মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৪
মির্জা সূচনা
দেখতে দেখতে কিছুদিন কেটে গেল। দিন যায় রাত আসে। সব কিছু ভালোই চলছে
তবে কবি সাহেবের কবিতা বলা কিন্তু বন্ধ হয়নি।
প্রতিদিন নিয়মমাফিক এসএমএস করে—
“আজ তোমার চুলের গন্ধটা বৃষ্টির মত ছিল নাকি, আরিওনা?”
“তোমার হাসি আজ দুপুরের রোদ, আর আমি ছায়া খুঁজি।”
এমন নানা প্রেমময় কথা বলে।
মেহরিন প্রথম প্রথম ভালো লাগলেও । এখন বিরক্ত কে এই কবি, না নাম বলে আর না নিজের পরিচয় দেয়।
এগুলো’ই ভাবছিলো মেহরিন, তখন
চুমকি বলল,
— “ওই ছেলেটা পাগল। তুইও আস্তে আস্তে পাগল হয়ে যাচ্ছিস দেখছি।”
মেহরিন হেসে ফেলল।
— “চুমকি, তুই জানিস না… ওই কবি সাহেবের পেটে পেটে সয়তানি, খচ্চর বেডা না নাম বলে আর না নিজের পরিচয় দেয় —চুমকি রে কবে যানি আমি সত্যিই পাগল হয়ে পাবনাই চলে যায়। শুন আমি পাবনা চলে গেলে আমাকে একটু দেখতে যাইস কেমন !”
দুজন অনেক হাসাহাসি করে কিছুক্ষণ।
ইউনিভার্সিটির প্রতিটা দিন এখন আর আগের মতো নেই।
ক্যাম্পাসে কোথাও হঠাৎ একটা কবিতা উঁকি দেয়।
সেদিন সন্ধ্যাবেলা মেহরিন জানালার পাশে বসে ছিল।
চায়ের কাপটা ঠান্ডা হয়ে গেছে, কিন্তু মাথাটা গরম।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— ” কে এই কবি সাহেব? ফোন দিলে, ধরছে না! অথচ প্রতিদিন কবিতা পাঠায়। ইনিয়ে বিনিয়ে কত কথা বলে—কিন্তু নিজের নামটাও জানায় না!”
চুমকির আব্বু আম্মু ওর দাদু বাড়ি গেছে ক্যাচ মেহরিন দের বাসায় থাকবে ..!
চুমকি এসে পাশে বসল,
— “তুই তো মনে মনে প্রেমে পড়ে গেছিস রে!”
মেহরিন চোখ রাঙাল,
— “নাটক করিস না। আমি শুধু জানতে চাই, কে ও!”
হঠাৎ, মেহরিনের ফোনে একটা নতুন এসএমএস এলো।
“একদিন যদি দেখা হয়, বলো… তুমি চিনে ফেলবে তো?”
মেহরিন এবার আর চুপ থাকতে পারল না।
— “Enough! আমি এই ছেলেকে খুঁজে বার করবই!”
চুমকি হাসল,
— “তাহলে তো detective Meherin নামতে চলেছে মিশনে—‘কবি সাহেবের খোঁজে’!”
চুমকি আবার বলে, জানিস আজ আমার প্ল্যান কি ?
মেহরিন দরজা খুলেই বলল,
— “তোর মাথায় আবার কি শয়তানি খিচুড়ি পাকাচ্ছি ?”
চুমকি চোখ টিপে বলল,
— “কবির খোঁজে তোকে নিয়ে একটা গোয়েন্দা মিশন কমপ্লিট করব !”
মাহবুবা তখনি ঘরে ঢুকে বলল,
— “তোরা আবার কি শুরু মেশিন কমপ্লিট করছি তাও আমাকে ছাড়া বলতো শুনি?”
চুমকি দুই হাত তুলে বলল,
— “তোর বোনের এই বিরহী মুখখানা দেখতে ভালো লাগছে, দেখ দেখ! দেখে মনে হচ্ছে কেউ মুখে করোলা পুরে দিয়েছে !”
মেহরিন ধুপ করে বালিশ ছুঁড়ে মারল চুমকির দিকে।
— “চুপ কর! আর একটা আজাইরা কথা বললে তোর খবর আছে!”
মাহবুবা বলল,
— “ঠিক আছে, তোমরা মারামারি বন্ধ করো আমার কথা শোনো । আমরা তিনজন একটা প্ল্যান করি। এই কবিকে খুঁজে বের করতেই হবে!”
প্ল্যান-১: কবিতাগুলোর ভাষা বিশ্লেষণ
মেহরিন বলল,
— “ওর কবিতায় এমন সব শব্দ থাকে যেগুলো ইংরেজি ক্লাসের রাফ খাতায় পাই। হয়ত একই ব্যাচে কেউ!”
চুমকি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
— “তাহলে তো খাতা চুরি করতে হবে!”
প্ল্যান-২: নাম্বার ট্র্যাকিং
মাহবুবা হেসে বলল,
— “আমার এক বান্ধবীর ভাই আছে যে টেলিকমে কাজ করে। আমি নাম্বারটা দিই, দেখি কিছু পাওয়া যায় কিনা!”
প্ল্যান-৩: হালকা দুষ্টুমি
চুমকি বলল,
— “মেহরিন, আজ রাতেই এসএমএস কর—‘আজ আমার ভাই নাম্বার চেক করতে বসেছে, তুমি যদি সত্যিই কবি হও, এবার নিজে থেকে দেখা করো।’”
মেহরিন হেসে কুঁকড়ে গেল—
— “তুই না একটা ড্যামেজ কেস!”
তিনজন হেসে কুটিকুটি।
কথা আর হাসির ভেতর দিয়ে রাত বাড়তে লাগলো,
আর ধীরে ধীরে অপারেশন ‘কবি সাহেব’ এগিয়ে চলল—
সাহিত্য, স্পাই স্টাইল আর মিষ্টি এক প্রেমের গন্ধ নিয়ে।ডিনার করা শেষ। তিনজনে বসে আছে হাতে কফির মগ।
অপেক্ষা করছে এই কবি সাহেব কে এটা জানতে । মাহবুবার হোয়াটসঅ্যাপে এসএমএস আসে ।
মেহবুবা উত্তেজনায় মোবাইল স্ক্রিনটা তাকিয়ে বলল,
— “পেয়ে গেছি! নামটা এসেছে!”
চুমকি তড়িঘড়ি বলে উঠল,
— “বল বল, নামটা কী?”
মেহবুবা ধীরে ধীরে পড়ে শোনাল,
— “নাম: নাসরিন বেগম”
তিনজন একসাথে চুপ!
মেহরিন বলল,
— “নাসরিন বেগম? এ আবার কে? আমি তো এমন কাউকে চিনি না!”
চুমকি হালকা হেসে বলল,
— “মনে হয় কবি সাহেব তার মা’র নামে সিম রেজিস্ট্রেশন করিয়েছিল। এখন কী করবি?”
মেহবুবা মুখে বুদ্ধির হাসি এনে বলল,
— “মানে আমাদের গোয়েন্দাগিরি এখানেই থেমে গেল!”
মেহরিন ধপ করে বালিশে মুখ গুঁজে ফেলল,
— “এত কাছে গিয়েও… কে ও, জানতেই পারলাম না।”
চুমকি বলল,
— “তবে যা বুঝলাম, ও খুব সাবধানে খেলছে। চায় না আমরা জানি, কে ও।”
মেহরিন একটু হেসে বলল,
— “তাহলে আমিও আর খুজবো না তাকে? দেখি, ও নিজে থেকে সামনে আসে কিনা!”
চুমকি আর মেহবুবা একে অপরের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি হাসে।
চুমকি ধীরে ধীরে বলে,
— “তোর ফোনটা দে তো, একটু দরকার।”
মেহরিন অবাক,
— “কেন?”
মেহবুবা তাড়াতাড়ি বলে,
— “বিশ্বাস কর, কিছু খারাপ করব না। একটু খোঁচা দেব শুধু!”
মেহরিন কিছু না বুঝেই ফোনটা দিয়ে দেয়।
চুমকি সঙ্গে সঙ্গে সেই নাম্বারে একটা এসএমএস লিখে ফেলে—
“তোমার কবিতা শুনে এখন মনে হয়, তুমিই বুঝি ইউনিভার্সিটির লুকানো কবি প্রেমিক সংঘের প্রেসিডেন্ট! এত লুকিয়ে প্রেম করো কেন? একদিন সাহস করে সামনে এসো না, দেখি আসল চেহারা!”
মেহবুবা ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে,
— “না না, শেষ লাইনে এটা দে— ‘আর হ্যাঁ, চশমা পরা থাকলে খুলে এসো, যেন চোখে চোখ পড়ে ঠিকঠাক।’”
চুমকি হাসতে হাসতে লেখে, সেন্ড বাটনে চাপ দেয়।
মেহরিন হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে,
— “তোরা কী করলি এটা?! আমার ফোন দিয়ে এসব কেন?”
চুমকি হেসে বলে,
— “তুই চুপ করে থাক, আমরা তোকে সাহস দিচ্ছি!”
মেহবুবা বলে,
— “এখন দেখি কবি সাহেব কতটা সাহসী, না ভয় পেয়ে ফের কবিতায় পালিয়ে যায়!”
তিনজনের মাঝে হাসির ঝড়—আর মেহরিন, লজ্জায় মুখ ঢেকে হাসে নিঃশব্দে।
রাত প্রায় ১১টা।
মেহরিন তখনও ফোনের দিকে তাকিয়ে, এক চোখে কৌতুহল, এক চোখে ভয়।
চুমকি আর মেহবুবা এখনো হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
ঠিক তখনই টিং করে মেসেজ আসে।
মেহরিন চুপ করে পড়ে—
চুমকি সাথে সাথে বলে,
— “দে দে দে, আমরা আগে পড়ব!”
মেহরিন না চাইতেই মেহবুবা ফোনটা কেড়ে নিয়ে পড়ে শোনায়—
“মনে হচ্ছে আজকের কবিতার বদলে সিনেমার স্ক্রিপ্ট পেয়েছি!
আর চশমা খুলে আসা? ভেবেছো না, যদি আমি চশমা পরে জন্মাই?
আরেকটা কথা… আজকের মেসেজে মেহরিনের ‘ম’ ছিল না, ছিল বেশি বেশি ‘মজা’।
তবে ধন্যবাদ, আজকের রাতটা আমারও হেসে হেসে কেটে যাবে।
— তোমাদের কবি সাহেব”
চুমকি চেঁচিয়ে উঠে,
— “এইটা একটা স্টাইল! দেখেছিস, কীভাবে ধরে ফেলেছে আমরা লিখেছি?”
মেহরিন লজ্জায় মুখ লুকিয়ে বলল,
— “এখন বুঝলি তো, কেন বলি, কবি সাহেব খুবই চালাক!”
মেহবুবা হেসে বলে,
— “চালাক তো বটেই… কিন্তু এই চালাকিকে আমরা খুব তাড়াতাড়ি ধরে ফেলব। ও বেশি দূর যেতে পারবে না।”
চুমকি এবার একটু গম্ভীর হয়ে গেল।
মেহরিন আর মেহবুবা কিছু না বুঝে তাকিয়ে আছে।
চুমকি বলল,
— “তোরা শুধু হাসাহাসি করিস কেন । আমি এখন সিরিয়াস এক্সপেরিমেন্টে যাচ্ছি। কবি সাহেব যদি সত্যিই ভালো মানুষ হন, তাহলে এই টেস্টে পাশ করবেন!”
মেহরিন ভয় পেয়ে বলে,
— “চুমকি প্লিজ, আমার না হওয়া প্রেম, লাইফকে ল্যাব এক্সপেরিমেন্ট বানাস না!”
চুমকি হেসে বলে,
— “শুধু দেখ, কিছুই হবে না!”
সে নিজের নাম্বার থেকে মেসেজ টাইপ করে—
“আপনার লেখাগুলো হৃদয় ছুঁয়ে যায়। আপনি নিশ্চয়ই অনেক গভীর মনোভাবের মানুষ। এমন একজনের সঙ্গে যদি এক কাপ চা খাওয়া যেত, তবে আমার দিনটা সোনালি হয়ে যেত।”
“আপনি কি কখনো ভেবেছেন, আপনার কবিতার পেছনে কে আছে সেটা জানার আগ্রহ আমারও আছে?”
মেহবুবা ঠোঁট চেপে ধরে,
— “এইটা তো একদম প্রেমের ফাঁদ!”
চুমকি চোখ টিপ মেরে বলে,
— “না রে, এটা টেস্ট। যদি উনি লোভে পড়ে কোনো ফ্লার্টি উত্তর দেন, তাহলে জানব—Not for our sweet Mahrin!”
মেহরিন কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
— “আর যদি না দেয়?”
চুমকি মুচকি হেসে বলে,
— “তাহলে সে একজন ভালোবাসার যোগ্য কবি।”
মিনিট পাঁচেক পরেই
কবি সাহেবের রিপ্লাই:
“চা খাওয়ার দাওয়াত পেয়ে কবির কলম কাঁপে,
কিন্তু মনে পড়ে—চায়ের কাপেও কখনো প্রেম ফেঁপে উঠে!
তবে ভয় পাই, আপনি আমার কবিতা নয়, আমার চরিত্রে আগ্রহী!”
“আর যদি সত্যি জানতেই চান—
আমি শুধু একজনের মায়ায় আটকে আছি।
আপনার সেই বান্ধবী…
আমার আরিওনা।”
মেসেজটা পড়তেই মেহরিনের মুখ হাঁ হয়ে যায়।
চুমকি চোখ গোল করে বলে,
— “এইটা কবে হলো? এখানে ও আরিওনা !”
মেহবুবা তো হেসে গড়াগড়ি—
— “ ‘মেহরিন’ তো এখন রোমান্টিক নাম পেয়ে গেছে—আরিওনা!”
মেহরিন কাঁপা কাঁপা গলায় ফিসফিস করে,
— “সে জানে আমি! মানে সে জানে এতদিন আমি-ই মেসেজ পেয়েছি, কবিতা শুনেছি!”
চুমকি বলে,
— “কবি সাহেব তো রাগ করে নাই, বরং এমন সুন্দর করে বুঝিয়ে দিল—সে তোরই কবি!”
মেহবুবা চট করে বলে,
— “এখন তুই যদি আমাদের কফি না খাওয়াস , আমি কবিকে নিয়ে চা খেতে চলে যাব!”
এই কথা শুনে সবাই উচ্চস্বরে হেসে ওঠে।
ওদের এমন হাসি মজা দুষ্টুমি খুনসুটিতেই রাতটা কেটে যায়। আজ সকাল থেকে রাহি মেহরিনকে একটার পর একটা কল করে যাচ্ছে।
প্রথমে না করতে চাইলেও, শেষমেশ রাহির মিষ্টি মিষ্টি আবদারে মেহরিন রাজি হয়ে যায়।
চুমকিকে বলল,
— “চল তো একটু দেখা করতে যাই, রাহি অনেক করে বলছে। কিছু একটা মনে হচ্ছে…”
চুমকি সঙ্গে সঙ্গে রাজি,
— “হাহ! আমি তো এমনিতেই বোর হতে হচ্ছিলাম, চল !”
ওরা দুজন একসাথে একটা ছোট্ট ক্যাফের সামনে পৌঁছায়।
রাহি ওদের জন্য টেবিল বুক করে রেখেছে।
রাহি হাসিমুখে দাঁড়িয়ে ছিল ওদের জন্য।
জড়িয়ে ধরল মেহরিনকে।তারপর ওরা টেবিলে নিয়ে বসে ।
চা আর হাসির গল্প শেষে রাহি একগাল হেসে বলে—
— “আচ্ছা, এবার আসল কথাটা বলি!”
চুমকি বলে ওঠে,
— “এইবার তো বল! এতো বিল্ড-আপ আর সহ্য হচ্ছে না!”
রাহি চোখে একটা নাটকীয় ভঙ্গি এনে বলে—
— “পরশু আমার জন্মদিন।
আর আমি চেয়েছি, আমার প্রিয় মানুষরা যেন থাকে।
তাই তোমাদের আমন্ত্রণ জানাতে এসেছি—স্পেশাল গেস্ট হিসেবে!”
চুমকি হাততালি দিয়ে বলে—
— “উফ! পার্টি! আমি তো রেডি!”
রাহি একটু চুপ করে মেহরিনের দিকে তাকায়,
— “তুমি আসবে না?”
মেহরিন মুচকি হেসে মাথা নাড়ে,
— “আসবো। তুমি তো আমার ছোট বোনের মতো, না গেলে চলবে নাকি?”
রাহি ঝাঁপিয়ে পড়ে, জড়িয়ে ধরে মেহরিনকে—
— “ আমার কুচুপু, আমার সুইটি, কিউটি আপুটা। তুমি এলে আমার জন্মদিন পারফেক্ট হয়ে যাবে!”
রাহি চলে যায় বাসার দিকে, আর চুমকি আর মেহরিন ঠিক করে একটু ফুচকা খেয়ে তবেই যাবে।
লেকপাড়ে বাতাসটাও তখন একটু বেশি নরম, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার ছায়া নেমে আসছে।
ফুচকার দোকানে ভিড় কম।
দুইজন হাসতে হাসতে ফুচকা খেতে শুরু করলো।
ঠিক তখনই, পাশের বেঞ্চে বসে থাকা তিন-চারজন ছেলে তাদের দিকে তাকিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কিছু ফিসফিস করতে থাকে।
একজন একটু জোরেই বলে ফেলে,
— “এই মেয়েটা না সেই… ওই যে কবিতা পোস্ট দেয় ফেসবুকে?”
আরেকজন ঠাট্টা করে বলে,
— “হ্যা, ওই মিষ্টি গলায় ‘দূরে থাকো, তবুও ছুঁয়ে যাও’ টাইপ মেয়েরা, রিয়েলে এরা কেমন হয় সেটা দেখি তো!”
চুমকি মুখ গোমড়া করে ফেলে।
মেহরিন ঠান্ডা হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।
সে সোজা তাদের সামনে গিয়ে বলে,
— “তোমরা আমাকে চেনো না, তবু মন্তব্য করছো।
এত সাহস যদি থাকেই, তাহলে পরিচয় দিয়ে বলো—
তোমাদের মায়ের, বোনের সামনে এই কথা বলতে পারো?”
এক মুহূর্তের জন্য ছেলেগুলোর হাসি থেমে যায়।
মেহরিনের চোখ জ্বলজ্বল করে, গলায় কাঁপন নেই, স্পষ্ট উচ্চারণে বলে—
— “একটা মেয়ের কণ্ঠ, পোশাক বা শব্দ নিয়ে তোমাদের এই সাহসই আসল সমস্যার নাম।
আমরা তো পালিয়ে যাই না… আমরা দাঁড়াই, চোখে চোখ রাখি।
যেমন আমি দাঁড়িয়েছি।”
চুপচাপ হয়ে যায় ছেলেগুলো।
একজন কেমন যেন অপ্রস্তুত হয়ে উঠে যায়।
চুমকি তখন ফিসফিস করে বলে,
— “তোর এই সাহসটাই আমার সবচেয়ে ভালো লাগে রে!”
মেহরিন একটু মুচকি হেসে বলে—
— “আমরা ফুল হতে পারি… কিন্তু কাঁটা ছাড়াও না!
মেহরিন চলে যাচ্ছিলো তখনি পেছন থেকে ছেলেগুলোর একজন আরেকটা বাজে কথা ছুড়ে দেয়, সরাসরি—
— “এই রকম আগুন মেয়ে হলে আমাদের কী দোষ …পুড়িয়ে দিতে তো পাড়ো তুমার রুপের আগুনে !”
চুমকি চিৎকার করতে যাবে এমন সময়,
মেহরিন ফুঁসে উঠে।
সে পিছনে তাকায়—ঠাণ্ডা, তীক্ষ্ণ।
— “তোর সাহস দেখানোর জায়গা ভুল করেছিস।”
একটা মুহূর্ত, নিঃশব্দ।
এরপর যা হয়, সেটা যেন কেউ কল্পনাও করেনি রীতিমতো এক ঝড়।
মেহরিন ছেলেগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়,
একটাকে সরাসরি চড় মারলো এমনভাবে—
সবাই থ!
এরপর দ্বিতীয় ছেলেটার কলারে ধরে টান মেরে বলে—
— “নারী দেখে সাহস দেখাস? এতদিন তোদের মতো জানোয়ারের জন্য মেয়েরা চুপ করে ছিল… আজ আমি চুপ করব না!”
তৃতীয় ছেলেটা কিছু বলতে যাবে, মেহরিন তাকে ধাক্কা দিয়ে বলে—
— “পিছন থেকে চিৎকার করতে পারিস, সামনে এসে কথা বল!”
চুমকি পেছন থেকে বলে—
— “তুই একাই সামলে ফেললি রে!”
পাসের দোকানদার আর কয়েকজন মানুষ এগিয়ে আসে,
ছেলেগুলো এখন পুরো গুটিয়ে গেছে।
একটা বলে—
— “আন্টি, ভুল হইছে, প্লিজ…”
মেহরিন বলে—
— “ভুলের মাফ মেলে, নিচু মানসিকতার না!”
চুমকি মেহরিনের হাত ধরে বলে—
— “চল, এইবার বাসায় ফিরে যাই—তুই তো আগুন!”
মেহরিন ধীরে হেঁটে যেতে যেতে ভাবে—
“আমি শুধু মেয়ে না, আমি একজন মানুষ।
আর মানুষ নিজের সম্মান নিজেই বাঁচায়, কবিতা লিখে নয়—প্রয়োজনে ঘুষি মেরেও।”
রাত সাড়ে এগারো টা ।
মেহরিন আর চুমকি বাড়ি ফিরেছে সেই সন্ধ্যায়।
রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ, সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছে।
টিভিতে তখন হঠাৎ করেই এক জোরালো শব্দ—
“ব্রেকিং নিউজ!”
সবাই তাকিয়ে থাকে।
“আজ রাত ৯টার দিকে শহরের লেক থেকে চার কিশোরের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সন্ধ্যার সময় ওই ছেলেগুলো লেকপাড়ে ঘোরাফেরা করছিল।
সকলের দেহ পানির ভেতরে অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায়—পরে জানা যায়, তারা কেউই বেঁচে নেই। নিহতদের পরিচয় এখনো জানা যায়নি, তবে প্রাথমিক তদন্তে সন্দেহ করা হচ্ছে—এটি একটি পরিকল্পিত হত্যা।
লাশগুলো উদ্ধার করা হয় লেকের একদম উত্তর প্রান্ত থেকে, যেখানে আজ বিকেলে বেশ কিছু মানুষ ভিড় করেছিল।”
স্ক্রিনে ভেসে ওঠে—
পুলিশের গাড়ি, জেলেদের ভয়ে তাকানো মুখ, আর কাদামাখা চারটি কালো বডি ব্যাগ।
মেহরিনের বাবা চুপচাপ তাকিয়ে থাকে টিভির দিকে।
মেহবুবা ফিসফিস করে বলে—
— “এটা তো ওই লেক… তুই আর চুমকি আজ যেখান থেকে আসলি, না?”
মেহরিন কোন উত্তর দেয় না।
তার চোখে কোনো শব্দ নেই, কেবল একটা অদ্ভুত চাহনি।
চুমকি তখন হঠাৎ করে বলে—
মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৩
— “ওরা… ওরা তো ওই ছেলেগুলো না?”
মেহরিন আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে—
না নিশ্চিত ভাবে, না অস্বীকার করে।
বাড়িতে তখন টান টান একটা নীরবতা।
আর মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন—
এই খুনের পেছনে কি কেউ আছে, যাকে তারা ভুল করে স্পর্শ করে ফেলেছিল?
না কি এটা কেবল এক কাকতালীয় নির্মমতা?
থেকে এই খুনি ….