মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ১৪
মির্জা সূচনা
সোনালি সূর্যটা ধীরে ধীরে পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ছে, ঠিক যেমন করে একটা নতুন জীবনের সূচনা হয় পুরনো দিনের রক্তিম ছায়ায়। রাজপ্রাসাদ জুড়ে আজ যেন এক অপূর্ব মোহময়তা। প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি স্তম্ভ, এমনকি বাতাসও আজ যেন বিয়ের সুরে বাঁধা। হাজার হাজার রঙিন আলোয় সাজানো প্রাসাদের প্রতিটি কোণা জ্বলজ্বল করছে সোনালী জ্যোৎস্নার মতো।
প্রাসাদের দক্ষিণ চত্বরে বিশাল একটি মণ্ডপ বানানো হয়েছে। মাথার উপর রুপালি রেশমের ছাউনি, নিচে লাল-সোনালি কার্পেট, আর মাঝখানে গোলাপি ও সাদা ফুলে মোড়ানো মঞ্চ—সেইখানেই বসবেন আজ রাজকন্যা, অর্ককন্যা মেহরিন।
মেহরিন—যার নামেই শুরু হয় কবিতা, যার হাসিতে গলে যায় বরফ, আর যার চোখে লুকিয়ে থাকে হাজার বছর পুরোনো কোনো প্রেমগাঁথা। আজ সে বসবে সবার সামনে, কনের সাজে—সোনার জরির কাজ করা মেহগনি লেহেঙ্গা, মাথায় টুকটুকে লাল ঘোমটা, গলায় রুবির হার, হাতে কাঁচের চুড়ি আর অলতা-পরা পায়ে রূপালি নূপুর। চুলে চন্দ্রমল্লিকা আর হাসিতে এক অদ্ভুত সংকোচ।
তার চারপাশে রমণীরা মেহবুবা ও চুমকি-মাথায় ওড়না টেনে দিলো অন্য রমণীরা নাচছে, চারপাশে ঢাক বাজছে, শঙ্খধ্বনি উঠেছে।
আর ঠিক তখনই দূর থেকে শোনা গেল ঘোড়ার টগবগ শব্দ।
সোনালি রথে চড়ে আসছেন রাজপুত্র—রিদ।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সাদা পোশাক, কোমরে তরবারি, মাথায় পাগড়ি—তার চোখে দৃষ্টি সোজা মেহরিনের দিকে। সে জানে, এই রাজ্য, এই সভা, এই আয়োজনের মাঝেও রাজকন্যা ছাড়া আর কিছু তার চোখে পড়ছে না।
প্রাসাদের মূল দরজায় দাঁড়ানো রিদ এক ঝলক তাকালো মেহরিনের দিকে।
তাকানোটা এমন ছিল যেন, সমস্ত পৃথিবী থেমে গেছে ওই দু’জনের চোখাচোখির মুহূর্তে।
সবার মাঝে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল রিদ।
রাজা ফিরোজ আর রাণী মালিহা হাসিমুখে আশীর্বাদ করলেন।
রিদ হাত বাড়িয়ে বলল,
চলো, আমার রাজকন্যা।
মেহরিন লাজুক হাসিতে মাথা নিচু করে রাখলো, কিন্তু চোখে ছিল এক অদ্ভুত সাহস।
সে জানে—এই হাতটা ধরে রাখবে সারাজীবন।
আকাশের তারা গুনছে, চাঁদ যেন আজ একটু বেশি উজ্জ্বল।
কারণ আজ রাজ্যের রাজকন্যা মেহরিন আর রাজপুত্র রিদের শুভ বিবাহ।
প্রাসাদের ভেতরে আজ যেন রূপকথার রাজ্য নেমে এসেছে।
মেহরিন আর রিদ—আজ তাদের শুভ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার দিন। দরবার হলে বসেছে রাজসভার মতো এক আসর।
আলো-আঁধারিতে দুলছে প্রদীপ, বাতাসে গোলাপ আর চন্দনের গন্ধ। রুপালি পর্দা সরিয়ে ঢুকছে অতিথিরা—সবাই রাজা-রাণীদের মতো পোশাকে।
আসরের মঞ্চে এখন রাজকন্যা মেহরিন ও রাজপুত্র রিদ পাশাপাশি বসে। মাঝে মাঝে চোখাচোখি হয়, কিন্তু সেই চাহনিতে এক লাজুক, গভীর, আর জাদুকরী টান।
সবার সামনে হঠাৎ বাজে শঙ্খ, শুরু হয় রাজপরিবারের বিশেষ ‘নৃত্য-উৎসব’।
শুরুতে আসে রাহি ও মেহবুবা—রঙ্গিলা ঘাঘরায়, রূপালি চুড়িতে।
তার নাচে ছিল প্রাণ, হাসিতে ছিল সুর।
তারপর আসে চুমকি ও শান্ত—একসাথে গানে গানে জানায় রাজকন্যার সৌন্দর্য আর রাজপুত্রের বীরত্বের কথা।
রাকিব ও মাহির দাঁড়িয়ে গায় এক ঐতিহাসিক গাঁথা—যেখানে প্রেম জয় করে যুদ্ধ, যেখানে চোখ বলে দেয় সেই কথা, যেটা মুখ বলে না।
আর ঠিক তখনই শুরু হয় সেই মুহূর্ত— রাজকন্যা মেহরিন আর রাজপুত্র রিদ উঠলেন মঞ্চে।
গানের সুর ধীরে ধীরে বাড়ে। রিদ এগিয়ে আসে, হাত বাড়ায়।
মেহরিন একটু হকচকিয়ে, একটু লাজুক হেসে হাত রাখে ওর হাতে।
নরম গানের সুরে শুরু হয় তাদের প্রথম রাজনৃত্য—
না, সেখানে জাঁকজমক নয়, বরং ছিল এক নিঃশব্দ স্বীকারোক্তি।
রিদ মাঝে মাঝে মেহরিনের চোখে চোখ রাখে, যেন বলতে চায়—”তোমাকে চেয়েছি, পেয়েছি, আর এখন সব কিছুর চেয়ে বেশি ভালোবাসি।”
চারপাশে কেউ কেউ চোখে জল ফেলেছে, কেউ থমকে দাঁড়িয়েছে।
এটা যেন শুধু এক নাচ না, এটা ছিল প্রেমের প্রতিজ্ঞা।
আর দূরে দাঁড়িয়ে রাহি মেহবুবা ও চুমকি—হাততালি দিয়ে হাসছে।
চোখে আনন্দ, ঠোঁটে প্রশংসা।
আর এই ভাবেই এক রাজপ্রাসাদে, রূপকথার মতো রাতের মাঝে,
মিলেছে দুটি হৃদয়, যাদের ছায়া গায়ে আজও জ্যোৎস্না পড়ে।
রাজনৃত্যের মাঝখানে, যখন চারপাশ নীরব আর জ্যোৎস্নার মতো আলো ঝরে পড়ছে মঞ্চে,
রিদ হঠাৎ মেহরিনের কানে নিচু হয়ে এক নিঃশব্দে বলল—
“আজ থেকে তুমি শুধু আমার… কেউ কিছু বলুক না বলুক, আমি তোমাকে পৃথিবীর সব কিছুর চেয়ে বেশি ভালোবাসি।”
মেহরিন কেঁপে উঠল, বুকের ভেতর কেমন যেন হালকা ঝড় উঠল।
তবে সে কিছু বলল না—শুধু চোখ তুলে রিদকে দেখল, আর সেই চোখে ছিল অসম্পূর্ণ হাজারটা কবিতা।
ঠিক তখনই দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক মেয়ে, নাম অদৃজা, যার চোখে ছিল অভিমানের ঝিলিক।
সে রিদকে পছন্দ করত বহুদিন, কিন্তু কখনো বলতে পারেনি।
আজকের এই দৃশ্য তার ভেতরকার কষ্টটাকে বিষ বানিয়ে তুলল।
সে সোজা গেল রাহির কাছে, মুখে হাসি রেখে বলল,
“তোর ভাবি মেহরিন তো অনেক ভাগ্যবতী, রিদের মতো মানুষ ওকে পেয়ে গেল… আর কেউ হয়তো চেয়ে চেয়ে দেখবে।”
রাহি সব বোঝে, সে হেসে বলল,
“ভাগ্যও সাহসীদের হয়। আর ভালোবাসা চাওয়ার না, দেওয়ার বিষয়।”
চুমকি তখন পাশে এসে ফিসফিস করে বলল,
“আমাদের মেহু তো এমনই, সে ভালোবাসা পায়, কারণ সে মন দিয়ে ভালোবাসে।”
আসরের মাঝে আবার গান শুরু হয়।
রিদ আর মেহরিন হাত ধরে মঞ্চ ছেড়ে নামছে—
সবার সামনে ওরা এখন শুধু রাজকন্যা-রাজপুত্র নয়,
ওরা হয়ে উঠেছে সেই জোড়া তারা, যারা একে অপরকে ছাড়া অপূর্ণ।
আর অদূরে দাঁড়িয়ে অদৃজার চোখে জল চিকচিক করে উঠল—
কিন্তু কারো চোখে সেটা পড়ল না, কারণ সেই মুহূর্তে
ভালোবাসা জয়ী হল সবকিছুর উপর।
আলো ঝলমলে রাজপ্রাসাদ। সোনা-রুপোর অলংকারে মোড়া দরবার হলের মাঝখানে সজ্জিত বিয়ের মঞ্চ। মেহরিনের গায়ে রক্তলাল বেনারসী, কপালে টিকলি, চোখে আবেশ। পাশেই দাঁড়িয়ে রিদ—সাদা শেরওয়ানি আর চোখে তীব্র এক সিদ্ধান্তের দীপ্তি।
সবার সামনে এসে মেহরিনের বাবা আদর আর গর্বে পরিপূর্ণ কণ্ঠে বললেন,
আজ আমার মেয়েকে তুলে দিচ্ছি এমন এক যুবকের হাতে, যে শুধু যোগ্য নয়, আমার মেয়ের ভালোবাসার আসল দাবিদার। রিদ, আমার মেহরিন এখন তোমার।
মেহরিনের হাতটা যখন রিদের হাতে তুলে দেওয়া জন্য বাড়ালো রাজ, রাজপ্রাসাদজুড়ে নিস্তব্ধ এক আবেগ। ঠিক তখনই…
ঘন ধোঁয়ার কুন্ডলী আর কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা একদল আগন্তুক চারপাশ ঘিরে ফেলে।
রাজপ্রাসাদের সমস্ত রক্ষী মুহূর্তেই সতর্ক, আতঙ্কের ছায়া নেমে আসে মঞ্চে।
এর মাঝেই এক গম্ভীর কণ্ঠ গর্জে ওঠে,
“রাজকন্যা মেহরিন আমার। আমি ছাড়া আর কেউ ওকে স্পর্শ করতে পারবে না। ভালোবাসা নয়, অধিকার আমার।”
সবার চোখে বিস্ময়। কেউ চিনতে পারছে না মুখ ঢাকা সেই লোকটিকে।
মেহরিন রিদের হাত চেপে ধরে, রিদ ঠান্ডা গলায় বলে,
“ভালোবাসা কেড়ে নেওয়া যায় না। আর যাকে ভালোবাসা যায়, তার উপর অধিকার দাবি করে না কেউ।”
চোখে চোখ রিদ আর মেহরিনের—দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে এখন বিশাল এক পরিণতির অপেক্ষা।
তখনই ব্যাকগ্রাউন্ডে ঢোলের শব্দ।
একদল রাজপ্রাসাদের যোদ্ধা ছুটে আসে।
চুমকি আর রাহি দূর থেকে চিৎকার করে,
“ওই লোকটা কে? ও মেহু আর রিদকে আলাদা করতে পারবে না!”
রাজপ্রাসাদজুড়ে উৎসবের আবহ মুহূর্তেই ভয় আর আতঙ্কে রূপ নেয়।
মুখোশধারী লোকটির চোখে হিংস্র জ্বলজ্বল আলো।
সে দৃষ্টি সোজা রিদের চোখে—কঠিন, হুমকিময়।
তার হাতে ধারালো একটি তরবারি।
হঠাৎ সে ঝাঁপিয়ে পড়ে রিদের দিকে।
রিদ সামলে উঠার আগেই এক প্রচণ্ড আঘাতে মাটিতে পড়ে যায়।
চারপাশ থেকে মুখোশধারীরা এগিয়ে আসে—সবাইকে অস্ত্রের মুখে দাঁড় করায়।
রাজসৈন্য, অতিথি, এমনকি চুমকি-রাহি মাহির রাজা-রানি বা শান্ত রাকিব পর্যন্ত কিছুই করতে পারে না।
মুখোশধারী সেই লোকটি মেহরিনের হাত ধরে টেনে তোলে।
“আমার রাজকন্যা,” সে নিচু গলায় বলে, “তোমাকে কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না।”
মেহরিন কাঁপতে কাঁপতে বলে, “কে আপনি? আমাকে ছেড়ে দিন!
কিন্তু তার কণ্ঠস্বর হারিয়ে যায় কোলাহলে।
একটা শিস দেয় লোকটা।
আর সঙ্গে সঙ্গেই রাজমঞ্চের সামনে এসে দাঁড়ায় এক কালো ঘোড়া।
সে জোর করে মেহরিনকে উঠিয়ে নেয় সেই ঘোড়ায়।
চারপাশে কেউ কিছু করতে পারে না—সবাই অস্ত্রের মুখে বন্দি।
রক্তাক্ত অবস্থায় রিদ উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে।
মেহরিনের দিকে হাত বাড়ায়, চোখে অসহায়তা।
মুখোশধারী লোকটা তাকিয়ে বলে ওঠে,
“তাকে ভালোবেসেছো? দেরি হয়ে গেছে রাজপুত্র।
সে এখন আমার।
তারপর ধুলোর ঝড় তুলে, মেহরিনকে নিয়ে
মুখোশধারীরা প্রাসাদ ছাড়ে যাচ্ছে।
রিদের ঠোঁটে তখন কেবল একটাই শব্দ—
মেহু!
মেহরিন চিৎকার করে ওঠে,
রিদ! রিদ! আমাকে বাঁচাও!
কিন্তু চারপাশ তখন ছুরি, তরবারি, বিষাক্ত নীরবতায় পরিপূর্ণ।
তারা অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।
ঘরটা নিস্তব্ধ। জানালার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে বিছানায়। নিঃশব্দ রাতে হঠাৎ—
“না-আ!”
একটা তীব্র চিৎকারে কেঁপে উঠল ঘর।
মেহরিন ঘেমে-নেয়ে উঠে বসে পড়ল। নিঃশ্বাস ফেলে, চোখ দুটো বিস্ফারিত। বুকের ভিতর ঢিপঢিপ শব্দ।
চুমকি ও রাহি চমকে উঠে ঘুম থেকে জেগে যায়। সাথী ও মৌ ও জেগে যায়।
রাহি প্রথমেই ছুটে আসে, মেহু আপু! কি হয়েছে তোর?
চুমকি পাশে এসে ধরে, এমন করে চিৎকার করলি কেন?
সাথী আর মৌ বলছে ভয় পেয়েছে মনে হয়।
মেহরিন কিছু বলতে পারছিল না। গলা শুকিয়ে গেছে। চোখের কোণে অশ্রু চিকচিক করছে।
রাহি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, স্বপ্ন দেখেছিস মেহু আপু ?
মেহরিন আস্তে মাথা নাড়ে। গলার স্বর কম্পিত, “ভয়ঙ্কর… কেউ আমাকে নিয়ে যাচ্ছিল… সবাই চুপ… কেউ কিছু করতে পারছিল না…
চুমকি এক গ্লাস পানি এগিয়ে দেয়, পানি খা, আর ভয় পাস না। আমরা তো আছি তোকে ঘিরে।
রাহি একটু হেসে বলে, চিন্তা করিস না আমার রাজকন্যা, এমন কেউ আসলে ওকে আমিই এক লাথি মেরে সরিয়ে দিতাম! অজানা অস্থিরতা এনে দিয়ে গেল তার মনে।
সাথী মৌ ব্যাপারটা বুঝে ওরা নিজেদের জায়গায় চলে যায় ওদের তিনজনকে একা ছেড়ে দেয় ।
মেহরিনের চিৎকার রাতের নিস্তব্ধতা ছিঁড়ে যেন এক অজানা ঝড়ের ঘূর্ণি তৈরি করল। পাশের রুমেই ছিল রিদ, শান্তু আর রাকিব। চিৎকার শোনার সাথে সাথেই রিদ যেনো এক প্রকার দৌড়ে এল দরজার সামনে।
মেহরিন! দরজা খোলো! কী হয়েছে? মেহরিন! রিদ কাঁপা কণ্ঠে ধাক্কা দিল দরজায়।
শান্তু ও রাকিবও ছুটে এল, ভাই, কী হইছে?
রিদ বলল, মেহরিন চিৎকার করলো! কিছু একটা ঘটেছে।
দরজা ভিতর থেকে বন্ধ।
চুমকি আর রাহি দু’জনে থমকে গেছে। মেহরিন চোখে জল, বিছানার চাদরটা মুঠো করে ধরে আছে।
রাহি হঠাৎ সামলে উঠে গিয়ে দরজার ছিটকিনি খুলে দেয়।
দরজা খোলার সাথে সাথেই রিদ এক পা ভিতরে—চোখ খুঁজে বেড়ায় মেহরিনকে।
চোখ আটকে যায় বিছানার কোণে সঙ্কুচিত হয়ে বসে থাকা মেয়েটার উপর।
“মেহরিন…”
তার গলা একটু নরম হয়ে আসে।
তুমি… ঠিক আছো?
মেহরিন মাথা নাড়ে। কিন্তু চোখে জল, কণ্ঠস্বর কাঁপা, স্বপ্ন… ভয়ঙ্কর একটা স্বপ্ন দেখলাম…তাই আমি আমি আর বলতে পারে না মেহরিন..
রাকিব তখন ঘরের ভেতরে ঢুকে দাঁড়ায়, চুমকি আর রাহির দিকে তাকায়—আমরা কি ডাক্তার আনাবো?
রাহি বলল, না ভাইয়া, ভয় পেয়েছে ও আর কোন সমস্যা নেই। একটু পানি খাওয়ালাম, এখন ভালো লাগবে।আপনারা বেশি চিন্তা করবেন না।
শান্তু তখন জানালার পর্দা একটু সরিয়ে বলে, রাতে এমন চিৎকার শুনলে কে না ভয় পাবে! আমি তো ভাবলাম কেউ কিছু করে ফেলল!
রিদ তখন ধীরে ধীরে মেহরিনের পাশে এসে বসে। তুমি একা না। আমরা আছি—তোমার পাশে। ভয় পেয়ো না ।
মেহরিন তাকায় রিদের চোখে। সেই চোখে ছিল আশ্বাস, আর একটা চাপা ভয়—যেন এই মূহূর্তে যদি কেউ কিছু না করে, মেহরিন সত্যিই আবার হারিয়ে যাবে।
রাহি আস্তে আস্তে বলে, চলো, এখন আমরা একটু সবাই চুপচাপ বসে থাকি। ওর পাশে থাকলেই ও শান্ত হবে।
রাত নেমে এল আরও গভীরে।
কিন্তু সেই ঘরের ভিতর এক অদ্ভুত অনুভূতি—ভয়, আশ্বাস, আর অজানা এক টানাপোড়েনের গল্প বুনে চলেছে নিঃশব্দে…
ঘর জুড়ে এক নিস্তব্ধতা।
সবে কিছুটা স্থির হয়েছে মেহরিন। চোখে এখনও ভয়ের ছায়া, গালে শুকিয়ে আছে এখনও চোখে অশ্রুবিন্দু। পাশে বসে থাকা রিদ তার দিকে তাকিয়ে আছে গভীর মনোযোগে। চুমকি, রাহি, সাগথী,মৌ রাকিব আর শান্তু চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে, কারোর মুখেই কোনো কথা নেই। যেন প্রত্যেকেই অপেক্ষা করছে—মেহরিনের শান্ত কণ্ঠের।
একটু চুপ থেকে, মেহরিন আস্তে বলে উঠল,
আমি ঠিক আছি। ভয় পেয়েছিলাম, কিন্তু এখন ভালো লাগছে।
তারপর চারপাশের দিকে তাকিয়ে, সবার চিন্তিত মুখ দেখে একটু হেসে বলল,
আমি দুঃখিত আপনারা সবাই জেগে গেছেন… আমার জন্য আসলে সপ্নটা… অনেক ভয়ানক ছিল… মনে হচ্ছিল আমি কোথাও হারিয়ে যাচ্ছি। একটা অদ্ভুত অন্ধকার আমাকে টেনে নিচ্ছিল… আমি—
ওর কণ্ঠ থেমে যায়।
চুমকি তখন এসে ওর পাশে বসল।
তুই একা না, মেহু। আমরা তো আছিই!
রাহি ওর মাথায় হাত রেখে হালকা গলায় বলে, মেহু আপু তোর আবার ভয় লাগলে ডাকবি, ঠিক আছে?
মেহরিন মাথা নাড়ল।
তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বলল,
আপনারা সবাই এবার ঘুমিয়ে যান। আমি ঠিক আছি এখন। আসলে সপ্নটার জন্যই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি ঠিক সামলে নেব নিজেকে।
রিদ চুপচাপ একবার তাকাল ওর মুখের দিকে। যেনো কিছু বলতে চায়, কিন্তু বলে না। শুধু মাথা ঝাঁকায়। রিদের খুব বলতে ইচ্ছা করছে চিন্তা করো না মেহেরিন পাখি আমি আছি তো, তোমার পাশে সারা জীবন থাকবো ।
রিদ, রাকিব আর শান্তু ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
দরজা বন্ধ হয় আস্তে।
মেহরিন তখন শুয়ে পরে তার দু’পাশে শুয়েছে চুমকি আর রাহি—কিন্তু তাও মেহরিনের ভেতরে ভেতরে একটু হালকা অনুভব করে।
বাহিরে রাত আরও গাঢ়, কিন্তু হৃদয়ের গোপন কোণে আলো এক বিন্দু জ্বলে থাকে।
ঘরটা আবার নিস্তব্ধ।
জানালার পর্দা হালকা নড়ে, মৃদু হাওয়ার ছোঁয়ায়।
মেহরিন ছাদটার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, যেন উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছে।
নিজের হাত দুটো জড়িয়ে ধরে মনের ভেতর কথাগুলো গুছিয়ে নিতে চায়।
আমি এমন স্বপ্ন দেখলাম কেন?
রাজপ্রাসাদ… রাজকন্যা… আমার হাত তুলে দিচ্ছেন বাবা… পাশে রিদ ভাইয়া… তারপর হঠাৎ সেই মুখোশধারী লোকটা…
আর এত আলো চারপাশে… এত অন্ধকারও…
কেন?
ওর চোখে তখনো প্রশ্নের ছায়া।
এই স্বপ্নের মানে কী? এটা কি কোনো সংকেত?
আর স্বপ্নে কেন বারবার রিদ ভাইকেই দেখছি?
কী আছে ওর সঙ্গে আমার এমন—
চিন্তার এক মুহূর্তে হঠাৎ কেমন একটা অস্থিরতা কাজ করে, আবার ছটফট করে বিছানায়,
কিন্তু মনের ভেতরের ঝড় ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়।
হয়তো ক্লান্তি, হয়তো আবেগ—সব মিলিয়ে দুচোখ ধীরে ধীরে নেমে আসে।
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে, মেহরিন আবারও চোখ বন্ধ করে।
মনের ভেতর রিদ ভাইয়ার চোখ দুটো ঘুরপাক খায়, সেই চাওয়াগুলো… কিছু না বলেই অনেক কিছু বলে ফেলা।
আরও একবার, গভীর ঘুমের আলিঙ্গনে তলিয়ে যায় মেহরিন।
বাইরে রাত এখন একেবারে নিস্তব্ধ।
আর ভিতরে… এক অদ্ভুত স্বপ্নের দরজা আবার খুলে যায়।
আবার একটা নতুন দিনের সূচনা। নীল আকাশে এখন রাজত্ব করছে সূর্যমামা।
সকালের রোদ গায়ে মেখে ধীরে ধীরে জেগে উঠল রিসোর্ট।
রাতের ঘুমে স্বস্তি মিলেছে সবার, কিন্তু মেহরিনের চোখে যেন এখনো সেই স্বপ্নের ছায়া লেগে আছে।
তবুও হাসিমুখে সবাই তৈরি হয়ে নিল।
আজকের গন্তব্য—মহাস্থান গড়, বাংলাদেশের ইতিহাসের এক জীবন্ত নিদর্শন।
রিসোর্টের ডাইনিং হলে সকালের নাশতা শেষে একে একে বাসে উঠে পড়ে সবাই।
সবার মুখে আজ অন্যরকম এক আগ্রহ, কারণ এই সফরের একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ওদের ওপর—একটা রিপোর্ট তৈরি করতে হবে মহাস্থান গড় নিয়ে।
চুমকি একহাত দিয়ে মেহরিনকে ধরে বলল,
এই যে রিপোর্ট, দেখবি আমি এমন বানামু যেটা স্যার একবার পড়ে বলবে, বাহ চুমকি তুমি তো একদম রিপোর্ট রাণী!
মেহরিন হাসল।
রাহি পিছন থেকে ঢুকে পড়ল ওদের কথার ভিতরে বলে তা রিপোর্ট রানী আপনি কি রিপোর্ট করবেন আমি চুমকি দা গ্রেট রিপোর্ট রানী নাকি রিপোর্ট রানী দা গ্রেট চুমকি।
তাদের হাসি-ঠাট্টার মাঝে বাস ছুটে চলে মহাস্থানের পথে।
সামনের দিকে চুপচাপ বসে থাকা রিদ মাঝেমধ্যে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে, চোখে এক অদ্ভুত গভীরতা।
রাখিব আর শান্তো নিজেদের মধ্যে কী একটা আলোচনা করছে, মাঝেমাঝে হালকা হাসি।
ঘণ্টাখানেক পর বাস থামে গন্তব্যে।
পৃথিবীর প্রাচীনতার গন্ধে ভরা সেই জায়গা—মহাস্থান গড়।
ভাঙা ইট, ধুলোয় ধরা ইতিহাসের গা ছমছমে চিহ্ন, সবই যেন বলে দেয় হাজার বছরের গাঁথা।
মহাস্থানগড়ের মাটি যেন ইতিহাসের গন্ধে আচ্ছন্ন।
পাথরের ভাঙা দেয়াল, মসৃণ করা ইটের পথ, আর প্রাচীন স্থাপত্যের চিহ্ন—সব কিছুতেই ছড়িয়ে আছে শতাব্দীর অভিজ্ঞান।
এখানে এসে যেন মেহরিনের মনটা ফুরফুর হয়ে গেল।
শিক্ষকরা হাঁটতে হাঁটতে বুঝিয়ে দিচ্ছেন প্রতিটি কোণার কাহিনি।
সত্য, বিশ্বাস, কিংবদন্তি আর ইতিহাস মিলেমিশে তৈরি হচ্ছে এক জীবন্ত পাঠ।
সেই ভিড়েই কোথাও আলাদা করে চোখে পড়ে যায় একদল মুখর ছাত্র।
রাহি কখনো চুমকি কে খোঁচাচ্ছে তো কখনো মেহেরিনের পিছনে লাগছে , কখনো ভিডিও করছে স্যারের কথা। চুমকি তো ক্যামেরা হাতে নিয়ে যেন একেবারে সাংবাদিক।
আর মেহরিন? সে কখনো চুপচাপ দাঁড়িয়ে প্রাচীন প্রাচীরের ছায়ায় স্যারের কথা শুনছে, কখনো বা চুমকির ক্যামেরার সামনে এসে পোজ দিচ্ছে।
আয় দাঁড়া, এখানটা একদম পারফেক্ট ব্যাকগ্রাউন্ড, চুমকি মেহরিনকে টেনে আনে দেয়ালের সামনে।
মেহরিন একটু লজ্জা পায়,
আরও তো অনেকে আছে রে… কি করছে না করছে…
রাহি পাশ থেকে বলে,
তোরা থামবি? দাঁড়া, ওর ওড়নাটা একটু ঠিক করে দেই… ঠিক এইভাবে চুলটা রাখ।
তারপর দুজন মিলে মেহরিনকে দাঁড় করিয়ে দেয় দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে, সামনে খোলা আকাশ, মুখে মৃদু হাসি—ঠিক যেন ইতিহাসের মাঝে দাঁড়ানো এক রাজকন্যা।
চুমকি বলল,
হাস একটু, আরে ওটা প্রেমে পড়ার হাসি না! এমন করে হাসবি যেন তুই ইতিহাস জয় করতে এসেছিস।
তারপর তিনজন একসাথে হেসে উঠে।
তিনজনের হাসিতে চারপাশে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে।
এদিকে রিদ আর শান্ত একটু দূরে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখে।
রিদ কিছু না বলেই চুপচাপ তাকিয়ে থাকে মেহরিনের হাসির দিকে, আর চোখে হালকা এক রঙ খেলে যায়—যা কেবল অনুভব করা যায়, বলা যায় না। অবশ্য সুযোগ বুঝে মেহরিনের কয়েকটা ছবিও তুলে নিয়ে রিদ।
রিপোর্টের কাজের ফাঁকে শিক্ষকরা দিচ্ছেন ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা, কখনো রাজাদের যুদ্ধ, কখনো রাজবন্দীদের আত্মত্যাগ, আবার কখনো প্রেমকাহিনির দৃষ্টান্ত।
সেসব কথা শুনে মেহরিনের চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে।
তাকে দেখে স্যার বললেন,
মেহরিন, কেমন বুঝলে জায়গাটা কত সুন্দর তাই না অবশ্য তোমার চোখেই যেন বোঝা যাচ্ছে তুমি ইতিহাসে বেঁচে উঠছো।
মেহরিন হেসে বলল,
স্যার, যদি সময়টা ফিরে পাওয়া যেতো…
রাহি ফিসফিস করে চুমকিকে বলে,
তোর বেস্টি কিন্তু আস্ত ইতিহাসপাগল। এখন যদি কেউ ওকে নিয়ে রোমান্টিক নাটক বানায়, আমি মোটেও অবাক হবো না।
চুমকি বলে,
তাহলে নাম রাখবো—মেহরিন: মহাস্থানরাণী!
সবাই হেসে ওঠে।
এভাবেই কেটে যায় সকালের ঘণ্টাগুলো।
ছবি, নোট, প্রশ্ন, পোজ, হেঁটে চলা আর ইতিহাস ছুঁয়ে দেখা—সব মিলিয়ে তৈরি হতে থাকে শুধু একটা রিপোর্ট নয়, তৈরি হয় স্মৃতির এক বর্ণময় খাতা।
মহাস্থানের শেষ কোণায় তখন বিকেলের নরম আলো পড়ছে।
মেহরিন, চুমকি আর রাহি একটু আলাদা হয়ে পুরোনো এক ইটের স্তূপ আর জাদুঘরের পাশের খোলা মাঠটা দেখতে বেরিয়েছিল।
চারপাশে খুব একটা ভিড় নেই। কিছু পর্যটক আর কয়েকজন সহপাঠী অনেকটা দূরে।
মেহরিন একটা ভাঙা গম্বুজের নিচে দাঁড়িয়ে ছায়া পড়া পথটার ছবি তুলছিল। চুমকি দূরে দাঁড়িয়ে কিছু শৈল্পিক কোণ খুঁজছিল ক্যামেরার জন্য।
তখনই চারজন অচেনা ছেলে এসে দাঁড়াল তাদের পাশে।
তাদের চেহারায় স্পষ্ট অস্বস্তিকর অভিব্যক্তি—হালকা বাঁকা কথা, চাপা হাসি, আর বিরক্তিকর চোখের ভাষা।
প্রথমে চুমকি আর রাহি বুঝে ওঠে না ব্যাপারটা।
একজন বলে উঠল,
এই দিকেই তো ক্যামেরা রাখো, ছবিটা সুন্দর হবে… তুমরা তো এমনিতেই মডেল।
রাহি চোখ রাঙিয়ে বলল,
আপনারা কে? আমাদের ক্যামেরা আমরা যেদিকে খুশি ওইদিকে রাখব আপনারা বলার কে? দেখে তো ভদ্র ফ্যামিলির মনে হচ্ছে। অপরিচিত মানুষের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় সেই ম্যানারস শিখেননি।
আরেকজন হেসে বলে,
আরেহ আমরা তো মজা করছি।এত সিরিয়াস হচ্ছো কেনো?
মেহরিন কিছু বলছিল না।
ও চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, চোখের কোণে শুধু চারপাশে সঠিক মুহূর্ত খুঁজছিল—কখন, কোথায় থেকে বেরিয়ে যাওয়া যাবে।
কিন্তু রাহি চুপ থাকার পাত্রী নয়।
সে রীতিমতো ধমক দিয়ে বলে উঠল,
নিজেদের ভালো চাইলে চলে যান এখান থেকে।
তাদের মধ্যে একজন আরও একধাপ এগিয়ে এসে মজা করে বলল,
আরে সুন্দরী রেগে যাচ্ছ কেন?আমরা তো শুধু একটু গল্প করতেই এসেছি।
এই কথা শোনা মাত্রই রাহির চোখ রক্তবর্ণ হয়ে যায়।
সে একদম সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
আপনি জানো না কার সাথে কথা বলছেন। আর একটা শব্দ বললে হাতটা এমন ঘোরাবো, চেহারা চিনতে পারবেন না আয়নায়।
চুমকি ওর পাশে দাঁড়িয়ে যায়।
এদিকে মেহরিন ধীরে ধীরে ফোন বের করে ক্যামেরা অন করে দেয়। ভিডিও চালু, স্পষ্ট সেই ছেলেগুলোর মুখ ধরা পড়ছে।
আলো ছায়ার খেলা চলছিল মহাস্থানের ধ্বংসাবশেষের গায়ে। ইতিহাস যেন চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখছিল বর্তমানের এক নতুন অধ্যায়।
রাহির মুখটা তখন রাগে জ্বলছে।
তিনজন ছেলের একজন কেমন ঘন হয়ে এসে রাহির হাতে ধরেছিল—অত্যন্ত বাজে ভঙ্গিতে।
চুমকি সাথে সাথেই একটা ধমক দিয়ে সরিয়ে দিতে গিয়েছিল, কিন্তু তখনই ছেলেটা বলে উঠেছিল,
আরেহ, মজা করছি তো! এতো সিরিয়াস হবার কী আছে?
রাহি গর্জে উঠেছিল,
মজা? আমার শরীর নিয়ে মজা করো? ছিঃ!
রাহির হাতে তখনও ছেলেটার চাপ। চুমকি কাঁপা গলায় কিছু বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই—
ওর হাতটা ছেড়ে দাও।
শান্ত, কিন্তু ধ্বনিতে ছিল শাসন। মেহরিন।
তার চোখে জ্বলছিল অদ্ভুত এক দৃঢ়তা। ছেলেগুলো ভেবেছিল—মেয়েটা বুঝি ভয় পাবে।
কিন্তু সেই মুহূর্তে, যেন পুরো আকাশ থমকে দাঁড়িয়েছিল।
একটা ছেলে স্পষ্ট অবজ্ঞায় বলে উঠল,
না ছাড়লে কি করবি? কাঁদবি নাকি?
ওদের কথা শুনে মেহরিন হালকা হাসলো।
আর তারপরই ঘটল সেটা।
মেহরিন হঠাৎ এক ফাঁকে ঢুকে গিয়ে গালে চড় বসালো ছেলেটার!
ছেলেটা ঘুরে পড়ে গেল, চোখ কুঁচকে রাগে দৌড়ে মেহরিনের দিকে ছুটে এলো।
আর ঠিক সেই সময়—
মেহরিন দিগন্ত ছেঁড়া আগুনের মতো ঘুরে গিয়ে পেছনের পিলারের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাঁশটা তুলে নিলো।
দ্বিতীয় জনকে সোপাটে দিলো এক বাড়ি!
তৃতীয় জন ছুটে এল—মেহরিন পিছিয়ে না গিয়ে সামনে এগিয়ে এল।
তার চোখে ভয় নেই। তার মনে তাণ্ডব।
একটা পা সরিয়ে ঝাঁপিয়ে গিয়ে ছেলেটার বুকের মাঝ বরাবর কনুইর ঘা!
সে পড়ে গেল মাটিতে। এখন তিনজন তিনদিকে ছিটকে আছে। কেউ উঠে দাঁড়াতে পারছে না।
মেহরিন দাঁড়িয়ে আছে নিঃশব্দে। হালকা শ্বাস, কিন্তু চোখে অগ্নি।
রাহি তাকিয়ে আছে—বিস্ময়ে, গর্বে। চুমকি চুপ।
রিদ, রাকিব আর শান্ত তখন দৌড়ে এলো— চুমকি কল করেছিলো ওদের তারা পুরো ঘটনাটা দেখেছে না দেখেছে, তাও বুঝে গেছে কিছু মারাত্মক ঘটেছে।
রাকিব রে’গে গিয়ে এলো পাথারি লাথি মারছে সেই ছেলে টাকে যে রাহির হাত ধরেছিলো। শান্ত গিয়ে ওকে ধরে যেভাবে মারছে ছেলে টা মরেই যাবে।
রিদ মেহরিনের দিকে তাকালো। তার ঠোঁটের কোণে লেগে ছিল একফোঁটা রক্ত। হয়তো ওদের মারতে গিয়ে লেগেছে।
সে এগিয়ে গিয়ে খুব নিচু গলায় বলল,
তুমি ঠিক আছো?
মেহরিন মাথা নাড়ল।
কোনো শব্দ নেই।
শুধু সেই চোখ দুটো বলে দিলো—
আমি ঠিক আছি।
মেহরিন এগিয়ে যায় মাটিতে পরে থাকা ছেলে গুলোর দিকে ,
ঠান্ডা গলায় বলল,
মেয়েরা দুর্বল না, তোমরা নিজেই আজ থেকে সেটা মনে রাখবে এই কথা । আমাদের সম্মান আমরাই রক্ষা করতে জানি।
ছেলে গুলো মাফ চাইছে,
ওরা বললো আমাদের ভুল হয়ে গেছে আপু, মাফ করে দিন। আমরা আর এমন করবো না।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল রাকিব। এতক্ষণ মেহরিন যা করছিল, রাকিব কিছু বলছিল না। তবে তার চোখের পলকে লাল রঙ ছড়িয়ে পড়ছিল একটু একটু করে।
কিন্তু সেই মুহূর্তেই, ছেলেটা যেইটা রাহির দিকে আবার বাড়িয়ে দিল হাতে— ছেলেটা রাহির কাছে মাফ চাওয়ার জন্যই হাত টা বাড়িয়েছে,
রাকিবের মাথার ভিতরে যেন একটা কাঁচ ভাঙলো।
তুই আবার হাত দিলি?
রাকিবের গলা ছিল চাপা, কিন্তু থরথর করে কাঁপছিল ক্ষোভে।
শান্তর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রাকিব আচমকা চিৎকার দিয়ে ছেলেটার দিকে দৌড়ে গেল—শান্ত কিছু বুঝে উঠার আগেই
রাকিবের এক লাথি দিলো সোজা ছেলেটার বুকে!
ধপ্!
ছেলেটা পেছনে উলটে গিয়ে পড়ে গেল মাটিতে।
চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে এলো।
শান্ত অবাক!
রাকিব, যে সবচেয়ে ঠান্ডা মেজাজের, চুপচাপ ছেলে—সে এতটা ক্ষিপ্র হয়ে এমন আচরণ করবে, এটা কেউ কল্পনাও করেনি।
তোকে এত সাহস কে দিলো, ওর হাত ধরার বল কে দিলো?
রাকিব এগিয়ে এসে ছেলেটার কলার চেপে ধরল।
চোখে তার আগুন, কণ্ঠে বরফ।
ওর দিকে যদি আর একবার তাকাসও, আমি নিজে তোকে তোর চোখ উপরে ফেলবো।
শান্ত রাকিবের হাত টেনে ধরে বলল,
রাকিব, ছেড়ে দে। অনেক হয়েছে। মরে যাবে তো।
রাকিব ধীরে ধীরে হাত ছাড়ল।
ছেলেটা ভয়ে থরথর করে উঠে দাঁড়িয়ে পালিয়ে গেল।
তখন শান্ত ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে রাকিবের দিকে তাকাল—চোখে প্রশ্ন,
তুই তো এমন না রে? যেখানে রিদ কিছু বলছে না তুই এত কেনো রেগে যাচ্ছিস।
রাকিব চোখ সরিয়ে নিলো। নিচু গলায় বলল,
ওর কথা আলাদা। ওর চোখে ভয় আমার… সহ্য হয় না। ওর গায়ে কেউ হাত দিলে আমি তাকে খু’ন করে ফেলবো।
শান্ত বুঝে গেল—এটা রাকিবের ‘ভালোবাসা’ নামের অজানা ভূখণ্ডে প্রথম ঝড়। শান্ত বুঝলো রাকিব যাকে ভালোবাসে সে আর কেউ না রাহি।
রক্তচাপের মতো উত্তাল মুহূর্তটা কিছুটা থিতিয়ে এসেছে। রাহি তখন চুপ করে একপাশে দাঁড়িয়ে, যেন কিছু বোঝার চেষ্টা করছে। আর ঠিক তখনই রাকিব ধীরে ধীরে পেছনের দিকে পা বাড়ায়।
শান্ত যায় রাকিবের পিছু জিজ্ঞাস করে। রাকিব তুই কি রাহি কে…..
রাকিব শান্তর পাশে গিয়ে,গলায় একরাশ দ্বিধা নিয়ে বলে ফেলে—
আমি রাহিকে ভালোবাসি।
শান্ত থমকে যায়। চোখ মেলে চায় রাকিবের মুখের দিকে—এমন কথা ওর মুখে কেউ কখনো শোনেনি। যে ছেলেটা সবসময় হাসি ঠাট্টায় থাকে, হঠাৎ এমন একটা স্বীকারোক্তি যেন চারপাশের হাওয়াকেও থামিয়ে দেয়।
রাকিব কিছু না বলে ঘুরে পড়ে। মাথা নিচু করে চলে যেতে থাকে… একটা ভার যেন বুক চেপে ধরে রেখেছে তাকে।
আর একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রিদ চুপচাপ সব দেখছে। ওর চোখে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই, ঠোঁটে নেই কোনো শব্দ—তবু ভিতরে ভিতরে যেন কেমন একটা গর্জন বাজছে।
মেহরিন ওর কাছেই দাঁড়িয়ে, কিন্তু রিদ কিছু বলে না। শুধু নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে।
হাওয়া বয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, অথচ কারো গলার আওয়াজ নেই। শুধু মাটির ওপর ভেসে আছে কিছু অনুচ্চারিত অনুভূতির ভার…
চারপাশে যখন নিস্তব্ধতা জমে উঠছে, হঠাৎ মেহরিন নরম স্বরে বলে উঠল—
“রিদ ভাইয়া…”
রিদ তাকাল, চোখে একটা নীরব প্রশ্ন।
আপনার কি মনে হয় না, রাকিব ভাইয়া রাহিকে ভালোবাসে?
রিদ কিছুক্ষণ চুপ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ঠোঁটের কোণে এক টুকরো মৃদু হাসি ফুটে উঠল।
আমি জানি,শান্ত অথচ গভীর স্বরে বলে উঠল সে।
মেহরিন কিছুটা অবাক হয়ে চেয়ে থাকল ওর দিকে। রিদ আবার মুখ ফিরিয়ে আকাশের দিকে তাকাল—যেন বহু আগেই সব বুঝে ফেলেছে, শুধু অপেক্ষা করছে কার কখন সাহস হবে তা বলার।
নিরবতা আবার ঘিরে ধরে দুজনকে, তবে এবার সেটা অস্বস্তির নয়—বরং একধরনের বোঝাপড়ার, একধরনের নীরব সম্মতির।
অন্যদিকে রাহি রাকিবের যাওয়ার পানে চেয়ে থাকে।
মনে মনে রাকিবের গুষ্টি উদ্ধার করছে।
শা’লা ডেমনা! মনে মনে গর্জে উঠলো সে।
আমাকে একটু ছুঁয়েছে বলে, গন্ডারের মতো রাগে ফুসফুস করছে! এমন ভাব, যেনো আমাকে ধরে নি ওর গায়ে বিচুটি পাতা ঘষে দিয়ে গেছে! হুহ! শা’লা আমি হলে ঠিক তোর গায়ে বিচুটি পাতা লাগিয়ে দিতাম। বলদ কোথাকার।
দাঁতে দাঁত চেপে আবার বললো, এই যে আমাকে একটু স্পর্শ করেছে বলে রেগে গেলি আসলে যে আমাকে নিয়ে কত্তো পজেসিভ, তা না হয় বুঝলাম তাই বলে তুই যে ভালোবাসিস সেটা আমাকে বলবি না।
তারপর চোখ গুটিয়ে একটা দুষ্টু হাসি হেসে রাহি বিড়বিড় করে বলল,
গু’লামের পুত! ভালোবাসিস, তাও বলিস না মুখ ফুটে!
আচ্ছা, ঠিক আছে। না বলিস, তোর ইচ্ছা।
কিন্তু যখন দেখবি আমি অন্য গু’লামের পুতের হাত ধরে হাঁটছি, তখন বুঝবি—কত চালে কত ধান!
ভালোবাসার কথা তুই নিজে এসে আমাকে বললি কিভাবে না বলে থাকিস সেটা আমিও দেখবো। তোকে দিয়ে যদি ভালোবাসার কথা আমি না বলাতে পারি, আমার নাম রাহি তালুকদার না হুম। এই ইট, বালু, সিমেন্ট, পাথর, আকাশ, বাতাস সবাইকে সাক্ষী রেখে প্রতিজ্ঞা করলাম আমি ।
হঠাৎ নিজের কথায় নিজেই হেসে উঠে রাহি। মনে মনে বলে ছিঃ রাহি তোর মুখের এসব কি ভাষা। মুখে মুচকি হাসি, চোখে ঝিলিক।
রাহি জানে—এই খুনসুটি, এই ঠাট্টা, এই না বলা ভালবাসাগুলো—সবই গল্পের মতো সুন্দর, একটু হাসির, একটু আবেগের।
রাহি তখনো নিজের মনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে চলেছে।
তার চোখে ছিল দুষ্টু ঝিলিক, আর ঠোঁটে গোঁজানো এক টুকরো বিজয়ী হাসি।
কিন্তু সে জানত না— ঠিক তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে চুপিচুপি চুমকি।
আর ওর একপাশে কৌতূহলী চোখে দাঁড়িয়ে আছে মেহরিন।
কথা শেষ হতে না হতেই—
“হাহাহাহা!”
চুমকি আর মেহরিন একসাথে হেসে উঠল।
রাহি থমকে গেল, চোখ গোল গোল, মুখ হাঁ…
তোরা… ক**কখন… এ**এলি ওমা সব শোনে ফেলিস নি তো?
চুমকি হাসি চেপে বলল,
মোটামুটি তুই ‘গুলামের পুত’ বলার আগেই!
আর মেহরিন তখন হাসতে হাসতে বলল,
রাহির ভালোবাসার দাওয়াত দেখি একদম নাট্যশালার মতো জম্পেশ!
রাহির মুখ তখন লাল নীল হয়ে উঠছে, কিছুটা লজ্জায়, কিছুটা রাগে। সে এক ঝাঁকানি দিয়ে বলল,
আরে দূর! তোরা না থাকলে আমি কত শান্তিপূর্ণ ফিসফিসানি চালাতে পারতাম…
চুমকি চোখ টিপে বলল,
মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ১৩
“না রে বোন, তোর প্রেম ফিসফিসে থাকলে চলবে না—সেটা পুরাই মাইকেঘোষিত হওয়া দরকার!”
আরও এক দফা হাসি, আর সঙ্গে সঙ্গে রাহির এক চাপড় চুমকির পিঠে।
সন্ধ্যার হালকা আলোয় তিন জনের খিলখিলিয়ে হাসির মাঝে মিলিয়ে গেল ভালবাসার এক পাগলাটে রঙ।