মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৩৪
সাদিয়া
“কিরে রে শা’লা তোর শত্রুতা আমার সাথে মাঝখান থেকে আমার মাথামোটা বউটাকে কেন তুলে আনলি?”
“এইতো চলে এসেছে আমাদের মেইন লিড। আয় ভাই। কাছে আয়। নতুন নতুন আত্মীয় বলে কথা।”
“আত্মীয় সে না হয় বুঝলাম কিন্তু আমাদের এত হয়রানি করে তো আর এখানে আদর যত্ন করে দুধু খাওয়াতে নিয়ে আসিসনি। তাই যা বলার কাজের কথায় এসে যা।”
ইহামের এই ধরনের কথায় বাঁকা হাসি আরো প্রসারিত হয় আযহার পাটোয়ারীর। ক্ষণে ক্ষণে সেই বিশ্রী হাসি বিদঘুটে ধারন করছে। ইহাম কঠোর ভাবে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও কেউ টের পেল না তার অন্তঃকরণের উত্তপ্ত দাবানল। ঝলসানো দৃষ্টিতে এক পলক আযহার কে দেখে ঘাড় বাঁকিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল মায়রার দিকে। মেয়েটা করুন মুখশ্রীতেও যেন বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। হৃদয়ে অনুভব করে কলিজা কামড়ানো যন্ত্রণা। নিশ্বাস টাও যেন ভারি হয়ে উঠেছে মায়রার ওই আদলে। হাত পা বাঁধা অবস্থায় সামনাসামনি দেখে চোখে মুখে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠে শক্ত কঠিন মানুষটার। দপদপ করে জ্বলতে থাকা রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে সেই সাথে সব ধূলিসাৎ করার অবকাশে হাত গুলি হয়ে উঠে দৃঢ় ও মুষ্টিমেয়। ভেতরের সব আক্রোশ আর ক্রোধ গুলি মিলেমিশে একাকার হয়ে খুবলে খেতে চায় আযহার কে। ক্রুদ্ধ কন্ঠে জানায়,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ওকে এখানে এনেছিস কেন? ছেড়ে দে।”
ইহামের তেজ মেশানো ক্রোধের ঝাঁঝালো কন্ঠ বেশ টের পেল আযহার। সে তুচ্ছ ভাবে হাসল। যেন বিরাট কাজ সাধন করতে পারল। তার এমন হাসি দেখে এবার ইহাম মায়রার করুন মুখশ্রী থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। তাকায় আযহারের দিকে। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে এক থাবায় আযহারের গলা চেঁপে ধরতে। কিন্তু তার দূর্বলতা যখন বৈরীর হাতে তখন তাকেও তো একটু দমতে হবে। চাইলেও আযহার কে আক্রমণ করতে না পারার পীড়া যেন ফুটন্ত ক্রোধে টগবগ করছে। চোখ দিয়ে আগুন বের হওয়া দৃষ্টিতে কেবল হিংস্র ভাবে তাকিয়ে আছে আযহারের দিকে। সিংহ যেমন শিকারের আগে নিখুঁত করে তীক্ষ্ণ ভাবে সবটা মেপে নেয় ঠিক তেমন। শাণিত তবুও স্থির কন্ঠে আবারও বলে উঠল,
“মায়রা কে ছেড়ে দে আযহার পাটোয়ারি। তোর শত্রুতা আমার সাথে ওকে যেতে দে।”
“আমার শত্রুতা তোর সাথে আর তোর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব মিসেস চৌধুরীর সাথে। শত্রুর বন্ধু শত্রু হয় ভুলে গিয়েছেন বেয়ান সাহেব?”
“তোর যা বলার যা করার আমার সাথে কর। ওর সাথে কি? ছাড় ওকে।”
“মিসেস চৌধুরী তোর দুর্বলতা ক্যাপ্টেন ফাহাদ ইহাম চৌধুরী।”
কথাটা কর্ণকুহরে পৌঁছতেই অপারগতায় চোখ মুদে আসল ইহামের। আরো দৃঢ় উদ্যমের সাথে মুষ্টিবদ্ধ হাত আরেকটু শক্তি দিয়ে চেঁপে ধরে। এক নজরে তাকিয়ে দাঁত চিবানো ভাবটাই বলে দেয় আযহারের প্রতি তার হিংস্রতার আভাস।
“জা’নোয়ারের বাচ্চা যেটা বললাম সেটা কর। আগে মায়রা কে ছাড়।”
“চু চু চুহ, আমার চান্দু রে। আহো বেয়ান সাহেব তোমারে একটা পাপ্পা খাই।”
“তোর পাপ্পা আমি কোন দিক দিয়ে ঢুকাবো সেটা আমি নিজেও জানি না। ভালো চাইলে মায়রা কে ছাড়।”
“তোর বুকের পাটা কত বড় চিন্তা করছোস? একে তো বউ আমার হাতের মুঠোয় তাও আবার তেজ মারাছ?”
“আযহার তোর সব কথা শুনব আগে মায়রা কে যেতে দে। তারপর যা কথা বলার আমার সাথে একান্ত বল।”
“আমারে কি ফিডার খাওয়ার আবু ভাবো তুমি? তুমি শা’লা বহুত শেয়ানা মাল। নয়তো এমনি এমনি গর্তে ঢুকে পড়ো? ফাঁদ না পাতলে কি আর তোমাকে আমার সামনে পাওয়া যাইত? তোমার বউরে কাজে লাগাইয়াই তোমারে এই খান পর্যন্ত টাইনা আনছি আমি।”
একটু আগেই ফোনের স্কিনে যখন মায়রার এই ছবি দেখেছিল তখন কেমন পাগল পাগল করছিল ইহাম। ঘামার্ত আর উন্মাদের মতো হওয়া অস্থির মুখশ্রী যে কাউকে ঘাবড়ে দিবে। পাগলের মতো দ্রুত সে ইবরাহিমের পাঠানো ফুটেজ টা ওপেন করে। বেশ মনোযোগ দিয়ে একটু জায়গা একবার দুইবার বহুবার দেখে। ওই ঘরে মায়রা ঠিকি প্রবেশ করেছিল কিন্তু আর বের হয়নি। ঘরে থেকে যদি বের না হবে আর সেই ঘরেও যদি না থাকবে মেয়েটা তবে গেল কোথায়? ওই ঘরেই বা কি আছে? ভাবনাটা মাথায় আসতেই আরো অস্থির হলো সে। বুকের গহীন থেকে আতঙ্কের ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে। ভেতরের বিচলিত ভাব যখন জোয়ারে রূপান্তর হয় তখন আর অপেক্ষা করতে পারে না সে। উদভ্রান্তের মতো দৌড়ে যায় সেই রুমের সামনে। মার্জিত বেশভূষায় আবৃত সুস্থ এক কঠিন মানবের আড়ালে লুকিয়ে থাকা হিংস্র পাগলের মতো চাপড় লাগায় দরজায়। হাতের তালু দিয়ে অনবরত ধাক্কা দিতেই থাকে। এক সেকেন্ডের জন্যেও যেন থামার কোনো প্রয়াস নেই।
ওমন উশৃঙ্খল শব্দ পেয়ে ভেতর থেকে বৃদ্ধা বেশ বিরক্ত হয়ে দরজা খুললেন। ওপাশে ইহামে কে দেখে চটে গেলেন বেশ তা উনার অভিমুখে স্পষ্ট। বিরক্ত হয়ে বিতৃষ্ণা সুরে কিছু বলবেন তার আগেই ইহাম ক্ষিপ্রে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে যায়।
যেখানে তার অন্তঃকরণে লুকায়িত নারীর ভয়ংকর বিপদ সেখানে ভদ্রতা দেখানোর কোনো প্রশ্নই উঠে না। ঘরে ঢুকেই একজন মহিলাকে শুয়ে থাকতে দেখে চোখ ফিরিয়ে আড়াল হয়ে দাঁড়ায়। তখনি বৃদ্ধা হুংকার ছেড়ে তেড়ে আসে।
“এই ছেলে বেয়াদব অসভ্য। তোমাকে বলেছি না আমার নাতনি তার বাচ্চা কে খাওয়াচ্ছে। নিলজ্জের মতো কি করে ঢুকলে? এখনি বের হও। নয়তো আমি লোকজন ডাকব। তুমি কোন পক্ষের হ্যাঁ? দাঁড়াও আমি আকবর কে জানাচ্ছি। এই অসভ্য কি করে এই বিয়ে বাড়িতে।”
উত্তেজনায় ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছে ইহাম। তার বুকের ছাতি জুড়ে যেন মায়রা কে নিয়ে আতঙ্ক আর ভয়। এই প্রথম কোনো অপারেশনে এত ভীতি ভাব তার শ্বাসটাই আটকে দিচ্ছে। বৃদ্ধা মহিলার হুংকার গায়েও লাগল না ইহামের। সে ঘুরে তাকায় উনার দিকে। চোখ গুলি অসম্ভব লাল হয়ে গিয়েছে, থেমে থেমে লঘু কন্ঠে জবাব দেয়,
“এই রুমে কাজ আছে। আপনারা দয়া করে আরেকটা রুমে যান।”
“এই ছেলে। ভদ্রতা শেখায়নি বাবা মা? মস্তানি করছো এখানে এসে? রাখো তোমার খবর করছি। বেয়াড়া ছেলে চরিত্রের ঠিক নেই। আবার এখানে এসে গুণ্ডামি করো? মতলব বুঝি না তোমার?”
বৃদ্ধার এমন ধরনের কথা এবার মেজাজ চটালো ইহামের। নিজেকে ভদ্রতার গণ্ডিতে আর সংযত করে রাখতে পারল না। রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে পরনে কালো কোর্টটা খানিক সরিয়ে কোমরের পিছন থেকে Glock 17 মডেলের পি’স্তলটা বের করল। কঠিন ক্রুদ্ধ মুখশ্রী তে কেমন রুক্ষ স্বরে বলে উঠে,
“ভালো ভাবেই বলছি এই রুম থেকে যান। আর বিষয়টা যদি রুমের বাহিরে গিয়েছে তাহলে খুব ভালো হবে না কিন্তু। আশা করি বুঝতে পেরেছেন। কেউ যেন ঘটনাটা একটুও না জানে। বুঝা গেল?”
পি’স্তল দেখে বৃদ্ধা এমনিতেই ভয়ে গুটিয়ে গিয়েছিলেন তারউপর এমন হুমকি শুনে একেবারে চুপসে গেলেন তিনি। মুখটা এইটুকু করে তিনি নাতি পুতি কে নিয়ে বিনা বাক্যে দ্রুত বের হন। তখনি পাগলের মতো তন্নতন্ন করতে লাগে ঘরটায়। তার মন বলে কোনো ঘাপলা আছে এই ঘরটায়। নয়তো একটা মানুষ রুমে ঢুকার পর বের না হলে কি করে উধাও হয়ে যায়? বিচলিত ভঙ্গিতে অস্থির হয়ে খুঁজতে থাকে কিছু। এই ঘরে কোনো সিক্রেট আছে তা নির্দ্বিধায় মেনেও নিল। তবে উন্মাদ মন পায়তারা করল যে করেই হোক পাশের তালা ঝুলানো ঘরটা খুলতে হবে।
“কিরে খুব কষ্ট হয়েছে নাকি ঘরটা খুঁজে পেতে?”
আযহারের ঠেস মারা কথায় আগুন চোখে তাকায় ইহাম। তার ভেতরটা ছলাৎছলাৎ করছে কেবল আযহারের মুণ্ড টা কচলাতে। দাঁত চেঁপে আবারও ফুলিঙ্গের ন্যায় বলে উঠে,
“চাস কি তুই? এভাবেই কি কথা বলা যেত না? আমাদের এত কষরত করে আনার কি দরকার ছিল? মেরে ফেলবি নাকি?”
বাঁকা করে হাসল ইহাম। তার এই ভয়ংকর হাসির মানে টা আযহার বুঝল না। কিন্তু অনুমান করতে পারল এই ধূর্ত সৈনিক টা কি তাকে কাবু করার কেনো প্ল্যান এঁটেছে?
ফুঁপিয়ে উঠল মায়রা। কাতর ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“আমার ভীষণ ভয় করছে। প্লিজ ওদেরকে বলুন আমায় ছেড়ে দিতে।”
গরম চোখে তাকায় মায়রার দিকে। কেমন শুষ্ক কন্ঠে জানায়,
“চুপ। বেয়াদবের মতো কান্না করছো কেন? কথা বলছি দেখছো না?”
মায়রা শক্ত কথার পিঠে আরো ফুঁপিয়ে উঠে কষ্টে। ইহাম বুঝতে পেরেছে মেয়েটা ভয় আর আতঙ্কে যবথব হয়ে আছে। তার নিজের কলিজাই তো শুকিয়ে আছে ওকে এই অবস্থায় দেখে। তবুও রুক্ষ গলাতে বলল,
“এই বেয়াদব মেয়েটা কখনোই আমার কথা শুনে না। যখন যা বলব তার উল্টোটা করতে গিয়ে অকাম বাজায়। বেয়াদব মাথামোটা কোথাকার।”
“এই সময়েও আপনি আমাকে ধমকাবেন? আজরাইল দম নেওয়ার সময়ও বুঝি আপনি আমাকে বেয়াদব সম্মোধন করবেন? আপনার কি কোনো মায়াদয়া নেই? এত পাষাণ আপনি?”
ঠোঁট উল্টে কেঁদে ফেলল মায়রা। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে কাঠ। তৃষ্ণায় বুকের ছাতি চৌচির। তবুও এই অসময়ে ওই পাষাণ লোকটার রুক্ষতা তাকে ভড়কে দিচ্ছে দ্বিগুণ ভাবে। নাক টেনে চোখের পানি বিসর্জন দেওয়া দেখল ইহাম। বিরক্তও হলো খানিক। রাগ লাগল। এই চোখের পানিটাই সে দেখতে পারে না। একদম বিরক্ত লাগে তার। আর এই মেয়েটা কারণেঅকারণে এভাবেই রাগিয়ে দেয় তাকে। কিছু হলেই কাঁদতে হবে কেন তাকে? কতদিন না, না করেছে তার সামনে কাঁদতে? তবুও গাধা মেয়েটা কেন চোখের পানি ফেলে? কেন বুঝে না ওই পানি তার ভেতরে আরো জ্বলন ধারায়।
“চুপ। একদম কান্না করবে না। অসভ্য বেয়াদব একটা। কোনো কথাই তো শুনো না। আমাকে কি নিজের শত্রু ভাবো নাকি? যে কথা শুনলে মহাবিপদে পরবে? অথচ সেই বিপদই তোমাকে টেনে নেয় গবেট কোথাকার।”
“আপনি আসলেই একটা কঠিন পাষাণ মানব। খুব খারাপ।”
“হ্যাঁ খারাপ। পাষাণ। আর তুমি বোধহয় ভালো? দয়ার সাগর? একটু আগেই না বললে আমি যেন বলি তোমাকে ছেড়ে দিতে তার মানে কি বুঝাতে চাইলে? ওরা আমাকে ধরে রেখে যেন তোমাকে ছেড়ে দেয় সেটাই? এই তোমার দয়াত্ব?”
মায়রা জবাব দেয় না। ফুঁপায় শুধু। এই লোকটা আসলেই নির্দয়, কোনো দয়া মায়া নেই। একটা পাথর যেন। একটু আগে আপ্রাণ ভাবে এই মানুষটা কে চাওয়া তার ভুল হয়েছে। মেজাজ চূত হতে না চেয়েও লাল লাল চোখে ইহাম অবলোকন করল মায়রার অসহায়ত্ব। আগুন চোখে দেখল চেয়ারের পিছনে বাঁধা হাত দুটো। না জানি মেয়েটা কতক্ষণ হয় এভাবে বসে আছে। অভ্যন্তরে কেমন নিদারুণ সুরে দ্রিমদ্রিম শব্দ হয়। দুরুদুরু করে বুকটা।
আযহার পাটোয়ারি সরু চোখে তাদের কথাবার্তা শুনে। তার পেছনের ৩ টা ছেলেও নীরবে দেখে যায় ঘটনা। নিঃশব্দে শুনে যায় ইহাম মায়রার কথোপকথন। ছোটছোট চোখে ইহামের দিকে তাকিয়ে আযহার কিছু ভাবে গভীর হয়ে। এই দৃঢ় মনোবলের সৈনিক টা বেশ দক্ষ এবং ধূর্ত মস্তিষ্কের। এই পরিস্থিতিতেও এমন স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে কেন? যেন কোনো বিচলতা ভাব কিংবা কোনো সংশয় আতঙ্ক কিছুই নেই। কিছু একটা ভেবেই কুঁচকানো কপালের চামড়া টানটান হয়ে যায়। এই ধড়িবাজ সোল্ডার ম্যান কি কোনো ছক কষে এসেছে নাকি? এই জন্যেই কি সময় পার করতে চাইছে শুধু?নাকি এমনি এমনি? বিশ্বাস করা যায় না। আর তার মতো মানুষের জন্যে প্রশাসনিক কাউকে তো একদমই বিশ্বাস করার প্রশ্নই আসে না।
“এই নাটক থামা তোদের। ড্রামা শুরু করেছিস নাকি? আমাদের কি চোখে পড়ে না? নিজের বেডরুম পেয়েছিস এটা?”
“শা’লা বিয়ে করেছিস নাকি? বউ এর মর্ম বুঝিস? বউ এর জ্বালাতন সম্পর্কে কোনো ধারনা আছে তোর? তারউপর যদি হয় আমার বেয়াদব বউয়ের মতো তাহলে তো আর কথায় থাকে না।”
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল আযহার। কপালে আবারও ভাঁজ পড়ল। ইহামের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারল না সে। জ্বালাতন, বেয়াদব বউ কি বুঝাতে চায় সে তাই ভাবে। কিন্তু না এই ধূর্ত ইহামের হাবভাব চালচলন তার মোটেও সুবিধার লাগছে না। কেমন যেন ঘাপলা লাগছে। পরক্ষণে নিজের পরিকল্পনার কথা মনে করে নিজের সংশয় ভাব দূর করার চেষ্টা করল সে। বাহিরে কোনো প্যাঁচ দেখলে সে এই ঘরের ভেতরে বসে থেকেই জানতে পারবে সেই ব্যবস্থা করেই এসেছে সে। তাই অযথা ঘাবড়ানোর কোনো কারণ নেই। তবে এদের দুজনের এই কথাবার্তা তার বিরক্ত লাগছে এবার। রুষ্ট গলায় বলে উঠল আযহার।
“থামবি তুই? বেশি কথা বলিস কেন? নিজেকে কি ভাবিস? বুকে ভয়ডর নেই নাকি?”
“যা কথা বলার আমার সাথে বল। আবারও বলছি আমার বেয়াদব বউটাকে ছেড়ে দে।”
“একদম চুপ করুন।” কেঁদেকেটে ঘেমে মুখের বিবর্ণ রূপ ধারন করছে মায়রার। “কথায় কথায় বেয়াদব বলা বন্ধ করুন। নয়তো খুব খারাপ হয়ে যাবে।”
“কি করবে? কি করতে পারবে তুমি?”
“খু’ন করে ফেলব আর একবার বেয়াদব বললে।”
“মাথামোটা গবেট রে। তোর হাত দুটিই তো বাঁধা আছে। নিজেই বাঁচতে পারছিস না আবার আমাকে মারতে চাইছিস?”
দাঁত কিড়িমিড়ি করে উঠে মায়রার। রাগে শরীর রি রি করে তার। মনে মনে চাইছিল ইহাম যেন যেভাবেই হোক চলে আসে। দোয়া করছিল বারবার যেন তাকে বাঁচিয়ে নেয়। অথচ এই লোক এমন ভয়াবহ বিপদের মুখেও তাকে বেয়াদব বেয়াদব করে যাচ্ছে। এই অবস্থায় শত্রুদের সামনে বন্দুকের মুখে বসে আছে অথচ লোকটার কি একটুও ভয় হচ্ছে তার জন্যে? একটুও চিন্তা নেই তার মনে? ঠোঁট ভেঙ্গে কেঁদে উঠে মায়রা। তথাপি বোকা মেয়েটা বুঝলও না শান্ত স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার ভেতরে আতঙ্কের ভয়াবহ তাণ্ডবের কথা।
“বেয়াদব মেয়ে আমার একটা কথাও শুনতে চায়না। এবার মজা বুঝো। তোমার মতো মাথায় গোবর ভরা গবেটদের একটু শিক্ষা পাওয়া দরকার।”
“তো এসেছেন কেন? আমি তো জন্মের বেয়াদব। চলে যান এখান থেকে। আমার বিপদ হোক বা মরি তাতে আপনার কি? এই গুণ্ডা ভাই আপনার পি’স্তলটা দিয়ে একটা গুলি করুন তো আমায়।”
মায়রার এহেন কথায় রাগে নিশপিশ করে উঠে ইহামের শরীর। দাঁত পিষে সে আগুন লাল চোখে তাকায় মায়রার দিকে। ইচ্ছা হয় বলদ মেয়েটার গলা চেঁপে ধরুক গিয়ে। এত মাথামোটা এই মেয়েটা। স্থির ভঙ্গিতে কেমন হীম কন্ঠে শাসিয়ে উঠল ইহাম।
“কি ভেবেছো এভাবে এই পরিস্থিতিতে আছি বলেকি তোমায় কিছু করতে পারব না আমি? আমি যদি এক চুল নড়ি তাহলে সোজা গিয়ে তোমার গালে ঠাস ঠাস করে কয়েকটা লাগাব। দেখতে চাও নাকি?”
“আপনি একটা রাক্ষস। পাথরও আপনার চেয়ে ভালো আছে। একটা পাষাণ আপনি। জাহান্নামে যান।”
“তোমাকে সাথে নিয়েই যাবো।”
“দূরদূর। আমি যাবো আপনার সাথে? থাকবোই না আপনার কাছে একটা কঠিন পাষাণ লোক। একবার শুধু বের হতে পারি এখান থেকে তারপর যা করার পরে দেখছি। কারো দাম নেই আপনার কাছে তাই না? আপনার মূল্য শুধু আপনার চাকরি? এই চাকরি দিয়ে যদি আমি ডুগডুগি না খেলি পেরে দেখবেন।”
“স্টুপিড একটা। বাঁদরের বাচ্চার মতো মাথায় তুলে দিব এক আছাড়।”
দাঁত কিড়িমিড়ি করে বলল ইহাম।
“চুপপপ” চোখ বন্ধ করে চেঁচিয়ে উঠল আযহার পাটোয়ারি। “একদপ চুপ কর দুটা। বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি আমি। আমারে কি বোকাচো* পেয়েছো তোমরা? সামনে রেখেই সমানে রেষারেষি করছিস। তোরা কি স্বামীস্ত্রী নাকি সাপ নেউল? এই অবস্থাতেও এমন করে কেমনে ঝগড়া করিস? নাকি অন্য ব্যাপারস্যাপার আছে?”
শাণিত তলোয়ারের মতো নজরে চকচক দৃষ্টিতে ইহাম রুষ্ট আযহার পাটোয়ারির দিকে তাকিয়ে রইল নিরুত্তর হয়ে। ঠোঁটের কোণে এক চিমটি পরিমাণ বক্র হাসি ফুটিয়ে আনল। তবে তার এই অনু পরিমাণ হাসিটা আদৌত বুঝা গেল কিনা তাতেই বিস্তর সন্দেহ। ততক্ষণে মনেমনে নিজের ছকটাও কষে নেয় সে। একে তো বিয়ে বাড়ি তারউপর অন্তরে বাস করা রমণী টি অনিশ্চিত বিপদের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। সেই অবস্থায় কি আর সে কোনো রকম বন্দোবস্ত হীন একাই চলে এসেছে নাকি এই বদ্দ খাঁচায়? ওই বলদা আযহার পাটোয়ারি কি ভাবছে সে তাকে এখানে টেনে এনেছে? উঁহু। নিজ থেকেই এসেছে এই রুমের ভিতর। নয়তো মায়রা কে উদ্ধার করার অন্য উপায়ও সে বের করতে পারত। তবে তার পরিকল্পনা আযহারের ধারনারও বাহিরে।
একটু আগেই যখন পাশের রুমটায় গিয়ে উশৃঙ্খলের মতো কিছু খুঁজছেও পাচ্ছিল না তখন সে নিশ্চত হয়েছিল এই রুমে কিছু না কিছু সিক্রেট আছে। তখনি তাড়াহুড়া করে সে ইবরাহিম কে জানায় ফুটেজ চেক করে বলতে এই রুমটায় ঘন্টা খানেক ধরে কে কে এসেছিল আর গিয়েছে। ততটুক সময় ইহামের বুকের ভেতরটায় কেবল বয়াল ঘূর্ণিঝড় চলেছে। দুশ্চিন্তা আর শঙ্কা ভাব কুণ্ডলীর মতো ঘুরপাক খেয়েছে তার হৃদয়ের আনাচেকানাচে জুড়ে। মায়রার অল্প সময়ের অনুপস্থিতি টুক আর বিপদের আশংকা তার অস্থিমজ্জায় টের পায়িয়েছে ওই বেয়াদব মেয়েটাকে তার কত প্রয়োজন। মস্তিষ্কের নিউরন সেলে খরস্রোতা প্রস্রবণের মতো কেবল একটা কথাই উদ্ভব হচ্ছিল “দুনিয়া ধ্বংস হোক তবুও বেয়াদব মেয়েটা তার বক্ষস্থানে ঠায় পাক।”
আর সেই মাথামোটা টা এখন ভুলভাল বুঝে আবলামি করছে গাধার মতো। তীক্ষ্ণ চোখে মায়রার দিকে তাকিয়েও চুপ রয় ইহাম। মনে পড়ে ইবরাহিম যখন ফুটেজ চেক করে তাকে জানিয়েছিল আর নিজের পর্যবেক্ষণ সব মিলিয়ে সে ধারনাই করে নিয়েছে এই ঘরে কোনো এক গোপনীয়তা লুকায়িত আছে। মায়রা আসার ১৫ মিনিট আগে আযহারের সাথে আরো ৪ জন ছেলে ঢুকেছিল সেই রুমে। কিন্তু বের হয়েছিল ৩ দুজন। তার কিছুক্ষণ পর মায়রা ঢুকেছে যা ভিডিওতে স্পষ্ট। তবে কেউই আর বের হয়নি। তখন প্রশ্ন এসেছিল আযহারের সাথে আরেকটা ছেলে আর মায়রা রুম থেকে বের না হলে কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিল?
এর একটুপর দেখা গিয়েছে ওই বৃদ্ধা নাতনী আর তার বাচ্চাকে নিয়ে ঢুকেছে বেস্টফিডিং করাতে। স্কিনে তখন আরেকটা সন্দেহজনক দৃশ্যে চোখ আটকে গিয়েছিল ইহামের। পাশের রুমটাতে একটা বড় রেক কিছু ছেলে তালা খুলে রুমে রেখে এলো। বের হওয়ার সময় কিছু একটা আঁচ করে আবারও পজড করল সেটা। আরেকটু পিছিয়ে দেখল ৫ জন ভেতরে ঢুকলেও বের হয়েছে ৩ জন। ঠিক তখনি যা বুঝার বুঝে গিয়েছিল সে। ঘাপলা টা যে এই রুম থেকেই শুরু তাতে আর সন্দেহের বিন্দুমাত্র কোনো অবকাশ নেই। উন্মাদনায় লিপ্ত মস্তিষ্কটি হঠাৎই এক দৃঢ় শাসনে এসে, স্থির মনোযোগে কিছু সূক্ষ্ম পরিকল্পনার ছক কষে নেয়। যেন বিক্ষিপ্ত ঝড় থেমে গিয়ে গভীর কোনো ষড়যন্ত্রের নীলনকশা আঁকা শুরু হয়—নির্ভুল অথচ অপ্রতিরোধ্য। যার প্রতিটি ধাপে লুকিয়ে ছিল প্রবল দৃৃঢ়তা।
ইহাম নিরুত্তর রইল। সূক্ষ্ম আড়চোখে তাকালেই দেখতে পেল মায়রা গলা টানছে। ঢোক গিলতেও বুঝি মেয়েটার কষরত করতে হচ্ছে। নিঃশব্দে বিষয়টা বুঝে নিল সে। সুচালো হিংস্র চোখে তাকাল আযহার পাটোয়ারির দিকে। তার প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে ইহাম নিজে প্রশ্ন করে উঠল,
“আমার পিচ্চি মিসেস চৌধুরীকে পানি দিয়েছিলি?”
ইহামের প্রশ্নে খানিক ভ্যাবাচ্যাকা খেলো আযহার। সন্দেহের স্থানে এবার ঠায় পেল চিন্তা। বুঝার চেষ্টা করল বিস্তর কঠিন ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে থাকা এক অদম্য সাহসী চতুর সৈনিক কে। থতমত খেলো আযহার। প্রত্যুত্তর না করে কুঞ্চন রূপে তাকিয়ে রইল ইহামের দিকে। একটু আগেই না দুটো তে কেমন ঝগড়া করছিল? এখন আবার কেমন করে সামান্য বিষয়টা গুরুত্ব দিল। কিছু মনে করে সে গভীর মনোযোগ দিল ইহামের মুখাবয়বে। হঠাৎ বজ্রবেগে হুংকার দিয়ে উঠল কঠিন মানব টা।
“কিরে কেউ উত্তর দিচ্ছিস না কেন? কি জিজ্ঞাস করলাম আমি? পানি দিয়েছিস ওকে কেউ?”
আযহার তখনো নিরুত্তর। তার তীক্ষ্ণ নজর তখনো ইহামের মুখের উপর। কোনো একটা হেতু খুঁজার আপ্রাণ চেষ্টা তার গহ্বরে। ইহামের হিংস্র রঙ্গিম আভা আর মেঘের গর্জন বাকি তিনজন ছেলেকে ভয় পায়িয়ে দিয়েছে। তাদের দলের সবার জানা আছে এই রুক্ষ দয়ামায়াহীন মানুষটার নির্ভীকতা। কেমন চুপষে গিয়ে একজন আমতাআমতা করে জবাব দিল “ন না” খেয়াল করা গেল ইহামের চোখ গুলি অসম্ভব লাল হয়ে উঠছে। সামনের এই মানুষটা কি মাত্রাতিরিক্ত রাগের স্বীকার?
দাঁত কটমট ভাবটা তিন ছেলেকে যেন পিষে দিচ্ছিল। কোনো নীরব ভাবনায় তাদের মনে হতে লাগল এটা যেন তাদেরই নিঃশেষ করে দেওয়া ইঙ্গিত। মায়রার পাশেই দাঁড়ানো লোকটা চুপচাপ এগিয়ে গিয়ে একটা মিনারেল পানির বোতল ধরল মায়রার সামনে। কঠিন পিপাসায় গলা শুকিয়ে আসা মেয়েটা যবথব হয়ে কাতর চাউনিতে তাকালো লোকটার পানে। এই মুহূর্তে আসলেই বেশ গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে পারছে পানির অপর নাম জীবন কথাটার মর্মার্থ। শুকনো করে ঢোক গিলল সে। তৃষ্ণায় গলার মনি শুকনো খালের মতো চৌচির হয়ে আছে। অন্তরটা অপ্রাণ চাইছে ওই জীবন টুক আস্বাদন করুক নিজ অভ্যন্তরে। কিন্তু নিরুপায় চেয়ে থাকে কেবল পানির বোতলটুকের দিকে।
মায়রার অনুচ্চারিত কথাটা নিজ দায়িত্বে আয়ত্ত করে কেমন চাঁপা ক্ষোভ মেশানো প্রগাঢ় কন্ঠে বলে উঠল,
“জা’নোয়ারের বাচ্চা। আমার বউ পানি খেতে চাইছে। পানি দিচ্ছিস না কেন? হাত পায়ের বাঁধন খুল চামচার বাচ্চা।”
রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে থাকা ভয়াল রূপটা দেখে হকচকিয়ে গেল ছেলেটা। নিঃশব্দে হাত কাঁপল। আতঙ্ক ভরা চাউনিতে বিক্ষুব্ধ সোল্ডার নায়ককে দেখে নিয়ে অসহায় চোখে ঘাড় বাঁকিয়ে চেয়ে দেখল আযহার পাটোয়ারি কে। লোকটাকে নির্লিপ্ত মনে হলেও গভীর চিন্তায় মগ্ন। চোখে মুখে উপছে পড়ছে উদ্বেগ। কিছু বলার আগেই ইহাম আবারও গর্জন দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল,
“হারা’মিরবাচ্চা মরার স্বাদ জাগছে? খুলছিস না কেন হাত দুটো? দেখছিস না পানি খেতে চাইছে ও?”
অপ্রয়োজনীয় আসবাব পত্র ছড়িয়েছিটিয়ে আছে বিশাল রুমটায়। ৬ জনের উপস্থিতিতেও ঘরটা শুনশান নীরবতা গ্রাস করল। চকিতে বিস্ময় নিয়ে মায়রা অপলক তাকিয়ে রইল ইহামের দিকে। লোকটার রঙ্গিম মুখাবয়ব তার ভেতরেরও ভয়ের দানা বুনছিল। মানুষটা কি সাংঘাতিক রেগে গিয়েছে? চোখ দিয়ে মনে হচ্ছে কেমন আগুন ঝড়ছে। তার না বলা কথাটা কি করে লোকটা এক তুড়িতে বুঝে নিল? এর জন্যেই কি এই উন্মত্ত হিংস্র রূপ?
আযহার পাটোয়ারি কিছুতেই যেন কিছু মিলাতে পারছেন না। কিন্তু তার সচল মনমস্তিস্ক জানান দিতে চাইছে কিছু একটা ঘাপলা আছে। নয়তো এসেই বউকে এভাবে দেখে যে মরিয়া না হয়ে ঝগড়া শুরু করে দিল আর যেই দেখেছে বউ পানি খেতে চাইছে ওমনি তার এত উথলা? ব্যাপারটা ঠিক ঠাউর করতে পারছে না সে। তবুও মনের কোথাও না কোথাও থেকে একটা সূক্ষ্ম সান্ত্বনা অনুভব করল। ঘাপলা পেলে নিশ্চয় বাহির থেকে খবর আসবে। নিজেকে দুশ্চিন্তা মুক্ত রাখতে গিয়েও যেন তার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে কেবল ইহাম।
সামনের ধুরন্ধর লোকটা খপ করেই যেন আযহারের মন পড়ে নিল। তার দুশ্চিন্তা আর আতঙ্কের খবর পেল সে। এক অনু বাঁকা হাসল ইহাম। তার এই নিগূঢ় হাসির মানে আর রহস্য কেবল সে জানে।
“এই চামচা কানের নিচে কয়টা খেতে চাস তুই? এদিকে আয় তোর কানের পর্দা ফাটাই। বা’ল শুনতে পাচ্ছিস না? আমার বউ পানি খাবে?”
“মকবুল” গলার স্বর নিচু করে আযহার। চিন্তা কাটাতে মুখ ফিরায়। “ম্যাডাম কে পানি খায়িয়ে দে।”
“তোর কি মনে হয়? আমি সামনে থাকতে আমার বউকে আরেক ব্যাটায় পানি খায়িয়ে দিবে আর আমি তোর আঙ্গুল চুষব?”
“তো তুই কি চাইছিস? আমি ওর হাত পায়ের বাঁধন খুলে দেই। আর তুই তারে কোলে তুলে পানি খাওয়াতে চাস?”
“আমাকে ওর কাছে যেতে দিলে কোলে তুলে শুধু পানি নয় তোদের সামনে ওকে চুমুও খেতে পারব অনায়াসে। সেই কথা বলে লাভ নেই। তোকে এক মিনিট সময় দিলাম এর মাঝে যেন আমার স্ত্রীর পানি পিপাসা মিটে। নয়তো কছম আযহার তোর পরিণতি খুব করুণ হবে। নিজ হাতে পিণ্ডী চটকাবো তোর। ওর হাত খোল। পানি খেতে দে ওকে।”
মায়রা কেমন হতভম্বের মতো বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে আছে। চোখে মুখে তার বিস্ময় এক কৌতূহল ভাব। এই লোকটার রাগ এত ভয়ংকর? শান্ত শীতল কন্ঠ টা তার নিজেরই গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে। হৃদয় ছলকে উঠছে কঠিন মানুষটার ক্রোধ দেখার আকাঙ্ক্ষা।
“আব্বে শা’লা তোকে আমি তুলে এনেছি নাকি আমাকে তুই তুলে এনেছিস? তুই কি আমারে ভয় দেখাচ্ছিস? আরে ওদের কেউ বুঝা না ওখানে ওদের ঢলেঢলে আদর করতে আনিনি আমি।”
“ওর হাত খুলে দে। খুব পানি পিপাসা পেয়েছে ওর।”
নিস্তরঙ্গ চোখে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে শান্ত অথচ শরীর শিউরে দেওয়ার মতো করে ইহাম কথাটা বলল।
“দেখ ফালতু প্যাঁচাল বাদ দে” আযহারের চোখে মুখে স্পষ্ট বিরক্তি ভাব। শান্ত কন্ঠে আবারও জানাল, “সেটা বলার জন্যে এত কষরত করতে হয়েছে সোজাসুজি সেই প্রসঙ্গে আয়।”
তখনি বিদ্যুৎ চমকের মতো ইহাম বজ্রধরের মতো পাশে থাকা একটা বুকশেলফ বাম হাত দিয়ে ঠেলে মাটিতে ফেলে দিল। মুহূর্তে বদ্ধ রুমে সেই বিকট শব্দ বারবার প্রতিধ্বনি সৃষ্টি হলো। মায়রা এতক্ষণ এক দৃষ্টিতে ইহামের দিকে নজর রেখেছিল। চোখে মুখে তার অবাক বিস্ময় ভাব লেপ্টে ছিল। শব্দ শুনে সে তীব্র আতঙ্ক আর শঙ্কায় নিদারুণ ভাবে চোখমুখ খিঁচে নিয়েছে বদ্ধ চোখের পাতায় ভাসছে ইহামের অতিরিক্ত হিংস্র রূপটা। দাঁত খিঁচে চোখ বন্ধ রাখা অবস্থাতেই ভীত মায়রা ঘনঘন নিশ্বাস নিল। আড়চোখে সবটা পরখ করে নিয়ে ইহাম হীমশীতল কন্ঠে জানাল,
“আমার বউ কে পানি দে আযহার। নয়তো কোনো কথা ছাড়াই তোর পরিণতি টানব আমি।”
চোখ দিয়ে ইহামের দাউদাউ করে যেন আগুন ঝড়ছিল। ফিচেল হেসে আযহার দেখে গেলে ইহামের ক্রোধ টা। মায়রার পাশেই এক হাতে পি’স্তল আরেক হাতে পানির বোতল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটাকে ইশারা করল খুলে দিতে হাতের বাঁধন। ছেলেটা দ্রুত তা করতে লাগল। আযহার দৃষ্টি ঘুরিয়ে পুনরায় তাকাল ইহামের দিকে। স্তব্ধ শরীর থেকে আগুন নির্গত হওয়ার মতো হোসহোস করছিল সে। অথচ তার ভেতরের তীব্র দাবানলের কথা জানতেও পারল না আযহার পাটোয়ারি। যা ওই গম্ভীর কঠিন মানুষটার শক্তপোক্ত উর্বর ভিতকেও নাড়িয়ে দিতে সক্ষম।
হাতের বাঁধন ছাড়া পেয়ে মায়রা সবার আগে ইহামের দিকে প্রশ্নাত্মক নজরে চাইল। চোখের চাউনির বুননে বুননে যেন না বলা কত অভিযোগ জানিয়ে গেল। নিঃশব্দে আগুন গিলার মতো সেটা হজম করল ইহাম। চোখ দিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে ইশারা করল পানিটুক খেতে। তবে ভুলক্রমেও পা বাড়ালও না সে। কারণ আযহার পাটোয়ারির পাশে থাকা একজন তার দিকেই ব’ন্দুক তাক করে রেখেছে। সেই সাথে মায়রার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার হাতেও Walther PPK মডেলের এক পি’স্তল ঝুলানো। তাই কোনো রকম রিস্ক নেওয়া চলে না। সে শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষায় স্থির।
তৃপ্তি নিয়ে অর্ধেক বোতলের পানি খাওয়াটা গভীর ভাবে তাকিয়ে দেখল ইহাম। মেয়েটা পানি হাতেই ঘুরে তাকাল তার দিকে। মায়রার মুখের পরদে পরদে ভয় আর আতঙ্ক ভাবটা ইহামের বুকটাতে ধুকবুক শব্দ তুলছিল। তবুও স্থির অবিচল চিত্তে সে চোখের পাতা টুক আস্তে করে বুঝল। যেন নিগূঢ় ভাবে জানান দিল নিজের উপস্থিতির না বলা ভরসাটুক।
আযহার পাটোয়ারি চোখের ইশারায় কিছু বুঝালে ইহাম তখনি বলে,
“উঁহু। একদম নয়। ভুলেও আর ওকে বাঁধার চেষ্টা করিস না।”
“চুপ কর” রেগে গেল আযহার সেই সাথে প্রচন্ড বিরক্তও হলো। “মামাবাড়ির আবদার পেয়েছিস?”
“তো বল” গা ঝাড়া দিয়ে বলল ইহাম। যেন আযহারের বক্তব্যের ন্যূনতম মূল্য তার কাছে নেই। আর না অফুরান সময় আছে তা শুনার। “আসল কথায় আয় মগা। যেটা বলার জন্যে কাপুরুষের মতো কাজ করলি সেটা বল। অবশ্য তোর জীবনটাই তো কাপুরুষি কাজ দিয়ে ভরপুর।”
রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল আযহার পাটোয়ারি। দাঁতে দাঁত চেঁপে সে ক্রোধান্বিত হয়ে কটমট করে তাকাল ইহামের দিকে। মন চাইছে ছুটে গিয়ে মাদারচো* এর গলাটা চেঁপে ধরতে। তবে কিছু একটা ভেবে ফণা তুলা সাপের মতো ফসফস করে শব্দ করল।
“তোর কলিজা ডা কি খুব বড়ো? দেহি আয় তো একটু ছিঁড়া দেহি কত্ত বড় পাডার মতো তোর কলিজা গান্ডুর পুত। আমার সাথে মসকারি চো*ও?”
“এইইই” হঠাৎ আগুন ঝাড়া ক্রোধে প্রলয়ঙ্করী কন্ঠে চিৎকার দিয়ে উঠল ইহাম। কন্ঠে আগুন তেজ নিয়ে বলল “বাই*দ পদ্দার পু আমার। আমারে তুই গালি দেস? এটায় পি এইচ ডি করা আমার। খালি জায়গা মতো ঠা’পাই। আর তুমি মাদারচো* আমারে গালি চু’ও? আর একটা গালি দিয়ে দেখ পরবর্তী বাক্যটা বলার জন্য তোর জিহ্বটা আমি কোথায় ভ’রি।”
ইহামের মাত্রাতিরিক্ত রাগের রক্তজবা রূপ দেখে সবাই স্তব্ধ বাকহারা। মায়রা একদম হতবিহ্বল হয়ে নিশ্চেষ্ট আভায় তাকিয়ে আছে কেমন করে। তার চোয়াল বিস্ময়ে ঝুলে আছে। ওই ভয়ংকর রূপ আর পিছলে পড়া বিশ্রী শব্দে ইহাম কে যেন চিনতেই পারছে না সে।
মেজাজ খুব খারাপ হয়ে আছে আযহারের। নিজের টগবগে রাগটাকে দমাতে পারছে না। ইচ্ছা হচ্ছে ঝাঁপিয়ে পড়তে ওই মা’দারির বাচ্চার উপর। মনে মনে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করে দাঁত কাটল সে। এখানে এর ভাবোলীলা সাঙ্গ করে দিতে। কিন্তু ঝামেলায় পড়লে ফাঁসবে সে। বিপদ তখন একদিকের বদলে দুই দিক দিয়ে তাকে মাইনকার চিঁপায় ফেলবে। এর চেয়ে আলোচনায় উত্তম।
“ঠিক আছে। এবার কথায় আসি।”
উত্তরের আশায় জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেও ইহাম জবাব দিল না। বরং ভেতরে নিভৃতে ফুঁসে যাওয়া তোপে ধারালো ভাবে তাকিয়ে রইল তার দিকে। অতঃপর আশাহত হয়ে নিজ থেকেই বলল,
“তুই তোর ডিপার্টমেন্টে জানিয়ে দিবি আমি স্পট ডেট। বাকিটা আমি সামলে নিব।”
“বেইমানি করতে বলছিস নিজের আরেক সত্ত্বার সাথে?”
“বাঁচার জন্যে যত মিথ্যা ছলচাতুরী সব মাফ।”
“…..
“চুপ করে না থেকে জবাব দে। বিশ্বাস কর তোর অভিনয় আমাকে অনেকক্ষণ যাবত মেজাজ গরম করে দিচ্ছে।”
“তোর বালের মেজাজ তোর কাছে রাখ।”
“দেখ তোর মতো ক্যাপ্টেন কে শায়েস্তা করা আমার ওয়ান টু ব্যাপার। কিন্তু আমি চাইছি আলোচনায় শেষ করতে।”
“তো তোর আলোচনা কি এইটায়?”
“হ্যাঁ।”
“এই বিশ্বাসঘাতকা আমি কেন করব?”
“তোর বউ কে বাঁচাতে।”
উত্তরে ইহাম কেমন নগণ্য ভাবে ঘাড় বাঁকিয়ে বাঁকা হাসল। ঠিক তখনি আযহারের কপাল কুঁচকে এলো। ততক্ষণে ইহাম নিজের কাঙ্ক্ষিত বাক্যটি শুনে অসম্ভব ক্রুর হাসিটাকে আরো প্রসারিত করে। আযহার পাটোয়ারি বিচলিত হয়ে উদ্রেক কন্ঠে শুধায়,
“ওই তোর কানে ওটা কি? কি দিয়ে রাখছোস?”
আযহারের ভীত চাউনি আর ভয়ার্ত মুখশ্রী দেখে কুঠিল হাসল ইহাম। এটার আর প্রয়োজন নেই। আযহার পাটোয়ারি নিজেকে শেয়ানা ভেবে হয়তো আরামচে বসে আছে। অথচ তার জন্যে যে সে ফাঁদ পেতেছে তাতে বিন্দুমাত্র কোনো অবগত নেই তার। শুধু কি আর এসেই সময় ব্যয় করেছে সে মায়রার সাথে কথোপকথনের মধ্য দিয়ে?
ইহাম হাত বাড়িয়ে ব্লুটুথ টা কানের গুহা থেকে আলগা করল। ঠোঁটের কোণে চমৎকার ভাবে হাসি ঝুলিয়ে সেটা বাড়িয়ে দিল আযহারের সম্মুখে। অদ্ভুত স্বরে বলে,
“এটা?” তারপরই সেটা মাটিতে আযহারের পায়ের দিকে ছুড়ে দিল। “এটার আর কোনো প্রয়োজন নেই। তুই রেখে দে।”
ব্যস আযহার পাটোয়ারি কেমন ছন্নছাড়া হয়ে গেল মুহূর্তে। তার সন্দেহ সংশয় ঠিক হওয়ার আশঙ্কা কেমন উতলা করল তাকে। উদভ্রান্তের মতো বলে উঠল,
“মাদারচো* খান* মা* এর পোলা। আমার সাথে তুই চালাকি মারোও? গাদ্দারি চো*ও ওই ধর ওর ধো* র বউডারে। আজ খাইছি ওরে।”
বলতে দেরি হলো কিন্তু ইহাম অত্যন্ত দক্ষতার সাথে চোখের পলক ফেলার সঙ্গেসঙ্গে কোমরের পিছনে গুঁজে রাখা সেমি অটোমেটিক + ফুল মুডে কাজ করা Glock 18 মডেলের পি’স্তলটা বের করেই আগে মায়রার পাশে দাঁড়ানো ছেলেটার হাতে গুলি ছুড়ল। মুহূর্তে শুনশান নীরব পরিবেশটা অনবরত গুলি ছুড়াছুঁড়ি করার শব্দে কেঁপে উঠছিল প্রতিটি দেওয়াল। নির্বাক মায়রা প্রথম কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ হয়ে থাকলেও এই মুহূর্তে তার রন্ধ্রেরন্ধ্রে ভয় আতঙ্ক স্রোতের মতো প্রভাবিত হলো। তখনি ইহাম গুলি ছুড়তে ছুড়তে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
“মায়রা কোনো কিছুর আড়ালে লুকাও। জলদি। খোদার কসম লাগে কোনো বেয়াদবি করিস না জান।”
ইহামের কন্ঠের আগুন থাকলেও মায়রা খুঁজে পেল শরীর শিউড়ে তুলা এক হীমশীতল বাতায়ন। তীব্র অসহায় আতঙ্কিত কন্ঠের পারদে পারদে ছিল আবেগ আদুরের সংস্পর্শ। তিন চার সেকেন্ড সেটা নিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে থাকলেও আরেকটা বিকট গুলির আওয়াজে সর্বাঙ্গ ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁপে উঠল। অতি দ্রুত কম্পিত শরীরটা নিয়ে একটা অপ্রয়োজনীয় সোফার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে নিল।
সেই সাথে শুরু হয়ে গেল তুমুল গুলাগুলির ধ্বনি। আযহার পাটোয়ারি নিজেকে কাভার করে বাকি তিন জনের সাথে ইহামের দিকে বুলেট ছুড়ছে। মোটামুটি পরিস্থিতি টা ভয়াল শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় ঠেকেছে। মায়রার হাত পা অনবরত কাঁপছে। শরীরটা অসাড় হয়ে আসতে চাইছে এই ভয়ংকর মুহূর্তের করাল গ্রাসে। কি হবে তা যেন তার কোমল হৃদয় কে কামড়ে ধরছে। মনের ভীতি ভাব টা তাকে সর্বশক্তি দিয়ে এক ভয়ংকর কালো আঁধারে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কোনো দৈব্যশক্তি যেন শীতল কন্ঠ মেলে কানের কাছে ফিসফিস করে বলে যাচ্ছে কোনো ভয়ংকর রক্তস্লানের নিগূঢ় পূর্বাভাস।
নিজের সবটুক মনোযোগ দিয়ে যখন আপ্রাণ চেষ্টায় শত্রু ঘায়েলের নেশায় মত্ত তখনি আযহারের ব্যঙ্গার্থ কন্ঠ কানে এনো। ইতিমধ্যে দুজন কে ঘায়েল করে কেবল একজনের দিক থেকে আসা গুলির মোকাবিলা করছিল ইহাম। তখন আযহারের কন্ঠ শুনে সেদিকে তাকাতেই হৃদপিন্ড টা ভয়ে থমকে গেল। গলা শুকিয়ে বড্ড তৃষ্ণা অনুভব করল। স্বীয় স্ত্রীর গাঢ় তৃষ্ণা! বিস্ময়ে ছানাবড়া হয়ে তাকিয়ে আছে আযহার আর মায়রার দিকে। আযহার পাটোয়ারির বন্দুক তখন মায়রার মাথায় ঠেকানো। মেয়েটার কোমল গলা ওই জা’নোয়ারটার শক্ত বাহুর মুড়িতে। মেয়েটা ভয় আতঙ্ক কিংবা যন্ত্রণায় খিঁচে রয়েছে। এক রত্তি তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। মায়রার ওই মুখশ্রী টা যন্ত্রণায় দগ্ধ করে তাকে অদ্ভুত ভাবে নিস্তেজ করেছে। অজানা শক্তির টানে একদম হতবিমূঢ়ের মতো ইহাম ঠাই দাঁড়িয়ে রইল নিজের বিবশ চিত্ত নিয়ে। কেবল গভীর ভাবে অনুভব করছিল বুকের তীব্র দুরুদুরু কাতর শব্দগুলি। শরীরে আর এক বিন্দু শক্তি হলো না আরেকটা গুলি ছুড়তে। হাতের পি’স্তলটা আপনাআপনি নিচে নামিয়ে নিল। ওর এই আত্মসমর্পণের দৃশ্য টা বাঁকা হেসে খুব উপভোগ করল আযহার পাটোয়ারি।
“তুই হু’গা মা* বাই*দ আমার সাথে টক্কর লস? আমার সাথে?”
কথা বলতে গলায় আটকে আসছিল শঙ্কা। আজ ইহাম হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে মরণের ভয় তার অন্তরে না থাকলেও কোনো এক বিষয়ে সে ভীষণ ভীত, ভীষণ অসহায়। কথা বলতে গলা কাঁপল তার। থেমে থেমে জানাল,
“দেখ আযহার পাটোয়ারি সালেন্ডার কর। ভুলেও কোনো ভুল করিস না। বাঁচতে পারবি না কিন্তু। আশেপাশে সব কিছু কিন্তু আমাদের আয়ত্তে। কোথাও পালাতে পারবি না। কোনো চালাকি না করে মায়রা কে ছেড়ে দে।”
“তুমি পু’দানির পু আমারে মা’রা খাওয়াইবা আর আমি তোমার মুখে মধু ঢাইলা দিমু? কোনো রকম চালাকি করিস না। আমার রাস্তা ক্লিয়ার কর। আমারে বের হতে দে।”
“দেখ আমি বলছি একটা মীমাংসাশ আসা হবে। আগে তুই মায়রা কে ছাড়।”
ভেতর থেকে উতলা হলেও বাহিরে শক্ত থাকার ভীষণ চেষ্টা করছে সে। এদিকে আযহার পাটোয়ারি মায়রার গলায় আরেকটু চাঁপ দিয়ে ধরতেই মেয়েটা ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠল। ইশশ বাবা মার অতি আদরের একমাত্র ভাইয়ের স্নেহে খুব যত্নে বেড়ে উঠা মেয়েটা যাকে দুঃখ কষ্ট ছুঁতে পারেনি সেই মেয়েটাকে একটা শক্ত কঠিন মানবের পরশে এসে কতই না যন্ত্রণা সহ্য করতে হচ্ছে। টপটপ করে কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানি ভর্তি করুন মুখটা দেখে ইহামের বুকে তোলপাড় হয়। কষ্টে গলা বসে আছে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা হয়
“দোহাই লাগে তোর। আমার প্রাণভোমরা টাকে ছেড়ে দে। ওর খুব করে কষ্টটা আমার বুকের বা পাশে বিষাক্ত তীরের মতো বিঁধাচ্ছে রে।”
বাহির থেকে দরজা ভাঙ্গার ঢগ ঢগ শব্দ হচ্ছে। তাতে আযহার পাটোয়ারি অনুভব করে তার আসন্ন বিপদ। আরো উদ্বিগ্ন হয় সে। মাথার ভেতর তখন আর কিছু ঢুকে না। ঠিক তখনি সে একদম নির্বোধের মতো আচমকা মায়রাকে জানের শক্তি দিয়ে একটা ধাক্কা দিসে বসল। মেয়েটা একদম ছিটকে সরে গেল। ইহাম জান ছেড়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল “মায়রা” বলে। চোখে মুখে তার নিস্তব্ধতা আর বিস্ময় আতঙ্ক ভাব। সেই সঙ্গে মায়রার বাহুতে একটা গুলি ছুটে গেল। মাংস ফেটে গলগল করে সঙ্গেসঙ্গে শোণিত ধারা গড়ালো। মায়রা গগন ফাটানো আর্তনাদ শুরু করেছে। কোনো কিছুর সাথে ধাক্কা খেয়ে একদম নিচে গড়িয়ে পড়ল মেয়েটা। হাত থেকে গলগল করে রক্তের ফোয়ারা বইতে শুরু করেছে। ফ্লোর ভেসে যাচ্ছে তাজা গরম র’ক্তে।
মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৩৩
কিন্তু মেয়েটার কেমন যেন হাতের দিকে নজর নেই। মাথায় হাত দিয়ে মায়রা মাটিতে মৃদু নড়াচড়া শুরু করল। লঘু কাতর ভাবে গোঙ্গানোর শব্দ আসছে মেয়েটার গলা দিয়ে। মেয়েটা কেমন নিথর হয়ে আসছে। আস্তেআস্তে নড়াচড়াও কমে আসছে যেন। এদিকে ইহাম একদম পাথর হয়ে গিয়েছে। হাত পা বরফের ন্যায় জমে আছে তার। চোখের দৃষ্টি একদম মায়রার দিকে নিবদ্ধ। দুনিয়ার আর কোনো হুশ যেন নেই তার মাঝে। কেমন প্রাণহীন চোখে অপলক চেয়ে আছে নিথর কাঁপতে থাকা মেয়েটার দিকে। আজকে বোধহয় এমন দৃশ্যটা ইহাম কে সত্যিকারের পাথরে পরিণত করে দিল। নিশ্বাসটাও কোথায় আটকে গিয়েছে। ঢোক গিলার আর কোনো সুযোগ নেই। আচমকা চোখ গুলি ঝাপসা হয়ে এলো। সেই ঝাপসা নেত্রপল্লবে ভেসে উঠল র’ক্ত ফোয়ারায় ভেসে যাওয়া র’ক্তা’ক্ত মায়রার নিথর দেহখানা।