মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৭৬

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৭৬
মির্জা সূচনা

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামছে। ঘড়ির কাঁটা তখন ৭টা ২৫ মিনিট ছুঁই ছুঁই।
ঘরভর্তি নিস্তব্ধতা শুধু মেহরিনের রাগের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সে এমনভাবে ফুঁসছে যেন একটু পরেই বিস্ফোরণ ঘটবে। মেহরিন রেগে বোম হয়ে আছে। অতিরিক্ত রাগ করেছে কিনা এটা বুঝে কাও আসছে না মেহরিনের আসেপাশে। শুধু চুমকি, একবার এসে মাহিনকে নিয়ে গেছে। আর মেহরিন মাহিমকে ঘুম পারাচ্ছে।
এমন সময় আল্লাহ রসুলের নাম নিয়ে, আয়াতুল কুরসি পড়তে পড়তে ঘরে ঢুকে রাজ। মুখে সেই চিরচেনা হাসি।
মেহরিন এখনো খেয়াল করেনি। ঘরে ঢুকেই রাজ শার্টটা আস্তে করে খুলতে থাকে। এটা দেখলেই বউ আবার খেপে যাবে কিনা, প্রয়োজনে এই শার্ট আগুনে পোড়াবে।

আর জীবনে কোনোদিন ব্ল্যাক শার্ট পরবে না! শার্ট কেন? আজ থেকে জীবন থেকেও ব্ল্যাক কালার কেটে দেবে।
কিন্তু শেষরক্ষা আর হলো না।
শার্টটার ওপরে দুইটা বোতাম খুলতেই, এমন সময় মেহরিনের গলা পাওয়া গেল—
খবরদার! ওই শার্ট খুলবি না!
রাজ চোখ বন্ধ করে আল্লাহকে ডাকে—
হে আল্লাহ, এইবারের মতো বাঁচাই দাও। কথা দিচ্ছি, দশ হাজার মানুষ খাওয়াবো।
তারপর মেহরিনের দিকে ফিরে হাসি মুখে বলে,
কেনো বউ, এটা তো খুবই বিদঘুটে কালার।ভাবছি, এটা পুরাই ফেলব। আর সাথে এটাও প্রতিজ্ঞা করেছি, ইহকালে আমি আর ব্ল্যাক কিছুই পরবো না। ভালো ভেবেছিনা বলো?
মেহরিন বাবুকে আস্তে করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে উঠে আসে। এসেই রাজের শার্টের বোতামগুলো লাগাতে লাগাতে হেসে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

না রে পাগলা, আজ থেকে তুই শুধু ব্ল্যাকই পরবি। প্রয়োজনে এগুলো সুপারগ্লু দিয়ে আটকে দিবো তোর শরীরে। খুউ শখ না? মেয়েদের দেখানো! আজ সেটা বের করবো।
রাজ কাদু কাদু মুখ করে বলে—
বউ, আমি তো কিছু করি ন….
কথা আর শেষ করতে পারলো না। তার আগেই ঘর কাঁপিয়ে এক থাপ্পড় মারলো মেহরিন।
রাজ গালে হাত দিয়ে মুখটা একটু সাইড করে বলে—
ওরে আল্লাহ গো! এই মেয়ের গায়ে তুমি এত জোর কেনো দিলা গো! ইসস্, আমার দাঁত বুঝি একটাও নাই। ও মা গো, উফ্ রে!
তারপর আবার মেহরিনের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলে—

বউ, তুমি ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করোনো না, তাই না? তোমার হাতের জোর তো একদম কমে গেছে। দাঁড়াও, আমি তোমার জন্য একটু মালটার জুস করে আনি। খেয়ে শক্তি বাড়বে, তখন আরো একটা থাপ্পড় দিয়ো।
এটা বলে সে পা বাড়াতে চাই বাহিরের দিকে, মূলত সে ভাঙতে চেয়েছিল। ভেবেছিলো এখন আর বউয়ের সামনেই আসবে না রাগ টা একটু পরলে আসবে, কিন্তু তা আর হলো না।
রাজ যে পা বাড়াবে, এমন সময় মেহরিন রাজের চুল ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে—
জোর কমে গেছে তাই না? তাহলে আয় এইবার দেখাই জোর কমছে কিনা।
এমন কথা শুনে রাজ ঢোক গিলে। মনে মনে বলে,

আরেকটা থাপ্পড় যদি খায়। আমি রাজ অজ্ঞান হয়ে যবো সিউর! বউয়ের হাত তো নয়, যেন লোহার টুকরা। আচ্চা! সাধারণত হাত ধরলে তুলার মতো নরম লাগে। তাহলে মারার সময় এত শক্ত হয় কেমন করে! না বউয়ের মুড ভালো হলে এটা জিজ্ঞেস করতে হবে।
মেহরিন চুলগুলো মুঠি করে ধরে ঘুরাতে ঘুরাতে বলে—
হট, তাই না?
রাজ মাথা নেড়ে বলে—
না না, বউ, আমার বাপ-দাদার চৌদ্দ গুষ্টিতে কোনো হট ছেলে নেই। আমি তো বরফের মতো ঠাণ্ডা।
মেহরিন আবার বলে—
হ্যান্ডসাম?
রাজ বলে—
না না, একদমই না।
মেহরিন আবার বলে—
চকলেট বয়?
রাজ মাথা নেড়ে বলে—

না না, এটা নিছকই ভুল কথা। চকলেট হলে তো তুমি এতদিনে খেয়ে ফেলতা তাই না। আমি তো মানুষ, চকলেট কেমন করে হবো বউ?
মেহরিন ছেড়ে দিলো রাজের চুল। শার্টের কলার ধরে আগুন চোখে তাকিয়ে বললো—
তুই এক মাস আমার রুমে ঢুকবি না। তোকে যদি আমার রুমের আসেপাশেও দেখি, আই প্রমিস জানে মেরে ফেলবো।
রাজ দুই দিকে মাথা নেড়ে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই এক ধাক্কায় ঘর থেকে বের করে দিলো মেহরিন। রাজ কিছু বলতে এগিয়ে আসে তা দেখে মেহরিন মুখের ওপর দরজা আটকে দিলো।
মেহরিন আবার চলে গেল মাহিমের কাছে।
বাপকে থাপ্পড় মারার শব্দে মাহিম উঠে গেছে। মেহরিন গিয়ে তাকে শান্ত করে।
ওদিকে রাজ গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকে। আর সেই মেয়েকে গালি দেয় ইচ্ছেমতো।
হঠাৎ রাজ বলে ওঠে—

আরেহ,আমি একা কেনো বউ আর মাইর খাবো? বউ থেকে আলাদা থাকবো? আর বাকিরা বউয়ের সাথে। না তাহলে তো হলো না। বউয়ের মাইর আমি খেয়েছি, মাইর সবাই খাবো। বউ থেকে দূরে সবাই থাকবে। আমি সমতা বঝাই রাখার মানুষ। আমার উচিত নিজ দায়িত্বে সব জমাই-বউকে আলাদা করা। যা হবে সব সমান সমান, আমি বউয়ের হাতে মাইর খাব বাকিরা খাবে না, তা হবে না তা হবে না।
হঠাৎ রাজ বাঁকা হেসে বলে—

আমি একা থাকলে, বা আমি মাইর খাইছি জানলে সবাই মজা নেবে না। আমি রাজ শিকদার—কারো মজার পাত্র হইনি, হবোও না। বউকে ছাড়া একা থাকতে কষ্ট হবে। তাই সবাইকে নিয়েই থাকতে হবে।
এটা বলেই সে শিষ বাজাতে বাজাতে চলে যায়। সব পুরুষের জীবনে ঘূর্ণিঝড় আনতে।
রাজ শিষ বাজাতে বাজাতে হেলে দুলে প্রথমেই গেলো মেহেরের কাছে। গিয়ে দরজায় নক করে।
মেহের রাজকে দেখে অবাক হয়ে বলল—
কী হয়েছে ভাইয়া? Any problem?
রাজ একটা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে গিয়ে বসে পড়ল সোফায়। কি আর বলবো? বললে তুমি কি বিশ্বাস করবে?
মেহের এবার সিরিয়াস হয়ে গেল।
Please, tell me what happened?
রাজ মুখটা গম্ভীর করে বলল—

রিদের অ্যাসিস্ট্যান্ট আশে না… কী যেনো নাম? ওহ হে রাইমা।
মেহের একটু ভেবে নিয়ে বলল—
হ্যাঁ, আছে। কেনো? কী হয়েছে?
রাজ মুখটা দুঃখি করে টেনে বলল—
না থাক, তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে না।
মেহেরের এবার সত্যি ভয় লাগতে শুরু করলো।Please ভাইয়া, তুমি না বলো আমি তোমার বোনের মতো প্লিজ বল বলছি।
রাজ উঠে দাঁড়িয়ে জেতে জেতে বলল—

হয়তো সেই মেয়ে রিদকে পছন্দ করে। ওদের একদিন কফি শপে দেখেছে আমার লোক।
এটা বলেই শয়তানি হাসি দিয়ে রাজ বেরিয়ে গেল।
ওদিকে মেহের রাগে ফুসে উঠল—
ওহ্! তাহলে ব্যাপারটা ঠিক আছে। আসুক আজ রাইমার ভুত যদি না বের করছি আমার নাম ও মেহের না। বলে সে গজগজ করতে করতে সোজা চলে গেল গোসলে। এখন মাথায় পানি ঢালা খুব দরকার।
রাজ এদিকে নাচতে নাচতে উপস্থিত হলো লামিয়ার রুমে।
রাজকে দেখেই লামিয়া হেসে বলল—
Hey bro, হঠাৎ আমার রুমে? কিছু বলবে?
রাজ কোনো উত্তর না দিয়ে লামিয়াকে জড়িয়ে ধরল।
বোন, bro-কে বিশ্বাস করিস?
লামিয়া হঠাৎ রাজের এমনকথায় অবাক হয়ে গেল। মাথা নেড়ে জানাল—
অবশ্যই।

রাজ লামিয়াকে ছেড়ে পেছন ফিরে দাঁড়াল।
আরশকে পাশের গ্রামের একটা মেয়ের সাথে কথা বলতে দেখেছে আমার লোকেরা। আমি জানি না মেয়েটা কে। তুই একটু শুনে নিস।
এটা বলেই রাজ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
বাইরে এসেই ভিলেনি হাসি দিল।
ওদিকে লামিয়া রাগে–দুঃখে কাঁপতে কাঁপতে আরশকে সব জায়গা থেকে ব্লক করে দিল। মুখে ফিসফিস করে বলল—
I will kill him…
রাজ এবার নিজের গাল হাত দিয়ে ঘষতে ঘষতে চলে গেল মেহবুবার রুমে। নক করে বললো আসবো?
মেহবুবা তখন ফোন টিপছিল। রাজকে দেখে অবাক হয়ে বলল—

অবশ্যই দুলাভাই & ভাসুর, আসুন আসুন।
রাজ হাসিমুখে ঢুকে বসলো।
সব কিছুই তো পছন্দ হয়েছে।
মেহবুবা হেসে উত্তর দিল—হ্যাঁ।
রাজ গভীর নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল—
দোয়া করি, তোমরা সুখী হও। কিন্তু সেই সুখ কতদিন টিকবে জানি না।
রাজের এমন কথা শুনে মেহবুবা আঁতকে উঠল।
এমন কেনো বললেন ভাইয়া? কী হয়েছে?
রাজ মেহবুবার মাথায় হাত রেখে মৃদুস্বরে বলল,
না রে পাগলি, জিজ্ঞেস কোরো না। আমি বললে তুমি সহ্য করতে পারবে না।
মেহবুবা বেশ গাবরে গেল। রাজের কাছে এসে কাঁপা গলায় বলল—
ও ভাইয়া, কী হইছে, বলো না!
রাজ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে, পিছন ফিরে গম্ভীর স্বরে বলল—

আমাদের অফিসে একটা মেয়ে আছে, নাম রুম্পা। ওই মেয়েটা আজকাল লাবিবের আশে-পাশে বেশিই ঘোরাফেরা করছে। হয়তো লাবিবকে পছন্দ করে। এখন ব্যাপারটা বলা উচিত হল কি না জানি না। তোমাকে আমি বোন মনে করি বলেই বললাম— তুমি লাবিবকে বলে দিও যেন ওই মেয়েটাকে বেশি প্রশ্রয় না দেয়। আমি তো বড় ভাই, সরাসরি এসব বলা যায় না, মান–সম্মানের একটা ব্যাপার আছে না।
এটুকু বলে রাজ দাঁত বের করে শয়তানি হাসল আর বেরিয়ে গেল।
রাজ এবার রাহির ঘরের দিকে যাচ্ছিল। কিন্তু পথে দেখা হলো চুমকির সাথে।
চুমকিকে দেখেই রাজ মুখটা দুঃখী করে ফেলল। চুমকি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল—
কী হইছে আমার ভাইটার? তোমার মুখটা অমন লাগছে কেন?মেহু বকেছে?
রাজ চুমকির মাথায় হাত রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল—

না রে বোন, তোর জন্যই কষ্ট হচ্ছে।
চুমকি অবাক-
আমার জন্য কেনো? আমি তো ভালো আছি।
রাজ মাথা নেড়ে বলল—
না রে বোন, কথা সেটা না। কথা হলো শান্ত।
চুমকি ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করল—
শান্ত কী করল?
রাজ চারপাশে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল—
শান্ত সাপ্তাহ খানেক আগে এক মেয়েকে নিয়ে ইকু পার্কে গিয়েছিল। আমার লোকেরা দেখেছে। তারপর ওরা আমাকে জানায়।

এটা শুনে চুমকি রাগে ফেটে পড়ল।
শান্তর বাচ্চা……, তোকে দিয়ে যদি আমি মাহিনের হাগু-মুত পরিষ্কার না করাই, তাহলে আমার নাম চুমকি না।
এমন শপথ নিয়ে চুমকি সোজা চলে গেল ঘরে, আর রাজ হাসতে হাসতে রওনা দিল রাহির ঘরের দিকে।
রাহি তখন নিজের গুছানো কাজে ব্যস্ত ছিল। রাজকে দেখে অবাক হয়ে বলল—
আরে ভাইজান, কী ব্যাপার? হঠাৎ আমার শরণাপন্ন হওয়ার কারণ কি?
রাজ হেসে উত্তর দিল—
না, এমনিই।
রাহি এগিয়ে এসে রাজের হাত ধরে ঘরে নিয়ে গেল। আমি জানি, কিছু বলতে এসেছো। বলো, শুনি।
রাজ মনে মনে বলল—

সরি পুচকি, আমি তোকে কষ্ট দিতে চাই নি।কিন্ত তোর ভাবির কেলানি আমি একা কেনো খাবো? তাই তোকেও একটুখানি উস্কে দিব।
রাকিব এখন কোথায় জানিস?
রাহি একটু ভেবে বলল—
আরশ ভাইয়ার সাথে।
রাজ হতাশভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল—
আমিও জানি ও আরশের সাথে, কিন্তু আরশের সাথে কেনো গেছে জানিস?
রাহি মাথা নাড়ল।
রাজ এবার রাহির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল—
রাকিব পাশের গ্রামে গেছে। ওখানে এক মেয়ে মালাই চা বিক্রি করে। সেই মেয়ের হাতে চা খেতে।
রাহির চোখে আগুন জ্বলে উঠল। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল—
“সত্যি?”
রাজ মাথা নাড়ল।
এরপর রাজ চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

রাহি সোজা হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকে রাকিবকে একগাদা গালি ছুরে ব্লক করে দিল। বসে বসে ফুঁসে উঠতে লাগল—
গুলামের পুত, তোকে আমি মালাই চা খাওয়াচ্ছি, তুই শুধু বাসায় আস, তোর গলায় আমি বিষ ঢালব!
বাহিরেই দাঁড়িয়ে রাজ রাহির গালি শোনে মুখ চেপে হেসে উঠল।
যাক মন টা এখন ফুরফুরে হয়ে গেলো।
এই মনে এখন এক কাপ চা খেতেই ইচ্ছে করছে,তাই সে রান্না গরের দিকে যাচ্ছে চা বা কফি খেতে। একটু আগে যে বউয়ের হাতে কী কেলানি টা খেলো, তা সে এখন দিব্বি ভুলে গেছে। আচ্ছা, আরফা টাকেও যদি একটু উল্টাপাল্টা বলে উস্কে দিই? থাক, পরে দেওয়া যাবে। আগে সামনেই দেখি কে আছে…
সামনেই রান্নাঘরের পথে রাজ চোখে পড়ল ফাইজা চৌধুরীকে। রাজের মাথায় শয়তানি খেলে গেল।
মামুকেও একটু বাঁশ দিলে কেমন হয়?

মমে মনে শয়তানি হেসে, রাজ এগিয়ে গিয়ে মামির সামনে মুখ ভার করল।
ফাইজা চৌধুরী রাজের ওমন মুখ দেখে, অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন—
কী হইছে, আব্বাজান? মন খারাপ?
রাজ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল—মামিমা, তুমি এত ভালো কেন? তুমি ভালো মানুষ… তাই তোমার এই ভালো মানুষীর সুযোগ নিচ্ছে সবাই।
ফাইজা চৌধুরী রাজের প্রথমে কথায় হেসেছিলেন, কিন্তু পরের কথায় আতঙ্কিত হলেন।
কেনো? কী করেছে বাপ?
রাজ তৎক্ষণাৎ ফাইজা চৌধুরীর হাত ধরে গম্ভীর স্বরে বলল—নিজের জামাইয়ের দিকে একটু নজর দাও মামিমা। নইলে অন্য কোন মহিলা নিয়ে যাবে। জানেন তো? মহিলা কলিগরা মামুর নামে কত কথা বলে! মৌসুমি নামে এক মহিলা আছে, সে তো মামুকে নিয়ে একদিন কফিও খেতে গিয়েছে। মামু ভালো মানুষ তাই সে মানা ও করতে পারে নি।

ফাইজা চৌধুরী স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
রাজ মিথ্যা সহানুভূতিতে বলল—
কষ্ট পেও না মামীমা, ব্যাপারটা আমি সামলে নিচ্ছি। এটুকু বলে রাজ কেটে পরলো।
এবার রাজের চোখে পড়ল শ্বশুরের ঘর। ভেতরে ভেবে নিল—
এই যে শ্বশুরের মেয়ে আমাকে মারলো, এখানে সমান তালে শশুড়ের দোষ আছে। শশুড় যদি আমার বউকে শিখাতো স্বামী হচ্ছে বউয়ের ভালোবাসার মানুষ মারা মারি করার না। না শশুড় তো এতুলো কিছুই করেনি? উল্টো আমাকে বলেছে মাইর খাওয়া অভাস করে নিতে। এই অপরাধে শ্বশুরকেও একটুখানি বাঁশ দিতে হবে।
রাজ দরজায় নক করল।
ভেতর থেকে মালিহা মির্জা বললেন—

কে? দরজা খুলাই আছে এসো।
রাজ ভদ্র গলায় উত্তর দিল—
অম্মু, আমি।
মালিহা মির্জা সস্নেহে বললেন—
আসো বাবা।
রাজ ঘরে ঢুকে একটু ইতস্তত করল। কিছু বলতে চায় আবার চুপ করে গেল। শাশুড়ী কে উস্কে দেওয়া কী ঠিক হবে?
মালিহা মির্জা লক্ষ্য করে বললেন—
কিছু বলবে, বাবা?
এটা যদি তার বউ জানতে পারে যে তার মা কে তারই বাপের নামে উল্টা পাল্টা বলে গিট্ট লাগাইছি আমাকে যে কি করবে!

রাজ গলা শুকিয়ে গেলেও একটা শুকনো ঢোক গিলে সাহস করে বলল—
আম্মু আপনি একটু আব্বুকে বোঝান, যেন এই বয়সে মেয়েদের নিয়ে না ঘোরেন। ব্যাপারটা খারাপ দেখায়, মানসম্মানেরও ক্ষতি হয়। কয়দিন আগে এক মেয়েকে নিয়ে শিশুপার্কে বসে বাদাম খাচ্ছিলেন— আব্বু আমার লোকেরা নিজের চোখে দেখেছে।
এটুকু বলে রাজ ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
তারপর সোজা রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ কেউ কানের টেনে ধরল। রাজ এক ঝটকায় বুঝে গেল— এ কাজটা শুধু রূপা বেগমেরই।
রাজ বলল—
উফফ, মামনি! এখন তো বড় হয়েছি। দুই বাচ্চার বাবা হয়েছি তুমি এখন আমার কান টানছো?
রূপা বেগম হেসে বললেন—
কই বড় হয়েছ? দিব্বি বাঁদরামি করে ঘুরছো, সবার সংসারে আগুন লাগাচ্ছো। এমনকি শ্বশুরকেও ছাড়লে না! কী কাহিনি বলো তো?

রাজ চারপাশে তাকাল, তারপর নিজের গালে ধরে শয়তানি স্বরে বলল—
তোমার বৌমা আমাকে সেই কেলানি কেলিয়েছে। এটা জানলে সবাই আমায় নিয়ে হাসাহাসি করত। তাই নারীগণকে একটু উস্কে দিলাম, যাতে তারা নিজেদের ঘর সামলাতে ব্যস্ত থাকে— আমার পিছে না লাগে।
রূপা বেগম তখন রাজের পিঠে চড় মারলেন।
দিন দিন খুব বাঁদর হচ্ছো!
রাজ হেসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল—
ও মামনি, এক কাপ কফি খাওয়াও। কুটনামি করতে করতে হাপিয়ে গেছি। ইসস মহিলা মানুষ সারাদিন কুটনামি কেমন করে।
রূপা বেগম হেসে বললেন—
তুমি বসো, আমি নিয়ে আসছি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই কফি এনে দিলেন। রাজ কফি শেষ করে গান গুনগুন করতে করতে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।

কিছুক্ষণের ভেতরেই সব পুরুষগণ বাড়ি ফিরল। তবে ফেরা বলা যায় না কারন,কেউ ইচ্ছে করে ফেরেনি, সবাইকে একপ্রকার বগলদাবা করে নিয়ে এসেছেন স্বয়ং রাজ শিকদার।
সবাই যে যার ঘরে চলে গেল।
ব্যতিক্রম ছিল মাত্র তিনজন—লাবিব, আরশ আর রাকিব।
তারা তিনজনই গেল প্রিয় মানুষের ঘরে, অনেকক্ষণ প্রিয় মুখ খানা দেখেনি কিনা।
কিন্তু যার যেখানেই যাওয়া হোক না কেন, সবার পরিণতি একটাই—নারীগণের রোষের মুখে পড়া।
একসময় একসাথে সব ঘর থেকে একই শব্দ ভেসে এলো—
“ঠাসসসসসসস!”

তারপর দরজা জোরে ধাক্কা মেরে বন্ধ করার কর্কশ আওয়াজ।
শব্দটা এতটাই প্রবল, মনে হল যেন পুরো জমিদারবাড়িই কেঁপে উঠল।
এগুলো শুনে রাজ ঠোঁটের কোণে একরাশ তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে তুলল।
হাতে থাকা কফির কাপ তুলে চুমুক দিল।
তারপর নিজের থাপ্পর খাওয়া গালে হাত বুলিয়ে নীচু স্বরে বলল—
উফফ… শান্তি! এখন কী যে আরাম লাগছে!
এরপর সব পুরুষগন বসার ঘরে এসে জমল,সব পুরুষের মুখ ঠিক যেন বাংলার পাচেঁর মতো শুকনো আর বিবর্ণ।
রাজের যের যে কি হাসি পাচ্ছে ওদের ওমন ভোতা মুখন টা দেখে। যেন পেট ফেটে যাবে।
তবে এই মুহূর্তে হাসাটা বিপদজনক,

তাই সে কষ্ট করে হাসি চেপে রেখে বলে,
কী ব্যপার, সবাই এমন মুখ করে বসে আছো কেন? কোনো প্রবলেম নাকি?
সবাই একসাথে রাজের দিকে তাকাল।
তাদের সেই চাহনি দেখে রাজের মনে হল,
হাসতে হাসতে আজকেই সে শহীদ হয়ে যেতে পারে।
তবুও হাসতে পারলো না,
শেষ পর্যন্ত হাসি চেপে কষ্ট করে দম আটকে বলল—
চলো, সবাই ছাদে যাই। আড্ডা দিই। তাহলে ভালো লাগবে।
প্রস্তাবে সবাই রাজি হয়ে গেল।
রাজ তখন কুলসুমকে বলল—সবার জন্য কফি দিতে।
কুলসুম হাসিমুখে রাজি হল।

কফির সাথে কিছু স্ন্যাকসও দিয়ে আসলো।
সবাই মিলে ছাদে উঠল।
আসলে, আড্ডার আড়ালে উদ্দেশ্য একটাই—
বউদের রাগ ভাঙানো।
ছাদে গিয়ে সবাই গোল হয়ে বসল। চারদিকের রাতের হাওয়া বইছে সাথে ঝিঁঝি পোকার ডাক, সবার মুখগুলোয় অদ্ভুত এক উত্তেজনা।
কে যেন প্রথমে বলল—
এভাবে আর কতক্ষন চলবে? কিছু একটা করতেই হবে।
সবাই একসাথে মাথা নাড়ল।
হ্যাঁ, করতেই হবে।
রাজ একসময় হাত তুলে সবাইকে চুপ করাল। ঠোঁটের কোণে চতুর হাসি ফুটিয়ে বলল—
শোনো, একটা প্ল্যান দিচ্ছি।

সে আস্তে আস্তে প্ল্যানের কথা খুলে বলল।
বাকিরা মন দিয়ে শুনল, আর যত এগোল ততই সবার চোখ জ্বলে উঠল উচ্ছ্বাসে।
কেউ কেউ হেসে উঠল, আবার কেউ তালি দিল।শেষমেশ রাজের প্ল্যান শুনে মনে হল, যেন প্রত্যেকের ভেতর জমে থাকা হতাশা আর কষ্ট একসাথে গলে গিয়ে নতুন একটা দুষ্টুমি ভরা আলো জ্বেলে দিল।
সবাই রাজের প্ল্যানটা মনে ধরল।
আর তারপর—
সবার মুখেই একসাথে হাসি ফোটল।
হাসির রেশে ছাদ ভরে উঠল এক অদ্ভুত রহস্যে।
রাত ৮টা।

সবাই বসার ঘরে বসে আছে। নারীগনের মুখের দিকে তাকানোই যাচ্ছে না। চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে বিস্ফোরণের আগাম ইঙ্গিত—যেন যেকোনো মুহূর্তে বোম ফাটবে। চারদিক নিস্তব্ধ, বাতাসে অদ্ভুত ভারী চাপা উত্তেজনা।
এই দৃশ্য দেখে রূপা বেগম একচিলতে হাসলেন।
আরফা নিজের ঘর থেকে এসে বসার ঘরে জায়গা নিল। ওদিকে মেহরিন, মেহের, চুমকি, রাহি, মেহবুবা, লামিয়া সবাই চুপচাপ বসে বসে ফুঁসছে। রান্নাঘরে আছে রূপা বেগম, ফাইজা চৌধুরী আর মালিহা মির্জা।

মাহির অনেকক্ষন ধরে সবাইকে দেখছে, আর মনে মনে পুরুষগনদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছে।ভারী দুঃখ হচ্ছে সবার জন্য। আহরাহে বেচারা গুলো কতই না নির্যাতীত এই রাক্ষসী রিনা খান টাইপ মহিলাদের কাছে।মাহির মনে মনে পন করলো সে বিয়েই করবে না। যেখাতে রাজ রিদরা বউয়ের হাতে মাইর খাই এমন কী তার বাপ ও বাদ যায় না। সেখানে তার বউ তেো নিশ্চিত কেলিয়ে বিন্দাবন পাঠিয়ে দিবে। না ভাবা তাক বিয়ে করে আর কাজ নেয় সারাজীবন এমনই থাকবো। আমার পরিবারের পুরুষগন কে বউয়ের হাতে ধলাই কেতে দেখে আমার বিয়ের স্বাদ মিটে গেছে।আরও কিছুক্ষণ এসব ভাবলো মাহির। একসময় আর সহ্য করতে না পেরে বিরক্ত স্বরে বলে উঠল—
তোরো মুখটা কুত্তার পুটকির মতো করে রেখেছিস কেন? কী এমন হল! নিজেরাই গতো ডাইনি রাক্ষসীদের মত ব্যবহার করিস পুরুষ গনের সাথে। এখন আবার নিজেরাই মুখ ওমন করে আছিস কেন? সমস্যা কী তোদের।
মাহির কথা শেষ হতেই সবার চোখ একসাথে ঘুরে তার দিকে যায়।

সে চোখে শুধু রাগ, দমবন্ধ করা রাগ।
সবার এমন দৃষ্টিতে তাকানো দেখে মাহির ভড়কে গিয়ে তাড়াতাড়ি দুই হাত তুলে বলল—
ওকে ওকে… চিল! তোরা যা মন চায় কর। আমি কিচ্ছু বলব না। হ্যাপি? তোরা পুরুষ নির্যাতন করিস এটা আমি কোন দুঃখে বলতে যাবো?
সবাই বিরক্তিতে মুখ ফিরিয়ে নিল।
ঘরে আবার নীরবতা নেমে এল। তবে এবার নীরবতার ভেতর চাপা আগুন আরও স্পষ্ট।
এভাবে কতক্ষন চুপ চাপ বসে থাকা যায় দূর।মাহির আরও কিছুক্ষন সবাই কে খুচিঁয়ে ফোন টা বের করে গেম এ ঢুকলো।
মেহরিন চুপচাপ বসে আছে মাহিমকে নিয়ে। মাহিনকে কোলে নিয়ে বসে আছে চুমকি। বাকি সবাই সবাই এদিক সেদিক বসে আছে কারো মুড ভালো না।
ওদিকে মাহির গেম খেলতে খেলতে চিৎকার করছে।
এই মার!! ডানে দেখ!! রিভাইব দে!!
সে ফ্রি ফায়ার খেলছে।

Cs ম্যাচ চলছে,মাহিরের দল হেরে যাচ্ছে কারণ ৩ নাম্বার প্লেয়ার কিছুই পারছে না—
না মারছে, না রিভাইভ দিচ্ছে।
মাহিরের মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে।
৪ রাউন্ডের মধ্যে ২টাতেই হার।
৩ নাম্বার এবারও ম্যাচ খারাপ যাচ্ছে। এখন যেভাবেই হোক ম্যাচ নিজেদের দিকে ফিরাতে হবে। কিন্ত বেসসস, ওই ৩ নাম্বার এর জন্য সবাই ম্যাচ খেলার আগেই মরে গেলো গ্রেনেডের নিচে পরে। ওই ৩ নাম্বার প্লেয়ার টা হয়তো নিও, একদমই পারে না গ্রেনেড এনিমির দিকে না মেরে নিজের কাছেই ফেলেদিয়েছে যার জন্য সবাই মারা গেছে।
অবশেষে সহ্য করতে না পেরে

মাহির মাইক অন করে গালি দিয়ে উঠল—
এই ৩ নাম্বার, মেহেরাব সালা!
খেলতে পারিস না, তাহলে গেমে ঢুকিস কেন?
বোকাচন্দর সালা! আমার বাল খেল।
কথা শেষ হতে না হতেই
একটা ভীষণ মিষ্টি বাচ্চা কণ্ঠ শোনা গেল—
এই ১ নাম্বার ভাইয়া,
আপনি আমাকে সালা বললেন কেন?
মাহিরের সাথে বাকি সবাই থমকে গেল।
ঘরের ভেতরে থাকা সবাই গেমের ভয়েস শোনার জন্য একটু এগিয়ে এল।
বাচ্চাটার কণ্ঠ এত মিষ্টি, বয়স মনে হয় ১০-১১ বছর। আজকালকার বাচ্চারাও এই বয়সেই মোবাইল চালায়,এমনকি ফ্রি ফায়ার খেলে!

মাহির রাগ সামলাতে না পেরে বলল—
তোর বোন তো আমার বউ।
তাই তোকে সালা বলেছি।
বাচ্চাটা মিষ্টি স্বরে উত্তর দিল—
আমার আপুর তো এখনো বিয়ে হয়নি। এটা বলেই বাচ্চাটা ডাকতে থাকে,
আপুই..এই আপুই.. কই তুমি?
ঘরের সবাই একে অপরের দিকে তাকাল।
মাহির চুপ।
ঠিক তখনই, অন্যপাশ থেকে
একটা মেয়ের সুন্দর কোমল কণ্ঠ ভেসে এল—
কি হয়েছে সোনা? ডাকছো কেন?
খিদে পেয়েছে? কিছু করে দিই?
অচেনা মেয়েটির বলা প্রতিটি শব্দ গুলো এসে মাহিরের বুক যেন ধাক্কা খেল।
এমন সুমিষ্ট কণ্ঠ সে জীবনে শোনেনি।
ওর বুকের ভেতরে ধুপধাপ শুরু হয়ে গেল।
মেহবুবা, রাহি, লামিয়া আর আরফা
গিয়ে মাহীরের পাশে দাঁড়াল—

ওর প্রতিক্রিয়া দেখতে। আর সেই মিষ্টি কন্ঠ শুনতে।
এবার বাচ্চাটা রাগী গলায় বলল—
তুমি বিয়ে করেছো, আমায় বলোনি কেন?
আমায় দাওয়াত দাওনি কেন?
আমি খুব রাগ করেছি আপুই।
বাচ্চার অভিমানী গলায়
ঘরের সবাই হাসি চাপতে পারল না। সবার মুখে মৃদু হাসি।
ঠিক তখনই মেয়েটার কণ্ঠ আবার বাজল—
এসব কি বলছো সোনা?
আপুই বিয়ে করলে তো তুমি জানতেই। আপুই কী তার ভাই সোনাকে না জানিয়ে বিয়ে করতে পারে? আমি তো বিয়ে করিনি সোনা।
বাচ্চাটা আবার বলল—

তাহলে ওই যে ১ নাম্বার ভাইয়া,
সে-ই তো বলল! সে তোমার বর, আমি তার সালা।
মেয়েটা বলল—
কে তোমাকে সালা বলেছে? এবার মেয়েটির কন্ঠে রাগ টা বুঝা গেলো।
বাচ্চাটা উত্তর দিল—
এই যে, আমি যাদের সাথে গেম খেলছি,
ওখানকার ১ নাম্বার ভাইয়া।
মেয়েটা ফোন হাতে নিয়ে বলল—
কই দেখি? ওহ্‌, এই যে মিস্টার মাহির।
আপনি আমার ভাইকে গালি দিলেন কেন?
ছোট মানুষদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানেন না নাকি? ও ছোট এতো খেলতে পারে না তার জন্য আপনি ওকে এমন গালি দিবেন?
অসভ্য, বদমাশ লোক একটা!

আর একবার যদি আমার ভাইকে গালি দেন,
আপনার নামে থানায় মামলা ঠুকে দেবো।
বুঝেছেন? যতসব, তুমি আর এসব ফালতু লোকের সাথে খেলবে না ঠিক আছে সোনা।
বাচ্চাটাও হয়তো লজ্জায় গেম থেকে বের হয়ে গেল।
ওদিকে গেম শেষ, মাহিররা হেরে গেল। হারবে নাি বা কেন সে তো খেলেইনি ওই কন্ঠ শুনার পর থমকে গিয়েছে।
মাহির বাকরুদ্ধ, মুখ হাঁ হয়ে রইল।
হঠাৎ মেহিরের হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেল।
মাহিরকে এমন হতভম্ব দেখে
মেয়েটার কথাগুলো সবাই আবার মনে করল।
তারপর হেসে গড়াগড়ি খেল সবাই।
হাসির শব্দে ঘর ভরে গেল।
মাহির ফ্যাকাসে মুখে ফোনটা তুলে

ঝটপট সেই বাচ্চাটার আইডিতে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাল।
মেহের কফির কাপে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
কি করছিস মাহির?
মাহির বুকের বাম পাশে হাত রেখে, কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলো।
এরপর হটাৎ অভিনয়ের মতো নাটকীয় গলায় বলল
আমি প্রেমে পড়ে গেছি।
মেহবুবা হাসতে হাসতে বলল—
গালি শুনে নাকি প্রেমে পরলি বুঝি?
বলেই হেসে উঠে সাথে বাকিরাও।
মাহির হাসি মুখে বলল—
হ্যাঁ! এমন মিষ্টি গালি জীবনে শুনিনি।

শুনেই প্রেমে পড়ে গেছি। আমার বুক ধক ধক করছে—মনে হচ্ছে এখনই হার্ট অ্যাটাক হবে। এখন বুজতে পারছি তোদের গালি মাইর খেয়েও কেন আমার দুলাভাই গন এত পাগল তোদের জন্য। আজ ৎেকে আমিও গালি শুনতে মাইর খেতে রাজি।
মাহিরের এভাবে বলাতে সবার হাসি যেনো থামছেই না।ঘর ভরে উঠল অট্টহাসিতে।
হঠাৎ লাবিব উঠে দাঁড়ালো আর হিরো দের মত দুই হাত মেলে বলে উঠলো—
দুলাভাইগণ! আমি প্রেমে উস্টা খেয়েছি, হেল্প মি।
বলে সোজা ছুটে গেলো ছাদের দিকে। তা দেখে সবাই আবার হেসে উঠলো।
মাহির এক দৌড়ে ছাদে উঠে ধপ করে গিয়ে শুয়ে পড়লো রিদের কোলে।
এমন সময়ে মাহিরকে দেখে সবাই অবাক হলো। রাজ কিছু বলতে যাবে, ঠিক তখনই মাহির রাজের দিকে তাকিয়ে বললো—

“দুলাভাই, আমি প্রেমে পড়ে গেছি।”
সবার চোখ যেন চরকগাছ!
এই বয়সে প্রেমে পড়া স্বাভাবিক, কিন্তু মাহির আর প্রেমের ব্যাপারটা তো ঠিক যাচ্ছে না—যে সারাক্ষণ বলে বিয়ে করবে না, সে-ই কিনা প্রেমে পড়েছে!
রাজ কিছু বলবে, তখনই ফিরোজ মির্জা বলে উঠলেন—
তুমি আবার কার প্রেমে পড়লা?
মাহির লাফিয়ে উঠে সবাইকে চাপিয়ে চলে গেলো বাবার কাছে। গিয়ে ফিরোজ মির্জার গালে একটা চুমু খেয়ে বললো
বাবা, তোমার ছেলে বড় হয়ে গেছে, সে প্রেমে পড়েছে বাবা।
ফিরোজ মির্জা হেসে মাহিরের পিঠ চাপড়ে বললেন—
বাঘের বাচ্চা! I am proud of you. মেরা বাচ্চা!
সবাই হেসে দিলো।
ভাবা যায়, ছেলে প্রেমে পড়েছে সেটা আবার বাবাকে বলে, আর বাবা তা শুনে বলে কিনা সে প্রাউড—এমন বাবা আর কোথায়!

ফিরোজ মির্জা ছেলে–মেয়েদের সবসময় নিজের বন্ধুর মতো ট্রিট করেন। যেজন্য যা-ই হোক, সবাই আসে আগে বাবার কাছেই।
ওদিকে আকরাম চৌধুরী হেসে বললেন—
তা, আব্বাজান, আপনি কার প্রেমে পরলেন? আর কিভাবে?
সবাই বলে উঠলো—
হ্যাঁ, সেই তো!
মাহির বাবা থেকে সরে গিয়ে এবার ফুফার কাছে এসে একইভাবে আকরাম চৌধুরীকে একটা চুমু দিয়ে বললো—
উফফ ফুফা, আমি তো তার গালি শুনে প্রেমে পড়ে গেছি!
এটা শুনে সবার চোখ যেন কঠোর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। কিছুক্ষণ নীরবতা, তারপর সবাই হা-হু করে হেসে দিলো।
মাহির সব খুলে বললো। সব শোনে রাজ বলে উঠলো—
তোর হিল্লে হয়ে গেল রে! যাক, কাল তোর ব্যাপারটা দেখা যাক। আপাতত মিশন—বৌ আর রাগ ভাঙানো—পালা শেষ করি।

মাহির মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো।
হঠাৎ ছাদের দরজায় কিছু ছায়া দেখা গেলো। রাজ সবাইকে চোখ টিপে কাঁদু-কাঁদু কণ্ঠে বললো—
আমার বউ আমার সাথে রাগ করলে, আমার নিজেকে এতিম–এতিম লাগে। মনে হয় এজগতে আমার কেউ নেয়।
রিদ বললো—
আমারও অনেক কষ্ট হয়, কান্না পায়, কিন্তু পুরুষ মানুষ তো তাই বলতে পারি না।
আকরাম চৌধুরী বললেন—
তোমরা তো তাও যুবক নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারো, আমি এই বড় বয়সে নিজের দুঃখ কাকে বলবো?
লাবিব বললো—
আমার তো মন চায় নিজের কিডনি খুলে কাউকে দান করে দিয়ে আমি মরে যাই।
ফিরোজ মির্জা বললেন—
আমার মনে হয় আমাকে আর কেউ ভালোবাসে না। আমি বোধহয় অকেজো হয়ে গেছি। মন চায় যেদিকে দুই চোখ যায়, চলে যাই।
শান্ত বললো—

আমার তো মন চায় কাঁদতে কাঁদতে কমোড ভরিয়ে ফেলি।
আরশ বললো—
আমার মন চায় তাল গাছে ফাঁসি দিতে।
রাকিব হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো—
আমার মন চায় নিজেকে কেটে রক্তাক্ত করে, সেই রক্ত দিয়ে চিঠি লিখি। এটা দেখে যদি সে আমাকে বোঝে…
বলে সবাই একসাথে কান্না শুরু করে দিলো। না, এটা আসল কান্না নয়—এটা হলো বউদের রাগ ভাঙানোর একটা প্রণালী!

একসময় সবাই গলা গলি ধরে কান্না শুরু করে দিলো। ওদিকে ছাদের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল নরীগণ।
সবার চোখে পানি। তারা মূলত এসেছিল মাহিরের কথা শুনতে, কিন্তু এগুলো শুনে ভীষণ কষ্ট পেলো।
মাহিম, মাহিন, রূপা বেগম, ফুলবানু আর কুলসুমের কাছে।
হঠাৎ মেহের ছাদে গিয়ে রিদকে টেনে নিয়ে চলে যায়। মেহরিনও তাই। এক এক করে সবাই চলে গেলো। এমনকি বাদ গেলো না মালিহা মির্জা আর ফাইজাও। সবাই গিয়ে নিজেদের ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলো।
আর পুরুষগণ?
রাজের কথায় নারীগণকে পাত্তা দিলো না।
কথা বললেও শোনে না, ডাকলেও শোনে না।
তাদের ভেতরে গভীর অভিমান জমেছে।
তারা কষ্টও পেয়েছে, অনেক এমন একটা ভাব ধরল।

আমাদের প্রিয় মানুষ যখন আমাদের সাথে অভিমান করে, তখন সেটা সহ্য করা ভীষণ কঠিন হয়ে যায়। আর যখন সেই প্রিয় মানুষ আমাদের কারণেই কষ্ট পায়, তখন সেই কষ্টটা আকাশছোঁয়া মনে হয়। মনে হয় নিঃশ্বাসই বন্ধ হয়ে আসছে—শুধু এই ভেবে যে, আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটা আমার কারণেই কষ্ট পেলো। এই ভাবনাটাই হৃদয়কে অসহ্য ভারী করে তোলে। ভিতরটা কুরে কুরে খায় এই একটা কথায় যে আমার প্রিয়জন আমার কারনে কষ্ট পেয়েছে।
মেহরিন তাকাই উল্টো দিক ফিরে বসে থাকা রাজের দিকে।
মেহরিন হটাৎ রাজের কোলে উঠে বসে গলা জড়িয়ে গাইতে শুরো করে,
সখা তুই বিহনে…!
মনের ও গহীনে…
জ্বলেনা জ্বলেনারে সুখের বাত্তি..!
রিদকে মুখ ফুলিয়ে বসে থাকতে দেখে মেহের, রিদের মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে কপালে একটা চুমু খেয়ে গাইলো..
সখা তুই বিহনে…!

মনের ও গহীনে….
জ্বলেনা জ্বলেনারে সুখের বাত্তি…!
শান্ত বাথরুমের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। তা দেখে চুমকি শান্তর দুই হাত নিজের কোমরে ধরে, শান্তর গলায় হাত দিয়ে গান গাইতে শুরু করলো…
আসমানের চন্দ্র তাঁরা…!
আন্ধার সব তোরে ছাড়া…!
ফাইজা চৌধুরী আকরাম চৌধুরীকে চেয়ারে গম্ভীর হয়ে বসে থাকতে দেখে তার বুকে মাথা রেখে গাইলো..
আসমানের চন্দ্র তাঁরা..!
আন্ধার সব তোরে ছাড়া…
কাটেনা কাটেনারে একলা রাতি!!
কাটেনা কাটেনারে একলা রাতি!!
ফিরোজ মির্জা বিছানায় বসে ছিলেন, মুখ অন্যদিকে ঘুরানো।
তা দেখে মালিহা মির্জা স্বামীর পাশে বসে তার মুখ নিজের দিকে ফিরিয়ে গান গাইল..
সখা তুই বিহনে..!

মনের ও গহীনে…
জ্বলেনা জ্বলেনারে সুখের বাত্তি..!
লামিয়া, আরশকে কাঁদু-কাঁদু মুখ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে আরশের বুকে ধাক্কা দিয়ে গান গাইল..
দরজাটা খোলা থাকে..!
ডাহুকে আমায় ডাকে….
বুজিনা কেমনে তাঁরা,,
আমারে মনে রাখে..!
দরজাটা খোলা থাকে..!
ডাহুকে আমায় ডাকে,,
বুজিনা কেমনে তাঁরা…
আমারে মনে রাখে..!

মেহবুবা, লাবিবকে রাগি রাগি চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে তার এক কান ধরে গান গাইল….
ছাড়েনা ছাড়েনারে..!
ছাড়েনা ছাড়েনারে..!
বানায় সঙ্গের সাথী ,,,,
কাটেনা কাটেনারে একলা রাতি…!
কাটেনা কাটেনারে একলা রাতি..!
রাকিব উল্টো হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
তা দেখে রাহি রাকিবকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বাচ্চাদের মতো দুই হাত বাড়িয়ে দিলো।
রাকিবও তাকে কোলেতে নিয়ে নিলো।
রাহি রাকিবের গলা জড়িয়ে ধরে গান গাইল..!

সখা তুই বিহনে..!
মনের ও গহীনে…
জ্বলেনা জ্বলেনারে সুখের বাত্তি..!
সখা তুই বিহনে…!
মনের ও গহীনে…!
জ্বলেনা জ্বলেনারে সুখের বাত্তি…!
আসমানের চন্দ্র তাঁরা…!
আন্ধার সব তোরে ছাড়া…
আসমানের চন্দ্র তাঁরা…!
আন্ধার সব তোরে ছাড়া..!
কাটেনা কাটেনারে একলা রাতি…
কাটেনা কাটেনারে একলা রাতি..!
এইভাবেই গান আর ভালোবাসা দিয়ে নারীগণ তাদের স্বামী–অর্ধাঙ্গীদের রাগ ভাঙালো।

১১টার সময় সবাই হাসিমুখে খাবারের টেবিলে বসে ডিনার করতে লাগলো, কাছাকাছি বসে গল্পগুজবও চলছিল।
এমন সময় হঠাৎ চুমকি “ওয়্যাক ওয়্যাক” করতে করতে চলে গেলো বেসিনে।
চুমকিকে এভাবে যেতে দেখে সবাই খানিকটা চমকে গেলো।
ওদিকে মেহরিন আর মেহের গেলো চুমকির কাছে।
চুমকি বমি করলো, শরীরটা দুর্বল হয়ে পড়লো।
মেহের বললো—

আর ইউ ওকে!
চুমকি মাথা নাড়লো।
মেহরিন চুমকিকে ধরে বললো—
তুই ঠিক আছিস।
চুমকি হেসে মাথা নাড়লো।
সবাই আবার আস্তে আস্তে যাচ্ছিল, এমন সময় হঠাৎ চুমকি মাথা ঘুরে পড়ে গেলো!
মেহরিন চিৎকার দিয়ে উঠলো—
“চুমকি!”
মুহূর্তেই হাসি–খুশির পরিবেশটা পাল্টে গিয়ে ভয় আর আতঙ্কে ভরে গেলো।
কি হলো চুমকির? শান্ত তো অস্থির হয়ে উঠেছে।
সবার ঘরের বাইরে ডাক্তার এসে চুমকিকে দেখলো। বাইরে ছোটখাটো গোলমাল চলতে লাগলো। শান্ত তাকে শান্তনা দিচ্ছিল, সবাই উদ্বিগ্ন।

মালিহা মির্জার চোখে জল—হবেই না কেন!
যতোই চুমকি অন্য কারো গর্ভে হোক, সে তো ছোটবেলা থেকেই তার নিজের মেয়ের মতোই ছিল।ভালোবাসা, আদর, শাসন—সবকিছু দিয়ে মানুষ করেছেন।
এমন সময় দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন ডাক্তার।
সাথে মেহরিন।তার মুখে হাসি।
ডাক্তার মেহরিনের দিকে তাকালেন।
মেহরিন ইশারায় শান্তকে দেখালো।
ডাক্তার শান্তকে বললেন—
কংগ্র্যাচুলেশন! আপনি বাবা হতে চলেছেন।
কথাটা শোনার সাথে সাথেই সবার মুখে “আলহামদুলিল্লাহ” ধ্বনি উঠলো।
মালিহা মির্জা কান্না করতে করতে চলে গেলেন চুমকির কাছে।
ফিরোজ মির্জার চোখেও দেখা গেল আনন্দ অশ্রু।
শান্ত যেন বাকহারা হয়ে গেলো।

এই অনুভূতি কেমন, কিছুক্ষণের জন্য বোধহয় তার সমস্ত শক্তি আর বুদ্ধি হারিয়ে গেলো।
সবাই হেসে উঠলো।
আরশ আর লাবিব ডাক্তারকে এগিয়ে দিতে গেলো।
রাজ এই অনুভূতির সাথে পরিচিত, তাই শান্তকে জড়িয়ে ধরে বললো—
কংগ্র্যাচুলেশন, ভাই! আমি জানি তোর কেমন অনুভূতি হচ্ছে।
এক এক করে সবাই শান্তকে অভিনন্দন জানালো।
শান্ত শির নত করে কোনো কথা বললো না—এই অনুভূতিটাই যেন ভেতরে ভেতরে উপভোগ করছিল।
কী মধুর অনুভূতি!

পুরুষ মানুষ নাকি কাঁদে না—এটা ভুল।
এই যে শান্ত কাদছে, শান্তর চোখ বেয়ে পানি ঝরছিল, কিন্তু সেটা দুঃখের নয়, সুখের অশ্রু।
মেহরিন হেসে বললো—
ভাইয়া, তুমি চুমকির কাছে যাও।
এটা বলতেই সবাই একে একে ওদের একা ছেড়ে দিলো।
শান্ত হঠাৎ ঘরে ঢুকে চুমকিকে জড়িয়ে ধরে জোরে কান্না শুরু করে দিলো।
চুমকিও শান্তকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো।

কেটে গেছে ৬ দিন। জমিদার বাড়ি সেজেছে বিয়ের সাজে। শুধু জমিদার বাড়ি নয়, সেজেছে পুরো শান্তিপুর গ্রাম।
এখন বেলা ১১টা। আজ মেহবুবা, লাবিব, আরশ আর লামিয়ার গায়ে হলুদ।সেই অনুষ্ঠান হচ্ছে এখন ছেলে আর মেয়ের গোসলের জায়গা করা হয়েছে বাগানে—পুকুর পাড়ের পাশে। এক সাইডে মেয়েদের জন্য, অপর সাইডে ছেলেদের জন্য।
সবাই আছে, শুধু চুমকি বাদে। যবে থেকে জানা গেছে চুমকি প্রেগন্যান্ট, ওই দিন থেকে সবাই চুমকিকে ছোট বাচ্চাদের মতো ট্রিট করছে—
ওটা করা যাবে না, এটা করা যাবে না, ভীরে যাওয়া যাবে না, এটা খাও, ওটা খাও।
এই তো অল্প আগে গিয়েছিল, একটু হলুদ দিতেই আবার পাঠিয়ে দিয়েছে সবাই।
চুমকি এগুলোতে রাগ করে না, বরং ভালই লাগে। এখন চুমকি মহিনকে নিয়ে বসে আছে।
মাহিমও ছিল, কিন্তু মাহিম কাঁদছিল তাই কুলসুম তাকে মেহরিনের কাছে নিয়ে গেছে।
চুমকি মাহিনর সাথে গল্প করছিল।

এমন সময় হঠাৎ তিনজন কালো মুখোশধারী লোক সেই ঘরে ঢুকে পড়ে। ওদের দেখে চুমকি গাবরে গেল। মহিনকে নিজের বুকে চেপে ধরল, যেন একটু আগলা হলেই কেউ নিয়ে যাবে।
চুমকি যে ভয় পেয়েছে, তা বোঝতে না দিয়ে জিজ্ঞেস করল—
এই, কে আপনারা? এখানে ঢুকলেন কী করে?
একজন হেসে উঠল আর বলল—
বাচ্চাটা ভালই ভালই আমাদের হাতে দিয়ে দেন।
চুমকি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল—
কে আপনারা?
লোকগুলো বোধহয় মজা পেল। হেসে হেসে বলল—
এই বাচ্চার জম…

কথাটা শুনেই চুমকির বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। সে কেঁদে উঠল, চিৎকার করতে চাইলো। কিন্তু একজন বন্দুক তাক করে বলল
এই, চিৎকার করলেই তোকে আর ওকে এখানেই মেরে পুতেঁ দেব।
চুমকি কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ হেসে দিল।
লোকগুলো হকচকিয়ে গেল।
চুমকির হাসিতে সে নিজের ওড়নাটা দিয়ে মহিনকে সুন্দর করে নিজের বুকের কাছে বেঁধে নিল।তারপর ভয়ানক একটা হাসি দিয়ে বলল,
ব্রাদার, আপনারা হয়তো জানেন না, আমার জন্ম আমার পরিবারে হলেও আমি আসলে বড় হয়েছি মির্জা বাড়িতে।
ক্লাস ওয়ান থেকে মেহরিন, মেহের, মেহবুবার সাথে। ওখানেই আমার বেড়ে ওঠা। আমি কেমন, আমি কেমন তা হয়তো জানেন না।

ভুল করেছেন ভাইজানরা।
এমন কথা শুনে লোকগুলো আরো রেগে গেল।
একজন ঝাঁঝালো কণ্ঠে কাঁধে বন্দুক রেখে বলল—
এই মেয়ে, মেলা বেশি প্যাঁচাল পারছিস। এখন বাচ্চাটা দিয়ে দে, নইলে দু’জনকেই এখানেই পুঁতে দেব।
চুমকি হঠাৎ ভয়ংকর রূপ ধারণ করল।
চোখ দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছে। আঙুল তুলে বলল—
হিশশশ, আস্তে বল। আমার সন্তান যদি জেগে যায়, তবে তোদের এখানেই পুঁতে ফেলব!
তুই বা তোরা কারা? যে এক মায়ের কাছ থেকে তার সন্তান কেড়ে নিতে চাইছিস?
শুনে রাখ—এটা আমার সন্তান। আর আমি বেঁচে থাকতে একে নেওয়া তো দূরের কথা, ছুঁতেও পারবি না।তার আগেই তোদের শরীর থেকে মাথা আলাদা করে দেব, জানোয়ারের দল!
লোকগুলো হেসে বলল—

এই নাটক বন্ধ কর। এটা তোর নয়, মেহরিন শিকদারের বাচ্চা।
চুমকি হেসে উঠল—
আররে বোকার দল! এই বাচ্চা আমাদের দু’জনের।
যার একটা মা আছে, তাদের সন্তানকে তোরদের মতো নরপিশাচরা কিছুই করতে পারবে না। এখন তো আমি সন্তানদের মা—দুই, দুটো! ভাব, তোরা কী করতে পারবি?
বাপের বেটা হলে এসে দেখ না, পারিস কি না?
একজন এগিয়ে এলো।
চুমকি নিজের পা সামান্য তুলে বের করল ধারালো কিছু একটা—চুরির মতো।
এক হাতে মহিনকে শক্ত করে বুকে ধরে, অন্য হাতে চালাল মায়ের তাণ্ডব।
মুহূর্তেই মনে হলো চুমকির শরীরে হাজার জনের শক্তি। সে এক ঝটকায় সামনের লোকটার গলায় একসাথে ২–৩টা কোপ বসিয়ে দিল। পেছনের দু’জন অবাক হয়ে গেল।

একজন এগিয়ে আসতে চাইলে চুমকি হাতের অস্ত্র ছুঁড়ে মারল তার কপালে।
লোকটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
তৃতীয় জন তেড়ে আসতে চাইলো, কিন্তু তার আগেই দুটো গুলি এসে লাগল লোকটার মাথায় আর পিঠে। সে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
চুমকি তাকিয়ে দেখল—
এক লোক দাঁড়িয়ে আছে সামনে।
গায়ে স্যুট, পায়ে কালো প্যান্ট, একদম পারফেক্ট জেন্টেলম্যান।
তার পেছনে ফিরোজ মির্জা।
দেখে চুমকি হেসে উঠল—
পাপা…. আংকল…

সামনের ভদ্রলোক এগিয়ে এসে চুমকিকে জড়িয়ে ধরলেন—
I am coming, মেরি বাচ্চা। papa in comeing..
চুমকিও তাঁকে জড়িয়ে ধরল।
হাসতে হাসতে এগিয়ে এলেন ফিরোজ মির্জা।
এমন সময় চুমকি চিৎকার করে উঠল।
আ..আংকল……..
সাথে সাথে সরে গিয়ে পেছনের লোকটার দিকে আরেকটা গুলি চালালেন ফিরোজ মির্জা।
চুমকি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।
এত চিৎকার-গুলির শব্দ কেউ শুনতে পেল না, কারণ বক্সা বাজছে। ওই লোক আর ফিরোজ মির্জার বন্দুকগুলোতে সাইলেন্সার লাগানো ছিল।
ফিরোজ মির্জা ভেতরে এসে চুমকিকে জড়িয়ে ধরে বললেন—ঠিক আছিস মা?
চুমকি মাথা নাড়ল।
ওই ভদ্রলোক বললেন—

উফ্‌ ফিরোজ ভুলে যাচ্ছিস কেন? আমাদের চার মেয়ে, কারও থেকে কেউ কম নয়। আমরা তাদের ওভাবেই বড় করেছি। তারা সবাই নিজেকে সেভ করতে জানে।
চুমকি হাসছে।
তারপর তাঁরা বেরিয়ে গেলেন, সবাইকে সতর্ক করতে যে শত্রুরা ভেতরে ঢুকে পড়েছে।
হঠাৎ তারা থামল। ফিরোজ মির্জা আর ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে চুমকিকে বললেন—
তুই যা, তবে সাবধানে। এই দিকটা আমরা সামলাচ্ছি। মনে হচ্ছে আরো লোক আছে।
চুমকি মাথা নাড়ল।
সে একটু এগিয়েই টের পেল, কেউ আছে।
দৌড়ে ঢুকে গেল লাবিবের রুমে।
আর হাত তুলে দিল ফুলদানি।

যা সন্দেহ করেছিল তাই সাথেসাথেই দু’জন ঢুকে গেল ঘরে। চুমকি ফুলদানি দিয়ে একজনের মাথায় আঘাত করলো, আরেকজন এগিয়ে এসে কিছু বুজার আগেই ডাইরেক্ট একটা লাথি মারলো চুমকির পেটে।
চুমকি “মা গো” বলে পিছিয়ে গেল। লোকটা একটা ফুলদানি তুলে চুমকির মাথায় মেরে দিল। পেটের ব্যথায় চুমকি কাত হয়ে গেল, তাই আক্রমণের মোকাবিলা করতে পারলো না।
এমন সময় লাবিব আসে—কারণ তার ফোনটা ঘরেই ছিল। কারও পায়ের শব্দ শুনেই লোকটা চুমকির কোলে থাকা মাহিনকে নিয়ে নিলো।

লাবিব ঘরে ঢুকেই আঁতকে উঠলো, চুমকিকে ওইভাবে দেখে। চুমকি তখনও জ্ঞান হারায়নি, লোকটার সাথে ধস্তাধস্তি করছিল মাহিনকে নিয়ে যাওয়ার ওদের হাত থেকে বাঁচাতে।
লাবিব সাথে সাথে নিজের পিছনে গুঁজে রাখা বন্দুক বের করলো আর চিৎকার করে বললো,
কু*ত্তার বাচ্চা, রাখ আমার বাচ্চাকে! রাখ বলছি কুত্তার বাচ্চা! দে আমার কাছে দে আমার বাচ্চাকে! দে! বলছি, নইলে মেরে দিবো। কসম খোদার, শুধু তোকে না পুরো বংশ ধ্বংস করে দিবো। দে আমার বাচ্চাকে!
লোকটা ভয় পেয়ে মাহিনের দিকে বন্দুক ঠেকিয়ে বলল—
গান ফেল, নইলে এটাকে মেরে দিবো।

লাবিব গাবরে গেল। হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। চিৎকার করে বলল—
না না না, আমি ফেলে দিচ্ছি! এই দেখো, ফেলে দিয়েছি। দে আমার বাচ্চাকে। দে, দিয়ে দে, কিছু করবো না তোকে দিয়ে দে আমার বচ্চাকে।
লোকটা এবার সাহস পেল। চুমকিকে একটা লাথি মেরে ফেলে দিলো।
লাবিব চিৎকার করে উঠলো—
“চুমকি আপু!!”
চুমকি আটকে আটকে বলল—
লা.লাবিব… আ.আমার বাচ্চা… আমার মাহিনকে… ও.ওরা নিয়ে যাচ্ছে… লাবিব… আমার মাহিনকে…
বলতে বলতে চুমকি জ্ঞান হারালো।
লাবিব দৌড়ে যেতে চাইল, এমন সময় লোকটা বললো—
খবরদার! সামনে আসবি না। আমার সাথে চল।

লাবিব কি করবে বুঝলো না, শুধু এতটুকুই বুঝলো মাহিন বিপদে। একন তার একটা ভুল মানে মাহিনের জীবনের যুকি। তাই মন শক্ত করে ধীরে ধীরে এগোলো। পথে আস্তে করে ওর্ডপ থেকে একটা মিনি ফোন বের করে কোনোমতে নিজের আন্ডারপ্যান্টে রেখে দিলো।

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৭৫

লোকটা ডাক দিলো, আরেকজন এসে লাবিবের মাথায় বন্দুক ধরলো। এগুলো লাবিবের কাছে কোনো ব্যাপার ছিল না, চাইলে একাই ১২–১৩ জনকে সামলাতে পারতো। কিন্তু এখন ভয়—মাহিনকে নিয়ে ওরা যদি কিছু করে ফেলে।
তাই লাবিবও গেল তাদের সাথে। তবে যাবার আগে পা দিয়ে ফেলে দিলো লাল রঙের একটা তরল, আর পায়ের আঙুল দিয়ে কয়েকটা চিহ্ন আঁকল—যেন রাজ বুঝতে পারে ওর এসএমএস।
ওই লোকগুলো মাহিন আর লাবিবকে নিয়ে বাড়ির পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে গেল।

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৭৭