মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ২০
সাদিয়া
“ভাবি কাজ টা কি আপনি ঠিক করলেন?”
আনতারা বেগমের চাঁপা গলার কথার মানেটা ফাতেমা বেগম ধরলেন। তিনি নম্র গলাতেই উত্তর দিলেন,
“আল্লাহ, আপা আমি তো কিছুই জানি না তেমন। ছেলেটা ৯ টার দিকে বাসায় এসেছে। হাতে যে কত কি আবিজাবি নিয়ে এসে তুহিন কে দিল জানি না কিছু। আমাদের বাসায় তো এক গ্লাস পানিও খায়নি। আসছি বলেই বের হয়ে গিয়েছে। পরে তুহিনের কাছ থেকে জানলাম মেয়েকে আনতে জামাই নিজেই চলে গিয়েছে ওখানে। কিভাবে বলব বলুন?”
“জামাই প্রথম আমাদের বাড়ি এলো। একটু পোলাও, রোস্ট আর খাসির গোশত রান্না করেছিলাম। খুব বেশি কিছু করতেও পারিনি অল্প সময়ে। এসে পর থেকেই শুধু তাড়া দিচ্ছে চলে যাবে বলে। খুব খারাপ লাগছে আমার।”
“চিন্তা করবেন না আপা। আরেকবার ইহাম বাবা কে নিয়ে যাবো আপনাদের ওখানে। আচ্ছা ওরা কি রওনা দিয়েছে?”
“হ্যাঁ ভাবি। এই তো মাগরিবের পরই বের হলো।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
জ্যাম এর পাল্লায় পড়ে ২ ঘন্টার রাস্তা আসতে সাড়ে তিন ঘন্টা লাগল। বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে তখন রাত প্রায় ১০ টার মতো বেজে গিয়েছে। ইহামের তখনের করা কাজের পর থেকে দুজনের মাঝে আর তেমন কথা হয়নি। কয়েকবার চোখে চোখ পড়ার পর দুজনই সংগোপনে সরিয়ে নিয়েছে। ইহাম নিজেও খুব একটা কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করেনি। বাসায় ঢুকে মহিন সাহেব কে দেখেই বিনম্র গলায় ইহাম উনাকে সালাম জানাল। মহিন সাহেব আপ্লুত হয়ে হেসে জবাব দিলেন,
“ওলাইকুম আসসালাম বাবা। তুমি সকালে এসেই নাকি চলে গিয়েছিলে?”
“জ্বি আব্বু। মায়রা কে আনতে ফুপির বাসায় গিয়েছিলাম।
মায়রা ভোতা মুখ নিয়ে হনহন করেই চলে গেল। ইহাম না চাইতেও ক্লান্ত শরীরটা নিয়েই সোফায় বসল। মহিন সাহেবের সাথে সৌজন্যতা দেখিয়ে অবসাদ গতর নিয়েই আলোচনায় বসেছে। এক পর্যায়ে ইহাম কৌতূহল দেখাতে প্রশ্ন করল,
“আপনার রিটায়ার্ড কবে আব্বু?”
“আছে বাবা আরো কয়েক বছর। হাতে কিছু টাকা আছে, ভাবছি পেনসন পাবার পর ফ্ল্যাট কিনে রাখব। আর যাই হোক বাকি জীবনের চিন্তা থাকবে না ইনশাল্লাহ। বিদ্যাশ্রমের ভাত না খেয়ে তখন বুড়োবুড়ি সংসারটা কেটে যাবে।”
“এভাবে বলছেন কেন আব্বু? তুহিন আছে আমি আছি। আমার বাবা মা আর আপনাদের মাঝে তো কোনো পার্থক্য নেই।”
মহিন সাহেব বুঝি খুব তৃপ্তিতা নিয়ে হাসলেন। জবাব দিলেন,
“তুহিন আমার খুব ভালো ছেলে। ওকে দিয়ে এই আশা করি না। তবুও ছেলেদের মন বিয়ের পর কি থেকে কি হয় জানা নেই। তাছাড়া ও বিদেশ গেলে আশা করি ওখানেই সেটেল হয়ে যাবে। ওকে বলেছি তবে ও রাজি না। পড়া শেষ করে সে দেশেই ফিরে আসবে বলে জানিয়েছে।”
“তুহিন খুব ভালো ছেলে আব্বু। ও কখনো এমন করবে না।”
“আল্লাহ দুনিয়ার সকল ছেলেদের বুঝার তৌফিক দান করুন। আচ্ছা বাবা তুমি যাও রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। তোমার শাশুড়ির রান্নাবান্না মনে হয় শেষ। ডিনারের জন্যে এখনি চিৎকার করবে।”
ইহাম খানিক হেসে এগিয়ে গেল মায়রার রুমের দিকে। মনে মনে ভাবল তুহিনের বিষয়টা নিয়ে। ঘরে ঢুকে দেখতে পেল মায়রা একটা সুতির থ্রিপিজ পরেছে। আয়নার সামনে বসে হাতে পায়ে লোশন মেখে যাচ্ছে। ইহাম বিছানায় বসতে বসতে বলল,
“মাথা মোটা গোবর ঠাসা মেয়েদের শরীরের যত্নের জন্যে এত কিছু করতে হয়? এদিকে গবেট মাথাটায় যে গু নিয়ে ঘুরে তার বেলায়?”
মায়রা রাগে কটমট করে অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে ইহামের দিকে তাকায়। চোখ গুলি জ্বলে যাচ্ছে ওই লোকটাকে দেখে। রাগে গজগজ করে জবাব দিল,
“কি করব বলুন আমি তো আর আপনার তনয়ার মতো সুন্দরি না তাই দিতে হয়। কারো চোখে তো পড়তে হবে। একা তো আর জীবন চলবে না।”
তার কথায় আচমকা ক্রোধে ইহাম এক পা এগিয়ে আসতেই ভয়ে সেও বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। পিছিয়ে যেতে চাইলেও সেটা আর হলো না। খপ করে ইহাম তার বাহু চেঁপে ধরে খিঁচে নিল দাঁত কপাটি।
“তখনের ডোজটা মনে নেই তাই না? মানা করেছিলাম না এসব কথা বলতে?”
ভড়কে গেলেও মায়রা নিজেকে শক্ত করে নিল। কঠিন গলাতেই শুধালো,
“তো কি করতে বলেন আপনি? এই নামমাত্র সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখব? যে সম্পর্কটার কোনো মূল্য নেই সেটা কেন টিকিয়ে রাখব? পরীক্ষা শেষ হলেই আব্বু কে সব বলব। তখন..”
“পরীক্ষা? পরীক্ষার পর দেখো না তুমি কোথায় থাকো। তখন দেখব তোমার ত্যাড়ামি। ঘাড়ের প্রতিটা ত্যাড়া রগ একটা একটা করে সোজা করব না?”
“আপনি কি এটা জানেন না মিস্টার ফাহাদ ইহাম চৌধুরী যে ব্যাকা জিনিস ঠিকঠাক ভাবে সোজা হয় না। বেশি সোজা করলে গেলে বরঞ্চ ভেঙ্গে যায় তা।”
“তোমরা মেয়েরা জানো তো শুধু এই এক হাদিস। সব কটা ঘাড়ত্যাড়ার জাত।”
বাহির থেকে তখন ফাতেমা বেগমের ডাক ভাসছে। ডিনারের জন্যে হাক ছাড়ছেন তিনি। মায়রা ইহামের চোখের দিকে তাকাল। তবুও নিজের কব্জি বন্ধন মুক্ত করল না মায়রার বাহু থেকে। বরং একটু শিথিল করে কোমল স্বরে বলল,
“ডিনারের পর্ব তাড়াতাড়ি শেষ করে ঘরে আসবে। আলমারিতে যে প্যাকেট টা আছে ওটা পরে রেডি হবে। কথাটা যেন দ্বিতীয় বার বলতে না হয় মাথা মোটা গবেট কোথাকার।”
হাত ছেড়ে দিয়ে ইহাম ওয়াশরুমে চলে গেল। মায়রার রাগে শরীর জ্বলে গেল। এই লোকটা তাকে মাথা মোটা গবেট কেন বলে সবসময়? দাঁতে দাঁত লেগে আসে ক্রোধে। পরক্ষণে মনে হয় আলমারির কথা। প্যাকেট? কিসের প্যাকেট ওখানে? এই রাতের বেলায় তৈরি হতে যাবে কেন সে? কপাল কুঁচকে আসে মায়রার। ভেতরের উদ্দীপনা সঞ্চয় করে এগিয়ে যায় আলমারির দিকে। তখন মায়ের চেঁচানো শুনে দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়।
শিফু মনমরা হয়ে বসে আছে। তার মন সন্দিহান, দ্বিধাগ্রস্ত সূর্য উদীয়মানের মতো সত্য।
মনটা আজকাল বিষণ্ণ নিস্তেজ থাকে। এই মন খারাপের নির্দিষ্ট কোনো কারণ খুঁজে পায় না সে। শুধু বুঝে তার কোনো কিছুতে ভালো লাগে না। পছন্দের ফেসবুকও আজকাল বিরক্ত লাগে। উদাস মনে যে কি কি ভাবে তার কচি মন সেই সম্পর্কে সে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ অচেতন। কেবল নাম না জানা উদ্দেশহীন এক অস্থিরতা অনুভব করে ভেতর ঘরে। ঠিকঠাক ভাবে খাওয়াদাওয়া হয় না তার। চিকন শরীরটাও আরো জীর্ণ হয়েছে। ক্ষণেক্ষণে তুহিনের কথা মনে আসে। অদ্ভুত ভাবে ভেতরটা ছটফট করে উঠে কোন কারণে? এই উত্তর খুঁজে না পাবার বিষয়টা তাকে আরো অস্থির আর বিষণ্ণ করে তুলে।
মা সেই কখন থেকে ডাকছে খাবারের জন্যে। কিন্তু তার খেতে মন চায়ছে না। দুপুর বেলা গুণেগুণে ৬ লোকমা খাবার পড়েছিল পেটে। এরপর আর কিছু খায়নি সে। বিকেলের নাস্তায় তার আম্মু তার পছন্দের রামেন রান্না করে দিয়েছিলেন তাও খায়নি। পেটে খিদেও বা লাগে না কেন? তার এই অনুভূতি গুলি কোথায় কোন অনুভূতির আড়ালে চাঁপা পড়ল? বড্ড হতাশ লাগে তার। নিজের মন কে বুঝতে না পেরে আরো বিষণ্ণতার কালো আঁধার তাকে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে নিচ্ছে। নিজের উপরও বড্ড বিষাক্ত অনুভব লাগে তার।
কাল তো আম্মু একবার বলেই বসেছিলেন “তুই কি তুহিন কে পছন্দ করিস?” সে তার মায়ের কথার পিঠে কোনো জবাব দেয়নি বরং নিরুত্তর রয়েছে। তারউপর আজকে ভাইয়ের আগমন তাকে আরো চিন্তিত করে তুলছে। ঘরে তুহিন ভাইয়ের বিষয়টা নিয়ে টুকটাক কথা হয়। আব্বু আম্মু কেউ কিছু তাকে সেভাবে না জিজ্ঞাস করলেও না বললেও ভাইয়া? ওই কাঠিন্য মানুষটার সামনে কি এই বিষয় নিয়ে তাকে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে?
খাবার খেয়ে এসেই ইহাম আগে আগে বিছানায় গিয়ে চিৎ হলো। শরীর অকারণেই যেন ক্লান্ত লাগছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় ১১ টা ১৬ বাজে। এর একটু পর মায়রা এলো রুমে। নিঃশব্দে গটগট পায়ে গিয়ে পড়ার টেবিলে বসল। আইসিটি বইটা নিয়ে ভোতা মুখ ঠেসে রেখেছে সেখানে।
ইহাম এক পলক তাকিয়ে দেখল তাকে।
দেখো যেন কত মেধাবী ছাত্রীর ছ টা এসেছে। এই ঘাড়ত্যাড়া মেয়ে কি আর এক কথায় তার কাজ করবে? এইটুকু শরীরে কত তেজ দেখো মেয়ের। সবটা সময় ফালতুগিরি ত্যাড়ামি না করলে মেয়ের হজম শক্তির অভাবে কুষ্ঠকাঠিন্য রোগ হয়। বেয়াদব মাথা মোটা মেয়ে একটা। ইহাম বিরক্ত হয়ে ডাকল,
“মায়রা? কি বলেছিলাম তোমায়?”
মেয়েটা তার কথা শুনতে পেয়েও এমন ভান করল যেন ঘরে বাকি আর কেউ নেই। সে খুব মনোযোগী ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে বই এ। ইহাম উঠল। দরজার শিটকিনি টা ভালো করে লাগিয়ে দিয়ে এসে মায়রার সামনে দাঁড়াল। মায়রা তখন নিরুত্তর। মাথা তুলে তাকায়ও নি। যেমন জোরপূর্বক মুখ গুঁজে রেখেছে বইয়ের দিকে। ইহাম রাগ দেখিয়ে বইয়ের পৃষ্ঠায় থাবা মেরে হাত রাখে। মায়রার দিকে তাকিয়ে কটমট করে বলে,
“এদিকে তাকাও বেয়াদব মেয়ে।”
মায়রা চোখ বন্ধ করল। বুঝতে পারল লোকটা রেগে গিয়েছে। কিন্তু সে নিজেই তো অনুচিত অস্থিরতায় ভোগছে। আজ কেন যেন তার নিজের রুমে এই লোকটার সাথে থাকতে তার অদ্ভুত লাগছে। একটা অস্বস্তি ভাবও হচ্ছে। ভেতরের আলোড়নটা ঢোক গিলে হজম করার চেষ্টা করল সে। অতঃপর মাথা উঁচু করে তাকাল ইহামের দিকে। শান্ত ভাবে জবাব দিল,
“জানেনই আমি বেয়াদব। বারবার এই কথাটা বলতে হয় কেন? কিছু বলবেন? লাগবে কিছু?”
“এই মুহূর্তে তুমি উঠে রেডি হও। এটাই চাইছি।”
“এতরাতে রেডি হতে যাবো কোন সুখে? আপাদত আমার পড়া আছে। আপনি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।”
“তুমি আমার কথা শুনবে না এই তো? এমন অভিনয় করছো যেন বিশ্ব সেরা ছাত্রী তুমি। মাথায় তো শুধু ওই পঁচা গোবরে ভরা। এখন পড়া বাদে যেটা বললাম সেটা করো।”
“আপনার কথায় আমি কিছু করতে যাবো কেন? কি মনে করেন কি আপনি? যা বলবেন তাই শুনব কেন আমি?”
ইহাম উত্তর দিল না। রাগলও না। উল্টে মায়রার হাতের কব্জি ধরে টেনে তুলল। আলমারির কাছে নিয়ে গিয়ে নিজেই খুলে শপিং টা বের করল। সেটা এগিয়ে দিয়ে শান্ত স্থির ভাবে বলল,
“এটা পড়ে রেডি হয়ে নাও। ফাস্ট। খুব বেশি সময় দিচ্ছি না কিন্তু।”
“পরব না আমি।”
“পরবে। অবশ্যই পরবে। আমি বলেছি তাই তুমি পরবে মায়রা।”
ওই মোলায়েম কন্ঠে না ছিল কোনো রুক্ষতা কঠোরতা কিংবা হুকুমের আভাস। যা ছিল কেবলি তা কোমলতা আর স্নিগ্ধতার আধিপত্য। ভেতরের এক গেয়ে জিদটা দমল যেন মায়রার। সে মাথা নিচু করে নিল। মুখ ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল,
“কি আছে এতে?”
“শাড়ি।”
চট করে মায়রা আবারও তাকাল ইহামের দিকে। চোখের ভাষা শান্ত স্থির নির্লিপ্ত। নাকের পাটা ফুলিয়ে প্রশ্ন করল,
“পরব না আমি ওটা। আপনি না মানা করেছিলেন আমায় শাড়ি পরতে? আপনি কোন না কোন মেয়ের উপর ক্রাশ খেয়েছিলেন কলেজে? তাহলে কেন পরব?”
“এখন তো আর আমি কলেজে পড়ি না? বিয়ে পাস করেছি। বউ কে শাড়ি পরতে বলব। দরকার পরলে বলব আমাকে আঁচলে বেঁধে নিয়ে ঘুরতে। তোমার মোটা মাথায় ওতসব বুঝতে হবে না তুমি আগে এটা পরে রেডি হয়ে নাও। বেশি সময় নিবে না কিন্তু।”
“আমি ভুলেও এটা পরব না। আপনার মনে নেই আপনি না করার পর জিদ দেখিয়ে শাড়ি পরেছিলাম বলে কি কি বলেছিলেন? কেমন ব্যবহার করেছিলেন? আমার মতো মেয়ের প্রতি আপনার কোনো আগ্রহই নেই বলেছিলেন। তাহলে এখন এত আলগা পিরিত দেখাচ্ছেন কেন? যান তো দূরে যান।”
ইহামের বাড়িয়ে দেওয়া শপিংটা ঠেলে মায়রা চলে যেতে পা বাড়াতেই ইহাম খপ করে তার কোমর পেঁচিয়ে নিয়ে এলো নিজের কাছে। কানের দিকে মুখ বাড়িয়ে দিয়ে ফিসফিস আওয়াজে বলল,
“পিরিতি দেখাতে চাইনি বলেই তো মানা করেছিলাম মাথা মোটা গবেট। তোমার ওই অঙ্গ জ্বালানো গায়ে শাড়ি যে একদম বেমানান সেটা যদি তুমি জানতে মেয়ে। যা একদম ঝলসে দেয় অন্তর। একটু স্বস্তির জন্যে হৃদপিন্ড টা হাকুবাকু করে বেসামাল ভাবে। এই মরণ যন্ত্রণা যেন সারা অঙ্গ গ্রাস করতে না পারে তাই বলেছিলাম কথাটা। যেটা তোমার মোটা মাথার গোবর অবধি যায়নি। এনিওয়ে, শাড়িটা ইউথআউট তর্ক ত্যাড়ামি না করে পরবে নাকি আমি চুপচাপ নিজে পরিয়ে দিব ইউটিউব দেখে?”
তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল মায়রা। মুখের বুলি হারিয়েছে সে। কিছুক্ষণ মন্ত্রপূতের মতো ওই মোহাচ্ছন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। অতঃপর শেষের বাক্যটা কান জ্বালিয়ে দিল তাকে। দুই হাত দিয়ে ধাক্কা মেরে সরায় ইহাম কে। কটমট চোখে তাকিয়ে হাত থেকে শপিংটা খাবলে নিয়েই ছুটে ওয়াশরুমে।
দ্বিধাদ্বন্দ্বে আনছান করে উঠছে কোমল মনটা। বদ্ধ রুমের গোমটতা মন পিঞ্জিরা কে আর অস্থির অশান্ত করে তুলছে। এই নীরব বোবা ছটফটানো তাকে দিকভ্রান্তও করছে। ব্যথাতুর মুখাবয়ব নিয়ে ফোন হাতে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জ্বলজ্বল করছে ফোনের স্কিনে একটা পরিচিত নাম্বার। যদিও এমন না যে এই নাম্বারটার সাথে সে খুব সহজ সোজা। কিংবা তাদের কথাবার্তাও হয়েছে খুব। তবুও এক বিষাক্ত দুটানা তাকে থমথমে করে তুলছে। হৃদয়ের তিক্ত যন্ত্রণার ডাক সাড়া দিয়ে অহেতুক দ্বন্দ্ব কে মাড়িয়ে তুহিন কল দিল সেই নাম্বারটায়। একবার দুবার কল হবার পরও রিসিভ করে না সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটা। সবসময় ফেসবুকে ডুবে থাকা মেয়েটাও আজকাল খুব অনিয়মিত হয়ে যাচ্ছে প্রিয় ফর্ম থেকে। শিফু যেন তার থেকে একদম গুটিয়ে নিয়েছে। বড্ড বিরক্ত আর ব্যাকুল হলো তুহিন।
রাগে হুংকার তুলে নিজের ফোনটা ছুড়ে দিল বিছানার উপর। ক্ষণে ক্লান্ত হয়ে ধপ করে নিজেও বসল বিছানায়। চোখে মুখে কাতর তিক্ত হতাশার কায়া। অসহায় হয়ে চোখ ঢেকে ফেলল দুই হাত দিয়ে। যতই বলুক সে বিদেশ যাবে না। জেদ ধরে থাকলেও সে ঠিকি সব কাজ চলমান রেখেছে। খুব শীর্ঘ সব ঠিকও হয়ে যাবে। এটাও তার জীবনের খুব বড় একটা অধ্যায়। সুযোগ টা হাত ছাড়া হলে জীবন ধরাশায়ীর দিকে অগ্রসর হবে। ঠিক কিছু একটা ব্যবস্থা সে করবে। মনে মনে ভেবে নিল এবার তার নিজেকেই কিছু একটা করতে হবে। বাবার আশায় বসে থাকাও যায় না।
“ইহাম ভাই এখন এক মাত্র ভরসা। উনি বিচক্ষণ হয়ে নিশ্চয় কিছু একটা করবেন। ওরা কেন বুঝতে চায় না শিফু কে আমি পছন্দ করি।”
টকটকে একটা লাল রঙ এর শাড়ি পরেছে মায়রা। জানলার ধারে বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। চোখের ভাষা অশান্ত চঞ্চল। স্বামী নামক মানুষটাকে পছন্দ করেছে সেই কবে। কিন্তু লোকটার কাছে তার কোনো মূল্যই নেই। আর না কোনো রকম দাম দেয় তাকে। উল্টে সবসময় অবজ্ঞা অবহেলা করে দূরে রাখে। কেন? এত দূরত্ব তাদের সম্পর্কে কিসের? কেন কাছে টানতে চায় না মানুষটা? দায়ে পরে কেনই বিয়ে করতে গেল? কি হবে এই মূল্যহীন সম্পর্কটার? বুক ভার হয়ে আসে মায়রার। ভেতরটা ছ্যাঁত ছ্যাঁত করে জ্বলে উঠে।
রাত তখন ১১ টা ৫২ বাজে। ইহাম নিঃশব্দে এগিয়ে গেল। শাড়ি পরিহিত মায়রার আগুন কায়া তার হৃদয় ঝলসে দেয়। চোখ জ্বালিয়ে আঙ্গার করে তুলে। ভেতরটা তখন অশান্ত বিক্ষোভে নামে। তবুও ধীর পায়ে একদম চুপটি করে এগিয়ে যায় মায়রার দিকে। একদম পিছনে গিয়ে দাঁড়ায় নিভৃতে। আচমকা শাড়ির আঁচল ভেদ করে মায়রার কোমল উদরে হাত ঢুকিয়ে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়। আচমকা এমন গাঢ় স্পর্শে কেঁপে উঠে মায়রার সমস্ত শরীর। সেকেন্ড কয়েক সময় নিয়ে বিষয়টা বুঝতেই চোখ নেতিয়ে আনে ব্যাকুলতায়। টপটপ করে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়তেই আড়াল করে নেয় তা।
ইহাম ওই তুলুতুলে উদরে হাত বুলিয়ে আরেকটু টেনে আনে মায়রা কে। উন্মুক্ত ঘাড়ে আলতো করে চুমু খেতেই শিউড়ে উঠল মেয়েটা। নিজেকে ধাতস্থ করে লেগে আসা কন্ঠে জানাল,
“হুটহাট করে আপনি আমাকে এভাবে স্পর্শ করবেন না। বিরক্ত লাগে।”
ইহাম প্রতিক্রিয়া দেখালো না। ঘাড়ের কাছ থেকে মুখটাও তুলল না। বরং এভাবেই ফিসফিস করে বলল,
“যদি বলি এই বিরক্ত স্থায়ী তবে? মরণের আগ পর্যন্ত এই বিরক্ত তোমাকে বধ করবে তখন? এই বিরক্তের রেশে আরো এক ধাপ বেশি বিরক্ত হবে তুমি বলদ মেয়ে?”
“দে দেখুন…”
“ইয়েস মিসেস চৌধুরী আজ দেখব। সব দেখব। প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে পরদে পরদে দেখব। আমার দেখার ধরণ না তোমাকে অস্বস্তি কিংবা বিতৃষ্ণায় ফেলে দেয়।”
মায়রা কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ইহাম আলতো করে কানের লতিতে একটা চুমু খায়। এক ভয়ংকর তোলপাড়ে শিউড়ে মেয়েটা চোখের কপাট লাগায়। পরপরই ইহাম একটা কাপড় বেঁধে দেয় তার চোখে। ভীষন বিস্ময়ে সে সন্দিগ্ধ কন্ঠে শুধালো,
“কি কি করছেন? চোখে কাপড় বাঁধছেন কেন?”
ইহাম তার কানের খুব কাছে মুখ নিয়ে এসেছে তা বেশ টের পাচ্ছে মেয়েটা। অজানা আশংকা তার ভেতর কাঁপিয়ে তুলছে। শরীরের শিরা উপশিরায় কি যে ছুটাছুটি করছে তা বুঝতে অক্ষম সে। ইহামের একদম ফিসফিস কন্ঠ কানের লতিতে লাগল,
“শিহহহহহ, চুপ। একদম চুপ।”
হাতটা শক্ত করে নিজের মুঠোয় নিয়ে আসে। আবারও ফিসফিস কন্ঠ, “শক্ত করে ধরে রাখবে হাতটা। একটুও এদিক ওদিক করবে না। চুপচাপ যেদিকে নিয়ে যাবো সেদিকে যাবে। আর মনে মনে ঠিক করে নাও এই যে হাতটা আমার মুষ্টিযোগে এলো। এই হাত আর ছাড়া হবে না। আর না বন্ধন টা ছিন্ন হতে দিবো আমি।”
মায়রার ভেতরটা লাভার মতো স্ফুটিত হলো। রক্ত কণিকায় উষ্ণ স্রোত বগবগ করে প্রবাহ করল। ভেতরে হাতুড়ি পেটা শব্দ তাকে যেন আরো আবর্তন করছিল। এই লোকটাকে কি করে বুঝাবে সে চায় না এই বন্ধনটা ছিন্ন হোক। বরং মনের সূক্ষ্ম ইচ্ছা গুলি তাকে জানান দেয়, মানুষটা তাকে বুঝুক, তাকে তার মতো করে ভালো রাখুক। ওই কঠিনতার বৈপরীত্যে কোমলতা পুনঃপুন হোক। তার সব ইচ্ছে আহ্লাদ পূরণ করুক তাকে সর্বদা সুখকর একটা মুহূর্ত দিক। কিন্তু হায় লোকটা যেন তার সম্পূর্ণ চাওয়ার বিপরীত। তার চাওয়া কাঙ্ক্ষিত কোমলতা স্নিগ্ধতার বৈপরীত্যে রুক্ষতা আর কাঠিন্য ভাব পরিপূর্ণ।
ধীর গতিতে মানুষটার অনুসরণে হেটে যাচ্ছে সে। ঢের অনুভব করতে পারছে তাদের এক তলা বাড়ির ছাঁদের সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়েছে। চোখ বাঁধা, হাত অন্য হাতে মুষ্টিমেয় তবুও এগিয়ে যাচ্ছে সিঁড়ি ভেঙ্গে,
“কি হলো আর কতক্ষণ? আমার চোখের বাঁধন টা খুলে দিন।”
ইহাম জবাব দিল না। এতে বরং মায়রার মেজাজ আরো খারাপই হলো। এই লোকটা এত কম কথা বলে কেন? একটু কি প্রয়োজন ছাড়া বাড়তি মিষ্টি আলাপ তার মুখে রোচে না? বিরক্তই হলো সে।
তার একটু পর ইহাম পিছন থেকে তার চোখের বাঁধন শিথিল করতে করতে ফিসফিস করে জবাব দিল,
“নাও এবার চোখ খুলতে পারো।”
চোখের উপর বাঁধন ছাড়া পেতেই পিটপিট করে তাকাল সে। কিন্তু যেন অন্ধকারের অতলে ডুবে গিয়েছে। চোখের আইলাইনার টানা বলে একেবারে কঁচলে দিতেও পারল না। তবুও আলতো করে চোখ মলে আবারও তাকাল সে। চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিচ থেকেও আলো আসছে না। শঙ্কায় কপাল জড়ো হলো তার। মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“এ এত অন্ধকার কেন এখানে? লাইট জ্বালাচ্ছেন না কেন?”
কি হলো বিষয়টা? উত্তর দিচ্ছে না কেন? লোকটা কোথায়? কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছে না। তাকে এই অন্ধকার ছাঁদে একা ফেলে কি পালিয়ে গেল? ঘুটঘুটে তিমির আঁধারে নিজের কায়াটাও স্পষ্ট নয়। মায়রা শুকনো ঢোক গিলল। ভুতে তার অনেক ভয়। ছুটে যে দৌড় দিবে তারও উপায় পাচ্ছে না। নিচ থেকে মৃদু আলো আসলেও তাকে এতক্ষণ এখানে থাকতে হতো না। ভো মেরে চলে যেতে পারত। আবারও কাঠ গলা ভেজানোর চেষ্টা করে দুই হাত সামনে তুলে এদিক ওদিক নাড়াল।
“কি হলো? কথা বলছেন না কেন? কোথায় আপনি?”
এদিক ওদিক হাত নেড়েও কাউকে পাওয়া গেল না। হঠাৎ অনেক গুলি কন্ঠের সংমিশ্রণ বেশ ভারি হয়ে কর্ণকুহর স্পর্শ করল “হ্যাপি বার্থডে মায়রা।” শুনশান নীরবতা কে গ্রাস করে আচমকা এমন মিশ্রণ ধ্বনি তাকে আতঙ্কে আঁতকে তুলে। মুহূর্তে চারপাশ জ্বলজ্বল করে উঠে। ছাঁদের পাশটা খুব সুন্দর ভাবে সাজানো হয়েছে, লাইটিংও করা। এত সব করল কখন? মায়রা মুগ্ধ হয়ে চারপাশটা দেখল। সামনেই ইহাম স্থির দাঁড়িয়ে আছে। সে পিছন ফিরল, আব্বু আম্মু ভাইয়া কে দেখে খুশিতে চোখ ভরে এলো। আজকে তার বার্থডে অথচ এত সব সমীকরণে সে নিজেই ভুলে গিয়েছিল। এই মানুষ গুলি কি যত্ন করে সবটা মনে রেখেছে। চোখ ভর্তি পানি নিয়ে ঠোঁটের কোণে চিলতে রোদ উঠে মায়রার। আদর সোহাগ গলায় অস্ফুটবাকে বলে,
“আব্বু আম্মু।”
মা বাবার ঠোঁটে তখন বিজয়ী তৃপ্তির হাসি। যেন জীবনের কঠিন একটা যুদ্ধ জয় লাভ করতে পরেছে তাকে এমন মানুষের কাছে তুলে দিয়ে। মহিন সাহেব হেসে হেসে বলে উঠেন,
“দেখ না মা, ইহামের কর্মকাণ্ড। সেদিন ১০ দিনের ছুটিতে এসেও ছেলেটা কাজের চাপে আবার ফিরে গিয়েছিল, এখন আবার তোর কারণে তিন দিনের ছুটিতে এসেছে। কাল রাতে চট্টগ্রাম থেকে সকালে বাসায় পৌঁছেছে। কোনো রকম ব্যাগ পত্র রেখে আমাদের বাসায় ছুটে এসেছে। তুই ছিলি না বলে আবার ছুটেছে তোকে আনতে। এই সব ব্যবস্থাও সে করেছে তোর খুশির জন্যে মা।”
মায়রা হতবিহ্বলের মতো ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায়। লোকটা ঠোঁটে আহামরি হাসি না দেখিয়ে কিংবা উচ্ছ্বাসে আহ্লাদে ফেটে না পড়ে কেবল এক টুকরো হাসি তুলে কোমল কন্ঠে বিড়বিড় করে জানাল,
“হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার। মে ওল দ্যা উইশ ওফ ইউর লাইফ বি ফুলফিল্ড মায়রা।”
সাগরের মাঝখানে জলোচ্ছ্বাস হয় না? ভেতরটা তেমন ভাবে তোলপাড় করছে তার। দাবানলের মতো চারিদিক ছড়িয়ে গিয়েছে তা। অদ্ভুত এক আবেশ ছোঁয়া অনুভূতি এসে স্পর্শ করল তার গা। মনটা শিহরণে দুলে উঠল। এই মানুষটা কি আসলেই এমন টা করেছে? সব কি তার জন্যে করা? সবই যেন কল্পনায় অবিশ্বাস্য লাগছে। তবুও তৃপ্তির একটা বিষয় অন্তঃকরণ শীতল করে তুলল। চোখ গুলি দিয়ে পরপর তিন ফোঁটা পানিও নির্গত হয়ে গেল নিমিষে।
“আর সব কিছু নিজ হাতে যে আমি রেডি করলাম তার বেলায়? ওই মুখ ফোলি তো আমায় কিছু বলল না।”
মায়রা পিছন ফিরে তুহিনের দিকে তাকাল। ওর মুখের রিয়েকশন দেখে ফিক করে হেসে উঠল। সাথে চোখ দিয়ে আনন্দ অশ্রুও ঝরল যত্ন নিয়ে। পিছন থেকে ইহাম বলল,
“চিন্তা নেই শালাবাবু এর জন্যে না হয় ট্রিট পাবে।”
“আমার ট্রিট টা আমি সময় মতো নিয়ে নিবো ইহাম ভাই। কথা শুধু আপনার দেওয়া নিয়ে।”
উপস্থিত সবাই তুহিনের কথার গোপন ইঙ্গিতটা ধরতে পারল। তবুও কারো মুখের রা রইল না আর। ফাতেমা বেগম ইতস্তত বোধ করে ইতিউতি করলেম। মহিন সাহেব স্বাভাবিকতা আনতে মায়রা কে তাড়া দিলেন কেক কাটতে।
ছোটখাটো পারিবারিক অনুষ্ঠান টা শেষ হতে হতে রাত প্রায় ১ টার কাছাকাছি। সবাই যার যার রুমে চলে গিয়েছে। ইহাম নিজেও অপেক্ষা করছে মায়রার। কিছু কথা বলা জরুরি। কাল থাকতে পারবে কি না বলা যায় না। বাসায় কাজও আছে। ওখানেও সময় দিতে হবে। সবাই তো নিজেদের রুমে চলে গিয়েছে। মেয়েটা এখনো আসছে না কেন? অধৈর্য হয়ে সে পা বাড়াল বাহিরের দিকে। তখনি মায়রা আঁচল ঠিক করতে করতে রুমে ঢুকল। ইহাম তীক্ষ্ণ চোখে এক পলক দেখল। পরক্ষণে চুপচাপ গিয়ে বিছানার উপর পা ঝুলিয়ে বসল।
মায়রার ভেতরের তখন সংকোচ ভাব। কিছু বলতে গিয়েও পারছে না। কোথাও একটা বাঁধা পাচ্ছে সে। কিন্তু মনে হচ্ছে অন্তত একটা ধন্যবাদ তাকে জানানো উচিৎ। কিংবা কিছু জিজ্ঞাস করা। ওদিক ফিরে করা তার ব্যতিব্যস্ত বিভ্রান্তি ভাব সবটাই নজর বুলাচ্ছে ইহাম। সে শুধু নীরব রয়ে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখতে থাকল, মাথা মোটা মেয়েটা করে কি।
নিজের সাথে নিজের নীরব দ্বন্দ্বের পর নিজেকে হালকা করতে তপ্ত শ্বাস ছুড়ে সে। এদিক ঘুরে ইহাম কে ওমন নেশাক্ত চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে থমকে যায় পুরো। বিব্রত বোধও করে বিস্তর। ওই ইতস্তত বোধ সাথে নিয়েই অস্থির ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে থাকে নিশ্চুপে।
ঘোর লাগা চোখে ধারালো নজরে ইহাম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করে মেয়েটাকে। টকটকে লাল শাড়ি পরনে গায়ে। আকর্ষণীয় লতানো অঙ্গ মাথা হ্যাং করে দেয়। শরীরের কিছু ভাবও স্পষ্ট যেন। মুখে খুব বেশি প্রসাধনীর ছাপ নেই। চোখে শুধু আইলাইনার টানা। ঠোঁটে হালকা লাল রং এর প্রলেপ। তবুও ইহামের এত বছরের নিভিয়ে রাখা অনল দাবানলের মতো বিস্তৃত হতে চাইছে। তাণ্ডব হচ্ছে যেন নীরবে নিঃশব্দেই। বুকের ভেতর তখন লণ্ডভণ্ড হওয়া স্পৃহার উৎপাত। এক দৃষ্টিতে সে এলোমেলো চোখে তাকিয়ে দেখছে মায়রার মুখের দিকে। তার এমন চাউনি মায়রা কে আরো বিব্রতে ফেলছে সে স্পষ্ট। তবুও দৃষ্টি সংযত করার কোনো তাড়া নেই।
ওই গভীর চোখের গাঢ় চাউনিতে তলিয়ে যাচ্ছে মায়রা। আরো বেশি তার অস্বস্তি হচ্ছে। গলা শুকিয়ে চৌচির হয়েছে। তবুও কোনো রকম ধরে আসা কন্ঠে বলল,
“আ আপনি এখানে এ এসেছেন কেন?”
খুব বেশি দূরে না থাকায় হাতের প্যাঁচে মুহূর্তেই মায়রা কে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো। এক চুটিতে মেয়েটাকে নিজের কোলের উপর বসিয়ে দিল। বিষয়টায় খুব বেশি লজ্জায় মাথা নুয়ে নিল মায়রা। একটু সময় নিয়ে উঠার প্রচেষ্টা করতেই ইহাম শক্ত করে চেঁপে ধরল নিজের উরুর উপর। মোহভরা কন্ঠে ফিসফিস করে বলল,
“তুমি জানো না? তখন তোমার বাপে বলেনি সেটা?”
“দে দেখুন। ছাড়ুন আমায়।”
“ছাড়ছি না। কথা আছে আমার।”
“ঠিক আছে। সেটা আমায় ছেড়ে দিয়েও তো বলা যাবে। নামতে দিন আমায়।”
মায়রার এক রোখা ভাব দেখে ইহাম চট করে আবারও তার গালে ছোট্ট করে চুমু খেলো। ফিসফিস করে জানাল,
“আবার কোনো কথা বললে এর বেশি কিছু হবে কিন্তু।”
“দে দেখ..”
তড়িত গতিতে ইহাম ঠোঁট আঁকড়ে ধরল তার। এই মেয়েকে কোনো কিছুতে হলেও কাবু করতে হবে। ত্যাড়ামি শুরু করলে মেয়েটা থামতেই চায় না। বেশ গাঢ় অধর স্পর্শের সমাপ্তি টেনে ছেড়ে দিল ইহাম।
“আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা কথা বলতে চাইছি মায়রা। খুব মনোযোগ দিয়ে আমার কথায় মনোনিবেশ করো। এই মুহূর্তেই কথা গুলি ক্লিয়ার করতে চাইছি। আরো বেশি সময় নিয়ে বিষয়টা ঘোলাটে করে পরিস্থিতি জটিল করা সমীচীন নয়।”
ভয়াবহ লজ্জায় লাল হয়ে আছে মায়রা। মাথা নিচু করে চুপটি করেই বসে আছে। নড়ছেও না। নড়লে আবার যদি লোকটা কি করে বসে? মাথা নিচু করে শাড়ির আঁচলে আঙ্গুল পেঁচিয়ে যাচ্ছে একাধারে।
“মায়রা আমি ছোটবেলা থেকেই একটু কঠিন স্বভাবের। বাহিরের সবার কাছে যেটা রুক্ষতা কাঠিন্য আমার কাছে সেটা সহজবোধ্য। আমি মনে করি না আমার মাঝে খুব বেশি কাঠিন স্বভাব আছে। আমি সবার কাছে আমার অনুভূতি কিংবা ভালো লাগা বলে বেড়ানো পছন্দ করি না। নিজের ভালো লাগা মন্দ লাগা গুলি একান্ত আমার। সেগুলি আমি কেবল নিজের মাঝে ধারন করি। তবে আমি বুঝতে পারি আমার আশেপাশের সকল মানুষ আমায় কঠিন মনে করে। একটু রগচটাও আমি। খুব বেশিক্ষণ নিজের মেজাজ ধরে রাখতে পারি না। তারউপর আমার কাজের সূত্র আমাকে আরো খিটখিটে বানিয়ে দিয়েছে।
একজন স্পেশাল ফোর্স ইউনিটের প্রশিক্ষণ কাজ সব দুর্দান্ত রকমের কঠিন দুরূহ। সব মিলিয়ে খুব অল্পেতে রেগে যাওয়ার স্বভাব তৈরি হয়েছে আমার। আমি সবসময় চাইতাম আমার জীবন সঙ্গি হবে ম্যাচিউয়ড। যে আমাকে আমার মতো করে বুঝে নিবে। আমার সব আচারণ ব্যবহার গুলি যত্ন করে বিচক্ষণতার সাথে সামলে নিতেও জানবে। আমার এই কঠিন স্বভাব খেই হারানো মেজাজ নিজে দক্ষ ভাবে সামলে নিয়ে আমাকে আমার মতো বুঝবে। কিন্তু ভাগ্য আমার হাতে এমন একজন কে তুলে দিয়েছে যাকে আমার নিজেকেই বুঝতে হয়। যার মাঝে ম্যাচিউরিটি নেই, উল্টো বাচ্চামি আর ত্যাড়ামিতে ঘেরা। যে আমাকে নিজ থেকে বুঝে নিবে তো দূর যাকে আমি বুঝাতেই পারছি না সবটা।”
মায়রা নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে ইহামের কোলে। হাত দুটি নড়াও বন্ধ করে দিয়েছে সেই কখন। মাথা এখন অবধি উপরে তুলে ইহাম কে দেখল না। তার এমন নিশ্চুপতা নীরবে দেখল ইহাম। আবারও মুখটা খুব কাছে রেখে,
“ছুটিতে এসে বাবা আমায় বিয়ের জন্যে বুঝিয়ে বলে। আমিও রাজি হয়েছিলাম। বিয়ের দিন এসেই তোমায় প্রথম দেখেছিলাম আমি। নিঃসন্দেহে তোমার রূপের মুগ্ধতা আমার মাঝেও ছড়িয়ে গিয়েছিল। সেদিনই শুনতে পেয়েছিলাম তোমার ১৮ বছর হয়নি আর ইন্টার পড়ুয়া। সবসময় চেয়েছিলাম ম্যাচিউয়ড একটা মেয়ে আর সেখানে এমন বাচ্চা মেয়ে বউ হবে সেটা মানতে পারিনি। বিয়ের পর দিনই আমি চট্টগ্রাম ফিরে গিয়েছিলাম। তোমার রূপের মুগ্ধতা আমার দৃঢ় ব্যক্তিত্ব কে ছাপাতে পারেনি। আমার ভেতরকার বৈশিষ্ট্য কিছুতেই মানতে পারছিল না বিষয়টা। মাথায় কাজ করত ১৮ বছরের একটা মেয়েকে বিয়ে করেছি যেটা আইন বিরুদ্ধ। একজন প্রশাসনের লোক হয়েও এটা আমি মানতেই পারছিলাম না। তোমার বয়সটা আমায় খুব এফেক্ট করেছিল। যেটার মূল এখনো তোমার মাঝে বিদ্যমান।”
ইহাম তাকালো মায়রার দিকে। চোখ দিয়ে টপটপ করে মেয়েটার পানি পড়ছে। খুব ধ্যান দিয়ে ইহাম সবটা খেয়াল করল। অতঃপর সময় লাগিয়ে চোখের পানি টুক মুছে দিল।
“প্লিজ কেঁদো না। আমার আরো কিছু বলার আছে।” মায়রা তখনো নাক টেনে যাচ্ছে। তাকে স্বাভাবিক হতে ইহাম সময় দিল। নিজেও নরম সুর তুলল, “দেখো মায়রা আমি জানি তুমি ছোট। তোমার আমার এইজ গ্যাপটাও খুব বেশি। হ্যাঁ আমার তোমাকে একটু সময় দেওয়া দরকার ছিল কিংবা তোমার সাথে সহজ হওয়া। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি সেটা পারিনি। আমার মনেও হয়নি সেটা প্রয়োজন। আমার কঠিন ব্যক্তিত্ব টা শিথিল হয়নি সেই বিষয়ে। তাই বিয়ের তিন মাস পরও আমি তোমার সাথে যোগাযোগ করিনি।
এর পরের বিষয় গুলি যদি বলো তবে বলব সেটা তোমার বেয়াদবির ফল। আগেই বলেছি তুমি নিঃসন্দেহ মোহনিয়া একজন। শাড়ি তোমায় বেমানান রূপে ঝলসে দেয় তোমার অঙ্গকে। ওই রূপে দ্বিতীয় বার দেখে নিজেকে অস্থির লেগেছিল আমার সেদিন। হ্যাঁ মানছি সেই বারণ করাটা আমার ভুল প্রক্রিয়ায় ছিল। তবে এটা ঠিক কলেজে আমি শাড়ি পরা একটা মেয়ের উপর ক্রাশ খেয়েছিলাম। কিন্তু তার জন্যেই যে মানা করেছি বিষয়টা তেমন নয়। তোমার রূপ আমার হিংসাত্মক করেছিল। সেটা আমি মানতে পারিনি। ওই আগুনে ঝাপ দিতেও চাইনি তাই বুঝিয়ে বলাটা আমার সমীচীন লাগেনি। এরপরের বিষয় গুলি কার কাছে কেমন জানি না তবে আমার কাছে বেয়াদবি। কথার অবাধ্যতা কিংবা বেয়াদবি আমি মুটেও সহ্য করতে পারি না মায়রা। আমার কথার পিঠে হোক বা ব্যবহারে তুমি আমার সাথে বেয়াদবিই করেছো।”
মায়রার কান্না আর দেখে কে? কান্নার ফল তাকে ফুঁপিয়ে তুলছে।
“আমি জানি তোমার বয়সী মেয়েরা কেমন হয়। কি চায়। তবে ট্রাস্ট মি আমি সেরকম নই। আদরের গদগদ হওয়া, রসালো সোহাগে ডুবে যেতে পারি না আমি। আমি আমার ভেতরের ভালো লাগা গুলি আবলিল ভাবে প্রকাশও করতে পারি না মায়রা। আমি এরকমই কারণ এ রকম। তোমায় এভাবে রাখতে কিংবা সম্পর্কের দূরত্ব টুকও আমি নিতে পারছি না। আমার কষ্ট হচ্ছে। আমি ভেতরের কথা গুলি তোমায় বুঝাতে পারছি না। তবে শুধু বলব তোমায় ভালো দেখতে চাই আমি। ভালোবাসি কি না জানি না তবে মনে হয় তোমায় ভালো লাগে। এই প্রথম বোধহয় আমি শুধুমাত্র তোমার বেয়াদবি গুলিও এভাবে মেনে নিয়েছি। মায়রা স্বামী স্ত্রী বন্ধন টা অটুট। কিছু সামান্য তুচ্ছ কারণে ছাড়াছাড়ি বিষয় গুলি আসা উচিৎ নয়। আমি চাইছি না এই পবিত্র সম্পর্ক টা ছিন্ন করতে। আমি আমার দিক থেকে চেষ্টা করব। কিন্তু তুমিও একটু ম্যাচিউয়ড হবার চেষ্টা করো। এই ত্যাড়ামি, বেয়াদবি অভদ্রতা না দেখিয়ে আমাকেও একটু বুঝার চেষ্টা করো?”
আচমকা মায়রা ইহামের গলা জড়িয়ে ধরল। ঘাড়ে মুখ গুঁজে দিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে লাগে। ওই উষ্ণ পরশে দিশেহারা হলো ইহাম। ভেতরের স্বত্বা আরো মাথা চাড়া দিচ্ছে।
“আপনি খুব পঁচা। অনেক খারাপ লোক। আপনি একটা পাষাণ মানব। আমার সাথে ভালো করে কথা বলেন না সবসময় কঠিন ভাব দেখান। অথচ আমি চাই আপনি আমার সাথে ভালো করে কথা বলুন আমায় একটু সময় দিন। আমাকে আদর করে নিজের সাথে জড়িয়ে নিল। কিন্তু আপনি সবসময় আমায় অবহেলা করেন। কেন ক্যাপ্টেন সাহেব? কেন?”
ইহাম মায়রা কে গলা ছাড়িয়ে আনল। দুই হাত দিয়ে মায়রার চুল ঠিক করে কপালে নরম ভিজে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল। তারপর দুই গালে পরশ বুলিয়ে গভীর তীব্র করে ছুঁয়ে দিল ঠোঁট গুলিও। আদুরে গলায় বলল,
“সময় হলে পুরো মায়রাটাকে নিজের কবলে নিয়ে আসব কথা দিলাম।”
মায়রার নিশ্বাস তখন বেগতিক ঘন। ওই ঘন নিশ্বাস পুরো মুখে ছুঁয়ে দিতেই আরো পাগল পাগল হয়ে উঠে ইহাম। নিজের দারুন কড়া ভাবে শাসানো কিংবা বারণ কোনো কিছুই মানতে চায় না তার ভেতর স্বত্বা। নিজেও যেন উশৃঙ্খল হবার আশঙ্কা পায়। না পারছে নিজেকে ডুবিয়ে দিতে মায়রার মাঝে আর না পারছে এমন মাতোয়ারা মুহূর্ত টাকে দুই হাত দিয়ে ঠেলে দূরে যেতে। উফ অসহ্য লাগছে সবটা। তীক্ষ্ণ চোখে মায়রার লজ্জায় রঙ্গিম হয়ে আসা বদনে ঘনঘন নিশ্বাস নেবার দৃশ্যটা যেন খেপাটে করে তুলল তাকে। মুহূর্তে ঠোঁট বুলিয়ে দিল মায়রার গলায়। অস্থির ভাবে হাত বিচরণ করল শরীরের ভাজে ভাজে। মায়রার প্রতিটি লোমকূপ যেন শীতল বরফে পরিণত হচ্ছে। চোখ খিঁচে সেই অস্থির যন্ত্রণা টিক গিলছে শুধু। খুব গভীরে চলে যেতেই আবারও দৃঢ় ব্যক্তিত্ব ইহামের কানে কানে কিছু বলে গেল ফিসফিস করে। নিজের ঘোর লাগা চোখ গুলি জট করে খুলল। মনে হলো না এখনি নয়। এটা সঠিক সময় নয় ইহাম। বিষয়টা যদি ভুল হয়? যার ভয়াবহ ফল যদি পড়ে মেয়েটার উপর।
আচমকা ইহাম শাড়ির আঁচল ঠিক করে দিল মায়রার। ঝট করে উঠে দাঁড়ালে মায়রা খপ করেই চেঁপে ধরল হাতখানা। মাথা উঁচু করে তাকিয়ে রইল ইহামের দিকে। ইহাম সময় নিয়েই ঘাড় বাঁকাল। মায়রার দিকে চেয়ে ওই করুণ লাজুক মুখশ্রী টা দেখে বুক কামড়ে উঠল। মেয়েটা এভাবে কেন তাকাচ্ছে তার দিকে? ওই চোখের ভাষা এমন কেন? বেশা নেশা লাগছে। সে বুঝতে পারছে না তার বুকের ভেতর দাবানল সবকিছু ভস্ম করে দিচ্ছে। তবুও কেন আটকাচ্ছে তাকে?
“মায়রা…”
“প্লিজ ক্যাপ্টেন সাহেব। আমাকে দূরে ঠেলে রাখবেন না। আমি কষ্ট পাচ্ছি।”
“মায়রা কিছুদিন পর তোমার ফাইনাল এক্সাম। এই সময়ে ভুল কিছু হয়ে যাক চাইছি না। এক্সাম শেষ হোক আমরা সময় নিয়ে এগুবো।”
“দোহাই লাগে আপনার। আপনি আমায় আর অবহেলা করবেন না। এটা আমি আর নিতে পারছি না। কেন এমন করছেন? কাছে টানতে কি সমস্যা আপনার? আর অবহেলা করবেন না আমায়। প্লিজ ইহাম।”
মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ১৯
দাঁত পিষে আনে ইহাম। হৃদয়ের দুটানা সব কিছু যেন ব্যর্থ হয় মেয়েটার কন্ঠ আর চেহারার বদলে। বজ্র বেগে ঝাপটে নেয় মায়রা কে। খেপাটে বাঘের মতো মুখ ডুবায় মায়রার গলার নরম ভাজে। নিশ্বাসের পাল্লা রাতের সাথে সাথে ঘন হয়। গাঢ় ভাবে ছোঁয়ে যায় নিশিথের রঙ। কোথাও যেন কোনো তৃপ্তির ডাক পরিবেশ কে আলোড়িত করে। ছিন্নতার বন্ধন থেকে মুক্ত করে এক পবিত্র বন্ধনের জোর।