মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৩৫

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৩৫
সাদিয়া

ফেনী সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় বর্ডার ক্রাইম করা এখানে অনেক সহজ। আযহার পাটোয়ারি তেমনি এক ভয়াবহ ক্রিমিনাল। অথরেটি থেকে যে খবর পেয়েছিল তাতেই মুখ গুঁজে বসে থাকেনি সে। নিজেও গোপনে চালিয়েছে অভিযান। আযহার পাটোয়ারি ভারতে অস্ত্র, কালো টাকা, ইয়াবা পাচারের সাথে জড়িত। ভারত থেকে গোপনে এবং অবৈধ উপায়ে এসব আদানপ্রদান করা তার নিয়মিত কাজ। এমনকি ইয়ারা সহ সকল মাদকদ্রব্য সে সারাদেশে সাপ্লাই করে। বর্তমানে মাদকদ্রব্য যুবসমাজ কে ঠিক কতটা ধ্বংসের মুখে ফেলেছে তা বলার অপেক্ষাই রাখে না। আযহার কে ধরতেই এবং মায়রাও ফেণীতে আছে বিধায় নিজের কাজের সাথে আরেকজনের কাজের উদলবদল করে নিয়েছে ইহাম। এর জন্যে অবশ্য তাকে প্রশাসনিক ঝামেলা পুহাতে হয়েছে। CO র কাছ থেকে অনুমোদনও নিতে হয়েছে।

সেদিন রাতে অপারেশনে গিয়ে জানতে পেরেছে হিমেলের বউ এর মামাতো ভাই হয় আযহার পাটোয়ারি। সূত্র টা এত কাছের পেয়ে আর সুযোগ ছাড়েনি ইহাম। রাতেই প্ল্যান করেছে ইবরাহিমের সাথে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বেড়াজালে আযহার আগেই তার প্রাণভোমরায় টান দিয়েছে। পরিকল্পিত প্ল্যান চেঞ্জ করলেও উন্মাদের মতো ছটফট করতে থাকা বিক্ষুব্ধ মস্তিষ্কে আরেক দারুণ নকশা এঁকে নিয়েছিল নিজ মনে। নিজের ব্যক্তিগত মানুষটাকে যেমন পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তেমনি আযহার পাটোয়ারির নাগাল পাওয়ার ছিল উদ্যম মনোবল আর স্পৃহা। তাই তো যখন তার উত্তপ্ত মস্তিষ্কের সেল তাকে সজাগ করেছে, জানান দিয়েছে এক সূত্রের যেটা ওই ঘর থেকেই শুরু।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তখনিই ইবরাহিমের সাথে নিজের নিগূঢ় ছক টাও সাজিয়ে নিয়েছে সে। CO এর মাধ্যমে ফেণীর এক সেনাবাহিনীর ফোর্স পাঠাতে বলে, সেই সাথে HQ এর অনুমতি নিয়ে নেটওয়ার্ক ব্ল্যাকআউট করার জন্যে জ্যামার ব্যবহার করার অনুমতি নিয়েই সে ভেতরে এসেছে। কানে সন্তপর্ণে ব্লুটুথ গুঁজে রেখেছিল নির্দিষ্ট সংকেতের আশায়। জ্যামার পুরোপুরি কাজ করতে তখনো ১০ মিনিটের মতো ছিল তার কাছে। তাই তো এই অবস্থায় এসে মায়রা কে দেখে কলিজা কামড়ে ধরা যন্ত্রণার মাঝেও বকা গিয়েছে ধমাধম। কিন্তু হায় ভাগ্য কি তার সাথে শেষমেশ ছলনার খেলা শুরু করে দিয়েছে নাকি? ঠিক যখন অস্থিমজ্জা সহ উপলব্ধি করল এই মেয়েটা ছাড়া কূলকিনারা বিহীন ছন্নছাড়া দিশেহারা এক পথচারী কেবল ঠিক তখনি ভাগ্য তার সাথে এমন মর্মান্তিক ভাবে ছলনার ছক কষতে পারে না।

যে মেয়েটাকে ছাড়া তার হৃদয়স্পট শুধু ধোঁয়াশা, ধূধূ করা মরুভূমি রূপ সেই মেয়েটাই কি নিয়তির যাঁতাকলে তাকে পিষ্ট করে দিতে চাইছে নাকি? ওই তো কি রকম করে মাটিতে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে আস্তেআস্তে। মায়রা কি তাকে ভৎসর্না করছে এই ভাবে অসহায় রূপে দেখে? নাকি তাকে পৃথিবীর ভয়ংকর এক শাস্তি দিয়েছে তার সাথে কঠিন ব্যবহারের প্রেক্ষিতে? মেয়েটার আশপাশ এমন রক্তে ভিজে টইটুম্বুর হয়ে আছে কেন? মায়রা চুপষে যাচ্ছে যে। মেয়েটা কেন ওভাবে মাটিতে শুয়ে রইল? কথা বলছে না কেন? মেয়েটা কি বুঝতে পারছে না তার ভেতরটা তীব্র যন্ত্রণা, হাহাকার, প্রগাঢ় শঙ্কায় থরথর করে কাঁপছে? বুকের গহীন থেকে আসা ব্যথাতুর করুন চিৎকার গুলি কি শুনতে পাচ্ছে না ওই মেয়েটা? তাকে এভাবে শাস্তি দেওয়ার অধিকার এই বেয়াদব মেয়েটাকে কে দিলো? কোন হারামির পু তের কাজ এটা? মায়রা কোন নিগ্রহের সরোবরে তাকে ডুবিয়ে মারার বদ্ধপরিকল্পনা করছে?

দরজায় বাহির থেকে আসা তীব্র এক শব্দে শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে কেমন কেঁপে উঠল ইহাম। গায়ে ধাক্কা লাগতেই ঝাটকা খেয়ে স্তম্ভিত ফিরে পেল সে। স্বচ্ছ কাঁচের মতো ঝলঝল করে উঠল র’ক্তে রঙ্গিত নিথর হয়ে আসা মায়রার গতরখানা। এইটুকুন শরীরটা নিয়ে শোণিত ধারার উপর মেয়েটা ঠাই পড়ে আছে। ঝাপসা চোখে মায়রার মুদে আসা নেত্রপল্লব দেখেই ভয় যন্ত্রণা তাকে খামছে ধরল। গগন বিদারক এক বিবৎস চিৎকারে কেঁপে উঠে গুটা ঘরটা। ততক্ষণে ঘরে আসা ইবরাহিম, সৌম্যের সাথে ফেণীর ৩ সেনাও নড়ে উঠল নিজেদের জায়গা থেকে। ইহামের পানি টলমলে লাল লাল হিংস্র চোখ দুটি কেমন যেন গা শিউড়ে দেয়। পুরো পাগলের মতো চেঁচিয়ে জীবন ছুটিয়ে দৌড় দেয় মায়রার নিকট। শক্ত হাতে মেয়েটার বাহু চেঁপে মাটি থেকে উঠায়। মৃদু ঝাঁকিয়ে দিয়ে কম্পিত দৃঢ় কন্ঠে শুধায়,

“এই মায়রা চুপ করে থাকার মানে কি? উঠো তাড়াতাড়ি। ফিরতে হবে তো আমাদের। দেখো সব ঠিক হয়ে গিয়েছে।”
ইহাম যেন জ্ঞান শূন্যের মতো মায়রার কে পরপর ডেকেই যাচ্ছে। কিন্তু মেয়ে এবার দুই চোখের পাতা একে বারে বন্ধ করে নিয়েছে। যেন বিগত কিছু পূর্বের কষ্ট গুলি তাকে ক্লান্ত বানিয়ে দিয়েছে। এবার মেয়েটা চুপচাপ ঘুমিয়ে আছে। বন্ধ চোখের পাতায় ক্লান্তি বিষাদের ছাপ।
ইবরাহিম কি করবে তার মাথায় কিছুই আসছে না। ক্রিমিনাল ধরার গুরুতর কাজটাও যেন ভুলে বসেছে সে। অনড় চোখের মনিতে কেবল অস্বাভাবিক ক্যাপ্টেন কে দেখার আকুলতা। চিরপরিচিত সবসময় এক স্বভাবে থাকা মানুষটার এমন এলোমেলো উন্মাদ রূপ আর খাপছাড়া কথা বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে ইবরাহিম কে। দৃঢ় মনোবল আর অদম্য সাহসিকতা লোকটার অবুঝপানায় সে নির্লিপ্ত।

“এই মেয়ে ডাকছি শুনতে পাচ্ছো না? মায়রা উঠো বলছি। দেখো আমার আর ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না। মেজাজ বিগড়ে যাবে পরে আরো বকা খাবে তুমি। তাড়াতাড়ি উঠো বলছি। শুনতে পাচ্ছো তুমি? উঠো মায়রা।”
ইহাম পাগলের প্রলাপের মতো অনর্গল ডাকতে লাগল মায়রা কে। অবুঝ বেপরোয়া ইহাম বুঝতেই চাইছে না নিজের ব্যক্তিগত মানুষটার ওই করুন হাল। সে একেবারে জেদ্দি হয়ে ডেকে গেল মায়রা কে। ইহামের টিমের বাকিরা আর শহর থেকে আগত সৈনিক মিলে পরিস্থিতি সামাল দিতে উঠেপড়ে লেগেছে। সেদিকে ইহামের বিন্দুমাত্র মনোযোগ নেই। তার ধ্যান সবটা মায়রার নিকট। বুকের জ্বলন টা আরো বাড়ছে মেয়েটার কথা না বলায়। এবার কিছুটা কঠিন স্বরে বলে উঠল,

“এ্যাই মায়রা কথা বলছো না কেন? দেখো এবার বিরক্ত হচ্ছি আমি। তুমি তো জানো আমি কি রকম। এখন হুট করে রাগ উঠলে কিন্তু যা মন চায় তাই বলেই বকব। খুব বকা খাবে। তাই আমায় না রাগিয়ে তাড়াতাড়ি উঠো।”
মায়রা একদম নিস্তব্ধ নিঃশব্দ। মেয়েটা বুঝি গতর ছেড়ে দিনদুনিয়ার সব চিন্তা চেতনা ভুলে ঘুমাতে বসেছে। হাত পা গুলি ঠান্ডা হয়ে এসেছে। র’ক্তের ধারা বাড়ছে। ইহাম এবার রেগে দাঁত কেটে বলে,
“এই বেয়াদব কখন থেকে তোকে ডাকছি শুনতে পাচ্ছিস না? উঠবি নাকি গালে ঠাস করে লাগাব আমি? আমার সাথে বেয়াদবি না করলে তোর চলে না না? মায়রা ভালোয় ভালোয় উঠ বলছি। আমার মেজাজ কিন্তু খারাপ হয়ে আছে। এত বড় স্পর্ধা তুই কোথায় পেলি আমার ডাকে না উঠে শুয়ে আছিস? দেখ মায়রা জান আমার প্লিজ তাড়াতাড়ি উঠে পড়। এবার আমার সত্যি খুব বিরক্ত লাগছে। প্লিজ জান উঠ।”

ইহামের পাগলামি দেখে ইবরাহিম স্তব্ধ। তার অবাক বিস্ময় ভাব সেই পর্যায়ে গিয়েছে যে এগিয়ে গিয়ে যে ইহাম কে কিছু বলবে তার সাহসই হচ্ছে না। মূলত সে কল্পনাতেও কোনো দিন হয়তো ইহাম কে এভাবে ভাবেনি। ইহাম যেন পাগল হয়ে উঠেছে নিজের স্ত্রীর জন্যে। এই মর্মান্তিক ঘটনা সে মানতে না চেয়েই বরং যেন জোর করে হলেও মায়রা কে টেনে তুলে সে। কিন্তু এভাবে চুপ করে থাকাও তো যাচ্ছে না। মায়রার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সময়ের সাথে সাথে খুব খারাপ কিছু হবে।

“এ্যাই জান। শুন না আমার কথা।” এবার ইহামের গলা কাঁপছে। বড্ড আদুরে শুনাচ্ছে তার কন্ঠ। “প্লিজ লক্ষ্মীটা আমার উঠ। দেখ তোর জন্যে আমার বুকের ভেতরটা দাপাচ্ছে। আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে দমটা বন্ধ হয়ে আসছে রে। প্লিজ আমায় শাস্তি দিস না আর কষ্ট না দিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে পড়।” এক বাহুতে মায়রা কে খুব আলতো করে চেঁপে ধরে অন্য হাত দিয়ে আদুরে আদুরে স্পর্শ লেপ্টে দিচ্ছে তার মুখের উপরে। কম্পিত ঠোঁট গুলি নাড়িয়ে ললাটে মৃদু চুমু খেতেই ইহাম বৃষ্টির মতো ঝরঝর করে কেঁদে উঠল। তার কান্নার দাপট ইবরাহিম কে যেন ভিন্ন কোনো গ্রহে নিয়ে গিয়েছে। পুরো হতভম্ব হয়ে গিয়েছে সে। দ্রুত এগিয়ে গেল। কিছু বলবে তার আগেই ইহাম বুক ফাটা চিৎকারে বলতে লাগল,

“এ্যাই আমার মিসেস পিচ্চি চৌধুরী আমাকে শাস্তি দিবি, বকবি ঝগড়া করবি বেয়াদবি করবি যা ইচ্ছা করিস আমার সামনে থেকে করবি। প্লিজ জান আমার, আমার ভেতরটা আর জ্বালাস না। তুই চোখ খুল কথা বল আমার সাথে। তুই শুধু আমার বুকে থাক আমি এটুক চাই। জান প্লিজ কথা বল। আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে তোর তীব্রতা ছেয়ে গেছে জান, সে গুলি না কাটিয়ে তুই আমায় শাস্তি দিতে এভাবে নীরব হতে পারিস না।”

ফেণীর হাসপাতালে নিতে নিতে এখানে অনেকটা সময় লস হয়ে গিয়েছে। ততক্ষণে মাথা আর বাম হাত দিয়ে রক্তক্ষরণের মাত্রা বেশ বেড়েছে। পুরো গাড়িতে মায়রা চোখ মুদে ছিল গভীর ভাবে। আর ইহামের বুকে চলছিল ভয়ংকর জলোচ্ছ্বাস। এক বিন্দু স্বস্তি নামক অনুভূতি টা ঠায় পায়নি তার হৃদয়ের গভীরে। পুরোটা পথ কেবল মায়রার রক্তে চুয়ে পড়া মাথাটা বুকের সাথে লাগিয়ে রেখেছে। বিড়বিড় করে বুলি আওড়েছে, “এ্যাই জান, চোখ খোল। দেখ সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই প্লিজ চুপ থাকিস না। তাকিয়ে দেখ। এ্যাই মায়রা?”

হাসপাতালে পৌঁছে সিনিয়র ডক্টর মায়রার অবস্থা ক্রিটিকাল দেখে সঙ্গেসঙ্গে জবাব দিয়েছে ঢাকা ট্রান্সফার করাতে হবে। গুলিবিদ্ধ হাতের অবস্থা নাজুক। মাংসের ভেতর ঢেবে উপরের অংশ কেবল বিন্দু আকার ধারণ করেছে। থেঁতলে যাওয়া মাংস দিয়ে ঢেকে গেছে পুরো ক্ষতটা। কালশিটে হয়ে এখনো চুইয়েচুইয়ে তাজা রক্তের দেখা মিলছে। নির্ঘাত অস্ত্রপাচারের মাধ্যমে সেটা বের করতে হবে। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ডক্টর ঢাকায় ট্রান্সফার করার কথা বলতেই তেলে বেগুনে ফুঁসে উঠে ইহাম। ডক্টরের সাদা ইউনিফর্মের কলার চেঁপে ধরে আগুন ঝরা কন্ঠে নিজের ক্রোধ প্রকাশ করে।

“কোন বা’লের ডাক্তারি পাস করেছিস তুই? একটা রোগীকে ভালো করে না দেখে কি করে এই কথা বলতে পারিস? তোকে সার্টিফিকেট কোন ম’গার বাচ্চা দিয়েছে? এখনি ঠিক কর ওকে।”
“আরে আশ্চর্য। ছাড়ুন। কলার ছাড়ুন। কি করছেন কি আপনি। পেশেন্টের অবস্থা শোচনীয়। বড় ধরনের ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে আগে তার দিকে খেয়াল করুন।”
ইহামের টিমের দুজন সোল্ডার তাকে ছাড়িয়ে নিল। ইবরাহিম ক্ষীণ গলায় জানায়,
“কি করছেন কি ক্যাপ্টেন? শুধু শুধু ঝামেলা বাড়াচ্ছেন আপনি। শান্ত হোন প্লিজ।”
ইবরাহিমের কথায় কোনো জবাব না দিয়ে ইহাম ডাক্তারের দিকে রক্তচক্ষু ভাবে তাকাল। বিক্ষিপ্ত গমগম আওয়াজে বলল,

“প্রাথমিক যা যা লাগে তা ইমিডিয়েটলি করুন। একটুও যেন আর রক্ত না ঝরে। ফাস্ট করুন।”
শেষের কথাটা চেঁচিয়ে বলে ইহাম লম্বালম্বা পায়ে সেখান থেকে চলে। কেমন পাগল পাগল হয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে ফোনে কোনো নাম্বার খুঁজে চলেছে। কাউকে কিছু একটা বলে আবারও অস্থির হয়ে চলে এলো। তার এমন অস্থির পাগল পাগল ভাব দেখে কেঁদে উঠেন শিরিন বেগম। ছেলের গায়ে মমতার আদর বুলাতে বুলাতে বলেন,
“বাপ আমার। এমন করিস না। একটু শান্ত হো তুই।”
“পারছি না মা। এটা করতেই পারছি মা।”

“এমন করে না বাবা। কিছু হবে না। একটু স্থির হো তুই। এত অস্থির হলে তোর শরীর খারাপ করবে।”
প্যান্টের প্যাকেট থেকে ফোনের বিপবিপ আওয়াজে বিরক্ত হলো ইহাম। তাকিয়ে দেখে মায়রার মা কল দিয়েছে। এই সময়ে উনার কল পাওয়াটা যেন তাকে আরো বিরক্ত দেখালো। কালো প্যান্টের সাথে জড়ানো সাদা শার্টটা মায়রার তাজা উষ্ণ রক্তে মাখোমাখো হয়ে আছে। এই শার্ট টা গা থেকে খুললে আর পরার উপযোগী হবে না। হাত এবং মুখের কিছু অংশেও রক্ত শুকাতে আরম্ভ করেছে। সেই অবস্থাতেই কল বেজে চলা ফোনটা হাতের উপর উঁচু করে শ্রাগ গলায় বলে, “উনাকে কে খবর দিয়েছে?” সবাই তার এই প্রশ্নে চুপ থাকা দেখে ইহাম মেজাজের খেঁই হারিয়ে বসল। হাসপাতালের করিডোরেই গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে বলল,

“কি হলো? বলছো না কেন? উনাকে কে জানিয়েছে?”
“আমি বলেছি” নরম সুরে জবাব দিলেন ইসহাক চৌধুরী। “উনাদের একটামাত্র মেয়ে মায়রা। তার এই করুণ অবস্থার কথা উনাদের জানাব না? পরে কিছু একটা হলে তখন কি হবে?”
“তুমি নিজের উকিলি বুদ্ধি ফলাচ্ছো মায়রার বিষয়ে? আগেভাগেই নিজেদের উপর থেকে দোষ ঝাড়তে চাইছো তাই তো?”
“তুমি যেটা ভাবছো সেটা নয় ইহাম।”

“আর কি বললে? কিছু হবে মানে? কিচ্ছু হবে না। ওই বেয়াদব মেয়েটার কিছু হতেই পারে না। আমাকে শাস্তি দিতে কষ্ট দিতে এমন সে কখনোই করতে পারে না। ওর কিছু হতেই দিবো না আমি। ওর যদি কিছু হয় তবে তো আমার জীবনটাই বৃথা। কি হবে আমার? যেখানে যদি নিজের বউ কেই বাঁচাতে না পারি সেইফ রাখতে না পারি তবে দেশের কোটিকোটি মানুষের নিরাপত্তায় কাজ করব কি করে আমি? আমি তো ব্যর্থ।”
“বাবা আমার ভেঙ্গে পড়ো না। নিজেকে একটু শক্ত করো ইহাম।”
“তুমি যে উনাদের খবর দিলে। এখন কি জবাব দিবো আমি? উনাদের আদরের মেয়েকে আমি সুরক্ষা দিতে পারি নি। সেইফ করতে পারিনি। ইভেন এখন পর্যন্ত সঠিক ট্রিটমেন্ট পর্যন্ত দিতে পারছি না সেই অপারগতা কিভাবে জানাব আমি ওদের? কোন মুখে উনাদের সাথে কথা বলব? কি জবাব দিবো উনাদের আদরের মেয়ের পরিণতি নিয়ে?”

ইসহাক চৌধুরী জবাব দিলেন না। ছেলের ভঙ্গুর গলা উনার ভীত নড়িয়েছে। ইহামের চেহারায় স্পষ্ট করুন গলায় কাতর ভাব। যেন সর্বস্ব হারিয়ে দিশেহারা সে।
খুব ভেবে চিন্তে তৃতীয় বার আসা কলটা রিসিভ করল ইহাম। সঙ্গেসঙ্গে ওপাশ থেকে হাউমাউ করে কান্নার শব্দ ভেসে এলো। উনার কান্না ইহামের এলোমেলো হৃদয়কে আরো অগোছালো করে দিল। হৃদয়টা দুরুদুরু করল কষ্টে। গলা ধরে আসছে। চোখের পাতা ভারী হচ্ছে ক্রমে।
“বা বাবা আমার মায়রা..”
এতটুক বলেই আবারও কান্নার আওয়াজ শুনা গেল। আহারে কাল রাতে ছেলেকে নিয়ে ছুটেছেন হাসপাতালে আজ আবার মেয়ের এই অবস্থা শুনে বাবা মার মন না জানি কতটা পু’ড়ছে। ফোনটা মায়রার বাবা মহিন সাহেব নিয়ে ভাঙ্গা গলায় প্রশ্ন করলেন,

“বাবা আমার মেয়ে? ও ঠিক আছে তো? চিন্তার কিছু কারণ নেই তো? আমার মায়রা কোথায়?”
“চিন্তা করবেন না। ওকে নিয়ে ঢাকা আসছি। হাতে সময় নেই। আপনি দয়া করে ওদিকটা সামলে নিল। চিন্তা না করে দোয়া করুন প্লিজ।”
বুক ফেটে আসছে ইহামের। দ্রুত কল কেটে সে মুখ ঘুরিয়ে চোখের গহ্বরে লুকিয়ে থাকা এক বিন্দু পানি যেটা আঁখির পাতায় এসে ঠেকেছে সেটা কেউ দেখার আগেই মুছে নিল সন্তপর্ণে। ভাড় হয়ে আসা গলায় শুকনো ঢোকটাও গিলে নিল সে। বুকের ভেতরটা দহনের আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে যাচ্ছে। অসহনীয় যন্ত্রণায় ছটফট করছে অন্তঃকরণ।
“আমাদের আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। দ্রুত এম্বুলেন্স ঠিক করা জরুরি।”
শক্ত গলায় বললেন ইসহাক চৌধুরী।
“৫/৭ মিনিটের মাঝেই চলে আসবে। সেটা নিয়ে ভাবতে হবে না।”

কেমন উদাস বিষণ্ণ গলায় বলল ইহাম। মলিন মুখটার ওপাশে তীব্র যন্ত্রণায় মুখটা বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। ইচ্ছা হচ্ছে চিৎকার করে বলতে “আমাকে এমন শাস্তি দিও না মায়রা। দেখো এখনি আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি। এমন কঠিন হইও না আমার উপর মায়রা। তুমি তো দেখছি আমার চেয়ে বেশি কঠিন হয়ে আমাকে শাস্তি দিতে চাইছো মেয়ে। এমন করলে তো আমি বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাবো। ফিরে এসো। প্লিজ জান ফিরে এসো।”
বিকেল চারটার মতো হবে হয়তো। হাসপাতালের বিশাল মাঠে আকাশে গর্জন তুলে ঝাঁকুনি দিয়ে ধুলোবালি উড়িয়ে সেনাবাহিনী তে ব্যবহৃত MI-171Sh মডেলের একটা হেলিকপ্টার এসে থামল। হেলিকপ্টারের বিশাল ব্লেডের বাতাসে আশপাশে যেন ধুলোরঝড় শুরু হয়েছে। ডানা ঝাপটানোর বিকট শব্দে চারপাশ কাঁপছে।

এত আওয়াজে হাসপাতালের শতশত জোড়া চোখ উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে বিষয়টা দেখার জন্যে। এই হাসপাতালে কোন বিআইপি লোকটা আছে যার জন্যে হেলিকপ্টার চলে এলো? নিজেদের ব্যস্ততা ভুলেও অনেক গুলি লোক হেলিকপ্টারের দিকে চেয়ে আছে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে। তাদের চোখে মুখে খেলছে বিস্ময় আর কৌতূহল। ইবরাহিম হতবাক হয়ে গেল। এত অল্প সময়ে ক্যাপ্টেন কি করে হেলিকপ্টার জোগাড় করে নিল? আর যাই হোক ভেতরে অসুস্থ র’ক্তা’ক্ত হয়ে শুয়ে থাকা তরুণী যে ইহামের কাছে কতটুক দামী তা আজকে হাড়েহাড়ে টের পেল সবাই। কিন্তু আফসোস যার জন্যে এই বাঁধনহারা উদ্বিগ্ন আর উন্মাদনা শুধু সেই দেখল না।

মায়রার চোখের পাতা ঢুলুমুলু করছে। আধোআধো ইহামের মুখটা দেখতে পাচ্ছে সে। তিড়তিড় করে কাঁপা খরায় শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট গুলি নিয়ে কিছু বলতে চাইছে সে। কিন্তু পারছে না। ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুল টা নাড়িয়ে হয়তো ধরতে চাইল ইহাম কে কিন্তু ক্ষীণ অসাড় শরীরে বুঝি অবশিষ্ট শক্তিটা নেই। ইহাম চটজলদি শক্তভাবে চেঁপে ধরল মায়রার হাতটা। হাতে, কপালে সাদা ব্যান্ডেজের উপর দিয়েই ভেসে উঠেছে ছোপছোপ র’ক্তের দাগ। ব্যান্ডেজ জড়ানো হাতে উল্টোপিঠে গভীর ভাবে চুমু খেলো ইহাম। ব্যথায় বুকের হাড় ভেঙ্গে আসে তার। মেয়েটাকে এই অবস্থায় কিছুতেই দেখতে পাচ্ছে না সে। বুকের ভেতর ঝলকে র’ক্ত উঠছে কোনো এক অজানা কারণে। দহন গুলি গলা চেঁপে ধরেছে তার।

“জান, প্লিজ জান আর চোখ বন্ধ করো না। তাকিয়ে থাকো। দেখো কিচ্ছু হবে না। আমি আছি। একটু অপেক্ষা করো। তোমার কিচ্ছু হতে দিবো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। ভরসা রাখো আমার উপর।”
মায়রা আস্তেআস্তে আবার চোখ মুদে নেয়। তা দেখে চিৎকার করে উঠে ইহাম।
“ওই বেয়াদব মেয়ে আমার কোনো কথাই কি তোর শুনতে ইচ্ছা হয় না? আমার সব কথাতেই তোর বেয়াদবি করতে হবে না? বললাম চোখ বন্ধ করিস না ঠিকি বেয়াদবি করে সেটাই করলি। কি ভেবেছিস তোকে এমনি ছেড়ে দিবো আমি? আমাকে পাগল বানিয়ে তুই চলে যেতে চাস? আমার থেকে নিস্তার পাবি তুই? তোকে তো ফিরতে হবে। আমার কাছে ফিরতেই হবে তোকে মায়রা।”

তৎক্ষণাৎ মায়রা কে কোলে তুলে নিল। নিজের শরীরের সব টুক শক্তি দিয়ে যত টুক দ্রুত সম্ভব হেটে নিচে নামল। মাঠের দিকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটতে লাগল মায়রা কে নিয়ে। যত তাড়াতাড়ি ঢাকায় যাওয়ায় যায় সেই চিন্তা ইহামের। তার ভেতরে নিগূঢ় উত্থান তৈরি করেছে এই বিধ্বস্ত মায়রা।

হেলিকপ্টারের ভেতরে ঢাকা কম্বাইন্ড মিলিটাররি হাসপাতাল (CMH) এর একজন ডক্টর আর একজন নার্স উপস্থিত। মায়রা কে কোলে নিয়ে আগে ভেতরে প্রবেশ করল ইহাম। স্ট্রেচারের আলতো করে শুয়িয়ে দিয়ে কাউকে তোয়াক্কা না করে আদুরে ভিজে ঠোঁট ছোঁয়ে দিল নিস্তেজ মায়রার ললাটে। হেলিকপ্টারের ভেতরটা একটু বিস্তৃত, ধূসর রঙের মেটাল বডির। চারপাশে শক্ত ধাতব ফ্রেমের আসনগুলো লম্বা লাইনে বসানো। মাঝখানে ফাঁকা জায়গা আছে। যেখানে এখন স্ট্রেচার পেতে শোয়ানো হয়েছে মায়রা কে। একপাশে ছোট ছোট হুক-রডে ঝুলছে অক্সিজেন সাপোর্ট সিলিন্ডার। স্ট্রেচারের পাশেই বেঁধে রাখা মেডিকেল কিট — ভেতরে সার্জিক্যাল ইকুইপমেন্ট, ব্যান্ডেজ, ওষুধপত্র। ছাদ বরাবর তার ঝুলছে। কমিউনিকেশন কেবল আর ইন্টারকম। মায়রা কে দ্রুত অক্সিজেন মাস্ক পড়ানো হলো। নার্স দ্রুত হাতে স্যালাইন টা পুশ করে পালস চেক করল। হেলিকপ্টারের ভেতরে একে একে ইসহাক চৌধুরী, শিরিন বেগম, শিফুয়া উঠে বসল। সেনাবাহিনীতে ব্যবহৃত এই হেলিকপ্টার বেশ বড় থাকায় অনায়াসে ১৮/২০ জন যেতে পারে। তাই ইবরাহিম সাথে তাউসও উঠে বসল। সামনে পাইলটের ককপিট থেকে মৃদু বার্তা আসে ইন্টারকমে
“ETA: 25 minutes to Dhaka! Hold tight!”

আবারও আকাশ কাঁপিয়ে ধুলোবালি উড়িয়ে মাটি থেকে উপরে উঠতে লাগল বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর মিশন গ্রেড অপরেশনে ব্যবহৃত MI-171Sh মডেলের হেলিকপ্টার টা। ভেতরের বাতাস ভারি। কাঁপা কাঁপা শব্দে এগিয়ে চলছে রটার। প্রচণ্ড আওয়াজে কথা বলা অসম্ভব প্রায়। পুরো হেলিকপ্টার হালকা দুলছে, যেন বাতাসের সাথে যুদ্ধ করে এগিয়ে যাচ্ছে।
ইহাম পাশে বসে মায়রার হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে। তার জ্বলন্ত নজর কেবল মায়রার দিকে স্থির। নার্স মাঝে মাঝে মায়রার ভিটাল চেক করছে, ডাক্তার অক্সিজেনের মাত্রা চেক করে যাচ্ছে। তীব্র আওয়াজে কোনো কিছু শোনার উপায় নেই কেবল ইন্টারকম হেডসেট ছাড়া। ইহামের ভেতরে তখন তোলপাড় চলে। হৃদয়ে তীব্র কম্পন চলছে। মনে হচ্ছে এই দুনিয়ায় আলোড়ন করা সহস্র শব্দের মাঝে কেবল মাত্র মায়রার নিশ্বাসের ধ্বনিটুক তাকে পুলকিত করুক।

গুনগুন করে শিরিন বেগম কান্না করেই যাচ্ছে। শিফুও চুপচাপ বসে থেমে থেমে চোখের পানি ফেলছে অল্প আঁচে। ইসহাক চৌধুরী কেও কেমন উত্তেজিত আর চিন্তিত দেখাচ্ছে। এদিকে এক রত্তি স্থির থাকতে পারছে না ইহাম। CMH এর ইমারজেন্সি কক্ষের বাহিরে অস্থির বেগে ছটফট করে পায়চারি করছে শুধু। চোখ ফুলে উঠেছে। দেখে বুঝাই যাচ্ছে তার ভেতরে কেউ আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে আর সে সেই জ্বলন সইতে না পেরে ছটফট করছে। ভেতরের উদ্রেক অশান্তি ভাব তড়তড় করে বাড়ছে। বুকের বা পাশের সুচালো ধারালো যন্ত্রণা গুলি তার ভেতর চঞ্চল আর উদ্বিগ্ন করে তুলছে। তীব্র অস্থিরতা আর উদ্রেক ভাবে ইহাম ধপ করে একটা চেয়ারে বসে। নিশ্বাসটা নিদারুণ ভাবে আটকে আসতে চাইছে বলে মুখ হা করে দম দিচ্ছে। ছেলের ভেতরের অবস্থার কথা আঁচ করতে পেরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন শিরিন বেগম। এগিয়ে গেলেন তার কাছে।

“বাপ আমার এতো চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই একটু শান্ত হো।”
“মা, ও মা” ইহামের গলা জমে আসে। উদ্বিগ্নতায় বুক কাঁপে তার কথা বলতে। “মা দেখো মায়রা কথা বলছে না আমার সাথে। মেয়েটা কত বেয়াদব হয়েছে দেখেছো তুমি? আমার কথা শুনতেই চায় না। কেমন করে একটা বাচ্চা মেয়েকে আমার ঘাড়ে ঝুলিয়ে দিয়েছো দেখছো? জীবনটা তেজপাতা বানিয়ে দিচ্ছে মাথামোটা মেয়েটা। আর এখন তো আমাকে শাস্তি দিতে চেয়ে কথা বলাই বন্ধ করে দিতে ব্যস্ত হয়েছে। কেমন বেয়াদব দেখেছো?” বক্ষের গহীনে জন্ম নেওয়া পীড়ার যাঁতাকলে কম্পিত কন্ঠে আওড়ালো, “মায়রার কিছু হবে না তো মা? ও আবার ঠিক হয়ে যাবে তো? আমার ডাকে সাড়া দিবে সে? ডাক্তার বের হওয়ার পর যদি ও আমার সাথে কথা না বলে মা তুমি দেখো কিন্তু ওকে আমি খুব বকব। ওকে এত সাহস কোন বা’ল চাল দিল আমার সাথে কথা না বলার? কলিজাটা দিন দিন বড় হয়ে গিয়েছে মেয়েটার। ও কি ভেবেছে? ও চুপচাপ শুয়ে থেকে আমাকে পাগল বানাবে? তা হয়? আমার কি এত সময় আছে নাকি?”

ইহাম স্থির ভাবে বসতেও পারছিল না। শরীর কাঁপছিল, অস্থির ভাব। শূন্যে তাকিয়ে পাগলের মতো কিছু বিড়বিড় করছিল। তার ওই উন্মাদ মুখাবয়ব মায়ের মন আরো গলিয়ে দেয়। ডুকরে কাঁদেন শিরিন বেগম। ভেতরের কষ্ট সইতে না পেরে গলা কাটা মুরগির মতো ছটফট করছে ছেলেটা তবুও নিজেকে কঠিন দেখানোর চেষ্টা করছে। খুব বেশি আঘাতের ফলে যে ছেলে আজেবাজে প্রলাপ বকছে তিনি তা বেশ বুঝতে পারছেন। ইহামের ওই এলোমেলো ছন্নছাড়া রূপটা উনাকে আরো কষ্ট দিচ্ছে। ইসহাক চৌধুরী ছেলের কাছে এসে কাঁধে হাত রাখেন। ইহাম বসা অবস্থায় গলা উঁচিয়ে দেখে নেয় বাবা কে। শুকনো ঢোক গিলে। মুখের হাবভাব বিধ্বস্ত করুন। চোখ গুলি লাল টকটকে হয়ে আছে। ঘামে চিপচিপে মুখটা মলিন বিষাদে ঘেরা। সবসময় দূরত্ব বজায় রাখা ছেলের মনটা তিনি চট করে পড়ে ফেললেন। নরম কন্ঠে বললেন,

“ধৈর্য ধরো বাবা। এত ভেঙ্গে পড়ছো কেন? সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“ধৈর্য ধরব? তাও মায়রার বিষয়ে? উঁহু সম্ভব না বাবা। প্রসঙ্গ টা যখন ওই বেয়াদব মেয়েটা কে ঘিরে তখন আমি বরাবরি ধৈর্যচ্যুত ব্যক্তি। ওর কোনো বিষয়ে ধৈর্য শব্দটা গ্রহণযোগ্য নয়।”
ইসহাক চৌধুরী অবাক হলেন ছেলের কথায়। ইহাম ছোটবেলা থেকেই নিজের আবেগ ভালোলাগা প্রকাশ করে কম। এটা বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব টা যেন তার আশেপাশের সকলের। সেই ছেলে আর বউ এর জন্যে এই ধরনের কথা বলছে? এই কথাতেই তিনি বুঝে নিয়েছেন বউ এর প্রতি উনার শক্ত মনের ছেলেটার অনুভূতির কথা। ছেলের ভেতরে মায়রার বাসস্থানের বিষয়টা তিনি বেশ অনুধাবন করতে পেরেছেন। সেই সাথে বুঝলেন ছেলের মনের বর্তমানে অবস্থার কথা। এর পৃষ্টে তিনি কি বলে সান্ত্বনা দিবেন বুঝলেন না।

“আধঘণ্টার মাঝে যদি ওই বেয়াদব আমার কথার জবাব না দেয় তখন বুঝাবো আমি। আমার কথা না শুনার জন্যে ওর মজা বুঝাবো আমি। কি ভেবেছে ওকে ধমকায় বলে কি আমাকে এই ভাবে শাস্তি দিবে? ও কি চাইছে আমি ওর জন্যে সব কাজ টাজ ভুলে পাগল হয়ে যাই? আমাকে অস্থির করে ও কি মজা পাচ্ছে? ওর সব ধরনের বেয়াদবি মেনে নিলেও ও কি ভেবেছে আমি এই ধরনের বেয়াদবি মেনে নিব? কখনোই না।”
উন্মাদের মতো ইহাম ব্যাকুল ভঙ্গিমায় অনর্গল এই ধরনের কথাই বলছে। ছেলের ভয়াবহ বিপর্যয় দেখে শিরিন বেগম কাঁদতে থাকেন। তবে ইসহাক চৌধুরী কে বেশ চিন্তিত দেখালো। তিনি ভীষন শঙ্কিত ছেলের চাঁপা আহাজারি তে। এখন তিনি অন্য ভয় পেতে লাগলেন। আল্লাহ না করুক মায়রার ভালো মন্দ কিছু একটা যদি হয় কারণ মেয়েটার অবস্থা মনে হচ্ছে না ভালো। এমন কিছু যদি হয় তবে ইহামের অবস্থা কেমন হবে তা নিয়ে খুব আশংকায় পড়েছেন তিনি।

বেশ সময় নিয়ে ডাক্তার রুম থেকে বের হতেই শৃঙ্খল ভাঙ্গা হিংস্র নেকড়ের মতো ছুটে এলো ইহাম। ক্ষিপ্র ভঙ্গিমায় প্রশ্ন ছুড়ল দারুন গতিতে।
“মায়রা? মায়রা কেমন আছে ডক্টর? ও কথা বলতে পারবে এখন?”
ইহামের প্রশ্নের ঝড়ে সেকেন্ড কয়েকের জন্যে ডাক্তার নিজেই যেন থমকালো। অদ্ভুত চোখে এক পলক দেখে নিল ভীতিগ্রস্ত এলোমেলো এক উন্মাদ মানব কে। উনার হাতে জড়ানো সাদা গ্লাবসটা তাজা শ্বেত বর্ণে টকটকে আছে। সেই তাজা বর্ণে স্পর্শ করলেই বুঝি প্রেয়সীর শরীরের উষ্ণতা অনুভব করা যাবে। সুচালো নজরে সেই র’ক্ত পরখ করেই আবার বিস্রস্ত কন্ঠে জিজ্ঞাস করে উঠল,
“কি হলো আপনি আবার চুপ করে আছেন কেন?”
“দেখুন মিস্টার ইহাম চৌধুরী আপনি আগে শান্ত হোন। আমার কথাটা শুনুন আগে।”

ডাক্তারের মুখ আর কথার পিষ্টে না বলা ইঙ্গিতটা যে সুখকর নয় সেই আঁচটা শিরায় শিরায় ধাবিত হলো। মুহূর্তে রেগে উঠল। কেমন চিবিয়ে চিবিয়ো শ্লথ আওয়াজে প্রশ্ন করে, “ভাব না দেখিয়ে কি বলবেন সরাসরি বলুন। এত ভঙ্গিমা আবার আমার সহ্য হয়না।” ইহাম রেগে আছে। দাঁতে দাঁত কেটে কেবলি অপেক্ষা করছে ডাক্তারের মুখ থেকে সত্যি ঘটনাটা শুনার জন্যে। ইহামের ভেতরের তোলপাড় করা তাণ্ডব পাশে দাঁড়ানো ইসহাক চৌধুরী বেশ বুঝলেন। তিনি শঙ্কিত তবুও ভরসার হাত ছেলের কাঁধে রাখতেই সে জ্বলে উঠে কেমন।
“বাবা ডাক্তারের লীলা বন্ধ করে বলতো বলো তো হয়েছে টা কি? কি বলতে চায় উনি? আমি জিজ্ঞেস করলাম মায়রা কথা বলতে পারে কি না তিনি সেই উত্তর না দিয়ে কেমন সঙ্গ সেজে দাঁড়িয়ে আছে। মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে আমার।”

ইহামের এই সরাসরি বেহাজ পূর্ণ কথায় ইসহাক চৌধুরী বেশ লজ্জায় পড়ে যান। বিব্রত বোধ করে অসহায় চোখে তাকান ডাক্তারের দিকে। পাশেই চিন্তিত ক্রন্দনরত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছেন শিরিন বেগম আর শিফুয়া। ডাক্তার বোধহয় বুঝলেন ইহামের খিটখিটে রগচটা মেজাজ টার কারণ। তিনি ধীর ভাবে নম্র গলায় জানালেন,
“পেসেন্টের অবস্থা বিপদমুক্ত তা বলতে পারছি না। বেশ আশংকা জনক। হাতের গুলিটার চেয়ে মাথায় পাওয়া আঘাতটা বেশ গুরুতর। এত গভীর আঘাত পাবার ফলে রোগীর মাথায় মাইনর স্কাল ফ্র্যাকচার হয়েছে। ৪৮ ঘন্টা অবজারভেশনে রাখতে হবে। জ্ঞান ফিরতেও ৬-১২ ঘন্টা প্রয়োজন। এর বেশিও লাগতে পারে। শরীর থেকে রক্তপাতও হয়েছে খুব বেশি। হাতের অবস্থাও খুব ভালো নয়। রোগীর জন্যে বিষয়টা ক্রিটিকাল।”
এই টুক কথা শুনেই সারাশরীরে গরম র’ক্ত ছলাৎ করে প্রভাবিত হতে লাগল দ্বিগুণ গতিতে। দাঁতে দাঁত পিষে বাঘের থাবার মতো ইহাম চেঁপে ধরে ডাক্তারের সার্জিক্যাল গাউন। হিসহিসে বলে,

“একদম উল্টাপাল্টা কথা বলবেন না। কি আবোলতাবোল কথা বলছেন টা কি আপনি। শেখানো বুলি ছাড়ছেন? ভেতরের ওই মাথামোটা বেয়াদব মেয়েটা আমাকে শাস্তি দিতে আপনাকে এসব শিখিয়ে দিয়েছে তাই না? এর জন্যে আগে আপনাকে ধরব তারপর ওই গর্দভ টাকে।”

ইহামের উদ্ধতপূর্ণ আচারণে স্তব্ধ হয়ে গেল ইসহাক চৌধুরী। দূর থেকে এতক্ষণ ইবরাহিম নিজের ক্যাপ্টেনের সব বেপরোয়া ভাবই দেখে গিয়েছে। কিন্তু ক্যাপ্টেন এখন কোন ধরনের পাগলামো শুরু করল? যে ভাঙ্গা উন্মাদনায় লিপ্ত হয়েছে ক্যাপ্টেন তার ফলাফল কি তিনি জানেন না নাকি? এই ডক্টর যদি আর্মির মেডিকেল কর্পসের কাছে কোনো রকম অভিযোগ করে তাহলে কি হবে ভাবলে তার নিজরই গা শিউড়ে উঠছে। আর্মিদের গুরুতর একটা অপরাধ আন্তঃবাহিনী নিয়ম ভাঙ্গের অপরাধে ক্যাপ্টেন কে অফিসিয়ালি সতর্কবার্তা, জরিমানা এমনকি পদাবনতিও হতে পারে। এত দিনে গড়ে তুলা জবের এই নিখুঁত ইমেজে দাগ লাগানোর জন্যে কেন এমন ব্যস্ত হয়েছেন তিনি? এত দিনের এত গুলি অপরেশনে সবসময় ইহাম কে দেখে এসেছে যে কোনো ভয়াবহ মুহূর্তেও কেমন ঠান্ডা মস্তিষ্কে কাজ করে পরিস্থিতির লাগাম টানতে। কিন্তু এখন এই একটা বিষয়ে কি ওই দৃঢ় মনোবল আর গাঢ় ব্যক্তিত্বের মানুষটা নিজের উপর ধৈর্য রাখতে পারছে না? ইবরাহিম দৌড়ে গেল ইহামের কাছে। ইসহাক আর ইবরাহিম দুজনে মিলে ইহাম কে ছাড়িয়ে নিল। অস্থির ভাবে শ্বাস নেওয়া ক্রুদ্ধ ইহাম কে ইসহাক চৌধুরী বুঝাতে লাগলেন। বারবার শান্ত হতেও বললেন। ইবরাহিম আশঙ্কিত চোখে একবার তাকাল ডক্টরের দিকে। বিনয়ের সাথে তখন ইসহাক চৌধুরী বললেন,

“প্লিজ ডক্টর কিছু মনে নিবেন না আসলে ছেলেটা বউমার অবস্থায় একটু বেশি রগচটা হয়ে গিয়েছে। আপনি..”
“ইট’স ওকে” ইহামের দিকে এক পলক তাকালেন ডক্টর। ছেলেটার রাগের আড়ালে লুকায়িত তীব্র এক ভয় আর আতংক খেলা করছে মুখাবয়ব জুড়ে। ছেলে টা বুঝি স্ত্রীর চিন্তায় ব্যাকুল ভাবে অস্থির হয়ে আছে। ইহামের ভেতরের ভয়টা কে বুঝে ডক্টর ম্লান হাসলেন। শ্লথ গলায় বললেন,
“একজন দুঃসাহসী সৈনিক হিসেবে আপনার এই অস্থির ভাব মানায় না মিস্টার ইহাম। পরিস্থিতি আর ব্যক্তি যেমনি হোক ধৈর্য রাখুন। ট্রেনিং এ কিন্তু আমাদের এটা খুব ভালো ভাবে রপ্ত করায়। আমাদেরই দেখুন না। নিজেদের খুব কাছের মানুষের খুব গুরুতর অপরেশনও কিন্তু করতে হয়। তাদের র’ক্ত হাতে মাখতে হয়। তাই ধৈর্য রাখুন। আশা করছি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে। বাকিটা রোগীর জ্ঞান ফেরার পর বলা যাচ্ছে।”

সার্জিক্যাল গাউন গায়ে জড়িয়েই ৩৫ কি ৩৬ বছরের টগবগে তরুণ হনহন করে স্থান ত্যাগ করল। ডক্টরের এই বানী বুঝি একটুও নিতে পারল না ইহাম। ক্রোধের রক্তজবা চোখ গুলি দিয়ে স্থির ভঙ্গিতে তাকিয়ে ছিল সেই পথে। ফোঁসফোঁস করে নিশ্বাস নেওয়া সাথে তীব্র আক্রোশ হলো তার। মনের ভেতরে তখন দুটানা দোদুল্যমান। ভেতরটা এত অস্থির ভাবে ছটফট করছে কেন বুঝতে পারছে না। প্রেয়সীর সংশয় তীব্র আশঙ্কা না কাউকে নাশ করে দেওয়ার প্রগাঢ় স্পৃহা? নাকি দুটো মিলেমিশে মিশ্র পায়তারায় তরল লাভার মতো বুদবুদ করছে তার ভেতরটা।

“কি হয়েছে তোর বাবা? নিজেকে সামলাতে পারছিস না কেন? এতটা খাপছাড়া হয়ে গিয়েছিস কবে?”
ইহাম জবাব দিল না। বরং খানিক ঘুরে চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত পিষল। সে নিজেই তো নিজেকে বুঝাতে পারছে না অন্যের বুঝ কি করে মানবে তার হৃদয়? ভেতরটা উত্তপ্ত লাভার মতো টগবগ করছে যে। মায়রার ওই নিস্তব্ধ করুণ মুখের ব্যথাটা সে কাকে দেখাবে? সেই বেপরোয়া দহন কে যে সে কিছুতেই থামাতে পারছে না।
“আমার ছেলের কি হলো? আমার শক্ত মনের ছেলের এই অবস্থা যে আমি সহ্য করতে পারছি না। এমন করছিস কেন রে বাবা?”
মায়ের ফ্যাচফ্যাচ কান্নায় এবার বিরক্ত হলো ইহাম। মেজাজ ঘেটে এক। উপায়ন্তর না পেয়ে কষে দিল মাকে এক ধমক।

“চুপ করবে তুমি? এসেছো থেকে দেখছি মরার কান্না জুড়েছো। হয়েছেটা কি? কেউ মরেছে? নিজের ছেলের জানাজা পড়বে?”
ইহামের লাগামহীন কথায় ইসহাক চৌধুরীর বুক কেঁপে উঠে। একটা মাত্র ছেলে উনার। আর সে কি কুক্ষণে কথা আওড়াচ্ছে? গরম চোখে মেয়েকে ইশারায় কিছু বুঝাতেই শিফু মা কে নিয়ে খানিক দূরে গেল। চুপ করে না থাকতে পেরে বিতৃষ্ণা কন্ঠে জোর দিয়ে বলে উঠেন ইসহাক চৌধুরী,
“নিজেকে সংযত করো ইহাম। মুখে যা আসছে তাই বকে যাচ্ছো। যার সাথে ইচ্ছা তার সাথেই খারাপ ব্যবহার করছো। এই শিক্ষা পেয়েছো তুমি? বিপদে যদি নিজেকেই সামলাতে না জানো তবে কেমন বীর সৈনিক তুমি? এত বাঁধভাঙা হয়ে যাচ্ছো কেন?”

ইসহাক চৌধুরীর কথা কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি ইহামের মাঝে। সে আগেরকার মতোই দহন মিশ্রিত নিশ্বাস নিচ্ছে থেমে থেমে। চোখ গুলিও লাল হয়ে আছে। আগুন ঝড়ছে সেখান দিয়ে। নিজেকে থামানোর চেষ্টা করেও যেন পারছে না। ভেতরের সব অনুভূতি গুলি বেপরোয়া হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সে ক্ষিপ্রে তাকাল বাবার দিকে। রক্ত লাল চোখে অবুঝের মতো চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৩৪

“ওকে বলো বাবা ও যেন ১ ঘন্টার মাঝে জেগে উঠে। আমার সাথে কথা বলে। কিসের ১২ ঘন্টা? জ্ঞান টেয়ান কিছু বুঝি না ও যেন চোখের পাতা খুলে এতটুক বলে দাও। যদি তা না হয় তো দেখো ওর রেশ ধরে যে, কয়টা লা’শ মাটিতে গড়াগড়ি খায়।”

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৩৬