মায়াবতীর ইচ্ছা সিজন ২ পর্ব ২২
ইশরাত জাহান
মায়া এসে মৌয়ের সামনে দাড়ালো।মৌকে জড়িয়ে ধরে বলে,”তুই ঢাকা আসলি কবে? আর বিয়ে করেছিস কেন তাও আবার আমাকে না জানিয়ে?ভাই জানে কি?”
মৌ মুখটা শুকনো করে বলে,”এক্সকিউজ মি,আপনি কে?”
মায়া অবাক হলো যেন।সাথে রাজ ভ্রু কুঁচকে তাকালো।মায়া অবাকের সাথে বলে,”আমি তোর বড় বোন।”
“আমার বড় বোন যে সে আমার খোজ খবর পয়েন্টে পয়েন্টে রাখে।আমার সাথে কথা বলার জন্য দিনে অন্তত এক ঘন্টা হলেও সময় রাখে।সেই বোনের হাবভাব আপনার মাঝে নেই।তাই আপনাকে বোন বলতে পারলাম না।”
“এটা কেমন ব্যাবহার?”
“যেমনটা আপনি করেছেন তেমন।”
“আমি কি করেছি তোর সাথে?”
“কি করেছো এটা জানোও না?”
একটু জোরেই বলে মৌ।মায়া মাথা নাড়ালো।মৌ কান্না কান্না মুখ করে বলে,”আমাকে না জানিয়ে বিয়ে করেছো তুমি।আমার সাথে একটাবার কথাও বলো নাই।এমনকি আমি কল দিলে রিসিভ করোনি।আমি যে আর্ট কম্পিটিশনে সুযোগ পেয়েছি এটাও জানো না তুমি।শুধু কি তুমি?ভাইয়াও তো হবু ভাবী নিয়ে ব্যস্ত থাকে।আমার খোঁজ কেউ নেয়না।আমি কেন সেধে সেধে খোঁজ দিবো বলো?”
মৌয়ের কথার মাঝে অভিমান স্পষ্ট।কান্নাও করে দিয়েছে বেচারি।মায়ার সহ্য হলো না এই কান্না।মৌকে জড়িয়ে ধরল।মৌ ছাড়াতে নিলে দেখলো মায়ার শরীর গরম হয়ে আছে।মৌ মায়ার কপালে হাত রেখে বলে,”তোমার তো জ্বর এসেছে আপু।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মায়া কিছু বলার আগে রাজ বলে,”কাল রাত থেকেই জ্বর তার।আর তুমি হয়তো আজকে অনেকবার কল দিয়েছিলে কিন্তু আমি তো ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখেছিলাম।তাই হয়তো কল আসলেও বুঝতে পারেনি।”
মৌ চোখ ছোট ছোট করে রাজের দিকে তাকিয়ে বলে,”আপনি আমার জিজু?”
রাজ মাথা উপর নিচ করে হ্যাঁ জানালো।মৌ কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে বলে,”সে যাই হোক।বিয়ে করেছিলেন আমাকে একবারও জানিয়েছিলেন আপনারা?”
“ওটা এক্সিডেন্ট বিয়ে ছিলো বোন।”
“মানে?আমি তো ভেবেছি তোমরা লাভ ম্যারেজ করেছো।”
রাজ বত্রিশ পাটি বের করে বলে,”যেই বিয়েতে বউ নিজ হাতে তার স্বামীকে ওপারে পাঠাতে চায় সেটা নাকি আবার লাভ ম্যারেজ!নাদান জীবন আমার।কেন বউ খুন করতে ব্যাস্ত এটাই জানি না।”
মৌ হা হয়ে গেলো।পিয়াশ বেচারা এদের নাটক দেখতে ব্যাস্ত।মায়া মৌকে নিয়ে ভিতরে ঢুকলো।পিছন পিছন আসতে নেয় পিয়াশ।রাজ তার পথ আটকে বলে,”তুমি কোথায় যাচ্ছো পিয়ু বেবী?”
“কেন আমার বউ যেখানে যাচ্ছে সেখানেই যাচ্ছি আমি।”
রুদ্র বলে ওঠে,”বাব্বাহ!বিয়ে হলোনা কয়েক ঘণ্টা এর মধ্যেই বউয়ের পিছন নিতে শুরু করেছো?”
“আব্বে ব্যাটা রুদ্র।এটাই তো বউয়ের জাদু।কবুল বলার পর স্বামীদের কিভাবে যেন বস করে নেয়।নাহলে স্বামীরা বউদের জন্য এতটা ব্যাকুল হয় নাকি?”
“আমার ওই হিটলার ভাইটা না থাকলে আমার বাবাও আজ বউয়ের স্বাদ পাওয়ার সুযোগ করে দিতো।আফসোস যার বিয়ের কোনো তাড়া নেই তার পয়দা আমার আগেই হয়েছে।”
হিয়া পাশ থেকে বলে,”বেশরম নষ্ট পুরুষ।”
রুদ্র হিয়ার পাশেই ছিল।দুষ্টু হেসে বলে,”পুরুষদের বেশরমেই মানায়।নাহলে ভালোবাসা আদায় করতে পারবে না।”
বলেই রুদ্র ভিতরে চলে যায় শীষ বাজাতে বাজাতে।রাজ পিয়াশের দিকে ফিরে বলে,”আমার সাথে ওদিকে চলো।”
বলেই সুইমিং পুলের দিকে চলে যায় রাজ। পিয়াশ পিছু নিলো।
সিয়া মন খারাপ করে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে।দরজাটা খোলাই আছে।আদ্র ঢুকলো ঘরে।সিয়ার কাছে না গিয়ে দরজার পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে দেখছে সিয়াকে।সিয়া পায়ের শব্দে বুঝতে পেরেছে আদ্র এসেছে তার ঘরে।তবুও পিছনে ফিরল না।এই কয়েকদিন ধরে কোনো কথা বলেনি তারা।আদ্রকে এতবার কল করেছে তাও তার কোনো উত্তর পাওয়া যায়না।অভিমান তো হবেই।আজকে সবার সামনে কথা না বলুক অন্তত তার দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি দিতো।ওখানে দাঁড়িয়ে সবার সাথে কত কথা বলল।আবার সিয়া তো ছিলো সবার সামনেই।তখন অন্তত তার দিকে হালকা হলেও তাকানো যেতো।সিয়ার এসব ছোট ছোট চাওয়া সম্পর্কে অবগত আদ্র।তবুও কেন যেন সে পূরণ করেনা।এই জন্য প্রায়ই সিয়া মন খারাপ করে।আদ্র রাগ ভাঙিয়ে দেয় না।সিয়াকেই নিজে গিয়ে ওর সাথে কথা বলতে হয়।আজকে আদ্র এসেছে তার কাছে।আদ্র পিছন থেকে দেখেই যাচ্ছে সিয়ার চুলগুলো।আর মুখের এক কোণা।সিয়ার কোনো নরনচরণ দেখতে না পেয়ে আদ্র বলে ওঠে,”প্রেয়সী?”
সিয়া তবুও কিছু বলল না।পিছনেও ঘুরল না।তর্জনী আঙুল দিয়ে জানালার গ্রিলে নাড়াচাড়া করছে।আদ্র ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে এগিয়ে গেলো সিয়ার দিকে।সিয়ার পিছনে এসে জানালার গ্রিলে হাত রাখলো।সিয়াকে নিজের মাধ্যমে ঘেরাও করে ধরলো আদ্র।সিয়া এবার পিছনে ফিরল।দেখতে পেলো নিজেকে আদ্রর অতি নিকটে।এই শান্ত লোকটার সাথে কখনোই অস্টেপৃষ্ঠে থাকেনি।ওই তো একবার গোলাপ দিয়ে প্রোপোজ করেছিলো।ওখানে গোলাপটা ছুঁতে গিয়ে আঙুলের ছোঁয়া লেগেছিল।তখনই সিয়ার মাঝে শিহরণ জাগে।আর আজকে এতটা কাছে।সিয়া অভিমানটাকে ভুলে গিয়ে লজ্জায় মাথা নিচু করে বলে,”এতটা কাছে আসা ঠিক নয়।”
“দূরে যাওয়ার কারণে অভিমান করেছো।এখন কাছে এসে অভিমান ভাঙতে চাই।সুযোগ দিবেনা আমায়?”
আদ্রর কথার সাথে সাথে গরম নিশ্বাস এসে সিয়ার কপালে ছুঁয়ে দিচ্ছে।সিয়া কেমন যেনো উতলা হয়ে উঠল।সিয়া পায়ের আঙুল ফ্লোরে ডলাডলি করে বলে,”এভাবে কাছে আসলে তো আমার…”
বলতে চেয়েও বলল না সিয়া।আদ্র তাকিয়ে আছে ওর মুখের দিকে।সিয়া চুপ হয়ে গেলো।আদ্র প্রশ্ন ছুড়লো,”কি হয় তোমার?”
“কিছু না।”
“অভিমান করো কেন?”
“একটু ভালোবাসেন না কেন?”
“ভালো তো বাসি।”
“কোথায়?”
“দেখিয়ে দিব?”
“কিভাবে?”
“ভালোবাসা আপাতত দেখানোর একটাই অপশন।”
“কি সেটা?”
“ফিল করা।”
“মানে?”
“আমার হার্টবিট ফিল করো প্রেয়সী।সবকিছু বুঝে যাবে।তোমার কাছে আসাতে যেমন তুমি লজ্জায় মুখ লুকাতে ব্যাস্ত ঠিক তেমনই আমার হৃদপিণ্ড দ্রুত গতিতে চলাচল করতে ব্যাস্ত।”
সিয়ার হাতটা ধরে আদ্র তার নিজের বুকে রাখলো।সিয়া ঠোঁট কামড়ে সেই হাতের দিকে চোখ রাখলো।আদ্র বলে,”অনুভূতিগুলোর উত্তর মিলছে কি?”
সিয়া কোনো উত্তর দিলো না।আদ্র আবারও বলে,”যদি অনুভূতির উত্তর না মিলে তাহলে আরো একটি উপায় বলে দিচ্ছি।”
“কি?”
“কান পেতে আমার হৃদপিণ্ডের কম্পনের গতিটা শুনে নেও।বুঝতে পারবে তোমার জন্য আমার অনুভূতি কতটা গভীর।ঠিক যেমন তোমার মধ্যে হচ্ছে ওই একই কম্পন।”
সিয়া আদ্রের চোখের দিকে তাকালো।ঠোঁট প্রসারিত করে বলে,”এতটা কাছে এসে লজ্জা দিচ্ছেন কেন?”
“একটু দূরে ছিলাম বলে তাড়িয়ে দিতে চাইছো তাই।”
“আপনি না খুব বাজে।হয় আমার সাথে কথা বলেনই না নাহয় একেবারে কাছে আসেন।”
“এই যে দূরে দূরে থাকি তখন অপেক্ষা করো তুমি।আর যখন তোমার কাছে আসি তখন নেতিয়ে পড়।তোমার এই অনুভূতিগুলো আমার মাঝে তোমার প্রতি কেমন অনুভূতির সৃষ্টি হয় জানো?”
সিয়া প্রশ্নবিত্ত নয়নে চেয়ে আছে।আদ্র ওর ঠোঁটটা সিয়ার কপালে ছুঁয়ে বলে,”তোমাকে কাছে পাওয়ার অনুভূতি।তবে সেটা অতি দ্রুতই হবে।”
বলেই আদ্র তাকালো সিয়ার দিকে।সিয়া চোখ বন্ধ করে আছে।এমনি এমনি বললে কথাগুলোর তেমন একটা অনুভব হতো না।আদ্র যে তার কাছে এসে নেশাল কণ্ঠে বলছে।তারউপর আজকে এই প্রথম আদ্রর ওষ্ঠের ছোঁয়া পেলো।না পেরেই চোখটা বন্ধ করে নিলো সিয়া।আদ্র ঠোঁট চওড়া করে কিছুটা দূরে সরে গেলো।চলে গেলো ঘর থেকে।সিয়া চোখটা খুলে আদ্রকে দেখতে পেলো না।এর জন্য অবশ্য তারই ভালো হয়েছে।থাকলে হয়তো আজকে এখানেই লজ্জায় শেষ হয়ে যেত।
জারা যখন দেখলো তার লোক আর বীরের লোক কেউই মৌয়ের খোঁজ পায়নি তখন জারা না পেরে বাইরে নামলো।নিজে ড্রাইভ করে এদিক ওদিক খুঁজতে থাকে মৌকে।এয়ারপোর্টে এসে মুখ ঢেকে মৌয়ের ব্যাপারে খোঁজ নেই।এরপর চলে গেলো স্টেশনে। কোথাও পেলো না মৌয়ের খোঁজ।বাস স্ট্যান্ডের কাছে এসে খোঁজ নিলে সেখানেও পেলো না।অবশেষে জারার কাছে একটি কল আসে।কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলে,”ম্যাম মিসেস সোনালী আজ তার লোকেদের দিয়ে কয়েকজন নারীকে নিয়ে আবাসিক হোটেলে পাঠিয়েছিল।আপনার কথা অনুসারে আমরা ওখানে পুলিশও পাঠিয়েছি।কিন্তু একটা সমস্যা হয়ে গেছে।”
“কি সমস্যা?”
“ওখানে থাকা এক যুবতী যে নির্দোষ তাকে ধরে নিতে চেয়েছিল পুলিশ।”
“তোমরা আটকাও তাদেরকে।যে করে হোক।”
“পারিনি ম্যাম।তার আগে ওই যুবতীর আরেকজনের সাথে বিয়ে হয়।আর বিয়ের পর তাদেরকে কাজী অফিসের সামনে থেকে কেউ নিয়ে চলে যায়।”
“কারা তারা?”
“মন্ত্রী শাহমীর রাজের লোক ওরা।”
জারা কিছু একটা ভেবে বলে,”বিয়েটা যাদের হয়েছে ওদের ছবি তুলতে পেরেছো কি?”
“জী ম্যাম দূর থেকে তুলেছি।আপনাকে দিচ্ছি ছবি।”
জারা কল কাটলে ওর কাছে ছবি আসে।ছবিগুলো জুম করে কয়েকবার দেখে জারা বলে,”মৌ আর পিয়াশ।বিয়ে করেছে ওরা।এটা কিভাবে সম্ভব?বীরের অবস্থা কি হবে ওর বোনের এই বিয়ের খবর পেলে?”
ভেবেই জারা গাড়িতে উঠে বীরের বাড়িতে এসেছে।এসে হলরুমে পা রাখতেই দেখতে পেলো বীর সোফায় বসে আছে।বীরের চোখ লাল।জারার দিকে তাকিয়ে বীর রাগী দৃষ্টি দিয়ে ওর টাইটা ঢিলা করে নিলো।জারা বীরের দিকে এগিয়ে আসলো।বীর ওর দিকে তাকিয়ে বলে,”কোথায় ছিলে তুমি?”
জারা চুপ করে আছে।কোনো উত্তর দিলো না।বীর এবার জারার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে নিজের কোলে বসিয়ে কন্ঠ মোটা করে রাগের সাথে বলে,”আমার কথার উত্তর দিচ্ছিস না কেন তুই?”
জারা বীরের চোখের দিকে চেয়ে বলে,”বাইরেই ছিলাম।”
“আমাকে না বলে আমার ত্রিসীমানা থেকে পালানোর চেষ্টা করবি না একদম।”
জারা কথা পাল্টে বলে,”মৌয়ের খোঁজ পেয়েছো?”
“হুম।বোন ফোন করেছিল।দুজনে এক স্থানেই আছে।খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম আজ ওকে নিয়ে।যখনই স্বস্তির নিশ্বাস নিয়েছিলাম ঠিক তখনই আবারও নিঃশ্বাসটা নিতে কষ্ট হয়ে উঠলো।”
“কেন?”
“কারণ আমি বাড়িতে এসে তোমাকে পাইনি তাই।জানো কত জায়গায় খুঁজতে গেছিলাম?”
“কেন খোঁজ করো আমার?”
“বারবার পালাতে চাও তাই।”
“এক সময় এমনও আসবে যখন তুমি নিজেই আমাকে ছেড়ে দিবে।”
“সে সময়টায় হয়তো আমাকে খাটিয়ায় করে মসজিদে নিয়ে যাওয়া হবে।”
“বীর!”
জোরে চিৎকার করে বলে জারা।যেটা শুনে বীর আলতো হাসে।জারা বীরের মুখের দুপাশে হাত রেখে বীরকে দেখতে থাকে।বীর নিজেও চুপ করে দেখেছে জারাকে।জারা ভেজা চোখে বীরকে দেখতে দেখতে বলে,”আমি তোমার থেকে মুক্তি চাই বলে এই না যে তোমার মৃত্যু কামনা করি।”
মায়াবতীর ইচ্ছা সিজন ২ পর্ব ২১
“আমার মৃত্যু তো তোমাকে না পাওয়ার সময় অনুভব করি।মনে হয় দমটা বন্ধ হয়ে আসছে।”
জারা উঠে দাড়ালো।বীর চুপ করে সোফায় বসেই আছে।জারা কোনো কথা না বলে উপরে চলে যায়।বীর সেদিকে রক্তিম ও ভেজা চোখে চেয়ে আছে।
