মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৪৫

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৪৫
মির্জা সূচনা

সকাল সাতটা।
মেহের আর মাহির, ভাই-বোন দুজনই বের হয়েছে একটু সকালে হাঁটাহাঁটি করতে। রাস্তা ফাঁকা, বাতাসে অদ্ভুত একটা প্রশান্তি।
মেহের পরেছে সাদা টি-শার্ট আর সাদা ট্রাউজার, একটু উঁচু করে ঝুটি করেছে চুলগুলো।
মাহিরের পরনে থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট আর সাদা একটা টি-শার্ট।
দুজনেই গল্প করছে ছোটবেলার কথা নিয়ে, আর দৌড়ঝাঁপও করছে হালকা। হাসির খিলখিল, নরম রোদে দুই ভাইবোন যেনো ফিরে গেছে শৈশবে।
হঠাৎ মাহির দাঁড়িয়ে পড়ে।
মেহের একটু এগিয়ে যায়, কথা পাচ্ছে না পাশে, ঘুরে দেখে মাহির নেই!
পিছনে ফিরে দেখে— মাহির দাঁড়িয়ে আছে এক দৃষ্টিতে কিছু দেখছে।
মেহের তার কাছে এসে বলে,

— কি রে?
মাহির হাতের ইশারায় চুপ থাকতে বলে।
কিছু না বুঝে মেহের তার চোখের দিক অনুসরণ করে।
আর যা দেখে— তাতে যেনো বুকের ভেতর কিছু একটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়।
রিদ দাঁড়িয়ে আছে একজন মেয়ের সঙ্গে।
হাসছে।
অবচেতনভাবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে কিছুর উত্তর দিচ্ছে।
মেয়েটার মুখ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু শরীরী ভাষা বলে— ওরা পরিচিত, আর খুব স্বচ্ছন্দ।রিদ কথাই কথাই মেয়েটির মাথাই হাত দিচ্ছে।
মেহের কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে…
তারপর মাহির হাত ধরে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— বাড়ি চল।
মাহির বলে,
— আরে দাঁড়া, রিদ ব্রো কে একটু হাই বলে আসি।
মেহের একটা ধমক দিয়ে বলে,
— চুপচাপ চল।
মাহির কিছু না বলে, মুখ দেখে বুঝে নেয়— বোনটা রেগে গেছে।
তবে সে বুঝতে পারে না, কেন হঠাৎ এত রাগ?
বাসায় ফিরে মেহের রুমে ঢুকে পড়ে।
রাগে-দুঃখে নিজের চুল টেনে ধরে।
গত রাতের কথা মনে পড়ে, রিদের ব্যবহার, কথাবার্তা— সবই ইঙ্গিত করেছিল, সে মেহেরকে পছন্দ করে।
তাহলে এই মেয়ে কে?
এত সকালে রিদ ওই মেয়ের সঙ্গে কী করছিল?
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে মেহের ফোন তোলে।
রিদকে কল দেয়।
রিদ কল ধরেই স্বাভাবিক ভাবে বলে,

— আপনি কোথায়?
রিদ উত্তর দেয়,
— বাড়িতে।
মেহেরের মাথাটা আরও গরম হয়ে যায়।
মিথ্যে বলছে!
সে বলে,
— “ও আচ্ছা।”
তারপর ফোনটা কেটে দেয়।
রুমে পায়চারি করে।
বুকের ভেতরে রাগ যেনো আগুন হয়ে ফুঁসে উঠছে।
রাগ আর কন্ট্রোল করতে না পেরে চলে যায় ওয়াশরুমে— একটা লম্বা শাওয়ার নেওয়ার জন্য।
ওয়াশরুমে গিয়ে ট্যাপ ছেড়ে দেয়, দাঁড়িয়ে থাকে…
সময় চলে যায়… মিনিট… মিনিট… এক ঘণ্টা…

অন্যদিকে…
মেহরিন রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে কফি বানাচ্ছে।
পাশে মেহবুবা।
সকালটা শুরু হয় একটু ব্যতিক্রমভাবে।
মেহবুবা চোখ কুঁচকে বলে, কি হয়েছে তোর মুখ অমন বাঘলার পেছনের মতো করে কেন?
মেহরিন ঠোঁট উল্টে বাচ্চাদের মতো বলে, বিয়ে হলে বুঝবি।
মেহবুবা হেসে বলে, ভাইয়ার অত্যাচারের শিকার হয়েছিস বুঝি!
মেহরিন মুখ গম্ভীর করে বলে, সব কিছুর সওদা এভাবেই নিয়েছে।
মেহবুবা হেসে মেহরিনের চিবুকে হাত রেখে বলে, আহারে আমার সোনা! খুব কষ্ট হচ্ছে, বল?
মেহরিন মুখ ফিরিয়ে বলে, “যা তো, জ্বালাস না।”
এই কথার মাঝখানে মালিহা মির্জা আসেন, ওনাকে দেখে দুই বোন তৎক্ষণাৎ টপিক চেঞ্জ করে।
মেহরিন বলে, কি রে, মেহের কোথায়?

মেহবুবা বলে, দুই ভাই-বোন মর্নিং ওয়ার্কে গেছিল, ফিরেছে এখন রুমে হয়তো।
মালিহা মির্জা বলেন, সবাইকে ডেকে আনো, আমি নাস্তা দিচ্ছি।
মেহরিন আর মেহবুবা দুইজন দুই মগ কফি হাতে নিয়ে মাথা নেড়ে চলে যায়। মেহরিনের হাতে রাজের কফি আর মেহবুবার হাতে লাবিবের। মেহবুবা চলে যায় লাবিবের রুমে, আর মেহরিন নিজের রুমে।
রুমে গিয়ে দেখে রাজ বিছানায় বসে। মেহরিন ব্রু কুঁচকে বলে, কি সমস্যা? এমনভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?
রাজ হেসে বলে, একটা বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম।
মেহরিন রাজকে কফি দিয়ে বলে, কি ব্যাপার?

রাজ মেহরিনকে নিজের কোলে টেনে নিয়ে বলে, তোমার বোন মানে আমার বড় শালিকা তো গর্তে পড়ে গেছে!
মেহরিন বলে, মানে? ও তো রুমে গর্তে পড়লো কিভাবে?
রাজ হেসে মেহরিনের নাকে চুমু দিয়ে বলে, আরে বউ, ওই গর্তে না।
মেহরিন মুখ গম্ভীর করে বলে, ডং না করে বলুন, না বললে নাই।
রাজ বলে, আরে শালাবাবু আর মেহের মর্নিং ওয়ার্কে গেছিল।
মেহরিন ভুরু কুঁচকে বলে, হ্যাঁ গিয়েছিল তো।আপনি জানলেন কীভাবে?
রাজ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে, আমার শত্রুরা জানে মাহির আমার শালাবাবু। তাই ওর উপর যেনো কোনো বিপদ না আসে, আমার লোকেরা সবসময় তাকে চোখে চোখে রাখে। শুধু তাকে না, তোমাদের সবাইকেই।
মেহরিন বলে, আচ্ছা, বুঝলাম। তো তখন কী গর্তে পড়ে গিয়েছিল?
রাজ কপালে হাত দিয়ে বলে, ইশ বউ, আগে আমাকে বলতে দাও।
রাজ বলে, ওখানে মাহির রিদ কে দেখে দাঁড়ায়। আর মেহের মাহিরকে এক প্রকার টানতে টানতে নিয়ে আসে। আমার কাছে যতদূর খবর আছে, রিদকে মেহের আগেই চিনত। আর তারা একই ফ্লাইটে সিঙ্গাপুর থেকে ফিরেছে।সিঙ্গাপুরেও ওদের একসাথে দেখা গেছে।
মেহরিন হেসে বলে, হ্যাঁ জানি, হয়তো ওদের ভিতরে কিছু আছে।
রাজ মাথা নেড়ে বলে, “হু।”

মেহরিন বলে, আচ্ছা, তারপর কি হল সেটা বলুন।
রাজ হেসে বলে, রিদ পুঁচকির সাথে কথা বলছিল, তোমার বোন হয়তো ভেবেছে অন্য মেয়ে।
মেহরিন হেসে বলে, ওহ, আচ্ছা এই ব্যাপার।
রাজ একটা শয়তানি হাসি দিয়ে বলে, আমার সাথে প্র্যাঙ্ক করেছিল তাই না? আজ শালিকার পালা।
মেহরিন হেসে বলে, বেশি কিছু কইরেন না, সে রেগে গেলে কিন্তু সবার ১২টা বাজাই দিবে।
রাজ বলে, এখন কেন? যখন ওরা প্র্যাঙ্ক করছিল আমার সাথে তখন তুমি সাপোর্ট দিসো। এখনো দিবা।
মেহরিন বলে, আচ্ছা, তা না হয় দিব। তবে রিদ ভাইয়াও কি ওকে পছন্দ করে?
রাজ হেসে বলে, ওই সালা শুধু পছন্দেই সীমাবদ্ধ না, রীতিমতো প্রেমে পড়ে খালবিলে পরে গেছে।
মেহরিন হেসে বলে, তাহলে দুইজনকে একসাথে পবিত্র বন্ধনে বেঁধে দিই, কি বলেন?
রাজ হেসে বলে, দিবো, but I think শালিকা আমাদের আশায় থাকবেনা, নিজেই কিছু একটা করবে। তার সম্পর্কে যতটুকু জানলাম, সে নিজের জিনিস ভালোভাবে না পেলে ছিনিয়ে নেয়।
মেহরিন হেসে বলে, হ্যাঁ, ছোট থেকে এমন। ওর কিছু পছন্দ হলে, সেটা ওর চাই মানে চাই। একবার কি হয়েছে জানেন?

“আমাদের পাশের বাসার একটা মেয়ে ছিল আয়েশা। ও একটা পুতুল কিনে আনছে। সেটা আমাদের মেহেরের পছন্দ হয়েছে। তাই ও চেয়েছে—বলেছে, ওটা আমায় দাও আমি টাকা দিচ্ছি, তুমি আরেকটা কিনে নিও। কিন্তু ওই মেয়ে ওটা দেবে না, তাই ওকে মেরে ওটা নিয়ে এসেছে।”
রাজ হেসে বলে, আরে বউ, শালিকা সব ডাকাত!
মেহরিন রাগি চোখে তাকিয়ে বলে, কি বললেন আপনি?
রাজ ঢুক গিলে বলে, না মানে, বলতে চেয়েছিলাম, খুব সাংঘাতিক।
মেহরিন রাজের কোল থেকে উঠে রাগ রাগ ভঙ্গিতে চলে যায়। রাজ মুখ বাঁকিয়ে বলে, যা বাবা, সত্যি বললেই চলে যায়। রাগে যায়। আজ কাল সত্যি ও বলা যায় না।তবে এরা দুই বোনই সাংঘাতিক।
তারপর বিছানায় শুয়ে বলে, ভাই রিদ, আমি একা কেন? আবার তুইও বুঝবি বউ কি জিনিস, কেমন লাগে বউয়ের প্যারা।

সকাল ৯টায় সবাই খাবার টেবিলে।
মেহরিন, রাজ, মেহের, লামিয়া, লাবিব, মেহবুবা, মাহির, চুমকি, ফিরোজ মির্জা, মালিহা মির্জা—সবাই খাচ্ছে, আর টুকটাক গল্প করছে।
সবার খাওয়া প্রায় শেষ, ফিরোজ মির্জা আর মালিহা মির্জা চলে গেছেন নিজেদের রুমে।মেহের প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছে।
তা দেখে রাজ শয়তানি হেসে মাহিরকে ডেকে বলে, বুঝলে মাহির, রিদ নাকি বিয়ে করবে।
মেহের ফট করে মাথা তুলে তাকায় রাজের দিকে। তা দেখে মেহরিন হেসে ফেলে। মাহির বলে, কি বলেন? ওইজন্যই আজ দেখলাম একটা মেয়ের সাথে কথা বলছিল।
রাজ মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ, কাল বললো, মেয়ে নাকি পছন্দ হয়ে গেছে। বিয়ে করবে ২-৩ দিনের মধ্যে।
মেহেরের ভিতরে যেনো ঝড় বয়ে যায়। মনে হচ্ছে কেউ তার শরীরের সব হাড় গুঁড়িয়ে দিয়েছে। অসহ্য পরিমাণ কষ্ট হচ্ছে। কান্নাভেজা গলায় ঢোক গিলছে।

মাহির বলে, ভালোই তো, একটা বিয়ে খাব।
মেহবুবা বলে, ও মা! তাহলে তো ভালোই। আবার একটা বিয়ে হবে!
লাবিব মেহবুবার কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে বলে, বিয়ে নিয়ে এত excited তুমি, ল্যাদা বাচ্চা! তাহলে চলো আমরাও বিয়ে সেরে নেই, তোমাকেও তো বাচ্চা থেকে বড় বানাতে হবে তাই না।
লাবিবের কথার মানে বুঝে মেহবুবার কান দিয়ে যেনো গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। লজ্জায় লাল-নীল-হলুদ হয়ে যাচ্ছে। আর লাবিব বলে যাচ্ছে। সহ্য করতে না পেরে মেহবুবা দেয় লাবিবের উরুতে একটা চিমটি।
লাবিব ‘ইসস’ করে উঠে, সবাই তাকায় তার দিকে। লাবিব হেসে বলে, “মশা মশা।”
মেহবুবার দিকে তাকিয়ে দাঁত চেপে বলে, খুব বড় মশা!
মেহবুবা হেসে ফেলে।

লামিয়া সবটা দেখেছে, তাই মাথা নিচু করে হাসছে।
ওদিকে চুমকি বলে, দুলাভাই, নিউজটা কি সত্যি, না কি? শান্ত তো কিছু বলল না।
রাজ চুমকির দিকে তাকিয়ে বলে, শালিকা, ওটা সিক্রেট, তাই হয়তো বলেনি।
চুমকি মাথা নেড়ে বলে, হয়তো।
মেহেরের সব কিছু অসহ্য লাগছে। সবাই একে একে উঠে যায়। রাজ, মেহরিন আর মেহের বসে থাকে।
রাজ হেসে বলে, মেহের?
মেহের তাকায়। রাজের অনেক হাসি পাচ্ছে, অনেক কষ্টে চেপে বলে, তুমি তো মেবি রিদকে চিনো।
মেহের মাথা নাড়ে।
রাজ বলে, ওর বউকে কি গিফট দেওয়া যায়, বলো তো?
মেহের, মেহরিনের দিকে তাকায়। মেহরিন বোনের কষ্ট বুঝে রাজকে ধমক দিয়ে বলে, আমি বলে দিব, আপনি এখন চুপ করুন।

রাজ বলে, আচ্ছা, তা বেশ। তুমিই বলো।
মেহরিন বলে, পরে বলে দিব।
মেহের উঠে চলে যায়…
রুমে গিয়ে মেহের দরজা আটকে দেয়।
অসহ্য যন্ত্রণা!
বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে রিদের সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো।
কানে বাজছে রিদের বলা প্রতিটা কথা। প্রতিটা মিষ্টি হাসি যেনো এখন বুকে ছুরি হয়ে বিঁধছে।
অন্যদিকে রাজ রুমে এসে হাসছে।
মেহের রাগী চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
মেহরিনের দিকে তাকিয়ে রাজ আরও জোরে হেসে ফেলে।
মেহের তেড়ে গিয়ে বলে,

— আমার বোন কষ্ট পাচ্ছে, আর আপনি হাসছেন?
রাজ বলে,
— শোনো, আমি তাদের রাস্তা ক্লিয়ার করে দিলাম।
যেই বিয়ে দুদিন পরে হতো, তা দুই দিন আগেই হবে!
মেহের বলে,
— তাও তো আমার বোন কষ্ট পাচ্ছে!
রাজ হালকা গলায় বলে,
— চিন্তা করোনা, যা হবে ভালোই হবে।
আরেক ধাপ বাড়াবো, বুঝলে? আমি ডিজেল দিয়ে দিয়েছি, এবার আগুন লাগার পালা!
মেহের হতাশ।
কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না।
রাজ যে খারাপ কিছু করবে না, এটা সে জানে।
তবুও…

বোনের কষ্টে মনটা মোচড় দিয়ে উঠছে।
বিকেল চারটা।
মেহের সেই যে দরজা আটকে দিয়েছিল, আর বের হয়নি।
কিছুক্ষণ কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে গিয়েছিল।
দুপুরে খাওয়ার জন্য সবাই ডাকছিল, কিন্তু মেহের আসেনি।
ঘুম ভেঙেছে, এখনও ক্লান্ত, মাথা ভার।মেহের নিচে আসে কফি বানাতে।
ঠিক তখনই বেল বাজে।
মেহের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,
— এখন আবার কে এলো?
গিয়ে দরজা খোলে।
একজন ছেলে বলে,

— ম্যাম, একটা পার্সেল এসেছে মেহরিন শিকদার নামে।
মেহের পার্সেলটা নেয়।
দেখে একটা কার্ড।
কৌতূহলবশত কার্ডটা খোলে।
একটা বিয়ের কার্ড।
চোখ আটকে যায়…
বর: রিদ তালুকদার।
কনে: সাথী।
মেহেরের ভেতরটা যেনো ছিঁড়ে যাচ্ছে।
কান্নাটা আর আটকানো যাচ্ছে না।
কার্ডটা হাতে নিয়েই দৌঁড়ে চলে যায় নিজের রুমে।
রাজ আর মেহরিন আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল।
মেহরিনর অসহায় চোখে তাকায় রাজের দিকে।
রাজ বলে,

— চিন্তা করো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমি শুধু ওকে বুঝাচ্ছি— আমার ভাইরা আর কতদিন ব্যাচেলর থাকবে?
বউ জিনিসটা কী, আমি একা কেন বুঝবো? ওরাও বুঝুক!বিয়ে কত মজা।
মেহরিনর রাজার শার্টের কলার ধরে টানতে টানতে তাকে নিজের রুমে ঠেলে নিয়ে যায়।
বলে,
— বউ কী জিনিস তা আজ তোকে বুঝাবো!
রাজ বলে,
— বউ এবারের মতো, মাফ করে দাও!
আর জীবনে কোনোদিন বলবো না ‘বউউউউ’…!
রুমে গিয়ে ধপাস করে পড়ে যায় মেহেরিনের রুমের।
অন্যদিকে…
মেহের নিজ রুমে।
কান্নায় ভেঙে পড়ে।
বুকের মধ্যে বিয়ের কার্ডটা চেপে ধরে, ফুঁপিয়ে উঠে বলে…

—এমনটা কেন করলেন রিদ?
আমি যে আপনাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন বুনেছিলাম…
আপনি কি না তা-ই এমনভাবে ধ্বংস করে দিলেন?
আমি যে আমার-থেকে-আমিটাকেই… আপনার নামে করে দিয়েছিলাম!
আর আপনি… আপনি সেই আমাকে-ই মেরে ফেললেন…
এই বলে সে ডুকরে উঠে কাঁদতে থাকে,
যেনো বুকের সমস্ত ব্যথা, সমস্ত ভালোবাসা, সমস্ত অপমান— একসাথে ফেটে পড়ে…
মেহের হু হু করে কান্নাই ভেঙে পরে।

রাত ১১টা।
মির্জা বাড়ি নিস্তব্ধ। সবাই নিজেদের ঘরে।
চুমকি বিকেলেই বাড়ি চলে গেছে।
লামিয়া আর মেহবুবা গল্প করেছে মেহবুবার রুমে।
লাবিব নিজের রুমে ল্যাপটপে কাজ করছে।
মাহির সামনের পরীক্ষার জন্য বইয়ে মুখ গুঁজে বসে আছে।
আর অন্যদিকে—মেহরিন আর রাজ বসে আছে মেহের আর রিদের নিয়ে আলোচনা করতে।
ঘরে আলো ম্লান, কিন্তু আবেগ স্পষ্ট।
হঠাৎ, মেহের চোখ কচলে উঠে বসে। কণ্ঠে কাঁপন।

— না! আমি মেহের! আমি কেন কাঁদব?
— সবসময় তো আমি সবাইকে কাঁদিয়েছি, আজ কেন আমি…
কথাগুলো বলেই উঠে গিয়ে দাঁড়ায় আয়নার সামনে।
চিড়নিটা তুলে নেয়, ধীরে ধীরে ঘোরাতে ঘোরাতে বলে—
—আমি সেই মেহের, যে নিজের পছন্দের জিনিস না পেলে ছিনিয়ে নিতে জানে।
যেখানে আমি ছোট্ট কিছুতে ছাড় দিই না, সেখানে আপনি তো একটা আস্ত মানুষ…
রিদ তালুকদার! আমাকে ঠকিয়েছেন। আমাকে প্রেমে ফেলে এখন অন্য কাউকে বিয়ে করে সংসার করবেন?
এক মুহূর্ত থামে। চোখে তীব্র আগুন।

— Like seriously? আমি মেহের! এটা হতে দেবো?
চিড়নিটা ছুড়ে ফেলে দেয় পিছনের দিকে।
— আমি আপনাকে ভালোবাসি, আজ থেকে আপনি শুধু আমার ভালোবাসার না… আমার জেদেরও অংশ।
দেখি, আপনি বিয়ে করেন কীভাবে!
আয়নার কাছে গিয়ে চোখের পানি মুছে, ঠোঁটের কোনে এক শয়তানি হাসি টেনে বলে—
— তোর বিয়ের শখ যদি গুঁড়িয়ে দিতে না পারি, তবে আমার নাম মেহের না।
বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। গন্তব্য—মেহরিনের ঘর।

মেহরিনের দরজায় ধীরে টুকা দেয়—
— মেহু, ভিতরে আসব?
মেহরিন হেসে বলে—
— আয়, দরজা খোলা।
রাজ একটা বিজয়ীর হাসি দিয়ে আয়েশ করে সোফায় বসে।
মেহরিন মেহেরকে নিয়ে আসে, আর মেহের গম্ভীর মুখে রাজের সামনে গিয়ে বসে পড়ে।
মেহেরের অভিব্যক্তি দেখে রাজ কপাল কুঁচকে বলে—
— কি হইছে শালিকা? এমন সন্ন্যাসিনী হাল কেন?
মনে হইতেছে ছ্যাখা খাইয়া বাঁকা হইয়া গেছো।
কেউ ছ্যাখা দিছে নাকি? দিলে শুধু নামটা বলো…
আমার শালিকারে ছ্যাখা দেওয়ার অপরাধে আমি ওকে সুলে চড়াবো!
মেহের হাত তোলে—

— Please!
রাজ একটু গম্ভীর হয়—
— Okay বলো, কি হইছে? সবকিছু ঠিক আছে তো?
মেহের উঠে দাঁড়ায়। চোখে জল নয়, আগুন।
— “No. Everything is NOT okay.”
রাজ অবাক হওয়ার ভান ধরে, বলে—
— But why, শালিকা?
মেহের রাজের চোখে চোখ রেখে বলে—
— I need your help, ভাইয়া।
রাজ মাথা নেড়ে বলে—
— অবশ্যই help করবো।
আমার বউয়ের বোন… মানে, আমার বোন আর বোনদের জন্য আমি রাজ শিকদার, always ready!
মেহের হেসে বলে—

— Thanks ভাইয়া। But কাজটা কিন্তু করতেই হবে!
রাজ রসিকতা করে বলে—
— অবশ্যই অবশ্যই করবো! শালিকা প্রথম কোন হেল্প চাইছে আর আমি করবো না সেটা কি হয়? আমি একজন আদর্শ দুলাভাই শালিকাদের জন্য আমার মনে, দিলে, ফুসফুসে সব জায়গাই অলওয়েজ রেডি থাকে হেল্প করার জন্য।
মেহরিন পাশ থেকে শুধু তাকিয়ে, চুপচাপ সেসব কথা শুনছে। যেনো একটা দর্শক, দুইজনের কথোপকথন শুনছে।
মেহের বলে—
— ভাইয়া, আমার বড় ভাই নাই। So সেই কাজটাই আপনাকে করতে হবে।
রাজ শান্ত চোখে মেহেরের দিকে তাকায়। মুহূর্তে তার মনে যেনো একটা নরম স্রোত বয়ে যায়।
‘বোন’—এই শব্দটাই রাজকে দুর্বল করে ফেলে।
রাজ উঠে দাঁড়িয়ে বলে—

— দিলে তো দুর্বল জায়গায়…হাত পা সব ঢুকিয়ে।
যাই হোক, তোমার কাজ যাই হোক, বড় ভাইয়ের জায়গা যখন দিয়েছো, তখন জান কুরবান।
মেহের হেসে বলে—
— একজনকে কিডন্যাপ করতে হবে।
সাথে একটা কাজি আর রেজিস্টারের ব্যবস্থাও!
— okay হয়ে যাবে… তারপর?
মিনিট দুয়েক চুপ থেকে, পুরো ব্যাপারটা বুঝে অবাক হয়ে বলে—
— কীইইই??!
মেহরিন তখন মেহেরের পিঠে একটা থাপ্পড় মেরে বলে—
—শেষমেশ কিডন্যাপ করে বিয়ে করবি?
মেহের গলা শক্ত করে বলে—

— তুই জানিস, আমি আমার জিনিস ভালোভাবে না পেলে, কেরে নিতে জানি!
রাজ একবার মেহেরকে, একবার মেহরিনকে দেখে।
তারপর মুখ টিপে হেসে ভাবে—
কি জিনিস মাইরি! এরা মেয়ে মানুষ ভাবতেই অবাক লাগে।
একজন জামাইকে বোমা গিফট করে, আরেকজন কিডন্যাপ করে বিয়ে করবে!
— অবশ্য রাজ শিকদারের শালিকা, মানে ইউনিক কিছু না করলে হয়।
নিজেকে বাহবা দিয়ে গলা পরিষ্কার করে রাজ বলে—
— তা কবে, কোথায়?
মেহের বলে—

— সকাল ৮টার মধ্যে আপনি কাজি আর রেজিস্টার রেডি রাখবেন।
আর ওই বা*ল কে তুলার জন্য ক’টা মোটা, তাজা হাতি লাগবে?
রাজ হেসে বলে—
— Okay!
মেহরিন সামনে হাত বাড়িয়ে বলে—
— তাহলে কাল আমাদের মিশন ‘Kidnap’!
রাজ বলে—
— That’s right!
তিনজন একসাথে ‘হাই ফাইভ’ করে।
মেহের বেরিয়ে নিজের ঘরে আসে। আয়নায় তাকায়।
একটা গভীর নিঃশ্বাস নেয়, ঠোঁটের কোনে আগুন।
— রেডি তো আপনি, Mr. Talukder…
আর দিক থেকে মেহরিন হেসে হেসে বলে,

—বুঝতে পারছেন, কি হবে?
রাজ দুষ্টু হেসে বলে,
—ওগুলো কাল সকালে দেখবো। এখন আমি শুধু আমার বউকে চাই। চল বউ!
মেহরিন বলে,
—মরন! শরুন তো!
রাজ বলে,
—বউ, তাড়াতাড়ি আসো, আমার কেমন বউ বউ পাচ্ছে!
মেহরিন বলে,
—মানে? বউ বউ আবার পাই কেমন করে?
রাজ বলে,
—এত কথা বলে সময় নষ্ট করোনা তো। নাতি-নাতনির মুখ দেখার জন্য আমার আর সহ্য হচ্ছে না, আসো আসো!
মেহরিন মাথায় হাত দিয়ে বলে,

—কি আজাইরা পাবলিক রে ভাই!
রাজ বলে,
—আমি তোমার ভাই?
মেহরিন বলে,
—আরে না মানে আমি… ওটা বুঝাইনি!
রাজ দুষ্টু হেসে বলে,
—আসো, আজ তোমাকে ভাই আর হাজবেন্ডের পার্থক্য বুঝাই।
মেহরিন বলে,
—না!
রাজ বলে,
—Yes বেবির আম্মু!
এই বলে মেহরিনকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে, লাইট অফ করে বলে,
—আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম…
তারা ডুবে যায় ভালোবাসার সাগরে।
কারো রাত কাটে সুখের সাগরে ভেসে, আর কারো রাত কাটে নতুন জীবন আর ভাবনায়!

সকাল ৬:৪০
মেহরিন, রাজ, লাবিব আর মেহের দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির বাইরে।
মেহের বলে,
—আপনি খুঁজ নিন।বের হয়েছে কি না!
রাজ কাউকে কল দেয়। কথা শেষ করে মেহেরের দিকে ফিরে হেসে বলে,
—তোমার কাজ শুরু করো। কিছু দরকার পড়লেই কল দিবে। আর আমরা ওয়েট করবো না, আমি অফিসে যাই। তোমরা ওখানেই চলে আসবা ওকে?
মেহের বলে,
—ওকে।
মেহের চলে যায়, সেই কালকের জায়গায়।
আজ রিদ আর একটা মেয়ে দৌড়াচ্ছে। মেয়েটার গায়ে টি-শার্ট আর লেডিস প্যান্ট, রিদের গায়ে কালো টি-শার্ট আর হাপ প্যান্ট। ঘামে ভেজা টি-শার্টটা শরীরের সাথে লেপ্টে আছে।
মেহের বলে,

—শেষমেষ,কিনা আমার জামাই হব হাপ প্যান্টওয়ালা! তার ওপর ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে বলে, But not bad… শখের বেডা সব কিছুতেই সুন্দর! পোশাকে কি আর আসে যায়, শুধু হাপ প্যান্ট কেন, আজ যদি খালি গায়েও থাকে, তাও আজই বিয়ে হবে! শালা, আমাকে ঠকাতে চায়! আমার সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে, আমার মনে প্রেমের ফুল ফুটিয়ে, তুই অন্য বেডিককে বিয়ে করবি? আর আমার প্রেমের ফুল ছাগলে খাবে? তা তো আমি হতে দেবো না! প্রয়োজন হলে তোর জীবন যৌবন ছাগল দিয়ে খাওয়াবো, তাও আমার প্রেমের ফুল না! আয় বলেই ফুল অ্যালার্জি নিয়ে রিদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
রিদ মেহেরকে দেখে খুশি হওয়ার সাথে অবাকও হয়ে।
রিদ কিছু বলবে, তার আগেই মেহের গম্ভীর ভাবে বলে,

—এই মেয়েটা কে?
রিদের পাশে থাকা মেয়েটা সাথী।ও হা করে তাকিয়ে থাকে। হুবহু মেহরিন!
মেয়েটা কিছু বলবে, তার আগেই রিদ হেসে বলে,
—ও হলো সাথী, আমার…
তার আগেই “ধসস্”
করে একখানা ঝাড়দার চড় পড়ে রিদের গালে!
রিদ গালে হাত দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
আর সাথী…
সাথী তো একেবারে হতভম্ব।
মেহের বলে,
—সালা! তুমি আমাকে কী ভেবেছো হে? বিয়ে হয়নি এখনো, রঙ্গ শুরু করে দিয়েছো? এই দাঁড়া, তোকে তো আমি…
এই বলে পাশে থাকা একটা ইট তুলে বলে,
—আজ তোর মাথায়ই ফাটায়ে দিব!
রিদ ইট নেওয়া দেখে পালিয়ে সাথীর পেছনে লুকায়।
সাথী বলে,

—আররে! কী হয়েছে? তুমি কী করছো? এমন করছো কেন?
সাথী কিছু বলবে,
তার আগেই মেহের সাথীর দিকে আঙুল তুলে বলে,
—আমাদের মাঝে একটা কথা বললে খুব খারাপ হয়ে যাবে!
ঠিক তখনই সাথীর ফোনে এসএমএস আসে—মেহরিনের পাঠানো।
লিখা:
—Apu, তুমি ওখান থেকে কেটে পড়ো।
সাথী কিছু একটা বুঝে সরে যায়।
মেহের ইট ফেলে রিদের কলার চেপে ধরে—
—বল, কী করছিলি ওই মেয়েটার সাথে?
রিদ বলে,

—ওটা মেয়ে না তো! ও তো… সাথী, আমার…
মেহের চারপাশে তাকিয়ে একটা হকি স্টিক দেখে সেটা তুলে নেয়।
এক ঘা, আরেক ঘায়েই রিদ শেষ!
রিদ পড়ে যায় অচেতন হয়ে।
মেহের রিদকে ধরে ফোন করে রাজকে।
রাজ সাথে সাথেই গাড়ি আর দুজন গার্ড পাঠায়।
ওরা এসে রিদকে গাড়িতে তুলে নেয়।
মেহের রিদকে তাকিয়ে বলে,
—সরি! আমি এটা করতে চাইনি। তবে আপনি বাধ্য করেছেন। You deserve it.
গাড়ি থামে অফিসের সামনে।
লোকগুলো রিদকে নিয়ে যায় ভিতরে।
রাজ জায়গাটা দেখিয়ে দেয়,
আর লোকেরা সেখানে বসায় রিদকে।
রিদ নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। ওকে অচেতন দেখে রাজ তো এক লাফে উঠে চিৎকার করে উঠল,

— একি সালিকা! তুই আমার বন্ধুটা কে মেরে-টেরে ফেললি নাকি? হায় রে! এ কি সর্বনাশ হইল!
মেহরিন বিরক্ত মুখে রাজকে টেনে সরিয়ে আনে।
মেহের বলে,
—মেরে ফেলিনি। দু’টো ঘাঁ খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে মাত্র।
মেহের গম্ভীর মুখে বলল,
— বেঁধে দিন, এখন ওকে। লোকগুলোকে বিদেয় দেই।
রাজ তাকিয়ে দেখে রিদ হাফপ্যান্ট পরে আছে। সে মুখ টিপে হাসে,
— আরে, তোমার জামাই তো হাপপ্যান্ট পরে আছে! এইভাবে বিয়ে করবে নাকি? দাঁড়াও, কাউকে বলি পাঞ্জাবি পরিয়ে দিক।
মেহর কটমটিয়ে তাকিয়ে বলল,

— তার দরকার নেই। এইভাবেই বিয়ে হবে।
রাজ মনে মনে বলে,
— এটা মেয়ে মানুষ তো? নাকি অন্য কিছু? কী সাংঘাতিক ভাই! আজকাল ছেলেরা দেশে নিরাপদ না। মেয়েরা ধরে বেঁধে বিয়ে করছে! হায় আমাদের ভাগ্য…
সআবার রিদের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ভাই, মাফ করে দিস। আমি তোকে জেনে শুনে এক জল্লাদের হাতে তুলে দিচ্ছি। কারণ আমি একা কেন বউয়ের মার খাবো—তুইও খা! আমি তো বিয়ের দিনেই খেয়েছি। আজ তুইও খেলি—সমতা বজায় থাকুক। না হলে তো আমাকে খোঁটা দিবি।
তারপর মেহরিনের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
— আমার বউ অন্তত এমনভাবে মারেনা যে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। মাঝেমাঝে এক-আধটা থাপ্পড় মারে, দাত নড়ে যায়—ব্যস!
আবার রিদের দিকে ফিরলো,

— ভাই, তোর কপালে যা জুটছে… আমি তোর আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি—মানে তোর দাম্পত্য জীবনের।
এদিকে মেহর বলল,
— ভাইয়া, পানি।
রাজ একজনকে ইশারা করতেই পানি এলো। মেহর জগ ভর্তি পানি নিয়ে রিদের মুখে ছুড়ে মারল। রিদ ধড়ফড়িয়ে উঠে। চোখ খুলতেই দেখে মেহের রাগি চোখে তাকিয়ে আছে। কিছু বলতে যাবে, বুঝে যায় তার মুখ বাধা শুধু মুখ না—হাত-পা সবই বাধা।
রিদ রাজের দিকে তাকায়। রাজ গলায় হাত দিয়ে বুঝায়,
— তুই শেষ।
মেহরিন তাকাতেই রাজ দাঁত বার করে হাসে। রিদ এবার মেহরিনের দিকে তাকায়,
মেহরিন হেসে বলে,
—কি অবস্থা দুলাভাই?
রিদ কপাল কুঁচকে ভাবে, ‘দুলাভাই মানে! আর আমায় বেঁধে রেখেছে কেন?
মেহের তখন বলে,

— ভাইয়া, কাজিকে ডাকুন।
রিদ কিছুক্ষণ চুপ করে মেহেরের মুখের দিকে তাকিয়ে, চারপাশ দেখে, সব কিছু মিলিয়ে বুঝে যায়—ওর বিয়ে হচ্ছে, তাও কিডন্যাপ করে।
রাজ কাজিকে ডাকে। কাজি এসে বসে, কাগজ কলম বের করে বলে,
— এত সকালে বিয়ে কেন?
মেহের কিছু বলতে যাবে, তার আগেই রাজ বলল,
— ওদের তাড়া আছে, আপনি আপনার কাজ করুন। ওদের তো আবার প্রসেসিং ও করতে হবে।
মেহরিন রাজকে চিমটি কাটে, চোখ রাঙায়। রাজ চুপ করে।
কাজি সব লেখালেখি করে, চোখ তুলে বলে কনে কে।
রাজ ইশারাই মেহের কে দেখাই।
মেয়েকে দেখে কাজি বলে,

— এ কনে? এই অবস্থায়? শাড়ি সালোয়ার কামিজ পরা তো দূরের কথা, একটা টিশার্ট পরে এসেছে!
লাবিব পাশ থেকে বলে,
— আর বর তো হাপপ্যান্ট পরে আছে, কাজি সাহেব!
কাজি লাবিবের দিকে তাকায় লাবিন ইশারাই রিদকে দেখায়।
কাজি রিদের দেখে বলে,
— এই বরকে বেঁধে রেখেছেন কেন? এটা কি জোর করে বিয়ে নাকি?
মেহের রাগে অগ্নিশর্মা। একদিকে রিদের দুশ্চিন্তা, অন্যদিকে কাজির অবিরাম বকবকানি। ধৈর্যের সীমা পেরিয়ে গিয়ে পিছনের একজন গার্ডের কাছ থেকে বন্দুক কেড়ে নিয়ে সোজা কাজির কপালে ঠেকিয়ে দিল সে।
— তুই কাজি, তোর কাজ বিয়া পড়ানো। তুই এত বকবক করবি ক্যান?! চুপচাপ বিয়া পড়ানো শুরু কর!
রিদ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। রাজ গলা শুকিয়ে ঢোক গিলে বলল, কি অবস্থা হইতেছে রে বাবা!
লাবীব হাসছে, মেহরিন এক ঝাড় দিয়ে বলে, মেহের! কি হচ্ছে এইসব! চুপচাপ বস!
কাজি এবার বুঝে গেলেন তাঁর জীবন এখন এক রাগত মেয়ের হাতে। তাই দাঁত বের করে এক হাসি দিয়ে বললেন, “আরে আম্মাজান, আপনি এতো রেগে যাচ্ছেন ক্যান! ছেলে রাজি না হইলেও এই বিয়া হইব। আমি না হই, আমার আব্বাও বিয়া পড়াইতো!

কাজির কথা শুনে রাজ আর লাবীব দু’জনেই হেসে গড়াগড়ি। আর কাজি মনের ভিতরে ঠিক করল, “আজ যদি বেঁচে ফিরি, জীবনে আর কাজি হব না। এই কেমন দিন আইলো! মেয়েরাও জোর কইরা বিয়া করে।
রিদের দিকে তাকিয়ে কাজি মনে মনে বলল, আহারে বাবা, তোর জীবন শেষ! যা, বউ হতে যাচ্ছে।
সব প্রক্রিয়া শেষে কাজি হেসে বললেন,
— এই বিবাহে আপনি রাজি আছেন? রাজি থাকলে বলুন— ‘আলহামদুলিল্লাহ, কবুল।
মেহের রিদের দিকে তাকিয়ে দাঁত চেপে বলল,
— কবুল।
রিদ দিকে ফিরে কাজি মনে মনে বলল, তোর জীবন ধ্বংস করার জন্য আমি দুঃখিত, বাবা। কিন্ত যে বাঁচলে বাপের নাম।
তারপর গলা পরিস্কার করে বলে,

— বাবা, আপনি কি এই বিবাহে রাজি? রাজি থাকলে বলুন, আলহামদুলিল্লাহ, কবুল।
রিদের মুখ খুলতে যাবে, এমন সময় মেহের বন্দুক ঠেকায় রিদের কপালে।
— কবুল ছাড়া মুখ দিয়া একটা শব্দ বের হলে— জানে মাইরা ফেলবো। আমার হাত একটুও কাঁপবে না!
যেটা আমার না, তা থাকুক বা না থাকুক— তাতে কিছু যায় আসে না।
তবে মরে গেলে জানবো—
তুই আমার ছিলি, আর কাউকে বিয়ে করলে আমি বাঁচলেও মরবো!
তাই তাড়াতাড়ি বল।
রিদ গলা শুকিয়ে ঢোক গিলে বলে ফেলে,

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৪৪

— কবুল! কবুল! কবুল!” — এক নিঃশ্বাসে তিনবার।
মেহের ধীরে ধীরে বন্দুক নামায়।
চারপাশ থেকে সবার কণ্ঠ একত্রে ভেসে আসে,
— “আলহামদুলিল্লাহ!”
কাজি আর দেরি করে না। নিজের জীবন বাঁচাতে দরজার দিকেই দৌড় দেয়।

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৪৬