মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৪২
সাদিয়া
“এ কি ক্যাপ্টেন সাহেব? আপনার পিঠে এত লাল হয়ে আছে কিভাবে? চামড়াও ছিলে গেছে দেখছি। কি করে হলো এসব?”
সদ্য শাওয়ার নিয়ে এসেছে ইহাম। কোমরে তার সফেদ টাওয়াল পেঁচিয়ে আছে। যার ফলে ভেজা হিমালয় শরীর টা স্পষ্ট। খাঁজকাটা শরীর দেখে আলাদা শিহরণ খেলা করে মনের কোণায়। বুকে সৃষ্টি হয় ধুকবুক ধুকবুক স্পন্দন। শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্র দ্রিমদ্রিম এক অনুভূতি উষ্ণ করে তুলে সারাঅঙ্গ। তবুও মুখ ফসকে প্রশ্ন খানা করে নিজেই তাজ্জব বনে গেল। এই মুহূর্তে বিস্ময় লজ্জায় নুয়ে যাচ্ছে তার কোমল লাজুক চিত্ত। আহাম্মকের মতো প্রশ্নটা করে ইতস্তত বোধ করছে নিজে নিজেই। লজ্জায় মায়রার মাথা নুয়া দেখে নিচের ঠোঁট কা’মড়ে হাসল ইহাম। মেয়েটা বুঝি তার ওই ঠোঁটকাটা হাসি দেখে আরো জমে বরফ হয়ে যাচ্ছে। দুষ্ট দুষ্ট চিন্তারা ইহাম কে নাড়া দিতেই ফিচেল হাসিটা আরেকটু প্রসারিত করল সে। একপা একপা করে ধীর গতিতে এগিয়ে যেতে লাগল বেডে আধশোয়া হয়ে থাকা লাজুক মেয়েটার পানে।
বুকের ভেতর কিছু একটা খামছে ধরেছে মায়রার। নিশ্বাসটা গলার কাছে কেমন দলা পাকিয়ে গিয়েছে। ওই কঠিন পাষাণ পুরুষটাকে আসতে দেখে হাতপা অটোমেটিক কেমন অবশ হয়ে আসতে শুরু করেছে। তবুও যেন শরীরের শেষ নিঃসৃত শক্তিটি ব্যয় করে বেডের গা থেকে শরীর তুলে কোনো রকম জড়সড় হয়ে বসল। ওই পাষাণ পুরুষের নেশালো চোখ আর দুষ্ট হাসিটুক দেখে হৃদপিন্ড থেমে আসছে সুচালো সংশয়ে। কি ভয়ংকর ওই চাউনি। এভাবে কাছে আসার মানে কি? আশ্চর্য!
মাতোয়ারা চোখের দৃষ্টি নিয়ে ইহাম একেবারে বেডের কাছে এলো। সেই সাথে দেখতে পেল নাজুক মেয়েটার আতঙ্কে শুকনো ঢোক গিলার দৃশ্যটুক। বড্ড মজা পেল যেন সেই ব্যপারটায়। মেয়েটাকে আরেকটু ভয়কাতুরে করতে মায়রার চোখে চোখ রেখেই বাহু চেঁপে ধরল। মোহাগ্রস্থ মুখাবয়ব টা আরেকটু এগিয়ে এনে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“দিজ ইজ দ্যা প্রুফ দ্যাট ইউ ওয়েন্ট টু বি ইন্টিমেট উইথ মি।”
লজ্জায় আড়ষ্ট মায়রা তৎক্ষণাৎ দাঁতে দাঁত কা’মড়ে ধরল। সাথে সাথে বেডকভারটাও দুমড়েমুচড়ে নিল হাতের মুঠোয়। ছিঃ, কি ভয়ংকর কথা ওই পাষাণ পুরুষের। সাংঘাতিক মিথ্যে কথাও তো বলতে পারে এই লোক। অনায়াসে কিসব যা তা কথাও বলে দিচ্ছে। ছিঃ, এমন ইচ্ছা কস্মিনকালেও কি করেছিল সে? চোখের পলকেই তো এই সাংঘাতিক লোকটা অনায়াসে কথা বানিয়ে সুন্দর করে উপস্থাপন করার ক্ষমতা রাখে। কি ভয়াবহ ব্যাপার! সাংঘাতিক পুরুষ!
তার কিঞ্চিৎ রাগে নাক ফুলানো সেই ভাবনার মাঝেই বরফ শীতল স্পর্শে অনিমেষ তার সর্বাঙ্গ চমকে কেঁপে উঠল। শরীরে তীব্র থেকে তীব্র ভাবে বিজলির মতো কিছু একটা ছুটে গেল প্রবলগতিতে। নিশ্বাসটা ঠিক নাকের ঢগায় এসে থেমেছে। শুকনো একটা ঢোক গিলারও কোনো অবকাশ নেই প্রচন্ড বিস্ময়ে স্তম্ভিত হওয়া মায়রার কাছে। নিজের জড়তা টুক কাটাতে না পারলেও আলতো হাতে ইহাম কে ঠেলে দূরে সরানোর প্রয়াস চালিয়ে মিনিমিনি গলায় জবাব দিল “ম মানে?” গলার সমস্ত স্বর জড়ো হয়ে আসছে তার।
“আই এম রাইট।”
“দে দেখুন আজেবাজে ক কথা বলবেন না। আপনি একটা সাংঘাতিক লোক ক্যাপ্টেন সাহেব। দূরে সরুন।”
ইহাম এক চুল তো নড়লই না। উল্টো আবারও আগের মতো কানের কাছে শরীরের লোম শিউড়ে দেওয়ার মতো ফিসফিস করে জানাল,
“আমি সরতে চাইলেও আমার পিচ্চি বউ সরতে দিতে চায় না। স্বামী সুইট সুইট আদর করে তো প্রচুর তাই চোখে হারায়। এই চিহ্ন দ্বারাই সে সূক্ষ্ম ভাবে বুঝিয়ে দেয় আমাকে সে ঠিক কেমন করে পেতে আগ্রহী।”
ইহাম আরেকটু এগিয়ে আসছে সেই আভাস পাওয়া মাত্র তড়িতে দুই হাত দিয়ে পুরুষ্টু বুক ঠেকানোর চেষ্টা করল। রাগ দেখানো অভিনয় করে নাক ফুলালো মেয়েটা।
“দে দেখুন, আপনি কিন্তু খুব খা খারাপ লোক। একদম উল্টাপাল্টা কিছু বলবেন না। দূরে সরুন, দূরে সরুন। একটা সোজা প্রশ্ন করেছি সোজা ভাবে উত্তর দিলেই হয়ে যায় তা না করে সবসময় আপনি প্যাঁচানো পথ অবলম্বন করেন। আপনি খুব ঝামেলার মানুষ।”
“ইউ এক্সপ্লেইন টু মি” ইহাম আলতো হাতে মায়রার গুলিবিদ্ধ দগ্ধ ব্যান্ডেজে মুড়া হাতটা মুঠোয় নিল। “তোমার সাথে খারাপ কি কি করেছি আমি? নাকি দেখতে চাইছো খারাপ কি কি করতে পারি?”
ইহামের খেই হারা চাউনি আর বেপরোয়া তরঙ্গের ন্যায় কথার ইঙ্গিত তার অন্তরআত্মা কাঁপিয়ে দিচ্ছে। শুকনো ঢোক গিলার সাথেসাথে আমতাআমতা করে কিছু বলার আগে ইহাম মৃদু তেজস্বী কন্ঠে জানাল,
“মেয়ে শরীরে র’ক্ত, শক্তি বেশি হয়ে গিয়েছে তাই না? বলেছি না এই হাতে জোর প্রয়োগ করবে না। একটুও রক্ত বের হলে আছাড় মারব? কথা শুনতে কি তোমার দুষ্ট বেয়াদব মনটা মানতে চায় না?”
লে হালুয়া। এই লোক “বেয়াদব” শব্দটা এতটাই রপ্ত করেছে যে যখন তখন যে কোনো অবস্থায় বের করে ফেলে। একটা রোমান্টিক মুহূর্তও এই পাষাণ পুরুষ ঘেটে ঘ বানিয়ে দিবে আবলিল ভাবে। বিরক্তিতে মুখটা খানিক ভোতা হয়ে এলো।
“সোনা বন্ধু তুই আমারে
ভোতা দা দিয়া কাইট্টালা
পিরিতের খ্যাতা দিয়া
যাইত্তা ধইরা মাইরালা।”
আকাশপাতাল বিস্ময়ে মায়রার তালু জিহ্বা এক হয়ে এলো। চোখ গুলি অবাকে এত বড় হলো যে কোঠর থেকে বের হয়ে আসবে এমন। বিস্মিত চোয়াল হা হয়ে আছে কেমন করে। এই লোক এই ধরনের গানও শুনে? কেমন লুচু লুচু হয়ে গান খেয়েও নিলো। পুরাই রাস্তায় উত্যক্ত করা ছেলেদের মতো। ছি ছি কি ভয়ংকর ব্যাপার। এই লোকের তো নানা রূপ গিরগিটির মতো। নিশ্বাস নেওয়া, চোখের পাপড়ি ফেলা কিংবা ঢোক গিলা সব কিছু ভুলে গিয়েছে মায়রা।
“হোয়াট?” মৃদু আওয়াজে প্রশ্ন করে ইহাম। এখনো মাতালের মতো বিভোর হয়ে তাকিয়ে আছে। ফিসফিস করে “তাড়াতাড়ি সুস্থ হোও। তোমার সাথে ধস্তাধস্তি খেলা খেলতে ইচ্ছুক ক্যাপ্টেন ফাহাদ ইহাম চৌধুরী। তারপর দেখব তোমার ওই টুকুন পিঁপড়ে শরীরে কতটুক শক্তি আছে আমায় আটকানোর। আমার শক্তি সামলানোর ক্ষমতা আছে তো তোমার মেয়ে?”
ভয়ে মিহি আতঙ্কে গলা শুকিয়ে চৌচির হয়ে আছে মায়রার। বিস্ময়ে চোখের পাপড়ি ঘনঘন ঝাপটায় ভীত মেয়েটা। ইহাম মুচকি হাসে। একটু ছাড় দিতে ঠোঁটের একদম কিনারায় একটা ছোট্ট অথচ শব্দ করে চুমু দিয়ে ফিসফিস করে আওড়ায় “তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও আমার সুইটহার্ট বেয়াদব।” সরে আসে ইহাম। মাথার মাঝারি সাইজে কাটা এক ঝাঁক চুল গুলি ঝাঁকিয়ে বৃষ্টির মতো ঝিরিঝিরি পানি ঝাড়ে। গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলতে থাকে,
“কাল উন্মাদের মতো যখন করছিলে তখন আমার শার্টের উপর তোমার নখ খুবলে ধরেছো। আর তোমার বিশাল সাইজের নখের দুষ্টু চিহ্ন বসিয়েছো মনে নেই?”
একটু থামে ইহাম। শপিং থেকে ওলিভ রাঙ্গা শার্টটা গায়ে জড়াতে জড়াতে ফের বলে উঠে,
“আর দুপুরের ঘটনাটা? ভুলে গেলে বেয়াদব জান? আমার খুব গভীরে ঢুকে যাওয়ার পায়তারা করতে করতে কখন তোমার দুষ্টু চিহ্ন গুলি গাঢ় করে তুলেছো বলতে পারো না বুঝি?”
মায়রা সরু চোখে নাক ফুলিয়ে তাকিয়ে ফোঁসফোঁস করছে। তার ভাবনা একটাই ‘ এই লোকটার এত সোজাসাপ্টা কথা কেন বলতে হবে সবসময়? যদিও বা একটু ভালো করে কথা বলে তাও তাকে লজ্জায় ইতস্ততে কোণঠাসা করার পথ ছাড়ে না ‘ মুখ ভেংচায় মায়রার্। তা দেখে ইহাম কিঞ্চিৎ হেসে বলে উঠে “মোটামোটা বেয়াদব।”
“এই একটা কথায় কি মধু পেয়েছেন আপনি?”
“বারে আমি সর্বদা সত্যি কথা বলি।”
“কেমন সত্যি কথা বলেন তা তো জানাই আছে। প্রমাণ তো দিলেনই।”
“মায়রা আসতে হবে এখন তোমার কাছে? আসব আমি?”
ইহামের প্রশ্নে মায়রার মেকি রাগ নিমিষে হাওয়া। হুমকির মানে বুঝে দ্রুত এদিক ওদিক মাথা নাড়ায় সে। বিব্রত পরিস্থিতির সেই লজ্জার ভয়ে আড়ষ্ট মায়রা মুহূর্তে সব মেনে নেয় চুপটি করে। বোকার মতো তাকিয়ে ঘন পাপড়ি যোগল হরিণ চোখ গুলি পরপর ঝাপটায়। ইহাম এক গালে হেসে বিড়বিড় করে “আমার বেয়াদব জান।”
“মায়রা ঘুমানোর সময় হয়নি? বকা খেতে চাইছো নাকি? কখন বলে গিয়েছি ঘুমানোর জন্য?”
থতমত খায় মেয়েটা। শাওয়ার নেওয়ার আগে নিজ হাতে মানুষটা যত্ন করে গরম গরম স্যুপ খায়িয়ে ঔষধ দিয়ে বলে গিয়েছে ঘুমানোর জন্যে। অথচ তার চোখে ঘুমই আসছে না। মানুষটার শক্ত গলা শুনে এবার সত্যি ভয় হলো বকা খাওয়ার।
“আ আমি..”
“একটা কথাও আর যেন মুখ থেকে বের না হয়। চুপচাপ ঘুমাও। চোখ বন্ধ করো।”
“আমার ঘুম আসছে না।”
মাথা নিচু করে অভিমানি স্বরে বলল মায়রা। ততক্ষণে ইহাম কোমরে প্যান্ট জড়িয়ে নিয়েছে। এখনো শক্ত প্রস্থ বুকটা উন্মুক্ত। শার্টের বোতাম লাগনো হয়নি। ইহাম বেডের থেকে হাত পাঁচেক দূরে। ঘাড় বাঁকিয়ে মেয়েটার মন খারাপ টা অবলোকন করে নিল চুপিসারে। বোতাম লাগাতে লাগাতে পা বাড়ায় মায়রার নিকটে। অর্ধ বুক উন্মুক্ত রেখে শার্টের তৃতীয় নাম্বার বোতাম টা লাগিয়ে মায়রার ঠিক পাশে বসল। নুয়ে রাখা থুতনিতে তর্জনী ঠেকিয়ে ইহাম উঁচু করল মেয়েটার মোহনিয়া বদনখানি। বিভোর চোখে তাকিয়ে দেখে কোমল কন্ঠে প্রশ্ন করল,
“কি সমস্যা? ঘুমাবে না কেন?”
“আসছে না।”
“কারণ জানতে চাই।”
“কোনো কারণ নেই। শুধু এমনি।”
“চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকো। ঘুম আসবে।”
ইহাম মায়রার মাথার পিছনে হাত গলিয়ে খানিক টেনে আনল কাছে। মেয়ের কপালে গভীর চুমু এঁকে জানাল,
“একটু কাজ আছে। সেরে আসছি। ঘুমাও লক্ষ্মী টা।”
ইহাম সরে আসতে চাইলেই মায়রা সাহস করে ওই পুরুষালী শক্ত হাতটা আঁকড়ে ধরল। মায়ামায়া চাউনি দিয়ে করুণ স্বরে বুলি ছেড়ে আবদার করল,
“একটু থাকুন না আমার কাছে।”
মায়রার ওই আদুরে মুখ আর আহ্লাদী গলা একেবারে তীরের মতো গিয়ে বিধ করল ইহামের বক্ষদেশ। মেয়েটা আসলেই একটু বেশি অবুঝ আর সরল টাইপের। মায়রার ওই আদুরে গাল চেঁপে এক মুহূর্তে ইহাম তার বুকের সাথে জড়িয়ে নিল মেয়েটার ছোট্ট কায়া। দিনদিন এই মেয়েটা তার মাথা নষ্ট করে দিচ্ছে। আগের কার মতো নিয়মমাফিক একগুঁয়ে দিন গুলির মোড় পরিবর্তন হয়েছে। এখন শত কাজ আর ঝামেলার মাঝেও ওই মাথামোটা একটু বেশি বুঝা মেয়েটা তার মস্তিষ্কে সূক্ষ্ম যন্ত্রণা দেয়। র’ক্তশোষা জোকের মতো তার ব্রেইন কা’মড়ে রাখে এই মেয়েটাই। নানান চিন্তায় তপ্ত সময়ের মাঝেও মায়রার আবদার টুক আলাদা প্রশান্তি দেয় ইহামের অন্তঃকরণে। মেয়েটাকে শক্ত করে বুকের সাথে চেঁপে ধরার মাঝে অদ্ভুত তৃপ্তি মিশে আছে। যেন বুকের সকল উথাল তরঙ্গ নিমিষে শান্ত সরল হয়ে বয়ে যায়। ইহাম আলতো করে মায়রার মাথায় চুমু আঁকে।
“মেডিসিন নিয়েছো, প্লিজ ঘুমাও। আমি আছি।”
মায়রার হৃদয় খুশির উচাটনে বাকবাকুম করে। এত শান্তি এত তৃপ্তি জীবনে নতুন বার উপলব্ধি করছে সে। দুনিয়াটা যেন স্বর্গীয় সুখ সমতুল্য। দাদী যে বলত “স্বামীর সোহাগ” এটাই কি তা?
বুক থেকে আস্তে করে তুলে ইহাম মায়রার কপালে চুমু দেয়। এরপর মুখ নামিয়ে গাল ও ঠোঁটের এক কিনারা ছুঁয়েও চুমু খায়। ব্যাপারটায় আলাদা এক অনুভূতি মিশে আছে যেন। প্রাপ্তির ভরাট খাতায় পূর্ণ নাম্বার পেয়ে আলতো হাসে মায়রা। লোকটার মুখ থেকে শুনতে পায় পাষাণ মানুষটা বিরবির করে বলছে “বেয়াদব জান।” মায়রা থম মেরে থাকে। সে বুঝে না পাষাণ পুরুষের মতিগতি। এত রোমাঞ্চকর পরিস্থিতিটা কেমন থমথমেও করে দেয়। মানুষটা বড্ড পাষাণ। যখন তখন মুখ ফসকে অপছন্দের কথাটাই বের করে ফেলে।
“মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।”
“লাগবে না আপনি যান।”
“গালে কয় কেজি চাল ভিজিয়েছো মায়রা?”
“মানে?”
“তুলতুলে গাল দুটি যে ফুলে গিয়েছে।”
মায়রা আরো গাল ফুলিয়ে ঘাড় বাঁকালো। ইহাম মুচকি হেসে বলল,
“ফুলো গালে চুমু খেতে কেমন লাগে মায়রা? একটু টেস্ট করি? দিবে নাকি?”
আহাম্মকের মতো চকিতে তাকাল মায়রা। এই লোক কোন ধরনের মানুষ? কখন কি করে কখন কি বলে তা নিয়ে কোনো ধারনা করা যায় না। পুরাই নিজের মর্জিমতো চলা কঠিন পাষাণ মানব একটা যেন।
ইহাম একটু এগিয়ে আসতে চাইলে মায়রা বলে,
“দিবো না। সরুন।”
“বিয়ে করা হালাল জিনিস তুমি আমার। ব্যক্তিগত সম্পদ। দিবে না মানে? মাথামোটার মতো তর্ক না করে সরো দেখি একটু টেস্ট করতে দাও।”
বলে মায়রার তুলুতুলু গালে চুমু খায়। কাল থেকে স্যালাইন চলার ফলে গাল আর শরীর খানিক যেন আরেকটু ফুলেছে। টসটসে গালে চুমু দিতে বেশ লাগছে। ডান গালে চুমু খেয়ে মুখ বাড়িয়ে ইহাম বাম গালেও শব্দ করে চুমু খায়। এরপর আবার ঠিক করে বসে। সরু চোখে দেখে বোকা মেয়েটার প্রতিক্রিয়া। ড্যাবড্যাব করে তব্দা খাওয়ার মতো বসে আছে মেয়েটা। তার ভাবনাতেই আসে না ইহাম ঠিক কোন ধরনের মানুষ। কখনো মনে হয় লোকটা খুব পাষাণ, নির্দয়, গম্ভীর। যখনই লোকটাকে একটু ভালো নরম আর আদুরে ভাবতে বসে আবার তার ভাবনা ভুল প্রমাণ করতে লোকটা একটুও পিছুপা হয় না।
তার ভাবনার মাঝেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হয়। দুজনই বুঝতে পারে কেবিনের বাহিরে শিরিন বেগম দাঁড়িয়ে। ইহাম এক পল মায়রার দিকে তাকায়। মেয়েটাও তার দিকে সরল চোখে তাকিয়ে। ইহাম কিছু ইশারা করে বেড থেকে উঠে দাঁড়ায়। হাক ছেড়ে জানায়,
“এসো মা।”
মায়রা ইতস্তত করে। কেমন বিচলিত ভাবে উষ্কখুষ্ক হয়ে বসে বেডের এক কোণে। মূলত তার নরম মন কখনো চিন্তা করেনি শিরিন বেগম তার সাথে কখনো এমন রূঢ় ব্যবহার করতে পারেন। সে প্রথম প্রথম উনার ব্যবহারে ধরেই নিয়েছিল তিনি তার আরেক মা হয়ে উঠবেন। বিয়ে নামক বন্ধন তাকে স্বামীর সঙ্গে আরেকটা বাবা মাও দিয়েছেন। কিন্তু বোকা মেয়েটার বাস্তবতা সম্পর্কে খুব একটা ধারণা হয়নি এখন অবধি। শাশুড়ি নামক আরেক মায়ের ওই কঠিন রূঢ় ব্যবহার তার কোমল মন মানতে না পেরে আরো বিচলিত হচ্ছে। এমন না যে সে এই জীবনে বকা শুনেনি কারো কাছ থেকে। কিন্তু তবুও তার মন উনার থেকে এই ব্যবহারটা মানতে চাইছে না কেন কোনো ভাবেই? উনার মুখোমুখি হতেও একটা অস্থিরতা খানিক লজ্জাও কাজ করছে। আড়চোখে ইহাম সবটাই খেয়াল করল। তখনি শিরিন বেগম এলেন কেবিনের ভেতর। মায়রার দিকে নজর বুলিয়ে ছেলেকে প্রশ্ন করলেন,
“খেয়েছে ও?”
ইহাম চোখ ঘুরিয়ে মায়রার দিকে তাকিয়ে নজর ফেরায় মায়ের দিকে।
“খায়িয়ে দিয়েছি। ঘুমাতে বলেছি। বলে ঘুম আসছে না।” ঘড়িতে ব্যস্ত ভঙ্গিতে সময় দেখে ইহাম। মায়ের মুখে তাকিয়ে নিম্ন আওয়াজে বলে, “তুমি থাকো আমার একটু কাজ আছে আসছি।”
শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে ইহাম চলে গেল। পিছন ফিরে এক পলক করুন মায়রার মুখটা দেখেও বউ শাশুড়ি কে খানিক সময় দিয়ে বের হয়ে এলো।
কেবিন থেকে খানিক দূরেই দেখতে পেল ইবরাহিম কে। মনে মনে ছেলেটার কাজে বেশ অভিভূত হলো সে। আসলেই ইবরাহিম এমন একটা ছেলে যে তাকে একে বারে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে। কলিগের চেয়ে ছেলেটা তার ছোট ভাই বেশি। তার গুরুগম্ভীর ভাবটার কারণে ডিপার্টমেন্টের সবাই তার সাথে পর্যাপ্ত দূরত্ব রেখে কাছে আসলেও এই একটা মাত্র ইবরাহিমই পুরোপুরি যেন তার খুব কাছের কেউ। কাছের একজন। ছেলেটা কে একটা কাজ দিলে নিজের সবটুক দায়িত্ব দিয়ে একেবারে নিজের কাজ বলে গুরুত্ব দিয়ে সেটা পালন করে। একদিন বলেছিলও “ক্যাপ্টেন আপনি আমার বড় ভাই।”
ইহাম এগিয়ে গেল তার দিকে। তাকে দেখা মাত্র ইবরাহিম ছেলেটা সটান হয়ে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করল।
“ইবরাহিম তুমি এখনো এখানে? দুপুরে খাওয়া হয়েছে?”
“ক্যাপ্টেন তাউস এখনো আসেনি খেয়ে। তাই..”
“আমি তো ছিলাম তবে গেলে না কেন ওর সাথে?”
উত্তরে ইবরাহিম মাথা নুয়ে নিল। ইহাম তার কাঁধের ভ্রাতৃত্বের হাত রেখে মোটা গলায় বলল,
“চলো আমিও লাঞ্চ করিনি। একসাথে লাঞ্চ করে বের হবো। একটু কাজ আছে।”
“ইয়েস ক্যাপ্টেন।”
মায়রা এখনো ভেতরের সংকোচ কাটাতে পারছে না। মাথাটা একদম নুয়ে রেখেছে। ইতস্ততে হাতে হাত কচলাচ্ছে। শিরিন বেগম সবটাই খেয়াল করলেন। পুরু মুখ নিয়ে তিনি গিয়ে বেডের পাশের ঢোলটায় বসলেন। নরম স্বরে জিজ্ঞাস করলেন,
“শরীর কেমন এখন তোমার?”
নরম গলা পেয়ে মায়রা দ্বিধা নিয়ে মাথা একটু তুলে তাকায়। শুকনো ঢোক গিলে। কিছু বলার আগেই তিনি হাত বাড়িয়ে তার গাল ছুঁয়ে বলে,
“আমার উপর রেগে আছো?”
মায়রার কেন যেন কান্না পেল। আটকে রাখতে চেয়েও পারছে মা মেয়েটা। ঠিক যেমন বাবা মা একটু বকা দেওয়ার পর আদুরে করে কথা বললে কান্না আসে। ঠিক তেমন করে কান্না আসছে। চোখ গুলি টলমল করে উঠে। ঠোঁট কাঁপে।
“তোমার মা তোমায় বকে না? আদর করতে আসলেও পরে রাগ করে বসে থাকো? আমি কি তোমার মা না?”
নিজেকে আর ধরে রাখতে না পেরে মায়রা এবার ফুঁপিয়ে উঠল। তার কান্না দেখে শিরিন বেগম ছলছল নয়নে উঠে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরলেন মায়রা কে। তখনের কথা মনে করে শিরিন বেগম কেই জড়িয়ে ধরে মায়রা কিছু সময় ফুঁপায়।
“তখন ছেলের কষ্টের কথা চিন্তা করে আমার রাগ হয়েছিল। একটু বকেছিই তো শুধু। নিজের মা মনে করে কষ্ট পাস না আম্মা তখনের জন্য। তোর মাও তো তোকে বকে তাই না?”
“আমি আপনার উপর একটুও রাগ করিনি।”
“তাহলে কান্না থামাও। শাশুড়িরা কি কখনো মা হতে পারে না? রাগে একটু বকা দিলে মা মনে করে কি ভুলা যায় না?”
রাগের মাথায় তখন মেয়েটাকে একটু বকে দিলেও নিজের কাছে খুব খারাপ লাগছিল তাই চেয়েও আর চুপ করে বসে থাকতে পারিনি তিনি। সত্যি বলতে মেয়েটাকে তো তিনিই পছন্দ করেছিলেন ছেলের জন্যে।
“ক্যাপ্টেন কাজটা খুব রিস্কি হয়ে যায় না?”
“রিস্কি হলেও কিছু করার নেই। করতে হতোই।”
ইবরাহিম কিছু বলতে পারে না। তবুও নিচু গলায় বলে উঠে,
“যদি কোনো ভাবে অথরেটির কাছে খবর যায় তা…”
“পারবে না। জানতে পারলেও টিমের কেউ এর জন্যে দায়ী থাকবে না। যার সব দায় ভার কেবলই আমার।”
“ক্যাপ্টেন কিছু মনে করবেন না একটা কথা বলতে চাইছিলাম।”
মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৪১
মাথা নুয়ে জানায় ইবরাহিম। একটু দূরে বসে থাকা ইহাম ঠোঁটের ভাঁজে আবারও সিগারেট টানল। সে আগেই বুঝে নিল ইবরাহিম কি বলতে চাইছে। তাই নাক মুখ দিয়ে ধোয়া বের করতে করতে নিজ উদ্যোগে জানাল,
“কি হবে তার ধার আমি ধারি না। অথরেটি কোনোদিন জানলেও আই ইউল হ্যান্ডেল ইট। তুমি জানো না ইবরাহিম ওই কুত্তারবাচ্চা আমার ঠিক কোথায় হাত বাড়িয়েছে। ওর কলিজা চিঁড়ে যে আমি কুচিকুচি করিনি এটাই ওর সৌভাগ্য নয়কি?”