মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৩৮

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৩৮
মির্জা সূচনা

রাত ১২টা। রাজ আর বাকিরা সবাই এসে গেছে মেহরিনদের বাসায়।
খাওয়া-দাওয়া শেষ, পেটভরে গল্প আর হাসির মহফিল এখন ছাদে।
চাঁদের আলোয় জমে উঠেছে আড্ডা।
মেহরিন, রাজ, মেহবুবা, মাহির, লাবিব, লামিয়া আর চুমকি—সবাই ছাদে।
চুমকি আজ সকালেই এসেছে, আর যতদিন মেহরিন থাকবে, ও-ও এখানেই থাকবে।
সবার মধ্যমণি রাজ, গল্প শুরু করে দিয়েছে।

কখন, কিভাবে প্রথম মেহরিনকে দেখেছিলো..এবং কখন কিভাবে কোথায় মেহেরিনকে সবকিছু থেকে প্রোটেক করেছে। একটু দেখার জন্য কতটা ছটফট করেছে কতটা পাগলামি করেছে এইসব।
চুমকি বলে, দুলাভাই, আপনি একটা জিনিস কি ড্রামা টাই না করে বিয়ে করলেন। একদম পুরাই ফিল্মি।
রাজ মেহরিনের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, আর কি মাইরটা যে খেলাম সেটা তো বললে না।আমার মত বিয়ে করতে এসে বউয়ের হাতের মাইর কয়জনে খাইছে বলো।
এই কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে ওঠে।
মেহরিন চোখ রাঙিয় রাজকে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

লাবিব ব্রো কুছকে বলে,এই ল্যাদা বাচ্চা, তোমারও কী ভাবীর মতো মারামারি করোর অভ্যাস আছে নাকি?
মেহবুবা রেগে বলে, এই বাঁদর আপনার সমস্যা কী! সব সময় পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করেন আমার সঙ্গে।বাঁদর কোথাকার।
লাবিব বলে, এই ল্যাদা বাচ্চা তুমি আমাকে আবার বাঁদর বললে?
মাহির বলে, আমার শুরু হয়ে গেলো টম এন্ড জেরির কাহিনী।
মেহবুবা বলে, হ্যাঁ বলব ১০১ বার বলবো। আমাকে যতবার ল্যাদা বাচ্চা বলবেন আমি ততবারই বলবো বাঁদয় বাঁদর বাঁদর।

লাবিব মেহবুবার কানে কানে বলে, এখন যত ইচ্ছা উড়ো সোনা সময়মত বোঝাবো তোমাকে। আমাকে বাঁদর বলা তাই না? তখন হারে হারে বুঝাব বাঁদর কত প্রকার ও কি কি।
মেহবুবা লাবিব কে ধাক্কা দিয়ে বলে, আমিও দেখবো কি কি করতে পারেন আপনি। এখন সরুন তো সবসময় বাঁদরের মতো ঘাড়ে উঠে পড়তে চায় যত্তসব বাঁদরামো।
লামিয়া কপালে হাত দিয়ে বলে, হায় আল্লাহ এরা এমন টম এন্ড জের মতো সারাক্ষণ ঝগড়া করে কেন?
চুমকি লামিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলে, ঝগড়া না সোনা এটা হল ভালোবাসা বুঝলা। লামিয়া হেসে ফেলে সাথে চুমকিও।
মেহরিন ধমক দিয়ে বলে, তোরা থামবি এবার?
রাজ বলে, এই বাঁদর চুপ করে বস আমার শালিকে এত জ্বালাবি না। রাজের কথায় মেহবুবা খুশি হলেও লাবিব মুখ ভোতা করে বলে।
ব্রুো…..

রাজ বলে, কি ব্রো হে! সারাক্ষণ ওর পিছনে লেগে থাকিস কেন?
লাবিব দাঁত বের করে বলে,আমার ভালো লাগে মাহবুবা মুখ ঝামটা দেয়। সবাই হাসে।
রাজ নাটুকে ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
বাচ্চারা, তোমরা গিয়ে ঘুমাও। আমি আমার বউকে নিয়ে একটু চন্দ্র বিলাস করে আসি।
সবাই ওউউউউউউ বলে উঠে।
মেহরিন মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, এখন রাত কতটা বাজে জানেন? আসছে চন্দ্রবিলাস করতে হুম।
রাজ দুঃখী দুঃখী মুখ করে বলে, জানি তো! এমন রাতেই তো বিবাহিতরা…….
মেহরিন রাজের মুখ চেপে ধরে বলে, চুপ করুন! অসভ্য লোক।
সবার মুখে মিটি মিটি হাসি।
মেহরিন বলে, তোমরা যাও, ঘুমাও। তারপর দাঁতের দাঁত চেপে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, আমি এই অসভ্য লোকটার সাথে গিয়ে চন্দ্র বিলাস করে আসি।
সবাই জোরে হেসে ওঠে।

সবাই একে একে নিচে নেমে যায়।
মেহরিন রাজের মুখ থেকে হাত সরিয়ে নেয়।
রাজ তার হাত ধরে, আলতো করে চুমু খায়।
তার পর নাটুকে ভঙ্গিতে বলে, বউ, তুমি আমার সঙ্গে অনেক অন্যায় করছো।
বিয়ে করেও আমাকে ভার্জিন রেখে দিলে?
জাতি শুনলে আমায় মেনে নেবে।
মেহরিন ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে,না মানলে না মানুক। এখন চলুন।
রাজ হেসে মেহরিনের পিছু পিছু যায়।
দুজনে রুমে ঢুকে কাপড় পাল্টে নেয়।
মেহরিন পরে জিন্স আর টপ,
রাজ পরে কালো শার্ট আর কালো প্যান্ট।
দুজনে বেরিয়ে পড়ে বাইকে চড়ে,
নীরব শহরে, রাতের ঘুমন্ত বাতাসে একসাথে ডুবে যেতে।

রাত গভীর। শহরের কোলাহল পেরিয়ে বহু দূরে এসে পৌঁছেছে রাজ আর মেহরিন। রাস্তাটা প্রায় ফাঁকা, চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফুলের বাগান যেনো নিঃশব্দে গন্ধ ছড়িয়ে দিচ্ছে বাতাসে।
রাজ বাইক থামালো রাস্তার ধারে একটা গাছের পাশে। রাজ আছি বলে কোথাও একটা গেছে।
মেহরিন নেমে বসে পড়ে পাশের ঘাসে। একটু এগিয়ে থাকা একটা বাগান বিলাশ গাছ পাশে চোখ চলে যায় তার। সেদিকে চেয়ে থাকে চুপচাপ। রাস্তা যেমন নির্জন, তেমনি রাতটাও।
কিছুক্ষণ পর রাজ ফিরে আসে, হাতে একটা লাল জবা ফুল।
মেহরিন কপাল কুঁচকে তাকায়,
— এই নির্জন রাস্তায় আমায় একা রেখে কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?
রাজ হেসে বলে,
— বউ, একটু মূত্র বিসর্জন দিতে গিয়েছিলাম।
মেহরিন ব্রু কুঁচকে বলে,
— তা হাতে ফুল এল কোথা থেকে?
রাজ হেসে বলে,

— ফুলগুলো সুন্দর লেগেছিলো। ভাবলাম, আমার নিজের সুন্দর ফুলটাকে আরেকটা ফুল দিই।
এই বলে রাজ আলতো করে জবা ফুলটা মেহরিনের কানের পেছনে গুঁজে দেয়।
মেহরিন চুপ। কেমন যেনো একটা থমথমে ভালো লাগা ছড়িয়ে পড়ে তার হৃদয়জুড়ে।
রাজ এরপর আরও একটা জবা ফুল তোলে, এবার গভীর চোখে মেহরিনের দিকে তাকিয়ে বলে,
— তোর জন্য একটা কবিতা বলি?
মেহরিন মাথা নাড়ে, ঠোঁটে হাসি, চোখে কৌতূহল।
রাজ গলা পরিস্কার করে বলতে শুরু করে…

“তুমি আমার বসন্ত”
তুমি কি জানো,
এই রাস্তার নীরবতা তোমার মতোই—
নরম, গভীর, কিছুটা রহস্যে মোড়া।
তোমার চোখের ভেতর
আমি একটা ছোট্ট ফুলের বাগান দেখি,
যেখানে প্রতিটা পাঁপড়ি
আমার নামে জেগে থাকে প্রতিদিন।
এই জবা ফুলটা শুধু ফুল নয়,
এটা একেকটা কথা—

“তুমি,” “আমার,” “ভালোবাসা,”
এই তিনটি শব্দের গন্ধ মেখে আছে তাতে।
আমি পথ হারাই তোমার পাশে এসে,
তুমি না থাকলে রাস্তা থাকে,
কিন্তু গন্তব্য হারায়।
তুমি আমার বসন্ত,
যেখানে প্রতিদিন প্রেম ফোটে
নতুন কোনো রঙে।
মেহরিন নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে রাজের দিকে। চোখের পাপড়ি একটু কেঁপে ওঠে। তার ঠোঁটের কোণে ধরা পড়ে একটা নরম হাসি।
সে আলতো করে জবা ফুলটা হাতে নেয়, দেখে… তারপর বলে,
— আমার পাগল প্রেমিক। আমার ভালোবাসা, আমার স্বামী,আমার কবি সাহেব।
নীরব রাস্তায় একটা গাছের নিচে মেহরিন আর রাজ কিছুক্ষণ বসে থাকে। চাঁদের আলোয় মেহরিনের মুখটা যেনো আরও কোমল, আরও স্বপ্নিল।
রাজ আলতো গলায় বলে,

— বউজান…
মেহরিন সাড়া দেয় হুমম করে।
রাজ মুচকি হেসে বলে,
— একটা গান শোনাও না।
মেহরিন একটু অবাক হয়ে বলে,
— এই রাতবেলা গান গাইতে বলছেন?
রাজ তার হাত ধরে আলতো করে বলে,
— “Moonbem… প্লিজ্‌…”

মেহরিন রাজের দিকে তাকায়, আর নরম গলায় একটা মায়াবী গান গেয়ে ওঠে।
তোমার আকাশ দুটি চোখে
আমি হয়ে গেছি তারা
ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে
আমি হয়ে গেছি তারা
এই জীবন ছিল
নদীর মতো গতিহারা
এই জীবন ছিল
নদীর মতো গতিহারা দিশাহারা
ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে
আমি হয়ে গেছি তারা
আগে ছিল শুধু পরিচয়
পরে হলো মন বিনিময়
আগে ছিল শুধু পরিচয়
পরে হলো মন বিনিময়
শুভ লগ্নে হয়ে গেল শুভ পরিণয়
শুভ লগ্নে হয়ে গেল শুভ পরিণয়
আজ যখনই ডাকি
জানি তুমি দিবে সাড়া
এই জীবন ছিল
নদীর মতো গতিহারা
ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে
আমি হয়ে গেছি তারা
রাজ মুগ্ধ হয়ে শোনে। গান শেষ হতেই রাজ মেহরিনকে জড়িয়ে ধরে। কিছু না বলে, শুধু ধরে রাখে—অনুভূতির ভাষা নেই, শুধু নিরবতা আর হৃদয়ের ছোঁয়া।
অনেকটা সময় এভাবে কেটে যায়।
তারপর মেহরিন বলে,

— চলুন, এবার যাওয়া যাক।
রাজ একটু বিরক্ত সুরে বলে,
— গেলেই কী! আমার তো ঘুম ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। তার থেকে এখানেই ঘুমিয়ে পড়ি।
মেহরিন হেসে বলে,
— ঢং না করে চলুন।
রাজ কেমন একটা ভান করে বলে,
— আমি ঢং করি?
তারপর চোখ নাচিয়ে বলে,

— আমার জায়গায় থাকলে বুঝতে… সামনে বিরিয়ানি কিন্তু আমি খেতে পারি না— কারন আমার হাত বাঁধা!এই ফিলিংসটা যে কি শুধু বিরিয়ানি লাভাররাই জানে।
মেহরিন হাসতে হাসতে রাজের বুকে ঢলে পড়ে।
রাজ ঘাসের উপর শুয়ে পরে মেহরিনকে নিয়ে।
সে বলে,
— বউ… আমি আর কতদিন ভার্জিন থাকবো?
মেহরিন হেসে বলে,
— সবাই তো বিয়ের পর ভার্জিনিটি হারায়, আপনার ভাগ্য ভালো… তাই এখনো সলিট আছেন।দেখছেন আমি কত ভালো বউ।
রাজ বলে,

— “বউউউউ…”
মেহরিন দাঁড়িয়ে পড়ে, রাজের হাত ধরে টেনে বলে,
— চলুন, এবার যাওয়া যাক।
রাজ বাইকে বসে স্টার্ট দিতে যাবে, ঠিক তখনই তিনটা বাইকে করে ন’জন ছেলে এসে হাজির। চেহারা দেখে বোঝাই যায়—গাঁজা খেয়ে সারাদিন তাল হয়ে থাকে দেখতে কেমন একটা গালকাটা ব্রু কাটা। লুক লাইক এ ভিলেন ভিলেন।
মেহরিন রাজের দিকে তাকায়। রাজও তার চোখে চোখ রাখে।
মেহরিন হেসে বলে,
—মনে হচ্ছে, আমাদের প্রেমটা কারও সহ্য হলো না কবি সাহেব।
রাজ মুচকি হেসে বলে,
— চলো, তবে ওদের একটু শেখাই… প্রেম বাধা দেওয়া ঘোর অন্যায় আর এর জন্য একটু শাস্তিও দেওয়া যাক যাতে অন্য কারো প্রেমে বাগড়া না দেয়।
দু’জনে বাইক থেকে নেমে পড়ে।
দুই হাত ভাজ করে বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে… ঠোঁটে সেই চেনা সাহসী হাসি।
রাত তখন গভীর, কিন্তু প্রেম আর সাহস দুটোই জেগে আছে।

মেহরিন ভাল করে তাকায় ওদের দিকে, চেহারা-চলনে বোঝা যাচ্ছিল—গাঁজার খপ্পরে পড়ে বেহাল দশা। চোখে রাগ, মুখে বাঁকা হাসি।
একজন চিৎকার করে বলে,
— এই রোমিও-জুলিয়েট, প্রেম করছোএইখানে দাঁড়ায়া?
বাইক তিনটা মেহরিন ও রাজের পাশে গোল গোল ঘুরতে থাকে।
রাজ ঠান্ডা গলায় বলে,
— কি সমস্যা ভাই তোমাদের? প্রেমে বাধা দেওয়ার কি কারন? নাকি নিজেরা প্রেম করতে পারো না তাই আমাদের প্রেম দেখে জ্বলছে, সেই রাগ?
এই সময়ই হঠাৎ একটা ছেলে কোমর থেকে ছোট একটা ছুরি বের করে ছুঁড়ে মারে মেহরিনের দিকে।
কিন্তু মেহরিন ক্ষিপ্র হাতে ছুরিটা ধরে ফেলে, ঠোঁটে এক চিলতে হাসি এনে বলে,
—নিশানা একদম বাজে! দাঁড়ান আমি দেখাচ্ছি নিশানা কাকে বলে?
এই বলে সে ছুরিটা গুছিয়ে ছুঁড়ে মারে—ঠিক সেই ছেলের বুক বরাবর। ছেলেটা বাইক থেকে পড়ে যায়।
রাজ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলে,

— আরে বাসসস…আরিওনা, তোমার নিশানা তো জাক্কাস!
মেহরিন হেসে চোখ টিপে দেয় রাজকে।
ছেলেটা ব্যথায় কাতরাচ্ছে। বাকিরা নামতে থাকে, একজন গালাগালি শুরু করে রাজকে উদ্দেশ্য করে আর ছেলেগুলো তেড়ে যায় মেহেরিনের দিকে। কিন্তু মেহরিন এর তাতে কোন ভক্ষেপ দেখা গেল না। সে আরামসে দাঁড়িয়ে আছে যেনো কিছু হচ্ছেই না।
রাজ হাত গুটিতে গুটাতে বলে,

— ওর দিকে গেলে হাতপা ভেঙে যাবে। তার থেকে ভালো আমার দিকে এই বাপ বিনা টিকিটে ওপরে পাঠানোর ব্যবস্থা করবো। বিশ্বাস কর কোন টাকা লাগবে না টিকেটও লাগবেনা সোজা জাহান্নামের দরজা পাঠিয়ে দিবো।
ছেলেরা ক্ষেপে গিয়ে রাজের দিকে ধেয়ে আসে।
রাজ এক হাতে সামনের ছেলেটাকে ঘুষি দেয়, আরেকজনকে লাথি মেরে দূরে ফেলে দেয়। মুহূর্তেই হুলুস্থুল মারামারি শুরু হয়ে যায়।
মেহরিন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে,
— ছিঃ! আপনি একজন গ্যাংস্টার হয়ে এদের সাথে এভাবে মারামারি করছেন? আমার সম্মান আপনি এভাবে রাস্তার মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়াচ্ছেন ছিঃ!
রাজ থমকে যায়।
এই ফাঁকে মেহরিন এগিয়ে যায়।

এক ছেলের হাত থেকে ছুরি নিয়ে নেয়, তারপর চারদিক ঘুরে ঘুরে উড়াধুরা কুপাকুপি শুরু করে দেয়।
এমনভাবে হামলা করে বসে, কেউই কল্পনাও করতে পারেনি।
ফলাফল?
মিনিট পাঁচেকের ভেতর বেশির ভাগ ছেলেই হাত-পা কাটা অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।সাথে রাজ কেউ দেয় এক ধাক্কা।
রাজ কাঁধ থেকে ধুলো ঝেড়ে বলে,
— বাবা! আমার বউ আমাকেই মাটিতে ফেলে দিলো! আমি তো দাঁড়িয়ে ছিলাম—আমাকে ধাক্কা দিয়ে দিলে তুমি নট ফেয়ার বউ।
মেহরিন হাসতে হাসতে বলে,

— আমাকে হালকাভাবে কেন নিচ্ছেন কবি সাহেব? ভুলে যাবেন আমি একজন গ্যাংস্টার লাভলী ওয়াইফ।সো বি কেয়ারফুল আমার সাথে নো পাংগা তাহলে করে দিব আপনাকে ঝঙ্গা ঝাঙ্গা।
এরপর মেহরিন একটু ঝুঁকে ছেলেগুলোর দিকে তাকায়, ঠোঁটে এক চিলতে বিষাক্ত হাসি।
— আমার প্রেমে ব্যাঘাত ঘটাতে আসলে শুধু হাত-পা না… men part পর্যন্ত কাটা যেতে পারে so mind it!
রাজ পাশে দাঁড়িয়ে হেসে বলে,
— ছিঃ বউ, তুমি অন্যের জিনিসে নজর দিচ্ছো কেন? তোমার নিজের জিনিসটাই তো রয়েছে।
মেহরিন বলে,
— নষ্ট পুরুষ!
দু’জনেই ঘুরে পেছনে হাঁটা দিচ্ছে ঠিক তখনই, হঠাৎ এক আহত ছেলে দাঁড়িয়ে উঠে এসে মেহরিনের গলায় ছুরি ধরে চিৎকার করে ওঠে,
— শালী! তোর অনেক তেজ তাইনা মাইয়া হইয়া বেডা গো মতো মারামারি করস … একটা টান দিমু, সব তেজ বের হয়ে যাবে শালী..
রাজ ঘাবড়ে যায়, মেহরিনের চোখের দিকে তাকায়।
মেহরিন চোখ টিপে দেয়।
রাজ মেহরিনের ইঙ্গিত বুঝেই ধীরে সরে যায়।
মুহূর্তেই—

ডান পা তুলে এমন এক লাথি ছুঁড়ে মারে ছেলেটার “স্পেশাল জায়গায়” যে সে তক্ষুনি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
মেহরিন মাটিতে পড়া ছুরি টা তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে ছেলেটার হাতের তালুতে গভীরভাবে গেঁথে দেয়।
ছেলেটা চিৎকার করে ওঠে।
মেহরিন চুল ঠিক করে রাজের কাছে আসে, হালকা একটা “সফট কিস” দেয় গালে,
তারপর বলে,
— চিল! এত ভয় পাওয়ার কী আছে?
রাজ হাসে,
— তুমি তো রীতিমতো রণক্ষেত্রের রাণী!
তারপর ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে,
— ভাইসাবেরা, text time দেখে আসবেন। আমার বউ মারামারিতে এতটা এক্সপার্ট, আমাকেও ছার দেয়নি আমার বিয়ের দিনেও আমার দাঁতের জায়গা নাড়িয়ে দিয়েছিলো। সেখানে তোরা কোন বাল যে তোদের ছেড়ে দেবে?
সবাই স্তব্ধ। কেউ আর কথা বলার সাহস পায় না।
মেহরিন বাইকের দিকে হেঁটে যায়, উঠার আগে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে,

— যারা তোদের পাঠিয়েছে, তাদের গিয়ে বলিস—ওদের সঙ্গে আমি খুব তাড়াতাড়ি মুখোমুখি হবো। সেই দিন আর হার জিনিসটা থাকবে না ওদের কাছে!
এই বলে সে রাজের পেছনে বসে পড়ে।
রাজ বাইক স্টার্ট দেয়, আর দু’জন বাতাস কেটে উড়ে চলে যায় রাতের শহরের বুক চিরে।
ফিরতি পথে রাজ গান ধরে।
কি নামে ডেকে বলবো তোমাকে
মন্দ করেছে আমাকে ওই দুটি চোখে
কি নামে ডেকে বলবো তোমাকে
মন্দ করেছে আমাকে ওই দুটি চোখে
আমি যে মাতাল হাওয়ার ই মত হয়ে
যেতে যতে পায়ে পায়ে গেছি জড়িয়ে
আমি যে মাতাল হাওয়ার ই মত হয়ে
যেতে যতে পায়ে পায়ে গেছি জড়িয়ে
কি করি ভেবে যে মরি বলবে কি লোকে
মন্দ করেছে আমাকে ঐ দুটি চোখে
কি নামে ডেকে বলবো তোমাকে
মন্দ করেছে আমাকে ওই দুটি চোখে

হালকা ঠান্ডা হাওয়া বইছে, বাইকের পেছনে বসে মেহরিন রাজের পিঠে মাথা রেখে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে দেয়।
এই রাতের নির্জনতা আর রাজের গলার সুর তাকে নিরাপত্তা আর ভালোবাসায় ভরিয়ে দেয়।
বাসায় ফিরে মেহরিন ফ্রেশ হয়ে আছে।
মেহরিন বিছানা বিছাচ্ছে..
রাজ শুধু টাওজার পড়ে বেরিয়ে আসে ওয়াশরুম থেকে। মেহরিন আরচোখে কয়েকবার দেখে রাজের হাব ভাব, রাজকে ওইভাবে দেখে চট করে চোখ ঘুরিয়ে নেয়।
কিন্তু বারবার রাজের দিকে তাকিয়ে ফেলে।
রাজ তা বুঝে ফেলে, হাসি চেপে বলে—

—আমি বুঝিনা বউ তুমি আমি গোসল করে আসলে এভাবে চোরের মত চেয়ে থাকো কেন?বউ হয়ে জামাইকে এভাবে চুরি করে দেখাটা কি ঠিক?
— সামনাসামনি দেখতে পারো না নাকি?আমি তো তোমারই বউ সঙ্গে দেখা কোন সমস্যা নেই।
মেহরিন বালিশ ছুঁড়ে মারে,
— আপনার কি একটুও লজ্জা নেই? এইভাবে খালি গায়ে থাকেন।
রাজ মুচকি হেসে বলে,

— বউয়ের সামনে লজ্জা পাই কাপুরুষেরা কতবার বলবো তোমাকে বউ আমি কাপুরুষ নয়।
তারপর মেহরিনার হাতটা নিয়ে জিম করা বডির সিক্স পেকে রাখে। আর বলে এই বডি সডি বানিয়ে লাভ কি যদি বউ ভালো করে না দেখে। যদি একটুখানি না ছুঁয়েই দেয়।
মেহরিন হাত সরিয়ে নেয়।
— নষ্ট পুরুষ!
রাজ আবার বলে,

— শুধু নষ্ট পুরুষ না… তুমি জানো আমি তোমাকে কেমন চোখে দেখি?
— কেমন চোখে?
রাজ ধীরে ধীরে বলে,
নষ্ট মনে নষ্ট চোখে দেখি তোমাকে…
মন আমার কি চায় বোঝাই কেমনে…
এটুকু বলে ঠোঁট কামড়ে হাাসে রাজ।
মেহরিন হঠাৎ রেগে গিয়ে বলে,
— এইবার একদম ঘর থেকে বের করে দিব বলে দিলাম।
রাজ নাটকীয় ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে,

— ওই একটাই কাজই তো পারো তুমি, ঘর থেকে বের করে দেওয়া আর মারামারি করা! বউ হয় নরম, লাজুক…আর আমারে আল্লাহ একটা বউ দিছে, আদর তো করেই না… করতেও দেয় না!
মেহরিন দাঁড়িয়ে পড়ে,
— আমি মারি তাই তো?
সে হাত তোলে, রাজ পাশ কাটিয়ে সরে গিয়ে
মেহরিনের গাল টুপ করে চুমু খায়।
মেহরিন স্তব্ধ।
— এই কী করলেন এটা!
রাজ হাত ধরে, গুরিয়ে বলে—
— আরো করব!
আরো কয়েকটা নরম চুমু দেয় তার গালে।
রাজ হেসে কোলে তুলে নেয়। মেহরিন হেসে ফেলে, জড়িয়ে ধরে।
রাজ তাকে বিছানায় শুইয়ে দেয়, নিজেও পাশে এসে শোয়।
মেহরিন মাথা রাখে রাজের বুকে।
রাজ চুলে হাত বুলিয়ে বলে—

—বউ, কালকে আমরা সাজেক যাবো… প্লিজ, আমি আর পারছি না এভাবে বেশি দিন চললে আমার জীবন যৌবন সব ফুস হয়ে যাবে।
মেহরিন ওকে জড়িয়ে ধরে, গালে একট চুমু দিয়ে বলে—
— চুপ করুন, নষ্ট পুরুষ!
রাজ হেসে ফেলে।
তার বুকের ভেতরটা হঠাৎ করে শান্ত হয়ে যায়—ভালোবাসায়, তৃষ্ণায়, আর আবেগে।
এই মেয়েটার রাগ, ভালোবাসা আর চুমুর ভেতরেই রাজ বার বার হারিয়ে যায়।
সাজেক হবে তাদের ভালোবাসার নতুন অধ্যায়।

সিঙ্গাপুরের সকালটা আজ ঝকঝকে।
সাতটা বাজে, রাস্তাগুলো ফাঁকা ফাঁকা।
হালকা হাওয়া আর সূর্যের কোমল আলোয় হাঁটতে বেরিয়েছে মেহের আর জেরি।
তবে আজকের সকালটা মেহেরের ভেতরটা একেবারেই ভারী।
রিদের মুখটা কিছুতেই সরাতে পারছে না মাথা থেকে।
চোখ বন্ধ করলেই, সেই চাহনি, সেই গম্ভীর গলা তার কানে বাজে।
সে বিরক্ত।
নিজেকেই প্রশ্ন করছে বারবার,

এত ছেলেকে তো দেখেছি, কথা বলেছি… কারো বেলায় এমন কিছু হয়নি! রিদের বেলায় কেন?
পাশে হাঁটতে হাঁটতে জেরি হঠাৎ হেসে ফেলে।
মেহের দাঁড়িয়ে রেগে যায়, কোমরে হাত দিয়ে বলে,
— তুই শকচুন্নির মতো হাসছিস কেন? আমি মরছি আর তুই মজা নিচ্ছিস?
জেরি দুষ্টুমির হাসি নিয়ে বলে,
— I think… you are in love with him. Look like a perfect case of love at first said baby…
মেহের চোখ ঘুরিয়ে বলে,

— না রে, তেমন কিছু না। হয়তো ও খুব সুন্দর করে কথা বলে তাই… আর ওর মনও তো ভালো। হয়তো সেই কারণেই…
একটু থেমে হঠাৎই তার চোখ চিকচিক করে ওঠে।
— বিশেষ করে…যখন একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে ভালোবাসে কিন্তু সে মানুষ কাউকে ভালোবাসে বলে তাকে ছেড়ে চলে আসে তার ভালবাসাকে সম্মান করে। এটা তো অবশ্যই ভালো মনের মানুষের কাছে তাই না কজন পারে এমন করতে।
জেরি একটু চুপ করে, তারপর মাথা নাড়ে।
— হুম, কিন্তু দেখ, যতই না বলিস, বারবার তার কথাই বলছিস। এটাতে কি বোঝায়?
মেহের কাতর কণ্ঠে বলে,

— “জেরি…”
তারপর হেসে ফেলে।
— ধর, যদি সত্যিই ভালোবেসে ফেলিস? তখন কী করবি?
মেহের মুচকি হেসে বলে,
— তাহলে তো ওকে তোর brother-in-law বানিয়ে ফেলবো ওকে!
জেরি বলে,
ঠিক আছে, আমিও রাজি! ছেলেটাকে এখনো দেখিনি, কিন্তু তোর পছন্দের উপর আমার বিশ্বাস আছে যাকে তাকে তার পছন্দ হবে না।
মেহের হেসে ফেলে।
ওরা আবার হেঁটে যেতে থাকে। কথা বলতে বলতে দুজনই হাটছিলো হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা খায় মেহের।
— কোন কানা রে? — মেহের বলে।

সে মাথা তোলে, দেখতে পায় তার সামনে এক হাত বাড়ানো।
চোখ তুলে দেখে… রিদ।
— “আপনি!” — মেহের বিস্ময়ে বলে।
রিদ নরম গলায় বলে,
— আগে ওঠো।
মেহের উঠে দাঁড়ায়।
— আচ্ছা আপনার কি আমাকে দেখলেই ধাক্কা মারতে মন চায়?
রিদ হেসে বলে,
— আমি ইচ্ছে করে দিই না, তবু কেন জানি তোমার সাথেই বারবার এমন হয়।
মেহের মুখ টিপে হাসে।
— তাহলে ঠিক আছে, আর কারো সাথে ধাক্কা খাবেন না… শুধু আমার সাথেই খান।
রিদ একটু চমকে তাকায়, তারপর হেসে ফেলে।

— কী ধাক্কা!
ওদের কথার মাঝখানে তখনো হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা জেরি দিকে ইশারা করে মেহের বলে—
—Meet my best friend, Jarry.
রিদ হাত বাড়িয়ে বলে,
—Hi Jarry, I’m Rid.
জেরি হেসে বলে,
— Ohhh, I see… by the way, I’m Jerry..
সকালটা যেনো জাদুময়ভাবেই এগিয়ে চলেছে।
জেরি সাথে হালকা দুষ্টুমো আর রিদের হঠাৎ দেখা—মেহের বুঝে উঠতে পারছে না তার মনটা আসলে কোন দিকে দৌড়াচ্ছে।
এই সময় রিদ এক পাশে তাকিয়ে বলে,

— ও আমার কাজিন, তুষার।
তুষার হাসিমুখে এসে দাঁড়ায়।
মেহের আর জেরি হাত বাড়িয়ে পরিচিত হয়।
তুষার চোখ টিপে মজা করে বলে,
— যাক বাবা! আজ তাহলে ঝগড়া হবে না!
এই কথা শুনে সবাই হেসে ওঠে।
জেরি বলে,
— চলো সবাই কোথাও বসি না হয়।
সবাই মিলে হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় একটা খোলা মাঠে। ঘাসে বসে, চারপাশে সূর্যের আলো।
হাওয়ার দুলুনিতে মেহেরের ঝুটি বাঁধা চুল উড়ছে, সে পরেছে একটা নীল টিশার্ট আর হালকা রঙের প্যান্ট।
রিদ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।
মনের মধ্যে যেনো নীরব সুর বাজে—
এত সাধারণ পোশাকেও কেউ এত সুন্দর হতে পারে?নাকি আমার কাছেই এমন লাগছে।
আর মেহেরও অজান্তেই বারবার চোখ ফেলে রিদের দিকে।
দুজনে চোখাচোখি হয়,
দুজনে আবার তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নেয়।
হঠাৎ রিদ বলে,

— তোমার বোন তো অনেক সুন্দর গান গাইতে পারে। তুমি কি পারো গান গাইতে?
জেরি সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে,
— হ্যাঁ ব্রো! একদম ওয়াও! বাংলা গান তো ওর স্পেশালিটি।
মেহের লজ্জা পায়, কিন্তু সেই মুহূর্তে তার চোখ রিদের চোখে আটকে যায়।
রিদ তার দিকে তাকিয়েই বলে,
— একটা হোক না, প্লিজ।
মেহের প্রথমে না করে,
কিন্তু চারপাশ থেকে সবাই অনুরোধ করতে থাকে।
শেষে সে রাজি হয়।
সে ধীরে ধীরে একটা মিষ্টি বাংলা গান শুরু করে—
তার গলায় এক ধরনের কোমলতা, আর এক অজানা গভীরতা।

তুমি আসবে ওগো হাসবে
কবে হবে সে মিলন
কাছে যাব কবে পাব
ওগো তোমার নিমন্ত্রন
এই মেঘলা দিনে একলা
ঘরে থাকে না তো মন
কাছে যাব কবে পাব
ওগো তোমার নিমন্ত্রণ
রিদ তাকিয়ে থাকে তার দিকে, যেনো প্রতিটা শব্দ তার হৃদয়ের ভেতর ধাক্কা দিচ্ছে।
গান শেষ হলে চারপাশে মুহূর্তের নীরবতা। তারপর তুষার বলে ওঠে,
— আরে বাহ্! তোমার গালির মতোই গানটাও একদম ওয়াও!
মেহের লাজুক হেসে ফেলে।
রিদ তখন বলে,

— একদম সত্যি বলছি—অসাধারণ ছিলো।
তোমার মতোই সুন্দর, অবশ্য মেয়ে হবে জমজ বোন তো তুমি দুজনের অনেক মিল আছে শুধু চেহারায় নয় সবকিছুতেই মিল।
এই কথা শুনে মেহের কেন জানি একটু খারাপ লাগে কারন মেহেরের সবকিছুতে রিদ মেহু কে খুঁজছে বা মেমুর সাথে তুলনা করছে।
পাশে বসে থাকা জেরি মেহেরের কানে কানে বলে,

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৩৭

— তুই এই গানের মধ্যেই তো সব ফিলিংস বলে দিলি, বেবি! আমি বুঝে গেছি।
মেহের জেরির দিকে কটমট করে তাকায়—
— চুপ কর।
জেরি হেসে ফেলে।

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৩৯