মোহমায়ার বাহুডোরে শেষ পর্ব
সাদিয়া
বুকটা ছ্যাঁত করে উঠে মায়রার। মনে হয় কেউ তার কলিজা এফার ওফার করে দিচ্ছে। ব্যথায় ছিঁড়ে যায় বুকের পাতা। কি বলে এসব এই লোক? তড়িতে চেঁপে ধরে ইহামের মুখ। মাথা তুলার আগেই গালে টের পায় উষ্ণ পানির দানা। লাফ দিয়ে উঠে ইহাম। ভ্রু সরু করে চায় সে। ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে, “এই মেয়ে কাঁদছো কেন? কি হয়েছে?” মায়রা হাত সরিয়ে দেয়। চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে আপনাআপনি। ইহাম বারবার চোখের পানি মুছে।
“এই মায়রা কান্না করছো কেন?”
“আপনি কথা বলবেন না একদম।”
“আচ্ছা ভুল হয়েছে মাফ করো আর কান্না থামাও প্লিজ।”
“আপনার কাছে আমার দাম না থাকতে পারে তাই বলে কি আমার কাছে আপনার দাম নেই?”
“আছে বুঝি?”
“একদম চুপ করুন। আপনি ভালোবাসেন না বলে কি আমি ভালোবাসি না এটা কি করে ভাবেন আপনি? সবাই কি আপনার মতো পাষাণ নাকি?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ফুঁপিয়ে কাঁদছে মায়রা। ইহাম গভীর নজরে তাকে পরখ করে আধো কন্ঠে জানায়, “আমি ভালোবাসা বুঝি না আমি শুধু বুঝি তোমাকে। ভালোবাসা কি তা আমি জানতেও চাই না। আমি শুধু জানি দুনিয়া এসফার ওসফার হলেও আমার কেবল তোমাকে চাই।”
ছলছল নয়নে মায়রা তাকিয়ে থাকে মানুষটার দিকে। কে বলে নীরবে, মুখে প্রকাশ না করে ভালোবাসা যায় না যায়। এইতো তার পাষাণ লোকটা পারে। কখনো মুখে প্রকাশ না করে নীরবে, কাজে নিজের দায়িত্বে সব বুঝিয়ে দিতে জানে এই কঠোর লোকটা। মায়রা কেঁদে জড়িয়ে ধরে ইহাম কে। বিড়বিড় করে, “আপনি একটা পাষাণ লোক।”
ম্লান হেসে তৃপ্ত কন্ঠে বলে ইহাম, “তোমারই।”
কিছু সময় যাওয়ার পর শান্ত করে মায়রা কে। এরপর বলে, “কান্না না থামালে কিন্তু এবার আদর শুরু করব মায়রা। এরপর দুষ্টু মিষ্টি যন্ত্রণায় বেশি কাঁদতে হবে।”
“শুরু হয়ে গিয়েছে আপনার অসভ্যতামি?”
“কথা পরে আগে নিজের চোখের পানি মুছো। নয়তো কানের নিচে টেনে দিবো একটা।”
অভিমানী মায়রা গাল ফুলিয়ে ছোটছোট চোখে চায়।
“চুমু খাও মিসেস মায়রা।”
মুখ ভেংচি কেটে মায়রা জবাব দেয়, “একদম না।”
“চুমু খাও মেয়ে গিফট পাবে।”
“লাগবে না আমার গিফট” নাক ফুলিয়ে আহ্লাদী স্বরে বলে মায়রা।
“কিন্তু আমার লাগবে।”
কথা শেষ করেই ইহাম মুখ বাড়িয়ে আঁকড়ে ধরে মায়রার অধর যোগল। ছোট্ট ছোট্ট মিষ্টি চুমু দিয়ে ভরিয়ে দেয় মায়রার ঠোঁট। উন্মাদের মতো শুষে নেয় তা। মারাত্মক অস্থিরতায় শরীরে কাঁপন ধরে মায়রার। শিরায় ধাবিত হয় উদ্দীপিত অনুভূতি। মৃদু মিষ্টি যন্ত্রণায় ফেঁপে উঠে বুকের ছাতি। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয় ইহামের ঠোঁটে পিষ্ট হওয়া নিজের অধরযোগল মেলে।
মায়রার এমন রূপ দেখে ইহাম ছেড়ে নেয়। লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে যাওয়া মায়রা চোখ মুদে টেনে টেনে শ্বাস নেয়। উষ্ণ নিশ্বাস ঝেড়ে ইহাম খুব কাছ থেকে দেখে মায়রা কে। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে, “এখনি হাইপার হবেন না ম্যাডাম আমি আপাদত আরো সময় দিচ্ছি।”
লজ্জায় মরো মরো অবস্থা মায়রার। সেই সময়ই ইহাম পকেট থেকে কিছু একটা বের করে। এগিয়ে দিয়ে বলে, “হাত বাড়িয়ে দিন ম্যাডাম।” মায়রা মাথা তুলে একটু চায়। তাকিয়ে দেখতে পায় লোকটার হাতে একজোড়া চিকন চুড়ি। ইহাম নিজেই তার হাত টেনে নিলো। চুপচাপ যত্ন করে পরিয়ে দিলো হাতে। একটুকরো হেসে জানালো, “তুমি যখন তোমার এই নরম মসৃণ চুড়ি পরা হাতে আমায় খাবার বেড়ে দিবে সেই দৃশ্যটা বুঝি হৃদয় ঘায়েল হবে আমার জন্যে। আদর করার সময় আমার দেওয়া শৃঙ্খল বদ্ধ তোমার হাত যখন চুল চেঁপে ধরবে আমি বুঝে নিবো এটাই আমার শেষ ঠিকানা। আমার জীবনের সকল তোলপাড়ের সমাপ্তি সেই স্পর্শে লুকায়িত। এই ভয়ংকর অনুভূতির লোভটা আর সামলাতে পারিনি আমার মিসেস পিচ্চি চৌধুরী।”
মায়রা ভালো ভাবে তাকিয়ে দেখল নিজের হাত দুটো। দুইটা স্বর্ণের চুড়ি সুভা পাচ্ছে তার দুই হাতে। ইহাম নরম হাতে তুলে নিলো মায়রার হাত দুটো। খানিক উপরে তুলে মুখ নুয়ে চুড়ি পরা হাতের কব্জিতে চুমু খেলো। সর্বাঙ্গে শীতল এক শিহরণ ছুটে যেতেই মায়রা চোখ মুদে আনে।
“তোমার পদ্ম কোমল রাঙ্গা হাতের স্পর্শে স্বর্ণও যেন নিজের জ্যোতি দ্বিগুণ ভাবে মেলে দিচ্ছে আমার জান।”
উত্তরে মায়রা কেবল লাজুক হাসে।
“কি দরকার ছিল এত টাকা খরচ করার?”
ইহাম তার চুলের ভিতর হাত গলিয়ে গাল স্পর্শ করে। ঘোরলাগা কন্ঠে জানায়, “তুমি আমার কাছে অমূল্য যার দাম ধরাছোঁয়ার বাহিরে। সেখানে স্বর্ণ হিরে মুক্তা অতি তুচ্ছ বউজান।”
মায়রা কিছু বলতে পারে না। হৃদয় উতলে উঠে অনাবিল খুশির জোয়ারে। মুহূর্তে হুমড়ি খেয়ে পড়ে ইহামের বুকের উপরে। হৃদয়ের প্রশান্তিতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে নিজের ব্যক্তিগত মানুষটাকে। এই ধ্বংসাত্মক দুনিয়ায় তার সকল শান্তি আরাম কেবল এই লোকটার বক্ষ তলে।
“আমার বউজান কি স্বামী কে খুব করে কাছে চাইছে নাকি?”
তার এমন কথা শুনে লজ্জায় লঘু হাসে মায়রা বুকে মুখ লুকিয়ে। মৃদু রাগ দেখিয়ে চিমটি কাটে ইহামের পিঠে। একটু দূরে সরে বলে, “সবসময় নিলজ্জ মার্কা কথা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন আপনি? দিনদিনই বেহায়া হয়ে যাচ্ছেন।”
“বেয়াদব জান ওগুলি কে রোমান্স বলতে শিখুন।”
“হঠাৎ এত রোমান্স কোথা থেকে শিখে ফেললেন আপনি?”
ইহাম মায়রা কে নিজের বাহুডোরে ঝাপটে ধরে। হিসহিস করে জানায়, “এমন আদুরে একটা বউ সবসময় চোখের সামনে কবুতরের বাচ্চার মতো ঘুরঘুর করলে কে রোমান্স করতে না চাইবে?”
মায়রা মুচকি হাসতেই ওর গাল দুটো একটু ফোলো ফোলো হয়ে যায়। আর এই জিনিসটাই ইহাম কে একেবারে নাজেহাল করে। ওই রঙ্গিম তুলতুলে গাল দুটো একটু ফুলে উঠতেই তার মনমস্তিস্ক একেবারে তার আয়ত্তের বাহিরে চলে যায়। নিজেকে চেয়েও তখন আর সামলাতে পারে না সে। শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেন তার আগুন ধরিয়ে দেয় মায়রার গাল দুটো। মাতোয়ারার মতো ডুবে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় ছটফট করে ভেতরটা।
হিসহিস করে মাতাল কন্ঠে বলল ইহাম, “ক্যান আই টেক আ বাইট?”
বিস্মিত চোখে সরু ভ্রু নিয়ে মায়রা তাকালো তার দিকে। চাউনিতে মিশিয়ে দিয়েছে ইহামের উপর কৌতূহলী প্রশ্নটা?
“তোমার চেরির মতো গাল দেখলে আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি না মায়রা।”
ইহামের এই ধরনের কন্ঠ শুনলেই মায়রার শরীরের লোম কাটা দিয়ে উঠে। শিরায় উপশিরায় ছুটে চলা উষ্ণ নিশ্বাসে ছন্নছাড়া হয় নিজেও। কিছু বুঝে উঠার আগেই নিজের কপোলে অনুভব করল ইহামের লেহন ছোঁয়া স্পর্শ। জিহ্বের অগ্রভাগ গাল ছুঁতেই দাবানলে বিগলিত হয় অঙ্গ। মুহূর্তে খামছে ধরে মায়রা নিজের কাপড়। বড্ড অস্বস্তিতে দম আটকে মরে যাবে এমন লাগে। সরে আসতে চাইলেই ইহাম তার কোমর টেনে আরো কাছে নিয়ে আসে। কামিজের নিচে হাত গলিয়ে দিতেই চোখ মুদে মায়রা সেটা খপ করে ধরে। তবে উন্মাদ পুরুষটা শুনে না তার বারণ। পেট বেয়ে হাত চলে উপরের দিকে।
ঝাটকা হাওয়ার মতো মায়রা কোনো রকম সরে আসে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে মুখ হা করে নিশ্বাস ছাড়ে পাগলের মতো। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। অথচ একটু আগে মানুষটার জন্যে শরবত বানাতে গিয়ে পুরো এক গ্লাস খেয়ে নিয়েছে সে।
ইহাম এগিয়ে আসে। তার থেকে খানিক নিচু মেয়েটা। বুকের উপর এসে পড়ে মেয়েটার মাথা। মুখ নুয়িয়ে গভীর ভাবে চুমু এঁকে দেয় মেয়েটার চুলের উপর। স্বর্ণের চুড়ি পরা হাতটা ধীরেধীরে তুলে তার বুকের ঠিক বা পাশে রাখে। মায়রা নিষ্পলক তাকিয়ে। হৃদপিন্ড টা যেন ছিঁড়েখুঁড়ে বের হয়ে আসে বুক থেকে। অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে বিমুগ্ধ হওয়া ইহামের মাতাল মাতাল চোখ দুটো। স্পন্দন বাড়ে তার নিজেরও। আশ্চর্য এটা আবার কেমন কানেকশন? মায়রা নিষ্প্রভ তাকিয়েই থাকে।
“শুনতে পাচ্ছো কিছু শব্দ? যা আমি মুখে বলতে পারি না এখান থেকে সেসব নির্গত হচ্ছে। তুমি কি তা শুনতে পাচ্ছো মায়রা? কিছু বুঝতে পারছো কি?” থামে ইহাম। চোখের দৃষ্টিতে কেমন মাদক মেশানো আছে। মায়রা মন্ত্রমুগ্ধের মতো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নিজের নামে লিখে থাকা মানুষটার দিকে। “এই আত্মার পিঞ্জিরার একমাত্র উত্তরাধিকারী তুমি। যেখানে লুকিয়ে আছে আমার না বলা সমস্ত অনুভূতি। সেই বুকতটের মালকিন তুমি। আমার দুনিয়া একদিকে আর আমার শখের বেয়াদব নারী অন্যদিকে। আমি এত কিছু বুঝি না আর না বুঝতে চাই। আমার হৃদয়ে বারংবার একটা কথাই উত্থাপিত হয় তা কেবল মায়রা নামক রমনীটা কেবল ফাহাদ ইহাম চৌধুরীর। যাকে নিশ্বাসের শেষটুক দিয়ে নিজের কাছে চায়। আমার হৃদয়ের কথা নিজ দায়িত্বে বুঝে নেওয়ার দায়িত্বটুক তুমি নিবে মায়রা?”
আবেগে আপ্লুত হয়ে মায়রা জড়িয়ে ধরল ইহাম কে। মনের সবটুকু সুখ ঠেলে জবাব দিলো, “এই দুনিয়ায় আপনি ছাড়া আমার আর কিছু চাওয়ার নেই ক্যাপ্টেন সাহেব।” মেয়েটা এক কথাতেই যেন সব কিছু ব্যক্ত করে দিলো। ঠোঁটের কোণটা আনন্দের তুফানে স্ফীত হয়ে এলো ইহামের। হৃদয় নিগড়ানো অনুভূতি দিয়ে জড়িয়ে নিল সে মায়রা কে। শুধু ওষ্ঠ নাড়িয়ে বিড়বিড় করল, “আমার এক আকাশ প্রশান্তি।”
অনেকটা সময় লতার মতো একেঅপর কে জড়িয়ে রেখে দুজন যেন দুজনের আত্মার শুকরিয়ায় মগ্ন ছিলো। নিশ্বাস উদলবদল কিংবা একে অপরের উষ্ণতায় তলিয়ে ছিল। অনেকটা সময় অতিবাহিত হবার পর ইহাম মায়রা কে তুলে বুক থেকে। দুই হাত দিয়ে মায়রার গাল দুটি ধরে ঠোঁটের মাঝে ছোট্ট করে চুমু খায়।
“রেডি হয়ে নাও।”
“কেন?” চমকে উঠে প্রশ্ন করে মায়রা।
“বের হচ্ছি দুজন।”
“এখন?” সন্দিহানি মায়রার কন্ঠ।
“জ্বি।”
“রাতে কোথায় যাবেন?”
“ডিনারে।”
“ডিনারে মানে?”
“মানে রাতে বাহিরে খাবো। আমার মাথামোটা বোকা রমণী বুঝে না কিছুই।”
“আর আমি ঘরে যে রান্না করা করে রাখলাম?”
“বাহির থেকে খেয়ে এসে ওগুলি আবার খাবে।”
“পাগল নাকি আপনি?”
“আপাদত হতে চাইছি না তবে আর বাহিরে যাওয়া হবে না, ঘরজুড়ে কেবল সুখকর আওয়াজ শুনা যাবে।”
কথার মর্মার্থ বুঝে চোখ পাকিয়ে উঠে মায়রা।
“একটা অসভ্য লোক আপনি। সবসময় বেলাজা কথাবার্তা সব।”
“কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ রেডি হতে যান ম্যাডাম। না হলে আমি আপনাকে কাঁধে তুলে সোজা বেডরুমে যাবো নিজেকে উন্মাদ করতে।”
এ কথা শুনেই মায়রা চুপ হয়ে গেল। রোবটের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কেবল। এই লোক সাংঘাতিক। দেখা যাবো সেটাই করে নিয়েছে। তাকে এভাবে দেখে ইহাম ঠোঁট কা’মড়ে হেসে ওয়াশরুমে চলে যায়। আর মায়রা দারুন ভঙ্গিমায় ভেতরের তপ্ত শ্বাস ঝেড়ে ফেলে।
রাতের খাবার শেষ করে শখের বউ এর আবদার পূরণ করতে রাতের নিস্তব্ধ রাস্তায় হেটে চলছে দুজন। ইহাম শক্ত করে মায়রার হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে। যেন ছোট্ট বাচ্চা সে।
“হাতটা তো ছাড়ুন ক্যাপ্টেন সাহেব।”
“নো।”
“আমি তো আর বাচ্চা না। আর এই রাস্তায় গাড়িও নেই দেখুন। হারিয়ে তো যাচ্ছি না।”
“এই দুনিয়ায় এমন স্থান হয়নি যা তোমাকে আমার থেকে লুকাতে পারে। আকাশ বাতাস এক করে নিজের জিনিস তুলে নিতে জানে ক্যাপ্টেন ফাহাদ ইহাম চৌধুরী। চুপচাপ হাটো মায়রা। ফিরতে হবে।”
ইহামের কন্ঠ কেমন গম্ভীর শুনালো। মায়রা পরখ করল লোকটা কেমন জহুরি চোখে আশপাশ দেখছে। এই রাস্তায় প্রায় সময় চুর ডাকাত কিংবা নেশাখোরের আড্ডা দেখা যায়। নিজেকে নিয়ে ভয় করে না ইহাম তার ভয়ের সূচনা এখন কেবল এই মেয়েটাকে ঘিরে।
“ওদিকে দেখুন ক্যাপ্টেন সাহেব।”
“কি?”
“ওখানে কেমন একটা ছায়া দেখা গেলো। দেখতে পান নি আপনি?”
“কোথায়?” ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে ইহাম।
“ওই তো ওই বাসার গেইটার পাশেই তো দেখলাম।”
“তুমি শিওর?”
“হ্যাঁ।”
ইহাম ঘাড় বাঁকিয়ে সূক্ষ্ম নজরে পরখ করতে লাগল আশপাশ। বাজপাখির মতো দৃষ্টিতে সবটা পর্যবেক্ষণ করে, “কোথায় এখানে তো কাউকে দেখা যাচ্ছে না” বলতে বলতে ইহাম আবার ফিরে তাকায়। কিন্তু কোথাও দেখতে পায় না মেয়েটা কে। কলিজা কা’মড়ে ধরে তার। কপালে চিন্তার ভাঁজ তুলেই চেঁচিয়ে ডাকে “মায়রা” বলে। মেয়েটা কোথাও নেই। পাগলের মতো আশপাশ দেখে চিৎকার করে ডাকতে থাকে মায়রা কে। কিন্তু কোথাও কোনো শব্দ পাওয়া যায় না।
মিনিট পাঁচ যেতেই পাশের একটা গলিতে ঢুকে ইহাম। এদিকওদিক তাকিয়ে মৃদু কথার আওয়াজ শুনতে পায়। পাশে ঘাড় বাঁকালে দেখতে পায় মেয়েটা কে। একটা মাতাল লোক এগিয়ে আসছে তার দিকে। আর মেয়েটা বারবার না করছে। ইহাম ছুটে যায় ওদিকে। মেয়েটার হাত টেনেই একটু দূর নিয়ে আসে। ওদিকে মাতাল লোকটা বারবার বলতে থাকে, “আরে আরে কে রে? কে আমার ভোগের মাল নিয়ে পগারপার হতে চায় রে? আয় হতচ্ছাড়া ল্যাংটা করে তোর পাছায় ঢোল পিটাই। নিজেই একদম মা এর ভোগে চলে যাবি। আরে এই যে রূপসী, তুই কোথায় যাস? তোরে ছাড়া আমার রসগোল্লার হাড়ি ফাঁকা পড়ে আছে রে! দাঁড়া সোন্টুমনা।”
ইহাম সেসবে পাত্তা না দিয়ে মায়রার দিকে তাকায়। মেয়েটাকে হাতের কাছে পেয়ে খুশির বদলে রাগ হয় তার। যেন সব বেত্তমিসগিরি সে বুঝে। রাগান্বিত দৃষ্টিতে মায়রার দিকে তাকিয়ে কঠোর ভাবে প্রশ্ন করে,
“কি হয়েছিল একটু আগে?”
মেয়েটা ভয়ে কেমন জবুথুবু হয়। মাতাল লোকটার না অনেকদিন পর সেই রাগী লাল দৃষ্টিতে আঁতকে উঠে তার ভেতর। লোকটাকে একটু ভয় দেখাতেই পাশের গলিতে খাম্বার পিছনে লুকিয়ে ছিল একটু দুষ্টুমি করে। কোথা থেকে এই আবাল মাতাল টা এসে তার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে।
“কি হলো কি জিজ্ঞেস করলাম? আন্সার মি ড্যাম ইট।”
ইহামের চিৎকারে নীরব রাস্তা সহ কেঁপে উঠল যেন। মাথা নিচু করে নিয়েছে মায়রা অপরাধীর মতো। লোকটা রাগে ফুঁসছে তা যেন না দেখেও শুনতে পাচ্ছে সে।
“কি হলো? কি জিজ্ঞেস করলাম তোমায়? কেন লুকিয়েছিলে মায়রা? হোয়াই?”
“….
“কিছু বলি না বলে কি মাথায় উঠে গিয়েছো নাকি? কখন কোথায় কি করতে হবে কোনটা নয় সেই বেসিক নলেজটুক তোমার নেই মায়রা? চুপ করে না থেকে উত্তর দাও।”
ভয়ে শরীরটা মৃদু কাঁপছে মায়রার। মানুষটা এত রেগে যাবে ভাবতে পারেনি সে। মাথা নুয়েই নখে নখ কুটছিল নিঃশব্দে। তার এহেন ভাব দেখে রাগে আগুন হয় ইহাম। চিবিয়ে বলে, “ইচ্ছা হচ্ছে কানের নিচে একটা লাগাই বেয়াদব মাথামোটা মেয়ে একটা।”
“এই কে রে? কোন মাদা’রচো* আমার জিনিস ধরে রে? আয় তোকে কচলাইয়া চাটপাটি বানাই। আর তোর পাছায় মরিচ দিয়া সালাদ বানাই… ”
ঠুলুমুলু করতে করতে ইহামের দিকেই এগিয়ে আসছিল মাতাল লোকটা। তা দেখে মায়রার উপর সমস্ত রাগটা যেন ঝড়ের বেগে গিয়ে মাতাল লোকটার গালের উপর পড়ল।
“ও মারে, ও বাবাগো। আমারে বিন্দাবন পাঠায় দিলো রে। আমি চরখির লাহান ঘুরতাছি দু। আমার গিলুটা উইড়া যাইতাছে। ওরে শ্যামলীর মা আমারে ধর রে।”
রাগে ফোঁসফোঁস করে নিশ্বাস নেয় ইহাম। চোরের মতো আড়চোখে মায়রা দেখতে পায় মাতাল লোকটা হাত উঁচু করে কেবল ঘুরছেই। মায়রার হাসি পেলেও এই পাষাণ লোকটার ভয়ে চুপ থাকে। শুনতে পায় ইহাম কাউকে বলছে এই মাতাল লোকটাকে এসে নিয়ে যেতে। নেশায় বুদ হওয়া লোকটা পাগলের মতো এখনো নিজে নিজেই ঘুরছে আর বিলাপ পারছে।
ইহাম দুই কদম এগিয়ে এসে চুপচাপ মায়রা কে কোলে তুলে নেয়। আবছা আলোর রাস্তা গলিয়ে থমথমে গাম্ভীর্য আদল নিয়ে নিঃশব্দে সামনে পা বাড়ায়।
ফ্ল্যাটের সামনে এসে ইহামই চাবি দিয়ে লক খুলে। প্রথমে মায়রা কে ভেতরে ঢুকতে দেওয়ার জন্যে নীরবে চুপচাপ দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে থাকে দায়িত্বশীল যত্নশীল হাজবেন্টের মতো। পেছন থেকে মায়রা গটগট পায়ে ভেতরে ঢুকলে নিজেও গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। শান্ত স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখে পিছন ফিরে থাকা রমনীর অবয়ব। তখনের ধমক দেওয়ায় নিশ্চয় অভিমানে গাল ফুলিয়ে রসে টইটুম্বুর করে রেখেছে। রাখলে রাখুক এমন ফালতু মজা করতে যাবে কেন? সে কি এখন বাচ্চা? কোথায় কোনটা দরকার কোনটা উচিৎ না এখনো কি বুঝে না সে? তখন যে তার ভেতরে শঙ্কার পোকারা কিলবিল করছিল, আতঙ্ক কা’মড়ে ধরছিল তার কলিজা সেই পীড়ন কি বুঝবে এই বোকা মেয়ে? তপ্ত শ্বাস ঝাড়ে ইহাম। শান্ত কোমল স্বরে ডাকে, “মায়রা” বলে।
অভিমানে গাল ভার হয়ে আসে মায়রার। একটু না হয় মজা করেই ফেলেছে তাই বলে এমন ধমকে রাগ ঝাড়তে হবে? লোকটা আসলেই একটা পাষাণ। নিজের নাম ধরে ডাকছে শুনে অভিমানির মান আরো বৃদ্ধি পেলো। ঠোঁট টিপে গাল দুটি ফুলিয়ে সোজা চলে গেল বেডরুমে। পা উপরে তুলে আরাম করে বসল বিছানায়। যেন কোনো ধ্যানে বসছে সে।
পিছুপিছু ইহামও এগিয়ে এলো। যেন পাঁচ বছরের কোনো বাচ্চার রাগ ভাঙ্গাতে সে মরিয়া। চুপচাপ মায়রার পাশে বিছানায় বসে ভারি গলায় ডাকল আবার নাম ধরে। অভিমানে ভরা গাল দুটো নিয়ে মায়রা রাগ দেখিয়ে পিছনে যেতে চাইলেই বিছানায় হাটুতে ভর করে একটু এগিয়ে আসে ইহাম। মেয়েটার পা টেনে হেচকা টানে কাছে নিয়ে আসে নিজের। এক হাতে পেঁচিয়ে ধরে আকর্ষণীয় কোমর। অন্য হাত দিয়ে নিজের পায়ের উপর চেঁপে ধরে মায়রার উরু। নরম মাংসে শক্ত চাঁপ অনুভব করেই হাঁসফাঁস করে উঠে মায়রা। ভীতিগ্রস্ত চাউনি দিয়ে দেখে সামনের ব্যক্তিটাকে। আসক্ত দুটি চোখের মাতোয়ারা দৃষ্টি তখন তার উপরেই বিদ্ধ। স্থির তবুও ভারি কন্ঠে প্রশ্ন করে লোকটা,
“সমস্যা কি? গাল ফুলিয়ে রেখেছো কেন?”
আহ্লাদী মায়রা এতক্ষণ কিছুর আশায় অভিমান করে থাকলেও পরিচিত এই মাতাল চাউনি দেখে ভীত হয়। তাই তর্ক করতে না চেয়ে জবাব দেয়, “কিছু না, ছাড়ুন।” মেয়েটা একটু সরে আসতে চাইলেই ইহাম আরো গাঢ় ভাবে টেনে একেবারে নিজের সাথে মিশিয়ে ধরে। মুখের খুব কাছে মানুষটার প্রগাঢ় উষ্ণ নিশ্বাসে বিচলিত হয় মায়রা। ছটফট করে উঠে ইহামের বিপদজনক সংকেত নিঃসৃত আবদ্ধে। সেই সাথে ইহামের স্পর্শও হয়ে উঠে আবেদনময়ী আর গভীর। উরু বেয়ে দুষ্টু হাত অনবরত বিচরণ করে তার দেহে। হিসহিস করে বলে,
“বাইট খাবো।”
আচানক কথায় আতঙ্কিত ভীত মায়রা ভ্রু তুলে তাকায় শঙ্কিত নজরে। যেন অভ্যন্তরীণ ভয়ে গুটিয়ে গিয়েছে সে। অবুঝ স্বরে শুধায়,
“ক কি?”
“আই হোপ তুমি এখন আমার থেকে বাইট নিতে চাইছো তাই তো কমলালেবুর মতো টসটসে করে রেখেছো গাল দুটি। মনে হচ্ছে খুব ডেলিসিয়াস হবে। কাম মায়রা একটু টেস্ট করে দেখি।”
“একদম না ব্যথা করে খুব।”
“করুক, আসো।”
“আশ্চর্য বললাম ব্যথা করে আর আপনি বলছেন করুক। কি নির্দয় লোক।”
ইহাম জবাব দেয় না। কানের কাছটায় জিহ্বার অগ্রভাগ ছুঁয়ে দিতেই সর্বাঙ্গে শীতল স্রোত বয়ে যায় মায়রার। মুহূর্তে শিহরণে গা কাঁপিয়ে তুলে নিজের। ভীত উদ্বিগ্ন মায়রা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলে, “প্লিজ ছাড়ুন।”
ইহাম তীক্ষ্ণ নজরে চায়। মেয়েটার চুল গুলি কপাল থেকে সরিয়ে দিতে দিতে ক্ষীণ অথচ সরু কন্ঠে জানায়,
“আরেকবার যদি তোমার মুখ থেকে ছাড়ুন কথাটা শুনি মায়রা তবে..”
“মাথায় তুলে আছাড় মারবেন নয়তো কানের নিচে একটা দিবেন তাই তো?” তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে জবাব দেয় মায়রা।
মেয়েটার খানিক অভিমানি নাক ফুলা ভাবটা দেখেই ঠোঁটের কোণে নিগূঢ় হাসি ফুটে ইহামের। মায়রার ঘাড়ে হাত ঠেকিয়ে নিজের মেয়েটার একেবারে সন্নিকটে নিয়ে আসে। কপালে কপাল ঠেকিয়ে মাতোয়ারা কন্ঠে ফিসফিস করে ইহাম।
“উঁহু। মারব না তবে মিষ্টি মিষ্টি ব্যথা দিবো বউজান।”
মায়রা কে কিছু বুঝে উঠার সুযোগ দেওয়ার আগেই ইহাম মায়রার পা নিজের উরুর উপর শক্ত করে চেঁপে ধরে গোড়ালি তে হাত দেয়। কাঁচা হলুদ আর সাদার মিশ্রনে জরজেট শাড়িটা মেয়ের পদ্ম রাঙ্গা অঙ্গে যেন কা’মড়ে ধরেছে। পায়ের নিচ থেকে শাড়িটা আস্তেআস্তে উপরের দিকে উঠছে দেখে আতঙ্কিত মায়রা ভীত নয়নে তাকায় ইহামের দিকে। শরীর ছুটে চলে বিদ্যুৎ। বুকের গহিনে চলা ঢিপঢিপ স্পন্দন নিঃশব্দেই বেড়ে যায়। উন্মুক্ত পায়ে লোকটার অবাধ স্পর্শ আর ঠোঁটের নিদারুণ কারুকাজে খেঁই হারিয়ে বসে মায়রা। হাপানি রোগীর মতো নিশ্বাস টেনে ধরে গহ্বরে। কণ্ঠনালী তে ভিজা অধর স্পর্শে চোখ আরো মুদে আনে মায়রা মিষ্টি যন্ত্রণায়। আবেশে খামছে নেয় ইহামের শার্ট। এতে মানুষটা আরো উন্মাদ হয় যেন। অনবরত ছোঁয়ায় মায়রা কে ঘায়েল করতে করতে এক হাতে শার্টের বোতাম খুলে সে। একেবারে ক্ষীণ আওয়াজে ফিসফিস করতে শুনা যায়,
“তোমার বিমোহিত সুঘ্রাণে ডুবে আমি প্রতি মুহূর্তে মাতাল হয়ে পড়ি মায়রা। অদ্ভুত মাদকতা তুমি নিজের গভীরে মিশিয়ে রেখেছো গোপনে। যা আমার শিরা উপশিরায় ছড়িয়ে পড়ে নেশার মতো। ভেতরে আগুন জ্বালিয়ে দেয় তোমার সেই নেশার জাদু। আমায় করে তোলে অসহায়, অথচ অমৃত মোহমায়ার বন্দী।”
ততক্ষণে মায়রা কাবু হয়ে গিয়েছে তার বিদ্যুৎস্পর্শে।
“তুমি জানো তখন তোমায় দেখতে না পেয়ে আমার দুনিয়া থমকে গিয়েছিল? তুমি ছাড়া এখন আমি এক মূহুর্তও আর বেঁচে থাকতে পারবো না মেয়ে। নিজের মায়ার জাদুতে ভেঙ্গে চুড়ে তছনছ করে দিয়েছো আমার কঠিন দৃঢ় সত্তাকে। তুমি ছাড়া আমি নিঃস্ব মায়রা।”
কথা শেষ করেই উন্মুক্ত বক্ষে চেঁপে ইহাম নিজের তপ্ত সত্তায় একেবারে মিশিয়ে ধরে এক আগুন অঙ্গার কে। যার ছোঁয়ায় মিষ্টি যন্ত্রণায় দগ্ধ হয় তার অন্তঃকরণ। যা নিহাতই সুখের প্রেমের তৃপ্তির। দুটি হৃদয় মন ও দেহ ধীরেধীরে ডুবে যেতে থাকে প্রেমময় এক অতল সুখ সাগরের গহীনে।
সকালে ঘুম থেকে উঠতে মায়রার একটু দেরিই হয়েছে বুঝি। একটু নয় অনেকটাই লেইট হয়ে গিয়েছে। এর মাঝে রাতেই মানুষটা ঘুমানোর আগে বলেছিল ৫ টার আগে ডেকে দিতে। জরুরি কাজ আছে। এদিকে কাল রাতের উৎপীড়নে মায়রা নিজেই ভোরের দিকে উঠতে পারেনি। ইহামকে ডাকবে আর কি? সকাল ৬.২৪ এ ঘুম ভাঙ্গতেই চোখ চড়কগাছ। চট্টগ্রাম আসার পর থেকে এরকম কখনো হয়নি তার। ভয়ে শুকনো কলিজা নিয়েই ইহাম কে ডাকে সে। ঘুম থেকে উঠে মায়রার ভয়ার্ত মলিন মুখ দেখে জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে?”
বেশ জড়তা আর অনেকখানি ভয় নিয়ে মায়রা বিরবির করে বলে সময়ের বিষয়টা। এদিকে ফোনে সময় আর ম্যাসেজ দেখেই মেজাজ সপ্তম আকাশে উপনীত হয়। বেশ গরম আর চোটপাট দেখিয়ে কোনোরকম ঘর থেকে বের হয়। ছোটখাটো একটা ঝগড়া আর অনেকখানি রাগারাগিও হয়ে যায় চোখের পলকে। মানুষটা মেজাজ দেখিয়ে তার দিকে না চেয়েই রেগে ঘর থেকে বের হয়। প্রতিদিনকার রুটিন অনুযায়ী আজ আর যাওয়ার সময় তার কপালে আর ঠোঁটের কিনারায় চুমু খেয়ে যায়নি পাষাণ লোকটা। বরং রাগারাগি করে দরজাটা সজোরে বারি দিয়ে লাগিয়ে গিয়েছে।
আজ অনেকদিন পর লোকটার রোষানলে পরে মায়রার হৃদয় কাঁদে। চোখ ফাটে পানিতে। চাঁপা কষ্টে ঠোঁট কাঁপে রিমরিম করে। নিজের ভুলের কারণে খুব বেশি তর্কও করতে যায়নি মানুষটার সাথে। নীরবে দাঁত কা’মড়ে মেনে নিয়েছে ইহামের রাগটা।
কাজের প্রেশারে আজ ইহাম দুপুরেও খেতে আসেনি বাসায়। ফিরতে ফিরতে রাত বেজে গিয়েছে তখন নয়টার মতো। ফিরে এসে দরজা খুলতেই, আঁতকে উঠে সে। শঙ্কা আর চিন্তার বিরল ভাঁজ ফুটে উঠে ভ্রুদ্বয়ের মাঝে। সংকুচিত হয়ে আসে কপাল। উদ্বিগ্ন হয়ে সে এগিয়ে যায় রুমের ভেতরের দিকে।
মায়রা তখনো সোফায় বসে আছে। যাওয়ার আগে মেয়েটাকে মুখ গোমড়া করে এখানেই বসে থাকতে দেখে ছিল। এখনো একইভাবে এখানেই বসে আছে। পার্থক্য শুধু আগে পা ঝুলিয়ে বসেছিল আর এবার হাত পা গুটিয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছে দলা পাকানো বস্তুর মতো। চিন্তিত বদনে কপাল কুঁচকে ইহাম এগিয়ে এলো। সোফার কাছটায় হাটু মুড়ে বসে নরম করে তাকাল মায়রার দিকে।
মেয়েটা দুই হাত দিয়ে হাটু জড়িয়ে মুখ গুঁজে বসে ছিল। ইহাম কে বসতে দেখে আধোআধো চোখে তার দিকে তাকায়। তার চাউনির উল্টোপিঠে লোকটাকে কেমন নির্বিক বিস্মিত দেখালো। মায়রার মুখ দেখে বুকটা ধক করে উঠল। মেয়েটার এই বিবশ ফোলা চোখ দুটি হৃদয়ে আলোড়ন তুলল। উন্মাদের মতো গালে দুই হাত রেখে শুধালো,
“এই মেয়ে হয়েছে কি?”
জবাব দিলো না মায়রা। উত্তেজিত হয়ে ইহাম জিজ্ঞেস করে, “ওই জান কি হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ? কাঁদছো কেন মায়রা? কি হয়েছে আমায় বলো।”
মায়রা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ইহাম আবারো তড়িঘড়ি করে অধৈর্যৈর মতো জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে বউজান বলো আমায়? মায়রা? প্লিজ কথা বলো। আমার টেনশন হচ্ছে জান। দম বন্ধ লাগছে। প্লিজ জান স্পিক আপ।”
ইহামের উদ্বিগ্ন উত্তেজিত ভাব নির্নিমেষ দেখতে থাকে মায়রা। লোকটার তার প্রতি এতটা অস্থিরতা দেখে বুকের ভেতরটা ভরাট হয়ে আসে। আবেগে মেয়েটা ইহামের দিকে তাকিয়েই হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠে। সঙ্গেসঙ্গে এক দলা বিষ মেশানো ছুড়ির তীব্র আঘাত লাগে যেন ইহামের বক্ষপিঞ্জরায়। মুড়মুড় করে তা যেন কম্পন ধরে। দুই হাটুতে ভর করেই সটান হয় সে মায়রার মুখোমুখি হয়ে আদর মেশানো গলায় শুধায়,
“এ্যাই জান প্লিজ কান্না থামাও। কি হয়েছে? রাগ করেছো? জান প্লিজ রাগ করো না। তাকাও আমার দিকে। আমি সরি মায়রা। শুনো কথা প্লিজ কেঁদো না।”
মায়রা ফুঁপাতে ফুঁপাতেই ঢলে পড়ে। আকস্মিক কান্ঠে একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়। জমে যাওয়া বরফের মতো হয়ে থাকলেও এহেন কান্ডে বুক ফাটিয়ে চিৎকার করে করে ছেলেটা। দ্রুত হাতের তালুতে মেয়েটার মাথা তুলে নেয়। হাত পেঁচিয়ে ধরেই তাকে উন্মাদের মতো ডাকতে থাকে। নিস্তেজ চোখের পাতা মুদে মায়রা নেতিয়ে রয়েছে ইহামের বাহুতে। মায়রা কে ডাকতে ডাকতেই পাজোকোলে তুলে আগে ছুটে বিছানায়।
দিকশূন্য পাগলের মতো মায়রার কে ডেকে যায়। পানির হাল্কা ছিটেফোঁটাও ছুড়ে মায়রার মুখে। কিন্তু মেয়েটা চোখ খুলে না। কলিজা কা’মড়ে ধরে ইহামের। সবসময় শান্ত মস্তিষ্কের ইহামও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। মাথায় কিছু আসে না কি করবে। শুধু অনুভব কর তার দুনিয়া শূন্য শূন্য লাগছে। বুকের চিনচিন ব্যথাটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। আশ্চর্য তার তো হার্টের সমস্যা নেই তবে এত ব্যথা করছে যেন নিশ্বাসটাই থমকে যেতে চাইছে হৃদপিন্ডের স্বাভাবিক কার্যকম ব্যাহত হওয়ার কারণে। অদৃশ্য ভাবে তার প্রাণ ভোমরাটা যেন এই মেয়ের মাঝে নিঃসৃত হয়ে আছে।
দিশেহারার মতো ইহাম ইবরাহিম কে কল করল ক্যান্টনমেন্ট থেকে দ্রুত ডক্টর নিয়ে আসার জন্যে। কথা গুলি বলার সময়ও ওত ধৈর্যশীল কঠিন পুরুষটাও অস্থির অস্থির করছিল। মোটা অদম্য কন্ঠটাও কেঁপে উঠছিল বারবার।
ক্লান্ত দূর্বল শরীরটা নিয়ে মায়রা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। ইহাম তার জন্যে ভেজিটেবল স্যুপ রান্না করছে। বারবার অস্থির চিত্তে এসে দেখে যাচ্ছে মেয়েটা ঘুম থেকে উঠেছে কিনা। ফ্রিজ থেকে দুধ নামিয়ে গরম করল। সাথে ডিমও সিদ্ধ দিলো দুটো।
রান্নাঘর থেকে খুবই ক্ষীণ শব্দ শুনে ইহাম এগিয়ে গিয়ে উঁকি দিলো। মায়রা কে পিটপিট করে তাকাতে দেখে দ্রুত এগিয়ে যায় বিছানার দিকে। দূর্বল ভঙ্গুর সারাদিনেও না খাওয়া মেয়েটা ঠিক করে তাকাতে পর্যন্ত পারছিল না। রাগে ইহামের শরীর জ্বললেও আপাদত সে চুপ রইল।
নিস্তেজ চোখের পাতা মেলে তাকাতে খুব কসরত করতে হয়েছে মায়রা কে। আঁখিপল্লবে তখনি জোয়ারের মতো ভেসে আসে পরিচিত কঠিন গড়নের সেই মুখটাকে। আস্তেআস্তে মনে করার চেষ্টায় চালায় সে কিছু। মনে বারবার করাঘাত করে সকালের দৃশ্যটুকই। মানুষের মনে যেটা প্রবল ভাবে দাগ কাটে স্মৃতির উপাখ্যানের তার স্থান বুঝি হয় প্রথমেই। মায়রাও হলো তেমনটা। মুখ ভার করে সে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো বড্ড অভিমানে।
ইহাম শান্ত স্বরেই জিজ্ঞেস করল, “খুব বেশি খারাপ লাগছে?”
মায়রা তাকালো না জবাবও দিলো না। পাষাণ লোকটা আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। আর না তার উত্তরের আশায় থেকে সময় নষ্ট করল। দুপদাপ পায়ে রুম থেকে বের হওয়ার দৃশ্যটা অভিমানে জমা মায়রা সুচালো নজরে দেখল।
একটু পরই ইহাম বাটি ভর্তি স্যুপ নিয়ে আবারও ফিরে এলো। আড়চোখে মায়রা সবটা দেখলেও নির্বাক শুয়ে রইল। ট্রে টা পাশে রেখে মায়রা কে গম্ভীর স্বরে বলল,
“উঠো।”
মায়রা হেলদোল দেখালো না। পরবর্তী আর কোনো আদেশ না দিয়ে ইহাম নিজেই তার মাথার নিচে হাত গলিয়ে তার ছোট্ট শরীর টা তুলে দিলো। বিছানার মাথায় বালিশ ঠেকিয়ে তাকে বসালো হেলান দিয়ে। মায়রা গাল ভার করে সবটাই মেনে নিলো। মুখের সামনে চামচে স্যুপ ডুবিয়ে আবারও বলে উঠল, “হা করো।”
মায়রা জবাব না দিয়ে বরং মুখটা আরো ঘুরিয়ে নিলো।
“চুপচাপ খাবারটা শেষ করো মায়রা। কথা তো তোমার সাথে পরে বলছি। আগে খাবারটা খাও।”
“না।”
“মায়রা ত্যাড়ামি না করে খেয়ে নাও। এমনিতেই ডক্টর বলেছে তোমার শরীর অনেকটা দূর্বল। চুপচাপ শেষ করো এটা।”
মায়রা বিস্মিত চোখে তাকালো। ডক্টর! এর মাঝে ডক্টরও চলে এসেছিলো?
“হা করো” লোকটার গমগমে রূপ আর কঠোর গলা শুনে মায়রা আর কিছু বলল না। চুপচাপ হা করল। ইহাম তীক্ষ্ণ চোখে তাকে পরখ করছে। মায়রার নিস্তেজ মলিন মুখটা আর নিভে আসা চোখের পাতা দেখেই বলা যায় মেয়েটা যে সারাদিনে এক গ্লাস পানি অবধি খায়নি। ওই পাণ্ডুর মুখ দেখে ইহামের শরীর নিশপিশ করে উঠে।
“সারাদিনেও কিছু খাওনি কেন?” অবশেষে প্রশ্নটা করেই বসল সে।
মায়রা সুচালো নজরে তাকালো ইহামের দিকে। এ্যা, নিজে বকে টকে সারাদিন খুঁজ না নিয়ে এসেছে পিরিত দেখাতে। মুখ ভেংচি কেটে মায়রা অন্যদিকে ফিরে তাকালো নিরুত্তর রূপে।
“এদিকে তাকাও বেয়াদব।”
“পারব না।”
“তাকাতে বলেছি মায়রা।”
হুমকি সরূপ ধমকটা কাজে লাগল। সরু চোখে তাকালো মায়রা।
“মানলাম একটু বকেছি তাই বলে কি না খেয়ে কাটাবে সারাদিন বেয়াদব কোথাকার? তোমাকে আমি বলিনি খাওয়া নিয়ে এসব তামশা আমি একদম পছন্দ করি না।”
“আপনি সারাদিনে একটা খুঁজ নিয়েছিলেন? বাসায় এসেছিলেন?”
ফোঁস করে নিশ্বাস ঝাড়ার শব্দ শুনা যায়।
“কাজের খুব চাঁপ ছিলো। একটা মিশনও ছিলো। সেটা ম্যানেজ করতে একটু লেইট হয়ে গিয়েছে। এই মুহূর্তেই চাইছি না তোমায় একা ফেলে দিতে।”
মায়রা কিছু বলল না। গাল দুটি আরো ফুলে উঠল তার। তা দেখে নিগূঢ় হাসলেও শক্ত গলায় বলে ইহাম, “সারাদিন কিছু খাওনি কেন সেটা বলো। না খেয়ে থাকলে কি, এমন টা হতো?”
“না খাওয়ার জন্যে এমনটা হয়নি হয়েছে তো আপনার দেওয়া কষ্টের কারনে” গাল ফুলিয়েই জবাব দিলো মায়রা।
“রাগ করেছো মানলাম তাই বলে কি না খেয়ে থাকবে? এটা কোন ধরনের ফাজলামি মায়রা? তোমাকে যে এখনো আমি মারিনি সেটাই তো বেশি।”
“আমার খিদে লাগেনি?”
“রাগে খিদেও লাগেনি?”
“….
“তুমি কি জানো রাগ হলে আরো বেশি খিদে লাগে? সেটা না বুঝলেও কিন্তু খিদের কারণে আরো রাগ বেশি লাগে। জানো সেটা?”
এবারও উত্তর দিলো না মায়রা। কথার ফাঁকে স্যুপ প্রায় শেষের দিকে। সারাদিন না বুঝলেও খিদের জন্যে এবার তার শরীর কেঁপেছে। এখন অনেকটা ঠিক লাগছে।
“দুধ টুক খাও।”
“আর কিছু খাবো না।”
“খেতে হবে। সারাদিন খাওনি কেন তার কৈফিয়ত টা কিন্তু এবার হাড়েহাড়ে নিবো মায়রা।”
“যা খুশি করুন আমি খাবো না। আর খবরদার আমার উপর আপনি চোটপাট করবেন না।”
মায়রার মেকি রাগ দেখে ঠোঁট টিপে হাসে সে। গা ঘেঁষে বসে বলে, “সকালে খুব কষ্ট হয়েছিল বকেছি বলে?” বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ঝাটকা দিয়ে সরিয়ে দেয় মায়রা।
“ছুঁবেন না আপনি একদম ছুঁবেন না।”
“ওকে ছুঁবো না। কিন্তু চুমু তো খেতে পারি? অনেক ক্ষণ ধরে হাঁসফাঁস করছে ভেতরটা।”
গালে ঠোঁটে পরপর চুমু খেয়ে বসে ইহাম কথার ফাঁকেই। মায়রার বাঁধা দেওয়ার সুযোগটুকও পেলো না। ঠোঁট খিঁচে কপট রাগ দেখিয়ে তাকিয়ে রইল লোকটার দিকে। অভিমান জমা হয়েছিল লোকটার উপর। কিন্তু এই লোক সব মিলিয়ে দেওয়ার কৌশলও জানে। আঘাতও করবে সারিয়েও তুলবে। আহামরি কিছু না বললেও হঠাৎ লোকটার শক্ত শক্ত কথা আর রাগারাগি টা তখন খুব মনে ধরেছিল তার। যদিও সেটা অনেকটা শিথিল হয়ে গিয়েছে এখন।
“আপনি খুব পঁচা ক্যাপ্টেন সাহেব।”
“আই নো। এই পঁচা লোকটাই তোমার ভাগ্যে ছিলো কি করবে মেয়ে? কাগজে কলমে লিখে এনেছি তোমায়।”
গালে হাত রেখে শান্ত ভাবে জবাব দেয় ইহাম।
“ভাগ্যে তো লটারিও আসতে পারত। আপনার মতোই পাষাণ একটা লোককেই কেন আনল বুঝলাম না।”
“তাহলে আমিই তোমার লটারি প্রাইজ মেয়ে। তবে ক্যাশ আউট করতে হলে আমার সঙ্গে বাকীটা জীবন থাকতেই হবে।”
“হুম, লটারি হলে একে তো ফেরত দেওয়ার অপশনও থাকে ক্যাপ্টেন সাহেব।”
“কিন্তু এই লটারিতে ‘নো রিটার্ন, নো এক্সচেঞ্জ’ লেখা আছে… সই করা হয়ে গেছে, মিসেস ক্যাপ্টেন!”
“আমি আবার কখন কোথায় সই করলাম?”
“যেদিন থেকে আমার সাথে থাকা শুরু করলে সেদিন থেকেই। তোমার শেষ ঠিকানা কেবল ফাহাদ ইহাম চৌধুরী।”
“এই শেষ ঠিকানায় যদি কষ্ট লেখা থাকে তবে কি হবে আমার?”
“থাকবে না। কষ্ট থাকলেও সেটা আমি নিজের কাঁধে তুলে নেব। তোমাকে আমি কষ্টের ছোঁয়াও লাগতে দেব না মায়রা। কষ্টের ভাগ আমার আর সুখের ভাগ তোমায় দিলাম মেয়ে। তবুও এই লটারির কোনো এক্সচেঞ্জ নেই।”
“আপনি কথা দিয়েই তো আমায় কষ্ট দিয়ে ফেলেন।”
“জবান সামলাতে আমি সদা তৎপর থাকি তুমি কি তা দেখো না? আমার যেদিক তোমায় কষ্ট দিবে আমি সে দিকটাই দুমড়েমুচড়ে দিতে প্রস্তুত আমার মিসেস পিচ্চি চৌধুরী।”
মায়রার অভিমান সব পানি হয়ে যায়। লোকটার কথা মিথ্যে নয়। এখানে আসার পর থেকে প্রতিনিয়ত কাছ থেকে দেখে এটা উপলব্ধি করেছে সে। লোকটার জীবনের অনেকটা অংশ যে শুধু তার জন্যেই বরাদ্দ তাও বেশ টের পায় সে। এটাই তো তার প্রাপ্তি তৃপ্তির। কারণ মানুষটা অনেক বদলে গিয়েছে। আগের মতো আঘাতে তাকে পিষ্ট করে না। বরং তার চাওয়া পাওয়া ইচ্ছা গুলি বিশেষ নজরে রাখে। একটা স্ত্রীর সুখী হওয়ার জন্যে বিশেষ কিছুর প্রয়োজন হয় না। তবে এত দিন পর এসে সে বুক ফুলিয়ে চিৎকার করে বলতে পারে সে সুখী।
“আপনি পঁচার মাঝেও ভালো।”
“মানে বলতে চাইছো পঁচা হলেও ভিআইপি?”
ঠোঁট টিপে হেসে উঠে মায়রা। সেই হাসির দিকে অপলক তাকিয়ে গভীর স্বরে বলে উঠে ইহাম,
“পঁচা হলেও এই পঁচার মাঝেই সারাজীবন আটকে থাকতে হবে আপনায় ম্যাডাম। আপনার ভালোর জন্যে আমি আমার খারাপ দিকটাও কুরবান করে দিবো।”
এতক্ষণ অভিমান জমা থাকলেও আনন্দরা এবার পাখা মেলতে শুরু করে দিয়েছে।
“এবার দুধটুক খেয়ে নিন।”
“না।”
“ধমক না খেয়ে চুপচাপ দুধ খাও মায়রা।”
“প্লিজ।”
“কোনো বারণ শুনছি না মেয়ে। সারাদিন না খেয়ে শরীরটা পাণ্ডুর করেছো একদিনে সেই রাগটাই রাখার জায়গা পাচ্ছি না আবার নতুন করে রাগিও না আমায়।”
“তাহলে কি করবেন?”
দৃষ্টি এবং কন্ঠ দুটোই আকস্মিক ভাবে কেমন পাল্টে নিলো ইহাম। অদ্ভুত স্বরে বলে উঠল, “খেয়ে ফেলব একদম।”
চোখ দুটি বড়বড় করল মায়রা। সেই ফাঁকেই গালে হাত দিয়ে ঠোঁটের মাঝে দুধের গ্লাস চেঁপে ধরল।
“আমায় নিজেকে খাওয়ানোর চেয়ে বরং তুমি এটুক খাও তবেই হবে। আজ আমি শান্ত আছি ভয় নেই। শুধু বুকের মাঝ খানে সযত্নে ঠাই দিও প্রিয়।”
হাত ঠেলে মায়রা তা দূরে সরিয়ে দিলো। জোর করে যাও অর্ধেক খেয়েছিল এবার আর পারছে না।
“আর পারব না ক্যাপ্টেন সাহেব।”
“অল্প।”
“একটুও নয়। নয়তো এবার আপনার উপরই বমি করব আমি।”
“তোমায় বমি করানোর মতো প্রসেসিং এখনো শুরু করিনি মায়রা। কেবল তো স্বামী স্বামী করানোর প্রসেসিং স্টার্ট করেছি। বমি করানোর প্রসেসিং শুরু করতে আরো ঢের দেরি।”
“বাজে কথা বলবেন না। আপনার ভুজুংভাজুং কথাতেও আমি আর খাচ্ছি না।”
“ওকে। তবে একটা ডিম খেয়ে নাও।”
“ওয়াক।”
“আশ্চর্য এত তাড়াতাড়িই কি বাবা হয়ে যাবো নাকি? আমি না হয় বাবা হয়ে যেতে পারব কিন্তু তুমি তো এখনি মা হতে পারবে না মায়রা। এখনো পিচ্চিটি আছো যে। তুমি আমার দেহের ডিএনএ কিভাবে এবজার্ভ করে সেই চিন্তা করেই আমি অস্থির।”
“অসভ্য অভদ্র বেহায়া একটা লোক” চোখ মুখ বেশ শক্ত করেই বলল মায়রা।
“অর্ধেক খাও।”
“আপনি আপনার সামনে থেকে যান তো প্লিজ।”
“হারিয়ে যাবো?”
এবার আর মায়রা সহ্য করতে পারে না। বুকে এলোপাথাড়ি মারতে থাকে। “আপনার মুখে কিচ্ছু আটকায় না না? কিচ্ছু না? আমায় কষ্ট দিবেন না দিবেন না করে সেই ঠিকই কষ্ট দেন অসভ্য পাঁজি পাষাণ লোক। আপনি একটা নিষ্ঠুর ক্যাপ্টেন সাহেব।”
ইহাম তার হাত দুটো ধরল শক্তি দিয়েই। মায়রা তবুও মানতে নারাজ। মারার জন্যে সে করে ছটফট। বিমোহিত কন্ঠে বিড়বিড় করে ইহাম,
“আর তুমি মায়াবতী। অদৃশ্য মায়ার এক মোহে আটকে ধরেছো আমায়। যার থেকে ইহজীবনে আমার মুক্তি নেই। তুমি একটা পবিত্র মায়ামায়া ফুল মায়রা। যার সুভাস ছড়িয়ে গেছে আমার কাঠপেটা অন্তরে। সেই বরফেও তুমি নিজের মোহমায়া দিয়ে মায়ার জন্ম দিয়েছো। পাষাণ লোকটাকেও কোমল হতে বাধ্য করেছো তুমি মেয়ে। আমার চিরাগত রুক্ষতা বদলে তুমি সতেজ হতে শিখিয়েছো তোমার সংস্পর্শে। এই পাষাণ ইহামের প্রাণ ভোমরাও এখন অন্য জনের গহ্বরে লুকায়িত থাকে মেয়ে তোমার কারণে। কঠিন রূঢ় ব্যক্তিত্বের ফাহাদ ইহাম চৌধুরী কে ভেঙ্গেচুরে নিজের অজান্তেই বানিয়েছো ভিন্ন কেউ। আমি আমার সকল কঠোরতা তোমার তরে অপর্ন করে দিতে রাজি মায়রা। এই দুনিয়ার কাছে আমি পাষাণ হয়ে থাকলেও কেবল তোমার নিকটই বোধহয় শীতল তরলে পরিণত হতে পারি।”
ঝড়ের বেগে মায়রা ঝাপটে ধরে ইহাম কে। বুকের খুব গহীনে ডুকে যেতে চায়। মিশে যেতে চায় অস্তিত্বের সর্বশেষ ধাপে। যেখানে ছুঁতে পারলে এই নশ্বর দুনিয়ার আর কোনো কিছু তাদের ছুঁতে পারবে না আলাদা করতে পারবে না। ঠিক ততটা।
বালিশে মাথা রেখে ইহাম ধীর কন্ঠে ডাকে মায়রা কে।
“বুকে এসো মায়রা।”
মেয়েটা জবাব না দিয়ে ভ্রু উঁচু করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
“কাম” বলে নিজের হাত মেলে বুকে ডাকে মায়রা কে। আদুরী মেয়েটাও স্বামীর সোহাগ পেতে বুকের হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এক হাতে মায়রার ছোট্ট আদুরে শরীরটা বুকের সাথে ঝাপটে ধরে ইহাম। মেয়েটাকে বুকের সাথে মেশালেই দুনিয়ার সকল ক্লান্তি অবসাদ দূর হয়ে সন্ধ্যায় নীড়ে ফেরা পাখির মতো প্রশান্তিরা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসে। আবেশে চোখ বুজে নেয় ইহাম। বিড়বিড় করে বলে,
“তুমি কি জানো মেয়ে তুমি আমার এক আকাশ প্রশান্তি? যার সান্নিধ্যে আমি আমার সকল ক্লান্তি দূর করে নতুন উদ্যম ফিরে পাই? তুমি এমন সুখ যে সুখের ছায়াতেও তৃপ্তি খুঁজে পাওয়া যায়?”
মেয়েটা পরম সুখে আরো তলিয়ে যেতে চায় ইহামের বুকের মধ্যিখানে। গাঢ় ভাবে নিজেকে মিশিয়ে নেয় উন্মুখ বক্ষে। ফিসফিস করে বলে,
“আমাকে কখনো কষ্ট দিয়েন না ক্যাপ্টেন সাহেব। কোনো দিন ঠকিয়েন না।”
মায়রার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মিগধ আওয়াজ তুলে বলে ইহাম, “মায়রা তোমার চোখের পানি আমার কাছে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অস্ত্রের থেকেও ভয়াবহ। তোমার চোখে পানি দেখার সেই রাগ মিশ্রনের যন্ত্রণা তোমায় আমি কোনোদিন বুঝাতে পারব না। তোমায় ঠকানোর আগে আমার এই বুক ঝাঁঝরা হয়ে যাক। মরণ নিশ্চত হোক আমি ইহামের। আমার শেষ ঠিকানা কিংবা সমাপ্তি কেবল তুমি মায়রা।”
আজকাল মানুষটার মুখে এধরনের কথা শুনলেই বুক কা’মড়ে ধরে ভয়ে। মানুষটাকে হারানোর ভয়ে অদৃশ্য শক্তি গলা চেঁপে ধরে তার। বেঁচে থাকার অবলম্বন এই একটা মানুষ। যার অস্তিত্ব তার সর্বাঙ্গে প্রবাহিত।
দ্রুত মায়রা ইহামের ঠোঁটে হাত রাখে। কাতর স্বরে বলে, “দয়া করে এই ধরনের কথা বলবেন না ক্যাপ্টেন সাহেব। আমার নিশ্বাসের অনুপ্রেরণা যে মানুষটাকে তাকে হারিয়ে বাঁচবো কিভাবে আমি?”
সার্থক বোধ করে ইহাম নিজেকে। সে পেরেছে তার ওই স্ত্রী কে নিজের মোহমায়ার বাহুডোরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিতে। বিজয়ী এক হাসি ফুটে উঠে ইহামের। তৃপ্তিতে বুকটা ভরে উঠে তার। এক চিলতে সুখের ঝলক ফুটিয়ে সে মায়রার হাতের তালুতে চুম্বন দেয়। মেয়েটাকে পরম যত্নে নিজের সঙ্গে চেঁপে ধরে ফের মাথায় চুলের মাঝে ঠোঁট গলিয়ে চুমু খায়।
জ্যোৎস্নাস্নাত এক মধ্যিরাত। ইহাম আর মায়রার ব্যালকুনিতে তখন চাঁদের সাদা স্নিগ্ধ আলো ভিজিয়ে দিচ্ছো তাদের অঙ্গ। সেই সাথে অনাবিল আনন্দ আর সুখেরা তাদের চারিপাশে খেলায় মেতে উঠেছে। ঠিকরে পড়ছে খুশির জোয়ার। মনের তৃপ্তিরা সব একত্রে আসর জমিয়েছে যেন তাদের কুঠিরের সেই ছোট্ট বারান্দাটায়। শান্তিরা সকলে যেন মনের আনন্দে প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক। মিগধ হাওয়া অন্তর ছোঁয়ে যায়।
অফিস থেকে এসেই দেখে মায়রা শাড়ি পরেছে। সেই থেকে মেয়েটাকে এক বিন্দু ছাড়ছে না ইহাম। আঠার মতো লেগে আছে তখন থেকেই। শরীর ঘেঁষে ঘেঁষে মৃদু মৃদু কথায় লজ্জায় আরো রাঙ্গিয়ে দিচ্ছে মায়রা কে।
রেলিং ঘেঁষে মায়রা কে পিছন থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে ইহাম। থেমে থেমেই নাকের খুব কাছে থাকা মায়রার কোমর সমান রেশমি চুলের বিমোহিত এক মাতাল সুভাস টেনে নিচ্ছে নিজের ভেতর। ঘাড়ের খুব কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
“তোমার ওই চুলের ঘ্রাণেই আমি মাতাল হয়ে যাবো মায়রা। কন্ট্রোল হারালে সামলে নিও প্লিজ জান।”
শরীরটা হঠাৎ শিউড়ে উঠে মায়রার। উন্মুক্ত কাঁধে বারংবার নাকের ঘঁষা লাগে। পরপর ভিজে ঠোঁটের পরশে শরীর কেঁপেও উঠে মায়রার। তবে লোকটার শক্ত বন্ধনে আর নিজেকে ছাড়াতে পারে না।
মেদহীন পেটে নাভির কিনারায় দুষ্টু ভঙ্গিতে তর্জনী আঙ্গুল ঘুরপাক খায়। তাতেই নাস্তানাবুদ মায়রা। দাঁত খিঁচে খাম্বার মতো নিজেকে শক্ত করে রাখে। হাটু বেয়ে উঠা শিরশির অনুভূতিতে মুহূর্তে দিশেহারা হয় সে। তার ঘনঘন শ্বাস টানা অনুভূতি টা নিমিষে অপর মানুষটা ধরতে পেরে ঝড়ের বেগে তাকি ঘুরিয়ে নেয়। গালের পাশে হাত গুঁজে ললাটে ইহাম ওষ্ঠ চেঁপে ধরে ভেতরের সবটুক অনুভূতি উগলে দিয়ে। বেশ সময় নিয়ে গভীর ভাবে সুতীব্র এক চুমু খেয়ে অধরে অধর গলিয়ে দেয়। তারপরও সেই স্পর্শ থেমে থাকে না।
ইহামের হাত আরও দৃঢ় হয়। মায়রার কোমরে শক্ত হাত চেঁপে ধরে নিজের মধ্যে বন্দি করে। এক অচেনা তৃষ্ণা জন্ম নিল বুকের ছাতিসহ কাঁপে। উর্ধ্ব শ্বাসের তাড়নায় হৃদয় যেন বেদনায় কেঁপে উঠে। বুকের আলোড়িত ঢিপঢিপ ধ্বনি ছন্দের তালে তালে আরো মুখিয়ে তুলে রোমাঞ্চকর পরিবেশ। চোখ বন্ধ করে তারা দুজনই অনুভব করে হৃদয়ের গর্জন। কোনো তাড়া নেই। কোমল ছোঁয়ায় নিজের মাঝে স্থাপন করে নেয় মায়রার মোলায়েম ওষ্ঠজোড়া। গাঢ় করে তুলে নিজের ছোঁয়া। প্রকৃতির শান্ত স্নিগ্ধ চাঁদের ফকফকে আলোর মতো সুস্নিগ্ধতা লেপ্টে দেয় ইহাম নিজের ছোঁয়ায়। জ্যোৎস্নার মতো কোমল ছোঁয়ায় মায়রার অন্তঃকরণ ছোঁয়ে দেয় সে। তাদের এই প্রেমময় আদরের সাক্ষী হতে জ্যোৎস্নাও যেন নিজের সবটুক রূপ মেলে ধরেছে এই ধরণীতে। বিরাজ করছে নীরব একটা মধুর আলোয় স্নাত রাত। জ্যোৎস্নার দ্বিগুণ জ্যোতিতে আরো আবেদনময়ী করে তুলছে মায়রার মোহিনী অঙ্গ কে। আর ইহামের হৃদয়ে প্রণয়ের অনল দাউদাউ করে জ্বলছে।
কানের লতিতে অল্প করে ঠোঁট ছোঁয়ে দেয় ইহাম। গলায় ছোট্ট চুমু খেতেই রুদ্ধশ্বাসে মায়রা এক ঝাটকায় ইহাম কে দূরে সরিয়ে দেয়। এক ছুটে চলে যায় ভেতরে। মুখ হা করে শ্বাস নেয় বারবার। মুচকি হেসে ইহাম এগিয়ে যায়। মেয়েটা আবার পালাতে চাইলেই ইহাম খপ করে শিকারির মতো ধরে ফেলে মায়রার আঁচল। মানুষটার চাউনিতে লাজুক ভীত মায়রা আমতাআমতা করে বলে,
“দে দেখুন…”
“দেখাও মায়রা।”
“ক কি দেখাবো?”
“যা তুমি দেখাতে চাও।”
“দেখুন খুব..”
“দেখার জন্যে আমি প্রস্তুত মায়রা। তুমি শুধু খোলো।”
“একদম বাজে কথা বলবেন না। অসভ্য লোক। কাছেও আসবেন না।”
“কাছে না আসলে দেখব কি করে? দূর থেকে দেখার মজা আছে নাকি?”
ইহাম মায়রা কে ধরতে গেলেই মেয়েটা হেসে দুই পা পিছিয়ে যায়। খিলখিল করে হেসে ঘরময় ছুটতে থাকে। কোয়াটারের মাঝারি আকারের ফ্ল্যাটটা জুড়ে খুশির রিনিঝিনি আওয়াজ ভাসে হাওয়াদের সাথে সাথে।
“কাছে আসো মায়রা। এই দেখো আমার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছো। দেখতে পাচ্ছো না তুমি? তাড়াতাড়ি আসো।”
“আপনার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে আমি কাছে এসে কি করব?”
“তুমি তো আমার ঔষধ মেয়ে। প্লিজ মায়রা আসো। এবার কিন্তু আমার দম বন্ধ হয়ে যাবে। এই দেখো নিশ্বাস গলায় এসে ঠেকেছে এখনি বের হবে হবে। জলদি এসো তো।”
ফিক করে হেসে মায়রা সোফার পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। হাসতে হাসতেই বলে, “ঢং! ঠকবাজ একটা। তামশা করার আর জায়গা পান না?”
“এই পৃথিবী জুড়ে আমি ফাহাদ ইহাম চৌধুরীর জায়গা একটাই তা হলো তুমি মেয়ে।”
“আপনার এসব কথাতেও কোনো কাজ হবে না। আমি আজ ধরা দিচ্ছি না।”
“আপনি বাধ্য ম্যাডাম। জলদি এসে পড়ুন তো।”
“মুটেও না। আজ আমি কিছুতেই ধরা দিবো না আপনাকে।”
মায়রা হেসে আবারও ছুটে যায় বিছানার কাছে। মেয়েটার এমন চঞ্চল হাস্যোজ্জ্বল মোহিনী মুখটা হৃদয় ঘায়েল করে ইহামের। এক গালে হেসে সেও ছুটে যায় বিছানার দিকে। রাউন্ড রাউন্ড ঘুরতে থাকে দুজন। ঠোঁট টিপে বলে ইহাম,
“একবার যদি ধরতে পারি না মায়রা সারারাতেও তোমায় আমি নিশ্বাস নিতে দিবো না আমার নিশ্বাসের বারোটা বাজানোর কারণে।”
“আপনার হুমকি তে ভয় পাই না আমি মায়রা চৌধুরী।”
মেয়ের কথায় কোমরে হাত ঠেকিয়ে ইহাম ঘাড় বাঁকিয়ে হাসে। এই মেয়ে আসলেই একটা ত্যাড়া। বাগে আনতে হলে এমন মানুষের সাথে নিজেও ত্যাড়ামি করলে চলে না এতদিনে সে বেশ টের পেয়েছে সে। অবশেষে ফোঁস করে দম ছাড়ে ইহাম। ঠোঁট কা’মড়ে বলে,
“আমি ফাহাদ ইহাম চৌধুরী আজ স্বেচ্ছায় আপনার কাছে হার মেনেছি মিসেস চৌধুরী। এবার আসুন প্লিজ।”
“উঁহু।”
“প্লিজ বউজান।”
“একটুও না।”
মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৫৪
“দেখো আমার খুব খিদে পেয়েছে। এবার মরেই যাবো। এসো বউ একটু সাহায্য করো তো। তোমায় একটু জিহ্ব দিয়ে টেস্ট করে দেখি ফ্লেভার ঠিক আছে কিনা।”
ইহামের মুখে এমন বেখাপ্পা কথা শুনে মায়রার মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। বিস্ময়ে চোখ দুটি বড়বড় করে বলল, “ছিঃ ছিঃ রাস্তাঘাটের লম্পটের মতো এসব কথা কোথা থেকে শিখলেন ক্যাপ্টেন সাহেব?”
ঠোঁট কা’মড়ে হাসল সে। চোখ টিপে নেশা নেশায় কেমন মাতালের মতো বলে উঠে ইহাম, “কাম বেবি।”