মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৪২
মির্জা সূচনা
মেহের আর রিদ বাংলাদেশে পৌঁছেছে। তবে গোটা পথে—একটাও কথা হয়নি তাদের মধ্যে।
রিদ ভেবেছে, হয়তো অভিমানেই কথা বলছে না মেহের।
সে চেষ্টা করেছে, খুব চেষ্টা—কিন্তু মেহের কিছুই বলেনি।
কিন্তু মেহের কি সত্যিই অভিমান করেছে?
না… তার অভিমান না, তার লজ্জা।এত কাণ্ড ঘটানোর পর কিভাবে কথা বলবে সে।
এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে রিদ বলে, — চলো, তোমায় মির্জা বাড়ি পৌঁছে দিই।
মেহের মাথা নাড়ে, না, আমি ক্যাব বুক করেছি।
রিদ আর কিছু বলে না, কিন্তু মেহের কে একাও ছাড়ে না চুপিচুপি তার পেছন পেছন চলে—গেট পর্যন্ত। মেহের যখন বাড়ির গেটে ঢুকে যায়, তখন রিদ চলে যায় রাকিবের বাড়ি।
নিজের বাড়ি সে যায়নি।
হয়তো যাবেও না।
সেই বাড়ি, আর বাবা—এই দুজনের প্রতিই এখন গা-জ্বালা রাগ আর ঘৃণা জমে আছে তার মনে।
অন্যদিকে, মেহের কারো কাউকেই জানায়নি যে সে আজ আসবে। রাত তখন তিনটা।
সবার ঘুম গভীর।
মেহের ফোনে করে মাহিরকে :
— দরজা খোল।
মাহির প্রথমে বিশ্বাসই করতে চায় না।
— তুই আজ আসবি? বললি না তো?
জবাবে জোরে ধমক খায়,
— তুই দরজা খুলবি, না আমি দরজা ভেঙে ঢুকব?
দরজা খোলার পর মাহির অবাক হয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরে,
—তুই বললে না কেন? আমি নিতে যেতাম তো
মেহের হাসে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
—বলে দিলে সারপ্রাইজ থাকত না, রে পাগলা।
মাহির হাসে,
— দাঁড়া আমি সবাইকে ডেকে আনছি তোকে দেখে সবাই একদম খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাবে…
— আবোলতাবোল বকিস না! কারো ঘুম ভাঙাবি না। যা, তুই শুয়ে পড়।
— আমি আজ মেহরিনের ঘরেই থাকি, ওর ঘর তো খালি, না?
মাহির মাথা নাড়ে।
তারপর চুপচাপ মেহেরের লাগেজটা নিয়ে চলে যায় মেহরিনের ঘরে।
অনেক দিন পর নিজের দেশে নিজের বাড়ি ফিরেছে মেহের। মনটা ভারি আনন্দে ভরে ওঠে।
এখন কাউকে বিরক্ত করতে চায় না সে।
সকালে সবাইকে চমকে দেবে সে।
মাহি চলে যেতেই ফ্রেশ হয়ে আসে মেহের, আর তারপর চুপচাপ শুয়ে পড়ে।
চোখ বন্ধ করতেই মনে পড়ে যায় ফ্লাইটের পুরো যাত্রাটা।
হাসে সে।
নিজের বুকের গভীরে লুকানো আবেগগুলো স্পর্শ করে যায় সে একে একে।আর মনে হয় নিজের বোকামি গুলো।
রিদ…
তাকে নিয়েই ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে—ঠিক টেরও পায় না।
ওদিকে রিদ বসে আছে রাকিবের সাথে।
রাকিব বলে, — তুই অন্তত আমাদের তো বলতে পারতিস! হুট করে দেশ ছেড়ে চলে গেলি?
রিদ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, — ভাগ্যিস গিয়েছিলাম। না গেলে হয়তো একাকীত্বের জোয়ারে ডুবে মরতাম।
রাকিব একটু বিরক্ত হয়ে বলে, — মানে?
রিদ হালকা হেসে বলে, — আল্লাহ উত্তম পরিকল্পনাকারী, দোস্ত।
রাকিব মুখ কুঁচকে বলে, —ঝেরে কাশ তো বাপ, আবার কোন আকাম করেছিস?
রিদ বলে, — আমার জীবনে আবার বসন্ত এসেছে।
রাকিব মাথায় হাত দিয়ে বলে, — আবার কার প্রেমিকার প্রেমে পরলি মামা?
রিদ গম্ভীর গলায় বলে, — “নীলয়োনা।”
রাকিব নাটকে ভঙ্গিতে বলে— “ওহহহ! নীলয়োনা…….. নামটা একটু টেনে টেনে বলে।
রিদ ঘুমিয়ে পড়ার ভান করে কম্বল গায়ে দেয়।
রাকিব অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে।
তার মাথায় এখন হাজারটা প্রশ্ন ঘুরছে—
এই কিছুদিন আগেই তো বিয়ের আসর থেকে ভেগে গেল! এখন আবার কোন মেয়ের প্রেমে পরলো কে জানে!
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
— এই ভাই বোন দুটো আমাকে একেবারে পাগল বানিয়ে ছাড়বে।
বোন আমার কলিজায় উঠে নিত্য করে। আর ভাই—ও তো টেনশনের পাহাড় বানিয়ে দিয়েছে আমার মাথার উপরে।
দুই ভাইবোন মিলে একদিন আমায় যোমের দুয়ারে ঠেলে দেবে।
আল্লাহ… তুমার কাছে বিচার দিলাম।
আমার মতো এই নিরীহ, নিষ্পাপ বাচ্চাটার উপর এই ধরনের অত্যাচারের বিচার তুমিই কইরো।
তারপর একটু থেমে আবার বলে, — না না, কিছু কইরো না, আল্লাহ… শুধু দুইজনরে একটু বোঝার তৌফিক আমাকে দান করো।
ভোর পাঁচটা।
মেহরিন গোসল সেরে এসে, নামাজ পড়ে। তারপর বসে থাকে জায়নামাজে, চোখে অদ্ভুত এক চিন্তার ঘূর্ণি।
মন যেনো কিছুতেই স্থির হচ্ছে না। একটা কথা, একটা মুখ বারবার মাথার ভিতরে ফিরে ফিরে আসছে।
রাজ তখনই গোসল সেরে আসে। মেহরিনকে জায়নামাজে বসে থাকতে দেখে পাশে গিয়ে চুপচাপ তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।
মেহরিন রাজের ভেজা চুলগুলো মুছে দিতে দিতে বলে,
—ভালোভাবে চুল মুছতে কী কষ্ট হয় আপনার? যখন ঠান্ডা লাগলে তখন টের পাবেন।
রাজ মেহরিনের দুই হাত ধরে চুমু খেয়ে বলে
— লাগবে না… কারণ আমার তো একজন স্ত্রী আছে, সে আছেন যত্ন নেওয়ার জন্য।
মেহরিন মুখটা গম্ভীর করে বলে,
— হুম্… আপনি তো সর্বজনতা। সব জানেন, সব বোঝেন।
রাজ হেসে ফেলে।
মেহরিন আবার মুখ ভার করে বলে,
— চলুন, ফিরেই যাই।
রাজ চোখ কুঁচকে বলে,
— মাত্র তিনদিন হল এসেছি, আর তুমি এখনই যেতে চাও?
মেহরিন বলে,
— ভালো লাগছে না। বাড়ি ফিরে অনেক কাজ আছে।
রাজ একটু গম্ভীর হয়ে বসে বলে,
— কি কাজ?
মেহরিন সোজা সাপটা বলে,
— আপনার বোনকে খুঁজে বের করতে হবে। আমার মন বলছে ও বেঁচে আছে।
রাজ বলে,
—আমারও বিশ্বাস ও বেঁচে আছে। বাংলাদেশে আসার পর থেকেই খুঁজছি, কিন্তু কোনো খবর নেই। এমনকি ড্রাইভার আঙ্কেল উনিও জানেন না, তিনি শুধু বলেছিলেন ওদের তুলে দিয়েছেন, আর কিছু জানেন না।
মেহরিন হঠাৎ জিজ্ঞেস করে,
— আপনার বোনের শরীরে কি এমন কিছু আছে, যেটা দেখলে আপনি চিনতে পারবেন?
রাজ বলে,
—হ্যাঁ। ওর ঘাড়ে একটা বড় তিল আছে। আমারও আছে ঠিক সেই জায়গায়।
মেহরিন বলে,
— দেখি তো।
রাজ তার ঘাড় দেখায়। মেহরিন একটু কিছু ভেবে বলে,
—ওদের এখন মুখোমুখি হতে হবে কবি সাহেব। অনেক হয়েছে লুকোচুরি।
রাজ মেহরিনের হাত ধরে বলে,
— তুমি আমার পাশে থাকবে তো, বউ?
মেহরিন হেসে বলে,
— আমি থাকবো, ইনশাআল্লাহ। আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমি থাকবো আমার কবি সাহেবের পাশে।
রাজ বলে,
— তোমার কেনো মনে হল ও বেঁচে আছে?
মেহরিন গলা নিচু করে বলে,
— আপনার বাবা তো আপনাদের দুই ভাইবোনের নামে সব লিখে দিয়েছিলেন। সবাই জানে আপনি মারা গেছেন। তাই যদি আপনার বোন বেঁচে না থাকে, সব সরকার নিয়ে নিতো। কিন্তু তা হয়নি। তার মানে আপনার বোন এখনো জীবিত। তাকে কাজে লাগাচ্ছে রেদওয়ান তালুকদার।
রাজ মুচকি হেসে বলে,
—বাহ আমার বউতো একদম গোয়েন্দা হয়ে গেছে।তবে হ্যাঁ তুমি ঠিক বলেছো।আমার বোন বেঁচে আছে, এমনকি আমার মনে হয় তুমিও তাকে চিনো।
মেহরিন হঠাৎ বলে,
—আচ্ছা, সাবিহা আন্টির মেয়েটা তো অসুস্থ ছিলো। সে কি ভালো হয়ে গেছিলো নাকি?
রাজ মেহরিনের চোখে চোখ রেখে হাসে। তার হাসির ভেতরেই যেনো প্রশ্নের উত্তর ছিল।
মেহরিন চিৎকার করে বলে ওঠে,
— Ohh shittt! তার পর রাজের দিকে তাকিয়ে বলে,আমি যা ভেবছি! আপনি কি সেটা মিন করছেন কবি সাহেব?
রাজ চুপ করে মাথা নাড়ে।
মেহরিন মুখে হাত দিয়ে অস্হির গলায় বলে,
— তাহলে বললেন না কেন?
রাজ গম্ভীর গলায় বলে,
— বলব। সময় হলে বলব।
—কোন সময়?! রেদওয়ান তালুকদারের মত নিকৃষ্ট একটা মানুষের কাছে ও নিরাপদ না! আপনি জানেন না, স্বার্থে টান পরলে সে ক্ষতি করতেও পিছ পা হবে না!
রাজ মেহরিনকে জড়িয়ে ধরে বলে,
— স্বার্থের জন্যেই ওকে কষ্ট দেবে না। আর এখনই যদি সব বলে দিই, ও সামলাতে পারবে না নিজেকে। ভেঙে পড়বে। তাই কিছু দিন যাক।
মেহরিন ধীরে মাথা নাড়ে। তারপর রাজের দিকে তাকিয়ে বলে,
—আপনার কি মনে হয় না, একবার তাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করবে? তার মুখে ভাই ডাক শুনতে ইচ্ছে করে না?
রাজের চোখ ছলছল করে উঠে।
মেহরিন তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
—I am sorry কবি সাহেব। আমি বুঝতে পারিনি আমার এ কথায় আপনি এতটা কষ্ট পাবেন। i am sorry..
রাজ থেমে থেমে কাঁপা গলায় বলে,
—আমার খুব ইচ্ছে করে… খুব ইচ্ছে করে… আমার পুঁচকিটাকে বুকে জড়িয়ে ধরি বলি তোর ভাই… ইচ্ছে করে ওর মুখে ‘ভাইয়া’ ডাক শুনি। যেদিন জানলাম ও আমার পুঁচকি, আমি আর লাবীব গিয়ে সব বলতে চেয়েছিলাম, ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমরা সেদিন গিয়ে দেখি… আমাদের পুচঁকি রিদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে… হাসছে… গল্প করছে। সেদিন আমার মনে হচ্ছিল রিদই যেনো পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান মানুষ যে বাবা মা ভাই -বোন পরিবার সব পেয়েছে আর আমি সবচেয়ে বেশি হতভাগা যে না পেলাম পরিবার না পেলাম বাবা-মা আর না পেলাম বোনের ভালোবাসা।আমি… আমি কিছুই বলতে পারিনি সেদিন। আমি বলতে পারিনি ‘রিদ না… আমি তোর ভাই আমি..আমি।’ আমি বলতে পারিনি ‘তুই আমার পুঁচকি, আমার কলিজার টুকরো।’
বলতে পারিনি… যাকে তুই বাবা বলে ডাকিস সে তোর বাবা নয়,সে তোর বাবা মার খুনি। আমি কিছু বলতে পারিনি,কারণ আমি জানি—সব বললে ওর জীবনটা শেষ হয়ে যেতো,সবার উপর থেকে বিশ্বাস উঠে যেত, ভেঙে পড়তো মানসিক ভাবে। তাই বলিনি… Moonbeam… আমি পারিনি…এত বছর পর আমার বোনটাকে পেয়ে আবার ওর কোন ক্ষতি করতে আমি পারিনি।
মেহরিন রাজকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, কাঁদতে কাঁদতে বলে,
—চুপ করুন… সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি তো। আমি সব ঠিক করে দেবো। আল্লাহ আমাদের পাশে আছেন। সব ঠিক হয়ে যাবে।
রাজ মেহরিনকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, বলে,
—জানো Moonbeam… আমি আর লাবিব রোজ যেতাম ওর স্কুল, কলেজের সামনে।
লাবিব মাঝেমধ্যে বলত, ‘Bro, আমি ওর সঙ্গে একটু কথা বলি? Bro আমার কলিজা ফেটে যাচ্ছে।
দেখছি, কিন্তু কাছে যেতে পারি না, কথা বলতে পারি না…
Moonbeam, ও তো আমার ছোটো… সেদিন কাঁদছিলো লাবিব। আমি পারিনি…কারন আমি কাঁদলেও আরো ভেঙে পড়তো।
রাজ মেহরিনকে বুকের বাঁ পাশে হাত দিয়ে বলে,
— জানো.. Moonbeam…তখন এখানে ঠিক এখানটাই মনে হচ্ছে কেউ যেনো ছুরি দিয়ে বারবার আঘাত করছে… মনে হচ্ছে আমার কলিজাটা কেউ টেনে বের করে নিচ্ছে… তাও আমি কিছু করতে পারছি না।
মেহরিন রাজকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলে,
— সব ঠিক হয়ে যাবে… সব। আপনি শান্ত হন…
রাজ গভীর ঘুমে। যেনো কত শত কষ্টের ভারে বিধ্বস্ত এক মানুষ অবশেষে একটু প্রশান্তির শ্বাস নিচ্ছে। মেহরিন অনেক কষ্টে রাজকে শান্ত করে ঘুম পাড়িয়েছে। এখন চুপচাপ তার পাশে বসে আছে, নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে রাজের মুখের দিকে।
তার ঠোঁট ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,
— একটা মানুষরে জীবনে আর কত দুঃখ তুমি দেবে আল্লাহ?এবার একটু শান্তি দাও… তুমি তো উত্তম পরিকল্পনাকারী… যা করো, মঙ্গলের জন্যই করো… আমার মাওলা… শুধু ওর জীবনে একটু শান্তি দাও… বাবা-মা, সব কিছু হারিয়েছে… শেষ সম্বল বোনটাকে ফিরিয়ে দাও…মাবুদ।
একটা কোমল চুমু রাজের কপালে এঁকে দেয় মেহরিন। এরপর ফোনটা হাতে নিয়ে চলে যায় ব্যালকনিতে। ঘড়িতে ঠিক সাতটা। সে কল করে রাহিকে।
বিরক্তিতে রাহি ফোন তোলে,
— এই সাতসকালে কার জামাই মরলো যে আমাকে জানানো লাগবে! মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে মনে হয় আমাকে কল না দিলে বাল…”
মোবাইল স্ক্রিনে ‘Mehu Apu’ নামটা দেখেই চোখে মুখে এক আনন্দের ঝলক খেলে গেল। মুখে হাসি ফুটে ওঠে। কিন্তু পরক্ষণেই, বিয়ের সেই দিনের কথাগুলো মনে পড়তেই হাসিটা মিলিয়ে যায়।
ফোন রিসিভ করে বলে,
— এতদিন পর মনে পড়লো আমাকে? নাকি ভাইয়ার রাগে আমাকেও ভুলে গেছিলে?”
মেহরিন হেসে উঠে,
— না রে পাগলি… তোর ভাইয়ার সাথে আমার সম্পর্কের কথা হবার আগেই তুই আমার বোন… তাই ওসব বাদ দে… কেমন আছিস?
—আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তবে তুই আমার ঘুমের পিন্ডি চটকে দিলে মেহু আপু!
—তাই নাকি ভারী অন্যায় হয়ে গেছে তো আমার? মেহরিন হেসে বলে।
— এই এখন কোথায়? শ্বশুরবাড়ি না বাবার বাড়ি?
মেহরিন একবার রাজের দিকে ফিরে তাকায়। তারপর উত্তর দেয়,
— সাজেকে এসেছি ঘুরতে…
— ওহহহ হো হানিমুন……..
— তুই একদম পেকে গেছিস দেখছি!
রাহি হেসে উঠে, তারপর গম্ভীর হয়ে বলে,
—ও ভাইয়া তো একদম মাফিয়া টাইপ তাই না? যেভাবে সবাইকে বন্দুক ঠেকালো বাবা গো…!
মেহরিনের মুখের হাসি মিলিয়ে যায়।
— ও এমন করেছে কারণ…তা না হলে আমি রাজি হতাম না। সে আমায় অনেক ভালোবাসে রে। অনেক…
রাহি একটু নরম গলায় বলে,
— বাবহ! কী প্রেম… তবে আমি খুশি, জানিস? তুই তোর ভালোবাসার মানুষকে পেয়েছিস। আর ওই ভাইয়াকে দেখে কেন জানি মনে হয়, দাদাভাইয়ের থেকেও বেশি তোকে ভালোবাসবে…
মেহরিন এবার চোখ নামিয়ে হেসে ফেলে,
— হ্যাঁ। তবে তোর ভাইকে ধন্যবাদ…উনি সত্যি প্রকৃত বন্ধু…
—মানে?
— ও তুই বুঝবি না। আজ বাড়ি ফিরব। কাল আমার শ্বশুরবাড়ি আসবি। আমি তোকে লোকেশন পাঠিয়ে দেব।
— আচ্ছা, কিন্তু তোর সেই ‘মাফিয়া বর’ আবার আমাকে মেরে গুম করে দেবে না তো?” রাহি হাসতে হাসতে বলে।
মেহরিন নিচু গলায়, গম্ভীরভাবে বলে,
— তুই জানিস না… তোকে যে সে কতটা ভালোবাসে… ও হাসতে হাসতে নিজের জীবনও দিতে পারে তোর জন্য।তোর গায়ে আঁচর ও লাগতে দেবে না…
— কি বললি শুনি? ঠিক শুনিনি তো!
— কিছু না… তোকে যা বললাম মনে রাখিস…
— জো হুকুম মহা রানি!
ফোনটা কেটে মেহরিন নিজের মনে বলে ওঠে,
—তোদের ভাই বোনকে আমি মিলিয়ে দেবই। আর যারা অন্যায় করেছে… সেই জালিমদের উপযুক্ত শিক্ষা ও দিবো। এবার সেই খেলোয়াড়দের সময় শেষ… রেদওয়ান তালুকদার আর সায়েম রহমান, প্রস্তুত হন… আপনাদের পাপের গড়া পূর্ণ হয়েছে… এবার ‘পতনের পালা’ শুরু…”
এক এক করে প্রত্যেকটা কষ্ট দুঃখ যন্ত্রণার প্রতিশোধ নেবো।সবকিছুর জবাব দিতে হবে।আপনাদের জীবনকে আমি মেহরিন শিকদার জাহান্নাম বানিয়ে দেবো। এটা আমার প্রতিজ্ঞা।
সকাল ৯টা।
মালিহা মির্জা রান্নাঘরে নাস্তা বানাচ্ছেন, মেহবুবা পাশে দাঁড়িয়ে হেল্প করছে। এদিকে মাহির ঘুম ভেঙে হেলতে দুলতে আসে।
— মা, চা দাও তো।
মালিহা মির্জা এক কাপ চা এগিয়ে দিতে দিতে বললেন,
—সারারাত জেগে গেম না খেলে বই নিয়ে একটু মন দে। এক মাস পরেই এসএসসি এক্সাম, ভুলে গেছিস?
মাহির বিরক্ত মুখে,
—মা, সকালে সকালেই এইসব অশুভ নাম নিও না তো।
মেহবুবা হেসে বলে উঠল,
— ঠিকই বলছিস। এই এক্সামটাই মানুষের জীবনে সবচেয়ে অশুভ জিনিস। মরার উপর খাঁড়ার ঘা। একটা শেষ হতে না হতেই আরেকটা হাজির! উফফ! এই এক্সামটা যে আবিষ্কার করছে, ওরে পাইলে উল্টায় পিটায় আফ্রিকায় পাঠাই দিতাম… না হয় হিরো আলমের গান শোনাইতাম!
মাহির চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,
—হ্যাঁ বোন, যা বলেছিস! তুই আমার মনের দুঃখটা বুঝলি।
মেহবুবা গম্ভীর মুখে,
— হ্যাঁ, বুঝবো না? আমারও তো একই পেরা!
মালিহা মির্জা মাথায় হাত দিয়ে অসহায়ের মতো বললেন,
— কি সব পোলাপাইন দিছো আল্লাহ! এরা পড়াশোনা নিয়া কত কিছু কই… কপাল ভালো যে ওনারা বাঁচে নেয়, না হলে তোদের কথা শুনেই মইরা যাইতো!
মাহির আর মেহবুবা হেসে ফেলে।
মাহির হঠাৎ বলে,
— মেজু আপু কই? এখনও ওঠে নাই?
এই কথা শুনে মালিহা মির্জা আর মেহবুবা একসাথে বলে উঠল,
— “কীইই?!”
চায়ের কাপ মুখে দিতে যাওয়া মাহির তো বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল। কাপটা পড়ে যায়, ভয়ে বলে,
— তোমরা এমন সিরিয়াল মতো চিৎকার করে ভয় দেখিও না! কিছু বললেই এমন চিৎকার করো যেন আমাদের বাসায় জি-বাংলা চলতেছে!
— ছোট প্যাকেট যা… গিয়া বড়ো প্যাকেটের ঘরে দেইখ্যা আয়। মেজু প্যাকেট ঘুমাইতেছে।
মেহেবুবা বলে,যদি এ কথার মিথ্যা হয় তোকে যে কি করবো রে।
মাহির হেসে বলে,
— যদি সত্যি হয়, তবে তুই আমার সব অ্যাসাইনমেন্ট করে দিবি!
মেহবুবা বলে,
— ডিল!
মেহবুবা ছুটে গেল মেহরিনের রুমে।
এদিকে মালিহা মির্জা বারবার মাহির কাছে জিজ্ঞেস করছেন,
— সত্যি বলছিস তো? ঢপ মারতেছিস না? মিথ্যা হলে তোর পিঠের ছাল তুলব! সবসময় বেয়াদপি বের করবো।
মাহির মুচকি হেসে বলে,
— মা, সব মায়েরা চায় সন্তান ভালো থাকুক, সুস্থ থাকুক। আর তুমি শুধু চাও আমার পিঠের ছাল ওঠাতে! মা, এইটা ঠিক না। তুমি একবার ভাবো তো করো তো পিঠ ছাল না থাকলে আমি জামা কাপড় পরবো কিভাবে?
মালিহা মির্জা রান্নার খুন্তি হাতে এগিয়ে এলে মাহির ছুটে পালায়! দৌড়ে রুমে গিয়ে দরজা আটকে ফেলে।
মালিহা মির্জা রেগে দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলেন,
— খুল হারামজাদা! দরজা খুল! আজ তোর একদিন কি আমার একদিন।
মাহির ভেতর থেকে বলে,
— আমাকে তো পাগলা কুকুরে কামড়ায়ছে, আমি দরজা খুললে তুমি ওই খুন্তি দিয়ে আমাকে মেরে আমার পিঠের ছাল তুলে খাল করে ফেলো তাই না।
মালিহা মির্জা হেসে বলেন,
— মারের এত ভয়? তবে এত বাদরামি করিস ক্যান?
মাহির হেসে ফেলে।
এদিকে মেহবুবা গিয়ে দেখে সত্যি সত্যি মেহরিন রুমে কেউ ঘুমিয়ে আছে!
ভেতরে গিয়ে একটা চিৎকারে বলে ওঠে,
— মেজু আপু!!!
বলেই লাফ দিয়ে খাটে উঠে পড়ে…
মেহের ঘুম ভেঙে উঠে বসে বলে,
—এমন চিৎকার করছিস কেন বইন! আমার কানের মাথা না খেয়ে! নাস্তা কর গিয়া।
মেহবুবা জড়িয়ে ধরে, মেহের ও হাসতে হাসতে জড়িয়ে ধরে।
— তুই আসবি বললি না কেন?
— সারপ্রাইজ দিতে!
— আমার কী যে খুশি লাগছে বলার মতো না! কতদিন পর আমরা সবাই একসাথে!
মেহের মেহবুবাকে একটা ছোট্ট চুমু খেয়ে বলে,
— হ্যাঁ রে, আমাদের বড়ো ম্যাডাম তো বিয়ে করে নিলো!
মেহবুবা হাসতে হাসতে বলে,
—তা আর বলতে,তুই যদি দেখতি কী ঐতিহাসিক বিয়ে! বাবা গো!
মেহের হেসে বলে,
—আচ্ছা, পরে শুনবো! বাবা তো অফিস চলে গেছে, চল মা’র সাথে দেখা করি!
মেহের ফ্রেশ হয়ে নিচে নামে।
মালিহা মির্জা মেহেরকে দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে!
মেহের মাকে ধরে, গভীর এক শ্বাস নিয়ে বলে,
— উফফ, কতদিন পর এই মা-মা গন্ধটা পেলাম!
মালিহা মির্জা বলে,
— তুই আসবি বললি না কেন?
— সারপ্রাইজ দিতে! দেখো না কেমন করে চমকে দিলাম!
ঠিক তখনই মাহির বের হয়ে এসে বলে,
— মেজু আপু, তোর মা তো বিশ্বাসই করে নাই তুই আসছিস! আমি বলছি, আর মা আমার পিঠের ছাল তুলতে চাইছে!
মেহের হেসে ফেলে।
মেহবুবা বলে,
— দাড়া, মেহুকে কল দেই, দেখি ম্যাডাম এখন কী করছে!
মালিহা মির্জা বলে,
— থাক, এখন দিস না, পরে দিস।মেহবুবা বলে আচ্ছা।
চারজন একসাথে বসে নাস্তা করছে আর গল্প করছে।
হঠাৎ লাবিবের কল আসে মেহবুবার ফোনে।
মাহির দেখে বলে,
—এই লাবিব ভাইয়ের আর কি কোনো কাজ নাই! সারাক্ষণ তোর লগে ঝগড়া করা ছাড়া!
মেহবুবা বলে,
— আমারও তাই মনে হয়!
মালিহা মির্জা বলে,
— ওভাবে বলিস না! ছেলে টা কত ভালো!
মাহির বলে,
হ্যাঁ, ভালার ছালা।এটা বলে উঠে যায়।
মেহর বলে,
— কেসটা কি বলতো? লাবিব তো ভাইয়ার কাজিন তাই না?
মাহির বলে,
— হ্যাঁ।
মালিহা মির্জা বলে,
— লাবিবের মা মেহবুবাকে লাবিবের জন্য চাইছেন। ছেলে ভালো, আমাদের আপত্তি নেই। লাবিবও পছন্দ করে মেহবুবাকে। মেহুর তো হয়েই গেছে তোর বিয়ে হয়ে গেলে ওদেরটার কথাও আগাবে।
মেহর হঠাৎ হেসে ফেলে, মুখ ঘুরিয়ে বলে,
—ছেলে পছন্দ করে ফেলেছি, বিয়ে করবো, কিন্তু আমার বিয়েতে তোমাদের দাওয়াত দিবো না!
মাহির বলে,
— আমাকে একটু দিস প্লিজ!
মেহর হেসে বলে,
— সঠিক বলতে পারলাম না!
মালিহা মির্জা হেসে বলে,
— কেন? আমরা কি অন্যায় করছি যে তোর বিয়েতে দাওয়াত দিবি না?
মেহর মুখ গম্ভীর করে বলে,
— কারণ, তোমরা তো তোমাদের বিয়েতে আমাকে দাওয়াত দাওনি!
তা শুনে সবাই হেসে ফেলে, মেহেরও হাসে…
সন্ধ্যা ৭টা। মেহরিন আর রাজ ফিরে এসেছে শিকদার বাড়িতে।বাড়িতে ঢুকতেই লামিয়া ছুটে এসে মেহরিনকে জড়িয়ে ধরে বলল—
— তোমাকে ভীষণ মিস করেছিলাম ভাবিমণি!
মেহরিন হেসে উত্তর দিল,
— আমিও তোমাকে মিস করেছি।
কুলসুম এসে পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
—ও ভাবি, কেমন আছেন? গরম লাগছে, নিন ঠান্ডা শরবত এনেছি, খান।
মেহরিন হেসে কৃতজ্ঞতা জানায়— ধন্যবাদ কুলসুম আপা।
রাজ ইতোমধ্যে ওপরে চলে গেছে। মেহরিন রূপা বেগমের রুমে গিয়ে কুশল বিনিময় করে, তারপর নিজ ঘরের দিকে পা বাড়ায়।
রুমে ঢুকে দেখে, রাজ কোথাও নেই। ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ আসছে। বুঝতে পারে রাজ শাওয়ার নিচ্ছে।
এই ফাঁকে মেহরিন লাগেজ খুলে একে একে সব জামাকাপড় ক্যাবিনেটে গুছিয়ে রাখে।
কিছুক্ষণ পর রাজ বেরিয়ে আসে। ভেজা চুলে, মুখটা কেমন যেনো ফ্যাকাশে। চোখে একরাশ অস্থিরতা।
মেহরিন তাকিয়ে দেখে— রাজের মন এখনও ভালো হয়নি, মুখে সেই উদাস ভাব।
রাজ ডাকে,
Moonbem……
— কিছু লাগবে?
মেহরিন ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে।
রাজ এক টানে মেহরিনকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলে—
— আমার তো শুধু আপনিই লাগে।
মেহরিন হেসে ওঠে। আগের মতনই রাজের দেখা পেয়ে খুশি হয় মেহরিন। আজ সারাদিন রাজ ছিল অন্য মনস্ক।
মেহরিন বলল,
—তাই বুঝি?
— তুমি সন্দেহ করছো আমার ওপর?
রাজ সরল চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।
মেহরিন মাথা নাড়ে,
— “একদম না।”
— ব্ল্যাক শার্টটা দাও তো।
মেহরিন শার্ট এগিয়ে দেয়। রাজ পরে নেয়, মেহরিনের সামনে দাঁড়ায়। মেহরিন এসে বোতাম লাগিয়ে দেয়।
রাজ হঠাৎ বলে উঠে—
— “বউ!”
মেহরিন তাকায়।
রাজ বলে—
— শরীরটা ভালো লাগছে না।
মেহরিন রাজের কপালে হাত রাখে,
— কি হয়েছে? জ্বর তো নেই… মাথা ব্যথা করছে?কফি খাবেন?
— “না।”
রাজ অসহায় গলায় বলল,
— আমার ভিটামিনের অভাব।
মেহরিন বলে,
—কি বলেন এসব! দাঁড়ান, আমি খাবার নিয়ে আসি।
রাজ ওকে টেনে ধরে,
— যেতে হবে না, আমি নিজেই খেয়ে নেবো।
মেহরিন বলে—
—রুমে খাবার নেয় তো?
রাজ হেসে বলে—
মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৪১
— আছে তো।
— কই?
রাজ চোখ দিয়ে ইশারা করে বলে—
—দেখাচ্ছি।
মেহরিন অবাক হয়ে রাজের দিকে তাকায়। কিছু একটা বুঝে তার চোখ বড় হয়ে যায়। কিছু একটা বলতে যাবে, তার আগেই রাজ ওকে টেনে নেয়… ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে,ডুব দেয় ভালোবাসার সাগরে।