মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৪৭

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৪৭
সাদিয়া

কেটে গিয়েছে দুই দিন। এই দুই দিনে মায়রা অসংখ্যবার কল করেছে ম্যাসেজ করেছে ইহাম কে। অথচ লোকটা ছিল পাষাণ, নির্বিকার। তার এত এত কল আহাজারি আবেগ মেশানো বার্তার কোনো উত্তরই আসে না। মায়রা ভেবে ভেবে অস্থির ওই লোকটা এতটা স্ট্রং, এত নির্দয় কিভাবে হতে পারে? অথচ কিছুকিছু ক্ষেত্রে মানুষটা পরম যত্নশীল একদম মোমের মতো নরম। কিছু ক্ষেত্রে নিজের সবটুকু ভুলে আগে তার অসুবিধার কথা চিন্তা করে। একটা লোক দুই ধরনের চরিত্রই এতটা শক্ত ভাবে কিভাবে পালন করে?

দুইটা দিন ধরে মেয়েটা কেঁদেকেঁদে অস্থির। খাওয়া ঘুমও বাদ দিয়ে দিয়েছে। ঘর থেকে বেরও হয়না। সারাক্ষণ ফোনটা নিয়ে বসে থাকে আর ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদে। এই ছিল কি তার কপালে? সে যে এত শক্ত কঠিন মনের মানুষের জন্যে না। ওই পাষাণ মানবটার সাথে তো সর্বদিক সামলে উঠতে পারছে না সে। কখনো নিজের কাছে মনে হয় ওই লোক তার কাছে সবচেয়ে আরামের সবচেয়ে স্বস্তির। মানুষটার কাছে থাকলে দুনিয়ার সকল শান্তি তার দোয়ারে এসে ভীড় জমায়। আবার কখনো লোকটার পাষাণ কঠিন দিক টা তার কোমল হৃদয়কে দুমড়েমুচড়ে নিঃশেষ করতে এক বিন্দু ছাড় দেয় না। এই দুই অনুভূতির যাঁতাকলে সে পিষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অসম কষ্ট আর যন্ত্রণায় সে কখনো কখনো ঠিক করে নেয় ওই লোকটার সাথে থাকা দায়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সকাল থেকে মায়রা ঘর থেকে বের হয়নি। ১০ টার উপরে বাজে। কাল সারাটা দিন মনে হয় না কিছু খেয়েছে এক কাপ চা আর অর্ধেক টা রুটি ছাড়া। ফাতেমা বেগম তিন চারবার ডেকে গিয়েছেন খাবারের জন্যে। সে উত্তর করেনি। আজ সকাল থেকে তার নিজেরও রাগ হচ্ছে। দৃঢ় হওয়ার চেষ্টা করছে নিজের ভেতরেও। মানুষটাকে আর কল দিবে না সে। যা খুশি করুক ওই লোক। ওই মানুষটা এতটা পাষাণ হলে সে কেন পারবে না?
ইহাম লাগাতার কল করছে মায়রা কে। ম্যাসেজ করেছে হাজার খানেক। মেয়েটা ফোনের কাছে বসেও সব দেখেও ধরছে না কোনো কিছুই। দুই দিন যে এত বার করে সে কল করেছিল তখন ওই লোকটার ফোন কোথায় ছিল? বলবে এখন তার ফোনও বাথরুমে পড়ে গিয়েছে তাই কল ধরেনি। বুঝুক মজা ওই ভণ্ড লোকটা এড়িয়ে চলার যন্ত্রণা টুক কতটা ভ’য়ংকর।

ফাতেমা বেগম অনবরত দরজায় কড়া নাড়ছেন। বারবার বলছেন ‘দরজা খোল।’ দুদিন ধরে কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেললেও দুপুরে ভরপেট খেয়েছে আনন্দের সাথে। লোকটাও একটু বুঝুক ইগনোর করা কেমন লাগে।
“কিরে মায়রা দরজাটা খুলবি? জামাই কলে আছে।”
কপাল কুঁচকায় মায়রা। নাক ফুলিয়ে মুখ ভেংচায়। উমম ঢং যত। কল না ধরলেই পেয়েছে একটা শাশুড়ি তার কাছে নালিশ মারে। যা খুশি করুক তবুও আজ ধরবে না সে কল।
“কিরে দরজা খোল। ছেলেটা কখন থেকে কল করছে।”
“করুক আমি ঘুমাচ্ছি।”
“তুই ঘুমালে কথা বলছে কে?”
“আমার আত্মা।। যাও তো এখন।”

“আরে বজ্জাৎ মেয়ে আগে তুই দরজা খুল। একটু তো কথা বলে নে। মায়রা, মা ছেলেটা রাগ করবে।”
“করুক। আমি যখন তাকে কল দেই? সে তো ধরে না।”
“আচ্ছা তুই কলটা এবার ধরে তো দেখ কি বলে। ছেলেটা বলছে খুব দরকারি কথা আছে। একটু কথা বলেই দেখ না মা।”
মায়রা বালিশ কোলে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে বসে আছে। মায়ের প্যানপ্যানানি ভালো লাগছে না তার। সে এটাও জানে যতক্ষণ উনার জামাই বাবার সাথে কথা না বলবে সে ততক্ষণ থামবেন না তার মা। একটু পর পর কানের কাছে এসে ঘ্যানঘ্যান করবেন। আর বড় কথা নিজেকে যতই শক্ত রাখুক তার নিজেরই যে কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে না এমনও নয়।

“তুমি যাও আমার ফোন দিয়ে কল করছি।”
“তাড়াতাড়ি কর মা।”
মায়রা সময় লাগিয়ে মিসকল দিলো ইহামের নাম্বারে। কল দিলেও সেই তো কেটে নিজে ঘুরাবে তো কি দরকার লম্বা কল করার? তার চেয়ে মিসকলই ভালো। এমনিতেও তার ফোনে টাকা নেই। ব্যালেন্সের কোনো প্রয়োজন পড়ে না তার তাই বলেও না। আর লোকটা যতই শক্ত নির্দয় হোক দায়িত্বের দিক থেকেও চরিত্রের মতোই শক্ত দৃঢ়। তার সকল প্রয়োজনীয় জিনিসের খরচাপাতি নিজ দায়িত্ব লোকটায় সব দিয়ে থাকে।
“হ্যাঁলো।”
“….
“আছো? কথা বলছো না কেন মায়রা?”
“মুখে টেপকস লাগিয়েছি আপাদত তাই কথা বলতে পারছি না। আপনি কি বলবেন তা বলুন।”
“কত গুলি কল দিয়েছি তোমায় মায়রা? ফোন তুলোনি কোন?”
“একই প্রশ্ন যদি আমি আপনাকে করি তখন? কি বলবেন?”
“…..
“কি হলো? এখন চুপ করে গেলেন যে?”

“মায়রা লিসেন, তোমাকে আমি বলেছি না হাজবেন্ট ওয়াইফের সম্পর্কটা একান্ত পারসোনাল। খুব গভীর ব্যক্তিগত। আমাদের দুজনের মাঝে যত যাই হোক এখানে কখনো তৃতীয় ব্যক্তিকে আনবে না। বলিনি তোমায়?”
ইহামের জলদগম্ভীর গলায় প্রশ্ন করার ধরনটা মায়রা বুঝল। কি কারণে এটা বলেছে সে তাও জানে। মোটা গলায় তাই নিজেও জবাব দিল এবার,
“আমি কি আপনাকে বলেছি আম্মু কে কল দিন? আপনি নিজ থেকেই উনাকে কল দিয়েছেন তা আমার উপর এখন দোষ চাপানো হচ্ছে কেন?”
“কলটা ধরলে কি আমার উনাকে ফোন দিতে হতো? নাকি আমাকে উনার কাছে ডিসকমফোর্ট ফিল করতে হতো বলো তো?”

কোনো জবাব দেয় না মায়রা।
“কি হলো কথা বলছো না কোন?”
“আমার কিছু বলার নেই। আপনি কি বলতে ফোন করেছেন বলুন।”
ওপাশ থেকে মানুষটার দীর্ঘশ্বাস ফেলার শব্দ আসে। তবুও মায়রা চুপ থাকে। কোনো প্রশ্ন করে না। মিনিট এক সময় নিয়ে ইহান জানায়,
“পরশু রাতে এক্সিডেন্ট করেছি।”
এতক্ষণ মায়রা গা ছাড়া ভাবে কথা বললেও শেষের বাক্যটা তাকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে। কানের পাতলা পর্দায় ঠেকল বিজলীর মতো ঝিলকে উঠেছে। পুরো আকাশটাই বুঝি মাথায় পড়েছে তার। হতবিহ্বল বিমূঢ় মায়রা তৎক্ষণাৎ বুঝল না কি করবে কি বলবে। শুধু টের পেল পাথরের মতো জমে গিয়েছে সে।
“তবুও আমাকে না জ্বালালে তোমার চলে না তাই না বেয়াদব মেয়ে?”

কথাটায় এত কোমলতা মায়া মিশিয়ে বলল ইহাম যে এই প্রথম মায়রার ‘বেয়াদব’,শব্দটাকেই বড্ড শ্রুতিমধুর আপন ও স্নেহের লাগল। যেন শব্দটার মাঝে মানুষটা ভেতরের লুকানো আবেগ টা গুঁজে দিয়েছে সংগোপনে। লোকটা বাহির থেকে যতই কঠোর নির্দয় দেখাক মানুষটার গহীনটা বড্ড কোমল মোলায়েম। যা লোকটার কাজের গভীর মর্মার্থে লুকিয়ে থাকে। হঠাৎ মায়রা ফুঁপিয়ে উঠল। মেয়েটার নাক টানা ফ্যাচফ্যাচ শব্দ শুনে ক্রুর হাসে ইহাম। মোলায়েম মৃদু কন্ঠে বলে,

“এ্যাই মাথামোটা মেয়ে কাঁদছো কেন? আমি সুস্থ আছি। বেশি কিছুই হয়নি। কান্না থামাও প্লিজ।”
ইহামের নরম গলার স্বর আরো গলিয়ে দিচ্ছে মায়রা কে। ফুঁপানি বাঁড়ছে মেয়েটার।
“শুনো প্লিজ কান্না থামাও। দেখো তোমার কান্নার শব্দে আমার কানের পর্দা বিরক্তিতে ফেটে যাবে।”
মায়রা নির্বাক থেকে কাঁদে শুধু।
“ট্রাস্ট মি মায়রা তোমার কান্নার স্বর আমায় যেমন বিরক্তিতে রাগ তুলে তার চেয়ে বেশি বুকের বা পাশটায় সূক্ষ্ম এক চিনেচিনে ব্যথা আমায় আরো বেশি অশান্তি দেয়। যন্ত্রণায় খুব করে ভোগায়। কান্না থামাও জান।”
ইহামের ভাঙ্গা স্বর অধৈর্য করে তুলে মেয়েটাকে। শব্দ করে কেঁদে বলে,
“আপনি এখন কেমন আছে ক্যাপ্টেন সাহেব?”
“আগে কান্না থামাও পরে বলছি।”
“আমি ভিডিও কল করছি। আপনি ধরুন।”

মায়রা কল কাটে। ঝাপসা চোখের কারণে কিছু দেখতে পায়না স্কিনে। ব্যস্ত ভঙ্গিতে মেয়েটা তাড়াহুড়া করে চোখের পানি মুছে হোয়াটসএপে ঢুকে।
“কোথায় ব্যথা পেয়েছেন দেখান আমায়?”
“রিলেক্স, আম ফাইন। হাতে আর পায়ে সামান্য একটু চোট পেয়েছি। অল্পেই সেরে যাবে।”
“আপনি দেখাবেন?”
এমনিতেই দুইদিন কান্না করতে করতে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছিল মেয়েটা। আবার কান্নার ফলে একটা স্নিগ্ধ বাচ্চাসুলভ ভাব এসেছে। টসটসে রঙ্গিম গাল টকটকে নাক। তুলোর মতো তুলতুলে ঠোঁট গুলি ভেঙ্গে কাঁদার দৃশ্য সব যেন ইহাম ঘোর লাগা চোখে চেয়ে দেখছে। চোখে মুখে তার মোহ। নেশায় যেন তীক্ষ্ণ চোখ দুটিও ঘুরে টালমাটাল। মাতোয়ারা কন্ঠে বিড়বিড় করে বলল,

“তোমার চেরির মতো নাকে কা’মড় দিতে ইচ্ছা হচ্ছে মেরি জান।”
লজ্জায় মায়রা খানিক সংকোচিত হলেও নাক টেনে চোখ মুছে।
“একটুও এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না ধড়িবাজ লোক। আপনি বড্ড চালাক তা আমি জানি। কোথায় ব্যথা পেয়েছেন সেটা আগে দেখান।”
“বললাম তো মায়রা। বেশি নয়। বাদ দাও। আগে আমায় বলো চোখ মুখের এই অবস্থা কেন তোমার?”
মায়রা খেই হারায়। অধৈর্য বিচলিত হয়ে সে উচ্চ স্বরে ফোনের মাঝে চেঁচিয়ে উঠে, “আপনি কোথায় ব্যথা পেয়েছেন আমায় দেখান অসভ্য লোক।”

মায়রার এমন উদভ্রান্তের আচারণ আর অস্থিরতা দেখে ইহাম ম্লান হাসে।
“শান্ত হোও মায়রা। দেখাচ্ছি। এমন করার কারণ কি বোকা মেয়ে? বললাম তো বেশি কিছু হয়নি।”
নাক টেনে টেনে কাঁদে মায়রা। বাচ্চাদের মতো করে প্রশ্ন করে, “এসব বেশি কিছু না আপনার জন্যে তাই না?”
মায়রা কে দেখে স্মিত হাসে ইহাম। বাঁকা হাসি রেখেই বলে, “মরিনি বেঁচে আছি। এটাই বেশি না?”
মায়রার কান্না আরো বাড়ে। ইহাম যেন পড়ে আরেক বিপদে। “এই পাগল কে বলে তো পড়েছি আরেক বিপদে।”
“মায়রা লক্ষ্মী টা প্লিজ শুনো আগে আমার কথা। দেখো ডক্টরের তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই অকারণেই সামান্য ব্যথায় এত ব্যান্ডেজ করে দিয়ে গেছে। তুমি চিন্তা করো না আমি তিন দিনেই একদম ফিট হয়ে যাবো।”
মেয়েটা কাঁদতেই থাকে। স্কিনে দেখা যাচ্ছে কপালের ডান পাশে ওয়ানটাইম ব্যান্ডেজ, বাম হাত ডান পা দুটোই বোধহয় বেশ আহত। ব্যথায় তার কলিজা যে খামছে ধরছে তা এই পাষাণ লোকটা কি বুঝবে?
“চুপ। একদম কান্না চুপ। মায়রা কান্না না থামালে আমি আসলে কিন্তু তুলে এক আছাড় মারব।”

অনেকক্ষণ ধমকাধমকি আর বুঝানোর পর মেয়েটা একটু স্থির হয়েছে।
“আপনি অসুস্থ আমি আসি আপনার কাছে?”
মায়রার ওই কথায় কত আকুতি আর অবুঝ আবদার ছিল তা ওর কন্ঠেই বুঝা যায়। ফোনের স্কিনের দেখা যায় মেয়েটার সরলসোজা স্নিগ্ধ মুখশ্রী টা। ইহাম কোমল অথচ ধীরো কন্ঠে জানায়,
“প্লিজ মায়রা একটু বুঝো। আমি তোমাকে আনতে চাইছি না তার নিশ্চয়ই একটা কারণ আছে? এটুক ভরসা কি তুমি আমায় করো না? সময় হোক আমি নিজে আনব তোমায়। প্লিজ অবুঝের মতো আবদার করো না।”
মানুষটার এত বুঝদার শান্ত কন্ঠে মায়রা আর কিছু বলার সাহস পায় না। কিন্তু ব্যাকুল অস্থির মনের আহাজারি উপেক্ষা করতে পারছে না সে। মাথা নিচু করে ক্ষীণ স্বরে বলে,

“একেবারের জন্য নয়। আপনি তো অসুস্থ। ওই সময়টুক না হয় আপনার সাথে থাকলাম।”
মায়রার আবদার আর সরল মুখটা কলিজায় বিঁধে। তবুও নিজেকে শক্ত করে জবাব দেয় ইহাম,
“তার কোনো প্রয়োজন নেই মায়রা। তুমি কেন বুঝতে চাইছো না বলো তো? আমি তো সব দিক বিবেচনা করেই এমন বলছি নয়কি? নিশ্চয়ই কারণ আছে। আর যাইহোক কোনো রিস্কের মাঝে তোমায় আমি আনছি না।”
ইহামের শক্ত গলা আর কঠিন মুখ দেখে মায়রা বুঝে ওই ঘাড়ত্যাড়া রগচটা লোকটা আর কোনো ভাবেই তার কথা শুনবে না। না নিজের সিদ্ধান্ত থেকে নড়বে। নিজে যা বলেছে তাই করবে। নাক ফুলিয়ে মায়রা অভিমান গলায় বলে,
“ঠিক আছে গেলাম না আপনার কাছে। করলাম না সেবা। আমি কি ঠেকায় পড়ে গিয়েছি? নাকি আমার পেটের পাকস্থালী তে খাবার যাচ্ছে না যে আপনার ওখানে না গেলে আমি মরে যাবো?”

মায়রার রাগ দেখে ইহাম ঠোঁট টিপে হাসে।
“তাই বুঝি? কারো ঠেকা পড়েনি? কেউ আসতে চায় না তো?”
“না।”
“ওকে। আমি আনতে গেলে যেন তার এই কথা গুলি মনে থাকে। রেকর্ড করে রাখলাম।”
গাল ফুলিয়ে মায়রা রুষ্ট গলায় বলল, “যা খুশি করুন পাষাণ লোক। নির্দয় জল্লাদ কোথাকার।”
ইহাম হাসে। মেয়েটা যেন তার সকল ক্লান্তি অবসাদ করার মহাঔষধ।
“কাল থেকে যে এতবার কল করেছিলাম ধরলে না কেন?”
“শোধ নিয়েছিলাম।”
“আমায় ইগনোর করা হচ্ছিল?”
“তো?”
“বিশ্বাস করো শরীরটা ফিট থাকলে এর শাস্তি তোমায় উড়েউড়ে হলেও সামনে গিয়ে দিয়ে আসত ফাহাদ ইহাম চৌধুরী।”

দুই মাসে তুহিনের মাঝে অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। লোকটা আগে থেকেই হ্যান্ডসাম ছিলো তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এখন লোকটার এত জৌলুস বেড়েছে যা বলার মতো না। যেন যৌবনের দুয়ার খুলেছে মনের সব আনন্দ ঠেলে। পরিবেশের সাথে মনে হয় খুব সহজে খাপ খায়িয়ে নিয়েছে মানুষটা। আজকাল তুহিন ভাই কে নিয়ে শিফুর মনের ভয়ের ডালাপালা বাড়তে থাকে। ওখানে গিয়ে কি কারো প্রেমে পড়ে যাবে সে? মেয়েরা যদি তুহিন ভাই এ তে মজে যায়? আচ্ছা ওখানে গিয়ে লোকটা একদম তাকে ভুলে গিয়েছে না? কথাবার্তা যে খুব কম বলে। হাজার মাইল দূরে থেকেও আলাদা একটা সরু দূরত্ব তবুও বজায় রাখছে মানুষটা।

আজকাল তুহিন ভাই প্রতিদিন নতুন নতুন জায়গায় নতুন নতুন বিদেশি বন্ধুদের সাথে ছবি আপলোড করে ফেসবুকে। বন্ধুদের মাঝে যে বিদেশি মেয়ে বন্ধু থাকে না এমন হয়। মাঝে মাঝেই দেখা যায়। আর তার বুকটা কা’মড়ে ধরে যন্ত্রণায়। একটা গাঢ় ভয় তাকে করে তুলে আরো অস্থির দিকভ্রান্ত। শিফু রোজ তুহিন ভাই এর আইডি চেক করে। এড না থাকলেও বাসায় থাকা অবস্থায় ঘন্টায় ঘন্টায় হয়তো আইডি চেক করে। আবার নতুন কোনো ছবি এড করলো কি না তা দেখতে।
স্কুল প্রাইভেটে নিজেকে ডুবিয়ে রাখলেও দিন শেষে মনের কোণ জুড়ে বেহায়ার মতো ঘুরপাক খায় কেবলি তুহিন ভাই।
আকাশের দিকে তাকিয়ে শিফু উদাস গলায় আওড়ায়, “আমার এত অপেক্ষার অবসান ঠিক কত দূর বলতে পারেন তুহিন ভাই?

এক সাপ্তাহে ইহাম মোটামুটি সুস্থ। কাল রাতে কথা হয়েছিল মায়রার সাথে। আর এখন রাত ১০ টা বাজে। এর মাঝে একটা বারও কল দেয়নি লোকটা। এমন তো করে না। খুব বেশি ব্যস্ত হলেও ১ কি ২ মিনিট কথা তো তার সাথে বলেই। কিন্তু আজ কেন কল করল না?

মায়রা নিজেই কল দিয়েছে ইহামের কাছে। একবার দুবার করে কল হয়ে যায় কিন্তু লোকটা কল ধরে না। তৃতীয় বারের মাথায় কল দেওয়ার পর কল টা কেটে আসে। মায়রা ভেবেই নেয় এখনি কল আসবে লোকটার থেকে।
এক মিনিট দুই মিনিট করতে করতে পাঁচ মিনিট হয়ে যায় কল আসে না। মায়রা চিন্তিত ভঙ্গিতে আবার কল দেয়। এবারও কল কেটে যায় কিন্তু আর কল আসে না। কি হলো? লোকটা কল কেটে দিলেও কল ব্যাক কেন করছে না? শরীর অসুস্থ হলো নাকি আবার? চিন্তা বাড়ল তার। ইহামের শরীর অসুস্থ এই কথা ছাড়া বাকি সব চিন্তা সে মাথা থেকে সরিয়ে দিয়েছে। অনবরত কল করেই যাচ্ছে ইহাম কে। এক পর্যায়ে ইহাম কল রিসিভ করল। ওপাশ থেলে ধমক সুরে বলল,

“হোয়াট’স রং উইথ ইউ মায়রা? মাথায় কি এই সেন্সটুক নেই কল কাটছি যেহেতু কাজে থাকতে পারি?”
সেই আগের রাগী হিংস্র স্বর। মায়রা কিছু বলতে গিয়েও থমকে যায়। মানুষটা বোধহয় চিবিয়ে চিবিয়ে তার উপর খুব ক্ষোভ নিয়ে কথাটা বলেছে। মায়রা ঢোক গিলে। সত্যি তার মাথায় এমন কোনো ধারনা আসেনি যে লোকটা হয়তো ব্যস্ত। তার অবুঝ মন বারবার ঘিরে ধরছিল লোকটার শরীর এই নাকি আবার খারাপ হয়েছে।
ক্ষীণ গলায় বলে, “আমি ভেবেছিলাম…”

“কি ভেবেছিলে তুমি? ভাবো টা কি তুমি? আমাকে কি একটু শান্তি দিবে না? সমস্যাটা কোথায় তোমার মায়রা? তোমার এই অবুঝ ন্যাকামো ভাবে আমি বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি।”
বিস্তর বিস্ময়ে মায়রা নির্বাক। মুখের বুলি হারিয়ে সে নিশ্চলের মতো বসে রইল। লোকটা কি বলছে এসব? সে কি সত্যি শুনছে? নাকি বেশি চিন্তায় ইহামের কথা ভুল শুনছে সে?
“আমি টোটালি হাপিয়ে উঠেছি তোমার অবুঝ নির্বুদ্ধিতার কারণে। একটা মেয়ে এতটা অবুঝ কি করে হয়? মাথায় কি আসলেই তোমার গোবরে ঠাসা গবেট কোথাকার। ফাকিং শীট। শীট।”
মায়রার চোখে পানির কণা আটকে আছে। টুপ করে গড়িয়েও পড়ছে না। ওরাও কি তার মতো জমে গিয়েছে? ভেতরটা এত ফাঁপাফাঁপা লাগছে কেন?

“আমার আসলে আগেই বুঝা উচিৎ ছিল আমার সাথে তোমার মতো কম বয়সী একটা মাথামোটার কিছুতেই যায় না। আম ডিপরেস্ট। তোমার মর্জির কোনো ঠিক আছে মেয়ে? কখন কি চাও তুমি নিজে জানো সেটা? এতটা আহ্লাদী কি করে হতে পারো তুমি? আগে তো আমায় দু চোখে দেখতে পারতে না। কথার মূল্যায়ন করতে না। এখনো করো না। তবে এখন এত চুকচুকামি কিসের মেয়ে তোমার? কিছু হতে না হতেই গাল ফুলিয়ে দাও। এতটা ন্যাকামো কি করে করতে পারো ড্যাম ইট? কি মনে হয় আমাকে তোমার? চাকরি টাকরি ছেড়ে সারাক্ষণ তোমায় কোলে নিয়ে বসে থাকি? সারাক্ষণ তোমার সাথে ফোনে গদগদ করব এমনটাই ভাবো স্টুপিড? যখন যা চাইবে সেটাই করতে হবে? কল করে একটু অপেক্ষা করা যায় না? সাথে সাথেই ধরতে হবে? আমাকে তোমার বেকার নিষ্কর্মা লাগে? যে সব কাজ ভুলে তোমায় নিয়ে পড়ে থাকব? আমি একজন সোল্ডার তোমার মতো বসে বসে শুধু অন্য ধ্বংস করি না। সারাদিন আমায় কাজ করতে হয়। মৃত্যু কে হাতে নিয়ে ছুটতে হয়। তোমার পুষালে তুমি থাকো নয়তো চলে যাও। তবুও এত ন্যাকামি করে বারবার বিরক্ত করতে এসো না আমার কাছে।”

গট করে কল কেটে গেল। এতক্ষণ বহু কষ্টে আটকে রাখা নিশ্বাসটা এবার আস্তেধীরে বেশ সময় নিয়ে ফেলল মায়রা। চোখ গুলি ঝাপসা হয়ে এসেছে। বুকটা প্রচন্ড রকম ভার লাগছে। শ্বাসকষ্টের রোগীর মতো টেনেটেনে মেয়েটা দম নিলো। নিশ্বাসটাও যন্ত্রণার ভীড়ে কোথাও যেন আটকে গিয়েছে। দমটা বন্ধ হয়ে আসছে কেন? এতক্ষণ ইহামের লাগাতার বলা এত কথার কোনো মানে খুঁজে পাচ্ছে না তার অচল মস্তিষ্ক। সামান্য কয়েকটা ফোন কলের জন্যে লোকটা এত গুলি কথার আঘাত করল তাকে? সে বসে বসে অন্য ধ্বংস করে? তার ন্যাকামো অবুঝ ভাব বেশি? ওই মানুষটা তার এইসবে এতই বিরক্ত? আর? আর কি যেন বলল? সব বুঝে পুষালে যেন থাকে নয়তো চলে যাওয়ার কথা বলল লোকটা? ওইভাবে এত ক্ষিপ্ত সুরে? ইহামের বলা প্রতিটা কথা প্রতিটা শব্দ তার বুকে তীক্ষ্ণ বিষাক্ত তীরের মতো বিঁধেছে। তার ভেতরটা ইহাম আহত ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে এক মুহূর্তে। সব কিছু যেন তার শূন্য লাগছে। ঝাপসা চোখ দিয়ে গলগল করে পানির স্রোত বইছে। নিশ্বাস নিতে এত কষ্ট হচ্ছে যেন একটু কৃত্রিম অক্সিজেন পেলে জানটা বাঁচবে। খিঁচুনির মতো শরীরটা কাঁপছে তার। আটকে আটকে নিশ্বাস নিচ্ছে লম্বা সুরে। ফেঁপে আসা ভার বুকটায় অক্সিজেনের বড্ড অভাব হচ্ছে যে।

কি করবে কি বলবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না মায়রা। তার নির্বাক ভাব যেন তাকে আরো যাতনা দিচ্ছে। চেঁপে রাখা কষ্টটা ঠিকঠাক ভাবে বের করতে পারছে না বলে দমটাও বুঝি এই আটকে এলো। শরীরটা অসম্ভব হারে কাঁপছে তার। ঝাপসা চোখে দেখল পাশে থাকা ফোনটায় কল এসেছে আবারও। একটা আননোন নাম্বার বোধহয়। মায়রার শরীর কাঁপছে হাত কাঁপছে। কলটা ধরবে তার শক্তিও যেন পাচ্ছে না নিস্তেজ শরীরে। ফোনের দিকে তাকিয়েই মেয়েটা মৃগী রোগীর মতো কাঁপছে।

অনবরত কল আসায় মায়রা কাঁপাকাঁপা হাতে রিসিভ করে। কিন্তু গলা দিয়ে তার কোনো কথা বের হয় না। দলা পাকানো যাতনার পিষ্ট কন্ঠস্বর যেন বরফে জমে গিয়েছে। ওপাশ থেকে ব্যস্ত ভঙ্গিতে কেউ হ্যালো হ্যালো করে। মায়রা জবাব দেয় না। কাঁপুনির কারণে তার দাঁতে দাঁতে বারি খায়। ওপাশ থেকে বারবার “হ্যালো” বলা কন্ঠের অধিকারি কে তার স্বল্প সময়ের পরিচিত মনে হলেও ঠিক ঠাউর করতে পারল না তার অচল অসাড় মস্তিষ্ক।
“হ্যালো? হ্যালো ম্যাম? শুনতে পাচ্ছেন? আছেন আপনি? সাড়া দিন।”

বিকার শূন্য মায়রা নিশ্চল যেন বোবা। কাঁপুনির কারণের নিশ্বাসের গতি থেমে আসছে তার। বেশ সময় পরপর অল্প একটু নিশ্বাস টানছে মেয়েটা। বুকের উপর পাহাড় সম ওজন নিয়ে কেউ যেন বসেছে জান কবজের জন্য।
“হ্যালো ম্যাম? ম্যাম আছেন আপনি? আমি ইবরাহিম বলছিল।”

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৪৬

এটা ওই ইবরাহিম না? ওই পাষাণ লোকটার কলিগ লেফটেন্যান্ট ইবরাহিম? মায়রার চোখ অন্ধকার হয়ে আসে। বুকের চাঁপা কষ্ট গুলি করাল গ্রাসের মতো তার গলা চেঁপে ধরেছে অসুরী শক্তিতে। চোখ গুলি কলিজা চিঁড়া যন্ত্রণায় নিভে আসছে। কানে ভাসে,
“ম্যাম প্লিজ রেসপন্স করুন। শুনতে পাচ্ছেন আপনি আমার কথা? এদিকে খুব বড় একটা ঝামেলা হয়ে গিয়েছে।”

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৪৮