মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৪৮
মির্জা সূচনা
তিনটা বাইক ছুটে চলেছে শুন-শান রাস্তায়।
গন্তব্য জানা নেই।
তারা শুধু ছুটে চলছে, বেপরোয়াভাবে,গন্তব্যহীন উদ্দেশ্যে।
হঠাৎ করেই আকাশ ভেঙে নামে বৃষ্টি।
তিনটি বাইক থেমে দাঁড়ায় রাস্তার পাশেই এক চায়ের টং দোকানের ছাউনিতে।
মেহরিন রাজের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলে,
— চলুন, চা পার্টি হয়ে যাক…
রাজ চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বলে,
— যথা আজ্ঞা মহারানী! আমার বউ চা খেতে চেয়েছে, আর আমি না করবো—এমন পাপ তো ভাবতেও পারি না!
রাজের কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে ওঠে—
— ও মাগো, টপ লেভেলের ‘টুরু লাভ’গো।
মেহরিন হেসে বলে,
— হয়েছে ড্রামা বন্ধ করুন! এখন এসব বাদ দিয়ে চলুন, চা খাই।
রিদ তখন বলে,
— তোমরা সবাই বসো, আমি চা নিয়ে আসছি।
সবাই মাথা নাড়ে।
সবাই চলে বসতে, কেবল দাঁড়িয়ে থাকে মেহের।
এটা দেখে রাজ কিছু বলতে যাবে,
ঠিক তখনই মেহরিন রাজের মুখ চেপে ধরে টেনে নিয়ে যায় একপাশে।
ওদিকে লাবিব মেহবুবার হাত ধরে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— চলো ল্যাদা বাচ্চা, আমরা একটু বৃষ্টি বিলাস করি!
খুব শখ ছিল তোমার সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজবো।
আজ মনে হয় প্রকৃতি সেই সুযোগটা দিয়ে দিল।
মেহবুবা শান্ত চোখে তাকায়।
তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
—আমার মুড টার ৪০শা না করলে শান্তি লাগে না, তাই না, বাদঁর?
লাবিব ভুরু কুঁচকে বলে,
— আরে রেগে যাচ্ছো কেনো? আমি তো…
মেহবুবা আঙুল তুলে বলে,
— চুপ! এইটা বলেই আশেপাশে তাকায়,
দেখে—রিদ আর মেহের চায়ের দোকানের দিকে।
আর রাজ, মেহরিনের সাথে খুনসুটিতে মগ্ন।
মেহবুবা লাবিবের হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় বৃষ্টিতে।
তারপর বলে,
—বৃষ্টি বিলাস ব্যাপারটায় তো একটা অনুভূতি থাকে, আবেগ থাকে।
সেইখানে আপনি আমাকে ‘ল্যাদা বাচ্চা’ বলে মুডের উপর কেরোসিন ঢেলে দিচ্ছেন!
লাবিব এতক্ষণে বুঝতে পারে আসল কারণ।
সে মাথা চুলকে হেসে বলে,
— তো এই ব্যাপার!
ম্যাডাম এই ডাকটা পছন্দ করেন না!
মেহবুবা বলে,
— একদমই না!
দেখেন না ভাইয়া, মেহুকে কী সুন্দর নামে ডাকছে—‘আমার বউ’, ‘মহারানী’!
আর আপনি?
সারাক্ষণ ভাইয়ার পাশে থাকেন, তাও এত ড্যামনাটিক কেন বলুন তো?
লাবিব নিজের দিকে আঙুল তুলে, ভুরু কুঁচকে মুখ বাঁকিয়ে বলে,
— আমি? আমি ড্যামনাটিক না!
ইউ মাইন, আমি আনরোমান্টিক?
মেহবুবা ১৪০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে মুখটা বাঁকিয়ে একটা মুখজামটা দেয়।
লাবিব তা দেখে হেসে বলে,
— নিজের ঠোঁটকে এত অত্যাচার করো না জানেমান!
ওটার উপর শুধু আমার অধিকার।
ওখানে চলবে শুধু আমার ঠোঁটের বিচরণ!
মেহবুবা চোখ বড় বড় করে তাকায়।
লজ্জায় কানে দিয়ে যেনো ধোঁয়া বেরোচ্ছে।
মুখটা আপনা আপনিই হা হয়ে গেল।
মেহবুবা সবসময় লাবিবকে ভদ্র ভেবে এসেছিল।
হ্যাঁ, এটা ঠিক—ঝগড়া করে পায়ে পা দিয়ে,
কিন্তু এমন কথা… এমন বার্তা…
যা সে ভাবতেও পারেনি লাবিব বলবে!
লজ্জা, অবাক, ভয়—সব অনুভূতিই একসাথে চেপে ধরে মেহবুবাকে।
মেহবুবাকে এমন কুঁকড়ে যেতে দেখে লাবিব বাঁকা হাসে।
তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
— লজ্জা, ভয় আর অবাক—এই তিনটা একসাথে হয়ে টাসকি খেলে নাকি?
তারপর আস্তে করে বলল,
— তুমি যখন লজ্জায় লাল-নীল হয়ে যাও, তখন আমার ঠিক কী হয়, সেটা তোমায় বলে বোঝাতে পারব না।
এতটুকু বলে মেহবুবার হাত ধরল লাবিব। মেহবুবা চমকে উঠল। এক অজানা অনুভূতি হল তার—ভালো লাগা আর ভয়, এই দুয়ের এক অদ্ভুত মিশ্রণে ওর বুকের ভেতরটা কেমন গুড়গুড় করে উঠল। হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল।
মাথা নিচু করে ফেলল মেহবুবা।
লাবিব মেহবুবার থুতনিতে হাত দিয়ে মাথা তোলে।
— তাকাও আমার দিকে, নবনীতা।
মেহবুবা চোখ তুলে তাকাতে পারল না।
লাবিব কোমল কণ্ঠে বলে,
— তুমি আমার নবনীতা। যে আমার হৃদয়ে বাসা বেঁধেছে, যে ভালোবাসার সৃষ্টি করেছে আমার মনের গহিনে। যার পাশে থাকলে নিজেকে সুখী মনে হয়। যার চোখে তাকালে ডুবে যেতে ইচ্ছে করে। যার গোলাপি রাঙা ঠোঁটের হাসি,আমার বিষন প্রিয়। তার ঝগড়া, বকা—সবই আমার ভালো লাগে। আমি যাকে করেছি মনের রাজকোঠার রাজরানী । যাকে সারাজীবনের জন্য চেয়েছি। যাকে ভালোবেসেছি প্রথম দেখাতেই।
অনেক মেয়ে দেখেছি, একসাথে কাজও করেছি, কেউ আমাকে ছুঁতে পারেনি।
কিন্তু তুমি? এক পলক দেখা দিয়েই ছুঁয়ে দিলে আমার মন।
সেদিনের শাড়ি পরা সেই রমণীটাই আমার নবনীতা।
মেহবুবা স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে আছে লাবিবের চোখে। সে চোখে নিজের জন্য নিখুধ ভালোবাসা দেখতে পেল।
লাবিবের প্রতিটা কথা যেনো মেহবুবার মনে গেঁথে গেল।
অচানক চোখ বেয়ে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।
লাবিব হেসে সেই জল মুছে দিয়ে বলল,
— কি হলো?
মেহবুবা কাঁপা গলায় বলল,
— আপনি আমাকে প্রথম দেখাতেই ভালোবেসেছেন—তা তো কোনোদিন বলেননি।
— বলব কেন? বুঝতে পারোনি আমার ব্যবহারে?
মেহবুবা দুদিকে মাথা নাড়ে।
লাবিব মাথায় ঠুক করে টোকা মেরে বলে,
— বুঝবে কীভাবে, মাথায় কিছু আছে নাকি? একদম ফাঁকা তো ল্যাদা বাচ্চা একটা।
মেহবুবা রাগে চোখ বড় বড় করে তাকায়।
লাবিব হেসে বলে,
— থাক, তোমাকে বুঝতে হবে না। সময় মতো সব বুঝিয়ে দেবো। বুঝলে, ল্যাদা বাচ্চা?
মেহবুবা চটে যায়।
— কি পেয়ে গেছে এই খবিশ বেডা! এতক্ষণ কী সুন্দর প্রেমের কথা বলছিল, আর এখন এই ‘বা*ল’ নাম দিয়ে ডাকছে! আমার রোমান্টিক মুডে এক বালতি গরম পানি ঢেলে দিলো!
সে আঙুল তুলে বলে,
— তোর সাথে কথাই বলব না! বিয়েও করব না তোকে…আমার চোখের সামনে থেকে সর বা*ল।
বলে সে ঘুরে চলে যেতে যায়।
লাবিব হাত ধরে ফেলে,
আর এক গান ধরে,
ঝুমকা দিলাউংগা…
কাংগনা দিলাউংগা..
সবকুছ মে লাউংগা তেরি কাসম..
চান্দা চুরাউঙ্গা…
তারে বিহ লাউঙ্গা…
সুরাজ ঝুকাউঙ্গা তেরি কাসম …
কাভি তো মেরি জান দিবানি বানোঙ্গি….
মুঝসে শাদি কারোগি …..
ও মুঝসে শাদী কারোগি…..
গান শেষ হতেই মেহবুবা হেসে ফেলে।
আর লাবিব বুকে হাত দিয়ে বলে,
— ইস্, এই হাসি একদিন আমার মৃত্যুর কারণ হবে।
এই কথা শুনেই মেহবুবার বুক ধক করে ওঠে। রাগে ও ওঠে।
ঠাস করে এক চড় বসায় লাবিবের গালে!
লাবিব গালে হাত দিয়ে বলে,
— এটা কী হলো?
মেহবুবা বলে,
— একদম ঠিক হয়েছে! তোকে এমনটাই করা উচিত। বিয়াদব ছেমড়া! এখনো বিয়েই করলাম না, ১০–১২টা বাচ্চার মা হলাম না, নাতি-নাতনির মুখ দেখলাম না—তার আগেই মরার কথা বলিস! এই যা,তুই রিজেক্টেড! তোকে বিয়ে করব না!
তবে সব কথার ভিড়ে লাবিব শুধু একটাই কথা ধরলো—
“১০–১২টা বাচ্চার মা!”
চোখ ছোট ছোট করে বলে,
—তুমি ১০–১২টা বাচ্চার মা হতে চাও? কুলাতে পারবে তো?
মেহবুবা থতমত খেয়ে যায়। রাগের মাথায় কী বলে ফেলেছে, টেরই পায়নি! তার ওপর লাবিবের এমন কথা! সে আমতা আমতা করে বলে,
— হে….হে… হুঁ… আমি ১০–১২টা বাচ্চারই মা হবো!
বলে সেখান থেকে এক প্রকার দৌড়ে চলে যায়।
লাবিব সেটা দেখে হেসে কুটি কুটি।
আর মেহবুবা, জিভ কেটে নিজের মাথায় গাঁট্টা মারে—
— ছিঃ ছিঃ ছিঃ ! আমি কী বললাম এইটা!
এগুলো বলতে বলতে চলে আসে মেহবুবা।লাবিব ও চলে এসেছে মেহবুবার পাশে পাশে। এতক্ষণে রিদ হাতে চা নিয়ে এসেছে সবার জন্য। মেহবুবা আর লাবিবকে ভিজে দেখে মেহরিন বলল,
— তোরা বিজলি কেমন করে?
মেহবুবা হাত কচলায়, কিছু একটা বলবে ঠিক তখনই লাবিব ঢুকে পড়ে,
— ভাবি, আমি আমার হবু বউকে নিয়ে একটু বৃষ্টি বিলাস করতে গেছিলাম।
গাল হাত বুলাতে বুলাতে আরও যোগ করল,
— দুর্ভাগ্যবশত, থাপ্পড় বিলাস করে আসলাম।
লাবিবের কথায় সবাই হেসে ওঠে। কেউ কমেন্ট ছাড়ে, কেউ আবার চুমুক দেয় চায়ে আর গল্প চলতেই থাকে। সবাই সবার পিছে লেগেই আছে যেনো।
ঠিক তখনই মেহের চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে হঠাৎ উঠে বৃষ্টিতে চলে যায়।
রাজ গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
— বাবা রিদ, যাও ব্যাটা যাও। একটু পিরিত বিলাস করে আসো তোমার গুণ্ডা বউয়ের সাথে।
রিদ হালকা হেসে বলে,
— পিরিত বিলাস?
রাজ বাঁকা হেসে বলে,
— ওই হলো বৃষ্টি বিলাস আর কি! যা যা!
রিদ ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বলে,
— বৃষ্টি বিলাস হোক বা পিরিত বিলাস—সব বিলাশ আমি তার সাথেই করতে চাই পিও।
রাজ হেসে বলে,
— ভাই, বাথরুম বিলাসও করতে পারিস। অনুমতি দেওয়া হলো।
রিদ খুকখুক করে কেশে উঠে। মেহবুবা আর মেহরিন লজ্জায় পড়ে যায় এইসব কথায়। দুজন দুদিকে তাকিয়ে থাকে।
লাবিব দাঁত বের করে বলে,
— আরেকটা বিলাসও করতে পারো।
রিদ হাত জোড় করে বলে,
— ভাই, খমা কর। তুই আর উল্টা পাল্টা কিছু বলিস না।
এই বলে রিদ চলে যায় মেহেরর কাছে।
ওদের এ অবস্থা দেখে চারজন হেসে ওঠে। হাসির গুনগুনে ছায়া মিশে যায় বৃষ্টির শব্দে। বৃষ্টিবিলাস, ভালোবাসা, আর দুষ্টামির এই মুহূর্তে যেনো সব একসাথে জীবন্ত হয়ে ওঠে।
হঠাৎ রাজ লাবিবকে বলল,
—এই যা এখান থেকে, আর হে, যাওয়ার সময় তোর বউটাকে নিয়ে যা। আমার এখন বউ বউ পাচ্ছে।
মেহরিন রাজের পিঠে এক থাপ্পর দিয়ে বলল,
— চুপ করুন! সভ্য, ছোট ভাইবোনদের সামনে কী বলছেন হে?
লাবিব হেসে বলে,
— থ্যাংকস, তোমার বউ বউ পাওয়ার জন্য! এই সুযোগে আমিও একটু ‘বউ’ মানে ‘হবু বউ’র সাথে সময় কাটাতে পারব।
রাজ এক হাত তুলে দরবেশদের মতো ভঙ্গিতে বলল,
— যাও, বৎস! দিলাম দোয়া কইরা। বউ নিয়া খাইবা, ভিক্ষা কইরা!
মেহবুবা ‘হা হা’ করে হেসে ওঠে। মেহরিনও হেসে ফেলে।
লাবিব মেহবুবার দিকে তাকিয়ে বলে,
— তুমি দাঁত বের করছো, শুনলে না , তোমার দুলাভাই কী বললো?
মেহবুবা হেসে বলে,
— আমি ভিক্ষা করবো না, আপনি জান!
লাবিব মেহবুবাকে কোলে তুলে নেয়, আর বলে,
— তুই যাবি? তোর ঘার যাবে বেডি?
মেহবুবা লজ্জায় আর রাগে ফুঁসফুঁস করছে, আবার ভালোও লাগছে, রাগও লাগছে। মেহরিন হাসে।
রাজ বলে,
— অরে শালা, বিয়ের আগে আমার শালীকে কোলে নিলি কেন? তোর সিস্টেমে প্রবলেম আঢ়ে। তোকে শালী দিবো না আমি! রেখে যা ওকে।
লাবিব মেহবুবাকে বলে,
— চলো পালাই!
এই বলে সে সোজা বেরিয়ে যায় মেহবুবাকে নিয়ে।
ওরা চলে যেতেই রাজ একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
— যাক বাবা, আপদগুলো বিদায় হলো।
মেহরিন হেসে ওঠে। রাজ মেহরিনের কাছে গিয়ে বলে,
— জিরো ওয়ান সেভেন—একটু ভালোবাসা দিবেন?
মেহরিন হেসে রাজের গালে একটা চুমু খেয়ে বলে,
— জিরো ওয়ান নিন।
রাজ হেসে বলে,
— আরে বাসসসস! বউ দেখি আমার রোমান্টিক হয়ে গেছে!
মেহরিন হেসে বলে,
— আপনার বউ আনরোমান্টিক ছিল কবে?
রাজ মেহরিনের নাকে নাক ঘষে দিয়ে বলে,
—হাচা নি?
মেহরিনও রাজের নাকে নাক ঘষে দিয়ে বলে,
— হুঁ, হাচাই কইতাছি!
রাজ হেসে ওঠে।
ওদিকে রিদ মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলে,
— ম্যাডাম, এই অধমকে কি আপনার বৃষ্টিবিলাসের সঙ্গী করা যায়?
মেহের চোখ তুলে তাকায়। রিদ-এর চোখে চোখ রাখে, আর বলে,
— যেখানে জীবনসঙ্গী করে নিয়েছি, সেখানে বৃষ্টিবিলাস করার জন্য সঙ্গী হতে পারবেন কি না, এটা জিজ্ঞাসা করছেন মশাই?
রিদ হালকা হাসে, বলে,
— আমার জায়গায় থাকলে বুঝতেন, ম্যাডাম। যেখানে সামান্য দুলাভাইয়ের উস্কানিমূলক কথাতেই আমার বউ আমাকে জোর করে তুলে নিয়ে গান পয়েন্টে রেখে বিয়ে করে ফেলতে পারে—সেখানে আমি যদি তার অনুমতি ছাড়া বৃষ্টিবিলাস করি তার সঙ্গী হয়ে। তাহলে গুলি মেরে আমার খুলি উড়িয়ে দেবে না, তার গ্যারান্টি কে দেবে বলেন তো? এখনো বাসর করা বাকি, আর আমি ভার্জিন থাইকেই মরতে চাই না!
মেহের অবাক হয়ে বলে,
— আআআআ!
রিদ খুব শান্তভাবে উত্তর দেয়,
— হে।
রিদ মেহেরের কপালে একটা টোকা দেয়।
মেহের কপালে হাত বুলাই।
রিদ একটা গান ধরে,
সা নি সা সা সা সা সা রে
সা সা সা সা সা রে
সা রে ধা পা নি।
সা রে ধা পা নি
সা নি সা সা সা সা সা রে
সা সা সা সা সা রে
প্রেমের কাহিনী।
ওহো ,,,,হো,,,,হো,,,
রিমঝিম এ ধারাতে,
চায় মন হারাতে।
রিমঝিম এ ধারাতে,
চায় মন হারাতে।
এই ভালোবাসাতে
আমাকে ভাসাতে।
এলো মেঘ যে ঘিরে এলো
বৃষ্টি সুরে সুরে
সোনায় রাগিনী।
মনে স্বপ্ন এলোমেলো
এই কি শুরু হলো
প্রেমের কাহিনী।।
এলো মেঘ যে ঘিরে এলো
বৃষ্টি সুরে সুরে
শোনায় রাগিনী
মনে স্বপ্ন এলোমেলো
এই কি শুরু হলো
প্রেমের কাহিনী।।
রাজ মেহরিনকে কোলে নিয়ে নেমে আসে আর গানটির পরের কলি গায়।
রিম ঝিম ধরাতে
চায় মন হাড়াতে
রিম ঝিম ধরাতে
চায় মন হাড়াতে
আগে কত বৃষ্টি যে
দেখেছি শ্রাবণে।
জাগেনি তো এতো আশা
ভালোবাসা এ মনে
হো,,আগে কত বৃষ্টি যে
দেখেছি শ্রাবণে।
জাগেনি তো এতো আশা
ভালোবাসা এ মনে
সেই বৃষ্টি ভেজা পায়েও
সামনে এলে হায়
ফোটে কামিনী।
আজ ভিজতে ভালো লাগে
শূণ্য মনে জাগে
প্রেমের কাহিনী।।
সেই বৃষ্টি ভেজা পায়ে
সামনে এলে হায়
ফোটে কামিনী।
আজ ভিজতে ভালো লাগে
শূণ্য মনে জাগে
প্রেমের কাহিনী।।
রাজের গাওয়া শেষ হতেই লাবিব নেমে আসে মেহবুবাকে তার পর লাবিব পরের কলি ধরে,
রিম ঝিম ধরাতে
চায় মন হাড়াতে
রিম ঝিম ধরাতে
চায় মন হাড়াতে
শ্রাবণের বুকে প্রেম
কবিতা যে লিখে যায়।
হৃদয়ের মরু পথে
জলছবি থেকে যায়।
হো,,শ্রাবণের বুকে প্রেম
কবিতা যে লিখে যায়।
হৃদয়ের মরু পথে
জলছবি থেকে যায়।
জানি সেই তো ছিল আগে
ঘুমে অনুভবে
স্বপ্নচারিনী।
আজ রাগে অনুরাগে
লেগে বৃষ্টি দাগে
প্রেমের কাহিনী
জানি সেই তো ছিল আগে
ঘুমে অনুভবে
স্বপ্নচারিনী।
আজ রাগে-অনুরাগে
লেগে বৃষ্টি থাকে
প্রেমের কাহিনী।।
রিদ আবার গায়,
রিম ঝিম ধরাতে
চায় মন হাড়াতে
রিম ঝিম ধরাতে
চায় মন হাড়াতে
এই ভালোবাসাতে
আমাকে ভাসাতে
এলো মেঘ যে এলো
ঘিরে বৃষ্টি সুরে সুরে
শোনায় রাগিনী
মনে স্বপ্ন এলোমেলো
এই কি সুরু হলো
প্রেমের কাহিনী
এলো মেঘ যে এলো
ঘিরে বৃষ্টি সুরে সুরে
শোনায় রাগিনী
মনে স্বপ্ন এলোমেলো
এই কি সুরুহলো
প্রেমের কাহিনী
রাজ গায়,
রিম ঝিম এ ধরাতে
চায় মন হাড়াতে
রিম ঝিম এ ধরাতে
চায় মন হাড়াতে
তিন জোড়া পাখি বৃষ্টিবিলাসে মেতে ওঠে একসাথে।
সবাই হাসছে, গান চলেছে…
শেষে মেহরিন বলে উঠল,
— আমাদের জীবন এভাবেই কাটুক… একসাথে, আনন্দে।
কারো বদ নজর যেনো আমাদের জীবনে না পড়ে।
সবাই উচ্চস্বরে বলে উঠল,
— “আমিন!”
রাজ বলে,
— চলো সবাই, বাড়ি ফিরে যাই। অনেক রাত হয়ে গেছে, আর আমরা অনেক ভিজেও গেছি!
সবাই যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে।
এতক্ষণে বৃষ্টিও কমে এসেছে।
রাজ, মেহরিন, লাবিব, মেহবুবা, রিদ আর মেহের—সবাই বাইকে উঠে বসে।
যেই স্টার্ট দিবে, এমন সময় সাতটা বাইকে মোট ১৩ জন।
২৫-২৬ বছর বয়স আনুমানিক, সবার হাতে কমবেশি অস্ত্র।
মেহরিন কপাল চাপড়ে বলে,
— আবার!
রাজ বাঁকা হাসে।
রিদ রাজকে উদ্দেশ্য করে বলে,
— এই নমুনারা আবার কে ব্রো?
রাজ হাসে,
— বুঝলি তো ভাই, এই পর্যন্ত বউ নিয়ে যতবার রাতে ঘুরতে বের হয়েছি, ততবার কেউ না কেউ ব্যাঘাত ঘটিয়েছেই ভাই! এই দুঃখ কই রাখি?
কই রাখি বলত—
লাবিব বলে,
— দুঃখ না, না রাখে ওদের দিয়ে দাও। ওরা সেগুলো বেচে বড়লোক হয়ে যাবে!
রিদ ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে,
— তাহলে চল ভাই, একটু ব্যায়াম করে নিই।
রাজ ভ্রু কুঁচকে বলে,
— তুই তো ভদ্র বেটা, তুই এই ব্যায়াম কেমনে করবি?
রিদ বলে,
— আরে বেটা, ভদ্রতা সবাই বুঝে নাকি?
মেহরিন ওই লোকগুলোর হাবভাব দেখছে।
মেহের ভ্রু কুঁচকে তাদের পর্যবেক্ষণ করছে।
আর মেহবুবা ভয়ে লাবিবের শার্ট খামচে ধরে আছে।
ওই বাইকগুলো একদম সামনে চলে আসে।
বাইক থেকে নেমে ওরা অস্ত্র হাতে এগিয়ে আসে।
রাজ, রিদ, লাবিব—সবাই তখন বাইক থেকে নেমে দাঁড়িয়ে গেছে।
লোকগুলো সামনে এসে বলে,
—রাত বিরেতে রাস্তাঘাটে নোংরামি করে বেড়াচ্ছিস কেন?
রাজ ঠান্ডা গলায় বলে,
— বউ নিয়া এসেছি। নোংরামি করি আর চুম্মাচুম্মি করি—তাতে তোর এত চুলকাচ্ছে কেন? বেশি চুলকালেই গিয়ে মলম লাগা তো বাপ! আমাদের বিরক্ত করিস না।একটু প্রেম করতে দে বাপ।
এই কথায় মেহবুবা ফিক করে হাসি দেয়।
লোকগুলো অপমানবোধ করে।
একজন তেরে এসে রাজের দিকে ঘুষি মারতে যাবে—
তার আগেই উল্টে পড়ে যায়।
রাজ স্বাভাবিকভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে।
কিন্তু বাকিরা মেহরিনের দিকে তাকিয়ে থাকে,
কারণ লোকটা উল্টে পড়ার প্রধান কারণ ছিল মেহরিনের লাথি।
রিদ মেহেরের দিকে তাকায়।
মেহের হাসিমুখে তাকিয়ে আছে মেহরিনের দিকে।
মেহরিনের দিকে মেহবুবা মুখ হাঁ করে তাকিয়ে।
লাবিবও একই রকম।
রিদ আগেই জানে,
মেহরিনের মারামারির ব্যাপারে অনেকবার দেখেছে সে—
তাই তেমন অবাক হয় না।
লাবিব শুনেছিল কিন্ত আজ তো রীতিমতো লাইভ দেখছে এখন।
ওই লোকগুলো রীতিমতো চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে।
প্রতিটা মুখ যেনো ভূত দেখছে!
লোকগুলোর মধ্যে একজন হঠাৎ ছুরি ছুঁড়ে মারে রিদের দিকে।
মেহের সেটা ধরে ফেলে আর মুখ দিয়ে “চু চু” শব্দ করে সেই লোকের ঠিক কপালের মাঝ বরাবর ছুরি মারে বলে,
এই সব আবাল নিয়ে এসেছে মারা মারি করতে ছিঃ।
সেকেন্ডের মধ্যে লোকটা মাটিতে পড়ে যায়।
মেহরিন বলে,
— ওয়েল ডান! তুই দেখি কিছুই ভুলিসনি!
মেহের হেসে বলে,
— গুলো এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে চলবে?
রাজ, লাবিব আর রিদের চোখ ছানাবড়া!
তিনজন ভূত দেখার মতো করে তাকিয়ে থাকে।
মেহরিনের ব্যাপারটা তো মানে, অনেক কষ্টে হজম করেছে এখন।
মেহের কেমন করে?
হঠাৎ মেহের বলে,
— মেহু!
মেহরিন বলে,
— I am ready!
এটা বলার সাথেসাথেই মেহের বলে,
— Okay, let’s start!
এটা বলেই মেহরিন আর মেহের এগিয়ে যায় সেই লোকগুলোর সামনে।
আর সেই লোকগুলো মারবে কি…
ওরা তো দুই মেয়ের এমন মারামারি দেখে হতাশ!
মেহরিন আর মেহের নিজেদের প্যান্ট একটুখানি তুলে নেয়। জুতোর ভেতর থেকে দু’জন বের করে একধরনের ধারালো চুরির মতো দেখতে কিছু একটা।
আর দেরি করে না—দু’বোন একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই লোকগুলোকে ঘিরে। ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটে যায় যে, লোকগুলো কিছু বুঝে ওঠার আগেই একে একে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তারা।
মেহরিন আর মেহেরের এমন রূপ দেখে আশপাশের সবাই থ।
রাজ, রিদ, লাবিব, মেহবুবা—সবাই হা করে তাকিয়ে থাকে।
তাদের দিকে না তাকিয়ে দুই বোন চুপচাপ কাজ শেষ করে একে অপরকে হাই-ফাই দেয়। অস্ত্রটা আবার আগের জায়গায় রেখে দেয় নিখুঁতভাবে।
তারপর ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে আসে।
রাজ কাঁপা গলায় বলে,
— এ…..টা কী…. ছিল..?
রিদও একই সুরে বলে,
— আ….আমারও একই প্রশ্ন…
মেহরিন আর মেহের একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে।
তারপর বলে,
— সিক্রেট!
মেহরিন আবার বলে,
—তবে সময়মতো জানতে পারবেন।
তারপর মেহরিন লাবিবের দিকে তাকিয়ে বলে,
—ওদের ব্যবস্থা করো।
লাবিব মাথা নাড়ে।
মেহের নিজের চুল পেছনে ঠেলে দিয়ে বলে,
— ইশ্! কতদিন পর এমন করে এনজয় করলাম, মেহু।
মেহরিন হাসে,
— আমি আরেকদিন পেয়েছিলাম।
মেহের হেসে ফেলে।
এদিকে বাকিরা এখনো তব্দা খেয়ে আছে।
মেহের হেসে বলে,
— চিল, একটা বাদে সব বেঁচে থাকবে।
এদিকে রাজ রিদের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে,
— ভাই, সাবধান! তোর বউ কিন্তু পুরোই ‘সাইকো’। সাবধানে দেখিশ বেশী রাগ তুলিস না, না হলে তোরা ওর ওটা কেটে দিবে!
রিদ বলে,
— চুপ কর শালা! ভয় দেখাস না!
রাজ বলে,
— ভাই, এখন তো বউকে কিছু বলতেও ভয় করবে কখন জানি ওটা বের করে আমার বুকে চালিয়ে দেয়!
ওদের কথা শুনে লাবিব একটা ঢোক গিলে মেহবুবার দিকে তাকায়।
আর দেখে মেহবুবা কাঁপছে।
তা দেখে লাবিব একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে মনে মনে বলে,
— যাক বাবা! আমার বউ তাহলে এমন ভায়োলেন্ট না!
মেহরিন বলে,
— চলো, সবাই বাড়ি ফিরি। ঠান্ডা লাগলে আম্মু বকবে।
রাজ রিদকে বলে,
— দেখলি ভাই, এতগুলো মানুষকে কি মারটাই না দিল!এ কিছুই না ওদের কাছে, আম্মু বকা দেবে—এই চিন্তা করছে!এরা কি সাধারণ মানুষ নাকি অন্য কিছু?
রিদ গম্ভীর গলায় বলে,
— ভাই, আমারও তাই মনে হয়—এরা দুইটা মানুষ না, অন্য কিছু…এদের শরীরে মানুষের রক্ত না… জিন টিনের।
রাজ বলে,
— আস্তে বল, ভাই! যদি শুনে ফেলে, তোর সাথে সাথে আমিও ফাঁসব!
রিদ চুপ করে যায়।
ওদের এই ফিসফাস দেখে মেহের মেহরিনকে কানে কানে বলে,
— মনে হচ্ছে, আমাদের এই রূপ হজম হচ্ছে না।
মেহরিনও বলে,
—একটু টেনশন নিতে দে, সময়মতো সব জানবে!
মেহের হাসে।
তারপর সবাই বাড়ির পথে রওনা হয়।
রিদ আর লাবিব এক রুমে।
আর বাকিরা যে যার ঘরে চলে যায়…
সকাল ৮টা।
সবাই টেবিলে বসে আছে নাস্তা করার জন্য—
মেহরিন, রাজ, লাবিব, মেহবুবা, রিদ, মেহের…মাহির,লাবিবা,ফিরোজ মির্জা,মালিহা মির্জা।
সবার শরীরেই ঠান্ডা আর জ্বরের প্রভাব।
একজনের হাঁচি কমে তো আরেকজনের বাড়ে।
এই অবস্থা দেখে মালিহা মির্জা বিশাল চটে আছেন।
একটানা দমকে সবাইকে একসাথে বকে যাচ্ছে,
— সব কটা বাচ্চা হয়ে গেছো! এই তোমরা জানো না, বৃষ্টিতে বেশি সময় থাকলে জ্বর আসে? বলো, জানো না?
সবাই একসাথে বলে,
— “Sorry…”
মালিহা মির্জা কিছু বলতে যাবেন,
ঠিক তখনই সবাই একসাথে হাচি দেয়।
তিনি বিরক্ত হয়ে কপাল চাপড়ান।
তারপর কিছু না বলে গরম গরম আদা লেবু চা বানিয়ে এনে দেন সবার জন্য।
আর বলেন,
— এইটা খাও। আমি ওষুধ নিয়ে আসছি। নাস্তা করে খেয়ে নিবে সবাই।
সবাইকে বকা খেতে দেখে মাহির আর লাবিবা মিটি মিটি হাসছে।
এদিকে পাশ থেকে ফিরোজ মির্জা বলেন,
—তোমাদের সময় এখনই… এনজয় করো, কিন্তু নিজের প্রতি যত্নশীল হও।
আর ওই ‘ভদ্র মহিলা’র কথা কানে নেওয়ার দরকার নেই।
সবাই মুখ টিপে হাসে।
ঠিক তখনই মালিহা মির্জার গলা শোনা যায়,
— কি বললে তুমি?
ফিরোজ মির্জা হকচকিয়ে বলেন,
— কই… কিছু না তো… বলছিলাম যে… তোমার কথা শুনতে!
তাই না বাচ্চারা।
সবাই মাথা নারে।
মালিহা মির্জা চোখ কুঁচকে বলেন,
— তাই নাকি?
মাহির বলে,
— না মা, বাবা তোমার নামে নিন্দা করছিল!
ফিরোজ মির্জা গম্ভীর গলায় বলেন,
— বাপ, তুই তো দেখি ঘরের শত্রু বিভীষণ!
এই বলে তিনি অফিস ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে এক দৌড়ে বেরিয়ে যান।
পেছন থেকে মালিহা মির্জার গলা,
— পালাচ্ছো কেন? কি বললে? বলো, কি নিন্দা করছিলে, হে বলে যাও??
ফিরোজ মির্জা আর পেছনে না তাকিয়ে বেরিয়ে যান।
সবাই হেসে ফেলে।
রাজ, রিদ আর লাবিবকে বলে,
— দেখলি, শ্বশুরমশাইও শাসু মাকে দেখে ভয় পায়! তাহলে আমরা কোন বাল?
রিদ বলে,
মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৪৭
—যা বলেছিস! কাল যে রূপ দেখালো, তারপরও যদি ওদের কথা না শুনে চলি, তাহলে কি হবে বুঝতে পারিস?
লাবিব হাঁফ ছেড়ে বলে,
— আমি বেঁচে গেছি ভাই!
রাজ আর রিদ মাথা নাড়ে।
আর মেহরিন আর মেহের…
ওরা হেসে যায়।