মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৩৮

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৩৮
সাদিয়া

নিশা সময়। ঘড়ির কাটা বোধহয় ২ টার কোঠায়। ফেণী টু ঢাকা তিন ঘন্টার রাস্তা ইহাম ২ ঘন্টায় এসে পৌঁছেছে। রজনীর ফাঁকা রাস্তা পেয়ে দিকবেদিক করে ছুটে এসেছে কেবল মায়রার কে দেখার প্রবণতায়। এসেও ডাক্তারের কাছ থেকে শুনেছে বেয়াদব মেয়েটা নাকি তার এখনো চোখ খুলেনি। বিষাদ বিদ্বেষ গোলমেল করে সে এগোয় মায়রার কেবিনের দিকে।

ক্যাপ্টেনের স্ত্রী হওয়ার সুবাদে বেশ সুযোগ সুবিধা পাচ্ছা মায়রা। এবং কি পুরো পরিবার। হসপিটালের ফাঁকা কেবিন গুলিতে তারা আরাম করেই শুয়েছে। আইসিইউর ভিআইপি ক্যাবিনে এখনো নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে মায়রা। মুখটা শুকিয়ে এইটুকু হয়ে আছে মেয়েটার। ইহাম ধীর গতিতে এগিয়ে যায়। শরীরটা বুঝি তার আর চলে না। ভেতর থেকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যায় মায়রার অবস্থায়। আরো বড্ড বেশি ক্লান্ত লাগে নিজেকে। সে বুঝতে পারে না যাওয়ার আগে বেয়াদব মেয়েটা কে যা বলে গেল সেই কথা অমান্য করেছে বলে কি রাগবে নাকি মেয়েটা এখনো চুপষে আছে বলে কষ্ট পাবে? কিন্তু বুকের ঠিক বা পাশটায় যে বড্ড বেশি ব্যথা করছে। আগুন লাগার মতো জ্বলছে। নিশ্বাসটা যে আটকে আসতে চাইছে তার বেলা? এই সব কিছুর দায় কি ওই মাথামোটা মেয়েটার নয়?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

উদাস অন্যমনস্ক ভঙ্গিমায় ইহাম পা ফেলে মেপেমেপে। এগিয়ে গিয়ে চুপটি করে দাঁড়ায় মায়রার বেডের কাছটায়। নিশ্চল ভাবে এক নজরে তাকিয়ে থাকে ওই পাণ্ডুর মুখ পানে। হৃদয়টা শূন্য হাহাকারে মেতে উঠে। অন্তরের ভূদেশে প্রবল ভূমিকম্প হয়। কিছুপল স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। শক্ত বুকের জমিনে ধস নামে। ঠোঁট কাঁপিয়ে কিছু বলতে চায় তবে গলা দিয়ে বের হয়না সেই আর্তনাদ মেশানো বুলি।

আচমকা খানিক ঝুঁকে মায়রা কে ও অবস্থাতেই চেঁপে ধরে বুকের মাঝে। নীরব মায়রার গলার ভাঁজে মুখ গুঁজে নিঃশব্দে চোখের জমানো পানিটা ছেড়ে দেয়। সেই কত বছর পর আজ চোখের পানি ফেলল ইহাম তার কোনো ইয়াত্তা নেই। ইচ্ছা হচ্ছে চিৎকার করে একটু কাঁদুক। এই মেয়েটা এবার তাকে বড্ড বেশি কষ্ট দিচ্ছে, পু’ড়াচ্ছে।
“এ্যাই মায়রা? এবার তুমি বেশি করছো না বলো? বেয়াদব মেয়ে তুমি কি ভেবেছো আমাকে এভাবে কষ্ট দিয়ে তুমি উন্মাদ বানিয়ে ছুটি পাবে? এরকম করে তোমার ছুটি মঞ্জুর করব আমি? মনে হয় তোমার? কখনো না। এই জীবনে সেটা মানব না আমি। অভিমান করেছো? রাগ করেছো? তাই এভাবে ছুটি নেওয়ার পাঁয়তারা জুটিয়েছো না? প্লিজ জান আমার উঠে পড়ো।”

একটু থামে ইহাম। ভেতর ফেঁপে আসে তার। ওভাবেই মুখ গুঁজে ফুঁপায়। অস্ফুটবাকে বলে “আমার বেয়াদব নারী উঠ। প্লিজ লক্ষ্মী জান আমার উঠ তুই। আমি আর নিতে পারছি না। সহ্য করতে পারছি না। আমার ভেতরটা জ্বলে পু’ড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে আমার বেয়াদব জান। প্লিজ উঠে শান্ত কর আমায়। আমার ভেতরের আগুন নেভা। একটা বার তাকা আমার দিকে, একটু কথা বলে আমার উথাল মনটাকে খানিক স্বস্তি দে। এই মুহূর্তে আমার বড্ড স্বস্তির প্রয়োজন মায়রা। প্লিজ সোনা আমার তাকা এদিকে। এভাবে চুপ থাকিস না আমার বেয়াদব জান।”
ইহাম ফুঁপিয়ে উঠে। কিছু সময় ওভাবেই মায়রার সাথে চাপকে থাকে। আলতো করে মেয়েটাকে বুকের সাথে মিশিয়ে রেখেছে। হৃদয়রের স্পন্দন তখন বেগতিক হারে উঠানামা করে। তবুও মেয়েটার গলার মাঝে মুখ ডুবিয়ে আপন মনে ফুঁপায় ইহাম। তার চোখের ওই অশ্রু কেউ দেখছে না, যার জন্যে বাঁধছাড়া অশ্রুর ধারা বইছে সে নিজেও এই মুহূর্তে স্তব্ধ। ওই তীক্ষ্ণ চোখ গুলি পানির আগমনে আরো কেমন লাল হয়ে উঠল। সারাক্ষণ বেয়াদব বেয়াদব করা মেয়েটার জন্যে যে সে এই রকম করে উন্মাদ হবে আদৌও ভেবেছিল কখনো?

আচমকা মনে হলো অক্সিজেন মাস্কের ভেতর থেকে অস্ফুট কোনো আওয়াজ। থমকালো কয়েক সেকেন্ডের জন্য। দুই ভ্রুর মাঝে রেখা অঙ্কন হলো। চকিতে ইহাম সোজা হয়ে দাঁড়াল। মায়রার চোখ পিটপিট করতে দেখে আনন্দে পুলকিত হলো তার চিত্ত। চোখ ভর্তি পানি নিয়ে স্ফীত হলো ঠোঁটের কোণ। সেভাবেই মায়রার দিকে নজর রেখেই চেঁচিয়ে উঠে “ডক্টর” বলে। পর পর কয়েকটা চিৎকার করে সে। যখন দেখতে পেল মায়রা সত্যি সত্যি চোখ পিটপিট করছে, এখনি তাকিয়ে যাবে। ওমনি ঘাড় বাঁকিয়ে নিজের চোখের পানিটুক আড়াল করল। হাতের উল্টোপিঠে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে চোখের পানিটুক মুছে নিজেকে ধাতস্থ করল খানিক।
ততক্ষণে মায়রা আধোআধো করে চোখ খুলল। ভার চোখের পাতা গুলি বেশ ঝাপসা লাগলো। আস্তেআস্তে চোখের দৃষ্টি স্পষ্ট হতেই ভেসে আসল ইহামের মুখখানা। বিড়বিড় করে বলল,

“ক্যা ক্যাপ্টেন ফাহাদ ইহাম চ চৌধুরী।”
মায়রার নিম্প্রভ চাউনি আর বিড়বিড় করে বলা উচ্চারণ ইহামের মনে এক রাশ শুভ্র প্রশান্তির ঝাটকা বয়ে গেল। হৃদয় আঙ্গিনায় সহস্র শান্তি আর তৃপ্তির ঢেউ খেলে গেল। ঠোঁটের কোণ গুলি খানিক সম্প্রসারিত হলো ইহামের। মায়রা আধো পলক ফেলে দেখল ইহামের স্ফীত মুখাবয়ব। আবারও বিড়বিড় করল “কঠিন পাষাণ মানব।” ইহাম কিছু বলল না। তবে মনে যে অশান্তির তাণ্ডব শুরু হয়েছিল তা শিথিল হলো। ততক্ষণে ডক্টরও এসে হাজির। সেই সাথে জাগন্ত তুহিনও।

ডক্টর কিছুক্ষণ মায়রাকে ভালো করে দেখতে লাগল। ইহাম শক্ত চোয়ালে হাত দুই দূরে দাঁড়িয়ে। তুহিনও চিন্তিত মুখে তাকিয়ে আছে বোনের খবরের আশায়। মায়রা অভিমান আর কিঞ্চিৎ মনস্তাপ নিয়ে তাকিয়ে ছিল ইহামের দিকে। মানুষটার গম্ভীর চাউনি তার দিকেই নিবদ্ধ। মনে মনে কিছু ভেবে মুখ ফিরিয়ে নেয় সে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে উপরের শুভ্র দেওয়ালে ঝুলন্ত চলন্ত ফ্যানের দিকে।
ডক্টর বেশ কিছুক্ষণ সব দেখে ইহাম কে জানাল,

“ক্যাপ্টেন আশা করছি সী ইজ ফাইন। তবুও কাল কিছু চেকআপ করাতে হবে। বাট উনার হ্যান্ডের অবস্থা কিন্তু সূচনীয়। টোটালি বেড রেস্ট থাকতে হবে এন্ড ঠিকভাবে ঔষধ নেওয়ার সাথে সাথে নিয়মিত করে পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। এমনিতেই কিন্তু অনেকটা ব্লাড লস হয়েছে।”

ইহাম খুব বেশি কিছু বলে উত্তর দিল না। গম্ভীর মুখে মায়রার দিকে তাকিয়ে শুধু জবাব দিল “হুম” বলে। মায়রা তৎক্ষণাৎ থমথমে মুখে আবারও দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল। এতে ইহামের কপাল ঈষৎ সরু হয়। মেয়েটার হাবভাব বুঝার চেষ্টা করে। অজ্ঞান থেকে ফিরে কি আবার নতুন দমে মাথামোটা হলো নাকি?
তুহিন এগিয়ে গেল বোনের কাছে। মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতেই মেয়েটা ব্যাকুল ক্লিষ্ট চোখে তাকায় ভাইয়ের পানে। মুহূর্তে চোখ গুলি চিকচিক করে উঠে তার। শুষ্ক ঠোঁট গুলি নাড়িয়ে অপরিস্ফুট স্বরে ডাকে “ভাইয়া।” তুহিনের বুক কেঁপে উঠে। চোখে পানি আসতে চাইলেও বোনের সামনে একটুও সেটা করল না। বরং ম্লান হেসে বলে উঠে,

“বোকা, কাঁদছিস কেন? কষ্ট হচ্ছে? ডক্টর তো বলল তুই ঠিক হয়ে যাবি। চিন্তা করিস না লক্ষ্মী টা।”
মায়রা কিছু বলে না। শুধু ঠোঁট কাঁপে তার। তুহিন খানিক নুয়ে বোনের কপালে চুমু দেয়। আবারও একটু মলিন হেসে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায় পিছনে ইহামের দিকে। মানুষটা তখনো গাম্ভীর্য মুখে দাঁড়িয়ে আছে দেখে তুহিন নিজেই ঘর থেকে বের হয়ে গেল নিঃশব্দে।
ধীর বেগে ইহাম এগিয়ে এলো। ইহামের সন্নিকট উপলব্ধি করে মায়রা মুখ ফিরিয়ে নিল আবারও। নজর অন্যদিকে ঘুরিয়ে ঘনঘন ঢোক গিলে মেয়েটা। ইহাম গম্ভীর হয়ে কিছুক্ষণ এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে মায়রার বেডের খুব কাছে। কয়েকপল অতিবাহিত হওয়ার পরও আড়চোখে যখন ইহামের স্থান ত্যাগের কোনো হেলদোল দেখল না তখন ভেতরের হাসপাস আর সইতে পারে না মায়রা। সারাশরীর ব্যথায় জর্জরিত। মাথার ভেতর ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। কেউ যেন মগজ ছিঁড়ে নিচ্ছে এমন যন্ত্রণা। তবুও অস্বস্তি কিংবা ক্ষোভ নিয়ে নিঃশব্দ প্রতিবাদে সে নড়েচড়ে ওদিক ফিরতে চাইলেই ইহাম ধমকে উঠে,

“সমস্যা কি? বেয়াদবের মতো নড়ছো কেন? কি প্রয়োজন আমায় বলো।”
মায়রা ক্ষিপ্রে তাকায় ইহামের দিকে। রাগী মুখ আর ধমকানো কথা শুনে নাক ফুলে উঠে তার অভিমানে। এক নজরে তাকিয়ে থাকে ওই পাষাণ লোকটার পানে। এই লোকটার মনে কি তার জন্যে একটুও মায়াদয়া নেই নাকি? সবসময় এভাবে কেন কথা বলে সে? একটু আদুরে করে কিছু বলতে পারে না নাকি? সবটা সময় একটা রুক্ষ ভাব নিয়ে কথা বলে। যেন তাকে সে গুনাতেই ধরে না। অভিমানে বুক ভার হয় তার। নাক ফুলে। ঠোঁট কাঁপে।
“কি হলো? সমস্যা কি তোমার? এভাবে থাকতে অসুবিধা হচ্ছে? অন্য পজিশনে শুবে?”
কেন যেন শেষের কথাটায় মায়রার একটু অস্বস্তি হলো। কিছু ভেবে লজ্জাও পেল ঈষৎ। তবে নিজেকে সামলে শক্ত গলায় জবাব দিল,

“আমার অসুবিধা তো আপনিই। আপনিই চলে যান এখান থেকে। তবেই হবে।”
কপাল কুঁচকে আসে মায়রার কথায়। ঠিক বুঝতে পারে না মানেটা। সন্দিগ্ধ চোখে তাই তাকিয়ে থাকে মায়রার দিকে। মায়রাও সমান তালে কিছুক্ষণ চেয়ে হাসপাস করে ইতিউতি করে। আরেকবার নড়তেই এবার জোরে ধমকায় ইহাম।
“সাহস টা বেড়ে গিয়েছে না? কথার কোনো মূল্য নেই? সবসময় বেয়াদবি করে কোন মজাটা পাও তুমি মায়রা? আবারও বলছি সীমার মাঝে থাকো।”
সেকেন্ড কয়েক নির্লিপ্ত ভাবে তাকিয়ে থেকে মায়রাও কেমন ফুঁসে উঠে।
“পারব না। কি করবেন আপনি? এতো বাধ্য হতে পারব না আমি। কার বাধ্য হবো? আপনার?”
“কি বলতে চাইছো?”
“অনেক কিছু। তবে এখন ইচ্ছাই হচ্ছে না। আপনি যান তাহলেই হবে।”
“মায়রা বেশি বাড়াবাড়ি করছো। কি হয়েছে বলবে তো।”
চিবিয়ে বলে ইহাম।

“তো? কি করব আমি? আপনার সব কথা শুনব? বাধ্য হবো? এটাই চান? আপনার বাধ্য হবো? যার আমাকে নিয়ে কোনো চিন্তাই নেই। আমাকে ওমন বিপদে দেখেও যে বিচলিত না হয়ে শান্তশিষ্ট ভাবে বসে থাকে। উল্টো আমাকে ওই অবস্থায় বকাবকি করে, সে আমার জন্যে কতটা চিন্তা করে তা বুঝায় যায়। আর তার বাধ্য আমি হতে চাই না।”

কথা শেষে মায়রা মুখ ফুলিয়ে দৃষ্টি অন্যত্র নেয়। ওর ফুলো গাল দুটির দিকে এক নাগাড়ে তাকিয়ে থাকে ইহাম। রাগে চোয়াল শক্ত হয় তার। দাঁতে দাঁত পিষে মায়রার দিকেই তাকিয়ে থাকে। সে ভাবে, এই মেয়েটা ঠিক কতটা মাথামোটা গবেট হলে এই ধরনের কথা বলতে পারে। এই মাথামোটা বলদ টা কি কোনো দিন ঠিক হবে না? সব কথা এই গবেটের সামনে তুলে না ধরলে কি বুঝতে পারে না নাকি কিছু? যে মেয়েটার জন্যে আজ সারাদিন উন্মাদপ্রায় ছিল সে ওই হাদারাম বলে কি না তার জন্যে তার মনে কোনো চিন্তাই নেই? যার চোখের চাউনি ঠোঁটের বিড়বিড়ানি শুনার জন্যে তার মনে বয়েছে উথাল অশান্তির ঢেউ সেই মেয়েটাই বলছে তাকে নিয়ে সে ভাবে না। এ কোন গবেটের পাল্লায় পড়ল সে? মায়রার উপর ভীষণ রাগ হয় ইহামের। সর্বোপরি এই রাগ আরো বেশি করে হয় নিজের বাবা মার উপর। কেন এমন মাথামোটা অল্প বয়সের একটা মেয়ে তারা গলায় ঝুলিয়ে দিল? দাঁতে দাঁত পিষে ইহাম তাকিয়ে থাকে মায়রার দিকে।

“কি? এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? খেয়ে ফেলবেন নাকি?”
“খেয়েই ফেলতাম তোমাকে মাথামোটা বেয়াদব। শুধু অসুস্থতার জন্যে সেটা পারছি না।”
“শখ কত। আমায় খেয়ে ফেলবে। রাক্ষস নাকি? মানুষের হৃদয় পুড়িয়ে খেতে খেতে আস্তো মানুষটাই খেতে চাইছেন?”
“আই স্যোয়ার পুরো তুমি টাকেই খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা হচ্ছে আমার।”
দাঁত পিষে বলে উঠে ইহাম। ওই শক্ত চোয়াল তার তীক্ষ্ণরাগী চাউনিতে থতমত খায় মায়রা। আমতাআমতা করে।
“পারবেন তো শুধু এসবই করতে। মা’রামারি, কাটা’কাটি, মানুষকে চিবিয়ে খাওয়া ছাড়া কি পারেন? মায়া দয়া আছে আপনার ভিতরে?”

“তোমার ভাবনায় কি? আমাকে কি মনে করো? স্পিক আপ ইডিয়ট।”
“আপনি হলেন একটা পাষাণ। দয়া মায়া ভালোবাসা কিচ্ছু নেই। আপনি তো আর আমাকে পছন্দ করেন না। মানুষ হিসেবেও মনে করেন না। তাই তো আমায় বেয়াদব বেয়াদব করেন। বেয়াদব হলেও তো মানুষ নাকি? নাকি সেটাও ভাবেন না? একটুও মায়া হলো না ওভাবে দেখে? কতটা পাষাণ আপনি। নাকি ভেবেছিলেন বেয়াদব টা উপরে টপকে গেলে আপনার খুব ভালোই হবে। আরেকটা বিয়ে করতে পারবেন। নতুন ব..”

“জাস্ট স্টপ দিজ ননসেন্স” হিসহিস করে বলেই একপা বাড়িয়ে দেয় বেডের দিকে। দাঁতে দাঁত চেঁপে আবারও বলে, “মুখের ভাষা সংযত করো ইডিয়ট। নয়তো চাপকে তোমার মুখ ভেঙ্গে ফেলব আমি।”
মায়রারও রাগ হয়। দাঁত কাটে সেও। তবে কিছু বলে না। ভয় পেয়েছে বুঝায় যায়। পাবে না? লাল লাল চোখ দুটি নিয়ে কেমন হিংস্র ভাবে তাকিয়ে আছে। চোয়াল শক্ত ভাবই যেন বুঝিয়ে দেয় তা। ভেতরটা ভার হয়ে আসে তার। মানুষটা কতটা নির্দয়। এই অবস্থাতেও তার সাথে কি ভাবে কথা বলছে। একটুও সহানুভূতি পর্যন্ত নেই। মায়া তো দূরের কথা।

“তুমি আসলেই একটা মাথামোটা গবেট। শুধু এমনি তোমাকে বলদ বলি না। তোমার মাথায় দামী জৈবসার গোবরটা পর্যন্ত নেই গবেট কোথাকার। এই কারণেই বয়সের অতিরিক্ত ছোট কাউকে বিয়ে করতে নেই। গুলিয়ে খাওয়ালেও তারা নাদানই থাকে। কচি শিশু। মাথা খাটিয়ে তোমার মতো হাদারামরা কিছুই বুঝতে পারে না।”
চিবিয়ে কোনো রকম কথাটা শেষ করেই ইহাম হনহন করে চলে যায় কেবিন ছেড়ে। রাগে শরীর জ্বলে তার। মায়রার অবুঝপানায় বিরক্ত সে। ভেতরে যতটা বেপরোয়া ভাব ছিল মেয়েটার জন্যে তা সম্পূর্ণ টা রাগে পরিণত হতে একটুও সময় লাগল না ওর বারবার মুখ ফিরিয়ে নেওয়া আর ওই কথায়। ইচ্ছা হয় মেয়েটার গালে চড়াতে চড়াতে সব কিছু বুঝাতে।

যেতে যেতে হাঠাৎই ইবরাহিমের সাথে দেখা হয়ে যায় তার। থমথমে রাগী মুখটা নিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার আগেই সাহস নিয়ে ইবরাহিম প্রশ্ন করে,
“ক্যাপ্টেন, মিশন?”
পা থামিয়ে দাঁড়ায় ইহাম। দাঁত পিষে জ্বলন্ত চোখে তাকায় ইবরাহিমের পানে। ওই আগুন চোখ দেখে খানিক অপ্রস্তুত হয় ইবরাহিম। কিন্তু পরিচিত ওই চোখের ভাষা বুঝতে দেরি হয়না। শীতল কন্ঠে রয়েসয়ে ইহাম জবাব দিল,
“মিশন কমপ্লিট হয়নি। আরো দুদিন লাগবে।”
ইবরাহিম সূক্ষ্ম চোখে কপাল কুঁচকে তাকায় ইহামের পানে। দেখতে বিধ্বস্ত এলোমেলো লাগে। তবে চোখের চাউনি স্থীর ও শীতল দেখায় এবার। ইবরাহিম তাকিয়েই থাকে ওই গম্ভীর মুখের দিকে। দুই চোখের ভাষা বুঝার চেষ্টা করে সে। তখনি ইহাম আবারও ঠান্ডা আওয়াজ তুলে,

“গট ইট?”
এতেই যা বুঝার বুঝে নেয় ইবরাহিম। মুহূর্তে শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে তার। কি করতে চাইছে কি ক্যাপ্টেন? উনার মতো মানুষের কাজ অসম্পূর্ণ থাকবে সেটা যেন মানতে পারছে না সে। তবে আন্দাজে বেশ বুঝে নিয়েছে প্রস্হিত ঘটনা সম্পর্কে। তবে মানুষটা চাইছে কি করতে? কোন ভয়ংকর খেলায় ডুবিয়েছে নিজেকে একটা মেয়ের জন্য? ক্যাপ্টেন যে চক্র সাজাচ্ছে সেই চক্রের শেষ পরিণতি কি তিনি জানেন না? ফলাফল সরূপ যে তিনি চাকরি হারাতে পারেন সেটা জেনেও কি এই খেলায় পা ডুবিয়েছেন নাকি তিনি? তার যতটুক জানা ক্যাপ্টেন নিজের ক্যারিয়ার খুব শখে গড়ে তুলেছে। তবে নিজের স্ত্রী কে কেন্দ্র করে কোন বিধ্বংসী খেলায় মেতে গিয়েছে? ইবরাহিমের ভাবনার মাঝেই গমগম পায়ে হেটে চলে যায় ইহাম।

ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে মায়রা। ওই মানুষটাকে বড্ড পছন্দ করে সে। খুব করে মনে গেঁথে গিয়েছে। তাই তো লোকটার ওই রূঢ় আচারণ হৃদয় সয় না। ওখানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার সাথে কিভাবে শক্ত শক্ত কথা বলল। এখনো ধমকে ধমকে সেই কঠিন ব্যবহারই। তার ভেতরটা যে জ্বলে ওসবে তা কি লোকটা বুঝতে পারে না? ওতটুক বুঝার ক্ষমতা নেই ওই দৃঢ় ব্যক্তিত্ব সম্পূর্ণ লোকটার? ঠোঁট উল্টে কেঁদে উঠে মায়রা। মাথা ব্যথায় ছিঁড়ে যায়। যন্ত্রণায় ইচ্ছা হয় সব চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলুক।

তুহিন করিডোরের শেষমাথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। হাতে একটা সিগারেট। যদিও নিষেধ আছে এখানে ধূমপানের কথা। তবুও সে ফাঁকা পেয়ে জ্বালিয়েছে কিছুক্ষণ হয়। ভেতরটা কেমন যেন ছটফট করছে তার। শিফু কে দেখার পর থেকে ওই কন্ঠ শুনার পর থেকেই আরো দিশেহারা লাগছে। বুকের বা পাশের ব্যথাটা এখনো কমছে না।
“তুহিন ভাইয়া?”
আচমকা ডাকে চকিতে ফিরে তাকায় তুহিন। শিফুকে শুষ্ক মুখে তাকিয়ে থাকতে দেখে কপাল কুঁচকে আসে তুহিনের। লঘু আওয়াজে আওড়ায় “শিফু” বলে।

“আপনি স্মোক করছেন কেন?”
জবাব দেয় না তুহিন। আবারও উল্টো দিক ফিরে যায় সে। পিছনে দাঁড়ানোর শিফুর উদ্দেশ্যে বলে,
“এখানে এসেছো কেন? তোমার ভাই এখানে আছে ভুলে গেছো নাকি ভাই এর বাধ্য বোনটা?”
শিফু কোনো জবাব দিতে পারে না। তুহিন ভাই যে তাকে ঠেস মেরে কথা বলছে তা সে বুঝতে পারে। মাথা নুয়িয়ে চুপ করে থাকে সে। পিছনে শিফুর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে তুহিন ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায়। তখনো ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাতের অসমাপ্ত সিগারেট টা টোকা দিয়ে ফেলে দেয়। শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,

“কেন এসেছো? বারবার আসছো কেন বলো তো? নাকি আরো জ্বালা বাড়িয়ে দিতে আসছো?”
“তু তুহিন ভাই…”
“এই মেয়ে একদম না। বলেছি না আমাকে ভাই টাই ডাকবে না। তোমার ভাই এর গোষ্ঠী কিলাই আমি। নিজের ভাই নেই? যাকে তাকে ভাই ডাকতে যাও কেন শিফুটিফু।”
তুহিনের মুখ থেকে এই “শিফুটিফু” ডাকটা মুহূর্ত আনন্দিত করে তুলল শিফুর ভেতর কায়া। নিজেকে শক্ত করে বলল,
“আ আমার কারণে আপনি কষ্ট পেয়ে ওভাবে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এই জন্যে নিজেকে খুব অপরাধী লাগছে আমার।”
মাথা নিচু করেই শিফু বলে। তার কথা শেষ হওয়ার পর থেকেই বিদ্রূপ করে হেসে উঠে তুহিন। কিছুক্ষণ হাসতে হাসতেই জবাব দেয়,

“কিসের অপরাধ? তুমি তো অপরাধ করছো না। শুধু পরিবারের বাধ্য মেয়ের মতো কথা শুনছো। শা’লা আমিই পারছি না মা বাবার কথা শুনে নিজের অনুভূতি গুলিকে ভুলে যেতে। কিন্তু চিন্তা করো না। চেষ্টা তো আমি করবই। শুধু বিদেশ থেকে ফিরতে দাও। তবে এটাও মনে রেখো তোমাকে আমি ছাড়ব না শিফুটিফু। বিরক্ত করতে যাবো না তবে মাসে তোমার একবার কল না ধরা সেটাও বরদাস্ত করবো না। মাইন্ড ইট।”
তুহিন এক দলা বিতৃষ্ণা নিয়ে যেতে যেতে দেওয়ালে একটা পাঞ্চ করে বসল। শিফু তখনো মাথা নুয়ে টপটপ করে চোখে পানি ফেলে। হৃদয়টা একদিকে তুহিনের কথায় আনন্দে উচ্ছ্বাসিত হয় তো আরেক দিকে পিছুটানে পুড়ে।

হসপিটালের নিচে সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে ইহাম। রাগটা এখনো পুরোপুরি শান্ত করতে পারছে না। আবারও আরেকটা সিগারেট পুড়ালো সে। ঠোঁটের ফাঁকে নিয়ে দম নিয়ে টেনে নিল ধোঁয়া। তখনি কোথাথেকে হন্নে হয়ে ছুটে এলো কেউ একজন। ঝাপসা আলোতে তেমনি দেখা গেল না। আর না ইহাম দেখার প্রয়োজন মনে করল। আবারও ধোয়া টেনে নেওয়ার সময় কানে এলো,
“ক্যাপ্টেন, তাড়াতাড়ি আসুন। ম্যাম প্রচন্ড মাথা ব্যথায় চিৎকার করছে। বলছে, কানে নাকি কিছুই শুনতে পাচ্ছে না।”

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৩৭

বিদ্যুৎ গতিতে ইহাম চকিতে তাকায় ইবরাহিমের দিকে। ওর উদ্রেক মুখশ্রী দেখে থমকে যায় ইহাম। কপালে ভাঁজ পড়ার সাথে সাথে মুহূর্তে হৃদস্পন্দনটা কেমন ব্যথাতুর ভাবে লাফিয়ে উঠে। জ্বলন্ত সিগারেট টা ফেলে দিয়ে থমকে আসা শ্বাস নিয়েই বজ্রবেগে ছুটে।

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৩৯