মায়াবতীর ইচ্ছা পর্ব ৬৪

মায়াবতীর ইচ্ছা পর্ব ৬৪
ইশরাত জাহান

সকাল বেলা,
পুরো সরদার পরিবার আজ একসাথে দাড়িয়ে আছে মাহমুদ সরদারের বাবার ঘরের সামনে।সবার সাথে মানিক আদ্র রুদ্র আর জেসিও আছে।উদ্দেশ্য একসাথে সিক্রেট রুমে যাওয়া।ওখান থেকেই লকারের কাছে যাওয়া।মাহমুদ সরদারের বাবার ঘরে ঢুকে সবাই চারপাশ তাকালো।পুরোনো স্মৃতি জমে আছে।মায়া ও রাজ দুজনেই তাদের দাদাজানকে স্মরণ করছে আজ।দাদুর ঘরে এসে ড্রেসিং টেবিল বরাবর সবাই তাকালো।মায়া এগিয়ে গেলো সেদিকে।আয়না হাত দিয়ে সরিয়ে দেখা গেলো সেখানে একটি ছোট চিকন দরজা।ওই দরজার চাবি শাহানা পারভীন মালিনীর হাতে দিয়েছিলেন।কারণ শাহানা পারভীনকে আহত করে তার থেকে যা কিছু পাওয়া যাবে ওরা নিয়ে যেতে পারতো।

মালিনী এসে চাবিটি দিলো মায়ার হাতে।মায়া দরজাটি খুলে ভিতরে ঢুকলো।আস্তে আস্তে সবাই একসাথে ভিতরে ঢুকতে থাকে।ধুলাবালিতে ভরা চারপাশ।বছরের পর বছর বন্ধ ছিল এই ঘরটি।উপরের দিকে দেওয়ালের সাথে মিশে আছে ঝুল।দরজা খুলতেই গরমের বাজে গন্ধ ভেসে আসলো সবার নাকে।মায়া খুক খুক করে কাশতে থাকলো।রাজ এসে মায়াকে আগলে রাখলো।মায়ার উদ্দেশ্যে বলে,”আজ তাহলে থাক এই কাজগুলো।আমি আমার মায়াবতী আর বাচ্চার কোনো ক্ষতি সহ্য করতে পারব না।তোমার ডাস্ট এলার্জি আছে।চলো মায়াবতী।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মায়ার হাত ধরে রাজ বের হতে নিলেও যেতে পারে না। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে মায়া।রাজ ঘুরে তাকালো মায়ার দিকে।মায়া বলে,”দেরি জিনিসটা মায়ার সহ্য হয় না মন্ত্রী মশাই।চারপাশে শকুনের কু নজর লেগে থাকে।এসব কাজ যত তাড়াতাড়ি মেটানো যায় তত ভালো।”
মায়ার কথাতে সম্মতি দিয়ে মাহমুদ সরদার বলেন,”মায়া মা ঠিক কথা বলেছে রাজ। এখান থেকে বের হয়ে নাহয় মায়া মা ফ্রেশ হয়ে নিবে।চারপাশে আমাদের শত্রু লেগেই আছে।তোমার বিরোধী দলের কথা ভুলে যেও না।তোমার এত বড় ক্ষমতার কথা তাদের কানে পৌঁছাতে সময় লাগবে না।যেহেতু আজ বড় আয়োজন করে রেখেছো।মিডিয়া সহ দেশের নামকরা কৃষি বৈজ্ঞানিক আর চাষীরাও অপেক্ষায় আছে আমাদের জন্য।”

রাজ আর বাধা দিলো না।মায়া নিজেকে শক্ত রেখেছে।রাজ শুধু তার মায়াবতী আর সন্তানের কথা চিন্তা করছে।কিন্তু এখন মায়ার কথাতে বুঝতে পারলো একবার যখন মায়া জেদ ধরেছে আজ এই কাজের সমাপ্তি হবে।সোনালী ও বিভানের পর্দা ফাঁস করেই এই ফর্মুলা পাবলিক করার কথা ছিলো।কিন্তু মোহন সরদারের মৃত্যুর জন্য সম্ভব হয়নি।সিয়া আর হিয়া নাকে কাপড় দিয়ে কাশতে থাকে।আদ্র আর রুদ্র সাথে জেসি নিজেও এসেছে।কাজের সুত্রে জেসিকে এখানে থাকতে হবে।শাহানা পারভীন আর মালিনী দাদুর রুমে বসে আছে।সিক্রেট রুমের ধুলাবালিতে শাহানা পারভীনকে আসতে দিলো না মায়া।কয়েকদিন হলো তিনি সুস্থ।এখন আবার রোগ বাদালে মায়া টেনশন করবে খুব।তাই শাহানা পারভীনের সাথে মালিনী নিজেও আছে।মৌ এখন প্রলয়কে নিয়ে ব্যস্ত সাথে আছে মিলি।তাই ওরাও আসেনি এখানে।মায়া রাজের হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে লকারের কাছে।লকারের কাছে এসে মানিককে ডাকলো রাজ।বলে,”এই ফর্মুলার পিছনে আংকেলের অবদান অনেক।আমার মা আর আংকেল ছিলেন বলেই এই ফর্মুলা তৈরি হয়েছে।তাই আমাদের সাথে তুমিও এই ফর্মুলা বের করবে।”

মানিক এগিয়ে যেতে নেয়।জেসি এসে বাধা দিয়ে বলে,”আপনাকে সেনিটাইজ করতে হবে।ওখানে অতিরিক্ত ময়লা।মনে আছে সেদিন সামান্য ধুলাতে আপনার হাতে এলার্জিতে ভরে গেছিলো।তাই সেনিটাইজ করুন।”
জেসি একটি স্প্রে বোতল বের করে মানিকের হাতে স্প্রে করে।যেটাতে ছিলো সেনিটাইজার।মানিক জেসির দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে সেনিটাইজ করে চলে যায়। মায়ারাজ একে অপরকে দেখে নেয়।দুজনেই দুজনকে দেখে মলিন হাসে।বুঝতে বাকি নেই এই কয়েক দিনে মানিক আর জেসি একজন আরেকজনকে ভালোবেসেছে।মানিক এগিয়ে আসলো মায়ারাজের দিকে।রাজ মানিক একসাথে দাঁড়িয়ে আছে।ওদের সামনে মায়া।লকারের গায়ে কিছু বোতাম।যেগুলো চাপতে হবে।মায়া একেক করে চাপলো ‘MAYARAZ’।এটা দেখে মাহমুদ সরদার ছাড়া সবাই একসাথে বলে,”দাদাজান তাহলে মায়ারাজ জুটি আগে থেকেই ঠিক করে গেছে?”

মাহমুদ সরদার বলেন,”হ্যাঁ।মায়া মায়ের জন্মের সময় মোহনের সাথে মিলিয়ে ওর নাম মোহনা সরদার দেওয়া হয়।কিন্তু বাবা ওকে মায়াবতী বলেই বেশি ডাকতো।আর রাজ ওটা শুনেই ওকে মায়াবতী বলতো।সেই থেকে বাবার মনে হয় আমাদের রাজ আর মায়া এক হলে ভালো হবে।বাবা পুরোনো দিনের মানুষ।তিনি আধুনিকতা বুঝতেন না।তাই নিজের আপনমনে মায়ারাজের বিয়ে ছোটবেলায় কাজী ডেকে নিজের মত করে দেয়।আমিও বাবার এই ইচ্ছাকে সমর্থন করেছিলাম।শুধু আমি না শাহানা নিজেও এটাতে রাজি ছিলো।বাবার মুখের ওপর কথা বলার সাহস আমাদের নেই।তাছাড়া আমরা নিজেরাও খুশি হই এই সম্পর্কে।এক বাড়িতে ছেলে মেয়ে দুটো থাকবে।এটা তো আমাদের কাছে তখন ঈদের আনন্দের মত ছিলো।”

লকার খুলে একটি বোতল দেখা গেলো।যেটা কিছুটা হলুদ রঙের।তারপাশে কিছু কাগজ।বোতলটি হাতে নিয়ে মায়া আলোর সামনে দাড়াতেই চিকচিক করছে।কাচের বোতলে হলুদ রঙের পানি।কাগজগুলো দেওয়া হলো জেসির হাতে।ওগুলো পড়ে জেসি বলে,”এটা ফর্মুলা তৈরির ডিটেইলস।কিভাবে এই ফর্মুলা বানানো হয়েছে।এছাড়া কিভাবে সংরক্ষণ করা যাবে।আর কি কি উপাদান জোগাড় করে এই ফর্মুলা আরো বানানো যাবে এই সকল বিষয়ে এখানে ডিটেইলস লেখা।এছাড়া এখানে লেখা আছে এক ধরনের সারের বিষয়ে।যেই মাটিতে সার ব্যাবহার করা আছে।”
জেসির কথা শুনে রাজ এগিয়ে গেলো লকারের দিকে।সেখানে কিছু শুকনো সার দেখতে পেলো।সারগুলো হাতে নিয়ে রাজ বলে,”এই যে এই সার।তাহলে এগুলো নিয়েই যাওয়া যাক আমাদের বাবা মায়ের উদ্দেশ্য সফল করতে?”
শেষের কথাটি রাজ মানিকের দিকে তাকিয়ে বলে।মানিক সম্মতি দিলো।বলে,”আপনি আর মায়া মিলে আসুন।আমরা আমাদের মত চলে যাই।ওদিকটায় কি হচ্ছে দেখতে হবে।”

রাজ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো।ফর্মুলা রাজ নিজের কাছে রাখছে।মায়াকে নিয়ে ফর্মুলা সহ যাবে জনসম্মুখে।গোসল করে এসেছে মায়া।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তৈরি হতে থাকে।রাজ এখনও চিন্তিত।এবার ফিচেল হাসে মায়া।বলে,”তুমি শুধু শুধু চিন্তা করছো মন্ত্রী মশাই।”
হালকা কেপে উঠলো রাজ।বলে,”কিসের চিন্তা!আমি কোনো চিন্তা করছি না।”
সোফার কাছে এসে রাজের পাশে বসে মায়া।রাজের অতি নিকটে নিজের মুখ রেখে বলে,”এই মায়া তার মন্ত্রী মশাইকে খুব ভালোভাবে চেনে জানে এমনকি ভালোবাসে মন্ত্রী মশাই।মায়ার চোখ ফাঁকি দেওয়া যায় না।”
রাজ তার ডান হাত মায়ার মুখের উপর রাখলো।মায়াকে বলে,”আর কোনো বিপদ আসবে না তো আমাদের জীবনে?আমাদের সন্তান সুষ্ঠুভাবে পৃথিবীর মুখ দেখবে তো?”

“তোমার মায়াবতীর ইচ্ছা কি কখনও অপূর্ণ থেকেছে যে এটা অপূর্ণ থাকবে?অবশ্যই আমাদের সন্তান আল্লাহ চাইলে পৃথীবির মুখ দেখবে।শুধু তাই না আমাদের জীবনে কোনো বাধা বিপদ আসবে না।আসলেও আমি আর তুমি মিলে একসাথে দমন করে দিবো।যেমনটা এতদিন করেছি।”
মায়ার গলায় নাক ডুবিয়ে দেয় রাজ।চোখ বন্ধ করে আরামের সাথে বলে,”এবার একটু শান্তিতে সংসার করতে চাই মায়াবতী।”

মায়া রাজের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”এবার তাই হবে মন্ত্রী মশাই।”
এবার শুরু হলো রাজের দুষ্টুমি।মায়ার কোমড়ে চিমটি কেটে দিলো রাজ।মায়া চিল্লিয়ে বলে,”আউচ।”
মায়া একটু সরে যেতে নেয়।রাজ দুষ্টু কণ্ঠে বলে,”দুষ্টুমি করতে নেই মায়াবতী।”
মায় হেসে দেয়।বলে,”চলো এবার যেতে হবে।সবাই অপেক্ষা করছে তো আমাদের জন্য।”
মাথা নাড়িয়ে রাজি হয় রাজ।চলে যায় মায়ার সাথে।সামনে আর পিছনে চারটা করে মোট আটটি গাড়িতে গার্ড আর মাঝের গাড়িতে মায়ারাজ।গার্ডগুলো কিছু রাজের আবার কিছু মায়ার।মায়া রাজের হাতের সাথে হাত মুঠ করে বসে আছে গাড়ির পিছন সিটে।দুজনেই বাইরের দৃশ্য দেখতে থাকে।হঠাৎ করেই রাজ সামনে থাকা ড্রাইভারকে বলে,”চোখটা সোজা রেখে ড্রাইভ করবেন।আপনাদের মন্ত্রী মশাই এবার প্রেম করবে।”
বলেই মায়াকে এক টান দিয়ে নিজের কাছে আনে।ড্রাইভার তার সামনের আয়নায় একটি ছোট্ট রুমাল দিয়ে রেখেছে।রাজ মায়াকে নিজের কাছে এনে তার ওষ্ঠের কাজ সম্পন্ন করতে থাকে।কাজ সম্পন্ন করে রাজ দূরে সরে আসে।মায়া হাঁফাতে থাকে।রাজ ফিচেল হেসে বলে,”আজকের মর্নিং কিস দেওয়াটা মিস করেছিলাম।তাই এখন কমপ্লিট করলাম।কোনো কাজ অসম্পন্ন রাখে না এই শাহমীর রাজ।”

সামনে তাকিয়ে রাজ দেখলো ড্রাইভার মনোযোগ দিয়ে ড্রাইভ করছে।সে খুব ভালো করেই জানে এসবে কান রাখলে ওই কান রাজ কেটে ফেলবে।তাই কিছু শুনেও যেনো শোনেনি সে।রাজ জানালার গ্লাস নামিয়ে ড্রাইভারকে বলে,”এবার রুমাল সরাতে পারেন।”
ড্রাইভার তাই করলো।এই মন্ত্রীর কোনো ঠিক ঠিকানা নেই।কখন কি বলে কি করে সে একাই জানে।তার কাজ মন্ত্রীর উপদেশ পালন করা।সে তাই করছে।
অবশেষে সবাই এসে পৌঁছালো আশ্রমের সামনে।আশ্রমের বড় মাঠে আজ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।রাজ গাড়ি থেকে নামতেই সাংবাদিক এসে হাজির।কেউ কেউ এসে ফুলের মালা পরিয়ে দিচ্ছে রাজকে।আবার কেউ কেউ ফুলের তোরা দিচ্ছে।রাজ ওদেরকে সাইড কাটিয়ে সোজা চলে যায় মায়ার দিকে।মায়ার দিকে এসে গাড়ির দরজা খুলে বলে,”মায়াবতী মাই ওয়ান এন্ড অনলি ওয়াইফ।আসো এবার।”

বলেই রাজ তার হাত বাড়িয়ে দিলো।রাজের হাতের সাথে হাত মিলিয়ে মায়া বের হয়।মুখে তার মায়াবী হাসি।মিডিয়ার লোক এসে মায়াকে প্রশ্ন করে,”ম্যাম আমরা শুনেছি আপনি আর স্যার আমাদের গুড নিউজ দিতে যাচ্ছেন।এটা কি সত্যি ম্যাম?আমরা সত্যি আপনাদের থেকে গুড নিউজ আশা করছি?”
মায়া শুধু হ্ বলেছিলো আর কিছু বলবেতার আগেই রাজ বলে,”গুড নিউজ অবশ্যই আমরা স্বামী স্ত্রী মিলে দিবো।তোমার বউয়ের সাথে আমার একত্রে গুড নিউজ আসবে না নিশ্চয়ই!যে তুমি অন্যকিছু আশা করবে।”
রাজের এই ঘাড় ত্যাড়া উত্তর শুনে সাংবাদিক ছেলেটি লজ্জা পেলো।মায়া রক্তচক্ষু করে তাকালো।রাজ এই দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলে,”আরে দেখছো না মায়াবতী।ওরা আমাদের থেকে গুড নিউজ আশা করবে কি না এটা নিয়ে আমাদেরকেই প্রশ্ন করে।আমি কি তুমি ছাড়া গুড নিউজ আনতে পারি বলো?”

“একবার এনেই দেখো মন্ত্রী মশাই।তোমাকে আর তোমার গুড নিউজ আলীকে আমি মাটিতে পুঁতে রেখে দিবো।”
বলেই মায়া চলে গেলো ওখান থেকে।রাজ একা দাঁড়িয়ে আছে মিডিয়ার সামনে।ক্ষিপ্ত হয়ে সাংবাদিককে বলে,”ব্যাটা বলদ।এমনি উল্টা পাল্টা প্রশ্ন করে নিউজ বানিয়ে কমেন্ট বক্সে আমাকে গালি খাওয়াস।তাতে শান্তি হয় না?এখন আমার সংসার ভাঙতে আসিস?”

অট্ট হাসিতে ফেটে পড়ল বাকি সাংবাদিক।এই সাংবাদিক একটি ফ্যাক নিউজ করেছিলো রাজের সর্ম্পকে।যার প্রতিশোধ নিলো রাজ।এদের কাজ এমন ফ্যাক নিউজ বানানো।যার কারণে আজকাল কমেন্ট বক্স জুড়ে লোকজন দেয় গালাগালি।গলার মালাগুলো খুলে রাজ ওগুলো দিলো পিয়াশের হাতে।তারপর উঠে পড়ল স্টেজে।সবাই হাততালি দিয়ে দাড়িয়ে থাকে।কেউ কেউ তো চেয়ারের উপরে উঠে রাজকে দেখতে থাকে।রাজের সামনে সাংবাদিক।তাদেরকে যে যে কথার স্ক্রীপ্ট দেওয়া হয় তারা সেই বিষয়ে প্রশ্ন করবে এবার।একজন প্রশ্ন করে,”আপনাদের পরিবারের পুরোনো সদস্য মিসেস রোহিনী ও মিস্টার মিনার আমাদের দেশের উন্নয়নের জন্য একটি ব্যাবস্থা করে গেছে।এই ডিটেইলস সম্পর্কে একটু জানাবেন স্যার?”

মাইকে টোকা দিলো রাজ।হালকা শব্দ হলো।বোঝা গেলো মাইকে কথা বলা যাবে।মাইকের সামনে মুখ নিয়ে বলে,”আমার মা মিসের রোহিনী আর আমার আংকেল মিস্টার মিনার এনারা ছিলেন কৃষি বৈজ্ঞানিক।বাংলাদেশে প্রথম সফল বৈজ্ঞানিক ছিলেন আমার মা। আর আমার আংকেল দ্বিতীয়।তাদের ইচ্ছা ছিলো দেশের মানুষ যতটুকু শস্য উৎপাদন করবে তা যেনো অর্গানিক হয়।এই যেমন আজকাল বিভিন্ন খাদ্যে আমরা ভেজাল পাই। ভেজাল না থাকলে ব্যাবসা উন্নত হবে না।অতিরিক্ত শস্য উৎপাদন হবে না।

আমার মা আর আংকেল চেয়েছিলেন এই দেশের মানুষ খেয়ে পরে বাঁচুক।গরিবদের জন্য আমরা হাতে গোনা কিছু মানুষ এগিয়ে আসি।বাকিরা তো নিজেদের মত দিন কাটিয়ে দেই।খাদ্যের দাম তুলনায় আমরা অনেক পরিবার চাহিদা মেটাতে পারি না।এরপর যতটুকু খাদ্য গ্রহণ করে থাকি সবই অধিক মাত্রায় ফরমালিন।এই ফরমালিনের ব্যাবহার কমাতে একটি নতুন ফর্মুলা তৈরি করা হয়।যেটার মাধ্যমে খাদ্যের ভেজাল কমতে থাকবে।বেশি বেশি শস্য উৎপাদন হবে।দামের সাথে চাহিদার পূরণটাও সুন্দরভাবে হবে।”
সবাই করতালি দিলো।মাঠ জুড়ে আছে অহরহ গরীব লোকজন।সামনের দিকে আছে কৃষকরা।সরদার বাড়ির সবাইসহ বসে আছে রাজের পিছনে।সবার মুখে মুখে ফুটছে,”আমাদের নেতা করেছে জনগণের সেবা।আমাদের নেতা সেরার সেরা।”

সবার থেকে যেনো ভালোবাসা অর্জন করে নিলো রাজ।এর মধ্যেই একজন সাংবাদিক খোচা মেরে বলে মূলত ওটা তার স্ক্রিপ্টে থাকে তাই বলে,”শুনেছি আপনার মা মিসেস রোহিনী আর মিস্টার মিনার একজন আরেকজনের সাথে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন।যার ফসল মিস্টার মানিক।এই বিষয়ে আপনার মন্তব্য কি?”
চোখমুখ লাল হয়ে এসেছে রাজের।রাজ কোনো বাজে পদক্ষেপ নিতে যাবে তার আগে মাহমুদ সরদার এসে হাত ধরে রেখেছেন।রাজ অগ্নি দৃষ্টি দিয়ে তাকালো মাহমুদ সরদারের দিকে।কেনো রাগ করবে না রাজ।এই দুনিয়ার আলো দেখলো যে মায়ের মাধ্যমে।এত ভালো ভালো শিক্ষা পেলো যে মায়ের থেকে।দেশের উন্নতি করতে পারছে যে মায়ের জন্য।আজ সেই মাকে নিয়ে নোংরা কথা সন্তান হয়ে সহ্য করার ক্ষমতা নেই রাজের।রাজের এভাবে এগিয়ে আসা যে ভয়ানক এটা অনুমান করে নিয়েছে সাংবাদিক।হালকা কুকিয়ে গেছে তারা।মায়া তারেকের দিকে তাকালো।এমন কথা শুনলো কার কাছে এরা।মালিনী মাথা নত করে আছে।কারণ সবাই ভাবছে এই মালিনী আসলে রোহিনী।তারেক মাথা নাড়িয়ে বোঝালো সে কিছু জানে না।মায়া এবার সামনে জনগনদের দেখতে থাকে।কিছু জনগন দেখেই মায়ার চোখে আসে একটি মেয়ে।যাকে দেখে মায়া অবাক হয়ে যায়।তারেককে ইশারা করে ডাকে।তারেক আসতেই মায়া বলে,”এই রুবি এখানে কেনো?”

তারেক কিছুক্ষণ খুঁজলো।পেয়েও গেলো রুবিকে।নিজেও অবাক হয়ে বলে,”জানি না ম্যাম।তবে আমার মনে হয় মিহিরের মৃত্যুর জন্য ও আজ এমন করেছে হয়তো।দেখুন রুবির চোখে মুখে হাসি।”
“এই কাজটি ওই করেছে।নাহলে এমন কেউ নেই যে মিডিয়াকে এসব নোংরা কথা জানাবে।মিহিরের মৃত্যুর বদলা নিতে চায় ও।”
“তাহলে কি করবেন ম্যাম?”
“ওর ব্যাবস্থা পরে করছি।আগে এদিকটা সামলাতে হবে।”
বলেই মায়া উঠে দাড়ালো।রাজের পাশে এসে দাড়িয়ে মাইকটা নিজের দিকে ঘুড়িয়ে বলে,”আজ আপনাদের সকল সত্যি কথা জানানো হবে।”
রাজ ঘুরে তাকালো মায়ার দিকে।মায়া আশ্বস্ত চোখে তাকিয়ে বলে,”যত লুকিয়ে রাখবে তত লোকজন বাজে মন্তব্য রটাবে মন্ত্রী মশাই।গুজব বৃদ্ধি পাওয়ার থেকে ভালো সত্যিটা জানুক সবাই।এতেই সবার থেকে ভালোবাসা আর দোয়া বাড়বে।”

“মায়া মা ঠিক বলছে রাজ।মাথা গরম করতে নেই।এটা রোহিনী তোমাকে শিখিয়ে গেছে।তুমি তোমার মায়ের শিক্ষা ভুলে গেলে?”
চোখ বন্ধ করে রাজ কল্পনা করে।রোহিনী রাজকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো,”জীবনে এগিয়ে যাওয়ার আসল অস্ত্র নিজেকে শান্ত রাখা।লোকে আগে পিছে মন্দ বলে।কিন্তু তাতে কান না দিয়ে সৎ পথে চলতে পারলেই তুমি আসল জয় লাভ করবে।তোমার জীবনের সফলতা আসবে তখন,যখন তুমি নিজের মস্তিষ্ক ঠান্ডা রেখে সত্যের মুখোমুখি হবে।”

এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ খুললো রাজ।মায়া বলতে শুরু করে,”আমার শাশুড়ি মায়েরা ছিলেন তিন ভাইবোন।বড় ভাই বিভান খান যিনি এখন জেলে আছেন।আসল কুকর্ম তিনিই করেছিলেন। আর তার সহযোগিতা করেছিলো মিসেস সোনালী।যিনি এই সরদার পরিবারের ছোট বউ হিসেবে ছিলেন। আর আমার শ্বাশুড়ি মায়েরা মূলত জমজ বোন ছিলেন।আমার মন্ত্রী মশাইয়ের বায়োলজিকাল মা মিসেস রোহিনী খান তিনি মারা গেছেন।আর যাকে আপনারা দেখছেন তিনি মালিনী খান।যার সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে ছিলেন মিস্টার মিনার। বিভান খান আর সোনালীর চক্রান্তে মারা যায় রোহিনী খান আর মিস্টার মিনার।এরপর পারিবারিকভাবে আমার শ্বশুর মশাই আর বর্তমান শাশুড়ির বিয়ে হয়।”

সাংবাদিক সবাই একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করে।শুধু তারাই না পিছনে যত জনগণ আছে সবাই এমন করে।অবাক হয়ে আছে সবাই।রুবির মুখে রাগের আভাস।হেরে গেলো সে।মিহিরের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে পারছে না।হাত মুঠ করে দেখছে মায়াকে।মায়ার মুখে ভিলেনি হাসি।বোঝা যাচ্ছে এখান থেকে বেড় হবার পর ছার পাবে না রুবি।যার খায় তার বদনাম করার ফল এখন সেও পাবে।একেক করে মায়া সবকিছু খুলে বলল মিডিয়ার সামনে।রাজ মায়া ও আদ্র রুদ্রের অতীত শুনে অনেকেই কান্না করে দেন।দুর্দিন পেরিয়ে আজও তারা দেশের জনগণের সুদিনের চিন্তা করে চুপ ছিলো।সবকিছু একেবারে নিজেদের আয়ত্তে এনেই আজ সুখের মুখ দেখবে তারা।আশেপাশে থেকে সবাই বাহবা দিচ্ছে মায়ারাজ আদ্র রুদ্র জেসি ও মালিনীকে।ধিক্কার জানালো বীভান আর সোনালীর উপর।কিছুটা কষ্ট হলেও মিলি চুপ করে দেখছে সবার আনন্দ।কষ্ট ঠিক তখনই হচ্ছে যখন তারা তার মায়ের সম্পর্কে বলছে।কিন্তু সবার এমন ব্যবহারের কারণ মাথায় আসলে মিলি নিজেও আলাদা শান্তি পায়।মিলির জীবনটা এখন এভাবেই যাবে।মনের মধ্যে দোটানা কাজ করবে।কিছু করার নেই।বাবা মায়ের করা পাপ তাকে সহ্য করতে হবে।

আসল ফর্মুলা আর তার ডোকুমেন্ট জনসম্মুখে প্রমাণ স্বরুপ বৈজ্ঞানিকদের কাছে পৌঁছে দিলো রাজ।এবার এটা দেশের কাজে ব্যবহার করা হবে।যারা এটা নিয়েছে তারা সই করলো কাগজটিতে।সমস্ত কাগজে উল্লেখ আছে এটা বাংলাদেশের কৃষক ব্যাবহার করতে পারবে।বাইরের দেশে এই ফর্মুলার সাপ্লাই হবে না।সরকার পক্ষ থেকে এই ডিলে রাজি হয়েছে বৈজ্ঞানিক সহ কৃষকেরা।সবাই এখন নাচগান শুরু করে দিছে।বৃদ্ধ থেকে কৈশোরের সমস্ত জনগণ এখন নাচগান করতে তাহলে।লাইভে সকল কিছুই এতক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে।সবাই এখন মিষ্টি মুখ করতে ব্যাস্ত।রাজ তাকালো আকাশের দিকে।অনুভব করছে তার মা ওই আকাশ থেকে দেখছে।আদৌ সম্ভব কি না জানে না রাজ।তবে মায়ের ভালোবাসা যেকোনো ভাবেই অনুভব করা যায়।

যদি মা কাছে না থাকে।আকাশের দিকে তাকালে এমনিতেই চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে।রাজ সানগ্লাস খুলেই আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলো।তাই তার চোখ বেয়ে অটোমেটিক পানি পড়ছে।মাহমুদ সরদার এগিয়ে আসার আগেই আজ মালিনী এসে জড়িয়ে ধরলো রাজকে।আরেক হাত দিয়ে ইশারা করে ডাকলো মানিককে।মানিক এখন নিজস্ব ব্যাবসা করে।এছাড়া মিনারের যা কিছু গড়া ছিলো সবকিছুতে এখন মানিকের অধিকার।মানিক মিনারের একমাত্র সন্তান।তাই তার সমস্ত সম্পত্তি মানিক পাবে।লন্ডনের আশ্রমে থাকার কারণে পড়াশোনা করতে পেরেছে মানিক।তাই আজ তার গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট।সব মিলিয়ে মালিনীর কোনো চিন্তা নেই।দুই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে শান্তির নিঃশ্বাস নিচ্ছে মালিনী।মায়া তাকালো সিয়া আর হিয়ার দিকে।ইশারা করতেই ওরাও চলে আসে মায়ার কাছে।পিয়াশ এসে মৌয়ের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,”মিলির কাছে যাও।”

মায়াবতীর ইচ্ছা পর্ব ৬৩

মৌ গেলো মিলির কাছে।আপন বোনকে এতদিনে অনেক ভালোবেসে ফেলেছে মৌ।মিলি নিজেও মৌকে আপন বোনের মতো করে ভালোবাসে।দুই বোন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে।আদ্র আর রুদ্র পাশাপাশি দাড়িয়ে দেখছে।শাহানা পারভীন প্রলয়কে কোলে নিয়ে বসে আছেন।ছেলেটা ছোট ছোট হাত গালে দিয়ে চোখ মেলে দেখছে আর হাসছে।তারেকের দিকে মায়া তাকাতেই তারেক ইশারা করে বুঝিয়ে দিলো,”ডান।”
পুরো মাঠজুড়ে এখন রুবিকে দেখা যাচ্ছে না।মায়ার মুখে দেখা দিলো আবারও সেই ভয়ানক রক্তিম হাসি।

মায়াবতীর ইচ্ছা পর্ব ৬৫