মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ২৫
সাদিয়া
বেলা ১১ টার দিকে তিন মা মেয়ে রওনা হয়েছে ফেণীর উদ্দেশ্যে। মহিন সাহেব পরশু দিন বিয়েতে যাবে। তাই নিজেস্ব প্রাইভেট কার করেই শিরিন বেগম শিফু আর মায়রা রওনা হয়েছে।
মায়রার আদল হাস্যোজ্জ্বল। মন ফুরফুরে। উচ্ছ্বাস নিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। অনেকদিন নিজের উপর এক প্রকার প্রেশার খাটিয়ে পড়ায় ডুবে থাকায় একঘেয়ে চলে এসেছিল। মোটামুটি ছাত্রী হওয়ায় এর আগে এভাবে আটঘাট বেঁধে পড়াশোনায় কখনো নামেনি সে। কিন্তু এবার ইহামের কথা বেশ প্রভাব ফেলছে তার মাঝে। হতচ্ছাড়া কিভাবে বলে সে ফেলটুশ ছাত্রী? দেখিয়ে দিতে হবে না ওই লোকটাকে তার রেজাল্ট? তাছাড়া মানসম্মান এর একটা বিষয় আছে। কোনো ভাবে ফেল করলে কিংবা রেজাল্ট খারাপ হলে ওই লোকটা তার ইজ্জতের ফালুদা বানাবে। আর শ্বশুর বাড়ির মানুষজনের সামনেও বা লজ্জায় কি করে মুখ দেখাবে? কিভাবেই বা বলবে নিজ মুখে রেজাল্টের কথা? সারাবছরের আধখাওয়া পড়া শেষ করতে এবার সে হিমশিমই খাচ্ছে। তাই ডান বাম তাকানোর সময় নেই। সময়ের দীর্ঘমালা অল্প হলেও এর কাছে মূল্য বিশাল। এখন ভেতরটা মনে হয় একটু স্বস্তি লাগছে। এইতো রিলেক্সে প্রাণ ভরে একটু শ্বাস নিতে পারছে।
শিরিন বেগম মাথা হেলিয়ে দিয়েছেন সিটে। ঘুমও পাচ্ছে গাড়ির ঝাঁকুনি তে। এদিকে শিফু আর মায়রা বকবক করে গাড়ি উঠিয়ে ফেলছে। দুজন মিলে ঢং করে সেলফিও তুলছে। ফোনের স্কিনে তুলা ছবি গুলি দেখতে দেখতে মাথা কিলবিল করল তার। শিফুর সাথে একটা ছবি মনে মনে ঠিক করল ডে তে দেওয়া যায়। অপরদিকে ওই মানুষটাও একটু জ্বলবে। গাড়িতে উঠার আগেই শিরিন বেগম বলে দিয়েছেন ইহাম কল করলে তা ধরার দরকার নেই। অযথা বকা শুনে কাজ কি? শাশুড়ির মুখে শুনেছে লোকটা তার পরীক্ষার দোহাই এ আসতে মানা করেছিল তবে এখন শাশুড়ির জোরে আসতে পেরে মন বড্ড ভালো লাগছে। শাশুড়ি তার একদম ছেলের মুখে ঝামা ঘষেছে। ঠোঁট টিপে হেসে উঠল মায়রা।
ছবিটায় হাত দিয়ে দুজনের মুখই আড়াল করে রাখা। দুজনেরই চোখ দেখা যাচ্ছে। ডে ডান করতে করতে মনে মনে তৃপ্তির হাসি হাসল মায়রা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“জ্বলুক ক্যাপ্টেন সাহেব। জ্বলে পুড়ে কয়লা হোক। তবেই না কাজ সাধন হবে। বউয়ের কাছে গম্ভীর চাঁপা ভাব দেখানো? পৃথিবীর কোন বদল এমন করতে যায়? আমাকে গাধা বলে নিজে যে একটা বলদ তার বেলায়? বউয়ের কাছে কোন লোকটা অনুভূতি প্রকাশ করতে না চায়? অনুভব করে তবে সরাসরি মুখ ফুটে বলে না কেন? কি এমন হবে নিজের ভালো লাগার, অন্তরের কথাটা বললে? আপনাকে সরাসরি নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতেই হবে ক্যাপ্টেন সাহেব। জ্বলতে হলে জ্বলুন তবুও বুলন। আর কোনো থামাথামি নেই।”
গাড়ি আপন গতিতে ছুটছে। পাকা ফাঁকা রাস্তা পেয়ে গাড়ি সাঁইসাঁই করে এগিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার দুই পাশের বড় বড় গাছ গুলি মাড়িয়ে গাড়ি নিজ গন্তব্যে এগিয়ে যাচ্ছে। শিরিন বেগম ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমে চলে গিয়েছে আর শিফু ক্লান্ত মন নিয়ে। সিটের হেডে মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে নিশ্চুপে। মায়রা জানে শিফু ঘুমায়নি। তার চোখের পাতা পিটপিট করছে। ছোট্ট মেয়েটা নিজেকে যতটা স্বাভাবিক স্বস্তির দেখাতে চাইছে ততটা নয় ভেতরের অবস্থা। তাকে দেখলেই সেটা বুঝা যায়। চওড়া হাসির মাঝেও কোন প্রাণ নেই, নেই কোনো সজীবতা। মেয়েটা ক্লান্ত ভারাক্রান্ত মনের পিছুটান কাটাতে পারেনি এখনো। তাই তো ইচ্ছাকৃত হাসির অন্তরালে গভীর ভাবে ফুটে উঠে গাঢ় ব্যথিত হৃদয়টা।
এদিক থেকে মায়রার মনে হয় শিফু তার থেকে বয়সে কম হলেও শক্ত মনের মানুষই। ভাইয়ের ধাত পেয়েছে বোধহয় খানিক। নয়তো আবেগে ভেসে পরা বয়সেও শিফুয়া কিভাবে দৃঢ় শক্ত ভাবে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে? সবটা সমালে উঠার চেষ্টাও করছে হয়তো। ওদিকে তার ভাইয়াটাও প্রায় নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে। আগের মতো কথা বলে না, ঝগড়া করে না সবসময় কেমন চুপচাপ থাকে। মুখে স্পষ্ট বিষণ্ণতার ছাপ নিয়ে ঘুরে। বাড়িতেও বেশি সময় থাকে না। এক সাপ্তাহ বাদেই তার ফ্লাইট। অথচ পরিবারকে সময় দেওয়ার বদলে একা থাকতে পছন্দ করে। দুজন দুইদিক দিয়ে কষ্ট পাচ্ছে। আচ্ছা ইহাম নিজের মতো করে সব না ভাবলে তো আর তাদের এত কষ্ট হয়না। দুজনই কষ্ট পাচ্ছে। তারচেয়ে এক করে দেওয়া কি যুক্তিসংগত ছিল না? যুক্তিতে চাঁপা পড়ে যাওয়া বিষয়টা কি আবার তুলা যায়? বিষয়টা নিয়ে একটু কথা বলে দেখা যায় না আবারও?
এক নাগাড়ে ইহাম কল করে যাচ্ছে মায়রা কে কিন্তু মেয়েটা ফোন উঠাচ্ছে না। চিন্তায় ব্যাকুলতায় শরীর জ্বলছে। মেজাজ খিটখিট করছে বিছুটি পাতা লাগার মতো। মেয়েটা কল কেন ধরছে না? ফোনটা তুলে কথা বললে কি হবে তার? এই মেয়েটা মনে হয় তাকে না মে’রে শান্ত হবে না। সেই কখন থেকে কল দিয়েই যাচ্ছে অথচ ধরার নাম নেই। ভেতরের অস্থির ব্যাকুলতার ভাব ক্রমশ ঝড়ের বেগে বাড়ছে। সামান্য কল ধরা নিয়ে আজ তার এত অস্থির লাগছে কেন? মেয়েটা তো এমনি। খামখেয়ালিতে মত্ত হওয়া ত্যাড়া একা মেয়ে। মাথার তারেও মেয়েটার সমস্যা আছে। নয়তো এত গুলি কল দেওয়ার পরেও কেন ধরছে না ফোন টা? ইচ্ছা করে এমন করছে কি?
মায়রার আজকে কল না ধরা তার রাগের বদলে দুশ্চিন্তায় পতিত করছে। মেয়েটা একটু কল ধরে বললেই হয় ওখানে গিয়েছে কি না বা সব ঠিক আছে কি না। এদিকে যে চিন্তায় চিন্তায় তার বুকটা ব্যথায় জর্জরিত হচ্ছে, দমটা আটকে আসছে সেদিকে কি কোনো ধারনা আছে ওই বদল মেয়ের? এই মেয়েটা নিশ্চয় তাকে মে’রে শান্ত হবে। ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলল ইহাম। ভেতরটা বড্ড চঞ্চল হয়ে উঠেছে তিক্ত অস্থিরতায়। সব কিছুতে কেমন বিরক্ত অনুভব করছে। ধীরগতিতে ইবরাহিম কে আসতে দেখে নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করল। ঢোক গিলে অভিভঙ্গি বদলানোর অভিপ্রায়ে গলা কাশল। অতঃপর ইবরাহিম কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজ থেকেই শান্ত অস্থির কন্ঠে শুধালো,
“কাউকে কখনো ভালোবেসেছো লেফটেন্যান্ট ইবরাহিম?”
আচমকা এমন কথায় বিস্ময়ে থমকে গিয়েছে ইবরাহিম। চোখ বড়বড় করে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সামনের গম্ভীর লোকটার দিকে। হলো কি তার স্যারের? প্রেম ভালোবাসা নিয়ে কখনো তো মানুষটা কিছু বলে না। বরং সবসময় এড়িয়ে যায়। কিন্তু এখন এমন কথা কেন? আচ্ছা স্যারের চোখে মুখে কি চিন্তা অস্থিরতার ছাপ? বউ এর সাথে কিছু হয়েছে কি? ঝগড়াটগড়া বাধায়নি তো কর্নেল সিহাবুউদ্দীনের মতো? লোকটা বউকে প্রচণ্ড ভালোবাসা এই বয়সে এসেও। কিন্তু বউ কে সময় দিতে পারে না বলে টুকটাক বিষয়েও ঝগড়া লেগে থাকে। আর বউ এর সাথে ঝগড়া করে এসে রাগ ঝারে তাদের উপর।
“কি হলো ইবরাহিম তুমিও বোবা হয়ে গিয়েছো নাকি?”
হঠাৎ ক্যাপ্টেনের কড়া গলা শুনে অপ্রস্তুত হয় ইবরাহিম ছেলেটা। থতমত খেয়ে তাকায় অসহায় দৃষ্টিতে। শুকনো ঢোক গিলে কোনো রকম বলে,
“জ্বি স্যার?”
“ভালোবেসেছো কাউকে?”
মানে সিরিয়াসলি এমন একটা কোমল মনের প্রশ্ন কিনা তার স্যার ধমকে জিজ্ঞেস করছে? যেভাবে তাকিয়ে ধমকাচ্ছে তাতে নিশ্চয় কেউ গভীর প্রেমে ডুবে থাকলেও স্যারের সামনে এসে বেমালুম ভুলে যাবে। এই স্যারের যে রুক্ষতা তাতে তার ওই ছোট্ট বউ টিকে কি করে? তার কাছে মনে হয় ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে রাগি রুক্ষতা বোধহয় ক্যাপ্টেন ফাহাদ ইহাম চৌধুরীই। স্যারের সব কিছুর মাঝে রুক্ষতা থাকা চাই। এই যে ভালো, নরম একটা প্রশ্নও উনি এমন ভাবে করবেন যে মনেই হবে না উনি সহজ ভাবে কিছু জানতে চাইছেন কিংবা সহানুভূতি প্রকাশ করছেন। বরঞ্চ বলার ধরন শুনে নিঃসন্দেহে মনে হবে সব কিছুতে যেন কঠোরতা মিশে আছে। সেই স্যারের মুখে ভালোবাসার কথা শুনা একটু আশ্চর্যেরই বিষয়। ইবরাহিম ঢোক গিলল। থেমে জবাব দিল,
“ন না স্যার।”
“তাহলে আর তোমায় বেকার জিজ্ঞেস করছি কেন? ধ্যাত বিরক্তিকর।”
“স্যার কিছু জানতে চাইলে বা বলতে চাইলে আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।”
তীক্ষ্ণ সরু চোখে ইবরাহিম কে দেখে সিগারেট জ্বালাল একটা। ঠোঁটের ফাঁকে কায়দা করে সেটা টান মেরে চোখ ফেরালো অন্যদিক। বাগানের টকটকে লাল গোলাপের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সরল নরম কন্ঠে শুধালো,
“ভালোবাসা কি ইবরাহিম।”
ইবরাহিম অতি আশ্চর্য হলেও ঠোঁট টিপে হেসে উঠল। তার ধারনা তবে ঠিক। স্যার তার ভালোবাসায় ফেঁসেছে। চেহারায় এক সূক্ষ্ম অস্থিরতা। চোখে কারো জন্যে গাঢ় ব্যাকুলতা। নিশ্চয় বউ এর প্রেমে মজেছে স্যার। গলা কাশল ছেলেটা। ধীর কন্ঠে বলল,
“স্যার ভালোবাসা হলো অন্তরের একটা সূক্ষ্ম অনুভূতি। এটা মনস্তাত্ত্বিক বিষয়। যা অনুভব করা যায় গভীর ভাবে। ভালোবাসা মানে একটা আবেগ স্যার। তীব্র একটা আকর্ষণ। ভালো থাকার প্রশান্তিতে থাকার একটা নির্ভেজাল মহাঔষধ। ধরতে পারেন হৃদয়ের একটা আলো। যা কখনো রোদের মতো উজ্জ্বল তো কখনো হীম শীতল অনুভূতি। আপনি যখন কাউকে ভালোবাসবেন তখন আপনার কাছে সেই মানুষটার একটা গুরুত্ব আপনার অন্তরে স্থায় নিবে। তার সব কিছু আপনায় ভাবাবে। তার আনন্দ আপনাকে আনন্দিত করার চেয়ে বেশি তার কষ্ট আপনাকে দগ্ধ দিবে। ওই মানুষটার কিছু হলে দেখবেন ঠিক আপনার নিশ্বাস আটকে আসবে।
তার জন্যে একটা চিন্তা আপনার মস্তিষ্কের এক কোণায় ঠায় নিবে। ভালোবাসলে সেই মানুষটাকে যত্নে রাখতে, সব কিছু থেকে আগলে রাখতে আপনার মনে প্রবল এক আকাঙ্ক্ষা জাগবে। সেই মানুষটার প্রতি তীব্র একটা নেশাময় আকর্ষণ আপনার আলোড়িত করবে। তার উপস্থিতি আপনাকে যেমন আনন্দ প্রশান্তি দিবে তেমনি তার অনুপস্থিতি আপনাকে তার চেয়েও অধিক পুড়াবেও। ভালোবাসার নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই স্যার। এটা কেবল অন্তরের গভীর স্থল থেকে অনুভবের এক মিশ্র আধুত অনুভূতি। এই জন্যেই হয়তো রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ভালোবাসা কেবল পাওয়া নয় তা অনুভব করাই যথেষ্ট।”
ইহাম মনোযোগ দিয়ে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে সবটা শুনল। ভেতরের গহীন থেকে কিছু একটা অনুভবও করল নিভৃতে। এই সব গুলি কি তার সাথে হচ্ছে? ভেতরের নীরব আন্দোলনের মানে কি এর আওতায় নয়? গভীর ভাবে ভাবল ইহাম। ততক্ষণে তার সিগারেট শেষ। শেষ ধোয়াটুক শূন্যে ছুড়ে ঘাড় বাকিয়ে তাকাল ইবরাহিমের দিকে। ছেলেটা নিশ্চয় তার তীক্ষ্ণ শাণিত নজর দেখে কাছুমাছু হয়ে গিয়েছে। কপালের সূক্ষ্ম ভাজটা ইহাম পরিষ্কার ফকফকে করল। শান্ত ধীর কন্ঠে বলল,
“তুমি তো দেখছি কবিদের মতো বর্ণনা দিচ্ছো ইবরাহিম।”
উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছে ছেলেটার। স্যারের মুখে প্রশংসা শুনে মাথা নত করে নিয়েছে সে।
“থাকো আসছি।”
চট করে মাথা তুলল ইবরাহিম। কপালের রেখা তুলে গটগট করে বলল,
“ক্যাপ্টেন, কমান্ডিং অফিসার আশরাফুল ইসলাম আপনার সাথে মিটিং রেখেছে। আমাদের এখনি যেতে হবে।”
ইহাম ফোঁস করে দম ছাড়ল। নিশ্চয় আবার কাজের ফোয়ারা। একবার নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও ছুটল CO এর বিল্ডিং এর দিকে।
ফেণীতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে মায়রাদের চার টার উপরে ভেজেছে। গাড়ি থেকে নামতেই এত মানুষের ঘিরে ধরা মায়রা কে বেশ অপ্রস্তুতে ফেলে দিয়েছে। লাজুক কায়ায় মাথা নত করে নিয়েছে সে। শ্বশুরবাড়ির এত আত্মীয়র সামনে বেশ বিব্রত বোধই করছে। হালিমা বেগম মায়রা কে দুই হাতে আগলে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন।
“তুমি যে এসেছো আমি কত খুশি হয়েছি যে মা বলে বুঝানো যাবে না। আপা কে বারবার বলেছিলাম ইহামের বউ কে নিয়ে আসতে। আম্মা আছে দেখবেন বলে যে কত বার সে কথা আওড়েছে। আসো মা ভেতরে আসো।”
একে তো বিয়ে বাড়ি তার উপর ঢাকা থেকে মেহমান আসায় ঘিরে নিয়েছে তাদের। ঘরে মানুষের গিজগিজ। শহর থেকে গ্রামে কেউ আসলে যেমন মানুষের ঢল পড়ে যায় তেমন ভীড় জমেছে বাড়িতে। আশেপাশের মানুষজনও দেখতে এসেছে কে এলো। চারিদিকে এত মানুষজন দেখে লঘু অস্থিরতায় ইতস্তত অনুভব করছে মায়রা। বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে। লোকে এসে এসে তাকে দেখে যাচ্ছে। ওড়না টেনে মাথা নুয়ে আছে সে। খুবই বিব্রতকর অবস্থা। গাড়িতে যতটা না অস্থির লেগেছে এখন তার বেশি লাগছে অস্বস্তি। লোক সমাগমে ভ্যাপসা গরমও লাগছে ঘরটায়। ফ্যানের বাতাসও যেন গায়ে লাগছে না। খানিক মাথা তুলে আশেপাশে ননদ কিংবা শাশুড়ি কে না পেয়ে সংকোচ বাড়ল তার। তবুও নীরবে বসে থাকতে হচ্ছে। বাহির থেকে শিফুর গলা শুনা যাচ্ছে। লোকজনের সাথে ভালোমন্দ কথা বলছে। তবে শাশুড়ি কোথায়?
হালিমা বেগম ঠান্ডাঠান্ড লেবুর শরবত করে এনে হাতে তুলে দিলেন। মায়রা কে জোর করে হাত ধরিয়েও দিলেন তিনি। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন “খাও মা খাও।” ভ্যাপসা গরমে ভেতর কাহিল। আশপাশ না দেখে চুমুক দিয়ে গ্লাসের সবটুক শরবত শেষ করল সে। কাগজী লেবুর শরবত বেশ লেগেছে খেতে।
“মা আরেক গ্লাস দেই? আরেকটু খাও। এত দূর জার্নি করলে।”
বেশ ভদ্রতার সাথে নম্র গলায় জবাব দিল মায়রা,
“না খালামনি। আর লাগবে না।” ইতস্তত বোধ করে জানতে চাইলো, “আচ্ছা খালামনি মা কোথায়?”
হালিমা বেগম হাসলেন। উত্তর দেবার আগেই এক বৃদ্ধ মহিলা “কই দেহি তো। সর তোরা দেহি আমার নাতবউ এর চাঁদ মুখটা” বলতে বলতে লাঠিতে ভর করে এগিয়ে এলেন। উনাকে ধরে ধরে শিরিন বেগম নিয়ে আসছেন। মায়রা বুঝল এটা তার নানী শাশুড়ি। শুনেছে উনার মেরুদণ্ডের সমস্যার কারণে ঘন্টার ঘন্টা রাস্তা তিনি বসে থাকতে পারেন না। তাই আকদের সময় যাওয়া হয়নি উনার। পাশের গ্রামেই তার নানাশ্বশুরের বাড়ি। ভদ্র লোক জীবিত নেই এখন। ৮০ বছরের বৃদ্ধা দেখতে এখনো পাকা আমের মতো লাল টুকটুক। কুজো হয়ে লাঠি ভর করে হাটেন তিনি। উনাকে কেঁপেকেঁপে আসতে দেখে চটজলদি করে মায়রা উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে গিয়ে পায়ে হাত লাগিয়ে সালাম করবার আগেই বাঁধ সাধলেন বৃদ্ধা আর শাশুড়ি দুজনই। মায়রা নীরবে কুলছুমা বেগম কে ধরে ধরে বিছানায় বসালেন। বৃদ্ধা হাত বাড়িয়ে টেনে তাকেও বসালেন নিজের কাছে। পিটপিট চোখ দিয়ে তাকিয়ে বললেন,
“বউ তো মাশাল্লা চাঁন্দের টুকরা রে শিরিন।”
“জ্বি আম্মা। আমার বউ চাঁন্দের টুকরাই।”
মায়রা লজ্জায় আরো রঙ্গিম হলো। মাথার উড়না টেনে কুঁকড়ে বসল। কুলছুমা বেগমের সামনের দাঁত নেই। অথচ মাড়ি দিয়ে পান চাবলাতে চাবলাতে জিজ্ঞেস করলেন,
“আমারে চিনবার পারছো?”
মায়রা তাকাল সাদা ধবধবে কুঁচকে যাওয়া দলা পাকানো চামড়ায় পান খাওয়া লাল ঠোঁট গুলি অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। যৌবন বয়সে এই মহিলা নিশ্চই আগুন সুন্দরী ছিলেন। মিষ্টি হেসে অল্প আওয়াজ তুলে বলল,
“জ্বি নানু।”
“বাহহ, নাতবউ তো আমার ভারি বুদ্ধিমতী। অনেক বড় হও বইন। স্বামী সোহাগি হোও।”
শেষের কথায় মায়রার গাল দুটি লাল হয়ে উঠল। মনে হলো সেখান থেকে গরম ধোয়া বের হচ্ছে।
হাতমুখ ধুয়ে আরো একটু দেরিতে মায়রা কে একটা রুমে নিয়ে আসা হলো। খুব গোছানো পরিপাটি একটা রুম। তবে খুব বেশি বড় নয়। মাঝারি আকারের একটা রুম। একটা ঘাট, একটা ওয়ারড্রব, একটা ড্রেসিংটেবিল আর ছোট্ট একটা টিটেবিল। এখানে শিফু আর সে থাকবে। শিফু এখনো রুমে আসেনি। ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে বিছানায় বসতেই খিদে মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। পেট ভুকভুক করে ডাকছে। খালি পেটে শরবত খেয়ে ওখানে দেওয়া নুডলস আর খায়নি সে। তার খুব খিদে পেয়েছে। তাই পছন্দের নুডলসটাও মুখে দেয়নি। এমনিতেই জার্নিতে মাথা ঘুরাচ্ছে তারউপর ওটা খেলে নিশ্চয় এসেডিটি হবে। তার এখন এক প্লেট ভাত হলে খেয়ে আরামচে শুতে পারবে। কিন্তু এখনো ভাত দিচ্ছে না কেন এরা? খিদেও পেট ভেঙ্গে যাচ্ছে তার।
নিজের সাইড ব্যাগ থেকে ফোন টা বের করল। লক খুলতেই আঁতকে উঠল সে। চোখ বড়বড় করে রসগোল্লার মতো তাকিয়ে থাকল ফোনের দিকে। “পাষাণ মানব” নাম্বার থেকে ৪৭ টা কল। সিরিয়াসলি? ওই মানুষটা এত বার কল দিয়েছে তাকে? শুকনো ঢোক গিলল। পরক্ষণে এক শীতল আবেশ শরীরের খিদে ক্লান্তি সব ভুলিয়ে দিল। ঠোঁটে একটু ফুটল সন্তুষ্টির হাসি। লোকটা আজকাল আধপাগল হয়েছে বুঝি। তার জন্যে করা অস্থিরতা গুলি বেশ উপভোগ করছে সে।
ফোনে চার্জও আছে ২% তাই দ্রুত কল দিতে গেল মানুষটাকে। নিশ্চয় রেগে গিয়েছে। তাকে ধমকও দিতে কৃপণতা করবে না মানুষটা। তবে নাম্বারটা ডায়াল করার আগেই শিফু এসে হাজির। ক্ষীণ গলায় জানাল,
“ভাবি চলো আম্মু ডাকছে খাবারের জন্যে।”
“এখনি যেতে হবে?”
“হ্যাঁ খালামনি ভাত বেড়েছে। আম্মু অপেক্ষা করছে তোমার জন্যে।”
“আচ্ছা চলো।”
ধীরেসুস্থে কল করবে বলে মায়রা ফোনটা চার্জে লাগিয়ে ওয়ারড্রবের উপরে রেখেই চলে গেল ভাত খেতে।
সন্ধ্যা সন্ধ্যা মায়রা কল দিল ইহাম কে। একবার রিং হয়ে এমনি এমনি কেটে গেল। আরেকবার কল দিলে মানুষটা নিজ থেকেই কল কেটে দিয়েছে দেখে মন খারাপ হলো মায়রার। ভেবে নিল লোকটা হয়তো ব্যস্ত আছে নয়তো রাগে কল ধরছে না। মন খারাপ মুখে ঠাই নেওয়ার পূর্বেই কল ঘুরালো ইহাম। মলিন মুখটা মুহূর্তে বদলে হাস্যোজ্জ্বল দেখালো।
“হ্যাঁলো।”
“তবে আমার কথা মনে হলো তোমার? আমি তো ভেবেছি স্বামী নামক বস্তুটাকেই ভুলে গিয়েছো।”
ইহামের কড়া কথা শুনে হেসে উঠল সে। তবে বুঝতে পারল লোকটা খানিক রেগেই আছে। তাই নিজ থেকেই বলল,
“আ আসলে আমার ফোনের চার্জ ছিল না। আর আমি ঘু ঘুমিয়েও গিয়েছিলাম।”
“একদম মিথ্যে কথা বলবে না মায়রা। ভালো হবে না। তুমি ইচ্ছে করে আমাকে জ্বালাতে কল ধরোনি।”
মায়রা আর জবাব দিল না। এটা সত্যি প্রথম ৪/৫ বার যখন ইহাম কল দিয়েছিল তখন সে ইচ্ছা করেই রিসিভ করেনি। কিন্তু এর পর সত্যি সে ঘুমিয়ে গিয়েছিল।
“আমাকে জ্বালাতে বেশ ভালো লাগছে তোমার তাই না? তাই আগুনের গায়ে বাতাস করছো তা আরো বৃদ্ধি পেতে? ভুলে যেও না এই বাতাসে বাতাসে তুমিও সেই আগুনের সংস্পর্শে চলে আসবে।”
“উমমম। বললেই হলো? এত সোজা নাকি সব কিছু? আমার এত শখ নেই আগুনে পুড়ার।”
“তবে আমাকে পু’ড়িও না। আমি পু’ড়লে তোমাকে নিয়েই পু’ড়ব মাথামোটা।”
মায়রা থম মেরে রইল। কথার তাৎপর্য বুঝার জন্যে চুপটি করে রইল সে। ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে স্থির গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন করল ইহাম,
“খাওয়া দাওয়া করেছো?”
“হুম।”
“গুড। এখন আমার কথা শুনো।”
“হ্যাঁলো। আপনার কথা ভালো করে শুনা যাচ্ছে না তো। এত শব্দ কেন আপনার ওখানে?”
“গাড়িতে আছি।”
“কোথাও যাচ্ছেন?”
“হুম। মিশনে।”
“আপনার এক জীবন এই মিশন মিশন করেই কাটবে।”
তার বিড়বিড় করে বলা কথাটা নিজ দায়িত্বে বুঝে নিয়েছে অপরদিকের মানুষটা। এক শীতল কন্ঠে সেই কথার জবাব দিল সে।
“কি করব বলো? বউ তো আমার আর স্বামী স্বামী করে না তাই আমাকে মিশন মিশনই করতে হয়।”
“বউ বউ না করলে বউ আর স্বামী স্বামী করবে কেন?”
“বউ কে রোজ ভালোবাসা দিলে বউ এমনি স্বামী স্বামী করবে। কোনো প্যারা নাই।”
স্তব্ধ হয়ে গেল মায়রা। খালি মুখেই বিষম খেলো সে। বিমূঢ় চিন্তাভাবনা গুলি আঁচও করতে পারেনি লোকটা এমন ধরনের বেখাপ্পা কথা বলবে।
“এটা তুমি বেশ চাইতে পারো তাই না আমার পিচ্চি মিসেস চৌধুরী।”
শুনেছে পুরুষ মানুষ খুব বজ্জাৎ হয়। তারা একটা উছিল্লা পেলে সময় অসময়ে নারী লোকের মতোনই খুঁচায়। আর তা যদি হয় গভীর অপ্রত্যাশিত কোনো বিষয় নিয়ে তাহলে তো কথায় নেই।
“উল্টাপাল্টা কথা বলবেন না। যতসব আজাইরা কথাবার্তা শুনার জন্যে আমি বসে নেই। রাখলাম।”
“শুনো মায়রা। কথা আছে।”
“আবার কি কথা? আউলফাউল কথা বলবেন?”
“সিরিয়াস মায়রা। শুনো আমার কথা গুলি। বাসার সবার সাথে দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে তোমার?”
“হুম হয়েছে। হঠাৎ এই কথা জিজ্ঞাস করছেন কেন?”
“শুনো, একা একা কোথাও বের হবে না। সবসময় মা কিংবা শিফুর সাথে সাথে থাকবে। কোথাও বের হলেও কোনো একজন কে সাথে নিবে। এমনকি খালি রুমেও একা বেশিক্ষণ থাকবে না। গট ইট?”
বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে নিল মায়রা। এই লোক এসব বলছে কেন? ঘুরতে এসেছে। একটু শান্তিতে থাকতেও পারবে না নাকি তিনটা দিন? আশেপাশের কোথাও গেলে কি কাউকে লেজ ধরে রাখতে হবে নাকি? কেউ তার জন্যে সবসময় ফ্রী হয়ে বসে থাকবে? সে তো আর বাচ্চা নয়। আর একা রুমেই বা না থাকার মানে টা কি? ইহাম কোন ধরনের বারণ করল এটা?
“এমন অদ্ভুত নিষেধাজ্ঞা কেন দিচ্ছেন? আমি তো আর বাচ্চা না যে একা থাকলে ছেলেধরা আমায় বস্তায় ভরে নিয়ে যাবে।”
তার প্রশ্ন শুনেও ওপাশ থেকে অল্প সময় নীরবতা বিরাজ করল। অতঃপর কোমল কন্ঠেই বলল,
“ছেলেধরা না রে মাথামোটা বলদি। তোমায় নিয়ে তো যাবে অভিশপ্ত আত্মা।”
আত্মার কথা শুনে সারা শরীর ভয়ে কাটা দিয়ে উঠে তার। ভয়ার্ত চোখ গুলি বড়বড় করে তাকায় ভাসমানে। ভেতর থেকে শঙ্কিত ধ্বনি কলরব পূর্ণ পরিবেশকেও যেন ভূতুড়ে করে দিচ্ছে। বাহির থেকে লোকসমাগমের আওয়াজ। তবে এখন একা রুমে থাকায় ভয় অন্তর খাবলে ধরেছে। কথা বলতে গলা কাঁপছে। প্রচন্ড ভীত চোখে ঘরে দৃষ্টি বুলিয়ে কোনো রকম আওয়াজ তুলল সে।
“আ আত্মা মা মানে?”
“মানে খালামনির ননদের আত্মা। যেটা এখনো এই বাড়িতে আছে। প্রায় সময় ঘুরে বেড়ায়, লোকজন কে ভয় দেখায়। একটুআধটু তুড়ি বাজিয়ে নিজের কালিসমাও দেখায়।”
এবার কপাল দিয়ে ঘাম ঝড়তে শুরু করে মায়রার। ছোটবেলা থেকেই ভূতে তার ভীষণ ভয়। রাত হচ্ছে সেই সাথে তার ভেতরটাকে গ্রাস করে নিচ্ছে ভয়ে। আর লোকটা তাকে কি আত্মাটাত্মার কথা বলছে। ভয়ার্ত মুখশ্রী তে কাঠ গলায় মরুভূমির ন্যায় ঢোক গিলল মায়রা।
“আ আপনি মিথ্যে ব বলছে না?”
“মোটেও না রে গবেট। ওই বাড়িতে সত্যিই খালামনির ননদের আত্মা আছে। শুনো, উনি একটা ছেলেকে ভালোবাসতেন তবে খালামনির শ্বশুর শাশুড়ি সেটা মেনে নিতে পারেনি। অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক করেছিল বলে দুঃখে কষ্টে গলায় দড়ি দেয়। সেই থেকেই উনার আত্মা ঘুরে বেড়ায় এখনো এই বাড়িতে। তাই আমি তোমায় সাবধান করছি। আর কিছু না। ওকে মায়রা আমি গাড়িতে আছি। পরে কথা বলব।”
মুচকি হেসে ইহাম কল কাটতেই থরথর করে কেঁপে উঠল মায়রা। আশপাশ তাকিয়ে মনে হলো অদৃশ্য একটা শক্তি আস্তেআস্তে তার খুব কাছে চলে আসছে। এই বুঝি ভয়াল কুৎসিত হাত গুলি দিয়ে তাকে ঝাপটে ধরবে। দিশেহারা হয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে কোনো রকম দৌড়ে ঘর থেকে বের হলো সে।
মাথা প্রচন্ড ব্যথা করছে মায়রার। তবুও ভয়ে আড্ডায় বসে আছে সে। সবাই মিলে এক সাথে আসর জমিয়েছে। হাতে হাতে কাজ করছে। রং তামাশা করছে। এদিকে মাথা ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে রগ। দিশে না পেয়ে শিফুকে নিয়ে একটু নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে বসল। শিফু তখন ফোন ঘাটাঘাটি করছে।
“শিফু খালামনির বাড়িতে তুমি আগেও এসেছো?”
“হুম অনেকবার এসেছি। প্রায় আসা হতো আগে। লাস্ট এক বছর ধরে কারো আসা হয়না আরকি।”
মায়রা ঢোক গিলল। আশপাশ তাকিয়ে চোখ বুলিয়ে নিচু কন্ঠে শুধালো,
“আচ্ছা তাহলে খালামনির যে ননদ টা আত্মহ’ত্যা করেছিল তার সম্পর্কেও সবটা জানো তুমি। তাই না?”
মায়রার এমন প্রশ্নে ফোনে হাত চালানো বন্ধ করে বিস্মিত বিহ্বল চোখে তাকাল শিফু। কপালে অনেক গুলি ভাজ পড়েছে তার। সরু চোখে পাল্টা সে প্রশ্ন করল,
“আত্মহ’ত্যা করেছে মানে?”
শিফুর কথায় তারও কপালে রেখা ফুটল। সংশয় নিয়ে বলল,
“আরে খালামনির যে ননদ টা অনেক বছর আগে যে প্রেম ঘটিত বিষয়ে গলায় দ’ড়ি দিল। যার আত্মা এখনো এই বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়।”
মায়রা ভীত চোখে একবার চোখ ঘুরিয়ে আশপাশ টা দেখল। আবারও গলা শুকিয়ে আসছে তার।
“তুমি কি বলছো এসব ভাবি? খালামনির কোনো ননদই তো এখনো মা’রা যায়নি। উনার এক ননদ কানাডায় পরিবার নিয়ে সেটেল। আরেকজন ঢাকায় থাকে। কালকেই আসবেন। তুমি কি আত্মা টাত্মার কথা বলছো বলো তো?”
শিফুর কথা শুনে মায়রা হতবিহ্বল হয়ে গিয়েছে। একদম স্তব্ধ বিমূঢ় আঁখি নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে শিফুর দিকে। বিরাট সংশয়ে দোদুল্যমান তার মন। একবার ইহামের বলা কথা মনে হচ্ছে তো এখন শিফুর বলা উত্তর। কোনটা বিশ্বাস করবে সে? ওই মানুষটা তবে তাকে মিথ্যে বলল?
“ভাবি তোমায় এসব কে বলেছে বলো তো?”
মায়রা উত্তর দিল না। সে ঠাই বসে থেকে গভীর চিন্তায় মজে গেল। “ভাবি?” শিফুর ডাকে ধ্যান ভাঙ্গল তার। যন্ত্রের মতো জবাব দিল “হু?”
“কি হলো? কি হয়েছে তোমার? কে বলেছে তোমায় এমন উল্টাপাল্টা কথা?”
“কিছু না শিফু বাদ দাও।”
বিষয়টা তখন তলানিতে চলে গেল রাতের খাবারের জন্যে তোরজোড় করে ডাকার কারণে।
খাবার খাওয়ার পর আবার একদফা সভা বসেছে। আলোচনার মূল বিষয় হলো হিমেলের বিয়ে। কাল গায়ে হলুদ। এরপর দিন বিয়ে, বরযাত্রী কে কে যাবে, বিয়ের কিনাকাটা আরো বাকি কি না, কনের মা চাচি দাদী নানীর সবার জন্যে কাপড় কিনা হয়েছে কিনা। এই সব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তারউপর এই রাতের বেলায়ও কেউকেউ এসে বিয়ের কেনাকাটা দেখছে, চুপচাপ বসে কথা শুনছে, রসিকতা করছে। সব মিলিয়ে জমজমাট অবস্থা। বাহিরে উঠানেই বসে আছে তারা। বিশাল বড় উঠানে আজ প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে বেশ জাঁকজমক ভাবেই। চারিদিকে লাইটিং তা দেখতেই ভীড় করছে আশেপাশের মানুষ। এদিকে মায়রা অসহায় দৃষ্টিতে এদিকওদিক তাকিয়ে শিফুকে খুঁজার চেষ্টা করছে। মেয়েটা কোথায় গেল? তার ওয়াশরুমে যাওয়ার দরকার ছিল। একা যেতে ভয়ও করছে।যদিও শিফুর তখনের কথায় সন্দেহ হচ্ছে তার। তবুও চিরাগত স্বভাবে একটা সূক্ষ্ম শঙ্কা মনের কোথাও কাজ করেই থাকে।
উপায়ন্তর না পেয়ে সে একাই বাড়ির ভেতরে গেল। তার পিছুপিছু যে আরেকটা পুরুষ কায়া ছুটেছে তার পানে সেদিকে সে বিন্দুমাত্র অবগত নেই।
ধীরপায়ে আরেকবার আশেপাশে শিফুকে দেখে নিল। রুমের বাথরুমে না গিয়ে মাঝরুমের এক কোণায় কমন বাথরুমে যাবে বলে সেদিকেই পা বাড়ায়। ঠিক তখনি একটা শক্তহাত তার কব্জি যেন খাবলা মেরে ধরেছে। চকিতে বিস্ময় নিয়ে সঙ্গেসঙ্গে সে ঘাড় বাঁকায়। আরেক পুরুষের হাতের বন্ধনে নিজের কব্জি দেখে আঁতকে উঠে সে। বিদ্যুৎ বেগে নিজের হাত জোরপূর্বক ছাড়িয়ে এনে সন্দিগ্ধ বিহ্বল চোখে তাকায় সামনের পুরুষটির দিকে। খালামনির ছোট ছেলেটার মুখে তখনো বিদঘুটে বাঁকা হাসি। ছেলেটার নাম হাসিবুল্লাহ। তার এমন হাসি দেখে ভ্রুকুঞ্চন হয়ে এলো মায়রার। বলা নেই কওয়া নেই এই ছেলে তার হাত ধরল কেন? এমন কদর্য পূর্ন হাসছেই বা কোন কারণে?
“হেই ভাবিজান কোথায় যাচ্ছেন? চলুন আপনায় একটু সঙ্গ দেওয়া যাক।”
“এসব কোন ধরনের ব্যবহার আপনার? আপনার সঙ্গের আমার কোনো প্রয়োজন নেই। যান আপনি।”
“কেন ভাবিজান?” হাসিবুল্লাহ একদম তার কাছে চলে এলো। ফিসফিস করল সে “সঙ্গ ছাড়া থাকতে থাকতে কি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন?”
ছেলেটার হাসি কথার ধরন কিংবা ব্যবহার কোনোটাই ভালো লাগল না মায়রার। বরং বিতৃষ্ণায় চেহারায় রাগ ফুটল। শক্ত গলায় বলল,
“সম্পর্কে আমি আপনার বড় ভাইয়ের স্ত্রী। তবুও আপনার কথার ধরন অত্যন্ত জঘন্য। ব্যবহারে সংযত হবেন।”
তার কথায় হাসিবুল্লাহ রাগল না। বরং নিলজ্জের মতো হাসল। ক্ষীণ গলায় বলল,
“সম্পর্কে দেবর ভাবি বলেই তো ফান করতে পারছি বলুন। চলুন এদিকে গিয়ে আড্ডা দেই। আপনাকেও একটু সময় দেওয়া হলো।”
“আমার আড্ডা দেওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই ভাইয়া। পথ ছাড়ুন।”
“ভাইয়া সাইয়া। ও হোহহ ইট’স ওকে। আমার অনেক ইচ্ছা হচ্ছে যে আপনার সাথে গল্প করার? চলুন ওই কোণায় গিয়ে গল্প করি। ভাইয়া তো আর আপনাকে সময় দিতে পারে না চলুন আমার সাথেই না হয় একটু সময় কাটালেন।”
কথার ধরন ও মুখের ভঙ্গি খুব বাজে। রাগে শরীরটা জ্বলে উঠল মায়রার। ইচ্ছা হলো গালে ঠাস করে দুটো চর লাগাতে। কিন্তু তা করল না। বেড়াতে এসেছে বয়সেও বড় এমন একটা কাজ বোধহয় শাশুড়ি ঠিক দেখবেন না। কিন্তু দুই গালে না দিতে পেরেও শান্তি লাগছে না তার। চাঁপা ক্রোধে চিবিয়ে বলল,
“আরেকবার যদি সস্তা মার্কা কথা আমার সামনে বলতে আসেন তবে কোনো কিছু বিবেচনা করব না। আমার হাত অবশ্যই আপনার গাল ফা’টাবে।”
“তাই নাকি ভাবিজান? আপনার কোমল হাত আমার গালে পরলে বরং ভালোই লাগবে।”
হাসিবুল্লাহ হাত ধরতে চাইলে হঠাৎ পাশ থেকে শিফু চেঁচিয়ে বলে উঠল,
“কি হচ্ছে কি হাসিব ভাই?”
দুজনই চমকে তাকাল। হাসিবুল্লাহর হাসিমাখা মুখ আস্তেআস্তে ফুরিয়ে এলো। স্বাভাবিক ভাবেই তাকালো শিফুর দিকে। আপন বোন না থাকায় শিফুকে বেশ স্নেহ করে সে। তবে জেদ্দি মেয়েটার তেজকেও ভয় পায়। ঠিক রাগি ভাইটার মতো হয়েছে।
শিফু এগিয়ে গেল। ভাবির দিকে তাকিয়ে তার রাগি চেহারা দেখে কড়া গলায় প্রশ্ন করল,
“কি হয়েছে ভাবি? হাসিব ভাইয়া কিছু বলেছে তোমায়?”
মায়রা কটমট করে তাকাল ওর দিকে। রাগে হিসহিস করছে। তার মস্তিষ্ক কিছু একটা সংকেত দিচ্ছে। এই কারণেই কি ওই লোকটা তাকে সতর্ক করেছিল ইঙ্গিতে?
মায়রার জবাব দেওয়ার আগেই হাসিবুল্লাহ মুখ খুলল। “আরে তেমন কিছু না। ভাবির সাথে একটু গল্প করতে চাইছিলাম আরকি।”
শিফু জহুরী চোখে দেখল। হাসিবুল্লাহ ভাই একটু অন্যরকম মানুষ। তার সাথে স্নেহপূর্ণ আচারণ করলেও যারতার সাথে ফ্লাটিং করা শুরু করে দেয়। মেয়ে মানুষদের জ্বালাতে তার যেন বেশ ভালো লাগে। সেই হিসাবেই কিছুটা আন্দাজ করে রাগি গলায় বলল,
“ভাবির সাথে যদি কখনো খারাপ কোনো ব্যবহার করেছো না ভাইয়া তখন দেখে নিও আমি কি করি। এমন ব্যবস্থা করব যে ঘরের ভাতই খেতে পারবে না আর।”
“আরে শিফু তুইও না। এমন কিছুই না।”
“চুপ করো হাসিব ভাই। তোমাকে আমি শুধু সাবধান করলাম। মনে রেখো।”
হাসিবুল্লাহর মুখটা চুপসে গেল। একটু লজ্জাও পেল। একপল মায়রার দিকে তাকিয়ে দ্রুত করে সরে গেল সেখান থেকে।
শিরিন বেগম দুই মেয়েকে রুমে দিয়ে গেলে। বিছানা ঝেড়ে গুছিয়ে দিয়ে বললেন,
“শিফু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড় তোরা। সকাল সকাল উঠতে হবে। গ্রামের বিয়েতে অনেক মজা হয়। দেখবি সকাল থেকেই মহিলাদের কেমন রসিকতা গান শুরু হবে।”
মায়রা আর শিফুর আরো কিছু লাগবে কিনা তা নিশ্চিত হয়েই তিনি বের হলেন।
টুকটাক কথা বলতে বলতে মায়রা বিছানায় গেল। শিফুর ফোনে বারবার কল আসায় সে বলল,
“ভাবি তুমি একটু থাকো। আমি দুই মিনিটে আসছি।”
দরজা চাঁপিয়ে দিয়ে শিফু চলে যেতেই মায়রা আবার উঠল। রাতে লাইট অন থাকলে কিছুতেই তার ঘুম আসে না। ডিম লাইটের অল্প আলোতে ঘুমালে যেন স্বস্তি লাগে। ঘুমটাও ভালো হয় নির্বিঘ্নে। রুমে ডিম লাইট আছে দেখে সে উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে গিয়ে ডিম লাইট টা জ্বালাতেই রুমটায় আবছা আলো বিরাজ করল। এই লাইটের আলো ক্ষীণ। খুব বেশি দেখা যায় না কিছু। হাতড়ে বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে দরজা খুলার আওয়াজ হলো। শিফু এসেছে ভেবে মায়রা বলে উঠল,
“শিফু কষ্ট করে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে এসো।”
মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ২৪
কোনো জবাব এলো না। ঘাড় বাঁকিয়ে শিফুকে দেখার জন্যে পিছন ঘুরার আগেই মনে হলো একটা শক্তপোক্ত শরীর তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঝাপটে ধরেছে। মুহূর্তে সারা শরীরে এক শীতল ভয় ছুঁয়ে যেতেই কারো বাহুবন্ধনে কেঁপে উঠল তার সর্বাঙ্গ। চোখে মুখে এক ভীত আতঙ্কের ভাব গভীর ভাবে চেঁপে বসল। বাহুবন্ধন আরো প্রগাঢ় হতেই শঙ্কিত হৃদয় আঁতকে উঠল তার। ভয়ার্ত শরীরটা আস্তেআস্তে নিস্তেজ অসাড় হয়ে আসছে। শূন্য মস্তিষ্ক টা কোনো বার্তাই প্রদান করছে না। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করার শক্তি পাচ্ছে না নিষ্প্রভ ক্ষীণ শরীরটায়। তবুও অজানা এক ভয় গভীর আতঙ্ক তাকে জানান দিল কিছু একটা করতে হবে। অপ্রীতিকর ভাবে এই রাতে কে তাকে জড়িয়ে ধরবে? চিন্তায় সংশয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। কোনো রকম ঢোক গিলে কম্পিত কন্ঠে চিৎকার দিবে ওমনি একটা শক্ত কঠোর হাত চেঁপে ধরল তার মুখ।