মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ২৯

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ২৯
সাদিয়া

হলুদের অনুষ্ঠানে আশপাশ মজে আছে। বেশ আওয়াজ দিয়ে বক্স বাজচ্ছে। স্টেইজে ভিডিও ম্যান ভিডিও করছে। গ্রামের অনেক মানুষ এসেছে সিদ্দিক বাড়িতে অনুষ্ঠান দেখতে। আগাগোড়া সবটাতে শহুরে আর বিলাসিতা ভাব। তা তো আর মিস করা যায় না।

ইহামের মিশন ছিল বরিশালে। বেশ সেনসিটিভ ইস্যু। তবুও কোনো ভাবে CO এর সাথে একটা বুঝাপড়া করে নেয়। অন্য একটা টিম কে বরিশাল পাঠিয়ে দিয়ে সে আসে ফেণী তে। গোপন সূত্রে জেনেছিল ফেণীর মিশনটা যতটা হাল্কা বা ছোট করে দেখছে উপরমহল এটা ঠিক ততটা না। বেশ গাঢ় একটা বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। তাই তো ইবরাহিম, সারজিদ, বৌলহাস, মইনুল আর কিবরা কে নিয়ে এসেছে এখানে। ওরা আপাদত একটা হোটেলে উঠেছিল। ভেবেছিল আজকের মাঝেই মিশন কমপ্লিট হবে সেই হিসেবে সব কাজও শেষ হয়েছিল তবে আসার পথে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত আক্রমণের স্বীকার হয়ে দুর্দান্ত খবর শুনে এসেছে। সেই আক্রমণে বৌলহাস কে বাঁচাতে গিয়েই তার হাতে ছু’ড়ির আঘাতটা লেগে যায়। বান্দরবনের মিশনে বেচারা হাতে গুলি খাওয়ার বিষয়টা বিবেচনা করে নিজের ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করেনি ইহাম।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মায়রা হাতে বক্স নিয়ে এসে দেখে লোকটাকে যেভাবে বসে থাকতে দেখে গিয়েছিল ঠিক একই ভাবে এখনো বসে আছে। আশ্চর্য হলো মায়রা। কপাল কিঞ্চিৎও করল খানিক। এই লোক কি নড়াচড়াও করেনি খানিক? সে যে ঘরে এলো এটা কি মানুষটা বুঝতে পারছে? কোনো সাড়াশব্দও তো দিচ্ছে না। আজব পাথরটাথর হলো নাকি? মায়রা গলা কাশল। তবুও কোনো হেলদোল হলো না ইহামের মাঝে। সে তখনো বিছানার উপর বসে হাটুতে দুই হাত ভর দিয়ে মাথাটা ঝুঁকিয়ে রেখেছে নিচের দিকে। মায়রার ভালো লাগল না। বিরক্ত হয়েই আরো এগিয়ে গেল। “দেখি হাতটা দিন” বলে সে বিছানায় বসল। ইহাম কে কোনো শব্দ টব্দ কিংবা নড়তে না দেখে গলার আওয়াজ বাড়াল মায়রা।

“কি হলো হাতটা দিন।”
এবার ইহাম মাথা তুলে তাকালো। চোখে মুখের ভাব কেমন বিষাদ গম্ভীর। শান্ত ধারালো কন্ঠে বলল,
“এটা রেখো তুমি অনুষ্ঠানে যাও। আমি করে নিব।”
মায়রা তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল ইহামের দিকে। দৃষ্টি তার স্থির। সে সেভাবে তাকিয়েই ইহামের হাতটা এগিয়ে আনল নিজের দিকে। ইহাম চকিতে তাকিয়েছে মায়রার দিক। মেয়েটা তখন আলতো হাতে ভিজে তুলো দিয়ে শুকনো রক্ত পরিষ্কার করছে। মুখের এক্সপ্রেশন দেখে মনে হচ্ছে ব্যথাটা তার নিজের হাতে লেগেছে।
“মায়রা এত দুঃখি হওয়ার কিছু নেই। খুব বেশি কাটেনি।”

“একদম কথা বলবেন না আপনি। দেখছি হাতের কাটাটা গভীর তবুও বলছেন কিছু হয়নি বেশি কাটেনি। মানুষ থেকে কি গণ্ডারে পরিণত হয়েছেন নাকি? যে ব্যথাট্যথা গায়ে লাগে না?”
পানি ভর্তি চোখ নিয়ে মায়রার উচ্চস্বরে বলা কথা গুলি শুনে হাসি পেল ইহামের। তবে ঠোঁট প্রসারিত করে সেটা প্রকাশ না করে বরং গম্ভীর আওয়াজ তুলল।
“বেয়াদবের মতো কথা বলছো কেন?”
“আপনার কাছে কি আমি এই জীবনে আদবী হতে পারব? কারো কিছুই বুঝেন না আপনি অথচ মূর্খ গবেট বলে ডাকেন আমায়। কারো ভেতরের অনুভূতি কিছুই কি বুঝতে চান না আপনি?”

ইহাম শান্ত হলো। নির্মল দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল মেয়েটা নাক টেনে টেনে কেঁদে যত্ন করে তার হাত পরিষ্কার করছে। ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে কপালে আসা চুল গুলি কানের পিছনে খুঁজে দিল।
“ছুঁবেন না। আপনার ছোঁয়ার দরকার নেই। আপনার আধভাঙ্গা জীবনে থাকার দরকার নেই আমার। যে খানে আপনি আপনার জীবনের নিশ্চয়তা দিতে পারেন না। সেখানে আপনার সাথে থেকে আমি কষ্ট পাবো নাকি? আর থাকব না আপনার সাথে।”

“একদম জানে মে’রে ফেলব মায়রা এমন ধরনের কথা বললে।”
মায়রা লাল চোখ নিয়ে ইহামের দিকে তাকায়। খুব কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছে। কাটা হাতটা দেখলেই ফুঁপাতে মন চাইছে। ভেতরটা জ্বলছে।
“মা’রামা’রিই তো আপনার কাজ। নিজে মরবেন মানুষকে মা’রবেন এটাই তো আপনার দায়িত্ব।”
চটে গিয়ে ইহাম মায়রার উন্মুক্ত চুলের পিছনে আঙ্গুল গুঁজে দিয়ে মায়রাকে টেনে আনল নিজের খুব কাছে। কপালে কপাল ঠেকিয়ে দিয়ে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে। বিড়বিড় করে বলে,

“এত কথা শুনতে চাই না আমি। আর কখনো সব কথা বলবে না। শুধু এতটুকই জানি।”
মায়রা আবেগি হয়ে আরো জোরে কাঁদে। চোখ বন্ধ করে নিজের ধড়ফড় বুকের কষ্ট নিয়ে ফুঁপায়।
“এই মেয়ে তোমায় মে’রেছি? তবে এত কান্না করছো কোন?”
কান্নার কারণে জবাব দেয় না মায়রা। দাঁত চেঁপে ইহাম বলে উঠে,
“ঠিক আছে একা ঘরে কাঁদো তবে যাচ্ছি আমি।”

ইহাম উঠতে চাইলে মায়রা তার হাত টেনে ধরে। শরীরের ক্ষীণ শক্তি দিয়ে। তার এতটুক শক্তি বসাতে পারে না দৃঢ় ইহাম কে। সে থাম্বার মতোই দাঁড়িয়ে আছে। মাথা খানিক নুয়িয়ে দেখে চলছে মায়রাকে। মায়রা মাথা উঁচু করে তাকায় ইহামের চোখের দিকে। মেয়েটার অভিমান বুঝে ফোঁস করে দম ছেড়ে ইহাম নিজের কাটা বা হাতের তর্জনী আর মধ্যমা আঙ্গুল উঁচু করল। সেটা বাড়িয়ে দিয়ে মায়রার চোখের পানি মুছে চুপচাপ নিচে বসল। এক পা ভাঁজ করে আরেক পা লম্বা করে ফ্লোর লেপ্টে রেখে বসল। যেন নীচে ক্লান্ত ভঙ্গিতে ছেড়ে দিয়েছে পা। মায়রা তখনো বিছানার উপরে বসা। ইহামের দিকে করুন অভিমানী হয়ে তাকিয়ে থাকে। ইহাম নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে মায়রার কোলে মেলে ধরে নিজের কাটা হাত। ইশারায় হাত দিয়ে বুঝায় কি করার দরকার তা যেন করে।

মায়রা রক্ত দেখতে পারে না। তবুও ইহামের হাতের রক্ত মুছে দিচ্ছে বহু কষ্টে। বুক থরথর করছে তার। চোখ দিয়ে তখনো টিপটিপ বৃষ্টি ঝড়ছে। মনে পড়ছে সেদিন বান্দরবন যখন ইহাম নিজের হাত নিজে ড্রেসিং করছিল তখন তাকে সাহায্য করতে বলায় কি অকপটে বারণ করেছিল সে। অথচ আজ এই হাত দেখে তার শরীর কাঁপলেও লোকটার অপ্রকাশিত ব্যথা তার অন্তরে আঘাত করছে। ইহাম কেমন গম্ভীর রাশভারী কন্ঠে বলে উঠল,
“আর একটুও যদি কান্না করো তবে ঘর ছেড়ে বের হয়ে যাবো মায়রা। এবার বিরক্ত লাগছে তোমার কান্না। অভদ্রের মতো কান্না করো না।”

ইহামের নিষেধাজ্ঞা খুব সুখকর হলো না মায়রার জন্যে। নিঃশব্দেই সে চোখের ধারা বিসর্জন দিতে ব্যস্ত। বারবার নাক টানছে সে। কান্না চেয়েও আটকাতে পারছে না। ইহাম দেখল মায়রার কান্না থামানোর প্রচেষ্টা। মেয়েটা যে কান্না থামাতে পারছে না তা সে বেশ বুঝতে পারছে।
মলম লাগিয়ে মায়রা হাতে একটা ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে দিয়েছে। মেয়েটার চোখ দিয়ে এখনো থেমে থেমে পানি পড়ছে। ব্যান্ডেজের গিট দেওয়া শেষ হতেই ইহাম দুই হাত দিয়ে মায়রার কোমর পেঁচিয়ে নিল। কোমরের দুই পাশে আলতো হাতে মায়রারকে আরেকটু টেনে আনল নিজের দিকে। ইহাম তখনো নিচে বসে আছে। নিজের শরীরটা আরেকটু মায়রার সাথে মিশিয়ে শীতল কন্ঠে বলল,

“রাগ করেছো?”
মায়রা জবাব দেয় না। মুখ ফিরিয়ে নেয় অন্যদিকে। ইহাম ম্লান হাসল। মায়রার চিবুকে তর্জনী আঙ্গুল ঠেকিয়ে মুখ ফিরায় তার দিকে। কন্দনরত মেয়ের দৃষ্টি তখনো অন্যদিকে। এবার শক্ত গলায় ইহাম বলে,
“বেয়াদব মেয়ে। আমার দিকে তাকাও।”
মায়রা তৎক্ষণাৎ ইহামের দিকে তাকায়। শান্ত স্নিগ্ধ সেই চাউনি। ইহাম ধ্যান ধরে তা দেখে।
“জানেনই আমি বেয়াদব অভদ্র তবে এভাবে বারবার বলতে কেন হবে? ডাকছেন, তাকাবো না জানেন। তবুও সেই আশা করছেন কেন? আমি না অভদ্র বেয়াদব?”
এক গালে হেসে উঠে ইহাম। মায়রা দেখেও চোখ ফিরিয়ে নেয়। তার ভেতর এখনো জ্বলছে সাথে রাগও হচ্ছে।
“দেখেছো কত বেয়াদবের মতো তর্ক করছো?”
“দুর। সরুন তো আমিই চলে যাচ্ছি।”

মায়রা উঠতে চাইলেও পারে না। কারণ তার পায়ের কাছটায় ইহাম শক্ত ভাবে বসে আছে। একটু নড়তেই তার কোমরের কাছে ইহামের হাতের বাঁধন আরো দৃঢ় হয়। সঙ্গে সঙ্গে জমে যায় মায়রা। নড়াচড়া বন্ধ করে চুপটি করে থাকে। ইহাম মায়রার কোলে মাথা রাখল। মেয়েটা কেঁপে উঠল। তার এই স্বল্প কম্পন অনুভব করল ইহাম। নিগূঢ় হেসে কোমল কন্ঠে বলল,
“তোমার কিছু বলার থাকলে আমায় বলতে পারো মায়রা। আমি শুনছি। কিন্তু এর পরে আর আমার এই বিষয় নিয়ে তুমি কিন্তু কিছু বলতে পারবে না। তখন কিন্তু সেটা ভালো হবে না।”
মায়রা কে চুপ থাকতে দেখে ইহাম ঘাড় উঁচু করে তাকাল ওর মুখের দিকে। মেয়েটার মন মরা মুখ দেখে থুতনি রাখল কোলে। উরুপিণ্ডে শক্ত চোয়াল স্পৃষ্ট হতেই সারাশরীর শিউড়ে উঠল মায়রার। শিরশিরে শিহরণ তাকে ছটফটে করে দিলো।

“এই মায়রা তাকাও না এদিকে।”
অতি কোমল কন্ঠ পেয়ে ধীরে তাকায় মায়রা। মোলায়েম দৃষ্টি পেয়ে নির্বিঘ্নে বলে উঠল,
“আমি মায়ের কথায় সমর্থন করি।”
ইহাম হেসে উঠল মায়রার ঘোরপ্যাঁচ কথায়। মেয়েটা হয়তো ম্যাচিয়োডের ধাপে আছে। কিভাবে ইঙ্গিত দিয়ে বলে ফেলল। মায়রার কথার ইঙ্গিত বুঝতে কষ্ট কিংবা সময় কিছুই ব্যয় হলো না ইহামের। তবুও মৃদু কন্ঠে সরল ভাবে বলল,
“তুমি কি বলতে চাও তা সরাসরি বলো মায়রা।”
“আপনার জীবন নিয়ে আমরা সবাই চিন্তায় থাকি। আপনায় নিয়ে সবসময় আপনার পরিবার ভয়ে থাকে সেটা আপনি বুঝেন?”

“তুমিও ভয় পাও?”
“না পাওয়ার কি পেলেন আপনি? ভালো লাগছে না আমার আপনার এই হেয়ালি। সরুন আমি চলে যাই।”
“উঁহু। বললেই হবে নাকি? আমাকে নিয়ে ভয় পাও কি না জানতে হবে না আমার?”
“যদি বলি পাই তবে কাজটা ছেড়ে দিবেন আপনি?”
ইহামকে চুপ থাকতে দেখে আগ্রহ হলো মায়রার। আরো কৌতূহলী হয়ে নরম কন্ঠে জিজ্ঞাস করল,
“কি হলো বলছেন না যে? আপনি আপনার জবটা ছাড়বেন তো তবে?”
ইহাম মায়রার প্রশ্নের উত্তর দিল না। বিচলিতও হলো না। শান্ত স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন করল,

“আমার চাকরি নিয়ে তোমার সমস্যাটা কোথায় বলো তো মায়রা।”
“এটা আমার প্রশ্নের জবাব না ক্যাপ্টেন সাহেব।”
“তোমার প্রশ্নের উত্তর তুমি পেয়ে যাবে। আগে আমার উত্তর দাও।”
মায়রা নির্বাক হয়ে ঘাড় নিচু করে তাকিয়ে আছে ফ্লোরে বসা ইহামের দিকে। লোকটা প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। দুই বাহু এখনো তার কোমর আগলে রেখেছে।

“কি হলো উত্তর দাও।”
“আপনাকে নিয়ে।”
“আমার লাইফ রিস্ক নিয়ে তাই তো?”
মায়রা জবাব দিল না। গম্ভীর মুখে ইশারায় সমর্থন জানাল।
“তখন তুমি বললে জীবনের নিশ্চয়তার কথা। তুমি তোমার জীবনের নিশ্চয়তা দিতে পারবে? কিংবা অন্য কেউ?”
নিরুত্তর রয় মায়রা। তার যা বুঝার বুঝে গিয়েছে সে। এই লোক এখন তাকে যুক্তি দিবে। নীতি কথা বলে বুঝিয়েও ফেলবে। যুক্তি দেখাতে এই লোক ভালো পারে কিনা! মানুষকে বুঝিয়ে ফেলতেও খুব ভালো সক্ষম এই ধূর্ত প্রকৃতির লোকটা। মায়রা নাকোচ করে উঠতে চাইলেই জোর হাতে ইহাম তার কোমর ঠেঁসে ধরল বিছানার সাথে। কঠিন গলায় শাসিয়ে জানাল,

“এই বেয়াদব মেয়ে আমি কথা বলছি দেখছো না? তোমার কি মনে হচ্ছে আমি আউলফাউল কথা বলছি তোমাকে? আম সিরিয়াস মাথামোটা। চুপ করে বসে কথা শুনো।”
মায়রা থমথমে মুখ নিয়ে বসে থাকে। ইহামের চোখের দিকে আর তাকায় না। কড়া গলায় বলে উঠে ইহাম,
“এক সেকেন্ডের জন্যেও যদি চোখ ফিরিয়েছো না তবে তোমায় আমি কঠিন থেকে কঠিন শাস্তি দিব বেয়াদব মেয়ে। এদিকে তাকাও।”
মায়রা বাধ্য মেয়ের মতো নিভৃতে তাকায় এদিকে। ইহাম তার ক্রোরে আলতো ঠোঁট বুলায়। শান্ত শীতল কন্ঠে জানায়,

“এক জীবন মানুষের কোনো নিশ্চয়তা নেই। তুমি আমি কেউই নিজের জীবনের নিশ্চয়তা দিতে পারব না। তাই বলে এই তুচ্ছ কারণে জব ছাড়তে বলাটা উদ্ধতপূর্ণ আচারণ। সেটা তুমি হোও কিংবা আমার মা। আমরা ডিফেন্সের একেকটা সৈনিক মরণের ভয় ট্রেনিং এই ছুড়ে ফেলেছি। আমাদের ভেতরে যা আছে তা সবটাই দেশাত্মবোধ, স্বদেশের প্রতিটা নাগরিকের নিরাপত্তা, দেশের যাবতীয় সব কিছু রক্ষার অঙ্গীকার। আমরা বোধহয় পরিবারের থেকে আমাদের দায়িত্ব কে বেশি সময় দেই। কিন্তু সেটাও তো আমাদের পরিবারের জন্যই। এটাও আমাদের পরিবারের অংশ। একটু ভাবো তো মায়রা আমাদের কারণে তোমরা, তোমরা সবাই প্রতিটা মানুষ যদি নিরাপত্তা পায়, শান্তিতে জীবনযাপন করতে পারে। নিজেদের পরিবার নিয়ে সুখে থাকতে পারে নির্বিঘ্নে, যদি বুকের ভেতর থাকে দেশ দেশের নাগরিকের প্রতি ভালোবাসা কিংবা নিজের প্রতিই সম্মান। তবে এইটাই কেন নয়? আমি আমার জবে প্রশান্তি পাই, আমার আনন্দ থাকে আমার প্রতিটি কাজে প্রতিটি দায়িত্বে। মানুষকে একদিন না একদিন তো মরতেই হবে। তবে সেটা সম্মান কিংবা গৌরবেরই বা কেন নয়? আমি আমার কাজ নিয়ে অহংকার বোধ করি, তৃপ্তি পাই। নিজেকে এই আনন্দময় কাজে নিয়োজিত রেখে আমার নিজের প্রতি নিজের সম্মান শ্রদ্ধা হয়। আমি মরতে চাই বীরের সাথে। যেখানে মিশে থাকবে আমার সম্মান আমার গৌরব।”

মায়রা নিস্তব্ধের মতো বসে আছে। এই লোকটার ভেতরে যা আছে তা যেন কেবলই অপরিবর্তনীয় এক কঠিন সিদ্ধান্ত। যেন নিজের পরিবারের সঙ্গে একাকার করে নিয়েছে দেশকে। ডিফেন্সের মানুষ গুলি এমন হয় কেন? নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন থেকে তাদের মূল্য যেন তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব। মায়রার এই কাজ নিয়ে কোনো অমত কিংবা দ্বিধা নেই। কিন্তু তবুও ইহামের লাইফ রিস্কের বিষয়টা তার মনের খচখচে জায়গা। ইহামের এত বোঝ এত কথা শুনে বুঝেও যেন সে শুনতে পারছে না বুঝতে পারছে না। কিন্তু বেশ উপলব্ধি করতে পারছে এই মানুষটাকে।

ইহাম নিজের দুই হাত কোমর থেকে সরিয়ে আনল। মায়রা তখনো তার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে। ইহাম আলতো করে নিজের হাতের মুঠোয় ওর হাত দুটি পুরে নেয়। নরম মোলায়েম গলায় বলে,
“মায়রা তুমি আমার স্ত্রী আমার অর্ধাঙ্গিনী। আমার ভালো লাগা খারাপ লাগার গুরুত্ব অবশ্যই তোমার কাছে থাকা উচিৎ। আমার কথায় হয়তো তুমি বুঝতে পারছো আমার ভেতরের কথা গুলি। বিস্তারিত বলার প্রয়োজন বোধ করছি না আমি। আমি আশা করব এর পর আর কখনো অন্তত এই বিষয়টা নিয়ে আমাদের মাঝে ঝামেলা না হোক। একজন ক্যাপ্টেনের স্ত্রী হিসেবে তোমার উচিৎ নিজেকে শক্ত করা। হতে পারে তুমি বয়সে এখনো ছোট কিন্তু আস্তেআস্তে এই অনুভব গুলি তোমায় বৃদ্ধি করতে হবে। আমার জন্যে নিজেকে সবসময় তুমি গর্ববোধ করবে কখনোই চোখের পানি নয়। এবং কি আমার দায়িত্বে থাকাকালীন কিছু হলে তুমি কান্না না করে মনে মনে একজন বীর শহীদের স্ত্রী হিসেবে সবসময় গৌরবে মাথা উঁচু রাখবে।”

ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল মায়রা। ইহামের কথার গভীরতা অনুভব করল সে। তবুও মন যে আশংকায় ডুবে আছে। বুকটা চিপে আছে হারানোর শঙ্কায়।
ইহাম চটজলদি বিছানায় উঠে বসে। কানের নিচে পুরু হাত গলিয়ে দেয়। বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে গালে আলতো ভাবে বুলায়। ত্রাসে বলে,
“শরীর খারাপ হবে মায়রা। প্লিজ আর কেঁদো না। এত নরম হলে কিভাবে চলবে? তুমি কি বুঝতে পারছো না আমার কথার মানে গুলি?”
মায়রা পেশীবহুল বাহুতে খামছে ধরে। ও অবস্থা তেই অধৈর্য হয়ে বলে,
“আমি আপনার সব কথা বুঝতে পারছি ক্যাপ্টেন সাহেব তবে আমার মন মানতে চাইছে না কেন বলুন তো? আমার ভেতরটা কে কি ভাবে বুঝাব আমি?”

ইহাম চট করে মায়রা কে নিজের বুকের সাথে চেঁপে ধরল। একটু সময় নিল। মায়রা তখনো একটু একটু করে ফুঁপাচ্ছে। আরেকটু সময় দেওয়ার পর মেয়েটার ফুঁপানো বন্ধ হলে দৃঢ় গলায় জানায় ইহাম।
“মায়রা এখন অবুঝের মতো করছো তুমি। এমন করলে আমি কঠোর হতে বাধ্য হবো। প্লিজ শান্ত হোও। দেখো তুমি যেমন তোমার প্রিয়জনদের নিয়ে চিন্তায় থাকো। বাকিরাও তো থাকে তাই না? সবাই সবার কাছের মানুষদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তায় থাকে। এটা স্বাভাবিক। আমরা আছি এই জন্যেই। তোমাদের নিরাপত্তার জন্যে আমরা আছি। তোমাদের অরাজকতা, যুদ্ধ সন্ত্রা’সবাদ থেকে শান্তিপূর্ণ জীবনের সুযোগ করে দিতে আমরা আছি। তোমার মতো যারা নিজেদের পরিবার নিয়ে চিন্তিত থাকে দুষ্কৃতদের ভয়ে তটস্থ থাকে আমরা কেবল সেগুলি কে অপসারণ করে তোমাদের সকল কে নির্বিঘ্নে জীবনযাপনের সুযোগ করে দেই। আর কিভাবে বুঝালে তুমি বুঝবে? দেশের একজন নাগরিক হিসেবে অন্যান্য নাগরিকদের প্রতিও আমার একটা দায়িত্ব আছে। আমার দায়িত্ব কে তুমি সম্মান দিবে। আমার অর্জন নিয়ে তুমি গর্ববোধ করবে। বোকার মতো অযথা চিন্তা করে কান্না করবে তো মার খাবে আমার হাতে। আল্লাহ যখন যার মৃত্যু যেভাবে রেখেছে সেভাবেই হবে। এটা নিয়ে আর কখনো মাথা ঘামাবে না। বরং সবসময় আমার অর্জন হাসি মুখে মেনে নিবে।”

উষ্ণ বুকের গহ্বরে মায়রা তলিয়ে গেল। নিজের মন কে শক্তও করার চেষ্টা করল। এই মুহূর্তে চেয়েও হয়তো খুব কার্যকর হচ্ছে না তা। তবে ইহামের কথার তাৎপর্য আছে। গভীরতাও স্পষ্ট সজীব। অনেক কিছু নিজনিজ মনে ভেবে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করল মায়রা। তাকে চুপটি করতে দেখেই ইহাম বোধহয় বুক থেকে আলগা করল। মুখোমুখি বসিয়ে বলল,
“আমি থাকতে তোমার কিছু হবে না। তোমার কিছু হতে দিবো না। তোমার নিরাপত্তা তোমার সেফটির দায়িত্ব আমার। একটা আঁচড়ও লাগতে দিবো না। এই ভরসাটা টুক রাখো। আর আমাদের পক্ষ থেকে এই ভরসাটুক সবার কাছে পৌঁছে দিতেই আমাদের যত যা কাজ যা দায়িত্ব। নিজেকে দূর্বল না করে একজন সাহসী সৈনিকের বউ হিসেবে নিজেকেও শক্ত কঠিন করো মায়রা।”

মায়রা জবাব দেয় না। কেমন নিশ্চল ভঙ্গিতে বসে থাকে কেবল।
“নিজের ঢাকঢোল কি নিজেই পিটিয়ে ফেললাম মায়রা?”
আচানক কুঁচকানো মুখে বলা ইহামের এই কথা শুনে ফিক করে হেসে উঠল মায়রা। কান্নার কারণে চোখ গুলি ফুলে উঠেছে। চোখে পানি রেখেই হাসছে মেয়েটা। কি স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে তাকে। ইহাম এক ধ্যানে তাকিয়ে দেখল এই মেয়েটাকে। সে কিসের মায়ায় পড়ল এই মেয়ের? কিভাবে এক মুগ্ধকর মায়ার বাহুডোরে তাকে বেঁধে নিয়েছে মেয়েটা নিমিষে।
চোখে মুখে শীতল কন্ঠে ইহাম বলে উঠল,

“একটা স্ত্রীর সান্নিধ্য কি পুরুষকে অনেক খানি বদলে দিতে পারে মায়রা।”
তার কন্ঠে কেমন একটা মুগ্ধতা আচ্ছন্নতার ভাব ভেসে আসছে। মায়া মায়া দৃষ্টিতে মায়রা গাঢ় ভাবে অবলোকন করল ইহাম কে। এলোমেলো দৃষ্টিতে ইহামের চোখে মুখে ঘুরপাক খাচ্ছে তার নেত্রপল্লব।
“কি হয়েছে আপনার? বদলে গিয়েছেন মনে হয়?”
“ওই যে আমার প্রশ্নের মাঝে তোমার উত্তর লুকিয়ে আছে।”
“আপনি এভাবে কথা বলেন কেন? মনের কথা মুখে বললে কি ফোস্কা পড়বে?”
“সবসময় সব কথা বলতে হয় না। কিছু কথা কিছু অনুভূতি লুকায়িত রাখলেই সৌন্দর্য বাড়ে। সময় হোক বলব।”
ইহাম নিজের প্যাকেট থেকে রুমাল বের করল। ডান হাতটা এগিয়ে দিয়ে বলল “দেখি এদিকে তাকাও।” কেমন যত্ন করে মায়রার চোখের নিচের কাজল মুছে দিচ্ছে।

“আপনি কি এই কাজে এক্সপার্ট?”
মায়রার প্রশ্নে ইহাম তার চোখে চোখে তাকাল। মিষ্টি হেসে জবাব দিল,
“এক্সপার্ট না হলেও কখনো কখনো সুযোগে হয়ে যেতে হয়। আফটার ওল বউ বলে কথা।”
“কি জানি সত্যি বলেন নাকি মিথ্যে।”
চোখের নিচ মুছতে মুছতে ইহাম আবারও প্রশ্ন করল,
“নারীর স্পর্শ পুরুষকে বদলে দিতেও সক্ষম। তবে কি কথা সত্যি?”
“হুম। কারণ নারী চাইলে সব পারে।”
“কিন্তু তুমি তো পারো না।”

কপাল কুঁচকে নেয় মায়রা। ইহামের দিকে তার পূর্ণদৃষ্টি। ইহাম এবার সোজাসুজি বসে জবাব দেয় এক অনাকাঙ্ক্ষিত।
“তুমি তো আমার এক রাতের ডোজেই জ্বর বাধিয়ে শরীর কাহিল করে বসে থাকো।”
মুহূর্তে চটে যায় মায়রা। ক্ষীণ রাগ লজ্জা সংশয় মিলেমিশে একাকার হয়। হুট করে বুকের বা পাশে ধাক্কা দিয়ে উঠে ইহামের।

“আপনি অসভ্য অভদ্র একটা পুরুষ। সরুন আমার থেকে।”
মায়রা কে উঠতে না দিয়ে মিহি হেসে ইহাম তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। মাথায় হাত গলিয়ে দিয়ে টেনে আনে মায়রা কে। প্রগাঢ় ভাবে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দেয় মায়রার ললাটে।

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ২৮

আবেশে মেয়েটা চুপটি করে রয়। তার ভেতরের শিহরণ কে মন দিয়ে অনুভব করে। মিষ্টি একটা অনুভূতি তার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি হয়ে উদিত হয় অচিরে। অথচ সে ধারনাও করতে পারছে না কি ভয়ংকর একটা ঘটনা তার জন্যে ওত মেতে আছে হিংস্র জন্তুর ন্যায়।

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৩০