মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৩

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৩
সাদিয়া

অপরাহ্ণের কমলা আভা কাটিয়ে অল্প সময়ের মাঝেই আঁধার কালো কিরণ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাবে মেদিনী কে। মায়রাদের বাসা থেকে ইহামের বাসার দূরত্ব কেবলই ঘন্টা দেড় এক এর। তারা সবাই যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ফাতেমা বেগম আর মহিন সাহেব অনেক জোরাজুরি করার পরেও তারা অন্যদিন থাকার প্রয়াসে নিজ বাসায় যেতে আবেদন জানিয়েছে।

তুহিন একমনে বিছানার হেডে হেলান দিয়ে আধ শোয়া হয়ে আছে। ল্যাপটপের স্কিনে এক নজরে তাকিয়ে আছে সে গভীর মনসংযোগে। ঘরে ঢুকে শিফু তুহিন কে দেখে মুখ ভেংচালো। নিঃশব্দেই এগিয়ে গেল তুহিনের রুমের ভেতর। তার উপস্থিতি টের পেল না বলে মেয়েটা বুঝি নাকও ফুলিয়ে দিয়েছে। সহ্য করতে না পেরে গলা খেঁকরে উঠল সে। আচমকা ঘরে শব্দ পেয়ে কপাল কুঁচকে আনল তুহিন। ল্যাপটপের স্কিন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ঘরের ভেতর নজর দিল। শিফুকে কেমন রাগান্বিত অবস্থায় গাল ফুলিয়ে থাকতে দেখে হাসি পেল তার। ওই ফোলা গাল আর নাকের ফুটো দেখে ফিক করে হেসে উঠল তুহিন। হাসি মুখেই বলল,
“এই নাক ফুলি আমার রুমে কি? নক করে এলে না কেন? এখন যদি আমি চিৎকার করি?”
ভীষণ ভাবে কাটার মতো শিফুর গায়ে ফুটল কথাটা। চিকন চিকন ভ্রুর মাঝদ্বয়ে ভাঁজ পড়ল তার। চোখ দুটিও সরু হয়ে উঠেছে। নাক ফুলিয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আপনার মতো বাঁদরের রুমে তো আর এমনি এমনি আসিনি আমি।”
তুহিন চমৎকার ভাবে মুচকি হাসল। ফর্শা গালে ক্লিন শেভ করা মুখটায় ভালো করে তাকাল শিফু। ঠিক কে ড্রামার নায়কের মতো লাগছে। কোরিয়ান ড্রামার ভক্ত সে। তুহিন কে দেখে তার ভেতরটা কেমন জানি করে উঠল। আর অবুঝ কোমল মন বুঝি নব্য হাওয়ায় দুলে উঠল। তবুও ওই হাসিটা সহ্য হলো না তার। সে দাঁত কটমট করতে করতে তুহিনের কাছে গেল। বার কয়েক ফোঁসফোঁস করে দম নিল সে। তা দেখেই ঠোঁট কামড়ে তুহিন বলে উঠল,
“শাপের মতো ফনা তুলছো কেন? কামড়ে দেবে নাকি আমায়?”

তুহিন আবারও চমকপ্রদ হাসল। শিফুর ভেতরে ভেতরে রাগ হচ্ছে। কিছু জবাব না দিয়ে সে তুহিনের হেলান দেওয়া বালিশ টা পিঠ থেকে টেনে কেড়ে নিল। দাঁত কেটে সেটা আবার ছুঁড়ে দিল তুহিনের কোলের উপর। এতটাই জোরে ফিকা দিল যে তুহিনের কোল থেকে ল্যাপটপ টা উল্টে পড়ল বিছানায়। হা হয়ে তুহিন শিফুর দিকে তাকাতেই মেয়েটা তার পিঠে ধাক্কা মারল। সেই সঙ্গে বালিশের নিচে থাকা ব্লুটুথ টা নিয়ে আবার হনহন করে বের হয়ে গেল। পিছন থেকে শিফু স্পষ্ট শুনল তুহিনের গলা।
“আমি কিন্তু তোমার রাগে ফিদা হয়েছি কালনাগিনী।”
জোরপূর্বক সবার কাছে বিদায় নিয়ে ইহামের বাড়ির সবাই বের হয়েছে। ইহাম তাদের এগিয়ে দিতে গেল। গাড়িতে উঠার আগে ইসহাক চৌধুরী ছেলেকে বললেন,
“নিজের রুক্ষ মেজাজ টা একটু দমানোর চেষ্টা করো বাবা। এতটাও কঠিন হইও না যাতে ওই মেয়েটাও তোমার রুক্ষতায় শুকিয়ে পড়ে।”

দাঁত চেঁপে ইহাম নীরবে সয়ে নিল যেন। বাবা কে ভীষণ শ্রদ্ধা করে সে। উনার মুখের উপর সে কখনোই উচ্চগলায় কথা বলে না। ইসহাক চৌধুরী ছেলের বাহুতে চাপড় দিতে দিতে গাড়িতে উঠে বসলেন। শায়লা বেগম ছেলের দিকে তাকালেন। তিনি বেশ জানেন উনার ছেলের রুক্ষ স্বভাব আর কাঠিন্যতা। ছোট থেকেই ইহাম একটু সবার থেকে আলাদা। ওর মাঝে আবেগ, অনুভূতি, নরম ভাবের চেয়ে গম্ভীর স্বভাব টা বেশি প্রাধান্যের। খুব কম বয়স থেকেই উনার বাস্তবিক এই ছেলে সবার থেকে একটু দূরে একা নীরবে থাকতেই পছন্দ করে। সবার সাথে হাসি মজা আড্ডা দিতে খুব একটা দেখা যায় না তাকে। একরোখা রুক্ষ মেজাজের ইহাম কে সবাই কঠিন পাষাণ মানব ভাবলেও তিনি জানেন উনার ছেলের নরম মনের কথা। তিনি এগিয়ে গিয়ে ছেলের হাত ধরলেন আলতো করে। নরম কোমল গলায় বললেন,

“তোকে কিন্তু বিয়েতে আমরা খুব বেশি জোর করিনি বাবা। তোর ঘাড়েও চাপিয়ে দেইনি। শুধু একটু জোর গলায় চেয়েছিলাম ওই সুন্দরি লক্ষ্মী মেয়েটাকে কাবিন করে ঘরের বউ করে নিতে। মায়রা কিন্তু খুব ভালো একটা মেয়ে। তুই এখনি বিয়ে করতে চাসনি বলে ওই নরম মিষ্টি মেয়েটাকে কষ্ট দিস না বাবা। ওর সাথে একটু সহজ নরম গলায় কথা বলার চেষ্টা করিস বাবা।”
ইহাম তবুও কোনো জবাব দিল না। একদম নীরব কঠিন মানবের মতোই ঠাই দাঁড়িয়ে রইল।ওদের সবাই কে বিদায় করে দিয়ে সে একা একাই হেটে গেল একটা চায়ের দোকানে। এক কাপ লিগার চা নিয়ে খুব দক্ষ হাতে সিগারেটে আগুন ধরালো।
মায়রা নিজের রুমে বসে নিঃশব্দে চোখের পানি ঝড়াচ্ছে বদলধারার ন্যায়। মিথিলা উচ্ছ্বাস নিয়ে ঘরে এসে তাকে কাঁদতে দেখে কপাল কুঁচকে নিল সন্তপর্ণে। সরু আঁখিপল্লবে এগিয়ে গেল মায়ার কাছে। কাঁধে হাত রেখে সংশয় নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“কি রে মায়রা কি হয়েছে তোর?”
মায়রা নয়ন ভর্তি শুভ্র দানা পানি নিয়ে তাকাল মিথিলার দিকে। আচমকা সে জড়িয়ে ধরল তাকে। ফুঁপিয়ে নীরব কন্ঠে মিনমিন করে বলল,
“আমার সাথে কেন এমন টা হলো আপু?”
মায়রার এহেন কথায় আরো কুঞ্চন হলো মিথিলার ললাট ভ্রুদ্বয়। তার মস্তিষ্ক ঠিক ধরতে পারছে না মায়রার কথার সূক্ষ্ম মানেটা। আজ তাদের প্রথম দেখা হলো। সামনাসামনি কথাও হয়েছে বোধহয়। তবে মেয়েটা এভাবে কাঁদছে কেন? কি হলো তার? শঙ্কিত কন্ঠে মিথিলা শুধালো,
“কি হয়েছে মায়রা বল তো আমায়? কাঁদছিস কেন সেটা বল।”
মায়রা কে টেনে নিজের সামনে এনে ধরল মিথিলা। মেয়েটা চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। নাকের ঢগা টুকটুকে লাল হয়ে আছে তার। চোখের বর্ণও রঙ্গিম আভায় ছড়িয়ে গিয়েছে। মিথিলা তার মুখে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিল। কন্ঠে কোমলতা ঢেলে জিজ্ঞেস করল,

“মায়রা বোন আমার বল কি হয়েছে। ওই বদ ক্যাপ্টেন টা কি তোকে কিছু বলেছে?”
মায়রার ভেতর ফুঁপাচ্ছে। তীব্র ঝড় তার ভেতরটাকে তাণ্ডবে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিচ্ছে। অশান্ত ঝড়ো হাওয়া তাকে সপ্রতিভ করে দিচ্ছে ক্রমাগত। বুকের উপর প্রকাণ্ড ওজন অনুভব করছে সে। মনে হচ্ছে কোনো অদৃশ্য শক্তি বুঝি তার গলাটা চেঁপে ধরে রেখেছে। শ্বাস নিতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে তার। নাক টেনে একটু সময় নিয়ে বিড়বিড় করে জানাল,
“আপু, উ উনি অন্য কাউকে পছন্দ করে। তাই হয়তো আমার থেকে এত দূরত্ব বজায় রাখে সে।”
মিথিলা মেয়েটা শান্তশিষ্ট হলেও ভীষণ রাগি। মায়রার মুখে এমন কথা শুনে দপ করে বুঝি তার আগুন জ্বলে উঠল। ক্ষোভ মেশানো কন্ঠে বলল,

“আমায় সবটা খুলে বল তো। ওই রোবট টা কি তোকে বলেছে এ কথা?”
“হ্যাঁ আপু। আমাকে বলেছে আমি যেন শাড়ি না পরি আর। কলেজে নাকি উনি কোন শাড়ি পরা মেয়েকে পছন্দ করেছিলেন?”
মিথিলা রাগে কটমট করে উঠল। সরু সরু ক্ষোভান্বিত নয়ন নিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
“ও তাহলে এই কথা? তবে দেখ!”
ইহামের গা থেকে সিগারেটের উদ্ভট গন্ধ ভরে গিয়েছে। মাথার যন্ত্রণায় কয়টার ধোয়া ফুঁকেছে সে তা জানে না। রাত নয়টা বাজতে চলল। এবার বাসার ভেতরে যাওয়া দরকার। তার শ্বশুর মহিন সাহেব ইতিমধ্যে তিনবার কল করে নিয়েছেন। অনমন্যস্ক হয়ে পা বাড়াল সে বাসার উদ্দেশ্যে।

চাকরিতে জয়েন্ট হয়েছে ১ বছরও হয়নি তার মাঝে বিয়ে করতে সে চায়নি। কিছুদিন পর মেজর পদে পদন্নোতিও হবার সম্ভবনাও রয়েছে প্রবল। এই মুহূর্তে কোনো ভাবেই বিয়ে করতে চায়নি সে। তারউপর যখন শুনেছে মেয়ে এখনো ইন্টার দেয়নি তখন বুঝি তার রাগ জেদ আরো চওড়া হয়ে চেঁপেছে পাষাণ হৃদয়টায়। একজন আর্মির স্পেশান সোর্স সেক্টরের ক্যাপ্টেন হয়ে কি করে সে ১৮ বছরের নিজে একটা মেয়েকে বিয়ে করে? অথরেটি বা তার কলিগরা শুনলে তাকে নিয়ে কি চিন্তা আনবে নিজেদের মনে? তার বাবা মার কথা রক্ষার্থে শুধু বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে সে। নয়তো এখনি বিয়ের বেড়াজালে নিজেকে কখনোই জড়াত না।
মায়রা কে নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে করতেই সে বাসায় ঢুকল। ফাতেমা বেগম ইহাম কে দেখেই বললেন,

“ইহাম বাবা কখন এলে তুমি? কিছু কি লাগবে বাবা?”
ইহাম সৌজন্যমূলক মৃদু হাসল। ওই রুক্ষ নিস্তেজ হাসির মাঝে যেন স্পষ্ট প্রাণ নেই ভাব টা ভেসে আসে। শান্ত গলায় জানাল ইহাম,
“সবেই এলাম আম্মু। আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
“তাড়াতাড়ি এসো বাবা আমি ডিনার দেই।”
সঙ্গেসঙ্গে ইহাম জবাব দিল,

“না আম্মু। আমি এখনি ডিনার করব না।লাঞ্চে যা খায়িয়েছেন ডিনার না করলেও চলবে অনয়াসে।”
ফাতেমা বেগম মুচকি হাসলেন। ছেলেটা একটু কম কথাবার্তা বললেও ভীষণ ভদ্র আর মার্জিত। নিশ্চয় উনার মেয়ে এই ছেলের সঙ্গে সুখে আরামে থাকবে। সোহাগ গলায় বললেন তিনি,
“কি বলো বাবা? তোমার জন্যে হাঁসের গোশত রান্না করেছি। বেয়ান বলল তুমি নাকি হাঁস পছন্দ করো।”
একটু বুঝি লজ্জা পেল ইহাম। মাথা নুয়ে নিল সে। মৃদু আওয়াজে বলল,
“আমি যাই তাহলে আম্মু।”
“আচ্ছা বাবা যাও। মায়রা মনে হয় ওর রুমেই আছে।”

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ২

ইহাম নিরুত্তর নিম্প্রভ হয়ে সেই জায়গা ত্যাগ করল। হন্তদন্ত হয়ে গাম্ভীর্য মুখের আদলে সে রুমে এলো। ভেতরে এসে অকস্মাৎ চোখের সামনে এমন লাস্যময় রূপ আগুনের উত্তাপে বুঝি থমকে গেল সে। গাম্ভীর্য আদল কর্পূরের মতো মেলাল কোথাও। আপন মতে পা গুলি আটকে গেল যেন অদেখা শিকলের বন্ধনে। বিস্মিত বিমূঢ় চোখের দৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্য যেন মাদকতায় মিশে গেল নির্নিমেষে।

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৪