মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৫২

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৫২
সাদিয়া

ভেতরে পা রাখতেই মায়রা হতবাক হয়ে যায়। সব কিছু এত গোছানো এত পরিপাটি দেখে সে অবাকই হয়। অথচ সে সবসময় অগোছালো। তার ঘরের ওয়ারড্রব থেকে শুরু করে ঘর গোছানো সব কাজ তার আম্মু করে দিতো। মায়রা বিহ্বল রূপে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে সব কিছু দেখে গেল। এটা তার ঘর। তার সংসার। একটা ব্যক্তিগত মানুষ ব্যক্তিগত ঘর আর সব দায়িত্ব কেবলি তার। অদ্ভুত একটা শঙ্কা মেশানো জড়তা কাজ করে মায়রার মাঝে।

সে কি করে পারবে এসব কিছু? সংসার মানে কি এত বড় দায়িত্ব? সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠা, নিজের ফ্রেশ হওয়ার সাথে ঘরটাকেও ফ্রেশ করা, রান্নাবান্না, মাছকাটা সবজি কাটা, কাপড় কাচা, ঘরের যাবতীয় কাজ। ভেবেই মায়রার শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠল। কি সাংঘাতিক দায়িত্ব মেয়েদের জীবনে। এই জন্যেই বুঝি মা বলত “আমার হাতে হাতে একটু কাজ কর অভ্যাস কর নয়তো পরের বাড়ি গিয়ে নাকের পানি চোখের পানি এক করবি।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বড্ড মিস করল মা কে। মায়রার দায়িত্ব শুরু হওয়ার আগে থেকেই তা চিন্তায় মাথা ভার হয়ে গেল তার।
আচমকা ইহাম পিছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরল। মাথায় চুমু খেয়ে বলল, “অলরেডি ৯ টা বেজে গিয়েছে মায়রা। এখনি যেতে হবে আমার। তুমি ফ্রেশ হয়ে এসে নাস্তা করে নাও।”
মায়রা হতবাকে কিছু বলতে পারল না। বিস্ময় ভাবটা তার যেন এখনো কাটছেই না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে নির্বোধের মতো।
“দরজা ভালো করে লাগিয়ে রাখবে। সাড়ে বারোটার দিকে লাঞ্চে আসব আমি বাদে কেউ ডাকলেও দরজা খুলবে না। বুঝা গেল?”

বিহ্বল মায়রা কেবল মাথা দুলালো। ইহাম তার গাল দুটির উপর হাতের তালু ছোঁয়ে মুখ বাড়িয়ে কপালে চুমু দেয়। এরপর কোনো কথা ছাড়াই নিজের চিরাগত নিয়মে ঠোঁটের একপাশে শব্দ করে চুমু দিয়েই বের হয়ে যায়।
নতুন ঘর নতুন পরিবেশে কোয়াটের রুমে মায়রা কেবল একা পড়ে থাকে। কিছুসময় এভাবেই স্তব্ধ হয়ে রইল মেয়েটা।
এরপর পরিস্থিতি সামলেও নিলো দ্রুত করে।

রাতের ফ্লাইটেই ইহাম চট্টগ্রাম ফিরতে চেয়েছিল। কিন্তু বউ কে একটু সময় দেওয়ার লোভ সামলাতে না পেরে সিদ্ধান্ত নেয় কাল সকালে গিয়েই ডিউটি জয়েন্ট করবে। রাতে কথায়কথায় ঠিক হয় মায়রাও এবার কোয়াটের ফিরবে। মেয়েটা আপত্তি না করলেও মহিন সাহেব দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। অতঃপর উনাকে ফাতেমা বেগম বেশ করে মানিয়েছেন। ওদের বিষয়ে সবটা বলেছেনও উনার কাছে। মেয়েটা একটু স্বামীর সাথে থাকুক। দুজন দুজন কে বুঝুক সময় দিক সব ঠিক হয়ে যাবে। অনুষ্ঠান পরে এমনি বড় করে করা যাবে।
মায়রা একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে উঠে দাঁড়ায়। গুটিগুটি পায়ে পায়চারী করে ঘরময়। একা একলা নতুন একটা ঘরে থাকতে ভয়ও হচ্ছে তার। কিন্তু বারবার মনকে বুঝ দিতে চেয়েও যেন পারছে না। তখনি মায়রার ফোন বাজে। আচমকা নীরব ঘর টা কেঁপে উঠে সাথে মায়রার বুক।

“হ্যালো আম্মু।”
“পৌঁছেছিস মা?”
“হেলিকপ্টার দিয়ে আসতে কত সময়ই লাগে মা?”
“তা তো জানি। জামাই বাবা চলে গিয়েছে?”
“হুম।”
“এখন কি একা আছিস?”
“হু।”

মেয়ের অবস্থা অদূরে থাকা ফাতেমা বেগম বুঝতে পারেন। উনার ঘরটাই কেমন নিঃস্ব নিঃস্ব লাগছে। একেবারেই ফাঁকা হয়ে গিয়েছে উনার বাসাটা। বুক ভার নিয়েও মেয়েকে বুঝ দিতে তিনি বললেন, “মন খারাপ করিস না মা। প্রথমপ্রথম আমারও খারাপ লাগত। এখন দেখিস না? একটু সময় পাই? সব ঠিক হয়ে যাবে মা। চিন্তা করিস না কিছু। একা থাকতে প্রথম প্রথম কষ্ট হলেও দেখবি মানিয়ে নিয়েছিস। এখন অন্তত একটু একটু করে রান্নাবান্না টা শিখে নে। সব কাজ তো তোকেই করতে হবে মা। স্বামী তো সংসার তোর কাজও তোর। যখনি মন খারাপ হবে আম্মু কে ফোন দিবি কেমন?”

নীরবে চোখের পানি ফেলে মায়রা। বাবা মা কে ছাড়া তার খুব কষ্ট হচ্ছে। মন কেমন করছে।
“শুন মা সবজি কাটতে গেলে সাবধানে করিস। আবার হাতটাত কেটে বসে থাকিস না। ইহাম কে বলিস মাছ বাহির থেকে যেন কাটিয়ে নিয়ে আসে। তুই তো মাছের আশেপাশেও যাসনি কখনো। আস্তেআস্তেই অভ্যাস হয়ে যাবে।”
ফোনের ওপাশ থেকে ফাতেমা বেগমের গলা বড্ড ভার হয়ে এলো। উনার কম্পিত ভেজা গলা পেয়ে মায়রা আরো চোখের পানি ফেলে।
“আর শুন গ্যাস সাবধানে জ্বালাবি। হাতটাত যেন না পুড়ে। তেলে সবধানে মাছ সবজি ছাড়বি ছিটকে আসলে কিন্তু ফোস্কা পড়ে যাবে।”

কথা শেষ করেই ফাতেমা বেগম আঁচলে মুখ গুঁজে নেয়। আদরে আহ্লাদে বড় করা একটা মাত্র মেয়ে উনার। উনার ঘর ফাঁকা করে আজ পরের ঘরে। বুক চিঁড়ে আসা যন্ত্রণা উনি কাকে দেখাবেন?”
মায়রা ফুঁপিয়ে উঠে শব্দ করে।
“এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে কেন গেলে হ্যাঁ? এখন কষ্ট পাও। আরো কাঁদো।”
“দূর বোকা কে কাঁদছে? কাঁদছি না। তুইও একটুও কাঁদিস না। ইহাম কে বলব কিছুদিন পর ছুটিতে তোকে নিয়ে আসতে।”
“তোমায় মিস করছি মা।”

“প্রথমপ্রথম তো তাই এমন লাগছে। কিছুদিন পর গেলে এমন লাগবে না। মন দিয়ে সংসার করো মা কেমন? আম্মু সবসময় ফোনে তোমার সাথে কথা বলব।”
মায়রা কানের কাছ থেকে ফোন দেখে বলে, “আম্মু কলটা রাখো। আমার শাশুড়ি কল দিচ্ছেন।”
“আচ্ছা মা কথা বল। সাবধানে থাকিস মা।”
মায়রা দ্রুত শাশুড়ির কল রিসিভ করে।
“হ্যালো আসসালামু আলাইকুম মা।”
“ওলাইকুম আসসালাম। তুমি কি কাঁদছো মায়রা? গলাটা এমন শুনাচ্ছে কেন?”
“…..
“মন খারাপ করো না। আস্তেআস্তে সংসারটা গুছিয়ে নাও। মেয়েদের জীবনই তো এমন। বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি। মন খারাপ করে থাকলে চলবে?”
“একা তো তাই খারাপ লাগছে।”
“অভ্যাস করে নাও মা। সংসার জীবন এমনি। আমার ছেলেটা যখন বাসায় থাকবে না তখন একা বসে না থেকে টুকটাক কাজ করবে। আর মন খারাপ হবে না।”

“আচ্ছা।”
“আস্তেআস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করো। আমার ছেলেটার একটু যত্ন নিও। আস্তেআস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো।”
জবাব দিতে পারে না মায়রা। নিজের মা তার যত্ন নিতে বললেও শাশুড়ি ঠিকি উনার ছেলের যত্ন নেওয়ার কথা বললেন। এটাই কি মা আর শাশুড়ির পার্থক্য।
“মন খারাপ করে থেকো না মা। নতুন নতুন একটু এমন লাগে সবার। আরো একা বাসায় তো তাই খারাপ লাগবে বেশি। কদিন গেলে ঠিক হয়ে যাবে। আর ইহাম কিছু বললে, রাগারাগি করলে আমায় জানাবে মা কেমন?”
“আচ্ছা মা।”

১২ টা ৩৫ বাজতেই কলিংবেল বেজে উঠে। আকস্মিক শব্দে পুরে হকচকিয়ে যায় মায়রা। কোনোরকম নিজেকে সামলে সে বাহিরে ইহাম আছে নিশ্চিত হয়ে দরজা খুলে দেয়।
দরজা খোলা পেতেই কোনোরকম কথা বিহীন ইহাম হাত বাড়িয়ে মায়রার কোমর পেঁচিয়ে নেয়। মুখ বাড়িয়ে মায়রার কোমল গালে টুপ করে দুটো চুমু খায়। মুখে কেমন মিষ্টি কিঞ্চিৎ হাসি। ফিসফিস করেই বলে, “এই প্রথম ডিউটি করার পর বাসায় এসে এত শান্তি পাচ্ছি জান। লাঞ্চ ব্রেকের জন্যে ভেতরটা ছটফট করছিল। কখন বাসায় আসব তার জন্যে হৃদয় ব্যাকুল হয়ে যাচ্ছিল। বাসায় কি মধু রেখে গিয়েছিলাম?”
লজ্জায় মায়রা মাথা নত করে নেয়। এতক্ষণের মন খারাপ মুহূর্তে কোথাও পালিয়ে যায়।
“খারাপ লেগেছিল?”

আহ্লাদী মায়রা সোহাগে গদগদ হয়ে মাথা নাড়ায়। এক গালে হেসে ইহাম জানালো, “চিন্তা করবেন না মিসেস চৌধুরী রাতে আপনার হাজবেন্ট এসে সব মন খারাপ নিমিষে ভুলিয়ে দিবে।”
আলতো করে নাকে নাক ঘষে ইহাম। পিঠপিছন থেকে এক হাতে মায়রার পেট জড়িয়ে শূন্যে তুলে নেয়। ওভাবেই সামনে পা বাড়ায়।
“আহহহ লাগছে ছাড়ুন।”
“দুষ্টু দুষ্টু সাউন্ড দিও না জান। লাঞ্চ ব্রেকে সময় খুব কম।”
কথার গোপন মানেটুক বুঝে লজ্জায় নুয়ে পড়ে মায়রা। ছিঃ অসভ্য লোকটার কি অসভ্য মার্কা কথা। সে এসব বুঝালো কখন? লোকটা আসলেই জঘন্য।

ইহাম মায়রার কানের পিছনে মুখ নিয়ে ফিসফিস কন্ঠে বলে, “রাতে পুষিয়ে দিবো জান ডোন্ট পিনিক।”
“আপনার যতসব অসভ্য কথাবার্তা। আমার পেটে লাগছে নামান আগে।”
ইহাম মায়রা কে নামায়। মেয়েটা চলে যেতে চাইলেও ইহাম দিলো না। বাহু ধরে জিজ্ঞাস করল, “নাস্তা হয়েছিল?” গাল ভার করে মায়রা সম্মতি জানায়। ইহাম ফিরতি প্রশ্ন করে, “শাওয়ার?” মায়রা মুখে কিছু না বলে এদিকওদিক মাথা নাড়িয়ে না বুঝায়। তখনি ইহামের ঠোঁটে খেলে যায় দুষ্টু এক বক্র হাসি। মুখটা বাড়িয়ে দিয়ে হিসহিস আওয়াজে আওড়ায়, “চলো তবে এক সাথে শাওয়ার নেই। নতুন একটা অভিজ্ঞতাও হয়ে যাবে সাথে একটু রোমান্স।”
এ কথা শুনেই মায়রার চোখ দুটি আপনাআপনি বড় হয়ে গেল। কোনো রকম নিজেকে ছাড়িয়ে দুই হাত দূরে দাঁড়িয়ে বলল, “সবসময় আপনার যত আজেবাজে কথা।”

“আজেবাজে কথা নয় ম্যাডাম। এসব প্রেমালাপ।”
“আপনার প্রেমালাপ রেখে শাওয়ার নিতে যান।”
“আসো না জান একসাথে শাওয়ার নেই।”
“না। আমি এখন শাওয়ার নিবো। যান তো আপনি। আপনার না দেরি হয়ে যাচ্ছে?”
“সময়ের কারণে বেঁচে গেলেন মিসেস চৌধুরী।”
মায়ের রান্নাকরে দেওয়া খাবার বক্স থেকে বের করে মায়রা ওভেনে গরম করতে দিয়েছে। তার মাথাতে কিছুতেই আসছে না কাল থেকে তার উপর রান্নাবান্নার ঝামেলা করতে হবে। কিভাবে রান্না করবে সে? শখ করেও কখনো রান্না করতে যায়নি সে। পারার মাঝে পারে শুধু ডিম ভাজিটা। এই রান্নার বোঝাটা মায়রার উপর যেন পাহাড়ের মতো ধসেছে।

“আহহ মায়রা সামলে, গরম।”
বলে দ্রুত এসে ইহাম কিচেন টাওয়াল দিয়ে ওভেন থেকে বাটিটা নামায়। মাছভোনা টা পুড়ে যাচ্ছিল বলে তাড়াহুড়া করে হাত দিতেই গরম চোকা লাগে মায়রার হাতে। ভিজে চুল নিয়ে ইহাম দৌড়ে এসেই সামলে নেয় বিষয়টা। মায়রার দিকে তাকিয়ে মোটা গলায় বলে,
“কাজ করবে দেখেশুনে মনে থাকবে?”
ইহামের এই ছোট্টছোট্ট বিষয় গুলি মায়রার মনে আলাদা একটা নরম তুলতুলে জায়গা সৃষ্টি করে। ঠোঁট টিপে হেসে মায়রা মাথা দুলায়।
আপনি গিয়ে বসুন আমি খাবার নিয়ে আসছি।”
ইহাম যাওয়ার আগে ভাতের প্লেট বেগুন ভাজি আর সবজির বাটি নিয়ে টেবিলে যায়। মুচকি হেসে বাকি খাবার নিয়ে এগিয়ে যায় মায়রাও।
পাতে খাবার বেরে দিয়ে মায়রা চুপটি করে পাশের চেয়ারে বসে।

“তুমি খাবে না?”
“একটু পর খাবো। আপনি খেয়ে নিন।”
ইহাম হাত বাড়িয়ে ইশারা করে ডাকে “কাম।”
পাশেই তো বসে আছে সে? আর কত কাছে যাবে? আড়ষ্ট মায়রা আমতাআমতা করে। তাই ইহাম নিজেই হাত বাড়িয়ে মায়রা কে নিজের কোলে বসায়। প্রথম লোকমা মায়রা কে খায়িয়ে দিয়ে হিসহিস করে সে।
“খাওয়া নিয়ে কোনো ভণিতা চলবে না মায়রা। আরেকটু ফিট হতে হবে।”
“আমি যথেষ্ট ফিট আছি।”
“এই চিকনি চামেলি শরীরকে তুমি ফিট বলছো? কতই আর হবে? ৫০ তো দূর ৪৫ ও হবে না বোধহয়।”
ভাতের লোকমা মায়রার মুখে দিতে দিতে বলল ইহাম। মুখে ভাত নিয়ে বিরোধিতা করল মায়রা।

“উমম, মুটেও না আমি ৪৯ কেজি।”
“আরেকটু মোটা হোও বউ। আদর করে মজা পাবো।”
তড়িতে মায়রা তার কোল থেকে উঠে গেল। দূরে দাঁড়িয়ে বলল, “ছিঃ, আপনার মুখে সবসময় এসব ছিঃ মার্কা কথা চলে।”
“তোমার সমস্যা কি মায়রা? শুধু পালাই পালাই করো কেন?”
“কারণ আপনি শুধু কাছে আসার ধান্ধায় থাকেন।”

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৫১

লাঞ্চের সময় কম বিধায় ইহাম দ্রুত খারাব শেষ করে আবারও বের হয়। যাওয়ার আগে সতর্ক করে, “আমি যাওয়ার পরই দরজা লক করে দিবে। ৭ টা ৮ টার মাঝেই ফিরে আসব।”
“আচ্ছা”
কপালে চুমু দিয়ে ইহাম ফিসফিস করে জানায়, “রাতে লাল টুকটুক একটা শাড়ি পরে আপনার চেরি গাল দুটো নিয়ে অপেক্ষায় থাকবেন ম্যাডাম। আমি এসে বাইট খাবো।”

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৫৩