মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ২৩

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ২৩
সাদিয়া

“মায়রা তোমার জন্যে একটা দুঃসংবাদ আছে।”
সদ্য গোসল করে আসা টাওয়াল দিয়ে ভেজা চুল মুছতে মুছতে রুমের ভেতর এগিয়ে এলো মায়রা। ইহামের ব্যস্ত আওয়াজ শুনে বিহ্বল চোখে তাকায় সেদিক। ঠোঁটে চমৎকার একটু হাসি ঝুলিয়ে একেবারে ঘরের ভেতর এলো। সদ্য গোসল করা মায়রার ওই মোহনিয়া রূপ দেখে খানিক থমকালোই ইহাম। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখল মায়রা কে। যেন ঘোর লাগা দৃষ্টি দিয়েই পা বাড়িয়ে দিয়েছে সামনে এগিয়ে আসার। মায়রা খুব বেশি খেয়াল করল না বিষয়টা। বরং চিন্তিত স্বরে শুধালো,

“এই সকালে কিসের দুঃসংবাদের কথা বলছেন আপনি?”
আচ্ছন্নতায় এমন ভাবে ডুবে আছে সে যে মায়রার প্রশ্ন গায়ে মাখল না। আর না কর্ণকুহর পর্যন্ত পৌঁছাল। সে পা বাড়িয়ে একদম নিকটে অবস্থান করল মায়রার। তখন ধ্যান ফিরল মায়রারও। কপাল কুঁচকে বিতৃষ্ণা নিয়েই বলল,
“কি হলো? আপনায় কি জিজ্ঞেস করছি? এগিয়ে আসছেন কেন এভাবে?”
“শুহহহহ!” দ্রুত গতিতে ইহাম চেঁপে ধরল মায়রার ঠোঁট। “তোমার সাথে কি ফ্লাটিং করবো নাকি আমি? না খেয়ে ফেলব? চুপটি করে দাঁড়াও তোমার ভিজে চুলের সুধা নিয়েই একটা জমপেশ খবর দিব।”
মায়রা খাম্বার মতো ঠাই দাঁড়িয়ে রইল। মানুষটা তার খুব গভীরে থাকায় নিশ্বাস আটকে আসছে। ইহাম ঘাড়ের পাশ দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দিল। চুলে নাক ডুবিয়ে আবেশে চোখ বন্ধ করে নেয় তৎক্ষণাৎ। মেয়েলি একটা সুভাসের সাথে শ্যাম্পুর কড়া ঘ্রাণ মিলে অন্যরকম অনুভূতি দিচ্ছে বুকের গহীনে। ইহাম মায়রার নরম কোমল গালে আলতো করে একটা চুমু খেয়ে সরে দাঁড়াল। মৃদু হেসে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“একগাদা শ্যাম্পু লাগিয়েছো চুলে তাই না? চুল থেকে তোমার নিজেস্ব ঘ্রাণ থেকে শ্যাম্পুর ঘ্রাণই বেশি আছে মনে হচ্ছে।”
মায়রা রাগান্বিত হয়ে তাকাল। এই লোকটা একটু কি কখনো প্রশংসা করতে পারে না? এত সোজাসুজি কথা কেন বলতে হবে সবসময়?
“আমি আজ চুলে শ্যাম্পু করিনি। অযথা বকবক না করে কি বলবেন বলেন।”
“তবে তো বলতে হচ্ছে আমার বউ এর চুলের ঘ্রাণে আমি দুই তিন দিন ধরে অজ্ঞান হয়ে থাকতে পারব। কি বলো আমার পিচ্চি মিসেস চৌধুরী?”

মায়রাকে একটু ফোলাতে খুব বেশি খারাপ লাগে না তার। মেয়েটার যখন তার কথায় মুখটা ভার করে দেয়। তখন অন্যরকম একটা সৌন্দর্য ভর করে তাতে। এই যেমন এখন খানিক লজ্জা পেয়ে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে অন্যদিকে। এই মুহূর্তে তাকে দেখতে আবার অন্যরকম লাগছে। মেয়েটা কি এই কথায় খুশি হয়েছে? প্রশংসা করলে কি মেয়েদের মন ভালো হয়ে যায়? এভাবে লজ্জায় লাল হয়? মেয়েটার সাথে থাকতে থাকতে বুঝি জীবনে তার নতুন অভিজ্ঞাত তৈরি হচ্ছে। ঠোঁটে এক চিলতে তৃপ্তির হাসি ফুটল মায়রার ওই আনন দেখে। মোহাচ্ছন্ন গলায় বলে উঠল,
“তোমার বোধহয় এখানের সময় ফুরিয়ে গিয়েছে মায়রা। কালই বোধহয় আমার সাথে তোমায় চট্টগ্রাম ফিরতে হবে।”

আচমকা এমন একটা কথায় বেশ বড়সড় ধাক্কা পেল মায়রা। চোয়াল ঝুলে বিস্ময় নিয়ে বিহ্বল চোখে স্থির রইল তার চোখ গুলি। কানে বারবার করাঘাত করতে লাগল যাবার কথাটা। তার মস্তিষ্ক কি বুঝল সে নিজেও ঠিক ধরতে পারল না। কানে বারবার বাজতে লাগল চট্টগ্রাম ফিরতে হবে কথাটা। কোন ভিত্তিতে তার চট্টগ্রাম যাবার কথা বলছে এই লোকটা?
বিস্ময় ভাবে হতবিহ্বলের মতো তাকিয়ে থাকা দেখে কপালে মৃদু সরু ভাব দেখা গেল ইহামের।মেয়েটার প্রশ্নাত্মক চাউনি ঠাউর করে নিজ থেকে শুধালো,

“আমার সাথে চট্টগ্রাম যাবে। এতে খুশি হওনি মায়রা?”
“মা মানে? চট্টগ্রাম যাবো মানে কি বলতে চাইছেন?”
“এটাই বলছি কাল তোমাকে নিয়ে চট্টগ্রাম ফিরব। প্রস্তুতি নিয়ে রাখো।”
মায়রা অস্থির হলো। কাল একটা রাত মা বাবা কে ছেড়ে এখানে থেকেছে তাতেই কেমন ফাঁকাফাঁকা লাগল। আর এই লোক বলছে চট্টগ্রাম যাবার কথা? সে তো এখনো সেসবের প্রস্তুতি নেয়নি। আর তাকে শ্বশুর বাড়ি একেবারে আসার বিষয়টা তো আরো পরে হবার কথা। তাহলে এখন অন্য জায়গায় যাওয়ার কথা আসছে কেন? বাবা মা কে ছাড়া কি করে থাকবে? বাবা মা কে ছাড়া একমাত্র ফুপির বাসায় গিয়ে থাকে সে। কিন্তু ফুপির বাসা আর এটা তো এক কথা নয়। ভয়ে চিন্তায় অস্থির হলো মায়রা। ঢোক গিলে বলল,

“কাবিনের সময় কথা ছিল ২ বছর পর তুলে আনবে আমাকে। তাহলে এখন আপনার সাথে যাবার কথা কেন বলছেন? আমি এখনি প্রস্তুত না। আমাকে একটু সময় দিন।”
মায়রার কাছ থেকে এমন কথা হয়তো আশা করিনি ইহাম। সে ভেবেছিল মায়রা খুশি হবে। বিয়ের পরই বাবা মার কারণে এক প্রকার বাধ্য হয়েই কোয়াটারের আবেদন জমা দিয়েছিল। এতদিন কোনো প্রকার গুরুত্ব না দিলেও লাস্ট মাসে বেশ গুরুত্ব দিয়েছে এই বিষয়টায়। মায়রাকে নিয়ে তার ভেতরের নিজেস্ব অস্থিরতা কাটাতে ঠিক করেছিল নিজের সাথে রাখার। তার বেশ জানা আছে একজন স্পেশাল ফোর্সের ক্যাপ্টেনের কাছে অল্প দিনে বৈবাহিক কোয়াটার পাবা খুব কঠিন নয়।

প্রথমে কর্নেল সিহাবুউদ্দীন কে না জানিয়ে আবেদনটা করে ছিল। এর জন্যে অবশ্য তাকে তার বিরুদ্ধে ডিসিপ্লিনারি একশন নেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও সেটা হয়নি। কর্নেল তাকে ভীষন স্নেহের চোখে দেখেন। উনার সাথে সম্পর্কটা ভালো সূত্রে থাকায় বরং বিষয়টায় চটে না গিয়ে আশ্বাস দিয়েছিলেন আবেদনটা মঞ্জুর করা নিয়ে। গত দুই দিনে তার মন বারবার বলছিল এই মেয়েটাকে সাথে নিয়ে যাবার কথা। কেন যেন মনে হচ্ছিল মনের প্রশান্তির জন্যে হলেও মায়রা কে নিয়ে যেতে হবে। গত মাস ধরে মনে হচ্ছে মেয়েটার দূরত্ব তাকে পীড়া দেয়। জীবন, সম্পর্কটা স্বাভাবিক করতে এক সাথে থাকা তার বেশ ভালো উপায় মনে হয়েছে।

এতে যদি সবটা স্বাভাবিক ধারাপাতে আসে। আর আজ সকাল সকালই কর্নেলের ফোন পেয়ে ভীষণ খুশি হয়েছে সে। ভেবেছিল মায়রারও খুশি হবে। কিন্তু এই মেয়ে তো উল্টো সুর গাইছে। যেতে চায় না নাকি? তার মুখের উপর কি মেয়েটা না করবে নাকি? করে দেখুকই না। এক চরে সব দাঁত ফেলে দিবে না সে? কোন সাহসে তার মুখের উপর কথা বলবে? না করতে যাবে কেন এই মেয়ে?

“আমার দিকে তাকাও মায়রা। তাকাও এদিকে। তুমি যেতে চাইছো না এমন কিছু কি?”
ধীর বেগে মায়রা তাকাল ওই তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সম্মুখে। তাকিয়ে থেকেই কিছু একটা ভাবল। শঙ্কিত কন্ঠে জবাব দিল,
“আমি এখন যেতে চাইছি না।”
ইহামের মেজাজ খারাপ হলো। দাঁতে দাঁত পিষলেও নিজেকে স্থির করলো সে। তপ্ত শ্বাস ঝেড়ে জানতে চাইল,
“যেতে না চাওয়ার কারণ?”
“কিছুদিন পর আমার ফাইনাল এক্সাম। এই মুহূর্তে আমি কি করে যাবো?”
“এটা কোনো বিষয় না মায়রা। ওখানে গিয়ে তুমি পড়াশোনা করবে। বিয়ের পর মেয়েদের স্বামীর সাথেই থাকতে হয়। এটা জানো না?”

“আপনি কেন বুঝতে চাইছেন না বলুন তো। আচ্ছা কথা হয়েছিল না ২ বছর পর আমাকে তুলে আনবেন? তাহলে এখন একরম কেন বলছেন?”
“আমার ইচ্ছা হয়েছে আমি আমার বউকে সাথে করে নিয়ে যাবো তাই দুই বছরের কথার নিয়ম ভাঙ্গলাম। হয়েছে? প্রস্তুত নাও কিন্তু মায়রা।”
ইহাম ফোনে কিছু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলে মায়রা ফুঁসে উঠল। জেদ নিয়ে কড়া গলায় বলল,
“আমি যাবো না।”
রাগান্বিত ভাবেই তাকাল ইহাম। এমনটাই আশা করছিল বোধহয় সে। ক্ষোভ মেশানো গলায় দাঁত পিষ্টে বলল,
“তুমি যাবে। আর কালই যাবো আমরা।”

মায়রার ভেতরে তরঙ্গের খেলা চলল। মানুষটাকে পছন্দ করে সে। খুব করে চায়। স্বামী হিসেবে মেনেও নিয়েছে সে। তাই তো এই খারাপ ব্যবহারের পরের আদুরে আহ্লাদ গুলি মনে করে গলে বসে। সে তো চাইছে না সম্পর্কটা খারাপ হোক। বরং নিজের দিক থেকে ঠিকি চেষ্টা করছে সম্পর্কটা আর পাঁচ দশটা সম্পর্কের মতো ঠিক করতে। একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে কিংবা স্বাভাবিক ধারায় আনতে কাউকে না কাউকে চেষ্টা করতে হয়। কিছু দিন কাউকে না কাউকে সেকরিফাইজ করতেও হয়। এই মানুষটাতো তার বয়সের অনেক বড়, একটু রগচটা রাগি। তাকে সমীহ করে কিংবা নিজের অনুভূতির কথা চিন্তা করে সম্পর্কটা স্বাভাবিক ধারায় আনার চেষ্টাটা নিজেই করতে চাইছে। আর যাই হোক তার প্রতি যে এই মানুষটার কিছু একটা আছে তা টের পায় সে।

তার স্বত্বা জানানও দেয় তা। লোকটা হয়তো মুখে মুখে বলে বেড়ায় না কিংবা বুঝেই উঠতে পারে না নিজের অনুভূতি টা। না স্বেচ্ছায় স্বীকার করে না তা জানা নেই। তবে বিপরীত লিঙ্গের একটা আলাদা মানুষ হয়ে ওই লোকটার চোখের চাউনি কিংবা নরম গলায় বলা কথা, আলতো স্পর্শ তাকে বলে বেড়ায় কিছু। রাগারাগির পর্যায়টা তার কাছে কেমন কর্পূরের মতো ঠেকছে। ওই রগচটা আচারণে রাগে কষ্ট পেলেও পর মুহূর্তের কোমলতা তাকে সব কর্পূরের মতোই সব ভুলিয়ে দিয়ে সক্ষম হয়। একটু সময় দিলে আস্তে ধীরে সম্পর্কটা সহজাতে আসবে বলে তার বিস্তর আশা। সেই অভাবনীয় লোভটুকু তাকে কেবল মাত্র লোকটার কোমলতায় ডুবিয়ে রাখছে। কিন্তু এই লোক তো এবার গাদ্দারি করা শুরু করে দিয়েছে। হঠাৎ এমন জেদ করছে কেন এই মানুষটা? চায়ছে টা কি? তার সুবিধা অসুবিধা চিন্তা করতে চাইছে নাই বা কেন?

“আপনি কি পাগল হয়েছেন? জেদ করছেন কেন? আমার ফর্মফিলাপ এখনো বাকি। এখানে প্রাইভেট আছে। কি করে যাবো আমি?”
ফর্মফিলাপের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও যেন তার গায়ে লাগছে না। নিজেকে স্থির রেখে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“ওসব আমি সামলে নিব। ওখানে গিয়ে বাসায় তোমার জন্যে প্রাইভেট ঠিক করে দিব। চিন্তা করো না।”
এবার মায়রারও যেন একটু রাগ হলো। লোকটা বুঝতেই চাইছে না যেন তার কথার মানেটা। এই অল্প সময়ের জন্য নতুন একটা পরিবেশে যাওয়ার মানে? সুবিধা অসুবিধার কথা কি মানুষটা ভাবছে না? খানিক বিরক্ত হয়েই বলল,
“আপনি কিন্তু এবার আমায় জোর করছেন।”

“তোমার স্বামী হিসেবে আমি তোমার উপর জোর করতেই পারি মায়রা। হ্যাভ মাই রাইট।”
এই পর্যায়ে মায়রা সত্যি বাকহারা হলো। হৃদয়ে সূক্ষ্ম একটা ব্যথা অনুভবের মাধ্যমেই ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের একটু হাসি চলে এলো তার। কেমন গাঢ় কন্ঠে বলে উঠল,
“আপনায় একদিন বলেছিলাম ইহাম জোর কাপুরুষেরা করে।”
শব্দটা যেন দাঁতে দাঁত কেঁটে আনে ক্রোধে। ইহাম আপ্রাণ লাগাম টানার চেষ্টা করে বলে,
“মুখ সামলে কথা বলো মায়রা। আমি তোমার হাজবেন্ট হই ভুলে যেও না।”

মায়রা কেমন গা হাতপা ছাড়া দাঁড়িয়ে রইল। সে সত্যিই এই মানুষটাকে সঠিক বুঝতে পারছে না। এই মানুষটার অভিব্যক্তি কি অথবা তার অনুভূতির অতল গহ্বর কোথায়? তাকে নিয়ে সে নিজের মনের ভেতর যে অনুভূতি টুক লালন করে আদৌত কি সঠিক? কি জানি। মায়রা নিস্তেজ ভাবেই শীর্ণ আওয়াজ তুলল গলায়।
“আপনায় কে বলেছে স্বামী কাপুরুষ হতে পারে না?”
অগ্নিগিরি লাভার মতো ক্রোধে টগবগ করে উঠল ইহাম। চোখের মুখের ভাব আগুন হয়ে উঠল। দাঁত পিষে দুই কদম এগিয়ে পৌঁছাল একদম মায়রার সন্নিকটে। বাহু চেঁপে নিজের দিকে ঘুরিয়ে চাঁপা বিদ্বেষ স্বরে শুধালো,
“কি বলতে চাইছো মায়রা? তোমার এসব বেয়াদবি কিন্তু মেনে নিব না আমি।”
“আমার সামান্য কথা যদি আপনি সহ্য করতে না পারেন তবে আমি কি করে আপনার সব ধরনের ব্যবহার সহ্য করি বলুন তো।”

মায়রার কাপন্ত করুণ কন্ঠটা কেমন যেন একেবারে বুকে গিয়ে লাগল। চেঁপে ধরা হাতটা আপনাআপনি আলগা হয়ে গেল। গভীর করে চেয়ে রইল টলমল করা ওই মায়রার আঁখিপল্লবের দিকে। মেয়েটার এমন ক্লান্ত বিষাদ চেহারা কি তাকে কষ্ট দিচ্ছে? কই আগে তো এমন হয়নি? কারো পানি দেখেও তো এমন হয়না তার। বরং তার হৃদয়টা এমন যে মৃত্য লাশ নিয়ে খুব কাছের মানুষের গগন ফাটানো আহাজারিও তাকে খানিকও টলাতে পারে না। তবে কোথাও কেন একটা ব্যথা অনুভব করছে আজ? তাকে মায়রা ইঙ্গিতে সরাসরি কাপুরুষ বলছে তবে সে কোনো রকম রিয়েকশন না দেখিয়ে কেমন নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

“আমি এখন দ্বিধায় পড়ে গিয়েছি ইহাম।” কেঁদে উঠল মায়রা। কম্পিত কন্ঠে থেমে থেমে বলল “আমি আপনাকে নিয়ে দ্বিধায় আছি। আমি কখনো বলেন আমাকে পছন্দ করেন আবার কখনো আমার সাথে এই রকম কঠিন ব্যবহারের আসলে মানে টা কি আমাকে বলবেন? আপনি আমার উপর জোর খাটাতে চান কেন? আমার নিজেস্ব কোনো ইচ্ছা থাকতে পারে না? আমাকে সব আপনার ইচ্ছাতে করতে হবে কেন বলুন? আপনার কারণে কি আমি নিজেস্ব স্বকীয়তা বিসর্জন দিব? আপনি আমাকে আদৌত কি মূল্য দেন বলুন তো? তাহলে অন্তত আমার দিকটাও বিবেচনা করতেন। আমাদের সম্পর্কটার আসলে মানে কি বলবেন? আমি চাইছি আপনার সাথে সবটা ঠিক করে স্বাভাবিক একটা ভালোবাসার সংসার করতে। আর আপনি কি চাইছেন বলুন? আমি আপনার কাঠিন্যতা ছাড় দিচ্ছি বলে কি আপনি আমার উপর জোর করতে পারেন? আমার সুবিধা অসুবিধার কথা চিন্তা না করে আমাকে ফোর্স করা আপনার কেমন পছন্দের তালিকায় পড়ে বলুন?”

ইহাম স্তম্ভিত হয়ে আছে। মায়রার কথা গুলি তাকে নির্বাক করেছে। তীক্ষ্ণ চোখে শুধু অবলোকন করছে মেয়েটাকে। মাথামোটা মেয়েটা কি খুব ভারভার কথা বলেছে তাকে? কপালে সরুসরু ভাজ নিয়ে সে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে মায়রার দিকে। মেয়েটা কি কিছু বুঝতে পারে না? সব কথা মুখে বলে বলে বুঝাতে হবে কেন? কিছু জিনিস কি নিজ থেকে বুঝে নেওয়া যায় না? মায়রা কেন বুঝতে পারছে না গত এক মাসে তাকে অস্থির করেছে সে। কেমন দিকভ্রান্ত লাগে। কোনো কিছু বুঝে উঠতে পারে না সে। এখন তো মনে হচ্ছে তার প্রশান্তির জন্য মেয়েটাকে অবশ্যই চাই। আচ্ছা প্রশান্তি কি ভালোবাসার কোনো অংশ? কাউকে সামনে দেখতে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা কিংবা পেলে প্রশান্তি উপলব্ধি করা কি ভালোবাসার আওতায় পড়ে? এই মাথামোটা গবেট মেয়েটা কেন বুঝতে পারছে না তাকে ছাড়া এখন সে থাকতে পারবে না। অস্থিরতার ভান তার বুক বধ করবে। তাকে যন্ত্রণায় পিষ্ট করার চেয়ে গর্দভ মেয়েটা ওখানে গেলে কি এমন হবে? মায়রার কথায় সে কোনো রকম জবাব দেয়না। নীরব নির্বাক থাকে। পরস্তু তার কাছে মনে হলো এসব প্রশ্নের উত্তর তার কাছে নেই।

“জবাব দিচ্ছেন না কেন ক্যাপ্টেন সাহেব? আমার জায়গা আপনার জীবনে কোথায় বলছেন না কেন?”
ভালোবাসা শব্দটা আর উচ্চারণ করে না মায়রা। কারণ লোকটা তো বলেই দিয়েছে তাকে সে ভালোবাসে না পছন্দ করে। সেটা উপলব্ধি করার সময়ও চেয়েছে। তবে মুর্খামি করে কি করে আজ আবারও এই প্রসঙ্গে কথা বলবে? ভালোবাসে না ঠিক আছে। তাই বলে এই রকম কঠিন ব্যবহার করবে কেন? জোর খাটাতে চাইছে কোন উদ্দেশ্যে তা সে বুঝতে পারছে না। নিজের উপর মানুষটার শান্ত ধারালো চাউনি দেখে দ্রুত দৃষ্টি নত করল সে। ইহাম তবুও কিছুক্ষণ ওভাবেই নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকে গম্ভীর হয়েই নিরুত্তর রূপে স্থান ত্যাগ করল।

এক বিস্তর সংশয় মায়রার অন্তরকে ছটফট করে দিচ্ছিল। তাই শাশুড়ির কাছে নাস্তার পরই আবদার করেছিল বাড়ি যাবার। ইহাম তখন শক্ত জোড়ালো কন্ঠে ধীর ভাবে বলেছিল,
“আজ মায়রা যাবে না। আমি কাল চলে যাবো। এর আগেই ওকে বাসায় পৌঁছে দিবো। মা ওকে এই বিষয়টা নিয়ে আবার রিপিট করতে বারণ করে দাও।”

অগত্যা মায়রা আর কিছু বলার সাহস পায়নি। সেও মেনে নিয়েছে চুপ করে। সারাদিন ইহাম আর বাড়িতে ছিল না। একেবারে এসেছে বিকেলে। এসেই নিজের রুমে গিয়ে গাপটি মেরেছে সে। নাওয়াখাওয়া বাদে এসেই মা কে হুকুম করেছে কফির। শিরিন বেগম নিজ হাতে কফি বানিয়ে দিয়ে তা ধরিয়ে দিলেন মায়রার কাছে। বললেন ইহামের রুমে গিয়ে দিয়ে আসতে। তখনের বিষয়টার পর থেকে আর তাদের কথা হয়নি। এখন এই সংশয় দ্বিধা তাকে কেমন অস্বস্তিতে ফেলছে। ভেতরটা খচখচ করছে মানুষটার সামনে যেতে। আবার না রেগে গিয়ে কিছু বলে দেয় রগচটা টা।

ধীর পায়েই মায়রা এগিয়ে যায় সেদিকে। রুমের ভেতর কোনো রকম অনুমতি চাইবার অপেক্ষা না করে নিজেই এসে ভেতরে পৌঁছায়। তাকে আসতে দেখে লোকটা অবশ্য একবার তাকিয়েছে। কিন্তু কোনো রকম জবাব না দিয়েই সে আবার ল্যাপটপে মুখটা ঠেসে দিল। তাকে এই রূপ নিরুত্তর প্রতিক্রিয়াহীন দেখে মুটেও ভালো লাগল না মায়রার। চাঁপা ক্ষোভে ফুঁসল নিজ মনে। কিছুক্ষণ নীরবেই দাঁড়িয়ে রইল। তার বলা “আপনার কফি” কথাটাও হেলদোল তৈরি করল না। লোকটাকে কিছু বলতে না দেখে এবার রাগই হলো তার। কেন একটু কথা বললে কি মানুষটার মুখ পচে যাবে? জবাব দিলে জাত চলে যাবে চুলোয়? মুখের শব্দরা কি তার সাথে দরকষাকষি করেছে? যে কথা বললেই জরিমানা ঠুকবে? ইহামের নির্বাক রূপ তেঁতে উঠালো তাকে।

নিজেও মুখ ভার করে সেন্টার টেবিলের উপর কাপটা রেখে এক পল তাকাল ইহামের দিকে। মানুষটা এমন করে ল্যাপটপে মুখ দিয়ে রেখেছে দেখো যেন এই রুমে সে ছাড়া আর কারো অস্তিত্ব নেই। একটা মানুষ যদি নিজ থেকে কিছু করতে না চায় কিংবা কথা না বলে তাকে তো আর সে জোর করাতে পারবে না। তাই বিদ্বেষ অভিমুখ নিয়ে নীরবেই পা বাড়াল দরজার দিকে। তখনি ল্যাপটপ রেখে বিদ্যুত গতিতে ইহাম তার হাতটা চেঁপে ধরল। এক টানে নিজের কাছে আনতেই পিঠে গলিয়ে দিল হাত। মায়রা ভ্রুকুটি করে দেখল তার অভিভঙ্গি। গম্ভীর মুখের ছায়ায় কিছুই ঠাউর করার জো তার নেই। গাঢ় কন্ঠে থমথম পরিবেশ কে গলিয়ে বলল ইহাম,

“গাধার মতো নড়াচড়া না করে এখানে দাঁড়াও।”
জবাব দিল না মায়রা। আগের মতো গা জ্বলে উঠল না এখন ইহামের এসব কথায়। বরং ভ্রুদ্বয়ের মাঝে আরো কুঞ্চন সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে। লোকটা আবার গম্ভীর কন্ঠে জানাল,
“তোমায় একটু জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। তার জন্যেও হয়তো অনুমতির প্রয়োজন। খুব বেশি আত্মসম্মানিনী হয়ে নয়তো আবার কখন না জানি তোমার গোবর পঁচা গবেট মাথায় মনে হয় যে আমি তোমার সাথে জোরজবরদস্তি করছি। তখন তো আবার কাপুরুষ ট্যাগ লাগিয়ে দিবে। এখনকার যুগের মেয়েরা আত্মনির্ভরশীল কি না!”
ইহামের মুখের ভাবভঙ্গি হাস্যকর। ওই গম্ভীর ভোতা মুখ দেখে না হেসে আর পারল না মায়রা। ঠোঁট টিপে মুচকি হেসেই উঠল সে। তার ওই ভুবন ভুলানো হাসির দিকে মন্ত্রপূতের মতো তাকিয়ে থাকল ইহাম। আচ্ছা মায়রার হাসিও কি তার মাঝে ইফেক্ট করছে? এই যে এখন এই হাসির পিঠে এক নির্মল স্বস্তিরতা খেলে যাচ্ছে তার অন্তঃগ্রথিতে। কোথাও খুব মিষ্টি আরাম অনুভব করছে। আচ্ছা এই প্রশান্তির নাম কি আসলে? হাসলে মেয়েটাকে দারুন লাগে তো। নিজের গাম্ভীর্য মুখের আদল আর পরিবর্তন করল না সে। ওভাবেই এক বুক আরাম উপলব্ধি নিয়ে আঁকড়ে ধরল মায়রা কে।

“কি করছো আম্মু?”
“বসে বসে তোর কথাই চিন্তা করছিলাম। আমার ছোট্ট মায়রা টা কত বড় হয়েছে যে শ্বশুর বাড়ি চলে গেল। আমার ঘরটা কেমন খালিখালি লাগছে।”
মায়ের কথায় স্পষ্ট বেদনার ছাপ। এই বেদনা বুঝি তার বুকেও প্রভাব ফেলল। বুকটা কেঁপে উঠল তার। আচ্ছা মেয়েদের বিয়ের পর কেন স্বামীর বাড়িরই থাকতে হয়? দীর্ঘ এক দুই যুগ যে ওখানে থেকেছে বড় হয়েছে সেই মায়া ছিঁড়ে কেন স্বামীর বাড়ি চলে আসতে হয়? দুই দিনের জন্যে এসেছে। তাতেই ভেতরে একটা শূন্যতার বেদনা। এরপর কি করে যে এত এত যন্ত্রণা নিয়ে একেবারে চলে আসবে তা সেও জানে না। এক্ষেত্রে তার মনে হয় মেয়েদের জীবন আসলেই অসহনীয় কষ্টের। প্রসঙ্গ পাল্টাতে মায়রা গলা কেঁশে বলল,

“আচ্ছা আম্মু কি করছো তুমি? বিকেলে কিছু নাস্তা করেছো? ঔষধ গুলি ঠিক করে খাচ্ছো তো?”
“আর নাস্তা? আমার ঘরের পাগলিটা নেই যে পিছু ঘুরঘুর করবে নাস্তার জন্যে। এটা খাবে ওটা খাবে তার বায়না করবে। তাই বানাতে ইচ্ছাও হয়নি।”
এবার আবেগি মায়রা কেঁদেই ফেলল। ফুঁপিয়ে উঠলেও বুঝতে দিতে চাইল না। ব্যর্থ প্রক্রিয়ায় লুকানোর চেষ্টা করল তা। নাক টেনেই বলল,
“এমন করে তুমি বলছো যে আমি একেবারের জন্য চলে এসেছি। দুদিনের জন্য এসেছি আর এমনি আমাকে পর করে দিচ্ছো।”

“কি রে মা কাঁদছিস তুই? আমার একা ঘরে ভালো লাগছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে রে। তুই শ্বশুর বাড়ি একেবারের জন্যে চলে গেলে আমি কার সাথে বকবক করব বল? আমার কাছে সারাক্ষণ আবদার করবে কে? কাকে শাসন করব আমি সেটা ভেবেই তো আমার বুক চিঁপা দিয়ে আসছে।”
মা মেয়ে দুজনই ফোনের দু দিক থেকে নীরবে কাঁদছে। মায়রার হৃদয় অন্তত কোমল। কারো একটু কথায় তার প্রভাব পড়ে খুব বেশি। এই যে কেউ একটু আহ্লাদী গলায় কথা বললেই তার ইচ্ছা হয় কেঁদে ফেলতে।
“একদম বাজে বকবে না। আমি তো বলিনি আমাকে বিয়ে দিয়ে দাও। এই বয়সেই বোঝা ভেবে তাড়াতাড়ি সরিয়ে ফেলতে চেয়েছিলে না? এখন কাঁদছো কেন আম্মু?”
ফাতেমা বেগম মুখে কাপড় গুঁজে কাঁদছেন। দরুনে আর গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না উনার।

“কান্না থামিয়ে চা করে খাও। তোমার মাথা ধরেছে বুঝাই যাচ্ছে। আব্বুর সাথে আবার ক্যাঁচক্যাঁচ করো না। কাল তো আমি চলে আসছি তোমাকে জ্বালাতে। এখন রাখছি।”
চোখের পানিটুক মুছে নিলেও ভেতরের পীড়াটা লেপনের কোনো উপায় পেল না মেয়েটা। পরিবার থেকে ছিন্নতার হৃদয় ফাটা বেদনা বুঝি মেয়েদের অন্তঃগহ্বরেই লুকায়িত থাকে।
শিরিন বেগমের ডাকে চোখ মুছে নাক ঝেড়ে মায়রা ঘর থেকে বের হলো। ড্রয়িংরুমে তখন শুধু শিরিন বেগম আর শিফু বসে আছে। সোফার উপর বসে মুভি দেখছে মনোযোগ দিয়ে। তাকে দেখেই মিষ্টি করে হাসলেন ভদ্র মহিলা। আদর মেশানো গলায় শুধালেন,

“মায়রা আম্মা, সন্ধ্যায় কি নাস্তা খাবে? কি বানাবো?”
মায়রা জবাব দিলো না। তার মাথা নিচু করে নেওয়ার দৃশ্যে কপাল কুঁচকে চিন্তিত ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলেন শিরিন বেগম,
“কি হয়েছে আম্মা এ দিকে তাকাও তো। দেখি।”
মায়রা নিঃশব্দে মুখ তুলল। ভেজা চোখ দেখে ব্যস্ত হলেন মহিলা।
“এই মেয়ে কাঁদছো কেন? দেখি তাকাও আমার দিকে মা। কি হয়েছে বলো? আমার বদমা’ইশ টা আবার কিছু বলেনি তোমায়?”
মায়রা মাথা দিয়ে না বুঝালো। চোখেও পানিও ছেড়ে দিয়েছ এতক্ষণে। ঠোঁট উল্টে কাতর স্বরে বলল,
“আম্মুর জন্যে মন খারাপ লাগছে মা।”

শিফুও মুভি ছেড়ে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। শিরিন বেগম ম্লান হাসলেন।
“দেখো মেয়ের কান্ড” মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন তিনি। চোখ মুছে আদর করলেন। “আমায় মা বলে ডাকছে আবার বলছে আম্মুর জন্যে মন খারাপ করছে। আমাদের মেয়েদের জীবনই এটা। এক কোল ছেড়ে আরেক কোলে আসতে হয়। আমি আমার এক মেয়েকে দিয়ে থাকছি না? আরেকটা কে দিতে হবে না? সব মেয়েকে শ্বশুর বাড়ি যেতে হয়। প্রথমপ্রথম কষ্ট হলেও যখন নিজের সংসারের দায়িত্ব পড়ে যায় কাঁধে, সংসারটা নিজের হয়ে যায় তখন আর এত খারাপ লাগে না। পরে তো দেখা যায় নিজের সংসারের ঝামেলায় বাপের বাড়ি গিয়ে যে কদিন থাকবে সেটারও উপায় হয় না। এটা তথাকথিত ভাবেই হয়ে আসছে রে মা।”
মায়রা মাথা নুয়ে কান্না করছে। আসলেই তার খুব কষ্ট লাগছে। শিরিন বেগম চোখ মুছলেন আবারও। মায়রার হাত টেনে নিয়ে যেতে লাগলেন রান্নাঘরে। “আয় তো মা দেখি আজ তোর পছন্দের কি নাস্তা করা যায়। তবুও আর কাঁদিস না মদ।”

অম্বরের কালো রঙ গাঢ় ভাবে ছুঁয়ে গেছে। চৌধুরী বাড়িতে চারদিকে তখন মৃদু আলো। সবাই ঘুমে কাত হয়ে আছে। এদিকে এক বিছানায় দুই নর নারী নীরবে বিছানার দুই দিকে ঘাপটি মেরে শুয়ে আছে। দুজনের চোখের পাতা তখন খোলা বইয়ের মতো। কারো চোখে ঘুমের নামটিও নেই। তবুও রুমে কোনো শব্দ নেই। পিনপতন নীরবতা চারদিকে। দুজনের মাঝেই খানিক ফাঁকা জায়গা। দুজনের ভেতরেই তখন আলাদা আলাদা এক অস্থিরতা বিরাজ করছে। কোথাও যেন অদৃশ্যের বেড়াজালে তাদের সুঁতো গিয়ে এক জায়গায় বাঁধা পড়ে। তবুও মুখ ফুটে কেউ কিছু বলে সবটা ঠিক করার প্রচেষ্টা কারো মাঝেই নেই। শুধু বিপরীত মানুষটাকে নিজের সাথে নিঃশব্দে শুয়ে থাকার ব্যাকুল একটা অনুভূতি দুজনকেই ব্যস্ত করছিল।

অতঃপর নিজের উদ্রেক চাঁপা রাখতে না পেরে ইহাম চট করে ঘাড় বাঁকিয়ে পিছন ফিরল। মায়রা তখন উল্টোপিঠে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে। ঝড়ের বেগে ইহাম ছুটে গেল। মায়রার নিচে বা হাত ডুকিয়ে এক টানে নিজের কাছে নিয়ে এলো। বুকের গভীরে মিশিয়ে নিয়ে দুই হাত দিয়েই জড়িয়ে ধরল মায়রা কে। ঘাড়ে মুখ গুঁজে দিতেই মায়রা একটু নড়েচড়ে উঠল। ভেতরটা তার অস্থির অনুভূতিতে মেতে উঠেছে। মানুষটার এভাবে জড়িয়ে ধরা তার নিশ্বাসকে পিষে দিচ্ছে যেন। আরেকটু নড়তেই ইহাম ফিসফিস কন্ঠে বলল,
“প্লিজ মায়রা চলো না আমার সাথে। এদিকের সব আমি সামলে নিব। তুমি প্লিজ আমার সাথে কোয়াটারে ফিরো। কেন বুঝতে চাইছো না তোমাকে ছেড়ে এখন আমার থাকতে কষ্ট হবে। অস্থির লাগবে ভেতরটা। প্লিজ চলো না আমার সাথে।”

গা শিউরানো কথা গুলি শরীরে কাটা দিচ্ছে মায়রার। সেই সাথে থমকেও গিয়েছে তার চিন্তাধারা। হঠাৎ লোকটা এভাবে কথা বলছে কেন? কথার সুর ছন্দ সব কিছু অদ্ভুত লাগছে তার কাছে। এই মানুষটা তার সাথে কি আহ্লাদী করে কথা বলছে? কন্ঠে এত সরলতা কোমলতা কেন? মানুষটা না বলেছিল সে বাকি সবার মতো আহ্লাদে গদগদ হতে পারে না। তবে এই কোমল সুরের কি মানে? এবার আসার পর থেকে কঠিন মানুষটাও কখনো যেন নিজের রুক্ষতা থেকেও বের হয়েছে।

এই যে তার জন্মদিনের সারপ্রাইজ প্ল্যানিং, তাদের কাটানোর প্রথম রাত, কাল রাতের কথাগুলি, যত্ন নিয়ে ফুচকা খায়িয়ে দেওয়া, চোখের চাউনি সোহাগ সব কিছু কি কাঠিন্যতা টপকে ভেতরের কোমলতার প্রবেশদ্বার নয়? এই যে এখন শিহরণ তুলা কন্ঠ, তাকে নিয়ে যাওয়ার আকুতি। নিজের অস্থিরতা প্রকাশ করা। সব তো তার রুক্ষতার বিপরীতের পাত। কাঠিন্যতার উল্টোপিঠে চলে নিজের ব্যাকুলতা প্রকাশ করছে কেন পাষাণ মানুষটা? শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতেই মায়রা শুকনো ঢোক গিলল। একটু নড়েচড়ে হাতটা সরানোর চেষ্টা করতেই কানের লতিতে উষ্ণ নিশ্বাস পড়ল। লোকটার ক্রোধ কিংবা অভিমানের ধাতে হিসহিস ভাবে ভার কন্ঠে শুনা গেল কেবল,

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ২২

“বুঝেছি বেয়াদব মেয়ে। স্বামীর কথা শুনবে কেন? আদব নেই তো ভেতরে হয়েছো তো আস্তো একটা মাথামোটা বেয়াদব। না নড়ে চুপ করে থাকো একটু। অন্তত আমাকে আজকের রাতটা এভাবে জড়িয়ে ধরে থাকতে দাও।”

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ২৪