মোহশৃঙ্খল পর্ব ১৪

মোহশৃঙ্খল পর্ব ১৪
মাহা আয়মাত

আদ্রিক অর্তিহার রুম থেকে বের হতেই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে মিষ্টি আর হানিন। ভেতরে ঢুকেই তারা যেন হঠাৎ ঝটকা খায়। অর্তিহা দাঁড়িয়ে আছে, সাদা একটা শার্ট পরে।
হানিন অবাক হয়ে অর্তিহার দিকে এগিয়ে এসে বলে,
— একি! অর্তি, তুই ড্রেস চেঞ্জ করে ফেলেছিস?
অর্তিহা নরম গলায় উত্তর দেয়,

— হ্যাঁ।
মিষ্টি জিজ্ঞেস করে,
— কেন?
অর্তিহা চোখ নামিয়ে বলে,
— ওই ড্রেসটা দিয়ে পেট দেখা যাচ্ছিলো, তাই…
মিষ্টি একটু সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
— আদ্রিক ভাইয়া বলেছে চেঞ্জ করতে?
অর্তিহা মাথা নাড়িয়ে বলে,
— উনি কিছু বলেননি। আমার নিজেরই অস্বস্তি লাগছিলো ওই ড্রেসটা পরে, তাই বদলে ফেলেছি।
ঠিক তখনই রুমে ঢোকে মেহজা আর মিশান।মেহজাও অর্তিহাকে দেখে থমকে যায়।
সে কাছে এসে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— এই অর্তি? তুই লেহেঙ্গার টপ খুলে শার্ট পরেছিস কেন?
অর্তিহা শান্তভাবে উত্তর দেয়,
— ঐটা দিয়ে শরীর দেখা যাচ্ছিলো। যেটা নিয়ে আমি অস্বস্তি ফিল করছিলাম।
মেহজা হেসে বলে,
— ওহ আচ্ছা, কোনো সমস্যা নেই! যেটাতে তুই কমফোর্ট ফিল করিস, সেটাই পরবি।
হানিন ভ্রু কুঁচকে বলে,
— কিন্তু এই শার্টটা কার? কোথা থেকে পেলি?
মেহজাও এবার প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকায় অর্তিহার দিকে। অর্তিহা একটু দ্বিধাভরে, কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে বলে,
— উনার…
মেহজা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

— উনি টা কে?
অর্তিহা মাথা নিচু আস্তে করে বলে,
— আদ্রিক ভাইয়া।
মেহজা চোখ বড় করে বলে,
— উনি এসেছিলেন?
অর্তিহা কোনো উত্তর দেয় না, চুপ করে থাকে।
তখন মিষ্টি বলে,
— হ্যাঁ।
মেহজা কিছুক্ষণ চুপচাপ অর্তিহার দিকে তাকিয়ে থাকে। তখনি মিশান বলে,
— আচ্ছা, চল না এখন অর্তি আপুকে নিয়ে যাই? সবাই তো অপেক্ষা করছে।
মেহজা সায় দেয়,

— হ্যাঁ, চল।
সবাই মিলে অর্তিহাকে নিয়ে ছাদের দিকে রওনা দেয়।
কারদার বাড়ির বিশাল ছাদের সাজসজ্জা শেষ হয়েছে সম্পূরূপে। ছাদের একপাশে একটা ছোট্ট স্টেজ বানানো হয়েছে। মাঝখানে একজোড়া ডাবল সোফা রাখা, পাশে দুটো সিঙ্গেল সোফা। সোফাগুলোর পেছন আর চারপাশ সাদা ফুল, সবুজ পাতা আর কাপড় দিয়ে সুন্দরভাবে সাজানো।
স্টেজের সামনে কিছুটা জায়গা ফাঁকা রাখা হয়েছে, সেখানে লাল কার্পেট বিছানো। তারপর একটু পরেই চেয়ারগুলো সারি ধরে সাজানো হয়েছে। ছাদের আরেকপাশ খোলা রাখা, যাতে লোকজন দাঁড়াতে পারে। মেহজা ডানপাশে, মিষ্টি বামপাশে, আর পেছনে মিশান ও হানিন মিলে অর্তিহাকে নিয়ে ছাদের দরজার দিকে এগিয়ে আসে।
দরজা দিয়ে ঢোকার সময় মেহজা মজা করে জোরে বলে ওঠে,

— এটেনশন! এটেনশন! বউ আসছে!
সবাই হঠাৎ চুপ হয়ে যায়। উপস্থিত মেহমানরা ঘুরে তাকায় ওদের দিকে। অর্তিহাকে দেখে সবাই মুগ্ধ। তার সৌন্দর্য যেন চোখ ফেরানো দায় করে তোলে। কিন্তু আভীর, তাহিয়া, নাজনীন আর আফির কারদাররা তাকিয়ে আছেন অন্য কারণে। তাদের চোখ আটকে আছে অর্তিহার পড়নের শার্টে।
লেহেঙ্গার টপের বদলে অর্তিহা যে সাদা শার্ট পরেছে এটাই হচ্ছে সেই কারণ। তাহিয়া কারদার আর আভীর কারদার সামনে এগিয়ে আসে, সঙ্গে নাজনীন আর আফির কারদারও। তাদের এগিয়ে আসতে দেখে মেহজা, মিশান, হানিন আর মিষ্টি চিন্তিত চোখে একে অপরের দিকে তাকায়।
আভীর অর্তিহাকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

— তুমি সাইহানের বাড়ি থেকে পাঠানো লেহেঙ্গা পরোনি কেন?
হঠাৎ করা প্রশ্নে অর্তিহা একটু থমকে যায়। তারপর নিজেকে সামলে আস্তে করে বলে,
— ড্যাড, স্কার্টটা পরেছি, কিন্তু টপটা পরিনি! কারণ টপটা অনেক ছোট ছিলো, আমি আনকমফোর্টেবল লাগছিলো। আর মাথার দোপাট্টা টা এই আউটফিটের সাথে যাচ্ছিলো না, তাই খুলে ফেলেছি।
আভীর ছোট করে বলে,
— ওহ!
তাহিয়া বলেন,

— আসলে আমারই ভুল হয়েছে। বিকেলে যখন শায়রা লেহেঙ্গাটা ডালার সঙ্গে নিয়ে এসেছিলো, তখনই আমার খেয়াল করা উচিত ছিলো যে টপটা একটু ছোট।
মেহজা হেসে বলে,
— আচ্ছা থাক শাউড়ী আম্মা! যা হবার তা হয়ে গেছে। তাছাড়া অর্তিকে কিন্তু আজ নজর কাড়া সুন্দর লাগছে!
নাজনীন হেসে উঠে বলে,
— আমাদের অর্তি তো এমনিতেই অনেক সুন্দর, তার উপর আজকে তো আরও বেশি সুন্দর লাগছে, মাশাল্লাহ!
তাহিয়া অর্তিহার কপালে স্নেহময় চুমু দিয়ে বলে,

— মাশাল্লাহ!
আভীর কারদারও এগিয়ে এসে অর্তিহার বাম হাতটা তুলে হাতের উপরে চুমু দিয়ে বলে,
— আমার প্রিন্সেসটাকে আজ অনেক সুন্দর লাগছে, তাহিয়া! আল্লাহ যেন নজর থেকে হেফাজত করেন, তুমি একটু দোয়া পড়ে ফু দিয়ে দাও!
তাহিয়া হেসে মাথা নাড়িয়ে দোয়া পড়ে অর্তিহাকে ফু দিলো, এরপর মেহজাকেও দিলো।
মেহজা অবাক হয়ে বলে,
— আমাকে কেন?
তাহিয়া মেহজার থুতনিতে হাত রেখে স্নেহভরা কন্ঠে বলে,

— আজকে আমার ছেলের বউটাকেও কিন্তু কম সুন্দর লাগছে! মাশাল্লাহ!
আভীর কারদার একবার বিরক্ত চোখে মেহজার দিকে তাকালো, তারপর চুপচাপ অর্তিহার মাথায় হাত বুলিয়ে স্টেজ থেকে নেমে চলে যায়। মেহজার চোখ এড়ায়নি আভীরের সেই বিরক্তিভরা দৃষ্টি।
মিশান গাল ফুলিয়ে বলে,
— আমাকে দিলে না মামানি? আমাকে বুঝি আজ সুন্দর লাগছে না?
মিষ্টি আর হানিন একসাথে বলে উঠে,
— শুধু কি তুমি? আমাদেরও তো দিলো না! অবশ্য, আমাদের ওপর কে নজর দেবে? অনুষ্ঠানে তো দুই পরী আছে!
তাহিয়া হেসে ওদের দিকেও দোয়া পড়ে ফু দিয়ে বলে,
— তোমাদেরও অনেক সুন্দর লাগছে, মাশাল্লাহ!
সবাই হেসে উঠে। হাসির মাঝেই তাহিয়া খেয়াল করেন অর্তিহার মুখে কোনো হাসি নেই। নেই চেহারায় কোনো প্রাঞ্জলতা। তিনি এবার অর্তিহার মাথায় হাত রেখে বলে,

— অর্তি?
অর্তিহা তাহিয়া কারদারের দিকে তাকিয়ে বলে,
— হুম?
তাহিয়া বলে,
— তুমি এমন মনমরা হয়ে আছো কেন? কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত?
— না মম। আমি ঠিক আছি।
— তাহলে হাসো, আনন্দ করো। আজকে তোমার জীবনের একটা বিশেষ দিন আর তুমি এমন মুখ বেজার করে বসে আছো! মানুষ কি ভাববে?
অর্তিহা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,
— এই তো মম, হাসছি আমি।
তাহিয়াও হেসে বলেন,

— আচ্ছা তুমি এখানে আনন্দ করো। আমি ঐদিকে যাই। অনেক কাজ বাকি, মেহমানদেরও দেখাশোনা করতে হবে। নাজনীন, তুমিও চলো!
নাজনীন অর্তিহাকে আদর করে বলে,
— আচ্ছা, চল ভাবি।
ওরা চলে যেতেই মেহজা চারপাশে তাকিয়ে আরভিদকে খুঁজে, কিন্তু কোথাও দেখা মেলে না। মেহজা মনে মনে বলে,
— নির্ঘাত পেছনের দিকে বসে জানের জিগার বন্ধুর সাথে বিড়ি খাচ্ছে!
তারপর অর্তিকে বলে,
— আমি একটু আসছি!

বলেই সে স্টেজ থেকে নেমে সামনে এগোতে থাকে। খুঁজতে খুঁজতে চলে আসে ছাদের পেছনের দিকে। গিয়ে দেখে, ছাদের এক কোণে আরভিদ আর আদ্রিক দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। আরভিদ সিগারেট টানছে, ধোঁয়া ছাড়ছে ধীরে ধীরে। মেহজা অপলক তাকিয়ে আছে তার দিকেই। চোখ সরাতে পারছে না।সিগারেট টানার ভঙ্গিটা মেহজার চোখে অদ্ভুত মোহনীয়। ওর সিগারেট ধরার ভঙ্গিটাও মেহজার কাছে অসহ্য রকম সুন্দর লাগে।
আরভিদের ধোঁয়া ছাড়ার স্টাইলে মেহজার ভেতর কাঁপে। আরভিদকে সিগারেট খেতে না দেখলে জানতেই পারতো না সিগারেট খাওয়ার সময় কোনো পুরুষ কে এতোটা আকর্ষণী লাগতে পারে। মেহজার ইচ্ছে হচ্ছে গিয়ে ছুঁয়ে ফেলতে আরভিদকে! এরই মাঝে মেহজার পাশে এসে কেউ দাঁড়ায়, কিন্তু তার সেদিকে খেয়ালই নেই। সে এখনো আরভিদকেই দেখে চলেছে।

— মন খারাপ হচ্ছে আরভিদ সিগারেট খাচ্ছে দেখে? আমারও বিয়ের শুরুর দিকে মন খারাপ হতো, আরভিদের বাবার সিগারেট খাওয়া দেখে!
মেহজা চমকে তাকায়। পাশে দাঁড়িয়ে আছেন তাহিয়া কারদার।
মেহজা হেসে ফেলে,
— আরেহ নাহ মামানি! কি বলেন! উনি যখন সিগারেট খান, তখন তো উনাকে দেখে আমার পুরাই চালতা-ফেরতা কোকেইন লাগে! কোকেইন!
আচ্ছা মামানি, উনি পেটে থাকতে কি আপনি বেশি বেশি গরম খাবার খেতেন?
তাহিয়া অবাক হয়ে বলেন,

— কেন?
মেহজা দুষ্টু হাসি দিয়ে বলে,
— আসলে উনি এত হট কিভাবে? আগুনও তো এত হট না!
তাহিয়া হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকেন, তারপর হেসে মেহজার মাথায় আলতো চড় মেরে বলেন,
— পাঁজি মেয়ে, শাশুড়ি হই!
মেহজা মুচকি হেসে বলে,
— তাই তো আপনাকে জিজ্ঞেস করছি! ভবিষ্যতে কাজে লাগবে!
— ভবিষ্যতে কাজে লাগবে? কিভাবে?
মেহজা চোখ টিপে বলে,
— আপনি আমাকে হট জামাই গিফট করেছেন! এখন আমারও তো একটা দায়িত্ব আছে! আমিও আপনাকে হট নাতি গিফট করবো!
তাহিয়া হেসে ফেলেন,

— ঠিক আছে, তাহলে দ্রুত নাতি গিফট করো!
মেহজা ঠোঁট কামড়ে বলে,
— আরে শাউড়ী আম্মা, দ্রুত কিভাবে করবো? নয় মাস তো কমপক্ষে লাগবে!
তাহিয়া হাসতে হাসতে বলেন,
— ঠিক আছে, নয় মাসই যেন লাগে! তার বেশি সময় কিন্তু দিচ্ছি না!
মেহজা লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেলে,
— ইশশ!
তাহিয়া মজা করে বলেন,
— কি হয়েছে? লজ্জা পাচ্ছো?
মেহজা মুখ ফিরিয়ে বলে,
— আপনি যে কথাগুলা বলছেন তাতে আমি লজ্জা পাবো না?
তাহিয়া হেসে বলেন,
— ওরে পাঁজি মেয়ে! এখন লজ্জা লাগছে, তাই না? অথচ কিছুক্ষণ আগেই আমার ছেলেকে নিয়ে যা বললে!
মেহজা হেসে বলে,

— ঐটা তো আপনার আর আপনার ছেলের প্রশংসাই করছিলাম!
তাহিয়া হেসে উঠে তারপর আদর করে মেহজার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
— জানো, আমি জানতাম, তুমি আমার ছেলেটাকে মেনে না নিয়ে থাকতে পারবে না। আমার ছেলেটা খুব অধৈর্য! যখন যা চায়, সেটা নিবে! সে জোর করেই হোক না কেন! তবু তাকেই দেখো, তোমাকে পাওয়ার জন্য সে পুরো সাত বছর অপেক্ষা করেছে! এটাই প্রমাণ করে, সে তোমাকে কতটা চায়, কতটা ভালোবাসে। কখনো ওকে ছেড়ে যেও না।
মেহজার মুখে লজ্জা আর খুশির মিশ্র অভিব্যক্তি। বিয়ের পর সে বুঝে গেছে, এই কথাগুলো কতটা মূল্যবান। বিয়ের রাতের আরভিদ আর এখনকার আরভিদের মাঝে অনেক পার্থক্য।
মেহজা তাহিয়ার হাত দুটো ধরে বলে,

— কখনো যাবো না।
তাহিয়া বলেন,
— জীবনে অনেক সুখী হও আর আমার আরভিদকেও সুখী রেখো।
এই বলে তিনি চলে যান। তাহিয়া চলে যেতেই মেহজা আবার তাকায় আরভিদের দিকে। সে এখনো সিগারেট টানছে। মেহজা এগিয়ে গিয়ে আরভিদের পাশে দাঁড়ায়। আরভিদ ঠোঁটে সিগারেট রেখেই আড়চোখে তাকায় মেহজার দিকে। আদ্রিকও তাকায়, তবে মুখে কোনো ভাবান্তর নেই।
মেহজা জিজ্ঞেস করে,

— এই চিপায় কি করছেন?
কেউ কোনো উত্তর দেয় না। মেহজা ভ্রু কুঁচকে বলে,
— আপনি কি আমাকে ইগনোর করছেন?
এবারও উত্তর নেই। মেহজা একটু কাছে সরে এসে বলে,
— নিজের বরকে মেরে আপনার বউকে বাঁচালাম, আর আপনার মধ্যে কৃতজ্ঞতা বলতে কিছুই নেই! জালেম কারদার!
আরভিদ গম্ভীর গলায় বলে,
— ইটস নট কৃতঙ্গতা। ইটস কৃতজ্ঞতা।
মেহজা মুখ বাকিয়ে বলে,

— উপকারটা চোখে পরলো না, কিন্তু ভুল বলেছি সেটা ঠিকই চোখে পড়েছে!
আরভিদ চোখ সরু করে ডান ভ্রুটা তুলে তাকায় মেহজার দিকে। মেহজা গাল ফুলিয়ে বলে,
— হুহ! অর্তিকে নিয়ে এসেছি গিয়ে দেখেন বোনকে কেমন লাগছে!
আরভিদ সিগারেট ফেলে পায়ের নিচে পিষে ফেলে। তারপর আদ্রিকের দিকে তাকিয়ে বলে,
— চল?
মেহজা তাড়াতাড়ি বলে,
— উনার যেতে হবে না!
আরভিদ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। মেহজা হেসে বলে,
— আরে উনি তো দেখেই এসেছেন অর্তিকে!

আদ্রিক চুপচাপ, নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে থাকে মেহজার দিকে। আরভিদ কিছু না বলে সেখান থেকে চলে যায়।
আরভিদ চলে যেতেই মেহজা হেসে বলে,
— শুধু দেখেই আসে নাই! ড্রেসও সিলেক্ট করে দিয়ে এসেছে! শরীর দেখা যাচ্ছিল বলে নিজের শার্টটাও দিয়ে এসেছেন! ভুল কিছু বলেছি?
আদ্রিক আগের মতোই নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে বলে,
— কী চাই?
— বলতে চাই!
— কী?
— অর্তি থেকে দূরে থাকুন!
— তুমি বলার কে?

— আর আপনি সিদ্ধান্ত নেওয়ার কে, যে অর্তি কী পরবে আর কী পরবে না সেটা ঠিক করে দেবেন?
— অর্তির সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক আছে।
— ভাইয়ের? কিন্তু আমি তো দেখছি আপনি ভাইয়ের মতো ব্যবহার করছেন না।
আদ্রিক হিমশীতল চোখে তাকিয়ে বলে,
— বেশি দেখা ভালো না! বাড়ির মানুষ যতটুকু দেখে, তুমিও ততটুকুই দেখো।
মেহজা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলে,
— আপনি বলার কে? আমি শুধু দেখবই না, হিসাবও নেবো!
— সাহসটা তোমার একটু বেশিই না?
মেহজা হেসে বলে,
— জামাই আমার পকেটে আইন রাখে, একটু সাহস তো দেখাতেই হয়!
আদ্রিক তাচ্ছিল্য করে হেসে বলে,
— ভাগ্য নিয়ে জন্মেছো! আরভিদ তোমার ঢাল!
মেহজা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বলে,

— সাহস নিয়েও জন্মেছি! ঢাল ছাড়াও দাঁড়াতে পারি!
— তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছো, বয়সে আমি তোমার বড়।
— ভুলিনি! কিন্তু পদে আমি আপনার বড়! বড় ভাইয়ের বউ!
আদ্রিক ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেলে।
— তোমার সমস্যা টা আসলে কোথায়?
— আপনার মধ্যেই!
আদ্রিক চোখ একটু ছোট করে বলে,
— আমার?
মেহজা ঠোঁট চেপে নাক কুচকে চোখে ঝাঁজ নিয়ে বলে,

— হ্যাঁ। কেন জানি আপনাকে সহ্য হয় না!
আদ্রিক অভ্যাসগত হাসিটা টেনে বলে,
— তুমি নিজেও সহ্য করার মতো না!
মেহজা মুচকি হেসে বলে,
— আপনার অপিনিয়ন জানতে চাইনি! আপনি আমারটা জানতে চেয়েছেন!
— একটা ভালো অ্যাডভাইস দিই?
— না! মেহজার কোনো অ্যাডভাইসের প্রয়োজন নেই! তার নিজের যথেষ্ট জ্ঞান আছে!
আদ্রিক এক পা এগিয়ে হিমশীতল চোখে তাকিয়ে বলে,
— আমার সামনে তুমি পিঁপড়ার মতো। এক চুটকিতে পিষে দেব!
মেহজাও এক কদম এগিয়ে চোখ তীক্ষ্ণ করে ঠোঁটে হাসি টেনে বলে,
— হাতির সামনে পিঁপড়া ছোট হলেও, যদি সেটা শ্বাসনালিতে ঢুকে যায়, তখন হাতিও পাগল হয়ে যায়!
মেহজা কয়েক সেকেন্ড আদ্রিকের দিকে তাকিয়ে চলে যায়। আদ্রিক সিগারেটের শেষটান দিয়ে সেটা মাটিতে ফেলে পায়ের নিচে পিষে আগুনটা নিভিয়ে দেয়। চোখজোড়া স্থির হয়ে থাকে মেহজার চলে যাওয়ার দিকে। মেহজা হাঁটতে হাঁটতে স্টেজের দিকে আসছিল, তখন কৌশালী তার কাছে এসে বলে,

— তোমাকেই খুঁজছিলাম!
মেহজা সন্দেহভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
— কেন?
— সাইহান ভাই এসেছে নিচে, অর্তিকে সারপ্রাইজ দিতে। শায়রা আপু আগেই আমাকে ফোন করে জানিয়েছে। অর্তির বন্ধুরাও নিচে ওনার সাথেই আছে। চল, আমরা নিয়ে আসি!
মেহজা খুশিতে লাফিয়ে উঠে,
— ওয়াও! তাহলে তো অনেক মজা হবে। চল।
লিভিং রুমে বসে আছেন সাইহান, শায়রা, ও তার ২ জন ফ্রেন্ড আর সাইহানের ৩-৪ জন বন্ধু, আর হানিন, মিষ্টি। সাইহান পরনে হলুদ পাঞ্জাবির উপর কমলা কেটি। দেখতে এমনিতেই সুদর্শন, আর আজ যেন আরও বেশি আকর্ষণীয় লাগছে। শায়রা পড়ে আছে কমলা ও সবুজ মিশ্রণের লেহেঙ্গা। তাকে দেখতেও খুব সুন্দর। মেয়েটা এমনিতেই চোখে পড়ার মতো সুন্দর! আজকেও তার সৌন্দর্য চোখে পড়ছে।
মেহজা আর কৌশালীকে দেখে সাইহান উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়,

— আসসালামু আলাইকুম ভাবি!
মেহজা হেসে সালামের উত্তর দিয়ে বলে,
— বাব্বাহ! হবু বউকে দেখার লোভ সামলাতে পারলে না, তাই না?
সাইহান হেসে বলে,
— হুম! দেখতে চাই আমার মায়াপরীটাকে হলুদের সাজে কেমন লাগছে!
মেহজা হাসি দিয়ে বলে,
— দেখে টাস্কি খেয়ে যাবেন, কনফার্ম!
শায়রা একটু বিরক্ত হলেও মুখে হালকা হাসি রেখে বলে,
— ছাদে যাওয়া যাক?
তখনি সাইহানের এক বন্ধু বলে,
— সায়রকে আসতে দাও! সে বাইরে ফোনে কথা বলছে।
শায়রা বলে,
— কথা শেষ হলে আসবে। এখন চল, আমরা যাই!
সাইহান বলে,

— আচ্ছা।
কৌশালী বলে,
— দোপাট্টাটা কোথায়? যেটা সাইহান ভাইয়ের মাথার ওপর ধরা হবে?
শায়রা হলুদ কাপড়টা এগিয়ে দেয়। তারপর সেটা সবাই মিলে ধরে। সামনে বামে মেহজা, ডানে শায়রা। পিছনে হানিন, কৌশালী, মিষ্টি, শায়রা ফ্রেন্ডরা এবং সাইহানের ফ্রেন্ডরা। সবাই ছাদের দরজা দিয়ে ঢুকতেই সাইহানের বন্ধুরা চিৎকার করে উঠে। সবার নজর চলে যায় সেদিকে। আভীর কারদার, তাহিয়া কারদার, আফির, নাজনীন কারদার—সবাই হেসে ফেলেন সাইহানকে দেখে। আরভিদ গম্ভীরভাবে তাকিয়ে আছে। আদ্রিকও আগের মতোই ঠান্ডা দৃষ্টিতে দেখছে সাইহানকে। ওরা সবাই গিয়ে দাঁড়ায় অর্তির সামনে। অর্তিকে দেখে সাইহান আর শায়রা দুজনেই অবাক হয়ে যায়। তারপর দুজনেই একে অপরের দিকে তাকায়।
মেহজা হেসে বলে,

— বলেছিলাম না, টাস্কি খেয়ে যাবেন!
সাইহান নিজের অবাক মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে।
মেহজা দুষ্টামি করে বলে,
— কিরে অর্তি? আর কত লজ্জা পাবি? এবার মাথাটা তুলে দেখ, নিজের হবু বরকে! বেচারা তোকে দেখার জন্যই ছুটে এসেছে!
পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা মিশান তখন অর্তির থুতনিতে হাত রেখে মাথাটা তুলে বলে,
— আরে জিজু দাঁড়িয়ে আছে, তোমার এক পলক তাকানোর জন্য!
অর্তি তাকায় সাইহানের দিকে। কিন্তু সে প্রচণ্ড অস্বস্তি অনুভব করছে! বিবাহিত হয়েও এমনভাবে পরপুরুষকে “হবু বর” বলা—তাকে অস্থির করে তুলছে। তার শরীরটাও ভালো লাগছে না। মাথা ঘোরাচ্ছে। প্রেগন্যান্সির ধকলটা শরীরে স্পষ্ট।অর্তিহার চোখে চোখ পড়তেই অর্তিহার শার্ট পরার বিষয়টা সাইহানের মাথা থেকে এক মুহূর্তে মুছে যায়।
সে ডুবে যায় অর্তিহার ওই চোখের দৃষ্টিতে। কিন্তু অর্তিহা বেশিক্ষণ তাকায় না। চোখ নামিয়ে নেয়।
তারপর দোপাট্টাটাও সাইহানের মাথা থেকে সরিয়ে নেয় সবাই।
তাহিয়া আর আভীর এগিয়ে আসলে সাইহান তাদের সালাম দেয়। ওরা দুজনও সালামের উত্তর দেয়।
সাইহান একটু দ্বিধা কন্ঠে বলে,

— আসলে, আঙ্কেল… অর্তিকে একটু দেখার জন্য…
আভীর বলেন,
— এসেছো ভালো করেছো। অনুষ্ঠান টাও আরও জমজমাট লাগছে!
তাহিয়া বলেন,
— হ্যাঁ, উনি ঠিকই বলেছেন। তুমি বরং অর্তির পাশে গিয়ে বসো।
তারপর মেহজা, হানিন ও মিষ্টিকে বলে,
— ওকে অর্তির পাশে বসাও।
ওরা মাথা নাড়ে এবং সাইহানকে নিয়ে স্টেজে ওঠে।
অর্তিহা আর সাইহানের মাঝে অনেকটা জায়গা রেখে সাইহান বসে। অর্তিহা আরও একটু দূরে সরে গিয়ে সোফার একদম কিনারায় গিয়ে বসে পড়ে।
মিষ্টি হেসে বলে,

— দোস্ত, পরে যাবি! বেচারি লজ্জায় একেবারে চুপসে যাচ্ছে!
সাইহান হালকা একটা হাসি দিয়ে অর্তিহার দিকে তাকায়। এতক্ষণে তার নজরে পড়ে অর্তিহার চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য। সে চোখ ফেরাতে পারে না। একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। মেয়েটার মুখশ্রী যেন তার চোখ জুড়িয়ে দেয়। মেহজা আর বাকিরা বুঝতে পারে, ওরা থাকলে হয়তো সাইহান আর অর্তিহা অস্বস্তি বোধ করবে, তাই ওরা ওখান থেকে সরে যায়।
ওদের সরে যেতেই হঠাৎ শায়রা স্টেজে উঠে অর্তিহার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলে,

— তোমার লেহেঙ্গার টপ কোথায়? শার্ট পরে এসেছো কেন?
শায়রার কড়া গলায় অর্তিহা কিছুটা ভয় পায়। এমনিতেই এত ঝকমকে পরিবেশে সে অস্বস্তিতে ছিল।
সাইহান শায়রার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলে,
— শায়রা! কীভাবে কথা বলছিস তুই অর্তিহার সঙ্গে!
শায়রা চুপ করে গেলেও পুরোপুরি থামে না। রাগ আর বিরক্ত মিশ্রিত চোখপ তাকিয়ে থাকে।
সাইহান নরম সুরে অর্তিহাকে বলে,
— অর্তিহা? তোমার কি লেহেঙ্গার টপটা পছন্দ হয়নি?
অর্তিহা আস্তে করে বলে,

— পছন্দ হয়েছে। কিন্তু টপটা অনেক ছোট ছিলো, পরে অস্বস্তি লাগছিলো।
শায়রা বিরক্ত গলায় বলে,
— ওটা শর্ট না! ওটাই ফ্যাশন!
সাইহান কিছু বলতে যাচ্ছিলো, ঠিক তখনই পেছন থেকে আদ্রিক বলে ওঠে,
— ফ্যাশনের নামে শরীর দেখানো কারদার বাড়ির মেয়ের সাথে যায় না। কজ সি ইজ ভেরি এক্সপেনসিভ!
শায়রা ঘুরে তাকায় আদ্রিক দিকে এবং সাথে সাথেই শায়রার চোখ আদ্রিকের আটকে যায় উপর। মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে আদ্রিককে দেখতে থাকে।চুপচাপ কিন্তু গভীরভাবে। আদ্রিকের প্রতিটি ভঙ্গি, প্রতিটি শ্বাস সবই তার চাই। তার ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে। এই পুরুষটাকে সে চাই, যেভাবেই হোক। আদ্রিকের সৌন্দর্য, তার তাকানো সব পাগল করে দেয় শায়রাকে।
সাইহান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় আদ্রিকের দিকে। তারপর অর্তিহার দিকে তাকিয়ে বলে,

— কোনো সমস্যা নেই। এই সাদা শার্টেও তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।
আদ্রিক হেসে বলে,
— সুন্দর লাগবেই তো! শার্টটা আমার।
এ কথা শুনে সাইহানের চেহারা গম্ভীর হয়ে যায়। শায়রা আদ্রিকের থেকে চোখ সরিয়ে অর্তিহার শার্টের দিকে তাকায়, আর রাগ আরও বেড়ে যায়। ইচ্ছে হয় অর্তিহার জানটা নিয়ে নিতে। হিংস্রতা ভর করে চোখে।
সাইহান চোখ সরিয়ে অর্তিহার দিকে তাকিয়ে আবার বলে,
— তোমার ঠোঁটে এই ন্যুড লিপস্টিকটা অনেক সুন্দর লাগছে।
আদ্রিক আবার বলে ওঠে,
— আর খেতেও অনেক টেস্টি!
এই কথা শুনে সবাই থমকে যায়। সাইহান বিভ্রান্ত হয়। অর্তিহা হতবাক হয়ে তাকায় আদ্রিকের দিকে।
সাইহান রেগে বলে,

— কিসের?
আদ্রিক ঠোঁটে নিজের অভ্যাসগত হাসিটা টেনে বলে,
— তুমি যেটা বললে সেটারই।
শায়রা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
— লিপস্টিকের?
আদ্রিক ঠান্ডা গলায় উত্তর দেয়,
— দুটোর কম্বিনেশন।
সাইহান এবার চমকে তাকায় অর্তিহার দিকে। অর্তিহার গলা শুকিয়ে যায়, সে বুঝে যায় আদ্রিক ইচ্ছা করে এসব বলছে। শায়রার নিজের রাগকে দমায়। তারপর হেসে বলে,
— আদ্রিক, ইউ আর টু মাচ ফানি!
আদ্রিক মুচকি হেসে বলে,
— রিয়েলি?
শায়রা হাসতে হাসতে বলে,
— ইয়াহ!
তারপর সাইহানের দিকে তাকিয়ে বলে,
— ভাইয়া কুল! আদ্রিক মজা করছিলো!
কিন্তু সাইহানের রাগে রূপ নেওয়া মুখশ্রীর পরিবর্তন ঘটে না। সে জানে আদ্রিক অর্তিহাকে বোনের নজরে দেখে না। তার চোখে অর্তিহার জন্য অন্যরকম একটা কিছু দেখে সাইহান। আর এখন যে আদ্রিক মজা করেনি এটাও ভালোই করেই জানে। সাইহান উঠে দাঁড়ায়। তা দেখে অর্তিহা অবাক হয়ে যায়। সে গিয়ে আদ্রিকের সামনে দাঁড়ায়। দু’জনের উচ্চতা প্রায় একই।
সাইহান দাঁতে দাঁত পিষে বলে,

— অর্তিহা থেকে দূরে থাকো!
আদ্রিক আগের মতোই ঠোঁটের কোনে অভ্যাসগত হাসিটা রেখে বলে,
— ও তো আমার পাশের রুমেই থাকে। কীভাবে দূরে থাকবো?
সাইহান রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলে। গলায় দৃঢ়তা এনে বলে,
— আর একটা দিন! এরপর থেকে অর্তিহা তোমার পাশের রুমে থাকবে না। ও থাকবে আমার রুমে। যেটা তোমার রুম থেকে কয়েকশ কিলোমিটার দূরে!
আদ্রিক এক ভ্রু তুলে বলে,
— কিন্তু আজকের রাতটা?
সাইহান কোনো উত্তর দেয় না, শুধু রাগী চোখে তাকিয়ে থাকে। ঠিক তখনই সেখানে মেহজা আসে। দূর থেকেই দেখছিলো আদ্রিকের সঙ্গে সাইহানের কিছু একটা চলছে। এবং খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারে আদ্রিক হয়তো সাইহানকে রাগাচ্ছে।
মেহজা হেসে বলে,

— আদ্রিক ভাইয়া, আপনি এখানে ওদের মাঝে কাবাব মে হাড্ডি হচ্ছেন কেন? ওদিকে উনি একা একা সব মেহমানদের অ্যাটেন্ড করছেন! যান, গিয়ে নিজের বন্ধুকে একটু সাহায্য করেন।
আদ্রিক শান্ত চোখে মেহজার দিকে তাকায়। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসি এনে বলে,
— হুম, যাচ্ছি মেহমানদের অ্যাটেন্ড করতে। ভাবি!
এরপর সে একবার অর্তিহার দিকে, তারপর সাইহানের দিকে তাকায়। কিছু না বলেই চুপচাপ স্টেজ থেকে নেমে চলে যায়। শায়রা আদ্রিকের চলে যাওয়া দিকে তাকিয়ে থাকে। ঠিক তখনই শায়রার বান্ধবী লাম্মি তাকে ডাকে, আর শায়রা সাইহানকে বলে সেদিকে চলে যায়।
মেহজা এবার সাইহানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
— কী হলো, আপনি রেগে যাচ্ছিলেন কেন? আদ্রিক ভাই কিছু বলেছে?
সাইহান হেসে উত্তর দেয়,

— না, তেমন কিছু না।
মেহজা হালকা হাসি দিয়ে বলে,
— আচ্ছা, সেসব বাদ দেন। এখন বলেন, হবু বউকে কেমন লাগছে?
সাইহান অর্তিহার দিকে একবার তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে বলে,
— ভাবি, বিশ্বাস করেন, ওর সৌন্দর্যের বর্ণনা আমি দিতে পারবো না!
মেহজা হেসে ফেলে। তখনই তাহিয়া কারদার এসে মেহজাকে বলেন,
— সব গেস্ট চলে এসেছে। হলুদের অনুষ্ঠান শুরু করতে বলেছে ওর ড্যাড। তুমি বরং নিচে কিচেনে গিয়ে হলুদের বাটি নিয়ে এসো। ভুলে গিয়েছি আনতে।
সাইহান বলে,

— আচ্ছা ফুপি, তাহলে আমরা এখন যাই?
তাহিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন,
— যাবে কেন?
সাইহান হেসে বলে,
— আমি তো অর্তিহাকে একবার দেখতে এসেছিলাম। দেখে নিয়েছি। এখন বাড়িতে সবাই হয়তো আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
তাহিয়া হেসে বলেন,
— ঠিক আছে, যেতে পারো। তবে যাওয়ার আগে আমি আর তোমার আঙ্কেল, তোমাদের দু’জনকে একসঙ্গে হলুদ লাগিয়ে নেই।
মেহজা সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে,

— ঠিকই বলেছেন শাউড়ী আম্মা। আরে ভাইয়া, আপনাকে আটকাবো না, কিন্তু পাঁচ মিনিট থাকলেই বা ক্ষতি কী?
সাইহান হেসে সম্মতি দেয়,
— আচ্ছা, থাকি।
মেহজা তখন বলে,
— তাহলে আমি এখনই হলুদটা নিয়ে আসি।
স্টেজে থাকা টেবিল থেকে দুহাত ভর্তি আঙুর হাতের মুঠোয় পুরে সেটা খেতে খেতে স্টেজ নেমে ছাদের সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে মেহজা। ঠিক তখনই হঠাৎ একটা ছেলের সঙ্গে ধাক্কা খায় সে। ধাক্কা এতটাই জোরালো যে ছেলেটা প্রায় সিঁড়ি থেকে পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ততক্ষণে মেহজা তৎপর হয়ে খপ করে ছেলেটার একটা হাত ধরে ফেলে। ছেলেটার আরেক হাত রেলিংয়ে ঠেকানো। যেন একটুখানির ভুলেই নিচে পড়ে যেত। মেহজা প্রাণপণে ছেলেটাকে টেনে তুলতে চেষ্টা করছে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে ছেলেটা যেন পড়ে যাওয়ার চিন্তায় নেই। সে একদৃষ্টিতে মেহজার দিকে তাকিয়ে শুধু ঝুলে আছে।
মেহজা রেগে গিয়ে মেহজা বলে,

— ঐ ব্যাডা! বাদরের মতো ঝুলে থাকার ইচ্ছে হলে আমার হাত ছেড়ে ঝুল!
মেহজার কথা শুনে ছেলেটা হকচকিয়ে ওঠে। রেলিং ধরে নিজে নিজেই উঠে দাঁড়ায়। তবে, সে এখনো মেহজার হাত ছাড়েনি! তার দৃষ্টি এখনও মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে মেহজার দিকেই। মেহজা এবার জোরে হাত ছাড়িয়ে নেয়। রাগে চোখে-মুখে বিরক্তি নিয়ে সিঁড়িতে ছিটকে পড়া আঙুরগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে
— গেছে! আঙুরগুলো পড়ে গেলো! শনির দশা লেগেছে আজকে! একটা কিছুও ভালো হচ্ছে না!
ছেলেটা এবার নিচে পড়ে থাকা আঙুরগুলোর দিকে তাকায়। গুনে দেখে, পাঁচ-ছয়টা আঙুর মাটিতে গড়াচ্ছে। এরপর আবার মেহজার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,

— পাঁচ-ছয়টা আঙুরই তো পড়েছে! এভাবে রাগ ঝাড়ছেন কেন?
মেহজা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে,
— ওরে আলালের দুলাল রে! পাচ-ছয়টা কি মাগনা দিয়েছে?
ছেলেটা একটু হকচকিয়ে যায়, তারপর বলে,
— না, বাট আপনার আঙুরের থেকে এক্সপেনসিভ আমার মোবাইলটা! যেটা আপনার সাথে ধাক্কা খেয়ে হাত থেকে পড়ে গেছে সিঁড়িতে! আমি তো এমন রিয়েক্ট করছি না!
এবার মেহজা ছেলেটাকে ভালো করে দেখে। হলুদ পাঞ্জাবি পরা ছেলেটার মধ্যে একটা এলিগ্যান্ট, ক্লাসি ভাইব। উচ্চতা আনুমানিক ৫ ফুট ৯ বা ১০ ইঞ্চি হবে। শ্যামলা গাত্রবর্ণ, শরীরটা মনে হয় রীতিমতো জিম করে গড়া। চুল জেল দিয়ে সেট করা, ঝকঝকে।
মেহজা চোখ সরু করে প্রশ্ন করে,

— আপনি রিয়েক্ট করার কে? আপনার জন্যই তো ধাক্কাটা লেগেছে! আর কী বললেন? এক্সপেন্সিভ? আচ্ছা বলুন তো, কত দাম আপনার মোবাইলের?
ছেলেটি হাসে, বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উত্তর দেয়,
— Samsung Galaxy Z Fold 7! ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা!
মেহজা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
— মাত্র!
ছেলেটা মজা করে বলে,
— সিরিয়াসলি? সামান্য কিছু আঙুর পড়ে যাওয়ায় আপনি যেরকম রিয়েকশন দিলেন, সেই তুলনায় ২ লাখ ৬০ হাজার টাকায় কোনো রিয়েকশনই দিলেন না!
মেহজা গম্ভীরভাবে বলে,
— আপনার কি মনে হয়, ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা আমার জন্য কোনো ব্যাপার?
ছেলেটি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়,

— তাই নাকি? তাহলে বলেন তো ২ লাখ ৬০ হাজারে কয়টা সংখ্যা থাকে?
প্রশ্নটা শুনে মেহজার চোখ বড় বড় হয়ে যায়! অংকে সে একেবারে কাঁচা। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত তো মোটামুটি পাশ করতো, কিন্তু সিক্স থেকে টেন পর্যন্ত অংকে কখনোই পাশ করেনি! এমনকি টেস্টেও ফেল করেছিল। কপাল ভালো যে তার চাচ্চু ছিল স্কুলের প্রিন্সিপাল—তাই পাশ করিয়ে দিয়েছিল! এরপর সব পরীক্ষাগুলোতে চোখ মেলে কপি করেই পাস। তবে এই দুর্বলতা তো এখন ছেলেটার সামনে প্রকাশ করা যাবে না!
মেহজা এক গাল হাসি দিয়ে বলে,

— আপনার কি মনে হয়, এটা বলতে পারবো না আমি?
ছেলেটি চট করে বলে,
— জ্বি, মনেই হচ্ছে আপনি পারবেন না!
মেহজা ভেংচি মেরে বলে,
— এক্কেবারে বলছি!
একটু চিন্তা করে বলে,
— ৫টা সংখ্যা!
কথাটা শুনেই ছেলেটা হেসে গড়াগড়ি খায়,
— ৬টা!
মেহজা রেগে গাল ফুলিয়ে মুখ বাঁকায়। তারপর ভাব দেখিয়ে বলে,

— আসলে খুব ছোট থাকতে পড়েছিলাম! বড় হয়ে ভুলে গেছি! তেমন মনে রাখার দরকার হয়নি কারণ আমার সব কিছুর পেমেন্টের জন্য আলাদা লোক আছে! যতবার এটিএম থেকে টাকা তুলতে হয়েছে, সেই তুলে দেয়! তাকে এই জন্যই তো রাখা!
ছেলেটার এবার চক্ষু চড়কগাছ,
— সিরিয়াসলি? এত বড়লোক আপনি? টাকা তোলার জন্য আলাদা লোক রাখেন!
মেহজা গম্ভীর মুখে উত্তর দেয়,
— হ্যাঁ!
ছেলেটি এবার কৌতূহল নিয়ে বলে,

— তা আপনার বাবার ইনকাম সোর্স কী? না মানে, আমার বাবা তথ্যমন্ত্রী আর কাজিন আইনমন্ত্রী! তাদের বলেই ইনকাম ট্যাক্সের লোক পাঠিয়ে দিতাম আপনার বাড়িতে!
মেহজা কথাটা শুনে হেসে ওঠে,
— আইনমন্ত্রীর বাসায়ই পাঠিয়ে দিয়েন!
বলেই ঘুরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে শুরু করে।ছেলেটা তখন পেছন থেকে বলে,
— বাই দ্য ওয়ে, এতক্ষণ কথা বললাম কিন্তু আমার নামটাই বলা হয়নি! আমি সায়র ইফতিয়ার রেজা!
মেহজা পেছন ফিরে মুখ বাঁকিয়ে বলে,
— জানতে চাইনি!

তারপর নিচে নেমে যায়। সায়র দাঁড়িয়ে হেসে ওঠে। মেহজার কথা বলার ধরন, অভিব্যক্তি, চঞ্চলতা—সবকিছুতেই সে যেন একটু ভিন্ন রকমের আকর্ষণ খুঁজে পেয়েছে। জীবনে অনেক মেয়ে এসেছে তার জীবনে কিন্তু মেহজার মধ্যে যেন অন্যরকম কিছু আছে। মেহজার দেখা আরেকবার পাওয়ার ইচ্ছে হয়। সে হেসে ভেতরে প্রবেশ করে। চোখে পড়ে, স্টেজে বসে আছে সাইহান আর অর্তিহা। সায়র সরাসরি স্টেজের দিকে এগিয়ে যায়।
অর্তিহার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বলে,
— হাই ভাবি! আমি সায়র! আপনার ওয়ান অ্যান্ড অনলি দেবর!
অর্তিহা কিছুটা বিস্ময়ের ভঙ্গিতে সায়রের বাড়ানো হাতের দিকে তাকায়, তারপর সাইহানের দিকে।
সাইহান হেসে বলে,

— তুমি ওকে চিনতে পারোনি?
অর্তিহা হালকা মাথা নাড়িয়ে বলে,
— না, চিনতে পেরেছি!
সায়র হেসে বলে,
— কাম অন ভাইয়া! ভাবি তার এতো সুন্দর, হ্যান্ডসাম আর ড্যাশিং দেবরকে চিনবে না কেন?
অর্তিহা ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসি এনে বলে,
— হ্যালো ভাইয়া!
সায়র হাতটা নামিয়ে নিয়ে হেসে বলে,
— সত্যি! সাইহান ভাইয়ার মুখে আপনাকে যতটা ইন্ট্রোভার্ট মনে হয়েছিল, আপনি তার থেকেও কয়েক হাজার গুণ বেশি! তবে, কিউটনেস আর সুইটনেসে আপনি পুরোপুরি অভারলোডেড!
অর্তিহা এই কথার কোনো উত্তর খুঁজে পায় না, শুধু মৃদু হাসে।
সাইহান এবার সায়রকে জিজ্ঞেস করে,

— এতক্ষণ কোথায় ছিলি?
সায়র উত্তর দেয়,
— ফোনে কথা বলছিলাম। তারপর সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে একটা মে…
কথা বলতে বলতেই তার চোখ পড়ে দূরে থাকা মেহজার দিকে। সে তখন তাহিয়া কারদারের হাতে হলুদের থালাটা দিচ্ছে। সায়র হঠাৎ থেমে যায়।
সাইহান অবাক হয়ে বলে,
— সিঁড়িতে একটা মে… কী?
সায়র তাড়াতাড়ি বলে,
— ওটা কিছু না! তোমাদের দুজনকে একসাথে কিন্তু খুব মানিয়েছে!
সাইহান হাসে,
— থ্যাংকস!
মেহজা তাহিয়া কারদারকে হলুদের থালা দিলে তিনি প্রশ্ন করেন,
— আরভিদ কোথায়?
মেহজা বলে,

— মনে হয় ঐদিকে। আপনি যান আমি উনাকে নিয়ে আসছি।
মেহজা সেখান থেকে চলে গেল আরভিদকে আনতে। সায়র তখন সাইহান আর অর্তিহার সঙ্গে কথা শেষ করে ঘুরে তাকাতেই দেখে, মেহজা সেখানে নেই। সে চারদিকে চোখ বুলিয়ে মেহজাকে খুঁজতে থাকে। ঠিক তখনি তাহিয়া কারদার সেখানে আসেন। তিনি হলুদের বাটি টা অর্তিহার সামনে রাখা টেবিলে রেখে দিলেন।
তাহিয়াকে দেখে সায়র হেসে সালাম দেয়,
— আসসালামু আলাইকুম ফুপি!
তাহিয়া কারদার স্নেহভরে তাকে জড়িয়ে ধরে বলেন,
— ওয়ালাইকুম সালাম বাবা!
সায়র জিজ্ঞেস করে,
— কেমন আছো ফুপি?
তাহিয়া বলেন,

— ভালো আছি।
এই কথার মাঝেই মেহজা, আরভিদ আর আদ্রিকসহ অন্যরাও সেখানে এসে উপস্থিত হলো। সায়র স্টেজ থেকে নেমে পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। এরপর প্রথমে তাহিয়া কারদার আর আভীর স্টেজে উঠলেন সাইহান আর অর্তিহাকে হলুদ লাগানোর জন্য।
আভীর বসলেন অর্তিহার পাশে রাখা সিঙ্গেল সোফায়, আর তাহিয়া বসলেন সাইহানের পাশে। তাহিয়া বাটি থেকে হলুদ নিয়ে সাইহানের গালে লাগালেন।
এরপর সেই একই হাত দিয়ে অর্তিহার গালে হলুদ লাগাতে যাবেন ঠিক তখনই আদ্রিক বলে,
— স্টপ মিমি!
সবাই চমকে তাকায় ওর দিকে। তাহিয়া থেমে গেলেন, অবাক হয়ে আদ্রিকের দিকে তাকান। আভীর জিজ্ঞেস করেন,
— কী হয়েছে আদ্রিক?
আদ্রিক বলে,

— অর্তির কন্টাক্ট উর্টিকারিয়া অ্যালার্জি আছে। যদি সাইহানের গালে লাগানো হলুদের স্পর্শ অর্তির গালে পড়ে, ওর অ্যালার্জি হবে!
তাহিয়া কিছুটা হতবাক হয়ে বলেন,
— কিন্তু…
আভীর থামিয়ে দেন,
— আদ্রিক ঠিকই বলেছে। আমরা তো ভুলেই গেছিলাম! সাইহানের গালের হলুদটা লাগানো ঠিক হবে না।
আদ্রিক এবার স্টেজে উঠে এল। সাইহান রাগ চেপে তাকিয়ে থাকে আদ্রিকের দিকে। তাহিয়ার সামনে ওয়েট টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বলে,
— ভালো করে হাতটা মুছে নাও। যাতে সাইহানের গালের হলুদের এক ফোঁটাও অর্তির গালে না লাগে।
তাহিয়া টিস্যু দিয়ে হাত মুছতেই আদ্রিক আরেকটা টিস্যু দিলো। তারপর সাইহানের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোনে অভ্যাসগত হাসিটা রেখে বলে,

— একদম ভালোভাবে মুছো!
তাহিয়া আবারও ভালোভাবে হাত মুছে নিলেন। আদ্রিক গিয়ে দাঁড়ায় আভীরের পাশে। এবার তাহিয়া নতুন করে বাটি থেকে হলুদ তুলে অর্তিহার গালে লাগালেন। এরপর আভীর অর্তিকে হলুদ লাগিয়ে সাইহানকে লাগাতে যাবেন তখনি আদ্রিক তার হাতটা ধরে অর্তির গালে লাগানো বাকি হলুদটা মুছে দিল।
আভীর কিছু বলার আগেই সাইহান রেগে গিয়ে বলে,
— আমার তো কোনো অ্যালার্জি নেই! তাহলে আমার গালে হলুদটা লাগাতে দিলে না কেন?
এই কথা শুনে আদ্রিক হেসে বলে,
— আসলে আমি ভুলেই গেছিলাম যে তোমার অ্যালার্জির সমস্যা নেই!
সাইহান রাগি চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। এর মাঝে তাহিয়া আর আভীর স্টেজ থেকে নেমে পড়েন। ঠিক তখনি সাইহানের ফোনে কল এল। কল রিসিভ করে সে বলে,

— আসছি।
কলটা কেটে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
— বাবা কল করেছে। যেতে হবে।
তাহিয়া বলেন,
— আচ্ছা ঠিক আছে, সাবধানে যেও।
সামির, শায়রা আর সাইহানের সাথে বাকিরাও এসে দাঁড়ায়। সাইহান চুপচাপ এগিয়ে যায়। সবার চোখের সামনে সে সোজা গিয়ে অর্তিহার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে। অর্তিহা ধীরে মাথা তোলে, চোখে চোখ পড়ে দু’জনার।
সাইহান গভীরভাবে তাকিয়ে থাকে অর্তিহার চোখে। কাঁপা কণ্ঠে বলে,

— মায়াপরী…আমি কাল আসবো তোমাকে নিজের করে নিতে। অপেক্ষা করো আমার জন্য। আমার বহু বছরের অপেক্ষার অবশান ঘটাতে অপেক্ষা করো আমার জন্য।
সাইহানের গলা ধরে আসে। কিন্তু সে কথা শেষ করে— যাচ্ছি আমি… প্লিজ আমার আমানত হয়ে থেকো। শুধু আমার!
আদ্রিক তাকিয়ে আছে ঠান্ডা চোখে তাদেরই দিকে।সাইহান ধীরে উঠে দাঁড়ায়। একবার তাকায় আদ্রিকের চোখে, দৃঢ়তা নিয়ে। এরপর চুপচাপ চলে যায়। বাকিরাও চলে যায়। স্টেজ থেকে নেমে আদ্রিকও পেছনে যেতে চায়। তখন আভীর জিজ্ঞেস করেন,

— তুমি কোথায় যাচ্ছো?
আদ্রিক উত্তর দেয়,
— ওদের এগিয়ে দিয়ে আসি।
বলেই আদ্রিক চলে আসে। দ্বিতীয় তলার সিঁড়ির কাছে এসে সাইহানকে নামতে দেখে ডাক দেয়,
— সাইহান!
সাইহান থেমে যায়, ধীরে ফিরে তাকায়। আদ্রিক হিমশীতল চোখে তাকিয়ে আছে। এই মুহূর্তে তার দৃষ্টিতে যেন ঠান্ডার ছোঁয়া একটু বেশিই! সেই চোখে একবার তাকালেই অজানা এক ভয় গায়ে কাঁটা ধরায়। সাইহানও কিছুটা ভয় পায়।
আদ্রিক কঠিন কণ্ঠে বলে,
— অর্তিকে পাওয়া তো দূরের কথা, তার ছোঁয়া লেগে থাকা ধুলোর কাছেও তুমি যেতে পারবে না!

আদ্রিক ছাদের এক কোণায় দাঁড়িয়ে সামির, ফারিদ আর আদনানের সাথে কথা বলছে।
ফারিদ জুসে চুমুক দিয়ে বলে,
— পার্টির ডেকোরেশনটা জোস হয়েছে! কে সিলেক্ট করেছে?
আদ্রিক স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উত্তর দেয়,
— আমিই!
আদনান হেসে বলে,
— সিরিয়াসলি? তুই তো তোর পছন্দের মানুষের হলুদের অনুষ্ঠানের ডেকোরেশন সিলেক্ট করেছিস! তোর তো দেবদাসের মতো কান্না করা, মদ খাওয়া আর পাগলের মতো ঘোরা উচিত ছিল!
আদ্রিক ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলে,
— আমি আদ্রিক কারদার! ঐসব থার্ড ক্লাস ইমোশন আমার জন্য না।
আদনান ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,

— তুই কি অর্তিহাকে ভালোবাসিস না?
আদ্রিক সরাসরি বলে,
— না।
আদনান অবাক হয়ে বলে,
— তাহলে এতদিন ধরে…
সামির তখনই আদনানকে থামিয়ে দেয়,
— চুপ থাক, আদনান!
আদ্রিক শান্তভাবে বলে,
— আদ্রিক কারদারের যা করার দরকার, সে সেটাই করছে!

এই বলতেই আদ্রিক খেয়াল করে সামির বারবার অন্যদিকে তাকাচ্ছে। আদ্রিক চোখে ঘুরিয়ে সেদিকে তাকায়। একটু দূরেই খাবারের জন্য বুফেট স্টাইলে আয়োজন করা হয়েছে। আর সামির সেদিকেই চোখ ঘুরিয়ে বার বার তাকাচ্ছে। আদ্রিকও সেদিকে তাকাতেই দেখে মেহজা সেখানে দাঁড়িয়ে চাফিং ডিশ থেকে কয়েকটা চিকেন ললিপপ তুলে খাচ্ছে। খেতে খেতেই মেহজার চোখ পড়ে আদ্রিকের দিকে। চোখে চোখ পড়তেই, মেহজা মুখ বিকৃত করে আদ্রিককে ভেংচি কাটে।
আদ্রিক আর সামির অন্যদিকে তাকিয়ে যায়, কিন্তু তখন আদনান আর ফারিদও দেখে ফেলে মেহজার আদ্রিককে ভেংচি দেওয়া। ফারিদ আর আদনান জোরে হেসে উঠে।
সামির মুচকি হেসে মেহজার দিকেই তাকিয়ে থাকে।
আদ্রিক আস্তে করে বলে,

— ডিস্টার্ব একটা!
আদনান হেসে বলে,
— ভাই, মাইয়াটা একটা চিজই! দেখলি কিভাবে তোকে ভেংচি দিল?
সামির চোখ না সরিয়েই আদ্রিককে বলে,
— ডিস্টার্ব তো ঠিকই! এই মেয়েটার প্রাণবন্ততা, চঞ্চলতা, হাসি বারবার মনোযোগ ডিসকানেক্ট করছে অনুষ্ঠান থেকে।
আদ্রিক স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে,
— চোখ সরা নয়ত প্রাণটাও ডিসকানেক্ট হয়ে যাবে দুনিয়া থেকে।
সামির ভ্রু কুঁচকে তাকায়। ফারিদ জিজ্ঞেস করে,

— মানে?
আদ্রিক বলে,
— ভাবি হয় তোদের!
আদনান সন্দেহভরা চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
— তুই কি এটাকেও…
আদ্রিক সোজা তাকিয়ে উত্তর দেয়,
— আরভিদের বউ!
এই কথাটা শুনে সামিরের মুখটা একটু থমথমে হয়ে যায়। সে আবার একবার তাকায় মেহজার দিকে। মেহজা তখনই এদিকেই আসছে হাতে একটা প্লেটে করে অনেকগুলো চিকেন ললিপপ নিয়ে। সামির তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নেয়।
আদনান হেসে বলে,

— সালারের চোখ আছে! জীবনের প্রথমবার কোনো মেয়ের দিকে নজর দিছে তাও ডিরেক্ট আইনমন্ত্রীর বউয়ের দিকে!
সামির বিরক্ত হয়ে বলে,
— চুপ কর, মেয়েটা এদিকেই আসছে।
এই কথা বলতে বলতেই মেহজা এসে সামনে দাঁড়িয়ে প্লেটটা বাড়িয়ে দেয় আদ্রিকের দিকে।
আদ্রিক বলে,
— এগুলো দিচ্ছো কেন?
মেহজা হেসে বলে,
— এতিমের মতো তাকিয়ে আছেন আমার খাবারের দিকে! যেন কখনো চিকেন ললিপপ খাননি! তাই দিলাম। এখন আর আমার প্লেটের দিকে তাকাবেন না, না হলে আইসা কাটা চামচ দিয়ে চোখ তুইল্লা ফেলমো!
আদ্রিক বলে,

— লাগবে না, নিয়ে যাও। আর আমি তোমার খাবারের দিকে তাকাইনি। কথা বলতে বলতে হঠাৎ চোখ পড়ে যায়। আর তোমার রাক্ষসীর মতো খাওয়া দেখে চোখ থেমে যায়!
মেহজা মুখ বাকিয়ে বলে,
— এমনিই শুকিয়ে গেছি, মুখে একদম রুচি নাই! তার ওপর আবার শকুনের নজর! হুহ্!
এই বলে চলে যেতে নিলে ফারিদ ডাক দেয়,
— আপু?
— জ্বি?
— ওর না লাগলেও, আমাদের লাগবে! এগুলো আমাকে দেন।
মেহজা প্লেটটা বাড়িয়ে দেয়। ফারিদ নিয়ে নেয় আর বলে,
— থ্যাংকস!
মেহজা হেসে বলে,
— আরে থ্যাংকস বলতে হবে না! আমার মনটা অনেক বড়!
ফারিদ হাসে। এদিকে সামির মাথা নিচু করে রেখেছে। মেহজা চলে যেতেই সে আস্তে করে মাথা তোলে। তখন ফারিদ মেহজার চলে যাওয়ার দিকটা দেখে বলে,
— এত কিউট ভাবির সঙ্গে এতো রূঢ় ব্যবহার!
আদ্রিক শান্ত কন্ঠে বলে,

— কিউট না, পেইন! যেটার কোনো ওষুধ নাই!
ঠিক তখনই আদ্রিকের ফোনে কল আসে। যেহেতু এই দিকটায় গানের হালকা আওয়াজ আসছে, তাই সে একটু দূরে চলে যায় কথা বলতে।
আদ্রিক চলে গেলে ফারিদ সামিরের সঙ্গে কথা বলতে থাকে। কথার মাঝে হঠাৎ আদনান বলে উঠে,
— আমার জীবনে একটা বড় আফসোস আছে!
ফারিদ ভ্রু কুঁচকে বলে,
— তোর আবার জীবনে কী আফসোস?
আদনান বলে,
— দেশি-বিদেশি অনেক মেয়েকে ট্রাই করেছি, কিন্তু আমাদের দেশেই একটা জোশ মাল ছিল, যাকে ট্রাই করতে পারিনি!
ফারিদ অবাক হয়ে বলে,

— তুই কার কথা বলছিস?
আদনান হালকা হেসে উত্তর দেয়,
— কার কথা আবার! আদ্রিকের কাজিন অর্তিহার কথা বলছি! সেই এক জোশ মাল ছিল! আফসোস, তাকে ট্রাই করতে পারিনি!
এই কথা শুনে সামির আর ফারিদ দুজনেই চটে যায়।
ফারিদ রেগে বলে,
— চুপ! ও আদ্রিকের কাজিন মানে আমাদের বোন! একটা বাজে কথাও বলবি না!
সামিরও রাগে বলে,
— আদ্রিক তোকে মেরে ফেলবে!
ঠিক তখনই পেছন থেকে আদ্রিক বলে,
— কাকে মেরে ফেলবো?

আচমকা এই কথায় সামির আর ফারিদ দুজনেই চমকে উঠে ঘুরে তাকায়। আদনানও কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। তারপর ফারিদ হাসি দিয়ে সামাল দিতে গিয়ে বলে,
— আদনানকেই বলছি! ও বলছিলো চলে যাওয়ার জন্য!
সামির জিজ্ঞেস করে,
— তুই কখন এলি?
আদ্রিক হালকা করে বিয়ারের গ্লাসে চুমুক দিয়ে আদনানের দিকে তাকিয়ে বলে,
— তোরা যখন বলছিলি আমি আদনানকে মেরে ফেলবো তখনই!
সামির হেসে ফেলে,

— ওহ! আচ্ছা, কে কল করেছিলো?
— ইউকে এয়ারলাইনসের অফিস থেকে।
ফারিদ অবাক হয়ে বলে,
— ওরা কেন?
— আমি কাগজপত্র পাঠিয়েছিলাম। ওরা বলছে, সব কোয়ালিফাই করেছে। এখন শুধু জানতে চায়, আমি কবে থেকে জয়েন করবো।
আদনান অবাক হয়ে বলে,
— জয়েন করবি মানে? তুই ওখানে কেন? তোর তো এমিরেটসে জব ছিল!
আদ্রিক শান্তভাবে বলে,
— ছিল, এখন আর নেই। ছেড়ে দিয়েছি। এখন ইউকে এয়ারলাইনসে জয়েন করবো।
মেহজা চারপাশে ঘুরছে আর আরভিদকে খুঁজছে। হঠাৎ সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই সে একটা মেইডকে দেখতে পেয়ে দাঁড় করায়,
— এই, আমার পাতিদেবকে দেখেছো কোথাও?
— জ্বি! ঐদিকে একটা মেয়ের সাথে কথা বলছে!
মেহজা অবাক হয়ে বলে,

— কও কি!
এই কথা শুনে সে দ্রুত মেইডের দেখানো দিকে চলে যায়। গিয়ে দেখে আরভিদ দাঁড়িয়ে আছে এক মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে। মেয়েটি ওয়েস্টার্ন পোশাকে, দেখতে বেশ সুন্দরী। মুহূর্তেই মেহজার ভেতর রাগে ফুঁসে ওঠে। ইচ্ছে করে মেয়েটার চুল ছিঁড়ে ফেলে, আরভিদের উপরও রাগ হয়। মনটা কেমন ছটফট করতে থাকে। এক মুহূর্তে মনে হয় ভ্যা ভ্যা করে কাঁদে, পরক্ষণেই ভাবে,
— না! আমি কাঁদবো না। দেখাচ্ছি মজা মামুর পোয়া!
আরভিদের কাছে না গিয়ে সে সোজা চলে যায় স্টেজের দিকে। স্টেজের সামনে কয়েকজন মেয়ে নাচছে খালি জায়গায়। মেহজা গিয়ে সাউন্ড বক্সে বাজতে থাকা গানটা চেঞ্জ করে, সেট করে দেয়,
— বন্ধু তুমি কই কইরে
তারপর আবার স্টেজের সামনের জায়গাটায় গিয়ে গানের তালে নিজেই নাচতে শুরু করে।
এদিকে আরভিদ শিক্ষা মন্ত্রীর মেয়ে তৃণার সঙ্গে কথা বলছিল। হঠাৎ করেই কানে এমন একটস গানটা বাজতে শুরু করতেই তৃণা অবাক হয়ে বলে,

— আরভিদ, এটা কি গান বাজছে?
আরভিদ অ্যামবারেস ফিল করে।
— আমি দেখে আসছি।
তৃণা বলে,
— আমিও চলি আপনার সঙ্গে।
দুজনে এগিয়ে আসে স্টেজের দিকে। সামনে এসে দেখে, মেহজা গানের তালে তালে নাচছে! সবাই তখন ওখানে এসে জমে গেছে অতিথিরা, কারদার বাড়ির সব সদস্য।
সাউন্ড বক্সে তখনও গান বাজছে,

এক নজর না দেখিলে বন্ধু, দুনিয়া আন্ধার হয়
এক নজর না দেখিলে বন্ধু, দুনিয়া আন্ধার হয়
পাশে তোমায় না পাইলে বন্ধু,দম যেন মোর যায়
ও বন্ধু তুমি কই কই রে
এ প্রাণও বুঝি যায় রে
ও বন্ধু তুমি কই কই রে
এ প্রাণও বুঝি যায় রে
মেহজা গোল হয়ে ঘুরছে, নাচছে। হঠাৎ গান বন্ধ হয়ে যায়। মেহজা থেমে গিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। তখনই সামনে এসে দাঁড়ান আভীর কারদার। রাগে কাঁপছেন। মেহজা অবাক হয়ে তাকায়।
তিনি বলে ওঠেন,

— তোমার হয়তো নিজের কোনো সম্মান নেই! কিন্তু কারদার বাড়ির বউ হয়ে, এভাবে নর্তকীর মতো নেমে সম্মান নষ্ট করার অধিকার তোমার নেই!
বলেই তিনি রেগে গিয়ে মেহজাকে থাপ্পড় মারার জন্য হাত তোলে। কিন্তু সেই হাতটা হঠাৎ থেমে যায়, মাথায় কিছু ঠেকে গেছে। তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেন, তার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরভিদ!আরভিদের চোখে আগুন, ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে রাগে। এই দৃশ্য দেখে পুরো অনুষ্ঠান স্তব্ধ। কেউ কল্পনাও করেনি এমন কিছু হবে। এমনকি মেহজাও হতবাক।
আরভিদ বলে,

— মারো থাপ্পড়! যদি আমার বউয়ের গালে হাত পড়ে, আমি সাথে সাথেই গুলি করে দেবো!
আভীর বিস্ময়ে বলে,
— তুমি তোমার বাবার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়েছো? কার জন্য? যে মেয়ে তোমার বউ হয়ে এত মানুষজনের সামনে নেচে তোমার সম্মান মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে?
আরভিদ দৃঢ় গলায় বলে,
— সেটা আমি দেখবো! কিন্তু আমার বউয়ের গায়ে হাত তোলার অধিকার তোমার নেই! আর আমি তোমাকে সেই সাহস দেইনি!
আফির দ্রুত এসে আভীরের তোলা হাতটা নামিয়ে নেয়।

— ভাইয়া, অনুষ্ঠানে অনেক নেতা-মন্ত্রী আছেন। সবাই দেখছে। শান্ত হও!
আরভিদ বন্দুক সরিয়ে নেয়। আভীর তখনো রেগে বলেন,
— এই মেয়েকে আমি এক মুহূর্তও আমার বাড়িতে থাকতে দেবো না!
আরভিদ ও রাগি স্বরে বলে,
— এই বাড়ি তোমার না! দাদান এই বাড়ি আমার আর আদ্রিকের নামে লিখে দিয়ে গেছেন। কিন্তু তারপরও, আমি নিজেই আমার বউকে আর এই বাড়িতে রাখবো না!
এই কথা শুনে মেহজা কেঁপে ওঠে। তবে কি আরভিদ তাকে তাড়িয়ে দিবে?
তখনি আরভিদ মেহজার হাত ধরে বলে,
— আমি মেহুকে নিয়ে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি!
সবাই তখন হতবাক। আফির আস্তে বলে,
— আরভিদ এসব কি বলছো! ভাইয়া রেগে…
আরভিদ থামিয়ে দেয়,

— রেগে বলুক, চিৎকার করুক, আমার বউকে অপমান করেছে! যেই বাড়িতে আমার বউকে সম্মান দেওয়া হয় না, সেখানে আমি থাকতে চাই না!
এই বলে আরভিদ মেহজার হাত শক্ত করে ধরে ছাদ চলে যায়। মেহজার শরীর কাঁপছে। এটা কি ভয়, না অন্য কোনো কারণে, সেটা বুঝতে পারছে না।
আরভিদ রুমে ঢুকে মেহজার হাত ছেড়ে দেয়। কাভার্ড খুলে নিজের আর মেহজার জামা-কাপড় গুছিয়ে লাগেজে ভরে। একবারও মেহজার দিকে তাকায় না।
মেহজা সাহস করে কিছু বলতে পারছে না।আরভিদের চোখ লাল, মুখ শক্ত।
লাগেজ গুছিয়ে বের হতে গেলে দরজার সামনে এসে দাঁড়ান আভীর কারদার, পাশে তাহিয়া ও আফির।
তাহিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলেন,

— কোথায় যাচ্ছো? আমাদের ছেড়ে?
আরভিদ সোজা চোখে বলে,
— তোমাদের শান্তি দিয়ে, আমি শান্তি নিয়ে চলে যাচ্ছি।
আভীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন,
— তুমি সত্যিই চলে যাবে?
— হ্যাঁ।
আফির বলেন,
— বাড়ি ছেড়ে যাওয়া কোনো সমাধান না আরভিদ!
আরভিদ বলে,

— রাইট নাও আমার কাছে এটাই সবকিছুর সমাধান লাগছে!
আভীর গম্ভীর স্বরে বলেন,
— কী করলে তুমি আমাদের ছেড়ে যাবে না? আমি তোমার বউয়ের কাছে মাফ চাইবো?
আরভিদ বলে,
— দরকার নেই। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা এখানে আর থাকবো না।
আভীর এবার মেহজার দিকে তাকিয়ে বলেন,
— আমি অনুতপ্ত আমার করা আচরণে। হাত তুলতে গিয়েছিলাম, সেটা একদমই উচিত হয়নি। ক্ষমা করে দাও?
মেহজা আরভিদের দিকে তাকায়, সে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।
আভীর আবার বলেন,

— ঠিক আছে, আমি হাত জোর…
এই সময় আরভিদ তার হাত থামিয়ে দিয়ে বলে,
— হাত জোর করতে হবে না।
আফির বলেন
— ভাইয়া তো ক্ষমা চেয়েছে! এখন অন্তত লাগেজটা রাখো।
আরভিদ লাগেজ ফেলে দেয়। আভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে একবার মেহজার, তারপর আরভিদের দিকে তাকিয়ে চলে যান। সাথে চলে যান তাহিয়া আর আফিরও।
উনারা যেতেই আরভিদ মেহজার হাত ছেড়ে রুম থেকে বের হয়ে যেতে নিলে মেহজা ডাকে,
— শুনুন?
আরভিদ ঘুরে তাকায়। চোখ-মুখ শক্ত করে বলে,
— তুই শুনিস আমার কথা?

মেহজা চোখ নামিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে। কাঁদতে ইচ্ছে করছে। আরভিদকে এমন রাগী অবস্থায় কখনো দেখেনি। সে আবার ডাক দেয়। কিন্তু আরভিদ আর থামে না। পেছন থেকে অনেকবার ডাকে, তবু আরভিদ কোনো উত্তর না দিয়েই সেখান থেকে চলে যায়।
রাত তখন প্রায় ১২টা। ঘর অন্ধকার। একটা চেয়ারে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বসে আছে আদনান। চোখেও কাপড় বাঁধা। সেই ১৫ মিনিট ধরে চিৎকার করে যাচ্ছে, গালাগাল দিচ্ছে। কারণ ১৫ মিনিট আগেই চার-পাঁচজন মিলে তাকে তার বাড়ির সামনে থেকে চোখ-মুখ বেঁধে জোর করে গাড়িতে তুলে এনেছে এখানে। এরপর তাকে চেয়ারে বেঁধে মুখের কাপড়টা খুলে দিয়ে সবাই চলে গেছে। তখন থেকেই আদনান চিৎকার করে যাচ্ছে।
আদনান রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,

— এই! কোথায় গেছিস তোরা? আমাকে বেঁধে রেখে চলে গেছিস কেন? আমার হাত খুল! ভাল হবে না বলছি! আমার চোখ খুল!
এই সময় হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ হয়। ঘরে ঢোকে তিনজন। একজন সাদা শার্ট পরা পুরুষ, তার পেছনে দুই তরুণ। ওদের পায়ের শব্দে আদনান আবার চিৎকার শুরু করে।
— এই! আমাকে এখানে কেন এনেছিস? মুক্তিপণ চাইতে? বল, কত টাকা লাগবে?
সাদা শার্ট পরা পুরুষটি আদনানের বাঁ পায়ের ওপর ডান পা রেখে একটু নিচু হয়ে তার কানে ফিসফিস করে বলে,
— তোর জানটাই চাই মুক্তিপণ হিসেবে!
লোকটার কণ্ঠস্বর শুনে আদনান থমকে যায়। সে তৎক্ষণাৎ কণ্ঠটা চিনে ফেলে।
আদনান আশ্চর্য হয়ে বলে,

— আদ্রিক?
আদ্রিক এবার আদনানের চোখে বাঁধা কাপড়টা খুলে চেয়ারে বসে পড়ে। অনেকক্ষণ চোখ বাঁধা থাকায় প্রথমে সব ঝাপসা দেখায়। তারপর একটু একটু করে চোখ সয়ে এলে সামনে বসা আদ্রিককে দেখে। আদ্রিকের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা দুইজনকে চিনে ফেলে মিরাজ আর সৌরভ। ওদের আগেও কয়েকবার আদ্রিকের সঙ্গে দেখেছিল।
— আদ্রিক! তুই এসেছিস! জানি না কোন কুত্তার বাচ্চা আমাকে কিডন্যাপ করলো! চল এখন হাতটা খুলে দে!
আদ্রিক ঠাণ্ডা গলায় বলে,

— সে তো তোর সামনেই বসে আছে।
আদনান হতভম্ব বলে,
— কি বলছিস তুই! তুই আমাকে কিডন্যাপ করাবি কেন? নিশ্চয়ই মজা করছিস! সামির আর ফারিদও আছে তোর সাথে, তাই না?
আদ্রিক এবার মিরাজের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। মিরাজ দ্রুত পাশে রাখা একটা ছুড়ি এনে আদ্রিকের হাতে দেয়। এটা দেখে আদনান ভয়ে সিঁটিয়ে যায়। আদ্রিক কিছুটা ঝুঁকে আদনানের দিকে এগিয়ে আসে। তার দুই চোখে এক ধরনের ভয়ানক শীতলতা আর সেই চোখ দুটো দেখে আদনানের শরীরটা হিম হয়ে যায়। চোখজোড়া এতটাই ঠাণ্ডা, এতটাই ফাঁপা, যেন কোনো প্রাণ নেই। আদনানের বুকের ভিতরটা কেঁপে ওঠে। শীতল ঘাম ছুটে যায় কপাল বেয়ে।
আদনান কাঁপা কণ্ঠে বলে,

— আ… আদ্রিক…
আদ্রিক ঠাণ্ডা গলায় বলে,
— দেশে-বিদেশে বহু মেয়ে ট্রাই করেছিস! কিন্তু হুরদের ট্রাই করা হয়নি! এখন উপরে গিয়ে হুরদের ট্রাই কর!
আদনান বিভ্রান্ত হয়ে বলে,
— কি… কি বলছিস তুই!
— তুইই তো বলেছিলি দেশে বিদেশে অনেক মেয়ে ট্রাই করেছিস! কিন্তু অর্তির মতো সুন্দরীকে ট্রাই করতে পারিস নি! কিন্তু আমার মতে, তুই সব মেয়েই ট্রাই করেছিস, এখন হুরদের পালা!
আদনান নরম হয়ে বলে,
— আদ্রিক, আমার ভুল হয়ে গেছে!
— ভুল না, এটা পাপ! আমার বউয়ের দিকে তাকানো, ওর নাম ঠোঁটে এনে কল্পনায় বাজে চিন্তা করা! ওকে মাল বলা!

— বউ?
— তিন কবুল পড়েছি ওর নামে! ও আমার সন্তানের মা হতে যাচ্ছে!
আদনান বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। যেন কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারছে না।
আদ্রিক আবার বলে,
— বিয়েটা যদি নাও হতো, তাও তোর ওর দিকে তাকানো ঠিক হয়নি! ও শুধু আমার! ওকে আমি দেখবো, আমি ছুবো! অর্তির সবকিছু আমার! শুরু আমার, শেষও আমার! এর মাঝে কেউ থাকবে না!
— আদ্রিক, আমি জানতাম না ও তোর বউ! আমি তো ভেবেছিলাম কিছুদিনের জন্য তোর অ্যাট্রাকশন ছিল! তুই ওকে ছেড়ে দিয়েছিস। তাই…
আদ্রিক এক ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করে,
— তাই তুই আমার অর্তিজানকে ছোঁয়ার ইচ্ছে করবি, বাস্টার্ড?
আদনান ভীত গলায় বলে,
— ভুল হয়ে গেছে আদ্রিক! প্রথম ও শেষবারের মতো আমাকে মাফ করে দে!
আদ্রিক হতাশের কন্ঠে বলে,

— আমি বুঝতে পারি না, কেন আমার কাছের মানুষগুলোই আমাকে সবচেয়ে বেশি হার্ট করে, আমাকে হতাশ করে? যাদের আমি আপন ভাবি, তারাই কেন বারবার আমার বিশ্বাস ভেঙে দেয়? আর তুই তো জানিস, আদ্রিকের ব্যাকগ্রাউন্ডে ক্ষমা বলতে কিছু নেই। কেউ যদি আদ্রিকের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, তার বিপক্ষে যায়, কিংবা আদ্রিককে কষ্ট দেয় তাদের কাউকেই আমি জীবিত রাখিনি! মাফ করা তো দূর! তারা যতই আমার কাছের হোক না কেন। আদ্রিক কে হার্ট করলে আদ্রিকও তাকে হার্ট করে। আদ্রিক কখনও নিজের উপর অন্যায় সহ্য করে না।
আদনান আকুতি করে বলে,

— তুই বললে আমি অর্তির কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইবো!
— তোর কি মনে হয় অর্তি তোকে ক্ষমা করে দেবে?
— হ্যাঁ!
আদ্রিক ঠাণ্ডা হেসে বলে,
— একদম ঠিক বলেছিস! অর্তি তোকে নিশ্চয়ই ক্ষমা করে দেবে। কিন্তু তোকে ক্ষমা করে কি অর্তি নিজে বাঁচতে পারবে? দেখ, আমাকে হার্ট করা মানুষকে ক্ষমা করে অর্তি যদি উদারতা দেখাতে চায়, তাহলে অর্তি আমাকে হার্ট করে ফেলবে। আর যে আমাকে হার্ট করে, আমি তাকে শেষ করে দেই! কিন্তু সমস্যা হলো, যদি সেই মানুষটা অর্তি হয় তাহলে আমি যদি অর্তিকে শেষ করতে যাই, শেষে আমিই হার্ট হবো। ওহ নো! তাহলে তুই ঘুরে ফিরে আবার আমাকেই হার্ট করতে চাচ্ছিস? নাহ ব্রো! তুই বাঁচলে আবার আমাকেই হার্ট হতে হবে! সো তোর আর বাঁচা হচ্ছে না!

— আমি তোর বন্ধু! বন্ধুত্বের খাতিরে আমাকে ছেড়ে দে!
— এইজন্যই তো ছাড়তে পারছি না! তুই বন্ধু হয়ে শত্রুর মতো কাজ করেছিস!
আদনানের চোখে পানি এসে পড়ে,
— তোর একবারও মনে পড়ছে না, আমাদের বন্ধুত্বের মুহূর্তগুলো?
— পড়ছে! মনে পড়ছে! কিন্তু তোর জন্য কষ্ট হচ্ছে না। বরং খুশি লাগছে, আমার অর্তির দিকে তাকানো একটা বাস্টার্ড দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে!
আদ্রিক ছুড়ির ধারালো অংশে আঙুল ঘুরিয়ে বলে,
— শোন, তোকে কিভাবে মারবো শুনে নে। যদিও সবাইকে একইভাবে মারি, কারণ সবার অপরাধ একই। তবুও তোকে বলে দিচ্ছি, কারণ তুই জানিস না আমি কিভাবে প্রাণটা বের করে নেই!
আদনান আতঙ্কে উঠে,

— আদ্রিক প্লিজ!
আদ্রিক ঠাণ্ডা কণ্ঠে বলে,
— প্রথমে তোর চোখ উপড়ে ফেলবো কারণ এই চোখই তো প্রথম দোষ করেছিল! তারপর তোর ঠোঁট কেটে ফেলবো, এগুলো দিয়েই অর্তিকে মাল বলেছিস বলেছিস! শেষে তোর মাথাটা ভেঙে ফেলবো, এই মাথাতেই তো ঘুরেছে অশ্লীল কল্পনা!
আদনান কান্না করে দেয়,
— না! তুই এটা করতে পারিস না! আমি তো তোর বন্ধু। সেই কলেজ লাইফ থেকে, আমরা একসাথে ছিলাম!
— চুপ! শব্দ করিস না! আমাকে তোকে হেল্প করতে দে!
— হেল্প?

— শুন, তুই জীবনে কখনো ভালো কাজ করিসনি যে জান্নাতে যাবি! আর জান্নাতে না গেলে হুরও পাবি না! তাই তোর জীবনের সব পাপ আমি আজকে মুছে ফেলবো! তোকে এমন মৃত্যু দেবো, যে কোনো পাপের শাস্তি বাকি থাকবে না! এখানে তোর চোখগুলো উপড়ে ফেলবো, তারপর ডিরেক্ট জান্নাতে চোখ খুলবি! তোর আগেও বহু অপরিচিতদের আমি হেল্প করেছি জান্নাতের হুরদের পাওয়ার জন্য! আর তুই তো আমার ফ্রেন্ড! তোকে আমি হেল্প করবো না এটা আবার হয়?

আদ্রিক তার স্বভাবসুলভ ঠান্ডা হাসিটা ঠোঁটের কোনে টেনে ছুরিটা সোজা ঢুকিয়ে দেয় আদনানের ডান চোখে। ছুরির ফলা চোখ ভেদ করে ঢুকে যায় ভেতরে। তীব্র যন্ত্রণায় আদনান বিকট চিৎকার করে ওঠে। এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে এবার আর মিরাজ আর সৌরভভয় পায় না। তাদের সয়ে গেছে রোজকার এই দৃশ্য দেখতে দেখতে। অভ্যস্ত হয়ে গেছে চোখ দুটো।আদনানকে দেখে আদ্রিকের মুখে ফুটে ওঠে এক অদ্ভুত তৃপ্তির হাসি। ধীরে ধীরে, সে তার বলা প্রকিয়া অনুযায়ী আদনানকে ক্ষত দিতে থাকে।

যেমনটা সে করেছিল তাহমিদের সঙ্গে। শুধু তাহমিদই নয়, আরও অনেককেই সে এই একই কায়দায় হত্যা করেছে। প্রতিটি খুন যেন একে অপরের প্রতিচ্ছবি। প্রথমে চোখ দুটো উপড়ে ফেলে দেয়। রক্তে তার হাত ভেসে গেছে। আদ্রিক এবার আদনানের ঠোঁট কেটে নেয়। তারপর মিরাজের দিকে তাকায়। মিরাজের হাতে হাতুড়িটা। আদ্রিক সেটা নিয়ে নেয়। প্রায় ১৫-২০ সেকেন্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে সে আদনানকে দেখতে থাকে।

আদনান তখনো জীবিত, তবে গোঙাচ্ছে, ছটফট করছে, যন্ত্রণায় কাঁপছে। হঠাৎই আদ্রিক হাতুড়িটা দিয়ে একেবারে জোরে আদনানের মাথায় বাড়ি মারে। প্রচণ্ড জোরে বাড়ি খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আদনান চেয়ার থেকে উলটে পড়ে যায়। মাথা ফেটে তার মগজ ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে। এবং সাথে সাথেই আদনানের যন্ত্রণায় কাতরানো দেহটা শান্ত হয়ে যায়। বের হয়ে যায় দেহ থেকে প্রাণ টা। দৃশ্যটা এতটাই ভয়ংকর আর বীভৎস ছিল যে মিরাজ আর সৌরভ চোখ বন্ধ করে ফেলে তারা আর সহ্য করতে পারে না।
আদ্রিক ঠায় তাকিয়ে থাকে আদনানের নিথর দেহের দিকে। তারপর চোখ ঘুরিয়ে মাটিতে ছড়িয়ে থাকা মগজের দিকে তাকায়। তার ঠোঁটের কোণে টেনে ওঠে এক অদ্ভুত, সাইকোপ্যাথিক হাসি। এরপর সে উঠে দাঁড়ায়, হাতুড়িটা ছুড়ে ফেলে দেয় দূরে, আর দু’হাত উপরে তুলে বলে,

—দ্যাটস মাই রিজাইন!
এটা খুনের পর এটাই আদ্রিকের কথা। এই কথাটা বলেই সে পাশের বেসিনের দিকে এগিয়ে যায়। হাত ধুতে থাকে। রক্তমাখা আঙুলগুলো পরিষ্কার করতে থাকে। আজকেও শার্টে রক্তের ছোপ লেগে গেছে। মিরাজ আর সৌরভ শার্ট আর তোয়ালে হাতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খায়, আদ্রিক প্রতিবার কাউকে মারার জন্য আসলে কেন সাদা শার্ট পরে আসে? রক্ত তো স্পষ্ট দেখা যায় সাদা কাপড়ে!
তাদের মনের কথাটা আদ্রিক ধরে ফেলে। সে সৌরভের কাছ থেকে তোয়ালেটা নিয়ে হাত মুছতে মুছতে বলে,
— সাদা শার্টে দাগ স্পষ্ট থাকে। প্রতিটা রক্তমাখা শার্ট আমার কাছে হিসাব দেয়, আমি অর্তিজানের দিকে তাকানো মানুষটাকে কেমন শাস্তি দিয়েছি।

হাত মুছে শেষ করে তোয়ালেটা ফিরিয়ে দেয় সৌরভকে, আর মিরাজের কাছ থেকে একটা নতুন সাদা শার্ট নিয়ে পড়ে নেয়। এরপর আদনানের দেহের দিকে একবার ইশারা করে। যেন বোঝায়, ওটার ব্যবস্থা করে ফেলো। তারপর শব্দ না করে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়।
রাত তখন আনুমানিক দুইটা কিংবা আড়াইটা বাজে। আদ্রিক ফিরে আসে কারদার ম্যানরে। গ্যারেজে গাড়ি পার্ক করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ থেমে যায়। পেছন ফিরে তাকায়, তারপর ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে বাগানের দিকে এগোয়। বাগানে এসে চোখ পড়ে চাঁদের ম্লান আলোয় দোলনায় বসে থাকা আরভিদের উপর। চুপচাপ বসে আছে, তার দৃষ্টি দূরে, একেবারে উদাসীন।
আদ্রিক পাশে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,

— এখানে কি করছিস?
আরভিদ একবার তাকায় তার দিকে, তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় সামনে। শান্ত গলায় বলে,
— ঘরের ভেতরের এই প্রতিদিনের কোলাহল আর ভালো লাগছে না। একটু একা থাকতে এসেছি।
আদ্রিক এবার একটু নরম কণ্ঠে বলে,
— চাচুর সাথে মিসবিহেভ করায় আপসেট?
আরভিদ এবার সোজা হয়ে তাকায় আদ্রিকের দিকে। দৃঢ় গলায় বলে,
— না! ড্যাড আজকে মেহুকে যা বলেছে আর ওর ওপর হাত তুলতে চেয়েছে সেই হিসেবে আমি একদম ঠিক করেছি! ড্যাড সব সময় কারদার বাড়ির সম্মানের কথা ভাবে, কিন্তু আমার বউয়ের সম্মান কি তার মনে থাকে না? আমি যা করেছি !
আদ্রিক কিছুক্ষণ চুপ করে আরভিদের দিকে তাকিয়ে রইল। আরভিদের মুখে আবার রাগ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

— চল, কার রেসিং করি!
আরভিদ আদ্রিকের দিকে বিরক্ত আর অবাক চোখে তাকাল। তারপর চোখ ঘুরিয়ে বলে,
— ভালো লাগছে না!
— ভালো লাগবে! চল আমার সাথে! অনেক দিন হয়ে গেছে, আমরা কার রেসিং করিনি!
— আজকে না!
আদ্রিক হেসে বলে,
— আজকেই! আর গাড়িতে বিয়ারও আছে!

কথাটা শুনে আরভিদ তাকায় আদ্রিকের দিকে। আদ্রিক মুচকি হাসি দিয়ে হ্যা সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। আরভিদ উঠে দাঁড়ায়। তারপর দুজনেই গ্যারেজে গিয়ে স্পোর্টস কার বের করে। আরভিদের গাড়ির মডেল লাম্বারগিনি, আর আদ্রিকের গাড়ির মডেল ফেরারি। দুজনেই নিজেদের গাড়িতে চড়ে বসে। দরোয়ান বড় গেট খুলতেই তারা গাড়ি স্টার্ট করে দ্রুত বাইরে বেরিয়ে পড়ে। দুজনের গাড়ির গতি বেশ দ্রুত। প্রথমে আদ্রিক আরভিদের গাড়ি ক্রাস করে সামনে চলে যায়।

প্রায় তিন মিনিট পর আরভিদের গাড়ি আদ্রিককে ওভারটেক করে এগিয়ে যায়। কিন্তু আদ্রিকও ফুল স্পিডে গাড়ি চালিয়ে এগিয়ে আসে। এখন দুজনের গাড়ির গতি প্রায় সমান সমান। আসলে আজকের এই রেসিং তাদের জন্য নতুন কিছু নয়! কলেজ লাইফ থেকেই তারা দুজনেই কার রেসিং করে আসছে। যদিও আদ্রিক তখন ইউকে-তে ছিল, কিন্তু যখনই দেশে আসতো দুজনে রাতে বেলায় কার রেসিং এর জন্য বেড়িয়ে পড়তো । কেউ কার থেকে কম নয়, দুজনেই একে অপরের সমান।

এই রেসে তারা একদম এক্সপার্ট। তাদের গাড়ি এখন একসাথে পাশাপাশি চলছে। আদ্রিক তার সাইডের গ্লাস নামিয়ে হালকা হাসি দিয়ে আরভিদের দিকে তাকায়। আরভিদও তাকায়। তারপর তারা দুজন একসাথে সামনে একটা বিশাল জায়গায় এসে কোনো সিগনাল ছাড়াই দুটো গাড়ি একসাথে ডু ডোনাট স্টান্ট শুরু করে। দুই গাড়ি মুখোমুখি, কাছাকাছি থেকে একসাথে ৩৬০ ডিগ্রি কোণে ঘুরতে থাকে। চারপাশে ধোঁয়া, চাকার ঘর্ষণে বালি ছিটকে যাচ্ছে। একটা নিখুঁত সিনক্রোনাইজড পারফর্মেন্স। যেন রেস নয়, কোনো শো চলছে।
একসময় তারা গাড়ি থামায়। গাড়ি দুটো ঠিক মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, খুব কাছে। এরপর আদ্রিক নেমে আসে, হাতে দুই বোতল বিয়ার। এক বোতল আরভিদের দিকে বাড়িয়ে দেয়। আরভিদ সেটা নিয়ে তার ব্ল্যাক গাড়ির সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ায়, আর আদ্রিক চড়ে বসে তার লাল ফেরারির ওপর। আদ্রিক অল্প অল্প করে খাচ্ছে আর আরভিদকে দেখছে। আরভিদ টেনে খাচ্ছে।

চার ভাগের তিন ভাগ বিয়ার আরভিদ বোতলটা ছুঁড়ে দূরে ফেলে দেয়। আদ্রিক বিয়ার খেতে খেতেই পকেট থেকে সিগারেট আর লাইটার বের করে বাড়িয়ে দেয় আরভিদকে। আরভিদ এগিয়ে এসে সিগারেট ঠোঁটে রেখে লাইটার দিয়ে আগুন ধরায়, তারপর লাইটার ফেরত দেয়। তারপর আবার আগের জায়গায় এসে গাড়িতে হেলান সিগারেট টানতে থাকে।
আদ্রিক লাইটার পকেটে রেখে বলে,

— তুই কি তোর বউয়ের সাথে ঝগড়া করেছিস?
আরভিদ তাকায়। আদ্রিক বলে,
— তোর রাগ দেখে তো মনে হচ্ছে না, এই রাগ চাচুর উপর!
আরভিদ বলে,
— ঝগড়া করিনি!
আদ্রিক বলে,
— তাহলে রাগ করে চলে এসেছিস, না হলে এখন বউয়ের কাছে থাকতিস!
আরভিদ কিছু বলে না, শুধু সিগারেট টানতে থাকে। হঠাৎ তার চোখ পড়ে রাস্তার পাশে থাকা ঝোপের ওপর। সিগারেট খেতে খেতে সে ঝোপের দিকে এগিয়ে যায়। আদ্রিক তাকিয়ে দেখে আরভিদের যাওয়ার দিকে, চোখে প্রশ্ন ভর করে। আরভিদ ঝোপের কাছে এসে ঠোঁটে হাসি ফোটায়, তারপর সিগারেট ফেলে ঝোপের চম্পা ফুল গুলো ছিড়ে দেয়।
ততক্ষণে আদ্রিক এসে তার পেছনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,

— এগুলো কেন ছিঁড়ছিস?
আরভিদ হেসে বলে,
— মেহুর পছন্দের ফুল!
— তুই না বউয়ের সাথে রাগ করে চলে এসেছিস!
আরভিদ কয়েকটা ফুল ছিঁড়ে বিরক্ত কণ্ঠে বলে,
— রাগ করেছি, আলাদা হয়ে যাইনি!
আরভিদ ফুলগুলো শেষ পর্যন্ত ছিঁড়ে খুব যত্নে দুই হাতের তালুতে রেখে বলে,
— বাড়ি চল সকাল হয়ে যাচ্ছে।

সত্যিই ধীরে ধীরে রাতের অন্ধকারে ঢাকা আকাশ আলোকিত হচ্ছে, ভোরের আলো দেখা দিচ্ছে। আদ্রিক মাথা নাড়ে। তারা দুজনেই গাড়িতে বসে বাড়ি ফেরে। ফিরে আসতে আসতেই সকাল ছয়টা বাজে। সবাই এসে নিজ নিজ রুমে চলে যায়। আরভিদ রুমে ঢুকতেই দেখে মেহজা বেডের এক প্রান্তে বেঁকে ঘুমিয়ে আছে। গায়ে হলুদের শাড়ি, মুখে সাজ। আরভিদ বুঝতে পারে, মেহজা তার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে গেছে।
আরভিদ ফুলগুলো পাশে টেবিলে রেখে আলতো করে মেহজাকে কোলে তুলে বেডের মাঝখানে এনে শুইয়ে দেয়। শরীরে কম্বল টেনে দেয়। তারপর কাভার্ড থেকে টিশার্ট আর টাউজার বের করে রাতের পাঞ্জাবি বদলে নেয়। সাইড টেবিলের কাছে এসে একটা ফুল তুলে মেহজার হাতের দিকে তাকায়, তারপর মুচকি হাসি দিয়ে কাভার্ডের ড্রয়ারে খুঁজতে থাকে সুই আর সুতা। খুব সাবধানে কাজ করে যেন মেহজার ঘুম না ভাঙে। অনেক খোঁজাখুঁজি করার পরও পায় না।

শেষে দরজা খুলে রুম থেকে বের হয়। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতেই দেখে নাজনীন কারদার কিচেন থেকে বের হচ্ছেন। আরভিদ তাকে ডাক দেয়। নাজনীন এগিয়ে আসে, হাতে পানি বোতল। পানি শেষ হয়ে যাওয়ায় কিচেনে পানি নিতে এসেছিল। তার মুখ দেখে বোঝা যায় সে একদম ঘুমোয়নি! অবশ্য ঘুমাবেই বা কিভাবে? রাতে বাড়িতে যে এত তামাশা হয়েছে!
আরভিদ নাজনীনকে বলে,
— মিমি, তোমার কাছে কি সুই সুতা আছে?
নাজনীন অবাক হয়ে বলে,
— আছে, কিন্তু তুমি সেটা দিয়ে কি করবে?
— একটু কাজ ছিলো, দাও তো!
— আচ্ছা, একটু অপেক্ষা করো, নিয়ে আসছি আমি।
এই বলে নাজনীন চলে যায় রুমে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ফিরে আসে। আরভিদকে সুই-সুঁতা দিয়ে বলে,
— এই নাও!
আরভিদ সেটা নিয়ে বলে,
— থ্যাংকস মিমি!

বলেই সিড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়। নাজনীন চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে থাকে, তারপর আবার রুমে চলে যায়। আরভিদ তার রুমে এসে দরজা লাগিয়ে বসে যায়। খুব মনোযোগ দিয়ে সুইয়ে সুতা পরায়, আর একে একে ফুলগুলো গাঁথে। ধীরে ধীরে সে একটা গাজরা তৈরি করে। এরপর আবার সুইয়ে সুতা ভরে দ্বিতীয় গাজরাটাও বানিয়ে ফেলে। দুইটা গাজরা সে পাশে রাখা সাইড টেবিলের ড্রয়ারে রেখে মেহজার পাশে এসে শুয়ে পড়ে। সারারাত না ঘুমানোর কারণে মাথা একটু ভার হয়ে আসে। মেহজার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।
সকাল তখন ৯ টা বাজে মেহজার ঘুম ভাঙে। চোখ খুলেই দেখে আরভিদ পাশে শুয়ে আছে। সে উঠে বসে দেখে নিজে বেডের মাঝখানে শুয়ে ছিলো, বুঝে যায় আরভিদকে তাকে এখানে শুইয়েছে। কিন্তু কখন এল সে? মেহজা তো রাতভর অপেক্ষা করছিলো তার জন্য! অপেক্ষা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে, টেরই পায়নি। এই কথা মনে হতেই মেহজার চোখে অভিমান ভর করে। কাল রাতে তার ডাক উপেক্ষা করে আরভিদ চলে গিয়েছিল। এই ভেবে অভিমানটা আরও বেড়ে যায়। মেহজা আরভিদকে ডিঙিয়ে বেড থেকে নামতে গেলে আরভিদ চোখ খোলে।
সে মেহজার দিকে তাকায়। মেহজা ভ্রুক্ষেপ না করে কাভার্ড থেকে টি-শার্ট আর প্লাজু বের করে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। প্রায় দশ মিনিট পর মেহজা ওয়াশরুম থেকে বের হয় পড়নে লাল টি-শার্ট ও প্লাজু, রাতের মেকআপও ধুয়ে ফেলেছে। মেহজা বেরিয়েই দেখে আরভিদ বেডে বসে আছে। হাতে থাকা শাড়িটা সোফায় রেখেই বের হওয়ার সময়ই আরভিদ ডেকে ওঠে,

— মেহু?
মেহজা ঘুরে তাকিয়ে অভিমানী কণ্ঠে বলে,
— এখন কেন ডাকছেন আমাকে? রাতে এতোবার ডাকার পরও একটাবার ফিরে তাকাননি আমার দিকে! আমাকে রেখে চলে গেছিলেন!
আরভিদ উঠে দাঁড়িয়ে মেহজার কাছে এগিয়ে এসে গালে হাত রেখে বলে,
— রাতে রাগ উঠেছিলো! তুই তো জানিস রাগলে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি না! রাগে বশে কিছু একটা বলে ফেলতাম! তাই চলে গেছিলাম!
মেহজা চোখ ঘুরিয়ে বলে,
— গেছিলেন তো আমার উপর রাগ করেই!
— হুম! তোর উপর রাগ করেই গেছিলাম! কিন্তু আমার রাগ উঠাটা একদম অকারণ ছিলো না!
মেহজা আরভিদের চোখে চোখ রেখে বলে,

— সব দোষ আমার তাই না?
আরভিদের কন্ঠে নরমের মাঝেও কিছুটা কড়া ছিলো,
— সব দোষ তোর না তবে সবচেয়ে বেশি তোর! কালকে তোর জায়গায় যদি অন্য কেউ থাকতো আমি নিজে তাকে জানে মেরে ফেলতাম কিন্তু তুই ছিলি!
মেহজার চোখে জল এসে পড়ে,
— মেরে ফেলেন! এমনিতেই কালকে মামা গালি দিয়েছে হাত তুলতে চেয়েছে! এখন আপনি মেরে ফেলেন!
আরভিদ মেহজার চোখের জল মুছে বলে,
— মেরে ফেলার হলে এতোক্ষণ বাঁচিয়ে রাখতাম না! কালকে ড্যাড যেমন অন্যায় করেছে তেমনি তুইও কম করিসনি! কালকে যে তামাশা হয়েছে সেটা এতো বছরে কখনো হয়নি! না কেউ করার সাহস পেয়েছে!

— সামান্য একটু নাচাতে….
— সামান্য না! তুই আমার বউ! আইনমন্ত্রী আরভিদ কারদারের বউ! কারদার বাড়ির বড় বউ! তুই কারদার বাড়ির সম্মান! তোর এভাবে এতো গুলো মানুষের সামনে নাচা সোভা পায় না!
মেহজা ঠোঁট ফুলিয়ে বলে,
— আপনার সাথে রাগ করে নাচতে গেছিলাম!
আরভিদ অবাক হয়ে বলে,
— আমার সাথে রাগ করে?
— হ্যা ঐ একটা হলুদ ওয়েস্টার্ন ড্রেস পড়া মেয়েটার সাথে কথা বলছিলেন তাই আমি ঐ গান ছেড়ে নাচছিলাম!
— তুই তৃণার কথা বলছিস?
— বাব্বাহ! নামও জানেন!
— শিক্ষামন্ত্রীর মেয়ে! আমাদের ইনভাইটেশনে অনুষ্ঠানে এসেছে! আমি জাস্ট সৌজন্যমূলক কথা বলছিলাম!
— হুহ্! সব হয়েছে আপনার জন্য! অথচ বকা দিচ্ছেন আমাকে! রাগি কারদার! শুধু রাগ ঝাড়ে!
আরভিদ আদরে কন্ঠে বলে,

— আমি তোর উপর রাগ ঝাড়ি?
মেহজা ঠোঁট উলটে বলে,
— হুম!
আরভিদ মেহজার কপালে চুমু দিয়ে বলে,
— মিথ্যুক একটা!
তারপর আবার বলে,
— মেহু, তোর ব্যাপারে কেউ বাজে কথা বললে আমি সহ্য করতে পারি না! আমার কষ্ট হয়।
— আচ্ছা আর নাচবো না!
— আমাকে না বলে কিছু করবি না!
মেহজা মুখ বাঁকিয়ে বলে,
— ভেবে দেখবো! এখন আমাকে ছাড়েন আমি যাবো!
— তোর জন্য একটা জিনিস এনেছি!
বলেই আরভিদ সাইড টেবিল থেকে গাজরা দুটো বের করে আনে এবং মেহজার সামনে ধরে। মেহজা চম্পা ফুলের গাজরা দেখে মুহূর্তেই মুখে হাসি ফোটে উঠে,

— চম্পা ফুল! আমার পছন্দের!
আরভিদ হেসে বলে,
— হুম!
— এগুলো কোথায় পেয়েছেন? হলুদ চম্পা তো দোকানে পাওয়া যায় না!
— দোকান থেকে আনিনি! গাছ থেকে ছিঁড়ে এনেছে! তারপর বাসায় এনে সুই আর সুঁতা দিয়ে তোর জন্য গাজরা বানিয়েছি!
মেহজা ফুল দেখে যতটা না খুশি হয়েছে, তার থেকেও বেশি খুশি হয়েছে এটা শুনে যে আরভিদ নিজের হাতে গাজরাগুলো বানিয়েছে। মেহজা হাত বাড়িয়ে বলে,
— নিন, পড়িয়ে দিন!
আরভিদ হেসে গাজরাগুলো মেহজার হাতে পড়িয়ে দেন। গাজরা পড়ানোর পরে মেহজা হাত নাড়িয়ে দেখে, হাসি ছড়িয়ে পড়ে তার মুখে। হঠাৎ করে আরভিদের জড়িয়ে ধরে বলে,

— অনেক অনেক থ্যাংকস রাগি কারদার!
আরভিদও হেসে মেহজাকে জড়িয়ে ধরে। মেহজা আরভিদকে ছেড়ে দিয়ে বলে,
— যাই, আমি সবাইকে দেখিয়ে আসি!
— শুন?
— বলেন?
— দেখিয়ে আবার রুমে এসে পড়বি! ড্যাডের রুমে যাওয়ার দরকার নেই! আর আজকে সারাদিন তুই আমার সাথে সাথে থাকবি!
— আচ্ছা।
— আর দাড়া ওড়না টা এনে দিচ্ছি!
আরভিদ কাভার্ড থেকে ওড়নাটা এনে দেয়। মেহজা ওড়না জড়িয়ে বের হয়ে আসে রুম থেকে। লিভিং রুমে আসতেই নাজনীন সরাসরি কারদারের সামনে পড়ে যায়। তিনি মেহজার হাতে থাকা গাজরাগুলো দেখে ভ্রু কুচকে তাকান।
মেহজা বুঝতে পেরে হেসে বলে,

— উনি নিজের হাতে বানিয়েছেন এগুলো!
নাজনীন কারদার বিরক্তি নিয়ে বলে,
— ও আচ্ছা! এজন্যই আমার কাছ থেকে সুই-সুতা নিয়েছিলো।
— হয়তো!
নাজনীন মুখ বাঁকিয়ে বলে,
— কেমন মেয়ে তুমি? শ্বশুরবাড়িতে টি-শার্ট আর প্লাজু পরে ঘুরে বেড়াও! লজ্জা করে না?
মেহজা নিচু গলায় বলে,
— উনি তো আমাকে কিছু বলেন না!
নাজনীন তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,
— আরভিদ বলবে কী করে? তাকে তো বশ করে রেখেছো! নাহলে কেউ পারে নিজের বাবার মাথায় বন্দুক ঠেকাতে?
মেহজা উত্তর দেয় না। মাথা নিচু করে রাখে। ঠিক তখনি পেছন থেকে আভীর কারদারের গম্ভীর কণ্ঠে বলেন,
— নাজনীন, যেতে দাও ওকে! আর যেন এই ধরনের কথা না শুনি!
নাজনীন ঘুরে তাকিয়ে বলে,
— ভাইয়া!
আভীর কারদার দৃঢ় গলায় বলেন,

— আমি যা বলেছি, তাই করো!
নাজনীন মেহজার দিকে একবার তাকিয়ে রুমের দিকে চলে গেল। আভীর কারদারও চলে যান।
মেহজা কিছুক্ষণ মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর চলে যায় কিচেনে। কিচেনে গিয়ে দেখে, তাহিয়া কারদার মেইডদের সঙ্গে কথা বলছেন।
তিনি রীতিমতো সবাইকে বকা দিচ্ছেন,
— রহিমা, তাড়াতাড়ি নাস্তা দাও! আর আসমা, বাড়ির প্রতিটা কোণা যেন ঝকঝকে থাকে। তোমরা এমন গা ছাড়া ভাব নিয়ে আছো কেন?
মেহজা সামনে গিয়ে ডাক দেয়,
— শাশুড়ি আম্মা?

তাহিয়া কারদার কোনো উত্তর দিলেন না, এমনকি তাকালেনও না। বরং মেইডদের উদ্দেশ্যে বলেন,
— কী হলো? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার মুখ দেখছো কেন? কাজে যাও!
ঠিক তখনি সেখানে কৌশলী আসে। সে এসেই বলে,
— আন্টি? এখনো নাস্তা রেডি হয়নি? আমার অরেঞ্জ জুস?
তাহিয়া মৃদু হেসে বলেন,
— এই তো মামনি, এক্ষুনি হয়ে যাচ্ছে! তোমার অরেঞ্জ জুসও রেডি!
মেহজা একবার কৌশালীর দিকে তাকিয়ে তারপর বলে,
— কিছু লাগবে? বলেন আমি সাহায্য করতে দেই!
তাহিয়া না তাকিয়ে বিরক্ত কন্ঠে বলেন,
— প্রয়োজন নেই!
তারপর কৌশলীর দিকে তাকিয়ে বলেন,

— মামনি, তুমি একবার মেকআপ আর্টিস্টদের ফোন করে জিজ্ঞেস করতে পারবে কখন বেরোবে ওরা?
কৌশলী হেসে বলে,
— অফকোর্স! পারব না কেন!
মেহজা কি বলবে খুজে পাচ্ছে। হঠাৎই গাজরাটা দেখে হালকা হেসে বলে,
— শাশুড়ি আম্মা দেখেন, আমি গাজরা পরেছি! উনি নিজে…
তাহিয়া মেহজার গুরুত্ব না দিয়ে আবার কৌশলীকে বলেন,
— কৌশলী, একটু রুমে এসো তো। অর্তির গয়নাগুলো গুছাতে হবে।
বলেই দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে গেলেন। কৌশলী মেহজার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,
— আসছি আন্টি!
এই বলে সেও চলে যায়। মেহজা কিচেনের মেইডদের দিকে তাকায়। ওরাও চুপচাপ তাকিয়ে আছে। মেহজা কিছু না বলে সোজা নিজের রুমে চলে আসে। রুমে ঢুকতেই আরভিদ মেহজাকে মন খারাপ করে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করে,

— কী হয়েছে মেহু? কেউ কিছু বলেছে?
মেহজা মাথা নাড়িয়ে না সূচক উত্তর দেয়।
আরভিদ তার কাছে এসে গালে হাত রেখে আদর করে বলে,
— তাহলে? কী হয়েছে বল?
মেহজা শান্ত গলায় বলে,
— কিছু না।
আরভিদ নরম গলায় বলে,
— কিছু তো হয়েছে। বল আমাকে।
মেহজা কিছু না বলে চুপ করে থাকে। আরভিদ একটু রেগে বলে,
— মেহু, আমাকে রাগাস না! বল, কী হয়েছে!
মেহজার চোখে পানি চলে আসে। ভেজা চোখে বলে,
— মামানি আমার সাথে রাগ করে আছেন। আমি অনেকবার ডেকেছিলাম, কোনো উত্তরই দেননি! তাকান ও নি আমার দিকে!
আরভিদ বুঝতে পারে তাহিয়া কারদার কালকের ব্যাপারটা মেহজার উপর ঝাড়ছেন। তারপরও মেহজাকে সেটা বুঝতে না দিয়ে হেসে বলে,

— এই ব্যাপার? এতে মন খারাপ করছিস? কিছুই হয়নি, বোকা মেহু! দেখবি, একটু পরেই মম তোকে আদর করে কাছে ডাকবে।
মেহজা মাথা নেড়ে বলে,
— হুম।
— এখন আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। কিন্তু তুই রুম থেকে বের হবি না।
— কোথায় যাচ্ছেন?
— একটু কাজ আছে। তুই রুমে থাক।
মেহজা ধীরে বলে,
— আচ্ছা।
আরভিদ রুম থেকে বের হয়ে সোজা চলে আসে আভীর কারদারদের রুমে। ভেতরে তাহিয়া কারদার, নাজনীন কারদার ও কৌশলী বসে আছে। তারা অর্তিহার বিয়েতে পরার গহনাগুলো দেখছিলেন। তাহিয়া বসে আছেন বেডের একপ্রান্তে, নাজনীন বেতের শেষ প্রান্তে, আর কৌশলী পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিল। এই সময় আরভিদ দরজায় কড়া নাড়িয়ে ভেতরে ঢোকে। তাহিয়া কারদার চোখ সরিয়ে নেন।
আরভিদ গম্ভীর গলায় কৌশলীকে বলে,

— একটু পরে এসো!
কৌশলী একবার তাহিয়া কারদারের দিকে তাকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। কৌশলী চলে যেতেই তাহিয়া কারদার বলেন,
— তোমার বউয়ের সঙ্গে আমি কথা বলিনি বলে এখন আবার আমাকে দিয়ে ওর কাছে মাফ চাওয়াতে এসেছো? যেমন কাল তোমার বাবা দিয়ে মাফ চাওয়ালে? নাকি আজ আমি মাফ না চাইলে, কালকের মতো আমার মাথায়ও বন্দুক ধরবে?
আরভিদ শান্ত গলায় বলে,
— এমন কিছুই করবো না। শুধু কথা বলতে এসেছি।
নাজনীন কারদার বলেন,
— তোমরা বরং কথা বলো, আমি পরে আসছি।
আরভিদ বলে,

— মিমি, তোমার সাথেও কথা আছে।
এই বলে সে এগিয়ে এসে তাহিয়া কারদারের সামনে দুই হাঁটু গেড়ে বসে। তাহিয়া কারদারের হাত ধরে নিজের মুঠোয় নিয়ে, কোমল কণ্ঠে বলে,
— মম, আমি ঝগড়া করতে আসিনি। শুধু মনের কথাগুলো বলতে এসেছি।
তাহিয়া কারদার তার এই কণ্ঠ শুনে কঠোরতা ধরে রাখতে পারেন না, কিন্তু পুরোপুরি নরমও হয়ে যান না। আরভিদ আবার বলতে শুরু করে,
— কাল মেহু অন্যায় করেছে, এটা আমি অস্বীকার করছি না। ওর ঐভাবে নাচা ঠিক হয়নি। কিন্তু ড্যাড চাইলে ওকে আলাদা করে বুঝাতে পারতো।
তাহিয়া কারদার রাগি কন্ঠে বলেন,
— তোমার বউ বুঝতে চায় কিছু? তোমার জেদী বউ যা বলে তাই করে!
আরভিদ শান্ত কণ্ঠে বলে,

— বুঝতে চায় না বলেই কি ড্যাড ওর তুলনা নর্তকীর সাথে করবে? সবার সামনে ওকে নর্তকী বলবে? ঐ নোংরা কথাটা বলার পরও আমার ছোট্ট বউটার গায়ে হাত তুলতে চাইবে?
তাহিয়া কারদার ছেলের দিকে তাকান। আরভিদের চোখে চিকচিক করছে জল। ছেলের এই অভিযোগ শুনে তার বুকটা ভারী হয়ে আসে।
আরভিদ আবার বলতে থাকে,
— মেহুর এই জেদ, এই বাচ্চামি আগে তো তোমরাই প্রশয় দিতে, আদর করতে। বাচ্চা মেয়ে বলে আমাকে বুঝ দিতে। তাহলে এখন কেন ওর প্রতিটা কাজেই তোমরা ভুল খুঁজে পাও? ও কি শুধু আমার বউ বলেই? কেন তোমরা আমাকে বুঝতে পারো না? তোমরা ওকে কষ্ট দিচ্ছো না, আমাকে দিচ্ছো! আমি কখনো পারব না তোমাদের বোঝাতে, মেহু আমার কাছে কতটা দামী। কিন্তু এটুকু বলতে পারি যে আমি কখনো নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করিনি, সে আমি আজ নিজেকে পাল্টাচ্ছি! আমার রাগকে কন্ট্রোলে আনছি! কেবল মেহুর জন্য! বিশ্বাস করো, মেহুর মুখ শুকিয়ে গেলে আমি সহ্য করতে পারি না! ওর চঞ্চলতা না দেখলে আমার শ্বাস আটকে আসে। কিন্তু আমার রাগেই ওর সেই চঞ্চলতা মরে যাবে, সেটাই আমি চাই না! এজন্য আমি নিজেকে বদলাচ্ছি।
আরভিদ থামে। তাহিয়া কারদার এখনো তাকিয়ে আছেন ছেলের দিকে। আরভিদের চোখে মুখে কষ্ট লেপ্টে আছে। আরভিদ আবার বলতে থাকে,

— মেহুর এমনিতেই বিয়েকে ভয় পায়। বিয়েতে নিজেকে চেঞ্জ করতে হয়, কম্প্রোমাইজ করতে হয়, ইচ্ছে-আহ্লাদ চাপা দিতে হয়। ও এই সবকিছুকে ভয় পায়। এখন যদি ও ছোট্ট ভুল করেও বুঝিয়ে বলার বদলে ধমক খায়, তাহলে তো ওর চঞ্চলতা, ওর আহ্লাদগুলো হারিয়ে যাবে! আর আমি সেটা চাই না। আমি আমার আহ্লাদী মেহুটাকে চোখে হারাই! আর রইল বন্দুক তাক করার কথা? আমি তখন ড্যাডের মুখে আমার বউয়ের প্রতি বলা নোংরা কথা সহ্য করতে পারিনি! নিজের বউকে নিয়ে এমন কথা সহ্য করব কীভাবে?
বলতে বলতে আরভিদের চোখ থেকে জল পড়ে। তাহিয়া কারদার অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ছোটবেলা থেকে এই ছেলেকে কখনো কাঁদতে দেখেননি! যা চেয়েছে, সবই তো দিয়েছেন! আর আজ সেই ছেলের চোখে জল! নাজনীন কারদারের চোখেও আবছা জল এসে পড়েছে আরভিদের কথায়।
আরভিদ এবার এগিয়ে আসে নাজনীন কারদারের দিকে। তার হাতটা ধরে কণ্ঠে ধরা গলায় বলে,

— মিমি, ছোট থেকে কখনো দেখিনি তুমি আমাকে আর আদ্রিককে আলাদা চোখে দেখেছো। সবসময়ই আমাকে নিজের ছেলের মতোই ভালোবেসেছো!
নাজনীন কারদার চোখে জল নিয়ে তার গালে হাত রেখে আদর করে বলেন,
— তুমি তো আমার ছেলেই! জন্ম না দিলেও, তুমি আমার ছেলেই!
— তাহলে তোমার ছেলে যার মাঝে খুশি খুঁজে পেয়েছে, তাকে আপন করে নিতে পারবে না? আমার মেহুকে মেনে নেওয়া খুব কষ্টকর? খুব কঠিন? বিশ্বাস করো, মেহু খারাপ না। একটু অবুঝ হয়তো। কিন্তু আমি শুধু সুখী থাকতে চাই তোমাদের সাথে, আমার মেহুকে নিয়ে।
আরভিদ থেমে যায়। একবার তাকায় নাজনীন কারদারের দিকে, তারপর তাহিয়া কারদারের দিকে। তিনি ফ্লোরে তাকিয়ে আছেন। এরপর আরভিদ উঠে দাঁড়ায়, চোখ মুছে বলে,

মোহশৃঙ্খল পর্ব ১৩

— আমার কথা শেষ! বাকিটা তোমাদের ইচ্ছা! আমি জোর করব না, আর না কখনো কিছু বলব!
এই বলে সে রুম থেকে বের হয়ে যায়। তাহিয়া কারদার ও নাজনীন কারদার দুজনেই চুপচাপ আরভিদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকেন। দুজনের মুখেই অদ্ভুত এক মলিনতা, আগের সেই কঠোরতা আর নেই। তাহিয়া কারদার হঠাৎ খেয়াল করেন, তার চোখেও জল!

মোহশৃঙ্খল পর্ব ১৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here