকে কল করা হয়েছে।উনি আসছে।”
“এই রাতে কাজী!”
“হ্যাঁ ব্রোকে বলেছি।ব্রো বলেছে কাজী আসবে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“এই তোমরা ভাই বোন কি শুরু করেছো বলো তো?বিয়ে করবা দিনের বেলা তা না কাজীকে বউয়ের কাছ থেকে কেড়ে এনে ভোর নাহলে রাতের বেলা বিয়ে করো।সময় সুযোগ বুঝে বিয়ের অফার দিতে পারো না?”
“তুমি বিয়েতে রাজি হতে পারো না?বিয়েতে রাজি হলে তো ঠিক সময় করে ডাকতাম কাজী।”
“তুমি আমাকে বিয়ে করে সুখে থাকবে না।বেটার কাউকে দেখো।”
তারেকের টি শার্ট মুচড়িয়ে মিলি বলে,”ওয় তোমাকে কেউ বলেছে ভাষণ দিতে?আমি এই বাড়ির বউ হয়ে থাকবো।এমনিতেও বাড়িটা খারাপ না।বেশ পরিপাটি আছে।দুজনের জন্য এনাফ।”
“তোমার বাবা মা?”
“তাদের কথা ভাবতে হবে না।ব্রো আর ভাবী রাজী তাহলে টেনশন কিসের?তারা থাকতে কোনো সমস্যা নেই।শুধু তুমি রাজি হও তানাহলে কিন্তু এই রাতে কোনো একটা লাশ বেড় হবে এই বাড়ি থেকে।”
বলেই গুলি বেড় করলো মিলি।গুলিটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে মায়ার গুলি এটা।মায়া তার গুলিতে ‘M’ স্টিকার দিয়ে রাখে।যেটা এখন তারেক দেখতে পারছে।শুকনো ঢোক গিলে তারেক বলে,”লাশ বেড় হবার দরকার নেই।আমার ঘরে জলজ্যান্ত মানুষ আসলেই ভালো হবে।”
তারেকের কথার মানে বুঝে হেসে দিলো মিলি।বলে,”তাহলে চলো ডাকি কাজী।”
“চলো।”
মিলি দরজার কাছে যেয়ে ইশারা করে মায়া ও রাজকে।হাতে একটি প্যাকেট নিয়ে আসে মায়া ও রাজ।তারেকের হাতে দিয়ে রাজ বলে,”এটা পরে আসো।”
তারেক গেলো চেঞ্জ করতে।মিলি অলরেডি লেহেঙ্গা পরা আছে।চারজন গার্ড মিলে ধরে বেঁধে নিয়ে আসে কাজীকে।ঘুমন্ত লুংগি পরা খালি গায়ের কাজী হেলতে দুলতে আসে তারেকের বাড়িতে।কাজীর এই অবস্থা দেখে রাজ বলে,”আজকেও কি বলিসনি যে শাহমীর রাজ ডেকেছে?”
একজন গার্ড বলে ওঠে,”বলেছি স্যার।ব্যাটা ঘুমে মন্ত্রীকেই ভুলে গেছে।দেখছেন চারজন ধরে আছি আর ব্যাটা এখনও ঘুমায়।”
খাবার টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে রাজ ছুড়ে মারে কাজীর মুখে।ধড়ফড় করে কাজী বলে ওঠে,”বউ আমার আর যাইও না বাপের বাড়ি তোমার নামে করে দিবো আমার বাকি সম্পত্তি।”
রাজ এবার জোরে হেসে দেয়।তারপর বলে,”ব্যাটা কাজী তুমি আসলেই একটা পাজী।মন্ত্রীর সামনে বউয়ের নাম নেও।”
কাজী এবার তাকালো রাজের দিকে।ভয়তে ঢোক গিলে বলে,”আজকে কার বিয়ে দিতে ডেকেছেন?”
“আমার বোনের।”
“একটা কথা বলব বাবা?যদি কিছু মনে না করো।”
রাজ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো।কাজী বলে,”তোমাদের পরিবারে যার বিয়েই দেও না কেনো আমাকে আগে থেকে একটু বলে দিও।কিন্তু বাড়িতে ঢুকে পাঁজাকোলা করে এনো না।তোমাদের জন্য বউ চলে যাবে আমার।”
কাজীর কথা শেষ হতে না হতেই সেখানে হাজির হয় রেজিস্টার। রেজিস্টার এবার মায়ার দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে বলে,”এবার কি বউ রাজি বাবা?”
রাজ তাকালো রেজিস্টারের দিকে তারপর বলে,”এবার বউ রাজি তবে বর রাজি না।”
“কি বলো বাবা!তাহলে বিয়ে হবে কিভাবে?”
পকেট থেকে গুলি বেড় করে রাজ বলে,”এটা আছে কিসের জন্য?”
রেজিস্টার ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলে,”বলি কি বাবা যারা রাজি থাকে না বিয়েতে দোষ তো তাদের।তুমি তাদেরকে খুন করো।কিন্তু আমরা তো দোষ করিনি আমাদের কেনো মারবে?”
রাজ এবার চ করে ওঠে।তারপর গার্ডদের বলে,”এদের মুখ বেঁধে রাখো তো।খালি বাজে কথা বলে।বিয়ের সময় শুধু মুখ খুলে দিবে।”
তারেক এলো পাঞ্জাবি পরে।মিলিকে একটু ঠিক করে দিলো মায়া।তারপর মিলিকে নিয়ে হাজির হলো ডাইনিং রুমে।কাজীর কাজ কমপ্লিট করলে রাজ তাকালো রেজিস্টারের দিকে।উনি রাজের দিকে তাকিয়ে বলে,”কাগজপত্র তো রেডি নেই বাবা।”
কঠিন চোখে তাকালো রাজ।রেজিস্টার ভয় পেয়ে বলে,”ইয়ে মানে এগুলো রেডি করতে গেলে তো আগে থেকে জানা লাগে।মন্ত্রীর বাড়ির মেয়ের বিয়ে হবে আগে জানলে নাহয় কাগজ রেডি রাখতাম।কিন্তু আমি তো জানতাম না।”
এবার মায়া তার নিজস্ব উকিলকে কল করে বলে,”রেজিস্ট্রি পেপার রেডি করুন।এক ঘণ্টার মধ্যে রেজিস্ট্রি করা হবে।”
বলেই কল কেটে দিলো মায়া।রাজ এবার সোফায় হেলান দিয়ে বলে,”বেচারা উকিল!নিজের বিবাহিত জীবন না দেখে অন্যের বিয়ের পাঁয়তারা শুরু করবে।ঠিকই আছে এদের জন্য।আমি মন্ত্রী হয়ে বউ নিয়ে রাত বিরাতে ঘুরতেছি এরা কেনো বউ নিয়ে আরামে থাকবে?”
কাজী এবার সাহস করে রাজকে বলে,”মনে কিছু না করলে গুরুজন হিসেবে একটা কথা বলব বাবা?”
রাজ তাকালো কাজীর দিকে।কাজী বলদের মতো হেসে বলে,”তোমার বউ মনে হয় তোমার দ্বারা সুখী না।তাই তো বিয়ে করতে রাজি ছিলো না এখন আবার বউকে কাছে পাও না বলে আফসোস করো।”
রাজের চোখে মুখে হিংস্রতার ছাপ।দেখে মনে হচ্ছে বাঘের রূপ ধারণ করেছে।কাজী শুকনো ঢোক গিলে বলে,”না মানে নিজে বউকে কাছে পাও না বলে আমাদের মতো অসহায় মানুষদেরকে বউ থেকে দূরে রাখো।কখনও সকালের শীতের ভিতর বউয়ের কাছ থেকে দূরে রাখো তো কখনও রাতের গরমের আভাসে বউয়ের থেকে দূরে রাখো।এভাবে চললে তো আমরা বুড়ো বয়সে বউ হারা হবো বাবা।তার থেকে তোমাকে তোমার বউয়ের মন পেতে আমি উপায় দিতে পারি।”
কাজীর শেষের কথাটি পছন্দ হলো রাজের।হেলান দেয়া থেকে উঠে বসে বলে,”কি উপায় পাজী থুড়ি আমার দুষ্টু কাজী?”
লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিমা করে হেসে কাজী বলে,”আমার কাছে একজন কবিরাজ আছে।উনি বউকে কাছে পাওয়ার দোয়া দুরুদ জানে।যেটা পানিতে ফু দিয়ে দিবে উনি।তোমার বউকে ওটা খাওয়ালে বউ আর রাতের বেলা পালাই পালাই করবে না।”
হো হো করে হেসে দেয় রাজ।কাজীর দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমার যেনো কয়টা বাচ্ছা?”
“আজ্ঞে দুইটা।”
“দুটোই তো আগের ঘরের?”
“হ্যাঁ।”
“তিন নম্বর বিয়ে তো দুই বছর ধরে হয়েছে।বাচ্চা নেও না কেনো?”
এবার চুপ হয়ে গেলো কাজী।রাজ বলে ওঠে,”বেশি পক পক করলে আমি নিজ দায়িত্বে তোমার বউকে অন্যের গলায় ঝুলিয়ে দিবো কাজী।আমার এই গুলির পাওয়ারে তোমার কবিরাজের পানি পড়া কাজে লাগে কি না দেখিয়ে দিবো।”
কাজী এবার পুরো চুপ হয়ে গেলো।আসলেই সত্যি কথা।পানি পড়া খেয়ে যা একটু বউ আছে।রাজের গুলি দেখলে বউ ওখান থেকে পালাবে।ওদের কথার মাঝে মায়ার উকিল চলে আসে।রেজিস্ট্রি পেপার নিয়ে এসে সই নিলো মিলি ও তারেকের।সাক্ষী হিসেবে ছিলো মায়া ও রাজ।
গভীর রাতে গান বাজনার সাথে গাড়ি আসছে সরদার বাড়িতে। ঢাক ঢোল বাজতে থাকে জোরে জোরে।সবাই উঠে যায় ঘুম থেকে।মৌয়ের অনুষ্ঠান শেষ করে সবাই এসে যে যার মতো ঘুমিয়ে গেছিলো।এখন উঠে পরে।সোনালী এখন আলাদা ঘরে ঘুমায়।মোহন সরদার তার রুমে আছে। ঢাক ঢোলের শব্দে সবাই বেড় হয়ে এলেও মোহন সরদার এখনও আসেনি। আয়রা নিজেও এসেছে হল রুমে। ঢাক ঢোলের তালে তালে নাচতে থাকে মায়া ও রাজ।গাড়ি থামার সাথে সাথে গাড়ি থেকে বেড় হয় মিলি ও তারেক।এদেরকে একসাথে দেখে হা হয়ে যায় সোনালী।সিয়া দৌড়ে গেলো মিলির কাছে।মিলিকে জড়িয়ে বলে,”ভাইয়া বলল তুমি ভাইয়ের সাথে তাই আমরা রিলাক্স ছিলাম।কিন্তু তুমি গলায় মালা নিয়ে পাশে তোমার ব্ল্যাক ডায়মন্ডকে নিয়ে আছো যে।কাহিনী কি?”
মিলি লাজুক হেসে বলে,”তোদের বোন এখন বিবাহিত। তাই তার স্বামীকে নিয়ে এসেছে।”
সিয়া খুশি হয়।কিন্তু মিলির হাত ধরে এক টান দিলো সোনালী।মিলির গালে চড় মারতে যাবে ওমনি সোনালীর হাত ধরে মায়া।রক্তিম চোখে মায়া বলে,”মেয়ে বিয়ে করে এসেছে সুখে সংসার করবে বলে।আপনার হাতে চড় থাপ্পড় খেতে নয়।”
সোনালী চোখ রাঙিয়ে বলে,”আমার মেয়েকে আমি মারব নাকি কি করব এটা আমার ব্যাপার।তুমি মাথা ঘামানোর কে?”
“ব্যাপারটা একান্ত আপনার হলে আমি ইন্টারফেয়ার করতাম না।কিন্তু এখানে আমার ভাইয়ের ব্যাপার।সেই ভাই যার চারকুলে আমি ছাড়া কেউ নেই।তার মৃত মায়ের কাছে ওয়াদা করে রেখেছি তার সবকিছুর খেয়াল রাখবো আমি।সেই ভাইয়ের বউকে নিজের সামনে মার খেতে দেখি কিভাবে?”
কথাগুলো হলেই হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে দিলো মায়া।মাহমুদ সরদার এসে মিলি ও তারেককে ভিতরে নিয়ে আসে।
এখন প্রায় ভোর।রাতে ঘুম হয়নি কারো।সূর্য উঠেছে মাত্র।মাহমুদ সরদারের কথামত কিছু গহনা এনে দিলো মালিনী।দুজনকে বরণ করে মাহমুদ সরদার বলেন,”তোমরা এখন একটু ঘুমিয়ে নেও।মিলি মা এখন সিয়ার ঘরে যাও আর তারেক রুদ্রর ঘরে যাও।আমরা মিলির ঘরটা সাজাবো আজ।আজকে সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান সেরে তোমাদের পাবলিকলি গ্রহণ করব।”
মালিনী বলেন,”আজকে তো ভাই ভাবী আসবে। বীরের কবর দেখতে।”
“কিছু করার নেই।বিয়ে যখন হয়েছে অনুষ্ঠান হবে। আর ভাই ভাবী এসে তো বেশ কয়েকদিন থাকবে।তাই প্রথমদিন নাহয় এদের অনুষ্ঠান উপভোগ করুক।”
মামা মামী আসবে বলে একটু চিন্তায় পড়ল রাজ।মাহমুদ সরদার এসে রাজের কাধে হাত রেখে বলেন,”চিন্তা করো না।এবার যা হবে ভালো কিছু হবে।”
রাজ মাথা দুলিয়ে বলে,”ভালো কিছু হতেই হবে।”
বীরের বাবা মা আসবে শুনে সোনালীর মুখে হাসি ঝুলে আছে।যেটা চোখ এড়ায়নি মায়ার।সবার দিকে তাকানোর পর মায়ার চোখ গেলো আয়রার দিকে।আয়রা নিজেও হেসে দেয়।মায়া এবার তারেকের পাশে এসে বলে,”কংগ্রাচুলেশন ভাই।”
“থ্যাংক ইউ।”
“বিয়ে হয়েছে বলে এবার শাশুড়ির দলে চলে যাবে না তো?”
তারেক দেখলো সোনালীকে।বলে,”এই তারেক কখনও বেইমানি করতে শিখেনি ম্যাডাম।এটুকু আপনি বিশ্বাস রাখতেই পারেন।”
“বীরের বাবা মা আসতে চলেছে।আমাদেরকে আরো বেশি সবদিকে নজর রাখতে হবে।বিশেষ করে এই সোনালীকে।অফস তোমার শাশুড়িকে।আমার শাশুমাকে আমি নিজেই দেখে রাখবো।এক কথায় এরা একেকজন কে কোথায় যায় এটা আমাদের জানতে হবে।”
মায়াবতীর ইচ্ছা পর্ব ৪৮
আলতো হেসে তারেক বলে,”এই বাড়ির জামাই হয়েছি তো শাশুড়িকে জ্বালাতে।চিন্তা করবেন না আমি আমার শাশুড়িকে ফলো করব আর আপনি আপনার শাশুড়িকে।”
বলেই মায়া ও তারেক একে অপরকে দেখে ভিলেনি হাসি দেয়।