মেহেরজান পর্ব ৩৮

মেহেরজান পর্ব ৩৮
লেখনীতে- সোহা

প্রিয় মানুষটির মুখ হতে নিঃসৃত বাক্যগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করলো রাউশি। খুবই শান্ত ভঙ্গিতে পেছনে ঘুরে তাকালো। চোখে পড়লো তার থেকে ছয় সাত হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটার দিকে। মাথায় ব্যান্ডেজ করা, বলিষ্ঠতা কমে শুকনো মুখ, ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসির রেখা। তবে সেই হাসিটা কেমন মলিন লাগলো রাউশির কাছে। রাউশির মনে হচ্ছে হাজার বছর পর দেখা পেল সে মেহরানের। স্থির দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ একধ্যানেই তাকিয়ে রইলো।

মেহরান রাউশির কাছে এগিয়ে এলো। রাউশি কাঁদলো না। বরং স্থিরচোখেই পলক ফেলে তাকিয়ে রইলো মেহরানের দিকে। মেহরান তার আরও কাছে এগিয়ে এসে বলল,
“কথা বলবি না?”
রাউশি সৎবিৎ ফিরে পেলো। একবার নিচে তাকিয়ে আবারও মেহরানের দিকে তাকালো। ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কেমন আছেন?”
মেহরান হাসলো। রাউশির মাথা ডান হাত রেখে বলল,
“সামনে কাঙ্ক্ষিত নারী দাঁড়িয়ে আর মেহরান ভালো থাকবে না? তা কি করে হয় রাউশি?”
রাউশি এবার মুচকি হাসলো। রাউশিকে অন্যদিনের তুলনায় অনেক চুপচাপ লাগছে। মেহরান রাউশির গালে হাত রেখে বলল,
“অভিমান করেছিস?”
“না।”
“তাহলে কথা বলছিস না যে?”
রাউশি এবার মেহরানের হাত ধরলো। মাথা নিচু করে বারকয়েক দীর্ঘশ্বাস নিলো। এরপর মেহরানের দিকে তাকিয়ে কোনো কথা না বলে পা দুটি উঁচিয়ে মেহরানের কপালে ঠোঁট ছুইয়ে দিলো। মেহরান আবেশে চোখ বুজলো। ফিসফিস করে বলেই ফেলল,

“ব্যাস এতটুকুই?”
রাউশি হেসে উঠলো। টুপ করে মেহরানের শুষ্ক ঠোঁটজোড়ায়ও একটা চুমু দিলো। মেহরান রাউশির এহেন কাজে হেসে ফেললো। রাউশির দিকে ঝুকে বলল,
“তানজিম যখন বললো তুই আমার ব্যাপারে সব জেনে গিয়েছিস, তখন ভেবেছিলাম না জানি কতদিন লাগবে তোর অভিমান ভাঙতে। কিন্তু আমি বুঝতে পারি নি আমার রাউশিটা এতো বুঝে আমাকে। এজন্যই তো_”
বাকিটুকু বলার আগে রাউশির কপালে গাঢ় চুম্বন এঁকে দিলো মেহরান। রাউশির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

“অনেক বেশি ভালোবাসি।”
কথাটা শেষ করেই মেহরান এক হাতে রাউশির কোমড় জড়িয়ে ধরলো । অন্য হাতে কানের পাশে পড়ে থাকা চুলগুলো কানের পেছনে গুজে দিলো। উষ্ণ হাতের তালু রাউশির গালে রেখে নাকে নাক ঘষলো। একইভাবে ফিসফিসিয়ে আওড়ালো,
“আমায় ক্ষমা করে দিস। সত্যিটা বলতে পারি নি। বেঁচে না থা_”
রাউশি আর বলতে দিলো না মেহরানকে। ঠোঁটে হাত রেখে বলল,
“আমার সাথে পুরো একটা জীবন কাটিয়ে দিন। মৃত্যু যদিই হয় তবে দুজনের একসাথেই হোক।”
মেহরানও কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
“তাই হোক তবে।”
মেহরান এবার নিজের উষ্ণ শুষ্ক ঠোঁটজোড়া রাউশির ওষ্ঠপুটে ডুবিয়ে দিলো। নিস্তব্ধ রজনীর মাঝে হালকা নাতিশীতোষ্ণ বাতাস জানান দিলো কিছু প্রশান্তির।

এই গভীর রাতেই ছোটখাটো একটা সভা বসেছে খান বাড়িতে। বাড়ির বড় ছোট সবাই উপস্থিত। সভার মধ্যবিন্দু হলো মেহরান। উর্মিলা বেগম রোকসানা বেগম আর রূপা বেগমের মাঝে বসে কেঁদে চলেছেন ছেলের অসুস্থতার কথা শুনে। অনেকেই স্বান্তনা দিচ্ছে তবে তিনি থামছেন না। নাহিন,মাইশা, তানিয়া, তাজবিরের ঘুম পাচ্ছে। ঢুলুঢুলু চোখে তাকিয়ে রয়েছে।

এদিকে মাহবুব খান সবাইকেই বলছেন ঘটনা। ঘটনা যত গভীরে যাচ্ছে বাড়ির কর্ত্রীদের কান্নার বেগ বাড়ছে। এতক্ষণ শুধুমাত্র উর্মিলা বেগমই কান্না করছিলেন এবার রূপা বেগম আর রোকসানা বেগমও যোগ দিলেন। এদিকে মাহতাব খান তো অবাকের চরম পর্যায়ে চলে গেছেন। চোখ বড় বড় করে শুধু তাকিয়েই আছেন। রাউশি মেহরানের পাশে বসেছে। মেহরানের সেসবে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে তো উজানকে মেসেজ দিয়ে যাচ্ছে।
উজান বাড়িতে একবার দুবার এসে দেখা করে যেতো শুধু। এইতো আজ তানিয়াকে দেখে গেলো পাত্রপক্ষ। ছেলেটা আজও আসে নি। একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করছে উজান। ঢাকার মিরপুরে একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকে নিজের টাকায়। মাহবুব খান ছেলেকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। তবে উজান মানা করে দিয়েছে। মেহরান এসেই উজানকে মেসেজ দিয়ে যাচ্ছে।
উজানও জানালো যে সে আসছে। এদিকে মাহমুদ খান বললেন,

“মেহরান অনেক বড় রোগ থেকে বেঁচে ফিরেছে। ওকে কিছুদিন রেস্টে থাকতে হবে। তাই ওদের ঘুমাতে যেতে দেওয়া হোক।”
একদিকে শ্বশুর তো অন্যদিকে মেজো চাচা। মাহমুদ খানের কথা শুনে মেহরান খুব খুশি হলো। উঠে দাঁড়িয়ে মায়ের কাছে গেলো আগে। উর্মিলা বেগম ছেলেকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরে কান্নাভেজা গলায় বললেন,
“বাপ রে আমাদের বুঝি কষ্ট হয় না? এভাবে আমাদের না জানিয়ে গেলি কেন? আর একটাবারও কথা বলিস নি।”
তানজিম পেছন থেকে বলল,

“মেহরান ভাই তো এই কয়মাসই কোমায় ছিলেন। কথা কিভাবে বলতেন।”
উর্মিলা বেগমের কান্না আরও জড়ালো হলো। মেহরান মায়ের চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,
“তোমাদের যদি জানানো হতো তবে তোমরা ট্রমায় থাকতে মা।দেখো, আমি সুস্থ আছি। তোমার দোয়ায় আল্লাহর দোয়ায় আমি সুস্থ আছি। তুমি শুধুশুধু কান্না করো না মা।তোমার কান্না আমার ভালো লাগে না।”
উর্মিলা বেগম কেঁদে কেঁদেই বললেন,
“তুই আর কি বুঝবি রে বাপ?”
এরপর মাহবুব খানের দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙিয়ে বললেন,

“ও নাহয় বাচ্চা মানুষ। কিন্তু তুমি বুড়ো হয়ে কিছুদিন পর নাতি দেখবে। তোমারও কোনো আক্কেল নেই।”
মাহবুব খান বউয়ের কথায় একবার চারপাশে তাকালেন। বাচ্চারা কেমন মুখ টিপে হাসছে। হালকা কাঁশলেন মাহবুব খান। তিনিই বা আর কি বলতেন? যদি কথাটা ভাইরাল হতো তাহলে পুরো বাড়ির প্রতিটা মানুষই মেহরানের মতো কোমায় থাকতো এতদিন। মাহবুব খান চুপ রইলেন।
মেহরান আবারও মায়ের চোখ মুছে দিলো। আর বলল,
“কেঁদো না মা। আমি একদম ঠিক আছি। আমি খুবই ক্লান্ত মা। এখন কিছুটা রেস্টের দরকার!”
ছেলের কপালে চুমু খেয়ে উর্মিলা বেগম বললেন,
“ঠিক আছে যা ঘুমা গিয়ে। বাবা কিছু খাবি না?”
উনার এই কথাটা শুনে বাড়ির ছেলেমেয়েগুলো সব একে একে নিজেদের রুমে চলে গেলো। এটা দেখে বাড়ির বড়রা শুধু তাকিয়ে রইলেন। রাউশি মেহরানের জন্য অপেক্ষা করছে। মেহরান বলল,
“আমার ক্ষিদে নেই মা। আপাতত একটা ঘুমের দরকার।”

উর্মিলা বেগম রাউশিকে ইশারা করলেন মেহরানকে নিয়ে যেতে। রাউশিও মেহরানকে চলুন বলে হাত ধরলো। তারাও চলে গেলো। দুজনকে এক সাথে দেখে বাড়ির বড়রা মাশা-আল্লাহ আওড়ালেন।
রুমে এসে মেহরান দরজা বন্ধ করে দিলো। রাউশি মেহরানের জন্য কাভার্ড থেকে জামাকাপড় বের করে দিলো। মেহরান সেসব নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো ফ্রেশ হওয়ার জন্য। শাওয়ার নেওয়াটা অতিব জরুরী এখন।
রাউশি বিছানা ঝারলো। মেহরানের জন্য অপেক্ষা করলো। মেহরান বের হলো। রাউশি এগিয়ে গেলো মেহরানের দিকে।

“আপনি এখনও অসুস্থ। ঠিকভাবে সুস্থ হোন নিম কিছুদিন বাড়িতে থেকেই রেস্ট করবেন।”
মেহরান টাওয়ালটা মাথায় রেখেই বলল,
“যথা আজ্ঞা আমার রানী।”
রাউশি মেহরানকে খাটের ওপর বসিয়ে টাওয়ালটা দিয়ে মেহরানের চুল মুছে দিলো। মেহরান হুট করেই রাউশির কোমড় জড়িয়ে ধরলো। রাউশিকে বিছানায় ফেলে নিজেও রাউশির পাশে শুয়ে রাউশিকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“এখন একটা প্রশান্তির ঘুম দরকার। পাশে অবশ্যই তোকে চাই।”
রাউশি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো না। মেহরানকে হারানোর ভয় তাকে জেকে বসেছে। মেহরানকে অন্তত তার জন্য সুস্থ থাকতে হবে। মেহরানকে আর কখনোই কষ্ট দেবে না সে। মেহরানের কপালে চুমু দিয়ে নিজেও চুপ করে রইলো। মেহরান বলল,

মেহেরজান পর্ব ৩৭

“ঘুমা।”
বাইরে থেকে বারান্দার পর্দা ভেদ করে বাতাস এসে দুজনের গা ছুয়ে দিলো। অনেকদিন মাস পর আজ হয়তোবা দুজনের শান্তির এক ঘুম হবে!

মেহেরজান পর্ব ৩৯