মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৪৬
মির্জা সূচনা
কাজি জীবন বাঁচাতে জুতা ফেলে সোজা দৌড়!
তাঁকে এমন ছুটতে দেখে রাজ আর লাবীব হেসে লুটোপুটি খায়—
হাসতে হাসতে দু’ভাই একে অপরের গায়ে পড়ে যাচ্ছে।
মেহরিনও হাসছে, তবে মুখ চেপে।
আর মেহের গম্ভীর গলায় বলল,
— এই বেটকাছেন কেনো, হাসাহাসি বন্ধ করুন। রেজিস্ট্রারকে ডাকুন। রাতভর ঘুম হয়নি, মাথা ব্যথা করছে।
রাজ হেসে বলল,
— সারা রাত তো ঘুমাওনি শালিকা! আমার ভাইরাভাইরে কি করে টাইট দিবা— এগুলো ভাবছো!
মেহের রিদের দিকে তাকিয়ে বলে,
— হ্যাঁ, তা ঠিক।
রিদ কিছু বলতে যাবে—
মেহের আবার বন্দুক তোলে!
— একটা কথাও মুখ দিয়ে বের করবি না হারামজাদা! আমার মনে প্রেম জাগাইয়া অন্য কাউরে বিয়া করতে যাচ্ছিলি?
তোর বিয়ের সখ গুচিয়ে দিবো— দাঁড়া!
রিদ অবাক অবাকের উপর অবাক।
সত্যি বললে, রিদ এখনও বুঝেই উঠতে পারছে না, মেহের কেন এত রেগে আছে।
সে রাজের দিকে তাকায়।
রাজ তাকিয়েই ছিল, কিন্তু রিদ দেখছে দেখে সঙ্গে সঙ্গে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে সিস বাজায়।
রিদ এবার লাবীবের দিকে তাকায়।
লাবীব গলার কাছে হাত দিয়ে গলা কাটার ভঙ্গি করে, তারপর জিহ্বা বের করে।
রিদ ঢোক গিলে মেহেরের দিকে তাকায়।
মেহের সেটা লক্ষ্য করেই বলে ওঠে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— এই! তুই আবার অমন কেবলা কান্তর মতো করে তাকাচ্ছিস কেন?! তোর চোখ কিন্তু তুলে ফেলবো!
রিদ অসহায়ের মতো বলে,
— আমি কী করছি… আমি তো…
মেহের তেরে এগিয়ে এসে বলে,
— কি করছিস মানে? জানিস না তাই না!
অবস্থা খারাপ দেখে মেহরিন দৌড়ে এসে বলে,
— মেহের, কি হচ্ছে? ভুলে যাস না, রিদ ভাইয়া এখন তোর বর!
মেহের খানিকটা শান্ত হয়।
তবে চোখ— সেই বাঘিনীর মতো, জ্বলজ্বলে।
রিদ তাকায়, আর সেই চোখে যেনো সে নিজের সর্বনাশ দেখলো।
সে ভাবে,
— নিশ্চয় কিছু হয়েছে, যেটার জন্য ও এত রেগে গেছে।
না হলে তো ও এমন করত না।
আমার নীলয়োনী— ও রাগী, ঠিকই। কিন্তু এমন ভয়ংকর রাগ তো করে না কখনো।
আর আমি তো এমন কিছু করিওনি যাতে ওর এত রাগ হয়!
যেই নীল চোখে আমি আমার জন্য প্রেম দেখেছি, আজ সেই চোখেই দেখছি আমার ধ্বংস…”
তারপর ঠোঁট আলতো করে চেপে হেসে ফেলে।
ভাবনায় বলে,
— তবে আমার ব্যাপারে ম্যাডাম খুবই পজেসিভ।
তারপর আবার মেহেরের দিকে তাকায়—
আর দেখে— মেহের এখনো তাকিয়ে আছে… ঠিক আগুনে চোখে।
রিদ হেসে ফেলে।
মেহের সেটা দেখে উঠে যেতে চায়—
মেহরিন তাকে চেপে ধরে।
এই মুহূর্তে রেজিস্ট্রার এসে যায়।
সব কাগজপত্র তৈরি করে সই করার জন্য দুজনকে ডাকে।
মেহের প্রথমেই সই করে ফেলে।
রিদকে সই করতে বললে—
রেজিস্ট্রার তাকাতেই, তার দিকে তাকিয়ে রেজিস্ট্রার বলে উঠল,
— এটাই ঠিক হয়েছে। প্রেম করবে ছেলেরা, আর বিয়ে করবে মেয়েরা!
আইডিয়াটা কিন্তু দারুণ!
রাজ খুক খুক করে কাশি দিয়ে বলে,
— শালিকা, খুলে দিবো নাকি? ভাইরা ভাইয়ের হাত না মানে, সই করবেতো?
মেহের এবার রিদকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলে,
— কোনো রকম তেরিবেরি করলে একদম টপকে দিব। চুপচাপ সই করে দে।
রিদ মাথা নাড়ে।
রাজ হেসে বলে,
— আরে বাপরে ভাইরাভাই! দেখি এখনই বউয়ের কথা শুনে ওঠাবসা শুরু করে দিয়েছে!
রিদ আস্তে করে বলে,
— গান পয়েন্টে থাকলে বুঝতি, শালা!
রাজও আস্তে করে বলে,
— ভাই, আমার বউ আমায় থাপ্পড় মেরে চাপার দাঁত নড়িয়ে দিয়েছিলো বিয়ের দিন!
গান পয়েন্টে আমিও ছিলাম…
তবে তোর চেয়ে কম মার খাইছি!
রিদ বলে,
— তোকে পরে দেখে নেবো শালা। বিয়েটা আগে শেষ হোক— তারপর!
রিদ সাইন করে এমন সময় রাজের অফিসে রাকিব আর শান্ত। রিদ এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায়, তারপর ঠোঁটের কোণে এক হাসি।
রাকিব হেসে বলে,
— ভাই, বিয়ে করলি, অথচ দাওয়াত দিলি না? এটা কি ঠিক কাজ করলি?
শান্ত সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে,
—দেখ দেখ শালা হাফ প্যান্ট পরে বিয়ে করছে।
সবাই হেসে ওঠে একযোগে।
রিদ গম্ভীর গলায় বলে,
— আমার কোনো দোষ নেই। আমার বউ এইভাবে বিয়ে করতে চেয়েছে। আমার কিছু করার ছিল না।
মেহের ঠান্ডা গলায় বলে,
— আমি মোটেও এইভাবে বিয়ে করতে চাইনি।আপনি যে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, তাই তো এমনটা হলো।
এবার হঠাৎ করে মেহের রিদ-এর টি-শার্টের কলার ধরে টেনে নেয়, চোখে রাগ, কণ্ঠে ঝাঁঝ,
—আপনার সাহস কত বড়? আমার মনে ভালোবাসা বিজ রোপণ করে অন্য কাউকে বিয়ে করতে চান? এই সাহস আপনি পান কোথায়?
রিদ কিছুটা থমকে যায়, কাঁধ নামিয়ে আস্তে বলে,
—তুমি কী বলছো এসব? আমি কাকে বিয়ে করতে চাইবো? আমি তো শুধু ভাবছিলাম, একটা চাকরি খুঁজবো। পেয়ে গেলে তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেব। সত্যি বলছি, আমি কাউকে বিয়ে করতে চাইনি।
মেহের হেসে ওঠে একরাশ তিক্ততা নিয়ে,
—একদম মিথ্যে বলবেন না। সাথী নামে মেয়েটার সঙ্গে আপনার দুই দিন পর বিয়ের কথা ছিল। আপনি তো বিয়ের কার্ডও পাঠিয়েছেন মেহুকে।
এই কথা শুনে রিদ চোখ তুলে তাকায় মেহরিনের দিকে।
মেহরিন মুখ ঘুরিয়ে ফিসফিস করে বলে,
— সরি।
রিদ এবার রাজের দিকে তাকায়।
রাজ এমনভাবে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয় যেন এই জায়গায় ও ছাড়া কেউ নেই।
রিদ সব বুঝে ফেলে। চোখ ছোট করে চেয়ে বলে,
— এই জন্যই তুমি আমাকে ধরে-বেঁধে বিয়ে করেছো?
মেহেরের রাগ যেনো এক ধাপ বাড়ে। চোখে চোখ রেখে বলে,
— যা আমার, তা শুধু আমার! আমি আমার জিনিসে একচিমটে ছাড় দিতেও রাজি না। আর সেখানে আপনি তো আস্ত একজন মানুষ, তাও আমার সখের কী করে অন্যের হতে দেবো?প্রয়োজনে মেরে বালি চাপা দিয়ে দিব তাও অন্য কারো হতে দিব না।
রিদ হেসে মেহেরের চুল গুছিয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বলে,
— আচ্ছা, আপনার যা ইচ্ছে ম্যাম।
মেহের অবশেষে রিদ-এর কলার ছেড়ে দেয়।
রাকিব আর শান্ত একসাথে বলে ওঠে,
— কী রোমান্টিক!
রিদ এবার নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয়। তারপর রাজের সামনে গিয়ে বলে,
— তুই এটা করলি কেন, সালা? আমি ভালোভাবে বিয়েটা করতে চেয়েছিলাম।
রাজ ঠান্ডা গলায় বলে,
— আমি একটু উস্কে দিয়েছি। যা একদিন হবেই, তা একটু আগে হলেই বা ক্ষতি কী?
রিদ মুখ শক্ত করে বলে,
— তুই জানিস আমি বাড়ি ফিরবো না। আমি আগে নিজেকে গুছিয়ে নিতে চেয়েছিলাম। তুই তো সব জানিস।
রাজ হাসে, তারপর বলে,
— গুছানোর কিছু নেই। সব গুছানোই আছে। তুই আমার বিজনেস পার্টনার হবি—আমি তোকে অনেক আগেই বলেছি।
রিদ দুদিকে মাথা নাড়ে,
— না, আমি পারবো না।
রাজ ওর কাঁধে হাত রেখে বলে,
— তোর এত ইগো কেন, আমাকে বল!
রিদ এবার রাজের-এর হাত ধরে বলে,
— ইগো না। আমি চাই না তোকে আবার হারাতে।পার্টনার হয়ে আমার বাবা কি করেছিল আমি তা ভুলে যাইনি।
রাজ হেসে বলে,
— কেউ পারবে না আমাদের আলাদা করতে। আল্লাহ ছাড়া।
রিদ হেসে ফেলে।
লাবিব এসে বলে,
— এর একটা সলিউশন আমার কাছেই আছে।
রাহ আর রিদ তাকিয়ে থাকে ওর দিকে।
লাবিব বলে,
— এই মুহূর্তে তুমি আমার ফ্ল্যাটে চলে যাও, আমাদের আপু এবং ভাবিকে নিয়ে। যতদিন না একটা জব পাচ্ছো, ততদিন পর্যন্ত তুমি ওখানেই থাকবে একদম না করতে পারবে না। তুমি আমার বড় ভাই—এই কথাটা রাখতে হবে। এটা তোমার বিয়ের গিফট, আমার তরফ থেকে।
রাজ লাবিবের কাঁধে চাপড়ে বলে,
— আরে বাসস, তোর মাথায় এত বুদ্ধি আসা শুরু করল কবে থেকে?
লাবিব চোখ ইশারায় কাছে আসতে বলে। রিদ আর রাজ কাছে আসে। লাবিব ধীরে বলে,
— তোমাদের ভাইরা ভাই হওয়ার সখ জেগেছে যবে থেকে।
লাবিবের কথা শুনে রাজ আর রিদ একসাথে হেসে ওঠে।
এইদিকে মেহরিন রাকিব আর শান্ত-র সঙ্গে মেহেরের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল। তাদের হাসির শব্দে পিছনে ফিরে তাকায় মেহরিন। ভ্রু কুঁচকে তাকায় রাজ-এর দিকে।
রাজ তাকায় মেহরিনের চোখে।
মেহরিন ভ্রু নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,
—কী হয়েছে?
রাজ দুদিকে মাথা নাড়ে।
এদিকে মেহের তাকায় রিদ-এর দিকে।
রিদ শান্ত চোখে তাকায় মেহেরের দিকে। মেহের মুখের ঝামটা দেয়।
রিদ মাথা নিচু করে, ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেলে।
রাজ সকালের নাস্তার ব্যবস্থা করেছে। সবার খাওয়া শেষ হতেই রাজ বলল,
— লাবিব, তুই রিদকে নিয়ে যা। সব কিছু বুঝিয়ে দে। আর… আরিওনা, তুমি সালিকাকে নিয়ে বাসায় যাও।
রিদ ভ্রু কুঁচকে বলে উঠল,
— আমার বউ, আমার সাথে যাবে।
মেহের ঠান্ডা গলায় বলল,
— এখন বউ মারাচ্ছে, আর দুই দিন পরে অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাইছিলো?
রিদ কিছু বলতে যাবে, ততক্ষণে রাজ একটু হাসে, মুখ খুলতে যায়। কিন্তু তার আগেই মেহরিন বলে উঠে,
— তুই ভুল বুঝেছিস। মেহের রিদ ভাইয়ার কোনো বিয়ে-টিয়ে হতো না। ওটা তোর ভাইই ইচ্ছা করে করেছিল। তুই ওর সাথে প্র্যাঙ্ক করেছিলি—তার প্রতিশোধ কিন্তু এটা ঠিক! ও চেয়েছিল, তোরা বিয়েটা তাড়াতাড়ি করে ফেল।
মেহের তখন রাজের দিকে তাকায়। রাজ হাত জোড় করে বলে,
— I am sorry সালিকা। আমি ওকে একটু উসকে দিয়েছি। যাতে তোমরা তাড়াতাড়ি বিয়েটা করো। আমর ভাই, দোস্ত জানে, জিগার… আর কতদিন বউ ছাড়া থাকবে? জানো, বউ ছাড়া থাকা কী কষ্টের!
মেহরিন রাগী চোখে রাজের দিকে তাকায়। রাজ হেসে বলে,
— না মানে… ওই আরকি, তাড়াতাড়ি বিয়েটা যেন করে ফেলে, তাই আরকি!
মেহের এবার মেহরিনের দিকে ঘুরে যায়,
— তুই সব জানতিস, মেহু?
মেহরিন মাথা নাড়ে। মেহের অপরাধীর মতো চোখে রিদের দিকে তাকায়। রিদ দুই পাশে মাথা নাড়ে। মেহের কিছু বলবে, তার আগেই রিদ বলে,
— থাক, কিছু বলতে হবে না। আমি বুঝতে পারছি।
তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
— কিন্তু কথা তা না কথা হচ্ছে, তুমি কী যে আমাকে হকি স্টিক দিয়ে মারলে…! যদি মাথা ফেটে মারা যেতাম!
সবাই হেসে ওঠে রিদের কথা শুনে। মেহের নিজেও হাসে,
— না, আমি জানি কোথায় মারলে মানুষ অজ্ঞান হয়। ওই জায়গাতেই মেরেছি!
রিদ চোখ বড় করে বলে,
— ওহহহ! তাও, ভালো—মাথা ফাটাওনি!
সবাই আবার হেসে ওঠে। তখন রাকিব বলে,
— ইসসস! আগে জানলে আজ আমিও যেতাম রে রিদ! তোর সাথে এই সিনটা দেখা—ও তো চোখের শান্তি! সারা জীবন তুই মারলি সবাইকে, আর তোর বউ, বিয়ের দিন তোকে মারলো!ভাবা যায়।
শান্ত হেসে বলে,
— তাও আবার যা তা দিয়ে না! একদম হকি স্টিক!
সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ে। রিদ নিজেও হেসে ওঠে। এরপর সবাই বেরিয়ে পড়ে।
মেহের আর মেহরিন রওনা হয় বাড়ির পথে। শান্ত, রাকিব, রিদ আর লাবিব যায় লাবিবের ফ্ল্যাটে।
আর রাজ অফিসে ফিরে যায়, কাজ শেষ করে ‘মির্জা বাড়ি’ যাবে কারণ ও জানে—একটা ঝামেলা হবেই। শ্বশুর মশাই এটা মেনে নেবেন না। এত সহজে তাই সেটা সামলাতে হবে তাকে।
সন্ধ্যা সাতটা। মির্জা বাড়ির বৈঠকখানায় বসেছে সবাই। মেহের মাঝখানে বসে, আর তাকে ঘিরে চুপচাপ বসে আছেন সবাই।
ফিরোজ মির্জার চোখে মুখে অসন্তোষ স্পষ্ট। তিনি বিরক্ত গলায় বলে ওঠেন,
— মেহের কেনো রেদওয়ান তালুকদারের ছেলেকে বিয়ে করলো? অন্য কেউ হলে হয়তো কিছু বলতেন না… মেনে নিতেন হাসিমুখে। কিন্তু সব কিছু জানে শুনে কোনো বাবাই চাইবে না। তেমনিই ওনিও চাই না, এমন নিচ একজন মানুষের ছেলেকে জামাই করতে।
মালিহা মির্জা বলেন,
— আহা! তুমি রাগ করছো কেনো? বাবা যেমনি হোক, ছেলে তো ভালো।
ফিরোজ মির্জা তখন রীতিমতো ক্ষেপে উঠেন,
— ছেলে ভালো কিন্ত থাকবে তো সেই এক বাড়িতে। ওই লোক কেমন, জানো না তুমি! যদি আমার মেয়ের কোনো ক্ষতি করে দেয়, তখন সেই দায় কে নেবে, হ্যাঁ?
মেহেরিন উঠে বলে,
— বাবা, তুমি ভুল বুঝছো। রিদ ভাইয়া বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। তিনি ওই বাড়িতে থাকেন না।
ফিরোজ মির্জা জবাব দেন,
— তা মানলাম। কিন্তু যার নিজের থাকার জায়গা নেই, সে কী করে আরেকজনের দায়িত্ব নেবে?
ঠিক তখনই রাজ দরজায় এসে দাঁড়ায়। শান্ত কণ্ঠে বলে,
— সেই দায়িত্ব না হয় আমি নিলাম, বাবা।
রিদের বড় ভাই বলেন বা বন্ধু, আমি সেই গ্যারান্টি দিচ্ছি—মেহেরকে ভালোই রাখবে রিদ। আর বাকি থাকল রিদকে নিয়ে প্রশ্ন… সে কোথায় থাকবে, কী করবে—বাবা, আপনি রিদকে চেনেন। সে কারো দয়ায় চলে না। নিজের আত্মসম্মান বুঝে চলে।
— আমি ওকে বলেছিলাম, আমার ব্যবসায়ে যোগ দিতে, কিন্তু সে রাজি হয়নি। কেনো হয়নি, তা আপনাকে হয়তো ব্যাখ্যা করতে হবে না। আপনি বুদ্ধিমান মানুষ, নিজেই বুঝবেন। বাবা, আমি মেহুকে যতটা ভালোবাসি, আমি জানি রিদও মেহেরকে ঠিক ততটাই ভালোবাসে। আর রিদ বেঁচে থাকতে কোনো দিন মেহেরের ক্ষতি হতে দেবে না।
ফিরোজ মির্জা কিছু বলতে যাবেন, তখন রাজ বলে উঠে,
— আপনি ভাবুন, বাবা—যে ছেলে নিজের বাবার দুর্নীতির কথা জেনে বাড়ি ছেড়ে দেয়, পরিবার ছেড়ে দেয়, সে ছেলে কতটা সৎ। রিদ নিঃসন্দেহে একজন ভালো মনের মানুষ,ও সৎ। আর সবচেয়ে বড় কথা—মেহের রিদকে ভালোবাসে, বাবা। আপনি তো মেহুর ভালোবাসা দেখে আমাকে মেনে নিয়েছেন, আমি এক জন মাফিয়া জেনেও। তাহলে রিদকে কেনো মেনে নেবেন না?
মেহরিন রাজের দিকে তাকায়। তার চোখে গর্বের ছায়া স্পষ্ট। মেহবুবা হেসে ওঠে।
লামিয়া বলে,
— “My bro is the best in the world!”
মেহবুবা হেসে মাথা নাড়ে।
মেহেরের চোখে জল টলমল করে। সে জীবনে কখনো ‘বড় ভাইয়ের ভালোবাসা’ পায়নি। কিন্তু আজ কেন যেনো মনে হচ্ছে—ভাইরা এমনই হয়। সব সময় বোনদের পাশে থাকে, বিপদে এগিয়ে আসে, আর সব কিছু থেকে প্রটেক্ট করে।
অন্যদিকে, ফিরোজ মির্জা কী বলবেন বুঝে উঠতে পারেন না। তিনি জানেন, রিদ ছেলে ভালো। কিন্তু যেসব সমস্যা ছিল, তার সমাধান রাজ একাই দিয়ে দিয়েছে।
শেষমেশ ফিরোজ মির্জা গম্ভীর মুখে বলেন,
— আচ্ছা, ঠিক আছে। তোমাদের যদি কোনো সমস্যা না থাকে, তাহলে আমি কেনো ভিলেন হবো? তোমাদের সমস্যা না থাকলে, আমারও কোনো সমস্যা নেই।
এই বলে মেহেরের মাথায় হাত রাখেন, চলে যান।
সবাই হেসে ওঠে। মালিহা মির্জা মেহেরের গাল ছুঁয়ে বলেন,
— সুখী হও মা।
এই বলে তিনিও উঠে যান।
মেহের দৌড়ে গিয়ে রাজকে জড়িয়ে ধরে।
প্রথমে রাজ অবাক হয়ে যায়, পরে হাসে।
সে মেহেরের মাথায় হাত রেখে,
— “Thanks ভাইয়া। আমি কোনো দিন ‘বড় ভাইয়ের ভালোবাসা’ পাইনি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, বড় ভাই তোমার মতোই হয়।”
রাজ হেসে বলে,
—বোনদের জন্য আমার জান কোরবান। আমি আমার বোনদের জন্য সব করতে রাজি।
তারপর মেহবুবার দিকে ফিরে হাত বাড়ায়।
মেহবুবা এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে।
রাজ বলে,
—আমি কখনো তোমাদের শালী ভাবি না। তোমরা আমার বোন। আল্লাহ আমার এক বোনকে নিয়ে নিয়েছিলেন, কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে আরও চারটা বোন দিয়ে দিয়েছেন।
লামিয়া আসে, বলে,
— চারটা? কে কে?
মেহরিন, লামিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলে,
— লামিয়া, মেহের, মেহবুবা, চুমকি।
লামিয়া বলে,
—ওহ, আচ্ছা!
মেহরিন বলে,
— হুম।
রাজ তখন বলে,
— এই সরো সরো! এখন আমার ‘বউ’ বউ পাচ্ছে! তাই এখন আমি বউয়ের সাথে যাচ্ছি। So don’t disturb me!”
সবাই হেসে ফেলে রাজের কথায়।
রাজ এগিয়ে গিয়ে মেহেরিনকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে, এক হাতে জড়িয়ে ধরে পিছন ফিরে বলে,
তোমাদের লজ্জা করে না? এখনো বিয়ে করতে পারলে না! আর একজন তো গন্ডাগিরি দেখিয়ে বিয়ে করে আসলো, তাও জামাইর ভালোবাসা পেলো না! বলি, তোমাদের লজ্জা করে না? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বড় ভাইয়ের প্রেম দেখছো! চোখ বন্ধ করো!
সবাই হেসে চোখ বন্ধ করে।
রাজ মেহেরিনের গালে ‘টুপ’ করে একটা চুমু খেয়ে বলে,
চলো বউ, আমার বোনগুলোকে ‘ফুপি’ বানাতে হবে। এখনো অনেক কাজ বাকি।
মেহেরিন হেসে বলে,
চুপ করুন, অসভ্য ঠোঁট কাটা লোক!
এদিকে সবাই চলে যায় যার যার মতো।
রাজ এদিক-ওদিক তাকিয়ে মেহেরিনকে কোলে তুলে নেয়, এবং রুমের দিকে হাঁটতে থাকে।
মেহেরিন রাজের গলায় হাত জড়িয়ে ধরে বলে,
আপনি এত অসভ্য কেন, কবি সাহেব?
রাজ মেহেরিনের ঠোঁটে একটা চুমু একে বলে,
দুই দিনের দুনিয়া। তাও যদি নিজের বউয়ের কাছে সভ্য হয়ে যায়, তাহলে বাচ্চার মুখে ‘বাবা’ ডাক আর শুনা হবে না! তাই আমি সভ্য হতে চাই না, বউ!
মেহেরিন হেসে বলে,
পাগল!
রাজ একটু ঝুঁকে বলে,
সেটা শুধু একজনের জন্যই।
মেহেরিন হাসে।
রুমে এসে রাজ মেহেরিনকে নামিয়ে দেয়।
রাজ বলে,
বউ, একটা আবদার ছিল… রাখবে?
মেহেরিন বলে,
হুম, অবশ্যই। বলুন।
রাজ বলে,
আমাকে বাবা হওয়ার সুখটা দেবে, বউ?
মেহেরিন রাজের কাছে আসে, দু’হাত ধরে বলে,
অবশ্যই দিবো, কবি সাহেব।
রাজ হেসে মেহেরিনের কপালে চুমু খায়।
মেহেরিন বলে,
জান, ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি কফি নিয়ে আসি।
রাজ ওয়াশরুমে ঢুকে।
মেহরিন দুই কাপ কফি হাতে ঘরে আসে।
ভেতর থেকে রাজ ডাকে,
—”বউ!”
মেহরিন হাসে,
—কিছু লাগবে?
রাজ বলে,
—তোয়ালেটা দাও তো!
মেহরিন বিছানা থেকে তোয়ালে নিয়ে এগিয়ে দেয়ার জন্য যেতে যেতেই বলে,
—তোয়ালে না নিয়েই চলে গেলেন!
রাজ হেসে বলে,
—এগুলো বউয়ের কাজ। বিয়ে করেছি, বউয়ের সুযোগ সুবিধা না নিলে চলবে?
মেহরিন চোখ রাঙিয়ে বলে,
—ঢং ধরণ!
রাজ তোয়ালের সঙ্গে মেহরিনকেও টেনে নেয়।
মেহরিন অবাক হয়ে বলে,
—আরে! এইটা কী করছেন? আজব তো! আমায় টানলেন কেন?
রাজ ভেজা গায়ে মেহরিনকে জড়িয়ে ধরে বলে,
—বউ! বউ পাচ্ছে তাই। পাগল করে দিচ্ছো আজকাল বউ। জানো, আমার কী হচ্ছে?
মেহরিন চোখ কুঁচকে বলে,
—কি হচ্ছে?
রাজ দুঃখী গলায় ফিসফিস করে,
—বউ ছাড়া সবকিছু অন্ধকার লাগে। মনে হয় আমি কানা হয়ে গেছি।খেলে খিদা লাগে না, ঘুমালে আবার চোখে দেখি না।
মেহরিন বলে,
—আর কত কী যে দেখতে হবে!
রাজ বাঁকা হেসে বলে,
—কি কি দেখতে চাও?
মেহরিন আঙুল তুলে বলে,
—এই দেখুন!
রাজ সেই আঙুলে হালকা কামড় দিয়ে বলে,
—দেখাও না! কী আর দেখাবে বলো তো? সব তো দেখা শেষ! তোমার শরীরে কয়টা তিল আছে, তাও জানি!
মেহরিন বলে,
—”ছিঃ!”
রাজ মুচকি হেসে বলে,
—ছিঃ!
হঠাৎই রাজ মেহরিনকে দেয়ালে ঠেসে ধরে।
—আমি কিছু বললেই ঢং! তাই না?
মেহরিনের হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। গলার শব্দ আটকে আসে।
রাজ মেহরিনের হাত ধরে নিজের বুকের ওপর রাখে।
মেহরিন গলায় গিলে নেয় কিছু শব্দ।
রাজ বলে,
মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৪৫
—কি জানি বলো তুমি, ওহ হ্যাঁ তুমি আমার অ্যাডামস অ্যাপলটা খুব পছন্দ করো, তাই না?
মেহরিন দুদিকে মাথা নাড়ে, রাজ মেহরিনের হাত অ্যাডামস অ্যাপলের ওপর রাখে।
মেহরিন চোখ বন্ধ করে নেয়।
রাজ মেহরিনের ঠোঁট আকড়ে ধরে। মেহরিন রাজের পিঠ খামছে ধরে।