মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৩১
সাদিয়া
অম্বরে তখন নিশীথের কালো আঁধার। বিয়ে বাড়ির সাজসাজ রবে চারিদিক আলোকিত। ইহাম বোধহয় দুই একজনের সাথে আড্ডা দিচ্ছিল উঠানের এক কোণায়। হাতে তার মুজুর বোতল। খানিক বিনয়ের সাথেই কথা বলছিল ঠোঁট মেলে। এমন সময় থমথমে গম্ভীর মুখে এসে হাজির হয় মায়রা। কেমন ভারী প্রাণ হীন কন্ঠে ডেকে উঠল,
“শুনছেন?”
অদ্ভুত গলা শুনে আকস্মিক ভাবেই ইহাম ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল। হাসি মুখে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই থামল সে। মায়রার এমন নিরস ভারভার মুখশ্রী দেখে সচকিতে সে কুঁচকে নিল নিজের মুখাবয়ব। কি হলো মেয়েটার? চোখ মুখ এমন দেখাচ্ছে কেন? হাসিবুল্লাহ কি আবার কিছু করেছে? কিন্তু তার যতদূর মনে হয় হাসিবুল্লাহ এর পর আম্মাজান ডাক ছাড়া কাছে ঘেঁষবে না। তবে কি হয়েছে ওই কোমল তনুর? কেমন যেন বিরহ, অভিমান কিংবা রাগের অস্পষ্টতা প্রকাশ করছে। চিন্তা গুলি যেন তার চোখদ্বয় আরো সরু করে তুলছে। কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই মায়রা গাম্ভীর্য কন্ঠে বলে উঠে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আপনার সাথে আমার কথা আছে।”
পরিস্থিতি বিবেচনা না করেই ইহাম কেমন মৃদু আচ্ছাদিত কন্ঠে বলে,
“হ্যাঁ বলো কি বলবে?”
মায়রা কেবল শান্ত তীক্ষ্ণ চোখে আশপাশ টা দেখল। সবাই হয়তো খাওয়া কিংবা ফ্রেশ হওয়া নিয়ে ব্যস্ত বিয়ে বাড়িতে কাজ তো আর কম থাকে না। তাই হয়তো এদিকটায় মানুষজন একটু কম। তবে একে বারে যে নেই তা বলা যায় না। তবুও ভেতরের অস্থিরতায় মায়রা আর কাল বিলম্বন না করেই চেঁপে ধরল তার হাত। আশপাশের মানুষ কে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেই কেমন টেনে নিয়ে গেল ইহাম কে। মায়রার এহেন কাজে ইহাম নিজেও যেন চমকালো। হতবুদ্ধির মতো কেমন ভ্রুকুঞ্চন করে তাকিয়ে রইল মেয়েটার পানে।
মনে হচ্ছিল কেউ শিফুর বুকে বিষাক্ত একটা তীর বসিয়ে দিয়েছে। বুকের গহীন থেকে তখন অদৃশ্য তাজা র’ক্ত ঝড়ছে গলগলিয়ে। নিশ্বাসটা যেন কোথাও হুচট খেয়ে থমকে গিয়েছে। চোখের দৃষ্টি তখন অত্যধিক পরিমাণে ঝাপসা। নিথর দেহটা নিয়ে কেবল মাটিতে বসে আছে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে।
হাতের কয়েকটা কাজ করতে শিরিন বেগম ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন শিফুকে। সেই যে মায়রা কে ফোন দিতে এসে হারালো মেয়েটা। আর পেলেন না তার খুঁজ। বিরক্ত অভিমুখে তিনি বাহিরে এলেন। প্যান্ডেলের এ দিকটায় এসে শিফুকে মাটিতে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে দেখেই আঁতকে উঠলেন। কি রে মেয়ের হলো কি? এভাবে নিশ্বাস আটকে বসে আছে কেন? মায়ের কোমল মন বিরক্ত ভুলে গিয়ে ছটফটিয়ে গেলেন মেয়ের নিকটে। ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“কিরে মা কি হয়েছে তোর? এভাবে বসে আছিস কেন? কি হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে?”
নিস্তেজ শিফু কিছু জবাব দিতে পারল না। কেমন প্রাণ হীন নিম্প্রভ চোখে আস্তেধীরে তাকাল মায়ের দিকে। মায়ের আশংকা জনিত মুখটা দেখা মাত্র টপটপ করে চোখের পানি গুলি গড়িয়ে পড়ল। তপ্ত এক শ্বাস তার ভেতর ঘর জ্বালিয়ে পু’ড়িয়ে নিঃশেষ করে দিল। মেয়ের এই করুন দুর্দশা দেখে অন্তরআত্মা কেঁপে উঠলো শিরিন বেগমের। ইয়া আল্লাহ! মেয়ের এই হাল কেন? কেমন মরার মতো দেখাচ্ছে। যেন ভেতরে কোনো প্রাণবায়ু নেই।
“কিরে শিফু? আম্মা আমার কি হইছে তোর? শরীর খারাপ? কথা বলিস না কেন মা?”
“আ আম্মু? সব কিছু আমার দোষ? আমি দায়ী এসবের জন্যে?”
মেয়ের মুখে আদরের হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শঙ্কিত কন্ঠে শুধান,
“আম্মা আমার। তোমার কি হইছে? কি বলো তুমি? কিসের দোষের কথা বলছো?”
“আ আম্মু ভাবি বললো তু তুহিন ভাই নাকি হাসপাতালে।”
চমকালেন শিরিন বেগম। চিকন চাউনিতে চেয়ে রইলেন কয়েক পল। আধো ভাঙ্গা গলায় শিফু বলে,
“আম্মু সব কিছুর জন্যে আমি দো দোষী?”
মেয়ের মনের ভাব বুঝলেন শিরিন বেগম। চোখ আর মুখশ্রী মেয়ের মনের কথা স্পষ্ট তুলে ধরছেন উনার সম্মুখে। শিফুকে ভঙ্গুর অবস্থায় দেখে ভেতরে অজানা এক ভয়ও হলো উনার। দ্রুত বলে উঠেন,
“এ কোন ধরনের কথা মা? তুই কেন দোষী হবি? আর তুহিনেরই বা কি হয়েছে? নিজেকে কেন দোষী ভাবছিস তুই?”
“আমিই তো দোষী আম্মু। তুহিন ভাই কে তো আমিও কষ্ট দিয়েছি। আমার থেকেও তো সে ক কষ্ট পেয়েছে বলো। তাহলে আমি দোষী না কেন?”
তৎক্ষণাৎ কোনো এক সন্দেহে মেয়েকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিলেন তিনি। সন্দিহান কন্ঠে বললেন,
“না মা। তুই মুটেও দোষী না। তোর কোনো হাত নেই এতে। নিজেকে কেন দোষারোপ করবি তুই?”
“ভাবি ঠিক বলেছে আম্মু। আমার থেকেও তুহিন ভাই কষ্ট পেয়েছে। আমিও কষ্ট দিয়েছি উনায়। তাই হয়তো কিছু..”
“থাম তুই মা। আমি দেখছি তুহিনের কি হয়েছে। তোর ভাইয়ার সাথে কথা বলছি এটা নিয়ে। তুই চিন্তা করিস না মা। চল আমার সাথে।”
শিফু মায়ের বুক থেকে মাথা তুলল। গাল লেপ্টে চোখের পানিতে। ছিপছিপ করছে কপোল গুলি। ছলছল চোখ আর তাচ্ছিল্যের হাসি ঠোঁটে নিয়ে বলে উঠল,
“না আম্মু থাক। ভাইয়া কে আর শুধু শুধু বলতে হবে না। এই সংবাদ টা ভাইয়ার উপর খুব একটা প্রভাবও খাটাবে না। ভাইয়া খুব কঠিন মনের মানুষ আম্মু। তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হবে না। আর আমি ভাইয়া কে খুব ভালোবাসি।”
আর পিছু ফিরার সময়টুকও ঠায় দিল না শিফু। এক প্রকার দৌড়ে সে সেই জায়গা থেকে ঘরের দিকে ছুটল। কেমন নির্বাক বিমূঢ় হয়ে শিরিন বেগম তাকিয়ে রইলেন মেয়ের গমন পথে। হঠাৎ যেমন বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল শিফুর কথার গভীরতায়। মেয়েটা কি তুহিন কে খুব পছন্দ করে? নয়তো দিনকে দিন তার মেয়েটা এমন নির্জীব হচ্ছে কেন? শুধুমাত্র ভাইয়ের কথাতে কি সব মেনে নেওয়ার চেষ্টা করছে নাকি? ওর বয়স কম। আবেগি এই মুহূর্তে কষ্ট কিংবা নিজেকে দোষারোপ করে মেয়ে কিছু করে বসবে না তো? সর্বনাশ!
ঘরে ঢুকে মায়রা দরজা বন্ধ করতে পিছু ঘুরল। অবস্থা কি সেটা না জানলেও ভয়াবহ কিছু একটা হয়েছে তা ইহামের সচল মস্তিষ্ক আঁচ করতে পারছে। তবুও কেবল মজার ছলে বলে বসল,
“দরজা বন্ধ করছো কেন পিচ্চি মিসেস চৌধুরী? স্বামীকে মাতাল টাতাল করার ফন্দি এঁটেছো নাকি?”
হঠাৎ এই পরিস্থিতিতে ইহামের মুখে এই ধরনের কথা শুনে ফোঁসে উঠল যেন মেয়েটা। ইহামের সাধারণ এই কথাটা বুঝি অসম জেদ চেঁপে ধরা মেয়েটার আগুনে ঘী ঢালার কাজ করল। অগ্নিচক্ষু তে তাকিয়ে ছুটে গেল ইহামের কাছে। প্রবল বেগে বুকে একটা ধাক্কা দিয়েই ক্ষোভান্বিত কন্ঠে বলে উঠল,
“কি ভাবেন কি আপনি?”
আকস্মিক এই অতর্কিত আক্রমণ টা বুঝি ইহাম আশা করেনি। কেমন বাকরুদ্ধ ভাবে কিঞ্চিতে তাকিয়ে আছে মায়রার দিকে। তার অবাকের সীমানা ঠাউর করার আগেই মেয়েটা আবারও বুকের পাশে আরেক ধাক্কা বসাল। “কি মনে করেন কি আপনি নিজেকে?” মায়রার পরপর আক্রমণে এবার কয়েক পা পিছিয়ে গেল ইহাম। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে করা এমন ধরনের ব্যবহার আর কথা ইহামকে চিন্তিত করে দিচ্ছে। সেই সাথে শান্ত স্তব্ধতাও বিরাজ করছে তার মাঝে।
“কি হলো বলুন? নিজেকে কি হুকুমদাতা মনে করেন? যে আপনি যা বলবেন সবসময় সবাই কে তাই মেনে নিতে হবে? আপনি কি জমিদার বাদশা নাকি প্রেসিডেন্ট?”
মায়রার এই উদ্ধতপূর্ণ ব্যবহার যেন খানিক রুষ্ট করল দৃঢ় ব্যক্তিত্বের ইহাম কে। সংশিত কুঁচকানো নয়নে সে পরবর্তী ধাক্কাটা দেওয়ার জন্যে বাড়ানো মায়রার হাত দুটি চেঁপে ধরল নিজের শক্ত মুঠোয়। মেয়েটা ছটফট করে উঠল। আশঙ্কিত কন্ঠে শুধালো,
“কি হয়েছে মায়রা? এমন ব্যবহারের মানে কি?”
হাত ছাড়াতে চেয়ে কাঁদতে লাগল মেয়েটা। মাথায় কেবল ঘুরঘুর করছে ভাইয়ের বিষয়টা। কি হয়েছে তার ভাইয়ের? খারাপ কোনো কিছু? মা তো ঠিক ভাবে কিছু বলতেও পারল না ঝামেলার কারনে। মস্তিষ্ক কেবল ইঙ্গিত দিল ভাইয়ের যাই হোক সে তো জানে তার হাসিখুশি ছায়ার মতো মানুষটা কেবল কষ্ট পেয়েছে দিনদিন। শুধুমাত্র এই মানুষটার গোয়ার সিদ্ধান্তের কারণে। আগুন চোখে তাকিয়ে আবারও ফোঁসে উঠল মায়রা। শক্তি দিয়ে হাত ছাড়ানোর অভিপ্রায়ে বলে উঠল,
“ছাড়ুন আমার হাত ছাড়ুন আপনি।”
এবার ইহাম যেন একটু কঠোর হলো। কেমন শক্ত রুক্ষ গলায় বলে উঠল,
“মায়রা বাড়াবাড়ি করার একটা লিমিট আছে। অভদ্রের মতো আচারণ করছো কেন? সমস্যা কি তোমার?”
“আপনি আসলেই একটা পাষাণ মানুষ। কারো মন কারো কষ্ট কিছুই আপনার দেখার সময় নেই।”
“ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে না বলে কি বলতে চাইছো সরাসরি বলো। তোমার এসব ব্যবহার কিন্তু আমি বেশিক্ষণ সহ্য করব না।”
কথা শেষেই মৃদু শক্তিতে মায়রা কে দূরে ঠেলে দিল। মেয়েটা এবার চোখের পানি ফেলতে ফেলতে গলার আওয়াজ বাড়াল।
“আপনার জন্যেই আজকে আমার ভাইয়ের এই অবস্থা। আপনার জেদ আপনার রুক্ষতা আমার ভাইটাকে আজ হাসপাতালে নিয়ে শুয়িয়েছে।”
মায়রার অগোছালো কথায় চোখের পাতা আরো সরু হয়ে এলো ইহামের। ভ্রুকুঞ্চন করে সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মায়রার দিকে। তার এই কথা সে ঠিক ভাবে বুঝতেও পারল না। তবে সজাগ মস্তিষ্ক তাকে জানান দিচ্ছে তুহিনের কিছু একটা হয়েছে।
“যা বলার স্পষ্ট ভাবে বলো মায়রা। তোমার এই বেয়াদবি আচারণ কিন্তু আমার মেজাজ বিগড়ে দিচ্ছে।”
“তো? কি হয়েছে? কি করবেন আপনি? মারবেন আমায়? ধমকাবেন? বেয়াদব অসভ্য বলবেন? যা ইচ্ছা করুন কিন্তু সত্যি এটাই আপনি একটা পাষাণ হৃদয়ের মানুষ। আপনার দয়া মায়া বলতে কিছু নেই। আমার ভাইয়ের এই অবস্থার জন্যে কেবল আপনি দায়ী।”
“হ্যাঁ আমি পাষাণ মানুষ।” ক্ষিপ্রে ইহাম দুই পা এগিয়ে এসে খামছে ধরল মায়রার বাহু। নিজের আরেকটু নিকটে এনে দাঁতে দাঁত পিষল সে। “আমার মাঝে দয়ামায়া বলতে কিছু নেই? তো কি হয়েছে? তোমার কি তাতে? নিজের সীমার মাঝে থাকো মেয়ে। দুই দিন একটু নরম হয়েছি বলে ভেবে নিও না তোমার সব আচারণ আমি মেনে নিব। কাকে কতটুক দিতে হয় তা আমার ধারনায় আছে। সীমার বাহিরে গেলে মাথার উপর তুলে আছাড় মারতে সময় নিব না কিন্তু। আর তোমার ভাইয়ের কি হয়েছে সেটা আমি জানিও না তাহলে আমার উপর এই অযথা দোষারোপের অর্থ কি?”
“কারণ আপনার মতো পাষণ্ডের এক গেয়ে এক সিদ্ধান্ত ভাইয়া কে কষ্ট দিতে দিতে এই পর্যন্ত করেছে। আপনার আর আপনার বোনের জন্যে আমার ভাইয়া আজ হাসপাতালে। না জানি কষ্ট পেতে পেতে ভাইয়া কি করেছে নিজের। এর সব দায়ভার কেবল আপনার।”
“আমি তোমার ভাইয়ের অসুস্থের কারণ? কি ভাবে? মাথামোটার মতো এমন অবান্তর একটা কথা বলছো কি করে গর্দভ?”
মায়রা এবার নিজের সবটুক দিয়ে ধাক্কা মেরে ইহাম কে দূরে সরালো। চেঁচিয়ে বলে উঠল,
“আপনারই তো দোষ। ভাইয়া বলেছিল না শিফুকে পছন্দ করে ভাইয়া? তারপরেও কেন মেনে নিলেন না? এর কারণেই তো ভাইয়া দিনের পর দিন কষ্ট পেতে পেতে একদম পু’ড়ে গিয়েছে হয়তো। আপনার না হয় আমার ভাই কে চোখে পড়ে না কিন্তু নিজের বোনকেও কি দেখেন না? শিফুর কষ্টও কি চোখে লাগে না আপনার? মেয়েটাও যে ভাইয়াকে পছন্দ করে তার কোনো দাম নেই আপনার কাছে? শিফুও যে একা একা দুঃখে দুঃখে কষ্ট পাচ্ছে তার কোনো মূল্য নেই?”
ইহাম আর ধৈর্য রাখতে পারছে না। ক্ষোভ নিয়ে চিবিয়ে বলে,
“শিফু কষ্ট পাচ্ছে সেটা তোমাকে ও বলেছে? সব নিজের মতো বুঝে নাও কেমন করে বেয়াদব মেয়ে?”
“বাহ! আপনি তো দেখছি পানির মতো কোমল হৃদয়ের মানুষ। আপনার দয়ার কোনো শেষ নেই। অপার দয়া আপনার। আপন ভাই হয়েও শিফুর না বলা কষ্ট বুঝতে পারেন না তাই না? একবার তাকিয়েও দেখেন না বোনের দিকে? এই আবার তার জীবনের সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন আপনি?”
মায়রার খোঁচাটা বুঝি লাগল ইহামের গায়ে। চোখ বন্ধ করে হজম করেও নিয়েছে সে। মৃদু আওয়াজে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলে,
“শিফু এখনো ছোট। ওর আবেগের বয়স। কিছুদিনের এই কষ্ট কিছুদিন পরেই ভুলে যাবে সে। তোমার তাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। ফারদার শিফু কে নিয়ে কিছু বলবে না। আর ওর আশেপাশে গিয়েও এমন ধরনের উসকানি মূলক কথা বলবে না কিন্তু মায়রা।”
“ওকে উসকে দিতে হয় না। ও বাচ্চা নয়। বয়সটা একটু কম। নিজের ভালোলাগা মন্দ লাগা সব বুঝে ও। তাই নীরবে কষ্ট পায়। সে গুলি আপনার চোখে পড়ে না?”
রাগে ফোঁসফোঁস করতে লাগল ইহাম। দাঁতে দাঁত চেঁপে দাঁড়িয়ে রইল কেবল। চোখের দৃষ্টি ধারলো। যেন আগুন নির্গত হচ্ছে তা থেকে।
“শিফুর সাথে ভাইয়ার আকদ টা হয়ে থাকলে কি হতো? খুব ক্ষতি হতো?”
“হ্যাঁ হতো। তোমাদের মতো গোবর মাথা নিয়ে বিষয়টা চিন্তা করিনি আমি। বিচক্ষণতার সাথেই সবটা ভেবেছি। বাস্তব জীবনটা তোমার ধারনার মতো সংকীর্ণ নয়। যেটা বুঝো না মূর্খের মতো সেটা নিয়ে তর্ক করো না।”
“নিজেকে কি ভাবেন আপনি? খুব বিচক্ষণ মানুষ? আপনি সবসময় ঠিক? সবাই ভুল? আর কারো কিছুর যায় আসে না আপনার কাছে?”
“না। আর কিছু যায় আসে না। আসবেও না। বলদের মতো যেটা বুঝো না সেটা নিয়ে একদম কথা বলবে না বলে দিচ্ছি। নিজের সীমার মাঝে থাকো।”
“পারব না। আমি পারব না আপনার কথা মতো থাকতে। আপনি হুকুম করবেন আর সবাই সেটা মেনে নিবে?”
এবার মেজাজ একদম চটে গিয়েছে ইহামের। এমনিতে আজকে মেজাজের পারদ খিটখিট করছে তারউপর মায়রার এই অসভ্য আচারণ তার মস্তিষ্কের নিউরনে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। আচমকা হিংস্র বাঘের মতো এগিয়ে গেল মায়রার কাছে। বেসামাল ক্ষোভ নিয়ে ক্ষিপ্রে চেঁপে ধরল মায়রার কোমল গাল। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
“সবাই না মানলেও তুই মেনে নিবি। কারণ তুই মানতে বাধ্য। ভুলে যাস না তুই আমার অধীনে। আর অকারণে রাগ দেখানো বন্ধ কর মেয়ে। তোর এই ফা’কিং রাগ দেখার সময় নেই আমার।”
কষ্টে অন্তরটা জ্বলে উঠল মায়রার। চোখ ফেটে আরো বেগে কান্না এলো। সেই সাথে বাড়ল তার অযাচিত ক্রোধ আর ক্ষোভ। রি রি করতে করতে অনবরত চাপড় দিতে লাগল ইহামের হাতে। দাঁত খিঁচে বলে,
“ছাড়ুন আমাকে। আপনি আসলেই একটা অমানুষ।”
“ভুলে যাস না এই অমানুষটার বউই তুই।”
মায়রা জবাব দিল না। লাল হিংস্র চোখে ইহাম ভালো ভাবে খেয়াল করল মায়রা চোখ মুদে ফুঁপাচ্ছে। গাল বেয়ে পানির দানা গড়াতে গড়াতে তার হাত স্পর্শ করতেই কেমন স্থির হলো ইহাম। চোখের দৃষ্টিটা একটু শিথিল করে আনল। নয়নের গোপনে লুকিয়ে থাকা অগ্নি ভাবটা কেমন নিভুনিভু হলো। গাঢ় ভাবে তাকালো মেয়েটার মুখশ্রীর দিকে। ললাট কুঁচকানো, ভ্রুদ্বয় আর চোখের মাঝে সরু ভাব। ঠোঁট গুলি কেমন উল্টে দিচ্ছে। গাল বেয়ে গড়াচ্ছে স্বচ্ছ পানি। মেয়েটাকে কি বেশি জোরে চেঁপে ধরেছে? খুব ব্যথা পেয়েছে সে? আরেকটু ফুঁপিয়ে উঠতেই ইহাম হাতটা ছেড়ে দিল। দুই কদম এগিয়ে গিয়ে উল্টো পথে দাঁড়ালো সে। সব কিছুতে কেমন বিরক্ত আর বিতৃষ্ণা ভাব লাগছে। ভেতরে রাগ টগবগ করে ফুটছে। দাঁত চিবিয়ে চোখ বুঝে ক্রোধ দমনের অভিপ্রায়।
ঘূর্ণিঝড়ের মতো রাগের তোপে যখন সে উর্ধ্ব বেগে শ্বাস টানছে তখন দরজার ওপাড়ে শিরিন বেগমের ডাক শুনা গেল। কোপের অনলে দাউদাউ করতে করতে ইহাম দরজা খুলে দিল। হন্তদন্ত হয়ে তখনি ঘরে ঢুকলেন শিরিন বেগম। খানিক অস্থির হয়ে বললেন,
“বাবা আমার শিফু…”
এইটুক কথাতেই কপাল আরো কুঁচকে এলো ইহামের। মেজাজ এমনিতেই চড়া। সব কিছুতে কেমন বিরক্তের ছাপ অনুভব করছে। কর্কশ কন্ঠে শুধালো,
“কি হয়েছে শিফুর?”
“বাবা রে শিফু মনে হয় তুহিনের জন্যে কষ্ট পাচ্ছে। তুই একটু বিষয়টা আরেকবার ভেবে দেখনা।”
মেজাজ এবার বুঝি সপ্তম আকাশে পৌঁছেছে। রাগ দমন করতে না পেরে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে অগ্নিদৃষ্টিতে একপাল ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল মায়রার দিকে। মেয়েটা এখনো নীরবে কাঁদছে। তা যেন আরো জ্বালিয়ে তুলল তাকে। তিরিক্ষি আওয়াজ তুলে জানাল,
“আমি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তার একচুলও এদিক ওদিক হবে না। তাতে কেউ কষ্ট পাক আর না মরে যাক তাতে কিছু যায় আসে না আমার।”
শেষের কথাটা মায়রার দিকে তাকিয়ে বলেই হনহন করে ঘর ছাড়ল ইহাম। না মায়ের কথা শুনার প্রয়োজন বোধ করল আর না স্বীয় স্ত্রীর কন্দনরত মুখ দেখার তৃপ্তি অনভব করল।
ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মায়রা বিছানায় বসে পড়ল। এ কেমন অদ্ভুত মানুষের সাথে বাস তার? এই মধু লাগিয়ে কথা বলে তো এই বিষ ঢেলে দেয়। তখন হয়তো বিপরীত মানুষটার কোনো তোয়াক্কাই থাকে না। ওই মানুষটা এত পাষাণ কেন? নিজের জিদের কারণে কেন দুইটা মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে সে? কেনই বা বুঝতে চাইছে না বিষয়টা? উনি যে সন্দেহ করছেন কাবিনের পর তো তা ঘটার কোনো অবকাশ নেই। তবুও কেন উনি কঠোর নিষ্ঠুর? দুইটা মানুষের কষ্টের কোনো মূল্য নেই উনার কাছে? হঠাৎ একটু আগে নিষ্ঠুর ভাবে চেঁপে ধরা গালে যন্ত্রণা অনুমান করতেই ফুঁপিয়ে উঠল মায়রা। সেখানে বুঝি আঙ্গুলের ছাপও বসেছে। শিরিন বেগম ধীরে এগিয়ে গেলেন মায়রার কাছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“কেঁদো না মা। তুহিনের কি হয়েছে? বেশি খারাপ কিছু?”
মায়রা তাকল ভদ্র মহিলার দিকে। উনাকে দেখলে সে অবাকই হয়। এই মহিলাটা আসলেই মায়ায় ভরা। নয়তো একটু আগে শিফুর সাথে ওভাবে কথা বলার পরও উনি কি সুন্দর তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন মাথায় হাত বুলিয়ে। নিশ্চয় শিফুর কাছ থেকে উনি কিছু জেনেছে। তবুও ব্যবহার কি অমায়িক। অথচ ছেলে মেয়ে দুটোই কি কঠিন।
“কি হলো মা? কি হয়েছে তুহিনের জানো কিছু?”
“না মা আম্মু কিছু বলতে পারেনি। শুধু বলেছে হাসপাতালে যাচ্ছে।”
“চিন্তা করো না। কিছু হবে না আল্লাহ ভরসা। কান্না থামাও। বিষয়টা নিয়ে আমি ইহামের বাবার সাথে একটু কথা বলব। নিশ্চিতে থাকো তুমি। আমি একটু শিফুর কাছ থেকে আসছি মা। মেয়েটা আমার..”
কথা সম্পূর্ণ না করেই লম্বা শ্বাস ফেলে তিনি চলে যান। একা ঘরে মুখে হাত চেঁপেই কেঁদে উঠে মায়রা। একে তো ভাইয়ার সংকটাপন্ন অবস্থা অন্যদিকে ইহামের রুক্ষতা। দুটোই যেন তাকে যন্ত্রণায় কূলহারা করে দিচ্ছে।
“হ্যাঁলো আম্মু? ভাইয়ার কি অবস্থা এখন? কি হয়েছিল ভাইয়ার? আবার কিছু উল্টাপাল্টা করেনি তো?”
“না রে মা। আমার ছেলে কষ্ট পেলেও এই রকম করার মানুষ নয়। দেখেছিসই তো কয়েকদিন ধরে ছেলেটা ঠিক মতো খায় না। সারাক্ষণ দুশ্চিন্তায় থাকে। ডাক্তার বলেছে শারীরিক দুর্বলতা আর মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাবে এভাবে অজ্ঞান হয়েছে। কিছুদিন নিয়মমাফিক খাবার আর ঔষধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।”
ফোঁস করে দম ছাড়ে সে। যেন অনাকাঙ্ক্ষিত চাওয়াটা পূরণ হয়নি বলে স্বস্তি পেয়েছে।
রাগে শরীর রি রি করে জ্বলছে ইহামের। বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছে সে। কোনো ভাবেই মেজাজ ঠিক হচ্ছে না তার। মৃদু ঠান্ডা আবহাওয়াতেও কপাল ঘামছে। শরীরে গরমের তাপমাত্রাও বাড়ছে কেবল ক্ষোভের রেশে। তুহিন আর শিফুর বিষয়টা এই পর্যায়ে তার কাছে বাড়াবাড়ি লাগছে। আর মায়রা? ওই গাধা মেয়েটা? মাথামোটা গর্দভ টা স্বল্প বুদ্ধি নিয়েই এসেছে তার সাথে তর্ক করতে। একটা বিষয় জানল না বুঝল না রাগারাগি শুরু করে দিল। এই মেয়ে কতটুক জানে? দুনিয়া সম্পর্কে কতটুক ধারণা আছে তার? তবুও যে ব্যবহারটা করল তার সাথে? মাও বা কেন বুঝতে চাইছে না? সবাই মূর্খের মতো কেন চিন্তা করছে? তার মতো গভীর ভাবে বিবেচনা করলে সবটাই সহজ হতো। আরে সে তো বলছে না শিফু আর তুহিনের সম্পর্কটা ভেঙ্গে যাক।
কিংবা অস্বীকার করবে। তার কেবল চাওয়া ছেলেটা বিদেশ গিয়ে ওই চালচলন থেকে আসার পরও শিফুকে পছন্দ করলে নির্দ্বিধায় তাদের এক করে দিবে। কিন্তু ওদেরকেও তো একটু সময় দেওয়া প্রয়োজন। জীবনের অনেক কিছুই তো বাকি। সবকিছুর চাক্ষুষ অভিজ্ঞতারও একটা বিষয় আছে। কম বয়সে একটা সম্পর্কে জড়ালে কিংবা সিদ্ধান্ত নিলে তার জন্যে পরে পস্তাতে হবেই। হাজারটা চিন্তা তার মাথা ধরে দিচ্ছে। নিউরনে টান খাচ্ছে প্রবল ভাবে। মাথা যন্ত্রণায় মুখ কুঁচকে নিল সে।
রাত তখন ১টার কাছাকাছি। সাদা পায়জামার জ্যাব থেকে সিগারেটের প্যাকেট তুলে নিল। একটা শলা ঠোঁটে চেঁপে ধরে বিরক্ত অভিমুখে লাইটার দিয়ে আগুন জ্বালালো তাতে। ক্যাটক্যাটে মেজাজ টা ঠিক করতে সিগারেটের ধোয়া টেনে নিল নিজের ভেতরে।
অনেকক্ষণ নিকোটিনের তেজালো ধোয়ার সাথে মেজাজটা একটু শান্ত করে ফোন লাগালো ইবরাহিমের নাম্বারে। ওপাশে বেশি সময় নিল না কল ধরতে। যেন এর আশাতেই বসে ছিল ওই মানুষটা। ফোন রিসিভ করতেই ইহাম বলে,
মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৩০
“যা কাজ দিয়েছিলাম সব কমপ্লিট তো ইবরাহিম?”
“ইয়েস ক্যাপ্টেন। অল মোস্ট ডান।”
“ভেরি গুড। তাহলে এই মিশন কালকেই কমপ্লিট হচ্ছে।”
“ইয়েস ক্যাপ্টেন। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ টা দিয়ে চেষ্টা করব।”
“ইবরাহিম বি কেয়ারফুল। মিশনটা যতটা সহজ মনে হচ্ছে ততটাও কিন্তু নয়। কাল আমাদের সকলকে সর্বোচ্চ এলার্ট থাকতে হবে বিয়ে বাড়িতে কিছু একটা হবেই। আর যাই হোক আমার ফ্যামিলি মেম্বারদের ক্ষতির আশংকা আছে শতভাগ।”