মেহেরজান পর্ব ৩১
লেখনীতে- সোহা
খুব ভোরেই সকলে ঘুম থেকে উঠেছে। ব্যাগপত্র রেডি করছে বৃষ্টিরা। রাউশি ভীষণ খুশি। হাসনা বেগম নাশতা বানাচ্ছেন আর সৃষ্টি মাকে সাহায্য করছে আজ। মেহরান বাইরে গিয়েছে। সাথে নুজাইশও আছে। নুজাইশও খুব ভোরেই যোগ দিয়েছে সবার সাথে। নুজাইশ রাউশির দিকে তাকাতে পারে না। কেমন জড়তা কাজ করে তবে ভালোবাসা সেটা যেন আমরণ পর্যন্ত। নুজাইশ মনে মনে হাসে শুধু। নুজাইশের জীবনে তার জানা মৌরিন যেন আজীবন দূরদর্শী হয়ে থাকবে। নুজাইশ ভীষণ খুশি মৌরিন তার জীবনে এসে। হ্যা সে মৌরিনকে পায় নি তাতে কি? জীবনে যা চাইবে সবকিছু যে পাবে এমন কোনো কথা নেই। মৌরিন যেন দূর থেকেই সুন্দর। দূর আকাশের সেই চাঁদের মতো। এখন শুধু ভাবে ভাগ্যিস মৌরিনকে ভালোবাসার কথা জানায় নি সে। নয়তো মেয়েটা তার সাথে কথা বলতে জড়তায় ভুগতো।
মেহরান আর নুজাইশ বাড়িতে ফিরলো। ততক্ষণে সমস্ত নাশতা রেডি। হাসনা বেগম ঘরে সাজাচ্ছেন। মেহরান মুখে পানি দিলো হাত ধুয়ে চলে গেলো। মূলত সকাল সকাল তারা একটি পুলিশ অফিসারের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো। সকাল সকাল যাওয়ার কারণ হলো ওই পুলিশ অফিসারই কল করেছিলো নুজাইশকে। নুজাইশ মেহরানকে বলে দুজনে পুলিশ অফিসারের সাথে দেখা করতে গেছে। পুলিশ অফিসার জানিয়েছেন পাওনা টাকার জন্য এক মুদি দোকানী মতিন মোড়লকে কুপিয়েছে। মেহরানের হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়েছিলো কথাটা শুনে। পাওনা টাকার জন্য মানুষ এতটা নিচে নামতে পারে। মেহরান ক্রেডিট কার্ডটা আনে নি সাথে করে। আপাতত নুজাইশের টাকা দিয়েই চলছে। নুজাইশের দিকে তাকালে নুজাইশ চোখ দিয়ে বোঝায় সে টাকাগুলো পরিশোধ করে দেবে।
নুজাইশ হাত ধোয়ার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলো। দূরে ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে ছিলো। মৌরিনের কথাই ভাবছিলো। তখনই রাউশি আসলো। নুজাইশের দৃষ্টি অনুসারে দূরে তাকিয়ে বললো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“স্যার কি ভাবছেন? খেতে চলুন। হাত ধোবেন? দাঁড়ান আমি পানি ঢেলে দিচ্ছি। ”
মৌরিনের কণ্ঠস্বর শুনে নুজাইশ তার মৌরিনের দিকে তাকালো। মুচকি হেসে বললো,
“একজনের কথা ভাবছিলাম। আমার না হওয়া চাঁদের ব্যাপারে।”
শেষের কথাটা খুব আস্তে করে বললো রাউশি শুনলো না।রাউশির কথায় হাত পাতলো ধোয়ার জন্য। আর জিজ্ঞাসা করলো,
“কার কথা ভাবছিলেন স্যার?”
পরে শিক্ষককে কি জিজ্ঞাসা করছে মনে পড়তেই জিহ্ব কেটে বললো,
“আসলে সরি স্যার।”
নুজাইশ কপাল কুঁচকে বললো,
“সম্পর্কে তুমি আমার ভাবী হও। আবার আত্মীয়তার সম্পর্কে তোমার শ্বশুর আমার বাবার দাদীর বোনের নাতি। এদিক থেকেও আমরা সম্পর্কিত। শুধুমাত্র ভার্সিটির হিসেবে স্যার ডেকো না প্লিজ।নিজেকে ভুড়িওয়ালা, মাথামোটা, গোমড়ামুখো লাগে।আর অফকোর্স আমি গোমড়ামুখো, ভুড়িওয়ালা, মাথামোটা নই। আই নো আ’ম অলসো হ্যান্ডসাম।”
বলে শার্টের কলারটা একটু ধরলো। রাউশি ফিক করে হেসে দিলো। নুজাইশ দেখলো সেটা। তার খুব ভালো লাগলো। রাউশি ভাবুক হয়ে বললো,
“তাহলে আপনাকে কি ডাকা যায় স্যার?”
“আবার স্যার?”
“ওহ সরি সরি স্যার।”
“স্যার!”
“ওহ সরি মি. শাহ।”
“মি. শাহ কি?”
“তাহলে নুজাইশ ভাইয়া।”
“এই রাউশি ভাইয়া না প্লিজ।”
রাউশি ভাবলো কি ডাকা যায়।ভেবে বললো,
“মেহরান যেহেতু নাম ধরে ডাকে। তাহলে আমিও নাম ধরেই ডাকবো। হ্যা আপনি আমার থেকে বড় এমনকি আমার শিক্ষক তবে আমার না নামকরণে একটু কষ্ট হয়।”
“আপনার যা ইচ্ছা তাই ডাকুন মিসেস. মেহরান খান।”
রাউশি হেসে উঠলো। নুজাইশও সঙ্গ দিলো। খাওয়া দাওয়া শেষে মেহরান নুজাইশের ফোন নিয়ে তানজিমকে কল করে জানালো তারা কিছুক্ষণ পর রওনা দেবে।সাবধানে যাওয়ার জন্য বললো মেহরান।
মেহরান রাউশির পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলো। সব শুনলো সে। মেহরান পেছনে ফিরে তাকাতেই রাউশিকে দেখলো। রাউশি একটা মিষ্টি হাসি দিলো। তাকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে রাউশি আজ কি পরিমাণ খুশি। মেহরান রাউশির মাথায় একটা হাত রেখে বললো,
“খুব খুশি আজকে।”
“আপনাকে আমি বিশ্বাস করাতে পারবো না যে আমি অনেক খুশি।তবে মতিন আঙ্কেলের জন্য অনেক খারাপ লাগছে।উনি থাকলে উনিও যেতে পারতেন আমাদের সাথে। কতই না ভালো হতো বলুন।”
মেহরানও দীর্ঘশ্বাস ফেললো।রাউশি পুনরায় বললো,
“শুনুন না।”
মেহরান দুষ্টুমির সুরে বললো,
“বলো না।”
রাউশি মেহরানের এমন কথা শুনে হেসে ফেললো।বললো,
“বৃষ্টি আমার সাথে বসে যাবে। দেখুন আমি এতদিন পর একজন মনমতো বান্ধবী পেয়েছি। ওর কষ্টের কথা আমি জানি। আর ওর অতীতও আমার মতোই।”
বলে ম্লান হাসলো রাউশি।তারপর আবারও বললো,
“আচ্ছা আমরা বৃষ্টিকে আবার বিয়ে দেব।”
মেহরান ভ্রু কুঁচকালো।মাথায় আসলো নুজাইশের কথা।তবে সেটা মেহরান নিজেই করতে দেবে না।কারণ ছেলেটা বিয়ে থেকে বাঁচতেই তাদের সাথে এসেছে।কিন্তু রাউশি বৃষ্টির বিয়ে নিয়ে ভাবছে কেন?আর এত তাড়াতাড়ি।রাউশি আবারও বলল,
“আমরা ওর জন্য যোগ্য পাত্র খুঁজবো ঢাকা গেলে। কি বলেন? ও আগে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করুক তারপর।”
বলেই চমৎকার হাসলো রাউশি।তারপর আবারও বলল,
“ওদের থাকার ব্যবস্থা কিন্তু সব আপনি করে দেবেন।”
মেহরান রাউশির কোমল হাত দুইটা ধরে বলল,
“আমিই করে দেব।এখন শোন একটা কথা।”
রাউশি চোখ দিয়ে বোঝালো ‘কি কথা?’
মেহরান টুপ করে রাউশির গালে একটা চুমু দিয়ে বলল,
“এই কথা।”
রাউশি আশেপাশে একবার তাকালো।এটা বাড়ির পেছনের দিক।তাই কেউ দেখার কথা নয়।তাই নিজেই পা উঁচিয়ে মেহরানের ঠোঁটে হালকা করে ছোট্ট চুমু দিয়ে একমুহুর্তও আর সেখানে না দাঁড়িয়ে চলে গেলো।মেহরান নিম্নের ঠোঁট কামড়ে হাসলো শুধু।
বৃষ্টি আর নুজাইশ ঝগড়া করছে।বৃষ্টি উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছিলো। নুজাইশ বাশের পাশে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ছিলো।হাজার বার সড়তে বললেও যখন সড়লো না।রেগেমেগে চেঁচালে নুজাইশ তাকে ডাইনি বললে বৃষ্টি ভীষণ রেগে যায়।নুজাইশও কম না। তবে তাদের এই ঝগড়ার মাঝেই আবার আগমন ঘটে সাঈদের।সাঈদকে এখানে দেখে ভীষণ চমকে গেলো।এই ছেলে এখানে কি করছে? আর জানলোই বা কি করে?
“শুধু তুই আর মেহরান তো প্রকৃতি উপভোগ করতে পারিস না।তাই আমরাও চলে আসলাম।”
‘আমরা’ শব্দটা শুনতেই নুজাইশ ভ্রু কুঁচকালো। সাঈদের পেছনে দেখা গেলো তুষার আর এহসানও আছে। তুষার নুজাইশের কাছে এগিয়ে এসে বললো,
“শালা গে হয়ে গেলি নাকি? এভাবে ঝগড়া করছিস কেন?”
নুজাইশ ভ্রুদ্বয়ের মাঝে ভাঁজ ফেলে এদের দিকে তাকিয়ে আছে। এরা দলবল নিয়ে এখানে কি করতে এসেছে?রাউশি তাড়াহুড়ো করে বাড়ির সামনে আসতেই সাঈদদের দেখতে পেলো।সাঈদদের না চিনলেও এদের সেদিন নুজাইশের বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখেছিলো।তবে এরা এখানে এই সময়ে কি করছে বুঝতে পারলো না রাউশি নিজেও।মেহরান এসে রাউশির পাশে দাঁড়ালো।রাউশি মেহরানকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এহসান রসিকতা করে মেহরানকে বলল,
“আমাদের চোখে পড়ে না তোদের? এতো ঘেষাঘেষি করিস কেন? সবেই তো বিয়ে হলো।”
মেহরান সেসবে কান না দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,
“গাড়ি রেডি আছে?”
সাঈদ বলল,
“গ্রামের রাস্তা ভালো না।গাড়িটা পুলিশ স্টেশনের সামনে রেখে এসেছি।গ্রামের মানুষজন যা গাড়িটা চাবি ছাড়াই ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাবে।আসার সময়ও কিভাবে যেন তাকিয়ে ছিলো।”
মেহরান শুনেছে গ্রামের লোকেরা আজকে বৃষ্টিদের বাড়িতে এসে বিভিন্ন ঝামেলা করতে পারে।সাঈদরা সিলেট এসেছিলো একটা কাজে।মেহরান তাদের ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য বললে সাঈদরা সঙ্গে সঙ্গেই এসেছে।মেহরান বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলল,
“বৃষ্টি আপত্তি না থাকলে আমি চাইছি এখনই চলে যেতে।নাহলে অনেক ঝামেলার মুখোমুখি হতে হবে।”
বৃষ্টি কি বলবে ভেবে পেলো না।এখনই চলে যাওয়া! তবে না করলো না।মাথা নাড়ালো। মেহরান এগিয়ে গিয়ে বলল,
“ভয় পেয়ো না।আমাদের ওপর ভরসা রাখো। তোমার ভবিষ্যত তুমি নিজেই ঠিক করবে।আমরা শুধু সহায়তা করবো।”
বৃষ্টি মাথা নাড়ালো।মেহরান পেছনে ফিরে রাউশিকে বলল,
“রেডি হয়ে নে।”
মেহরান রাউশি, বৃষ্টি,হাসনা বেগম আর সৃষ্টির জন্য বাজার থেকে জামাকাপড় কিনে এনেছে গতকাল বিকেলে।
সবাই রেডি হয়ে গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে রওনা দিলো।গ্রামের লোকেরা কেমন চোখে তাকিয়ে ছিলো।তবে আসার সময় কোনো ঝামেলা হয় নি।কারণ সেইসময়ে গ্রামের মানুষজন কম ছিল।সবাই যে যার ঘরে ছিলো।শুধু কিছুজন বাদে।পুলিশ স্টেশনের সামনে আসার পর সাঈদরা গাড়িতে উঠে বসলো। সবাই উঠে বসলো। হাসনা বেগম কেমন মুখ শুকনো করে রেখেছেন।স্বামীর কবরের পাশে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে ছিলেন আসার আগে।বৃষ্টি, সৃষ্টিও ছিলো।তাদের চোখ দেখলেই বোঝা যায় মানুষগুলো কান্না করেছে।বুক ভার করে নিজগৃহ ছেড়ে যেতে হচ্ছে।তবে নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য হলেও তো ছাড়তে হবে বাড়ি।বৃষ্টি রাউশির প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকবে।
মেহেরজান পর্ব ৩০
মাইক্রো বাসটাই বারোজনের বসার সিট হওয়ায় খুব সবাই যার যার মতো করে বসেছে। সাঈদ গাড়ি ড্রাইভিং করবে। নুজাইশ, এহসান, তুষার মিলে অহেতুক কথাবার্তা বলছে।বৃষ্টি আর রাউশি দুজনে একসাথে বসেছে।সৃষ্টি বসে রয়েছে হাসনা বেগমের পাশে। আর হাসনা বেগম চোখ বুজে বসে রয়েছেন।
এদিকে মেহরান সবার পেছনে কেমন চিন্তিত মুখে বসে আছে।কোনো বিষয় নিয়ে মেহরান আজ খুব চিন্তিত।মেহরানের চোখেমুখে গাঢ় চিন্তার ছাপ। তবে ঠিক কি বিষয় নিয়ে চিন্তির মেহরান সেটা কেউই জানে না।