মোহশৃঙ্খল পর্ব ১১
মাহা আয়মাত
কেবিন একদম নিস্তব্ধ। শুধু মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে কাগজ উল্টানোর শব্দ। এসির ঠান্ডা বাতাসে গোটা ঘর জমে আছে। মেহরাব চেয়ারে বসে গভীর মনোযোগে একগুচ্ছ তাহমিদ নিখোঁজ রিলেটেড কেস ফাইল পড়ছে। ঠিক তখনই দরজায় শব্দ হয়। ভেতরে প্রবেশ করে দুইজন ব্যক্তি।
মেহরাব চোখ তুলে তাকিয়ে অবাক। সঙ্গে সঙ্গেই চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট জানায়,
— স্যার, আপনি?
কেবিনে ঢুকেছেন ডিআইজি আরিফুজ্জামান খন্দকার। চেহারায় স্পষ্ট রাগের ছাপ। তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বলেন,
— আসতে হয়েছে, মেহরাব! তোমার কাজকর্মে এখন আমাকেও নড়াচড়া করতে হচ্ছে!
পাশ থেকে এসিস্ট্যান্ট দ্রুত এগিয়ে এসে উনাকে চেয়ার এগিয়ে দেয়। আরিফুজ্জামান বসেন। চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করেন,
— তুমি কার অনুমতি নিয়ে আইনমন্ত্রীর বাড়িতে গেছো? তার ওপর উনার বোনকে ইনচার্জ করেছো?
মেহরাব একটু থতমত খেয়ে যায়। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
— স্যার, ভিকটিমের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় উনার বোনের সম্পৃক্ততার কিছু তথ্য ছিল…
— সেট আপ, এসপি মেহরাব! এডিশনাল আইজিপি স্যার কল দিয়েছিলেন! তিনি খুবই রেগে ছিলেন! এই কেস তুমি এখানেই বন্ধ করবে!
মেহরাব কণ্ঠে কিছুটা ক্ষোভ নিয়ে বলে,
— কিন্তু স্যার, এখানে একজন মানুষের জীবন প্রশ্নে…
আরিফুজ্জামান থামিয়ে দেন,
— আমি যা বলেছি, তাই হবে! এই কেস আর তুমি এগোবে না।
তারপর উঠে দাঁড়ান। চলে যাওয়ার জন্য এক পা বাড়িয়ে ঘুরে সোজা মেহরাবের চোখে তাকিয়ে বলেন,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— তোমার সব কাজকর্ম আমাকে জানিয়ে করবে। একটাও ব্যতিক্রম চলবে না!
মেহরাব কিছু না বলে ঠোঁট শক্ত করে, মাথা নিচু করে স্যালুট জানায়। আরিফুজ্জামান কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে যান। তিনি বেরিয়ে যেতেই মেহরাব হঠাৎ ডেস্কের ওপর রাখা বড় মার্বেলের কাগজদানি তুলে নিয়ে এক ঝটকায় ছুঁড়ে মারে দেয়ালের দিকে।মেহরাবের চোখেমুখে জেগে ওঠে দাউদাউ আগুন।
চোখে তীব্র প্রতিশোধের ঝলক, মুখে জমে থাকা হিংস্রতা।
সে কণ্ঠস্বর রুক্ষ, রাগে ঘোলা আর কঠিনতা নিয়ে বলে,
— যতই চেষ্টা করো না কেন আরভিদ কারদার, না তুমি বাচঁতে পারবে আর না তোমার পরিবারকে আমার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না! তোমাদের বারবার পাপ করে, মানুষ মেরে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ানোর দিন শেষ! আমি তোমাদের কাউকে ছাড়বো না। ধ্বংস করে দেবো একেবারে শিকড় থেকে! কারদার ম্যানর রূপ নেবে ধ্বংসস্তূপে! তার সঙ্গে তোমার বাড়ির প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি মুখ! হিসেব করে শেষ করবো! আমি প্রতিটা অন্যায়ের হিসাব নেবো আর সেই হিসাব হবে ভয়ংকর!
মেহরাব থরথর করে কাঁপছে। তার চোখের গভীরে জ্বলজ্বল করছে আগুন যা থামার নয় বরং সবকিছু থামিয়ে দেওয়ার।
আরভিদ এসে দাঁড়ায় আদ্রিকের দরজার সামনে। নক করতে যাবে ঠিক তখনই পেছন থেকে এক মেইড বলে ওঠে,
— স্যার, আপনার জন্য বড় স্যার অপেক্ষা করছেন উনার রুমে।
আরভিদ গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দেয়,
— ঠিক আছে।
মেইড মাথা নিচু করে সেখান থেকে চলে যায়। আরভিদ একবার আদ্রিকের দরজার দিকে তাকায়, তারপর নিঃশব্দে সেখান থেকে সরে গিয়ে সোজা চলে যায় আভীর কারদারের রুমের দিকে। দরজার সামনে পৌঁছে ভেতর থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বর শুনতে পায়।
আফির কারদার বলে,
— সত্যিই ভাইয়া, আরভিদের কালকের ব্যবহারটা খুবই অবাক করার মতো ছিল!
ঠিক তখনই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ে আরভিদ। সে দৃঢ় কন্ঠে বলে,
— ড্যাডেরও আমার বউয়ের সাথে বলা কথার ধরনটা চমকপ্রদ ছিল!
আভীর কারদার চুপচাপ সোফায় বসে আফির কারদারের কথা শুনছিলেন। সামনের সোফায় বসে ছিল আফির। আরভিদের উপস্থিতিতে দুজনেই চোখ তুলে তাকায় তার দিকে।
আভীর কারদার ঠান্ডা, কিন্তু রাগ মিশ্রিত গলায় বলেন,
— তোমার বউ হওয়ার আগে, সে আমার বোনের মেয়ে।
আরভিদ এক ধাপ এগিয়ে আসে। চোখে তীক্ষ্ণ দৃঢ়তা, গলায় জোরালো অথচ সংযত ক্ষোভ।
— কিন্তু এখন সে শুধুই আমার বউ। ওর সব পরিচয়, সব সম্পর্ক এখন আমার কেন্দ্রেই। তাই আমার বউয়ের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হবে, সেটা তোমার জানা উচিত ছিল! কালকের বলা ধরনে কথা বলার কোনও রাইটস নেই তোমার!
— ঠিক আছে, ও শুধুই তোমার বউ। তাহলে আমি তো ওর শ্বশুর? আর নিজের শ্বশুরের মুখের উপর কথা বলা বেয়াদবি না? এটা তার অন্যায় নয়?
— হলেও, আমাকে বলতে! আমি বুঝিয়ে নিতাম।
আর শাসনের প্রয়োজন হলে আমি করতাম।
কিন্তু তুমি করে ভুল করেছো!
আভীর রাগে গর্জে ওঠেন,
— তোমার কাছে এখন বউ-ই সব? ড্যাডের থেকে বড় হয়ে গেছে?
— অবশ্যই। আমার দায়িত্ব ওর পাশে থাকা, ওর সম্মান রক্ষা করা। আমি ওকে এই বাড়িতে এনেছি, তার মানে ও আমার নিরাপত্তার মধ্যে। তাকে কেউ অপমান করলে, আমি প্রতিবাদ করবোই! এখন বলো, কোন চুক্তির বিনিময়ে তুমি অর্তি আর সাইহানের বিয়েতে রাজি হয়েছো?
আভীর মুখ শক্ত হয়ে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলেন,
— তুমি কী বলতে চাইছো? আমি আমার মেয়েকে নিয়ে সওদা করছি?
আরভিদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়।
— সত্যিই কি অর্তি তোমার মেয়ে?
আবীর রাগে চিৎকার করে বলে,
— হ্যা, আমার মেয়ে। আভীর কারদারের মেয়ে!
আর আমি কোনো সওদা করিনি। শুধু শত্রুতা শেষ করার জন্যই রাজি হয়েছি!
আরভিদ ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
— আর কিছু না?
আভীর কারদার কিছু টা শান্ত হয়ে চোখ নামিয়ে বলে,
— আর সারফারাজ সেই গাজীপুরের জমিটা দিয়েছে, যেটা নিয়ে শত্রুতা শুরু হয়েছিল।
বলেই আরভিদের দিকে তাকিয়ে বলে,
— কিন্তু আমি আমার মেয়েকে নিয়ে কোনো লেনদেন করিনি!
— তুমি কি একবারও অর্তির ইচ্ছে জানতে চেয়েছো?
— তোমার বউ-ই এসব মাথায় ঢুকিয়েছে, তাই না?
এইসব ইচ্ছা-অনিচ্ছার ভাষা শুধু তোমার বউয়ের!
নাজনীন ঠিকই বলতো, এই মেয়ে নিজের মর্জিতে চলতে চলতে অসভ্য হয়ে….
আরভিদের চোখ মুহূর্তেই জ্বলে ওঠে। সে চাপা কন্ঠে তীব্র রাগ নিয়ে বলে,
— থেমে যাও, নয়তো ভুলে যাবো তুমি আমার ড্যাড!
আফির অবাক হয়ে বলেন,
— আরভিদ! এইভাবে তুমি তোমার ড্যাডের সাথে কথা বলছো!
— হ্যা, বলছি। যেভাবে ড্যাড আমার বউ সম্পর্কে কথা বলছে!
— ভাইয়া বয়সে বড়, বলতেই পারে! কিন্তু তুমি কিভাবে তোমার বউয়ের পক্ষ….
— বলতেই পারে, কিন্তু সেটা আমাকে! আমার বউকে না! আমার বউ সম্পর্কে কেউ বাজে কথা বললে আমি সেটা সহ্য করবো না! আমি স্পষ্ট করে দিচ্ছি, আমি আমার বউ সম্পর্কে একটাও বাজে কথা শুনতে যেন না পাই। নাহলে…
আভীর কারদারের ভ্রু কুচকে যায়। তিনি আরভিদকে প্রশ্ন করেন,
— নাহলে কী? মেরে ফেলবে?
তখনই দরজার দিক থেকে ভেসে আসে এক পরিচিত কণ্ঠস্বর,
— মেরে ফেলাই উচিত!
আভীর ও আফির কারদার চমকে উঠে তাকায় দরজার দিকে। দরজার চৌকাঠে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিক। বুকের দু’পাশে হাত গুজে, চোখে বিদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আভীরের দিকে।
আভীর কারদার বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন,
— কি বললে?
আদ্রিক ভেতরে আসে, একবার আরভিদের দিকে তাকায়। কিন্তু আরভিদ তাকায় না। তার চোখের মনি গুলো এখনো স্থির হয়ে আছে আভীর কারদারের দিকেই।
আদ্রিক আভীর কারদারের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঠান্ডা কন্ঠে বলে,
— আমি বলেছি, বউ নিয়ে টানাটানি করলে মেরে ফেলাই উচিত!
আফির বিস্ময় কন্ঠে বলেন,
— তুমি? তুমিও আরভিদকে সাপোর্ট করছো?
আদ্রিক অবলীলায় উত্তর দেয়,
— হ্যাঁ, করছি। বউ নিয়ে টানাটানি করলে মরতেই হবে!
আভীর রাগে কাঁপতে থাকে,
— দুজনেই দেখি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছো!
আদ্রিক ভ্রু নাড়িয়ে বলে,
— আর তুমি কী করছো চাচু? ধান্দাবাজি?
আফির কারদার গর্জে ওঠেন,
— আদ্রিক!
আদ্রিক আফির কারদারের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
— আস্তে ড্যাড! জোরে কথা আমার পছন্দ না!
আভীর গলা চড়িয়ে বলেন,
— আমার মেয়ে, আমি বিয়ে দিচ্ছি। ব্যাস!
— যা নিজের না, তা নিয়ে বড়াই করা উচিত না। চাচু!
আভীর রেগে বলেন,
— কী বুঝাতে চাচ্ছো তুমি?
আদ্রিক স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
— এতটুকু বোঝার মতো ব্রেইন তো থাকার কথা!
আভীর কিছু বলার আগেই আরভিদ বলে ওঠে,
— তোর সাথে কথা আছে, ছাদে আয়।
আর কিছু না বলে সে বেরিয়ে যায়। আদ্রিক একবার আভীর কারদারকে দেখে সেও বেড়িয়ে যায় রুম থেকে। এখন রুমে নিস্তব্ধতা।
আভীর কারদার এবার রাগে ফুসতে ফুসতে আফিরের দিকে তাকায়,
— আমার ছেলে বউয়ের পক্ষে নিয়ে এসে লাগছে, তা বুঝি। কিন্তু তোর ছেলে কেন অকারণে লাগছে? আমি কি তার বউকে নিয়েও কিছু বলেছি?
আফির হতবাক হয়ে বলেন,
— কী বলছো ভাইয়া? ওর কোথা থেকে বউ আসবে?
— তাহলে সে কেন এভাবে আমার উপর চড়াও হচ্ছে?
আফির কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন,
— ও অর্তিকে খুব যত্ন করে, খেয়াল রাখে। দেখেছোই তো! হয়তো ওকে না জানিয়ে বিয়ে ঠিক করায় রেগে আছে! প্রিন্সেস তো তারও লাগে!
আভীর কারদার গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। চোখ বন্ধ করে যেন মুহূর্তেই উপলব্ধি করেন, বাড়ির দুই ছেলে আজ তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে। তারা আগে কখনো এমন করেনি। এমন বেয়াদবিও না। আরভিদের প্রতিবাদ তার কাছে যতটা স্বাভাবিক, আদ্রিকের এমন চড়াও হওয়া তাকে দ্বিগুণ চিন্তায় ফেলেছে। সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না—আদ্রিক কেন ক্ষেপে উঠেছে? তবে একটাই প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খায়—এই দুই ছেলে যদি একসাথে বিরোধিতা করে, তাহলে শেষ পর্যন্ত কিভাবে সামলাবেন তিনি?
আদ্রিক ছাদে পা রাখতেই দেখতে পেল, আরভিদ আগে থেকেই সেখানে দাঁড়িয়ে তার জন্যই অপেক্ষা করছে। আদ্রিক চুপচাপ গিয়ে ওর পাশে দাঁড়ায়। তখনই আরভিদ চোখে রাগ ও কণ্ঠে কঠোরতা মিশিয়ে আদ্রিকের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলে,
— আমি যা জিজ্ঞেস করবো সবকিছু সোজা ও সত্যি করে বলবি! নাহলে…
বলেই কোমরে গোঁজা বন্দুকটা বের করে আদ্রিকের দিকে তাক করে। চোখে ভয়ানক দৃঢ়তা।
— এই বন্দুকে থাকা সাতটা গুলিই তখন তোর বুকে গেঁথে যাবে!
আদ্রিক হেসে ফেলে। স্বভাবসুলভ ঠাণ্ডা কণ্ঠে বলে,
— বুকে তো তোর বোন থাকে, কিভাবে মারবি?
আরভিদ চোখ বন্ধ করে রাগ সংবরণ করার চেষ্টা করে। গভীর শ্বাস নিয়ে আবার চোখ খুলে গম্ভীর গলায় বলে,
— তোর কাল রাতে হঠাৎ আসা অর্তির বিয়ের খবর শুনেই?
— হ্যাঁ।
— অর্তির রুমের দেয়ালে যে রক্ত লেগে আছে, সেটা তোরই?
— হ্যাঁ, তোর বোন চোখ বন্ধ করে ছিল, তাই চোখ খুলানোর জন্য দেয়ালে পাঞ্চ মেরেছিলাম!
এইবার আরভিদের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। আদ্রিকের টি-শার্টের কলার চেপে ধরে গর্জে উঠে,
— তুই মাঝরাতে অর্তির রুমে গিয়েছিলি কেন?
আদ্রিক আগের মতোই নির্বিকার কন্ঠে বলে,
— বউ তো আমার, যেতেই পারি।
আরভিদের আর কোনো সংযম রইল না। কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই সে আদ্রিকের মুখে এক ঘুষি বসিয়ে দেয়। ঘুষির চোটে আদ্রিক কিছুটা পিছিয়ে গেল, তবে পড়ে না। নিজেকে সামলে নেয় কারণ সে জানত, এমনটাই হবে। কিন্তু এমতাবস্থায়ও আদ্রিক রাগে না। বরং বরাবরের মতোই একেবারে শান্ত।
আরভিদ চিৎকার করে বলে,
— বউ মানে কিসের বউ? আরেকবার বউ বললে মেরে ফেলবো তোকে!
— তিন কবুল বলা বউ আমার!
কথাটা শেষ করতেই আরেকটা ঘুষি এসে পড়ে আদ্রিকের মুখে। এবার সে ঠোঁটে একটা কিছুর ভেজা অনুভব করে। হাত দিয়ে ঠোঁট ছুঁয়ে সামনে আনতেই দেখে, রক্ত!
আরভিদ রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে,
— তোকে আমি মেরে ফেলবো! কোন সাহসে এসব বলিস? তোর কাছে সবকিছু মজা মনে হয়?
আদ্রিক ভ্রু উঁচিয়ে, ঠান্ডা গলায় বলে,
— মজা মনে হলে কি তোকে মামা বানাতাম?
আরভিদ থমকে যায়, চমকে তাকায় আদ্রিকের দিকে। অবিশ্বাসের সুরে বলে,
— মানে? কী করেছিস তুই অর্তির সাথে?
আদ্রিক নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে,
— বেশি কিছু না, শুধু তোকে মামা বানিয়েছি।
আরভিদ রেগে প্রশ্ন করে,
— মামা বানিয়েছিস মানে?
আদ্রিক অভ্যাসগত হাসিটা ঠোঁটের কোনে টেনে বলে,
— মানে আর ছয় মাস অপেক্ষা কর, মামা হবার জন্য!
আরভিদের চোখে খুন চেপে বসে। ওর চোখ লাল, রাগে কপাল স্লাইড করতে করতে প্রশ্ন করে,
— সত্যি বিয়ে হয়েছে?
— হ্যাঁ।
— অর্তির সম্মতিতে?
— না!
আরভিদ এবার হাত থামিয়ে তাকায় আদ্রিকের চোখে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
— জোর করেছিস?
— হুম। আর কি করতাম? কলেজে এক ছেলের সাথে প্রেম করছিল। ঐ ছেলেকে উপরে পাঠিয়ে তারপর বিয়ে করেছি!
— বিয়ে কবে করেছিস?
— ১ বছর আগে।
— আমাকে বলিসনি কেন?
— ইচ্ছে হয়নি, তাই বলিনি। এখন তুইও একজন ভালো বন্ধুর মতো আমার পাশে থাক। আর না থাকলেও সমস্যা নেই!
আরভিদের মুখ কঠিন হয়ে ওঠে। তখন আদ্রিক হেসে বলে,
— কিন্তু আমি অর্তিকে ছাড়বো না! কারো জন্য না!
আরভিদ সরু চোখে প্রশ্ন করে,
— ভালোবাসিস?
এই প্রশ্নে আদ্রিকের চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। গলার স্বর পাল্টে যায়। ভয়ানক অন্ধ এক পাগলামি ভরে ওঠে তার কণ্ঠে।
— আমি ওকে চাই। আমি ওকে চাই এমন গভীরতা আর তীব্রতায়, যা কেউ কল্পনাও করতে পারে না। আমি ওকে এমনভাবে চাই, যেভাবে কেউ কোনোদিন কিছু চায়নি। ওর চাওয়ায় আমি রক্তে হাত রাঙিয়েছি, আরও রক্ত ঝরাবো-মৃত্যু অবধি। ওকে ছুঁতে গিয়ে আমি লাশের পাহাড় বানিয়েছি। আমি পাপী হয়েছি, হিংস্র হয়েছি, অমানুষ হয়েছি তবুও থামিনি। পারবেও না কেউ আমাকে থামাতে। কারও কান্না, প্রার্থনা, কল্পনা-কিছুই ছুঁতে পারেনি আমাকে। আমি ওর জন্য সব করেছি, সব নষ্ট করেছি। কেউ পারবে না ওকে আমার মতো করে চাইতে।
আরভিদ এক মুহূর্ত স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকে আদ্রিকের দিকে। কখনো তার মনে হয়নি যে আদ্রিক অর্তিহার সঙ্গে এমন কোনো সম্পর্ক রাখে, আর তা তো ভাবাই যায় না যে আদ্রিক এই পরিমাণ গভীরভাবে ওকে চায়। অবশ্য, বাহিরের মানুষের বুঝতে না পারা একদম স্বাভাবিক। আদ্রিক এমন এক মানুষ, যে সহজেই অন্যদের বিভ্রান্ত করতে পারে। মানুষের সামনে কখনোই সে নিজের রাগ বা তীব্রতা প্রকাশ করে না।
সে সবসময় শান্ত থাকে। এমনকি যখন তার ভিতরে আগুন জ্বলে, সেটা নিজের মধ্যে গোপন রাখে, হাসিমুখে গিলে ফেলে। তার ভিতরে যা কিছু ভয়ঙ্কর, তা সে নিজের মাঝে চাপিয়ে রাখে। কখনোই সেগুলো প্রকাশ পায় না। আরভিদ ঠিক তার বিপরীত। সে কখনোই নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ছোটবেলা থেকেই রাগ হলে সে হিংস্র হয়ে ওঠে।
যদিও এখন সে যথাসম্ভব চেষ্টা করে সেই হিংস্রতা নিয়ন্ত্রণে রাখতে, তবুও মাঝে মাঝে সে সেটা রাখতে ব্যর্থ হয়।
তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তার দিক থেকে, নিয়ন্ত্রণ আর সংযত খুবই কঠিন দুটি শব্দ। কিন্তু আদ্রিক? সে পুরোপুরি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সে জানে কিভাবে নিজেকে এবং পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, আর এজন্যই কেউ কখনো টের পায়নি তার প্রকৃত রাগ বা অনুভূতি। আর এটা আদ্রিকের বিশেষ গুণ।
আরভিদ নিজের ভাবনা থেকে বেড়িয়ে, রাগ ও গম্ভীর স্বরে বলে,
— তুই ওকে এক বছর ধরে মেন্টালি আর ফিজিক্যালি টর্চার করছিস!
আদ্রিক ভ্রু কুচকে বলে,
— ভাই, ফিজিক্যাললি কোথায় টর্চার করলাম? যদি সবার সম্মতিতে আমাদের বিয়েটা হতো, তখনও কি ঐসব করতাম না?
আরভিদ রেগে দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
— নিলজ্জ! ও ছোট!
আদ্রিক হেসে বলে,
— তোর বউয়ের থেকে মাত্র এক বছরের ছোট।
আরভিদ রেগে বলে,
— নিলজ্জ! তুই যখন ওকে বিয়ে করেছিস, তখন ওর বয়স ছিল ১৭ বছর, আর আমি মেহুকে ১৯ বছর বয়সে বিয়ে করেছি!
আদ্রিক ঠাণ্ডা স্বরে বলে,
— সতেরো বছর তোর কাছেই কম লাগছে! নয়ত সতেরো বছর বয়সে মেয়েরা তো দুই তিন বাচ্চার মা হয়ে যায়!
— অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রি নিয়ে অশিক্ষিতের মতো কথা বলছিস!
আদ্রিক বিরক্ত কন্ঠে বলে,
— ভাই, আমি অশিক্ষিতই! তাও ভালো! বিয়ে তো করেছি তোর আগে, তার উপর তোর আগে বাপও হচ্ছি!
— লুকিয়ে ছুপিয়ে!
— তোর বোন চায়নি! নয়তো তুই জানিস, আদ্রিক কাউকে ভয় পায় না!
আরভিদ রাগি চোখে তাকিয়ে বলে,
— আমি কখনো ভাবিনি তোর আর অর্তির বিয়ে! আমি ভাবতাম তুই সালা, অর্তিকে নিজের বোন মনে করিস, তাই তো এত খেয়াল রাখিস!
আদ্রিক হাসতে হাসতে বলে,
— দুবাই থেকে দুইদিন একদিন, পরে এসে তোর বোনকে ম্যাথ বুঝাতাম, যাতে সে বড় হয়ে অন্যকাউকে বিয়ে করে তার বাচ্চাকে ম্যাথ বুঝাতে পারে!
আরভিদ রাগ ও বিরক্তি মিশ্রিত কন্ঠে বলে,
— তোকে ব্লাড ভাবতাম, কিন্তু তুই তো সালা ব্লাড ক্যান্সার!
আদ্রিক পকেট থেকে ফোনটা বের করে ক্যামেরা অন করে নিজের চেহারাটা দেখে বিরক্ত নিয়ে বলে,
— সালা, পরশু আমার বিয়ে! দিলি তো ফেইসটা বরবাদ করে!
আরভিদ বিরক্তিতে দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
— তোর কাজ অনুযায়ী, কমই খেয়েছিস। নয়ত এতোক্ষণে তোর ফেইস কাটিং বদলে দিতাম!
আদ্রিক মুচকি হাসে,
— আমিও তোকে মারতাম, কিন্তু সালা, তোর বউ তোকে এমনি পছন্দ করে না। তারপর মেরে চেহারার নকশা বিগড়ে গেলে, আরও পছন্দ করবে না!
আরভিদ সে কথায় পাত্তা না দিয়ে বলে,
— বিয়ে ভাঙবি কিভাবে? আর যদি বিয়ে ভাঙার কারণ মিডিয়ায় চলে যায়, তাহলে কারদার ম্যানরের সম্মান
আদ্রিক নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে,
— সেটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না! আমি সব সামলে নেবো!
আরভিদ সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
— ঐ কোচিং টিউটর কেও নিশ্চয়ই তুই ই সামলেছিস?
আদ্রিক কঠোর কন্ঠে বলে,
— হুম! কুত্তার বাচ্চা আমার বউয়ের দিকে তাকিয়েছে! আমার বউয়ের দিকে যে তাকাবে তাকেই দাফন করে দেবো!
আরভিদ ভ্রু কুচকে বলে,
— তুই কি সাইহানকেও মেরে ফেলার কথা ভাবছিস?
আদ্রিক হেসে ফেলে জোরে।
— না! ঐ বাস্টার্ডকে এত সহজে মারবো না! আমার অনুপস্থিতিতে আমার বউকে প্রেম নিবেদন করে! হুহ! শুয়োরের বাচ্চা! একেবারে কলিজাটা ছিঁড়ে ফেলবো! প্রথমে ওর শরীরের সব প্রেম মারবো!
— কী করতে চাইছিস তুই?
— ওকে এমনি মারবো না! ছটফট করাবো! ওকে এমন কষ্টে ফেলবো যে বাঁচতে ওর তিক্ত মনে হবে, আর মনে হবে যে মরা তো তার জন্য শ্রেয়! তবে এই না যে মারবো না! ওর মরণ নিশ্চিত, কিন্তু ছটফট করতে করতে!
আরভিদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
— আমারও খুব ইচ্ছে করছে তোকে এমনভাবেই মেরে ফেলতে।
আদ্রিক হেসে বলে,
— তোর বোন এমনি কম পোড়ায়নি মন!
— কম হয়েছে! ওর উচিত ছিল তোর বুকে ছুরি বসানো!
— আমার বউ পেরে উঠবে না। কিন্তু তোর বউয়ের ভেতর এই শক্তি আছে!
আরভিদ গম্ভীর কন্ঠে বলে,
— আমার বোনকে আন্ডারএস্টিমেট করিস না! শান্ত স্বভাব মানেই এই না যে অশান্তি করতে জানে না! সে চুপ থাকে, মানে এই না যে ছেড়ে দেবে!
এই বলে সে ঘুরে চলে যেতে উদ্যত হয়। ঠিক তখনই আদ্রিক তার কাঁধে হাত রাখে, থামিয়ে দেয়। আরভিদ ঘুরে তাকাতেই, আচমকাই তার মুখে পড়ে এক শক্ত ঘুষি। নিজেকে সামলে নিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখে, আদ্রিক হাসছে।
আরভিদের ভ্রু কুঁচকে ওঠে। আদ্রিক হেসে বলে,
— হাতটা নিশপিশ করছিল তোকে একটা ঘুষি দিতে!
আরভিদ বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে কোনো কথা না বলে চলে যায়। আদ্রিক ছাদে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে হাসতে থাকে। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে, নিজ মনেই বলে,
— আমিও চাই তোর বোন আমাকে না ছাড়ুক! আমি চাই, সে আমাকে সারাজীবন আকড়ে ধরে রাখুক।হোক সেটা ঘৃণা দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে বা প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে!
আকাশের নীল রঙ ধীরে ধীরে লাল আভা নিতে শুরু করে। চারপাশের পাখিরা নিজেদের বাসায় ফিরে যাচ্ছে। মেহজা তার রুমে— তুনে মারি এন্ট্রিইয়ার দিল মে বাজি গান্টি ইয়ার গান বাজিয়ে নাচছে। গানের তালে তালে মেহজাও গান গাইছে আর নাচছে।
মেহজা নাচতে নাচতে গায়,
— Peechhe meri aashiqon… Peechhe meri aashiqon ki poori poori countriyan re Tang tang tang…।
আরভিদ দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে বুকে হাত গুঁজে সুর মিলিয়ে বলে,
— এক একটাকে খুঁজে খুঁজে বের করে মারবো… টাং টাং টাং টাং!
মেহজা ঘুরে তাকায়। আরভিদ দাঁড়িয়ে আছে দরজার চৌকাঠে, বুকে দুই হাত গুঁজে। মেহজা লাফ দিয়ে বেড থেকে নেমে সাউন্ড বক্স থেকে গানটা বন্ধ করে গিয়ে আরভিদের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
— বাব্বাহ রে! কয়জনকে মারতে পারবেন?
আরভিদ মেহজার কোমর জড়িয়ে ধরে আরও কাছে টেনে এনে বলে,
— তোকে চাওয়া প্রতিটা ব্যক্তিকে!
— আর যদি আমি কাউকে চাই?
আরভিদের চেহারা শক্ত হয়ে ওঠে,
— তাহলে তাকে অন্যদের থেকে আরো জঘন্যভাবে মারবো!
— কেন? আমি তো শুনেছিলাম মানুষ বলে, যে ভালোবাসার মানুষের ভালোবাসার মানুষের সামনে দাড়ানো যায় না, ক্ষতি করা তো দূরের কথা!
— কিন্তু আমি পারবো। আর শরীরটাকে টুকরো টুকরো করে ফেলবো, এইটা দেখার জন্য যে, তার মধ্যে তুই কি এমন দেখেছিস, যা তুই আমার মধ্যে দেখতে পাসনি!
— যদি ধরে নিই, আমি আপনাকেই ভালোবেসে ফেলেছি, তখন কি নিজেকে টুকরো টুকরো করবেন? তখন তো আপনি আমার ভালোবাসার মানুষ হবেন!
— তুই বললে, আমি নিজেকে হাজার টুকরো করতে পারি, মেহু জান, আমার!
মেহজা হেসে আরভিদের বুকে ছোট করে ধাক্কা মেরে বলে,
— হুহ্! হয়েছে অনেক পসেসিভ কথাবার্তা!
— আমি কিছু দেখিনি, কিছু দেখিনি!
মেহজা আরভিদের থেকে চোখ সরিয়ে করিডোরের দিকে তাকায়। মিশান দু’হাত রেখে চোখ আড়াল করে দাঁড়িয়ে। তাকে দেখে আরভিদ অবাক না হলেও মেহজা যেন আকাশ থেকে পড়েছে।
মেহজা বিস্ময়ে তাকিয়ে বলে,
— তুই এখন এখানে? কখন এসেছিস?
মিশান হেসে বলে,
— এই তো, পাঁচ মিনিট হবে। জিজু এসেছিলো তোমাকে নিচে নিয়ে যেতে, কিন্তু না, উনি এসে এখানে তোমার সাথে রোমান্স জুড়ে দিয়েছে।
মেহজা তাড়াতাড়ি আরভিদের থেকে সরে যেতে চায়, কিন্তু আরভিদ তাকে ছাড়তে দেয় না। সে মেহজাকে শক্ত করে ধরে রাখে। মেহজা চোখের ইশারায় ছাড়তে বলে, আরভিদ মুচকি হেসে না নাড়ে, অর্থাৎ না।
মিশান হেসে বলে,
— রোমান্স করলেও অন্তত ভেতরে ঢুকাও! এভাবে দরজায় রেখেই?
আরভিদ হেসে ফেলে। মেহজা প্রচুর লজ্জা পায়, তবে সেটা আড়াল করে মিশানের দিকে তাকিয়ে বলে,
— আম্মু আব্বুও এসেছে?
মিশান বলে,
— না, এসে পারবে? জিজু নিজে গাড়ি পাঠিয়েছে আমাদের আসার জন্য!
মেহজা আরভিদের দিকে তাকায়। আরভিদ মুচকি হেসে মেহজার হাত ধরে নরমস্বরে বলে,
— চল, আঙ্কেল আর ফুজির সাথে দেখা করবি।
তারপর তিনজন নিচে চলে আসে। নিচে নেমেই মেহজা দেখতে পায়, আহিরা তালুকদার এবং মাসরিফ তালুকদার পুরো কারদার পরিবারকে নিয়ে বসে আছেন এবং তাদের সঙ্গে কথা বলছেন। মেহজা এতদিন পর মাকে-বাবাকে দেখে চোখে যেন ঝাপসা হয়ে যায়।
মেহজাকে দেখে তাহিয়া কারদার হেসে বলেন,
— এই তো, আমাদের মেহু আরভিদ এসে গেছে!
মাশরিফ এবং আস্মিতা মুখ ঘুরিয়ে তাকান। মাসরিফের মুখে ফুরে উঠে সুন্দর মিষ্টি হাসি কিন্তু আস্মিতার মুখে একটু চিন্তার ছাপ ফুটে ওঠে।
হয়তো তিনি ভাবছেন, এখনও কি মেয়ে রেগে আছে? আবার কি আমাকে দোষ দেবে? মুখ ফিরিয়ে নেবে না তো? এই সব চিন্তা গাড়িতে বসে অনেকক্ষণ করেছেন।
মাশরিফ উঠে মেহজার কাছে এসে হেসে মেহজাকে কাছে টেনে নেন, এবং মেহজাও বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
— আব্বু, কেমন আছো?
মাশরিফ মিষ্টি হাসি দিয়ে উত্তর দেন,
— ভালো, আম্মু।
মেহজা মাশরিফকে ছেড়ে এবার নিজের মায়ের দিকে তাকায়। মাশরিফ হেসে বলেন,
— তোমার আম্মুর কাছে যাও।
মেহজা একবার বাবার দিকে তাকিয়ে আবার আস্মিতার দিকে চোখ দেয়। আস্মিতা এবার চোখে জল নিয়ে বলেন,
— এখনো কি রাগ করে আছো? আসবে না আম্মুর কাছে?
মেহজা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে আস্মিতাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
— না, আমি রেগে নেই আম্মু। তোমার সাথে রেগে নেই!
আস্মিতা তার মেয়ে কে আঁকড়ে ধরে বলে,
— তুমি ভালো আছো তো, কলিজা?
তখনি মিশান হেসে বলে,
— কি বলো আম্মু? ভালো মানে? আপু তো একদম বিন্দাস আছে! আমি যখন তাদের ডাকতে গেলাম, দেখি জিজু আর আপু রোমান্স করছিলো!
মিশানের কথায় পুরো পরিবেশ কিছুটা বিব্রতকর হয়ে পড়ে। মেহজা রাগী চোখে মিশানের দিকে তাকিয়ে বোঝায়,
— তোর খবর আছে!
আরভিদও একটু অস্বস্তিতে পড়ে যায়। আস্মিতা যদিও বিব্রত হন, তবে মেয়ে তার সুখে আছে এবং সবকিছু মেনে নিয়েছে, এই ভেবে তিনি মনে মনে খুশি হন।
এমন সময় মেইড খাবার নিয়ে আসেন। তাহিয়া কারদার হেসে বলেন,
— মেয়েকে আদর করার সময় অনেক আছে , এখন কিছু খেয়ে নাও। তারপর বিশ্রাম নাও। এত পথ চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা এসেছো!
মেহজা আস্মিতাকে জরিয়ে ধরে বলে,,
— হ্যা, আম্মু! আব্বু, তোমরা কিছু খেয়ে নাও! তোমরা তো অনেক দিন পর এসেছো! এত তাড়াতাড়ি তো যেতে দিবো না!
আস্মিতা হেসে বলেন,
— তিনদিন পরেই চলে যাবো! তোমার আব্বু ব্যবসা ফেলে বেশিদিন থাকতে পারবেন না।
আরভিদ হাসতে হাসতে বলে,
— একদমই না, ফুজি! এক সপ্তাহের আগে তুমি চলে যেতে পারবে না! আর আঙ্কেলও আমার কথা ফেলবে না!
মাশরিফ হেসে বলেন,
— কিভাবে ফেলবো? আমার বড় মেয়ের জামাই!
সবাই হাসতে থাকে। মেহজা মুখ বেঁকিয়ে বলে,
— এ্যাহ? আমার থেকে কি উনি বেশি ইম্পর্ট্যান্ট তোমাদের কাছে? যে আমার কথা ফেলতে পারবে, কিন্তু উনার না?
আরভিদ মেহজার দিকে হেসে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলেন,
— শুনছিস না? আঙ্কেল কি বললো? আমি উনার বড় মেয়ের জামাই! আর মেয়ে থেকে মেয়ের জামাইয়ের ইম্পর্ট্যান্স তো সবসময় বেশি!
মেহজা ভেংচি মেরে বলে,
— হুহ!
আস্মিতা আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে খুঁজে বলে,
— তা আমার অর্তি আম্মু কই? আদ্রিক কেও দেখছি না! ও কি দেশে নেই?
নাজনীন বলে,
— না, দেশেই আছে! হয়তো বাড়িতে নেই!
তখনই সিড়ি দিয়ে নামতে থাকে আদ্রিক। তাকে দেখে মেহজা বলে,
— এই তো আসছেন!
আদ্রিক এসে লিভিং রুমে উপস্থিত হয়। মাশরিফ আর আস্মিতাকে দেখে বলে,
— কেমন আছো, ফুজি-আঙ্কেল?
— ভালো!
আস্মিতা ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করেন,
— তোমার ঠোঁট কেটে গেছে কিভাবে?
আদ্রিক হেসে উত্তর দেয়,
— একটা সাইকো রাগের ঠেলায় মেরেছে!
আভীর কারদার ভ্রু কুচকে বলেন,
— কে মেরেছে?
আরভিদ গম্ভীর স্বরে বলে,
— কেউ মারেনি! ছাদে উঠার সিঁড়িতে মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়ে কেটে গেছে!
সবাই সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায় তাদের দিকে। আদ্রিক আবার হেসে বলে,
— আই’ম কিডিং! আরভিদ সত্যি বলছে।
মেহজা হেসে বলে,
— আপনার উপর তো শনির দশা যাচ্ছে! কাল রাতে ছুড়িতে হাত কেটে, আজকে মুখ থুবড়ে পড়ে! একটু সাবধানে থাকুন, নয়ত পরেরবার আল্লাহর কড়াইতে চলে যাবেন!
আদ্রিক হেসে বলে,
— থ্যাংকস বলার জন্য! তবে এটা তোমার বরকে বলো!
নাজনীন চিন্তিত কন্ঠে বলেন,
— সত্যি আদ্রিক, তুমি অনেক বেখেয়ালি হয়ে যাচ্ছো ইদানীং!
— হুম, ভাবছি বিয়ে করে ফেলবো। তারপর আমার বেখেয়ালি গুলোকে বউ খেয়াল করে রাখবে!
এই কথায় সবাই হাসে, কিন্তু নাজনীন কারদারের মুখটা কিছুটা মলিন হয়ে যায়। তবে তিনি কিছু বলেন না। সবাই নানা কথা বলতে থাকে।
ড্রিম লাইটের অল্প আলোতে অর্তিহা রুমে পায়চারি করছে, ছটফট আর অশান্তি অনুভব করছে। তার মনে অস্থিরতায় এক মুহূর্তের জন্যও বসতে পারছে না। আদ্রিক একদম চুপ! কিন্তু কেন? সময় তো নেই! আদ্রিক কখন বিয়ে বন্ধ করবে? আদ্রিক কি সবাইকে জানাবে তার আর অর্তিহার বিয়ের ব্যাপারে, সন্তানের ব্যাপারে? সে কিছুই বুঝতে পারছে না। সময় যে নেই! পরশু বিয়ে!
অর্তিহা বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে, কখন রাত গভীর হবে এবং সে আদ্রিকের সাথে কথা বলবে। এখন কথা বলা যাবে না! হঠাৎ দরজায় নক হয়। অর্তিহা আয়নার কাছে গিয়ে নিজেকে একদম স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে, দরজা খুলতে দেখে তাদের বাসার মেইড সুমন। তার হাতে একটি রঙের বালতি।
অর্তিহা অবাক হয়ে বলে,
— আপনি?
শাকিল মাথা নিচু করে বলে,
— স্যার পাঠিয়েছে, আপনার রুমের দেয়ালে লেগে থাকা রক্তের দাগে রং করতে।
অর্তিহার মাথায় আসে, দেয়ালটার কথা। সে তো ভুলেই গিয়েছিল। অর্তিহা দরজা থেকে সরে গিয়ে লাইট জ্বালিয়ে দেয়। শাকিল ভেতরে ঢুকে রং করতে থাকে। অর্তিহা ভাবে, আদ্রিকই শাকিলকে পাঠিয়েছে।
অর্তিহা ধীর কন্ঠে অস্বস্তি নিয়ে প্রশ্ন করে,
— আদ্রিক ভাইয়া কি রুমেই আছে?
শাকিল রং করতে করতে বলে,
— না ম্যাম, উনি নিচে সবার সাথে কথা বলছেন।
— নিচে সবাই?
— জ্বি ম্যাম। আস্মিতা ম্যাম আর মাশরিফ স্যার এসেছেন।
— ফুজি আর আঙ্কেল? কখন এসেছে?
— কিছুক্ষণ আগেই।
শাকিল রঙ করা শেষ করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। অর্তিহার চিন্তা আরও বাড়তে থাকে।
অর্তিহা মনে মনে ভাবে,
— ফুজি আর আঙ্কেল নিশ্চয়ই আমার বিয়ের দাওয়াতে এসেছেন। সবাইকে দাওয়াত দেওয়া হয়ে যাচ্ছে! আদ্রিক ভাইয়া আটকাচ্ছে না কেন?
অর্তিহা রুম থেকে বেরিয়ে নিচে যাওয়ার জন্য সিড়ি দিয়ে নামতে থাকে। নামতে নামতে শুনতে পায় লিভিং রুমে বসে থাকা সবার কথাবার্তা। তার বিয়ের বিষয়েই আলোচনা হচ্ছে।
মাশরিফ আভীরকে প্রশ্ন করেন,
— তাহলে, আভীর, এত তাড়াতাড়ি অর্তির বিয়ে দিয়ে দিচ্ছো যে?
আভীর কিছুটা খোঁচা মেরে বলেন,
— তুমিও তো তোমার মেয়ের বিয়ে দিয়েছো তাড়াতাড়ি!
কথাটা শুনে উপস্থিত সবার মুখ কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে। অর্তিহা নিচে এসে সোজা লিভিং রুমে দাঁড়িয়ে থাকে, তবে সবাই তার উপস্থিতি টের পায় না কেবল আদ্রিক ছাড়া। সে বুঝতে পারে, অর্তিহা এসেছে, কিন্তু তাকায় না। আভীরের কথায় মেহজা আর আরভিদ একে অপরের দিকে তাকায়। তারপর আরভিদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আভীর কারদারের দিকে তাকায়। আস্মিতা স্বামীর দিকে তাকান।
মাশরিফের মুখে কিছুটা কঠোরতা দেখা দেয়। তিনি বলেন,
— হুম, দিয়েছি। কিন্তু সেটা তোমার ছেলের জেদ আর আমার মেয়ের প্রতি ভালোবাসা দেখে।
আভীর দৃঢ় কন্ঠে বলেন,
— আমিও সেটা দেখেই দিচ্ছি। আমার মেয়ের প্রতি সাইহানের ভালোবাসা দেখে। ওর ভালোবাসা এতটাই শক্তিশালী যে ৩৫ বছরের শত্রুতা শেষ করেছে কেবল আমার মেয়েকে পাওয়ার জন্য!
অর্তিহা তাকায় আদ্রিকের দিকে। আদ্রিক একদম চুপচাপ, চোখে তার সামনে রাখা টেবিলের দিকে তবে, তার মুখাবয়ব বলে দেয়, সে সবকিছু শুনছে । হঠাৎ করেই আস্মিতার চোখে পড়ে অর্তিহাকে। তিনি মিষ্টি করে ডাক দেন।
— অর্তি আম্মু, তুমি ঐখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? এদিকে আসো!
অর্তিহা আস্মিতার কাছে চলে আসে। আস্মিতা তাকে নিজের পাশে বসিয়ে, একটু থুতনিতে হাত রেখে বলেন,
— আমার অর্তি আম্মু তো বড় হয়ে গেছে! পরশু তো তোমার বিয়ে!
আস্মিতা এবার হেসে আভীর কারদারকে প্রশ্ন করেন,
— তা সবাইকে দাওয়াত দেয়া শেষ?
আভীর একটু হেসে বলেন,
— হ্যাঁ, আমি দলের লোক আর পরিচিতদের দাওয়াত দিয়ে দিয়েছি। আত্মীয়দের দাওয়াতের দায়িত্ব তাহিয়ার।
তাহিয়া হেসে বলেন,
— হ্যাঁ, সব আত্মীয়দের বাড়িতে কার্ড পাঠানো হয়ে গেছে।
মাশরিফ উঠে দাঁড়িয়ে বলেন,
— আমি একটু রেস্ট নিতে চাই। অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছি।
আস্মিতা মাথা নেড়ে সবাইকে বলেন,
— আমি ওকে নিয়ে রুমে যাচ্ছি, তোমরা কথা বলো।
মাশরিফ উঠে যাওয়ার সময় অর্তিহার কাছে এসে, তার মাথায় হাত বুলিয়ে মিষ্টি করে বলেন,
— সুখী হও জীবনে, নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা, আম্মু।
অর্তিহা দাঁড়িয়ে, তার মুখে একটা হালকা হাসি নিয়ে উত্তর দেয়,
— থ্যাংকিউ, আঙ্কেল।
মাশরিফ চলে যায় পেছনে আস্মিতাও তার সাথে চলে যান। এরপর সবাই আভীরের দিকে তাকায়। আফির একটু দ্বিধায় ভোগে, বলবে কি বলবে না। তারপর অবশেষে বলেন,
— ভাইয়া, তোমার এভাবে মাশরিফ ভাইয়ার সাথে কথা বলাটা ঠিক হয়নি। তিনি বাড়ির একমাত্র জামাই।
আভীর রাগি চোখে তাকিয়ে বলেন,
— এখন তুই আমাকে শিখাবি, কোনটা ভুল আর কোনটা ঠিক?
আরভিদ মেহজার দিকে তাকিয়ে মিশানকে দেখিয়ে বলেন,
— মিশানকে তার রুমে দিয়ে আয়! সেও অনেকটা পথ জার্নি করেছে।
মেহজা অবাক হয়ে ভ্রু কুচকে তাকায়, এবং পাশে থাকা মিশানও একবার আরভিদের দিকে, আরেকবার নিজের বোনের দিকে তাকায়। মেহজা কিছুটা বুঝতে পেরে, আর কোনো কথা না বাড়িয়ে মিশানকে নিয়ে চলে যায়।
আরভিদ তার দৃঢ় কন্ঠে আভীরকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
— তোমাকে আমি বারবার বলব না, ড্যাড! আমি শুধু এটুকুই বলছি, যদি তুমি দ্বিতীয়বার আমার বউ বা শ্বশুরবাড়ির কাউকে অসম্মান করো, এর ফলাফল খুবই খারাপ হবে!
আভীর রেগে বলে,
— এখন তোমার শ্বশুর-শাশুড়ি বলেই কি আমি আমার বোন বা বোনের জামাইয়ের সাথে কথা বলতে পারব না?
আরভিদ দ্বিগুণ রাগি চোখে তাকিয়ে বলে,
— না, বলতে হবে না! যদি তোমার আচরণ এমন হয়, তাহলে তোমার আমার বউ বা শ্বশুরবাড়ির মানুষদের সাথে কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই! তারা আমার বাড়িতে এসেছে, আর আমার কর্তব্য হলো আমার শ্বশুরবাড়ির মানুষের সম্মান দেওয়া!
আভীর বলেন,
— আরভি…
তাহিয়া তাড়াতাড়ি বলে ওঠে,
— চুপ করেন না আপনি! কেন শুধু ঝামেলা করছেন?
আভীর ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে,
— ঝামেলা আমি করছি? তুমি তোমার ছেলের আচরণ দেখেছো? সে প্রতিনিয়ত বউ আর শ্বশুরবাড়ির হয়ে আমার সাথে বেয়াদবি করছে! অসভ্য মেয়েটা, বিয়ে হতে না হতেই বাবার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে!
আরভিদ গর্জে ওঠে,
— অসভ্য না ও! ও আমার বউ, ওকে সম্মান দিয়ে কথা বলবে! ও আমাকে তোমার বিরুদ্ধে দাঁড় করায়নি, বরং দুদিন ধরে তোমার ঘৃণা আর অকারণে ওকে দোষারোপ করাই আমাকে তোমার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে! তুমি আমার ড্যাডকে দেখে ওয়ার্ন করছি, নয়তো পুঁতে ফেলতাম আমার বউকে অসভ্য বলার অপরাধে! তাই বলছি থেমে যাও তুমি, নয়তো এর পরিণাম খুবই খারাপ হবে!
আভীর জিজ্ঞেস করে,
— কতটুকু খারাপ করবে তুমি? নিজের বাবাকে পুঁতে ফেলবে?
আরভিদ দৃঢ় কন্ঠে বলে,
— আমি আমার বউকে নিয়ে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো, আপাতত এতটুকুই করবো!
বলেই উঠে দাঁড়িয়ে মেইডকে ডাকে। শাকিলা দৌড়ে এসে বলে,
— বলুন স্যার।
— ফুজি, আঙ্কেল আর মিশানের জন্য নাস্তা পাঠাও, আর ওদের প্রয়োজনীয় সকল কিছুর খেয়াল রাখবে! যত্নে কোনো ত্রুটি না থাকে!
— ওকে স্যার।
আরভিদ সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়। আভীর চোখে রাগ নিয়ে তাকিয়ে থাকে। তাহিয়া আভীরের কাঁধে হাত রেখে বলে,
— কেন ছেলেটাকে রাগাচ্ছেন? পরে রাগ চলে যাবে!
— তোমার ছেলেকে গিয়ে বুঝাও!
— ছেলেকে বুঝালেও বুঝবে না, তা আপনি ভালো করেই জানেন! আপনি আপনার ছেলের ভালোবাসার মানুষকে এই ধরনের কথা বললে, সে কিভাবে সহ্য করবে? বুঝবে? আপনি কি ভুলে গেছেন, আপনার ছেলে মেহুর জন্য কতটা পাগল? আর এটা তো নতুন কিছু না, সে বরাবরই মেহুকে নিয়ে জেদি! তাই ছেলেটাকে রাগিয়েন না, পরে হারাবেন!
বলেই তাহিয়া আভীরের কাছে থেকে চলে যায়। আভীর একবার সেদিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। তখন সেখানে থাকে কেবল আদ্রিক, অর্তিহা, আভীর, আফির, আর নাজনীন।
আভীর এবার আদ্রিকের দিকে তাকিয়ে বলে,
— একজন তো কেবল বউ নিয়ে পড়ে আছে! তোমার তো বউ নেই, তুমি কি একটু নিজের বোনের বিয়ের দিকে নজর দিবে? আয়োজনে সাহায্য করবে? তোমারও তো একটা দায়িত্ব আছে!
আদ্রিক একবার অর্তিহার দিকে তাকিয়ে বলে,
— অফকোর্স! দায়িত্ব তো আছেই! ইনফ্যাক্ট আমারই তো সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব ওর বিয়েতে!
অর্তিহা আদ্রিকের দিকে তাকিয়ে, তার মধ্যে ভয় ভরে ওঠে। আদ্রিকের এমন হেয়ালি কথায় সে আরো বেশি ভয় পায়। যে ছেলে ওর নাম কেউ মুখে নিলে তান্ডব শুরু করে, সেই ছেলে বলছে বিয়েতে দায়িত্ব পালন করবে!
— হুম, আমি ইভেন্ট ম্যানেজারের সাথে কথা বলে রেখেছি, কালকে আসলে তুমি দেখিয়ে দিও কেমনভাবে সাজানো হবে!
— ওকে!
বলেই আদ্রিক উঠে দাঁড়িয়ে যায়। আফির কারদার ভ্রু কুঁচকে বলেন,
— কোথাও যাচ্ছো?
— হুম! তোমার মেয়ের বিয়ের প্রস্তুতি নিতে!
বলেই আদ্রিক বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। মেহজা মিশানকে তার রুমে রেখে এসে নিজের রুমে বসে আছে। মনে একের পর এক প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। আরভিদ কি মেহজার পরিবারের পক্ষ থেকে কিছু বলবে, নাকি তাদেরকে কিছু বলা বা করা নিয়ে আরভিদের কোনো চিন্তা নেই? আভীর কারদার কি মেহজার বাবা-মায়ের বিষয়ে কিছু বলবেন? আর আরভিদ কি তার প্রতিবাদ করবে? এসবই ঘুরপাক খাচ্ছে। তখনই আরভিদ রুমে প্রবেশ করে। তার চেহারায় আগের মতোই গম্ভীর ভাব। মেহজা উঠে দাঁড়িয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আয়নায় আরভিদের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
— থ্যাংকস!
— কেন?
— আম্মু আব্বু এখানে নিয়ে আসার জন্য।
আরভিদ মেহজার কাছাকাছি গিয়ে পেছন থেকে মেহজাকে জড়িয়ে ধরে। দুজনের প্রতিবিম্ব আয়নায় দেখে আরভিদ বলে,
— তুই শুধু আমার হয়ে থাকবি, বাকী পৃথিবীর সব সুখ আমি তোর পায়ের কাছে রাখবো।
মেহজা আরভিদের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকে। সময় পার হয়ে যায়, কিন্তু তাদের দৃষ্টি এক চুলও নড়ে না। হঠাৎ মেহজা আস্তে করে বলে,
— হয়েছে! এবার চুলের জটগুলো একটু খুলে দিন!
আরভিদ মেহজার কানে এক আলতো চুমু খেয়ে বলে,
— জু হুকুম, জালেমা!
মেহজা শিরশির করে ওঠে আরভিদের ঠোঁটের আলতো স্পর্শে, তবে এই অনুভূতিটা তার কাছে খারাপ লাগেনি। বরং, একটা অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করে মনে। সে ড্রেসিং টেবিল থেকে চিরুনি নিয়ে বেডে বসে যায়, আরভিদ তার পেছনে গিয়ে বসে। মেহজার চুলে আলতোভাবে হাত রাখতেই সে ঘাড় ঘুরিয়ে আরভিদের দিকে তাকিয়ে চোখ সরু করে হুমকি সরূপ কন্ঠে বলে,
— সাবধানে, একটুও ব্যথা দেবেন না! নাহলে আমি আপনার হাত কেটে কুটি কুটি করে ফেলবো!
আরভিদ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে মেহজাকে বলে,
— পাকনামি না করে, মাথা সোজা কর, গর্দভ একটা!
মেহজা আঙুল উঁচিয়ে চোখ কড়া করে গর্জে ওঠে,
— ঐ আরভিদ, কারদার গর্দভ হবে তোর বাচ্চা!
আরভিদ অবলীলায় বলে,
— হ্যা, তোর কারণেই!
মেহজা ঠোঁট বাকিয়ে নিজেকেই বকতে থাকে, কেন যে এমন কথা বললো, যেচে ডাবল অপমানিত হলো! আরভিদ মেহজার চুলের কাছে নাক নিয়ে জোরে শ্বাস টেনে নেয়, যেন মেহজার চুলের ঘ্রাণের মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে দেয়। তার কাছে, মেহজার চুলের ঘ্রাণ নেশার মতো। সারা দিন চুলের ঘ্রাণ নিতে পারলে, যেন সে সুখ অনুভব করে।
মেহজার চুল কোমরের উপর পর্যন্ত—ঘন, কালো এবং সিল্কি! প্রায় সবাই মুগ্ধ হয়। আরভিদ যত্ন করে মেহজার চুলের ঝট ছাড়াতে থাকে। মেহজা বুঝতে পারে।
মেহজা হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,
— দেখেন, আমি সাধারণত কাউকে আমার চুলে হাত দিতে দিই না, কিন্তু আপনাকে দিয়েছি, তাই প্লিজ, ফায়দা লুটবেন না!
আরভিদ হাসি আটকে রাখতে পারে না হেসে ফেলে।
— আমি তো লুটবোই! কারণ আমি তো তোর দুই নাম্বার বেডা, তাই না?
মেহজা চোখ ঘুরিয়ে বলে,
— হু, ভুলেই গেছিলাম আপনি তো নেতা মানুষ! লুটে খাওয়া তো নেতাদের স্বভাব!
আরভিদ বিরক্ত কন্ঠে বলে,
— আর তোর স্বভাব হচ্ছে, যেই একটু মিল বা মোহাব্বত শুরু হবে, তখনি ঝামেলা করা!
তারপর সে মেহজার মাথায় বেনী করতে থাকে। বেনী করার পর মেহজা এক রাবার দিয়ে চুল বেঁধে দেয়। তারপর আরভিদ উঠে গিয়ে একটা বালিশ এনে বেডের মাঝখানে রেখে শুয়ে মেহজাকে টান দিয়ে নিজের বুকে শুয়ে নেয়।
মেহজা উপুড় হয়ে শুয়ে ফ্যানের দিকে চোখ রেখে বলে,
— শুনেন, আমার মুখে চুল উড়ে এসে পড়ছে, যা ছোট থেকেই বিরক্ত লাগে! আপনি চুলগুলো সরিয়ে দেন!
আরভিদ মেহজার মুখ থেকে উড়ে আসা চুলগুলো যত্ন সহকারে সরিয়ে দিতে থাকে, কোনো প্রকার বিরক্তি ছাড়া। মেহজার ঠোঁটের কোনে হালকা হাসি ফুটে ওঠে।
মেহজা হেসে বলে,
— আপনি মানুষটা জালেম, পটলা দুই নাম্বার বেডা হলেও, আপনার যত্ন মাশাল্লাহ ফাস্ট ক্লাস!
আরভিদ ভ্রু কুচকে বলে,
— যদি এটা তোর প্রশংসা হয়, তাহলে ধন্যবাদ! তবে আবার এমন প্রশংসা করিস না!
মেহজা মুচকি হেসে উপুড় হয়ে আরভিদের দিকে তাকিয়ে বলে,
— গালি দিলাম ভালো লাগলো না, প্রশংসা করলাম সেটাও ভালো লাগলো না! তাহলে আরভিদ কারদার আসলে কিসে আটকায়? কিসে মন্ত্রী মশাই?
আরভিদ হেসে ফেলে। মেহজার হাসি আরও চওড়া হয়ে ওঠে। তারপর, সে হাসি থামিয়ে, মেহজার গলায় নাক ঘষে বলে,
— আরভিদ কারদার আসলে মিসেস মেহজা আরভিদ কারদারের সহধর্মিণীতে বিশেষ ও অশেষ ভাবে ফেসে গেছে! সে পুরোপুরি আসক্ত হয়ে পড়েছে!
মেহজা আড়চোখে তাকিয়ে বলে,
— এমা! আরভিদ কারদার পরকিয়া করে?
আরভিদ মুচকি হাসে,
— হ্যা! তুইও চাইলে মিসেস মেহজা আরভিদ কারদারের পাতিদেবের সাথে পরকিয়া করতে পারিস!
মেহজা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
— না, আমি আমার দুই নাম্বার বুইড়া জামাইয়ের প্রতি বিশাল লয়াল! যদিও সে আমার মতো সুন্দর না, তারপরও আমি সেই গম্ভীর, রাগি বজ্জাত বুইড়া জামাইয়ের প্রতি আকাশ সমান লয়াল!
আরভিদ মেহজার দুষ্টুমিতে দ্বিগুণ সায় দিয়ে বলে,
— সত্যিই, আপনার স্বামী অনেক ভাগ্যবান, জালেমা!
মেহজা হাসতে থাকে। হঠাৎই মেহজার কিছু একটা মনে হতেই হাসি থামিয়ে গাল ফুলিয়ে আরভিদের বুকে কিল মেরে বলে,
— হাসবি না পটলা বেডা!
আরভিদ অবাক হয়ে বলে,
— কি হয়েছে? কি করেছি? রাগ করেছিস কেন?
মেহজা আরভিদের কাছ থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করে রাগ করে বলে,
— আমার শপিং করতে নিয়ে যাস নাই!
আরভিদ কোমর ধরে আটকে ফেলে হেসে বলে,
— এই ব্যাপার?
— তো এটা কি সামান্য ব্যাপার? পরশু বিয়েতে আমি কি পুরাতন কাপড় পরবো?
আরভিদ দ্বিমত করে গম্ভীর হয়ে বলে,
— না, একদমই না! পুরাতন কাপড় পরবে আরভিদ কারদারের বউ! আমার বউ তো অবশ্যই নতুন কাপড় পরবে!
— হুহ! এবার কোনো কথা নেই! আপনি একটু খেয়ালও রাখেন না! আমার তো মনে হচ্ছে আপনার কাছে আমার কোনো গুরুত্বই নই!
— এবারের মতো ক্ষমা করে দেন, জালেমা! আপনার এই জালেমটা আবার ভুল করে ফেলেছে। কাল ভোর পাঁচটায়, শপিংয়ে গিয়ে আপনার পুরো শো-রুমটা তুলে এনে দেবো?
— আমি কি আপনার মতো ক্ষ্যাত? ভোর পাঁচটায় উঠে শপিংয়ে চলে যাবো? গ্রামের মামাতো ভাই বলে কি!
আরভিদ মুচকি হেসে বলে,
— ঠিক আছে, শহুরে বউ আপনই বলেন কখন যাবেন? সেই অনুযায়ী আমি প্রস্তুতি নেবো!
মেহজা মুখ গম্ভীর করে বলে,
— আমি ঘুম যখন ভাঙবো তখনই যাবো!
আরভিদ হাসতে হাসতে বলে,
— আচ্ছা!
— আর শুনেন, কাল শপিংয়ে ঐ সাদা বিধবা রঙের পাঞ্জাবি বাদ দিয়ে কালো রঙের পাঞ্জাবি পড়বেন!
— কেন সাদা পাঞ্জাবিতে ভালো লাগে না আমাকে?
মোহশৃঙ্খল পর্ব ১০
— না, ভালো লাগে, কিন্তু সাদা পাঞ্জাবি পড়লে মনে হয় যেন আমি আল্লাহর কড়াইতে চলে গেছি!
এই কথা শুনে আরভিদ হাসে তা দেখে মেহজা ভ্রু কুচকায়। আরভিদ হঠাৎই টুপ করে মেহজার গালে চুমু দিয়ে দেয় আর মেহজার ভ্রু কুঁচকানো হালকা হয় এবং সে হেসে ফেলে।
