মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৪৩

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৪৩
সাদিয়া

কড়া মেডিসিনের প্রভাবে মায়রা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। বিকেল পেড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে এখনো মেয়েটা ঘুমে। এসে দেখে ফাতেমা বেগম মেয়ের পাশে বসে ঘুমন্ত মায়রার মাথায় হাত রেখেই মাথা হেলিয়ে দিয়েছেন বিছানায়। বোধহয় ক্লান্তিতে চোখ লেগে এসেছে। ইহাম কেবিনে ঢুকে এমন দৃশ্য দেখে আবার ফিরে যেতে চাইলেই ফাতেমা বেগমের গলা শুনতে পায়,

“তুমি কখন এলে বাবা?”
“এই তো মাত্রই এসেছি আম্মু। আপনি থাকুন আমি একটু আসছি।”
“না না বাবা, আমি এখনি চলে যাচ্ছি। তুমি ছিলে না তাই ওর পাশে বসে ছিলাম। কখন চোখটা লেগে গিয়েছে বুঝতে পারিনি।”
“আপনি অসুস্থ বোধ করলে পাশের কেবিনে গিয়ে একটু রেস্ট করতে পারেন আম্মু।”
মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সম্মতি জানিয়ে তিনি জায়গা ছাড়েন। ফাঁকা কেবিন পেতেই ইহাম ধীর পায়ে এগোয় ঘুমন্ত মেয়েটার পানে। আস্তেধীরে পাশে বসে। ক্যানুলা লাগানো নিস্তেজ হাতটা মুঠোপুড়ে নিলো পরম আদরে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে মায়রার মোহিনী মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ক্ষীণে স্বরে আওড়ালো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কি জাদু করেছো আমায় বেয়াদব মেয়ে? কোন বশীকরণ তোমার প্রতি আমায় আফিমের মতো আসক্ত করেছো বলো তো মায়রা? আগে তো কখনো নিজের প্রিয় জায়গায় ফিরতে আমার এত কষ্ট কিংবা খারাপ লাগা ছিল না। তবে এখন এই পিছুটান কোন মায়ায় বেঁধেছো? এত অস্থির লাগছে কেন তোমায় ছাড়া যেতে? দূরত্ব টুক বড্ড পীড়া দিচ্ছে বক্ষপিঞ্জরায়। উতলা হচ্ছে মন। ভেতরকার দহন ছটফটিয়ে তুলছে কেন মায়রা? আমার মতো মানুষকে এতটা মায়ায় জড়ানোর খুব কি দরকার ছিল অবুঝ মেয়ে?”

একা একাই বুলি ছুড়ে ইহাম। তার কথা ঘুমন্ত পরীর কর্ণকুহরে পৌঁছাতে পারে না। নিজের নির্বুদ্ধিতার কারণে নিজেই বাঁকা হাসে ছেলেটা মাথা নুয়ে। খানিক পল পর আবার তাকায় মায়রার মুখের দিকে। মেয়েটার দিকে ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ একটা কিছু চোখে পড়ে আলতো করে হাসল। এক নজরে তাকিয়ে থাকল মায়রার মুখের দিকে। এভাবে ঘুমন্ত মায়রার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকা আগে কখনো হয়নি। মায়রার গালের কোণে এক চিমটি লালা দেখে ইহাম হেসেই যাচ্ছে। মেয়েটা ঘুমিয়ে কি লালা ফেলে নাকি ঔষধের প্রভাবে বিঘোরে ঘুমাচ্ছে বলে এমন হচ্ছে। যাই হোক ব্যাপারটা বেশ কিউট লাগছে তার কাছে। ফিচেল হেসে মায়রার দিকে আরেকটু ঝুঁকে সে নিজের পরিষ্কার রোমালটা বের করল।

খুঁতখুঁতে ইহামও আজ নিজের রোমাল দিয়ে ব্যক্তিগত মানুষটার ঠোঁটের কোণ মুছে দিল অনায়াসে। আচমকা স্পর্শে ঘুমের ঘোরেই মেয়েটা একটু নড়েচড়ে বসল। ও পাশ ফিরে ইহামের হাতটা গালের নিচে চেঁপে ধরেই ঘুমিয়ে গেল। অপ্রয়োজনে সময় ব্যয় না করা হিসেবী মানুষটাও আজ অকারণে চুপটি করে বসে নিজের অন্তঃকরণে বাস করা ব্যক্তিগত নারীটিকে মোহিত দৃষ্টিতে অবলোকনে বিভোর। মায়রার মোমের মতো সফেদ গালের নিচে নিজের হাত রেখে অনায়াসে মুচকি হাসে ইহাম। বিড়বিড় করে ফুটফুটে ঘুমন্ত পরীকে প্রশ্ন করে,

“আমার পরিচিত দুনিয়াকে ভুলিয়ে দিতেই কি আমার জীবনে তুমি এমন অদ্ভুত অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে আগমন ঘটিয়েছো মায়রা? কবে আমার মনের শক্ত আবরণে মুড়া কুঠরিতে নিজের পাকাপোক্ত জায়গা দখল করে নিলে আমার বেয়াদব জান? আমাকে সম্পূর্ণ উন্মাদ করে দিতেই কি আমার আরো সংস্পর্শে আসো তুমি? আমায় খু’ন করতেই আমার জীবনে অতি নীরবে সংগোপনে পদচারণ করলে নাকি? তোমার দূরত্বের কারণে ভেতরে যে ছটফটানি হয়, বুকে দহন চলে সেই অসহ্য অস্থিরতার দায়ভার কি তুমি নিবে না মেয়ে?”

একটা কেবিনে চুপচাপ বসে আছে শিরিন বেগম। পাশেই ইসহাক চৌধুরী বসে আছেন। CO এর সাথে কথা শেষ করে ইহাম কেবিনে নক করল। শিরিন বেগমই গিয়ে দরজা খুললেন। ছেলেকে দেখে প্রশ্ন করলেন,
“কি হলো বাবা? কিছু হয়েছে? মায়রা ঠিক আছে?”
“সী ইজ ফাইন মা”
“তাহলে?” প্রশ্ন করলেন ইসহাক চৌধুরী। “কোনো দরকারে এসেছো?”
ইহাম স্বাভাবিক ভাবেই জবাব দিয়েছে,
“মার সাথে একটু কথা ছিল তাই।”

ছেলের কথার মানে বুদ্ধিমান ইসহাক চৌধুরী বুঝলেন। এমনিতে তো আর উনার চুল পাকেনি। ঢাকা শহর জুড়ে উকালতি করতে করতে আজ এই বয়সে। সোফা থেকে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে শান্ত গলায় বললেন,
“তোমরা মা ছেলে কথা বলো। আমি একটু বাহির থেকে ঘুরে আসি। একটু দেখে আসি মহিন সাহেব কি করেন।”
“তুমি থাকতে পারো বাবা সমস্যা নেই আমার।”
“না বাবা তোমরা কথা বলো। আমি আশপাশটা একটু দেখে আসি। একটু ব্যায়ামও হবে।”
ঘিয়ে রাঙা পাঞ্জাবি টা ঠিক করতে করতে তিনি কেবিন থেকে বের হলেন। শিরিন বেগম তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করলেন ছেলেকে,

“কি দরকার বাবা কি বলবি?”
ইহাম এগিয়ে যায়। মাকে বসায় বেডে। পাশে নিজেও বসে মায়ের মুখোমুখি। গলা কেঁশে নরম স্বরেই বলে,
“ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি তুমি আমাদের তিন ভাই বোনকেই কত আদর যত্ন আর স্নেহ করো। অন্যসব মায়েদের থেকে তোমার শাসন করার ধরন ছিল অন্যরকম। আমাদের তিন ভাই বোনের কাউকে কখনো গায়ে হাত তুলেছো বলেও আমার খুব একটা মনে পড়ে না। সবসময় আদর করে বুঝিয়ে যা বলার বলতে। তবে মায়রার বেলায় তোমার ওই বুঝদার স্বভাব টা কোথায় গিয়েছিল মা?”

ছেলের প্রশ্নে থমকায় শিরিন বেগম। তিনি মনে মনে আঁচ করেছেন ছেলে কোন দরকারে কাছে এসেছে এমন থমথমে মুখে। শান্ত নরম গলায় কথা বললেও মায়রার সাথে তখনের ব্যবহারটা যে ছেলের মনঃপুত হয়নি তা মুখ দেখলেই অনুমেয়। এক দৃষ্টিতে তিনি ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করেন কিছু।
“শিফুর কাছ থেকে জেরা করে ঘটনাটা শুনেছি আমি মা। তুমি তো আমার লক্ষ্মী মা। তবে ওর সাথে এমন রুড হলে কেন? ওর বাবা ভাই এর সামনেই মেয়েটার সাথে হঠাৎ এভাবে কেন কথা বললে বলবে মা? তুমি তো এমন নও। তবে কি হয়েছিল তোমার?”
ভারভার কন্ঠে শিরিন বেগমের থেকে জবাব আসে,
“দুদিন ধরে না খাওয়া ছিলি, ঘুমাসনি। আমি বাসা থেকে রান্না করে নিয়ে এসেছিলাম তোকে নিজের হাতে খাওয়াবো বলে। কিন্তু মায়রার সাথে ঝগড়া করে তুই রেগে চলে গেছিস। এতে আমার রাগ হয়েছিল। তাই একটু রিয়েক্ট করে ফেলেছি।”

আলতো করে ইহাম মায়ের হাত ধরল। ক্ষীণ গলায় প্রশ্ন করল,
“আমি ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি তুমি অনেক ধৈর্যশালী মা, নারী। আচ্ছা মা শিমলা কিংবা শিফুর সাথেও যদি আমি কোনো কারণে রাগ করে এভাবে চলে যেতাম ওদেরও কি তুমি এমন করেই বলতে?”
“অবশ্যই।”
“না মা। এত রুড তুমি হতে পারতে না। কারণ এটা তোমার স্বভাবের বাহিরে।”

মলিন হেসে জানাল ইহাম। ছেলের কথার ধরন এবার শিরিন বেগমকে বিব্রত করলেন। খানিক রুষ্টও দেখালেন উনাকে। ছেলের এই প্রশ্ন তিনি নিজেকে কখনো করেননি মনে মনে। হয়তো প্রশ্ন করলে ছেলের উত্তরই পেতেন ভেবেই এমনটা মনেও করতে চান না তিনি। মায়ের অভিভাব বুঝেও ইহাম বলতে লাগল,

“উত্তর চাই না তবে প্রশ্ন রেখে গেলাম তোমার কাছে, মায়রা যদি তোমার নিজের মেয়ে হতো কোনো কারণে এমন রূঢ় হতে পারতে তুমি? হয়তো হতে তবে এতটাও না। এর কারণ কি মায়রা পরের মেয়ে তাই? মানছি তুমি মায়রা কে অনেক পছন্দ করো। নিজের মেয়ের মতোন দেখো। তবে পুরোপুরি ভাবে নও। এটা হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু মা মায়রাও তো আমার জীবনের নতুন একটা অংশ। তোমরা নিজেরাই তো আমাকে সেই অংশ উপহার দিলে তবে কেন ওকে তুমি তুচ্ছ করে কথা বলবে মা? যেহেতু আমি থাকি না এখানে। আমার অবর্তমানে মায়রা তো আমার শ্বশুর শাশুড়ি আর তোমাদের আমানত বলো? তো নিজের ছেলের আমানতের যত্ন ভালো মন্দ তুমি দেখবে না? আমার স্ত্রী আমার সম্মান। তার অসম্মান কি আমার অসম্মান নয় বলো তো মা? তুমি এবং মায়রা দুজনই আমার কাছে খুব ইম্পরট্যান্ট। প্লিজ, আমি আশা করব আমাদের তিন ভাই বোন কে তুমি ঠিক যেমন চোখে দেখো যেভাবে ভালোবাসা দাও মায়রার ক্ষেত্রেও তুমি তার বিকল্প হবে না মা।”

মায়ের থমথমে গম্ভীর মুখের দিকে বাঁকা চোখে তাকায় ইহাম। হয়তো মা দ্বিধায় ডুবে আছেন। কিংবা তার কথা গুলি উনাকে খারাপ লাগা কাজ করাচ্ছে। তবুও কথা গুলির মাঝে গোপন সতর্কের দরকার ছিল। মহিন সাহেবের মুখের দিকে তখন তাকাতে পারছিল না ইহাম। মানুষটা হয়তো সরাসরি মেয়েকে এভাবে বলা নিয়ে মুখে কিছু না বললেও মনে মনে বেশ কষ্ট পেয়েছেন। তারউপর মায়রার আড়ালে মা কে এসব বলায় মা নিজেও বুঝবে ছেলের জীবনে বউ এর মূল্য। নিজের ভুলটাও হয়তো বুঝবেন। এরপর হয়তো ছেলের কথা ভেবেও বউ এর সাথে কখনো এতটা রাগারাগি করবেন না তিনি। এমনটাই ধারনা ইহামের কাছে। যদিও সে মাকে আঘাত করে কিছুই বলেনি সে। সবটাই ভবিষ্যৎ সতর্কতা দিয়েছে কেবল। তবুও সে বুঝে মা হয়তো কষ্ট পাচ্ছেন। ইহাম চুপচাপ উঠে দাঁড়িয়ে খানিক ঝুঁকে মায়ের কপালে চুমু দেয়। এরপর লম্বা কদম ফেলে প্রস্থান করে সন্তপর্ণে।
ছেলে চলে যেতেই গম্ভীর শিরিন বেগম অনুভূতি শূন্য চোখে তাকান সেদিক পানে। উনার মন দুটানায় দোদুল্যমান। ঠিক বুঝতে পারছেন না কেমন অনুভূতি প্রকাশ করা উনার দরকার। উনার বিচক্ষণ মস্তিষ্ক আর বিবেক এক কানে বলছে ছেলের কথা ভুল নয়। সব গুলি তো সঠিকই। তো উনার আরেক কান বলে অন্য কথা। মনের কোথাও কিঞ্চিৎ পরিমাণ উঁকি দেয় এক হিংসাত্মক মনোভাব।

হাসপাতালের বাহিরে তাউস আর সৌম্য অনেক ক্ষণ ধরে কিছু নিয়ে কথা বলছে। দুজনের মাঝে খানিক চিন্তার আভাস দেখা দিলেও সৌম্যের চেহারায় লঘু অসন্তুষ্টের ছায়া দেখা যায়। কথার এক পর্যায়ে দুজনের মাঝে বেশ গভীর আলোচনা হতে লাগল। সৌম্য কপাল কুঁচকে নীল মুখে বলল,
“তোর কি মনে হয় তাউস ক্যাপ্টেন যা করছে তা কি একটু সন্দেহ জনক লাগছে না?”
“মাথা খারাপ তোর সৌম্য? ক্যাপ্টেনের সাথে কি আমরা আজ থেকে আছি? তুই কোন সন্দেহের কথা বলছিস? মাল টাল খেয়ে এসেছিস নাকি সৌম্য বা’ল?”
“তুই বুঝতে পারছিস না আমি কিসের কথা বলছি তাউস। হেয়ালি করিস না সব কথায়।”
গরম গরম বাদামের খোসা ছুলে মুখে বাদাল ছুড়ে দিয়ে তাউস ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দেয়,
“না আমি সত্যি বুঝতে পারছি না।”
“মিশন রেখে ক্যাপ্টেন এভাবে হাসপাতালে বসে থাকার মানুষ? আমরা কিন্তু এখনো জানি না আযহার পাটোয়ারি কোথায় আছে। কি হয়েছে তার? সিহাবুউদ্দীন স্যারের কাছে কিন্তু আমরা নতুন আপডেট জানাই নি।”

“তোর কি ক্যাপ্টেন কে বু’দাই মনে হয় বা’ল? কি মনে হয় ক্যাপ্টেন CO এর সাথে যোগাযোগ রাখছে না?”
চিন্তিত ভঙ্গিতে সৌম্য বলে উঠল,
“ভুলে যাস না আমরা কিন্তু হাত গুটিয়ে বসে আছি। এত বড় একটা রিস্কি মিশন এখনো কমপ্লিট নয়। আদৌতে কি খবর তাও জানি না। আচ্ছা ক্যাপ্টেনের অতি পছন্দের কাছের ইবরাহিম কিছু কি জানে আযহার পাটোয়ারি কোথায় আছে?”
শেষের কথাটা সৌম্য খানিক রুষ্ট আর তাচ্ছিল্য জ্ঞানেই বলল।
“মিশন কমপ্লিট হয়েছে তা কিন্তু টিমের সবাই জানি। ক্যাপ্টেন তবুও অথরেটি কে জানায় নি। ক্যাপ্টেনের স্ত্রী অসুস্থ তাই এখানে থাকা হচ্ছে। টিমের সবাই এটাও জানে কাল বিকেলেই আমরা চট্টগ্রামের দিকে রওনা দিচ্ছি। সব জেনেও অবুঝের মতো জিজ্ঞেস কেন করছিস বাল?”

“তবে আযহার পাটোয়ারির কি খরব? তা আমরা জানি না কেন?”
“ক্যাপ্টেন নিশ্চয় এই বিষয়ে জানে। উনি এই বিষয়ে CO এর কাছে জানাবেন নিশ্চয়। তুই খামোখা এটা নিয়ে হঠাৎ ম’রছিস কেন বুঝলাম না।”
উত্তর দেয় না সৌম্য। তবে কপাল কুঁচকে গভীর হয়ে কিছু ভাবতে থাকে কেবল।

ঘুমন্ত চোখ গুলি পিটপিট করে তাকায় মায়রা। চোখের সামনে দেখতে পায় ঝাপসা ঝাপসা ইহামের গভীর আদল খানা। ইহামের পুরুষ্টু গম্ভীর মুখটা দেখে তুলতুলে কোমল ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে আনে। তার ওই হাসির দিকে তাকিয়ে ইহামের ওষ্ঠ স্ফীত হয়। মায়রা আধোআধো কন্ঠে আওড়ায়,
“গুডমর্নিং ক্যাপ্টেন সাহেব।”
ইহাম প্রত্যুত্তর না করে ঠোঁট টিপে নিঃশব্দে হাসল খানিক। তার ওই হাসি দেখে বিস্মিত হলেও মায়রা কপাল কুঁচকে নিল। ক্ষীণ গলায় সে প্রশ্ন করল,
“আপনি হাসছেন কেন?”
ইহাম জবাব দেয় না। মায়রার দিকে ঘোর নজরে তাকিয়ে আগের মতোই বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে রাখে ঠোঁটে। মানুষটার হাবভাব কেমন কেমন ঠেকে মায়রার কাছে। বদ্ধ শুভ্র কেবিনের আশপাশ তাকিয়েও বাহিরের টিকিটি পাওয়া যায় না। ভ্রুকুটি করে সে আবারও শুধায়,

“খুব বেলা হয়ে গিয়েছে কি?”
এবারও ইহাম জবাব দেয় না। বরং তার ফিচেল হাসিটার পরিমাণ আরেকটু দীর্ঘ করে। কোনো সহজস্বাভাবিক হাসি না দেখতে পেয়ে খানিক বিরক্ত হয় মেয়েটা। মনমরা হয়ে বলে উঠে,
“আশ্চর্য কিছু না বলে হাসছেন কেন? এই টিটকারি মার্কা হাসির মানে কি?”
ইহাম নরম স্নিগ্ধ নজরে মায়রার দিকে তাকিয়েই ঠোঁট কা’মড়ে হাসে প্রথম। এরপর অল্প ঘাড় নুয়িয়ে নিচের ঠোঁট টা দুই আঙ্গুলে চেঁপে ধরেই মেয়েটার নজরে নজর রেখে জবাব দেয়,

“কেবল নয়টা বাজে।”
“এত সময় ঘুমিয়েছি আমি? এই কারণেই মাথাটা বড্ড ভার লাগছে বোধহয়।”
চোখ বন্ধ করেই মায়রা মাথায় হাত দিয়ে বলে।
“এখন রাত নয়টা। তুমি বিকেলে ঘুমিয়েছো। তো সকালটা কি স্বপ্নে টেনে আনলে?”
ইহামের ঠেশমারা কথায় মায়রা চট করে তাকায়। সবটা মস্তিষ্ক ধারনা দিতেই কিঞ্চিৎ লজ্জা পায়। মাথা নুয়ে বিরক্ত সুরে গোমরা মুখ করে বলল,
“আপনি আসলেই একটা ঝামেলার মানুষ। আগে বললেই হতো। সব কিছু আপনি প্যাঁচান। খাডাস লোক।”
“তোমার চিন্তাভাবনা টা কত দূর গেল তা দেখতে হবে না মাথামোটা গবেট।”
“একদম উল্টাপাল্টা কিছু বলে ডাকবেন না আমায়।”
“তুমি নিজেই তো প্রমাণ পেলে তুমি একটা মাথামোটা।”
মায়রার মাঝে এবার সত্যি রাগী রাগী ভাব ফুটে উঠছে। নাকের ঢগাটা রাগে লাল টকটকে হয়েছে। সেদিকে ঘোরলাগা দৃষ্টিতে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে নেশাগ্রস্থের মতো বলে বসল ইহাম,
ল”মায়রা তোমার চেরি নাকে একটা বাইট খাই?”
আচমকা মানুষটার এমন প্রশ্নে নিজেকে খিঁচে বসে রইল মায়রা। শরীরটা জড় এক খণ্ডের মতো বেডে স্থান নিয়েছে। ঠোঁটের সাথে ঠোঁট চেঁপে ধরে চোখ দুটি রসগোল্লার মতো বড় করে নিয়েছে ইহামের প্রশ্নের তীক্ষ্ণ ধারে। এই লোক তো সাংঘাতিক পাজি।

ইহাম তার ওই রোবট ভাব দেখে ক্রুর হাসে। বেড থেকে উঠে আগবাড়িয়ে মায়রার সরু লাল নাকে মৃদু বলে কা’মড় বসায়। মুহূর্তে মেয়েটার শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁপে উঠে লজ্জায়। বেডের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে ঘনঘন শ্বাস নেয়। ইহাম তা দেখে ঠোঁট কা’মড়ে হাসে। বেডের এক পাশে দাঁড়িয়েই মায়রার নত চিবুক ছোঁয়ে মুখ উপরে করতেই দেখতে পায় নাকের সাথে এবার টসটসে গাল দুটিও লাল হয়ে উঠেছে। টালমাটাল হয়ে ইহাম হিসহিস করে বলে,

“আমার লাজুকলতা। এমন আপেল ফেইস করো না। তোমার এই লাল লাল ফেইস দেখলে নিজেকে কন্ট্রোল করা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। সো প্লিজ নিজের বিপদ ডাকতে এখন আমার সামনে এই ফেইস করো না বোকা মেয়ে।”
লজ্জায় মুখ লুকাতে মায়রা তৎক্ষণাৎ ইহামের বলিষ্ঠ কোমর ঝাপটে ধরল। বুকটা অসম্ভব হারে উঠানামা করছে তার। গহীন থেকে আসা “ধুকপুক ধুকপুক” ধ্বনি মুখরিত করে তুলছে কেবিন টা। পাষাণ পুরুষটার গা থেকে ভেসে আসা পুরুষালি কড়া পারফিউমের গন্ধ তাকে আরো মাতাল করে দিচ্ছে। মানুষটাকে শক্ত ভাবে আঁকড়ে ধরে লম্বালম্বা শ্বাস টানে মেয়েটা। মৃদু ঝুঁকে ইহাম মায়রার এলোমেলো রুক্ষ চুলে চুমু খায়। বিড়বিড় করে আওড়ায়,
“আমি আছি মিসেস ফাহাদ ইহাম চৌধুরী। আপনার ভয় নেই। এভাবে লজ্জায় আপনায় বারংবার মারতে আর একটু সময়ের অপেক্ষা। তাড়াতাড়ি সুস্থ হোন।”

মায়রা জবাব দিতে পারে না। হৃদয়ের আন্দোলিত ধ্বনিতে একেবারে বিমূঢ় সে। মানুষটার প্রতিটা কথা তাকে বরফের মতো জমিয়ে দিচ্ছে। খেই হারা বেসামাল বুকের ভারসাম্য টানতে অপারগত সে। চোখ মুদে মানুষটার প্রতিটা কথা অনুভব করে লজ্জায় মূর্ছা যায় যায় সে।
“হসপিটালে তোমায় কিছুদিন থাকতে হবে মায়রা। একটুও বেয়াদবি করবে না কিন্তু। দুদিন পর আরো দুই একটা টেস্টও করাতে হতে পারে। একটুও বাহানা করবে না ঠিক আছে? আর ঔষধ গুলি সময় মতো নিবে কেমন?”
মায়রা নিজেকে ধাতস্থ করে। ভেতরে অনুভূতির রঙ্গিন ঢেউ আছড়ে পরলেও সে শান্ত। কিছু বলতে গিয়েও গলা দিয়ে আওয়াজ বের হলো না।

“কাল বিকেলে কিন্তু আমি চলে যাচ্ছি চট্টগ্রাম।”
ইহামের শান্তশিষ্ট ভাবে কথাটা সরাসরি মায়রার কলিজা ভ’য়ংকর বেগে খুবলে ধরল। পাষাণ মানুষটার দূরত্বের নিদারুণ যন্ত্রণাটুক নিমিষে নিশ্বাস আটকে দিল। কিছুপল দুজনই স্তব্ধ হয়ে রইল। ইহাম স্থির দাঁড়িয়ে কেবল বুঝে উঠার চেষ্টা করছে মায়রার মনোভাব। মেয়েটা কিছুসময় একদম নিস্তেজ থেকে বেডে বসা অবস্থায় ইহামের কোমরে হাত রেখেই মুখ তুলল। ছলছল নয়নে নিজের পুরুষটার শক্ত আদলে দৃষ্টি বুলিয়ে করুণ স্বরে শুধায়,
“চলেই যখন যাবেন তখন কাছে এসে এত ভালোবাসা দিয়ে দূরত্বের কষ্টটুকু দিগুণ করেন কেন ক্যাপ্টেন সাহেব?”

টইটুম্বুর মায়রার চোখ আর কম্পিত কাতর গলা ইহামকে অস্থির করে বুকের ভেতর চূর্ণবিচূর্ণ হয় এক পলকে। এই মেয়ে নির্ঘাত তাকে বদ্দউন্মাদ করবে নয়তো একেবারে খু’ন। দাঁতে দাঁত চেঁপে বজ্রবেগে কেমন সবটুক শক্তিদিয়ে মায়রার মাথাটা নিজের উদরের সাথে চেঁপে ধরল। মেয়েটা বলিষ্ঠ হাতের পিষ্টে ব্যথা পেলেও নির্বাক রয়। ভেতরটা গুমড়ে গুমড়ে কাঁদে। থাকুক না একটু ব্যথা। অন্তঃকরণে শুঁকে নিক পাষাণ পুরুষটার মাতাল করা মিষ্টি ঘ্রাণ টুক।
“লক্ষ্মী সোনা বউ আমার। সুস্থ হয়ে এক্সাম টা কোনো রকম দিলেই তোমায় তুলে নিয়ে যাবো মনের ছোট্ট কুঠরিটায়। আরেকটু অপেক্ষা করো জান।”
মায়রা এবার আর নিজেকে শক্ত করতে না পেরে ফুঁপিয়ে উঠল। মানুষটাকে আরেকটু ঝাপটে ধরে হেঁচকি তুলে কাঁদল।

কিঞ্চিৎ সময় ব্যয় হওয়ার পরও যখন মেয়েটা কান্না থামায় না তখন বিরক্ত হয় ইহাম। হিতে না আবার বিপরীত হয়ে যায় ভেবে মিগধ আওয়াজে বলে,
“মায়রা আবার দুষ্টু দুষ্টু চিহ্ন দিচ্ছো কিন্তু। আমি খেই হারালে সামলাতে পারবে না আমার পিচ্চি মিসেস চৌধুরী।”
থমকায় মায়রা। কান্নাও থেমে যায় আচমকা। সেকেন্ড কয়েক পর লজ্জায় দুই হাত দিয়ে ইহাম কে ধাক্কা দিয়ে মেকি রাগ দেখায়।
“আপনি একটা অসভ্য পুরুষ।”
“তবে তোমারই।”
আর উত্তর দেওয়ার মতো কথা খুঁজে পায় না মায়রা। লজ্জায় কেবিনের এদিক ওদিক তাকিয়ে ইতিউতি করে। তার হাসফাস দেখে ইহাম কিছু বলতে যায় তখনি কেবিনে নক করে নার্স।
“আসতে পারি স্যার?”
দুজনই ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায়। নার্স কে দেখে অজানা শঙ্কায় ইহাম মুখ করে গম্ভীর। পাশ ফিরে তাকায় মেয়েটার গোলগাল মুখের দিকে। নিজের শরীরে এত কাটাছেঁড়া হলেও যে ব্যথা পাত্তা দিতো না সেই শক্ত মনের কঠোর পুরুষটাও আজ অন্য এক রমণীর ব্যথার কথা চিন্তা করে অগ্রিম মুখ শুকিয়ে নিয়েছে। ফাঁকা একটা অনুভূতি অনুভব করছে গহীন কোণে।

“ইয়েস কাম।”
গম্ভীর রুক্ষ গলায় জবাব দেয় সে।
“স্যার তখন ম্যাম ঘুমিয়ে ছিল বলে ডক্টর আসেনি ড্রেসিং করতে। তবে এখনি ড্রেসিং টা করতে হবে স্যার।”
রয়েসয়ে ইহাম জবাব দেয় “শিওর” বলে।
ড্রেসিং এর কথা শুনতে আত্মা কেঁপে উঠে মায়রার। কাঁদোকাঁদো মুখ করে বলে “আম আমি ড্রেসিং করব না।” মায়রার মুখ দেখে বড্ড মায়া হয় ইহামের। মেয়েটার যন্ত্রণার কথা চিন্তা করে তার নিজের ভেতরটায় তো হাহাকার করছে। বুকে সূক্ষ্ম পীড়ার উদয় হয়েছে। শুকনো ঢোক গিলে ইহাম মায়রার গালে হাত রাখে। প্রাণহীন গলায় বলে,
“ইনফেকশন হবে। ড্রেসিং টা আরো আগে করার দরকার ছিল। তুমি ঘুমে ছিলে বলে আমি ডক্টর কে চলে যেতে বলেছিলাম। রাত বেশি হয়ে যাচ্ছে। করে নাও ড্রেসিংটা। বেশি ব্যথা পাবে না জান।”
ইহামের বুঝ শুনে না মায়রা। অনবরত মাথা দুলিয়ে জানায় সে ড্রেসিং করবে না। মোটা গলায় ইহাম ধমকের সুরে বলল,

“বলছি তো বেশি ব্যথা পাবে না। চুপটি করে বসে থাকবে কেবল।”
একটু থেমে পকেট থেকে ফোন বের করে। কিছু একটা করে জানায়,
“একটু কাজ পড়ে গেছে। আম্মু কে ডেকে দিচ্ছি। তুমি থাকো।”
বলে মায়রার আঁকড়ে ধরা হাত ছুটিয়ে কোনো রকম পা চালায়। পিছন থেকে উত্তেজিত হয়ে মেয়েটা অসহায়ের মতো বলতে থাকে “আপনি যাবেন না নিষ্ঠুর লোক। আমি ড্রেসিং করব না।” মায়রার ডাক উপেক্ষা করেও ইহাম বের হয়ে যায়। আসার আগে মেয়েটার কন্দনরত অভিমানি মুখ বলে দেয় এমনটা হয়তো আশা করেনি সে। এর জন্যে হয়তো তার উপর রাগও দেখাবে কিংবা ভুল বুঝবে। তবুও সেটা উপেক্ষা করল ইহাম। শক্ত মনের অধিকারী লোকটাও যেন আজকাল কতটা কষ্ট পায় এক অষ্টাদশীর জন্য তার হদিস কেউ জানে না। মায়রা অভিমান করলেও সে কি করে বুঝাবে মেয়েটার পীড়াযুক্ত আর্তনাদ তার বুকে সহস্র বিষাক্ত ছুরিঘাতের মতো অসহনীয় যন্ত্রণা দিবে?

সেই তখন থেকে তুহিন রাগে ফোঁসফোঁস করছে। মায়রার শাশুড়ির কথা গুলি তার কানে বিষ ঢেলে দিচ্ছে যেন। সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না তখনের পরিস্থিতিটা। এখনো তুষের মতো জ্বলছে তার রাগ। তখনি খেয়াল যায় পরিচিত ও অবয়বে। চিনতে অসুবিধা হয়না মানুষটাকে।
বিষাদ মুখে শিফু করিডোরের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে। নিজেকে খুব করে বুঝিয়েছে তুহিন ভাই এর জন্যে তার আর কিছু করার নেই শুধু অপেক্ষা ছাড়া। এমনিতেও মানুষটা এবার নিজের দিক থেকে কঠোর হয়েছে হয়তো। কি দরকার শুধুশুধু একটু পা এগিয়ে দিয়ে মানুষটাকে কষ্ট দেওয়ার?
তখনি এক প্রকার তেড়ে আসে তুহিন। দাঁত চেঁপে কিড়মিড় করে বলে,
“কথা আছে তোমার সাথে।”
চমকে তাকায় শিফু। তুহিন কে রাগান্বিত দেখে ভ্রু কুটি করে সে। তার কোনো রকম জবাবের আশা না করে তুহিন বলে,

“তোমার ভাই তোমার ভবিষ্যৎ ভালোর জন্যে তোমাকে আমার হাতে তুলে দেয়নি এই মুহূর্তে। হেনতেন বুঝ দিয়ে দিয়েছে। তোমার ভাই এর কাছে তুমি যেমন দামী আমার কাছেও আমার বোন কিন্তু দামী।”
আঙ্গুল উঁচু করে ক্ষিপ্ত হয়ে তুহিন বলে উঠে, “মনে রেখো আমার বোনের অসম্মান কষ্টও কিন্তু আমি সহ্য করে নিবো না। বিয়ে যখন করেছে আমার বোনের সবকিছুর ভার যেন সে নেয়। তোমার ভাই কে কথাটা জানিয়ে দিও।”
তুহিন রেগেমেগে চলে যাচ্ছে। শিফু শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করে,
“এতে আমার দোষ কোথায় তুহিন ভাই?”
থমকায় তুহিন। ঘাড় বাঁকায় কেবল। মোটা স্বরে জবাব দেয়,

“নিজে চিন্তা করে দেখো। আমায় না মাঝেমাঝেই বলতে আসো আমার ভাই আমার ভালো চায় এটা তো খারাপ না। তাই তোমাকে বুঝাতে এলাম আমার বোনেরও আমি ভালোই চাই।”
“এবার বুঝেছেন তো? একটা ভাইয়ের কাছে তার বোন কতটা দামী?”
কিছু সময় চুপ যায় তুহিন। এরপর দায়সারাভাবে জানায়,
“বুঝেছি বলেই তো পথে থেকে সরে এসেছি। তবে মনে রেখো শিফুটিফু ভুলে যাইনি আমি।”
বলে গমগম পায়ে তুহিন পথ ছাড়ে। হৃদয়টা হু হু করে কেঁদে উঠে শিফুয়ার। চোখ গুলি পানিতে চিকচিক করে উঠলেও নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে সামলানোর চেষ্টা করল। চোখের পড়ে যাওয়া পানিটাকেও আটকে নিল শক্ত মনের জোরে।
“এই সব কিছুর মাঝে আমার দোষটা কোথায় তুহিন ভাই? আমায় কেন গুমড়ে গুমড়ে কাঁদতে হচ্ছে সবটাক্ষণ?”

মেদিনীতে আলো ফুটে চারিদিক চকচকে। মায়রা এখনো ঘুমে। কাল রাতে ড্রেসিং করার পর মেয়েটা সেই যে বেঘোরে ঘুমিয়েছে এখন পর্যন্ত উঠেনি। ইহাম মায়রার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বেলা আটটা বাজে। ভোর থেকে সে এভাবেই বসে আছে মেয়েটার সামনে। মনে পড়ে কাল রাতের কথা।
কাজের বাহানায় সে কেবিন থেকে বের হয়ে এলেও বাহিরেই দাঁড়িয়েছিল। ভেবেছিল অবস্থা বেগতিক দেখলে নিজেই যাবে। ডক্টর কেবিনে যাওয়ার আগে হাত জোর করে অনুনয়ও করেছিল বেশ করে। ওইটুকন মেয়েকে যেন ব্যথাবিহীন ড্রেসিং করে। ডক্টর আশ্বাস দিয়ে ঢুকলেও মায়রার কয়েকটা আর্তনাদ শুনেই অধৈর্য হয়ে যায় ইহাম। বুকের অসহ্য কামড়ানি আর ধাপাধাপিতে টিকতে না পেরে দ্রুত একদম হসপিটাল থেকে বের হয়ে কেবলই বিষাক্ত ধোঁয়া উড়িয়েছে।
ঘুমে থাকতে থাকতেই একবার ফাতেমা বেগম এসে দেখে গেলেন মেয়েকে। মেয়ের জামাই কে দেখে আর বসলেন না।

“ও কখন ঘুম থেকে উঠবে বাবা?”
“ঘুমের ঔষধ দিয়েছে তো একটু দেরি হতে পারে। ডক্টরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম বলেছে ৯ টার মাঝেই ঘুম ভেঙ্গে যাবে।”
“আচ্ছা তাহলে আমি এখন যাই।”
“আপনি চাইলে বসতে পারেন আম্মু।”
“না বাবা তুমি থাকো। আমি পরে আসব। ঘুম থেকে উঠলে ও তোমায় দেখতে পেলে খুশি হবে।”
ইহাম জবাব দেয় না। ফাতেমা বেগম চলে যেতেই সে বিড়বিড় করে বলে উঠে, “কে জানে খুশি হয় নাকি আরো রেগে বসে মাথামোটা টা।”
প্রায় নয়টার দিকে মায়রার চোখের পাতা নড়তে দেখে ইহাম নড়েচড়ে বসে। আস্তেধীরে মেয়েটা চোখ খুলতেই ইহাম মাথায় হাত রাখে। কোমল কন্ঠে শুধায়,

“কোনো রকম অসুবিধা হচ্ছে?”
প্রশ্নের জবাব দেয়না মেয়েটা। ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধীরে মনে করে সব। কাল রাতে লোকটার নিষ্ঠুর ভাবে উপেক্ষা করার বিষয়টা বড্ড আঘাত দিয়েছে তাকে। এই লোকটা এত পাষাণ কেন সবসময়? হৃদয়টা আবারও কেঁদে উঠে নিগূঢ় ভাবে। স্থবির থেকে মায়রা মুখ ফেরায়। ইহামও বুঝে অভিমানিনীর তপ্ত অভিমান। স্নিগ্ধ স্বরে ডাকে,
“মায়রা?”

ইহামের কোমল ডাক অগ্রাহ্য করে সে এখনো মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। তার চোখের সামনে ও মনের অবয়বে বারবার ভেসে উঠছে পাষাণ মানুষের কালকের নিষ্ঠুরতা। সে জানে না কোন কারণ, শুধু দেখছে কেবল নিষ্ঠুর করে তার প্রত্যাখ্যান টুক।
শুনশান নীরব কেবিনটায় ইহামের মৃদু আওয়াজও কেমন গমগম করে। লঘু স্বরে শুধায়,
“রাগ করে আছো আমার উপর? কথা বলবে না?”

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৪২

মায়রার সোজাসাপ্টা জবাব, “না।” ইহাম কিছু বলবে তার আগেই মেয়েটা অন্য দিকে তাকিয়ে জবাব দিল, “আপনি এই রুম থেকে যান।” মায়রার আহত গলা টের পায় বুদ্ধিবৃত্তি চতুর মস্তিষ্কের ইহাম। তাই নীরব থাকে। ক্ষীণ গলায় বলে, “এদিকে তাকাও। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলো তো শুনি কি বলছো।”
এমন কথায় মেয়েটাও যেন জ্বলে উঠল। দ্রুত করে মুখ ফিরালো ইহামের দিকে। শক্ত কন্ঠে খানিক উচ্চরবেই আওড়ালো,
“আপনি এখনি এই রুম থেকে বের হয়ে যান।”

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৪৪