মোহশৃঙ্খল পর্ব ৮

মোহশৃঙ্খল পর্ব ৮
মাহা আয়মাত

রাতটা যেন শহরের জন্য একটু বাড়তি সাজপোশাক নিয়ে নেমেছে। ওপরে খোলা আকাশ, নিচে সেজে উঠেছে রেস্টুরেন্টের রুফটপ—ঝুলন্ত সোনালি ফেয়ারি লাইটে ছাওয়া, মাঝেমধ্যে নড়ছে কাচের লণ্ঠন, আর একপাশে বাজছে ডিজে বিট। গেস্ট রা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে কথা বলছে, হাসছে, গ্লাসে গ্লাসে ঠোকাঠুকি আর ক্যামেরার ফ্ল্যাশে মিলিয়ে যাচ্ছে আলোর ভেলায়।
এই ব্যস্ত ভিড়ের মাঝেই রুফটপের মেইন দরজাটা ঠেলে ঢোকে আদ্রিক। ব্ল্যাক শার্ট আর গ্রে কালারের স্যুট। সে এসেছে তার বন্ধু ফারিদের গার্লফ্রেন্ড ত্রিসার জন্মদিনে—পার্টির আয়োজনটাও করেছে ফারিদ নিজেই। আদ্রিককে দেখে ফারিদ এগিয়ে আসে, মুখে চওড়া হাসি।

— ভাই, তোর জন্যই তো অপেক্ষা করছিলাম! আমি ভাবছিলাম, ক্যাপ্টেন আজকে আর আসবে না!
আদ্রিক ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি এনে বলে,
— “বলেছিলাম আসব। আদ্রিক কারদার নিজের কথা রাখে—ইউ নো দ্যাট।“
— ইয়াহ!
বলে ফারিদ, হাতটা আদ্রিকের পিঠে রাখে।
— তা বার্থডে গার্ল কোথায়?
আদ্রিকের প্রশ্নে ফারিদ চারপাশে চোখ বুলায়, কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখে ফেলে তাকে।
ফারিদ ডাক দেয়,
— ত্রিসা! এইদিকে এসো!
ত্রিসা হাসিমুখে এগিয়ে আসে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— হাই আদ্রিক ভাইয়া!
আদ্রিক হাসে, সামনে বাড়িয়ে ধরে হাতে ধরা একটা ফুলের বুকে।
— হ্যাপি বার্থডে।
ত্রিসা বুকেটা হাতে নিয়ে বলে,
— থ্যাংকস!
আদ্রিক চারপাশে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
— সামির, আদনান এখনো আসেনি?
— এসেছে ভাই, ঐদিকে ওরা অনেকক্ষণ ধরেই অপেক্ষা করছে তোর জন্য।
আদ্রিক মাথা নাড়ে,
— আচ্ছা, ঠিক আছে। চল।
ত্রিসা হেসে বলে,
— হ্যাঁ, তোমরা যাও, তোমাদের ফ্রেন্ডদের সাথে দেখা করো। আমিও যাচ্ছি আমার ফ্রেন্ডদের কাছে।
ফারিদ আদুরে ভঙ্গিতে বলে,

— ওকে, বেবি।
ফারিদ ও আদ্রিক চলে যায় তাদের ফ্রেন্ড সামির আর আদনানের কাছে, আর ত্রিসা হেঁটে যায় নিজের ফ্রেন্ড সার্কেলের দিকে।
আদ্রিক ওদের কাছে পৌঁছাতেই সামির হেসে বলে,
— কি রে, এতো দেরি করে এলি? সেই কখন থেকে তোর নিয়ে অপেক্ষা করছি!
সামির হেসে গালি দেয়,
— ধুর, সালা!
সবাই হেসে ফেলে। ওরা সবাই কথা বলতে থাকে। এদিকে, ত্রিসা এসে পৌঁছায় ওর ফ্রেন্ড সার্কেলে, যেখানে চারজন মেয়ে অপেক্ষা করছিল। ত্রিসাকে দেখেই রুশা বলে ওঠে,
— ত্রিস, কোথায় ছিলি তুই?
ত্রিসা হেসে উত্তর দেয়,

— ফারিদের ফ্রেন্ড আদ্রিক ভাইয়াকে ওয়েলকাম করছিলাম।
ত্রিসার কথা শুনে রুশা ও লাম্মির দৃষ্টি চলে যায় তাদের পাশে বসে থাকা, পিঙ্ক গ্লিটার স্প্যাগেটি স্ট্র্যাপ সাইড-স্লিট মারমেইড ড্রেস পরা মেয়েটির দিকে। সে নিঃশব্দে ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিল। ওদের সার্কেলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় মেয়ে সে। ঠিক তখনই ত্রিসার ফোনে কল আসে, সে সরে গিয়ে কথা বলতে ব্যস্ত হয়।
এই ফাঁকে লাম্মি, পিঙ্ক ড্রেস পরিহিত মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলে,
— শায়রা, পার্টিতে আদ্রিক ভাইয়াও এসেছে।
শায়রা হালকা হাসে, গ্লাস নামিয়ে দাঁড়ায়,

— “আই নো, ও আসবে—এই জন্যেই তো আমি এসেছি!”
সে একটি ওয়েটারকে ডাক দিয়ে কিছু একটা কানে কানে বলে। কথার শেষে, রুশা নিজের পার্স থেকে টাকা বের করে হেসে ওয়েটারকে দিয়ে দেয়। ওয়েটার মাথা নেড়ে চলে যায়।
রুশা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,
— তুই ওই ওয়েটারকে কী বললি? আর টাকা দিলি কেন?
শায়রা রহস্যময় হাসি হেসে উত্তর দেয়,
— কাজের জন্য।
বলেই সে হেঁটে যেতে শুরু করে।
রুশা ডাকে,
— কোথায় যাচ্ছিস?
শায়রা কোনো উত্তর না দিয়ে চলে যায়। লাম্মি মুচকি হেসে বলে,

— ও আর কোথায় যাবে! আদ্রিক ভাইয়ার কাছেই তো। সেই লন্ডনে দেখা হওয়ার পর থেকে তো পিছু ছাড়ছে না!
রুশাও হেসে ফেলে,
— ঠিক বলেছিস!
এদিকে, আদ্রিক আর ওর বন্ধুরা কথা বলায় ব্যস্ত। ঠিক তখনই, এক ওয়েটার হঠাৎ করে আদ্রিকের গায়ে জুস ফেলে দেয়। আদ্রিক শান্ত দৃষ্টিতে তাকায় নিজের কাপড়ে, তারপর ওয়েটারের দিকে।
ফারিদ রেগে বলে,
— কী করছো এটা? দেখে হাঁটতে পারো না?
ওয়েটার ভয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
— সরি স্যার! ভুল হয়ে গেছে! ক্ষমা করে দিন!
আদনান তেড়ে ওঠে,

— কি ভুল! একদম মেরে…
সামির আদনানের কাঁধে হাত রেখে থামায়,
— থাক, ওকে যেতে দাও।
ওয়েটার সেখান থেকে চলে যায়।
ফারিদ বলে,
— সরি ভাই, একটু ওয়াশ করে নে!
আদ্রিক শান্ত গলায় বলে,
— ইটস ওকে। ওয়াশরুমটা কোথায়?
ফারিদ দেখিয়ে দেয়,
— ঐ ডান দিকে।
আদ্রিক চলে যায় ওয়াশরুমের দিকে। সে গিয়ে বেসিনে পানি নেয় জামাটা পরিষ্কার করার জন্য। ঠিক তখনই, পেছন থেকে এক কোমল কণ্ঠস্বর ভেসে আসে,
— আমি পরিষ্কার করে দিই?
আয়নার দিকে চোখ তোলে আদ্রিক। পেছনে দাঁড়িয়ে শায়রা, হাতে টিস্যু।
শায়রা আবার বলে,

— আমি কিন্তু হাতে টিস্যু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি!
আদ্রিক ঠান্ডা কণ্ঠে উত্তর দেয়,
— প্রয়োজন নেই।
বলে সে নিজেই শার্ট পরিষ্কার করতে থাকে। শায়রা ধীরে ধীরে আদ্রিকের দিকে এগিয়ে আসে। আদ্রিক আয়নায় তাকে এগিয়ে আসতে দেখে ঘুরে দাঁড়ায়। এবার শায়রা তার একদম মুখোমুখি।
— কিন্তু আমার তো প্রয়োজন!
বলেই আদ্রিকের শার্ট পরিষ্কার করতে হাত বাড়ায়।
ঠিক তখনই আদ্রিক শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
— টাচ করবি না! নাহলে জানে মেরে ফেলবো।
শায়রা হেসে হাত নামিয়ে নেয়। তারপর হালকা কণ্ঠে বলে,
— আমি তো অনেক আগেই তোমার উপর মরে গেছি,
আর নতুন করে কী মারবে?
আদ্রিক একদম স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উত্তর দেয়,
— অফিসিয়ালি মেরে দাফন করে দিয়ে আসবো।
শায়রা হেসে ফেলে।

— তুমি পারবে না!
— আমার পারা না পারার সম্পর্কে তোর কোনো ধারণাই নেই।
শায়রা ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি ঝুলিয়ে আদ্রিকের চোখে চোখ রেখে বলে,
— ধারণা দাও না! আমি চাইছি তো… আমাকে কাছে টেনে সবকিছুর ধারণা দিয়ে দাও।
আদ্রিকের চোখে তখন হিমশীতল তীক্ষ্ণতা। ঠান্ডা গলায় বলে,
— আদ্রিক কারদার কখনোই তোদের মতো নষ্ট মেয়েদের কাছে টানবে না।
এইবার আর নিজেকে সামলাতে পারে না শায়রা। রাগে গর্জে ওঠে,
— তাহলে কাকে কাছে টানবে? অর্তিহাকে? ওর জন্যই তো আমাকে এড়িয়ে চলো, বাজে ব্যবহার করো— তাই তো? শোনো আদ্রিক, তোমার করা প্রতিটা অপমান, প্রতিটা অবহেলার হিসাব আমি অর্তিহার থেকে আদায় করবো। আমি হচ্ছি আগুন… আর সেই আগুনে অর্তিহার জ্বলেপুড়ে ছাই হওয়া অনিবার্য!
আদ্রিক চুপচাপ নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে হাতে পেঁচাতে থাকে। চোখদুটো তখন হিমশীতল অথচ ভয়ানক হিংস্র। ঠান্ডা গলায় বলে,

— তোর আগুন আমি থুতু দিয়ে নিভিয়ে দেবো, ইউ লিটল বিচ!
বলেই আচমকা এক চড় বসিয়ে দেয় শায়রার গালে! মুহূর্তেই অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে শায়রা। ঠিক তখনই সেখানে এসে পড়ে সামির। সে আসছিলো ওয়াশরুমে, কিন্তু সামনে শায়রাকে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
— আদ্রিক! ওর কী হয়েছে? মাটিতে পড়ে আছে কেন?
আদ্রিক একদম স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে,
— থাপ্পড় মেরেছি, জ্ঞান হারিয়েছে।
সামির বিস্ময়ে কিছু বলতে যাবে, তখনই তার চোখ পড়ে আদ্রিকের হাতে পেঁচানো রুমালের দিকে। চিন্তিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

— তোর হাতে কী হয়েছে? কেটে গেছে?
— না, হাতে কিছু হয়নি।
সামির আরও অবাক হয়ে বলে,
— তাহলে রুমাল পেঁচিয়ে রেখেছিস কেন?
আদ্রিক একদম শান্তভাবে বলে,
— আমি অর্তিকে ছাড়া আর কোনো মেয়েকে টাচ করি না। তাই ওকে থাপ্পড় মারার জন্য রুমাল পেঁচিয়েছিলাম।
সামির অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আদ্রিকের দিকে। এই ছেলেটা কীভাবে এমন ভয়ংকর কাজ করার পরেও এতটা স্বাভাবিক থাকতে পারে? যেন কিছুই হয়নি!
সামির এবার চিন্তিত কণ্ঠে বলে,
— এখন এর কী হবে?
আদ্রিক হেসে উত্তর দেয়,

— তুই ভাবিস এর কী করবি! আমি গেলাম।
সামির বিস্ময়ে বলে,
— ভাই মেরে অজ্ঞান করলি তুই আর ভাববো আমি?
আদ্রিক কিছু না বলে সেখান থেকে চলে যায়। সামির পেছন থেকে ডাক দেয়, কিন্তু আদ্রিক থামে না। উপায় না দেখে সামির শায়রাকে কোলে তুলে নেয় এবং ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে।
ওয়াশরুম থেকে বের হতেই আদনান আদ্রিককে দেখে বলে,
— কী রে, সামির কোথায়?
আদ্রিক পেছনে ইশারা করে বলে,
— আসছে।
ফারিদ ও আদনান পেছনে তাকিয়ে দেখে সামির আসছে—কিন্তু তার কোলে একটি মেয়ে! সামির আরেকটু কাছে আসতেই মেয়েটির মুখ স্পষ্ট হয়। দুজনেই অবাক হয়ে একসাথে বলে ওঠে,
— শায়রা? তাও আবার সামিরের কোলে?
সামির তাদের কাছে এসেই শায়রাকে সোফায় শুইয়ে দিয়ে আদ্রিকের দিকে দেখিয়ে বলে,
— সালা ওকে মেরে অজ্ঞান করে ওয়াশরুমেই ফেলে রেখে এসেছে!
ঠিক তখনই ত্রিসা ও তার বন্ধুদের সার্কেল সেখানে আসে। শায়রাকে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে ত্রিসা চমকে ওঠে,

— শায়রা? ও অজ্ঞান হয়েছে কীভাবে?
আদ্রিক ঠান্ডা গলায় বলে,
— আমি থাপ্পড় মেরে অজ্ঞান করেছি।
সবাই স্তব্ধ। আদ্রিক সামির ফারিদের দিকে তাকিয়ে বলে,
— আমি গেলাম।
বলেই কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পার্টি থেকে বেরিয়ে যায়।
রুশা এবার চিন্তিত ও রাগান্বিত কণ্ঠে সামিরকে লক্ষ্য করে বলে,
— কিন্তু আপনার সাইকো ফ্রেন্ড আমার ফ্রেন্ডকে মেরে অজ্ঞান করেছে কেন?
সামির ঠান্ডা মাথায় উত্তর দেয়,
— তোমার সাইকো ফ্রেন্ড আমার সাইকো ফ্রেন্ডের পেছনে মাছির মতো ঘুরে ঘুরে ডিস্টার্ব করছিল, তাই মেরে উড়িয়ে দিয়েছে!
রুশা রাগে গজগজ করে, কিন্তু সামির পাত্তা দেয় না।
লাম্মি রুশাকে থামিয়ে বলে,
— আচ্ছা, এসব বাদ দাও। আগে ওর জ্ঞান ফেরাতে হবে।
ফারিদ একজন ওয়েটারকে ডেকে পানি আনায়। তারপর শায়রার মুখে ছিটিয়ে দেয়, কিন্তু শায়রার কোনো সাড়া নেই।

রুশা এবার ন্যাকা কান্নায় ভেঙে পড়ে,
— দোস্ত, শায়রা উঠছে না! নির্ঘাত ওকে মেরে ফেলেছে!
সামির বিরক্ত হয়ে বলে,
— কানা নাকি? শ্বাস নিচ্ছে দেখছো না? তাও বলো মরে গেছে! পাগল একটা!
ফারিদ বলে,
— আচ্ছা, একটু ওয়েট করি? হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে আসবে।
ত্রিসা সম্মতির মাথা নাড়ে। প্রায় এক ঘণ্টা কেটে যায়, তবুও শায়রার জ্ঞান ফেরে না।
আদনান বলে,
— আই থিংক আমাদের ওকে এখনই হসপিটালে নেওয়া উচিত।
সবাই একমত হয়। সামির শায়রাকে কোলে তুলতে যাবে, ঠিক তখনই শায়রা পিটপিট করে চোখ খোলে।
সামির চমকে বলে,
— ফারিদ! ওর সেন্স আসছে!
শায়রা চারপাশে তাকায়। মুহূর্তেই ওর মনে পড়ে আদ্রিকের থাপ্পড়। সঙ্গে সঙ্গে সে রাগে ফুঁসে ওঠে।
রুশা উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করে,

— দোস্ত, তুই ঠিক আছিস?
শায়রা চিৎকার করে ওঠে,
— আদ্রিক? আদ্রিক কোথায়? আদ্রিক?
আদনান বলে,
— আদ্রিক তোমাকে থাপ্পড় মেরে অজ্ঞান করে ওয়াশরুমে ফেলে চলে গেছে! সামির তোমাকে এখানে এনেছে।
সবাই অবাক হয়ে আদনানের দিকে তাকায়। আদনান হাত তুলে বলে,
— ভাই, আমি বিস্তারিতভাবে বলছিলাম।
ফারিদ বাধা দেয়,
— বলতে হবে না। তুই চুপ থাক।
তারপর শায়রার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
— তুমি ঠিক আছো?
ত্রিসা চিন্তিত গলায় বলে,
— হ্যাঁ শায়রা, তুই ঠিক আছিস তো?
আদনান বলে ওঠে,

— আরে কী প্রশ্ন করছো তোমরা? আদ্রিকের থাপ্পড় খেয়েছে! কোনো সাধারণ থাপ্পড় না! নির্ঘাত এখনো মাথা ঘুরছে!
শায়রা চোখ রাঙিয়ে আদনানের দিকে তাকায়, তারপর রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে উঠে হনহন করে বাইরে বেরিয়ে যায়। সবাই ফের আদনানের দিকে তাকায়, সে ঠোঁটে আঙুল তুলে বোঝায়—আর কিছু বলবে না। কিন্তু ততক্ষণে সবার মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। রুশা আর লাম্মি নিচে নেমে দেখে, শায়রা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছে। হতাশ হয়ে তারা আবার পার্টিতে ফিরে যায়।

শায়রা রাগে কাঁপছে, তার গাড়ির স্পিড একদম হাই। রাস্তা ভরা গাড়ি, যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে, কিন্তু শায়রার মাথায় এখন কেবল একটি কথাই ঘুরছে—আদ্রিকের শেষ কথা। এক ঘণ্টা পর, সে একটি বিশাল বাড়ির সামনে গাড়ি থামায়। গেটের সামনে লেখা—রেজা মঞ্জিল। গাড়ি থেকে নেমে সোজা কলিংবেল বাজাতে থাকে। কয়েকবারের পর বাড়ির মেইড দরজা খুলতেই,
শায়রা রাগে তার গলা চেপে ধরে বলে,
— এতোক্ষণ লাগল কেন দরজা খুলতে?
মেইড কাঁপা গলায় জবাব দেয়,
— ম্যাম… কিচেন থেকে আসছিলাম!
শায়রা এক ধাক্কায় মেইডকে ফেলে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়। নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে হঠাৎ একটা দরজার সামনে থেমে যায়। ভেতর থেকে চিৎকার চেচামেচির শব্দ আসছে।
সে ভ্রু কুঁচকে বলে,

— বাবা আর ভাইয়া?
সে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ে।
সাইহান রগে উচ্চ স্বরে বলে,
— আমি যা বলছি, সেটাই হবে!
সারফারাজ গর্জে উঠেন,
— তা কোনোদিনও না!
শায়রা অবাক হয়ে ভ্রু কুচকে বলে,
— কি হয়েছে? তোমরা ঝগড়া করছো কেন?
সারফারাজ রাগে অগ্নিমূর্তি হয়ে বলেন,
— তোমার ভাইয়ার মাথা খারাপ হয়ে গেছে! একেবারে পাগলের মতো কথা বলছে!
শায়রা এবার সাইহানের দিকে তাকিয়ে বলে,
— কি হয়েছে ভাইয়া? এতো চিৎকার চেঁচামিচি কিসের জন্য!
সাইহান রাগ দমন করার চেষ্টা করে বলে,
— আমি অর্তিহাকে বিয়ে করতে চাই!
সারফারাজ তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে,

— আমি ঐদিনও বলেছি আর আজকেও বলছি আভীর নিজের শত্রুর ঘরে কখনো মেয়ে দেবে না! কথাটা ভালোভাবে নিজের মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে নাও।
সাইহান চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কন্ঠে বলে,
— শত্রুতা না থাকলে নিশ্চয়ই দেবে, তাই না?
সারফারাজ রেগে বলেন,
— এখন তুমি কি আমার কাটা মাথা নিয়ে নিজের হবু শ্বশুরের সামনে হাজির হয়ে বলবে—শত্রুতা শেষ?
শায়রা বিরক্ত গলায় বলে,
— বাবাহ!
সাইহান শান্ত কিন্তু গম্ভীর কন্ঠে বলে,
— “নাহ! যেটা নিয়ে সমস্ত শত্রুতা, সেটা যদি ওরা পেয়ে যায়—তাহলেই তো ওদের রাগ-ক্ষোভের অবসান হবে, তাই না? আমি সেটাই দিয়ে দেবো।”
সারফারাজ চমকে বলেন,

— কী বলছ তুমি? কী করতে চাও?
সাইহান দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
— আমি সেই প্রপার্টিটা আভীর আঙ্কেলকে দিয়ে দেবো। এই জায়গাটাকেই ঘিরে তো সব বিবাদ শুরু। যখন সেটা ওনার হয়ে যাবে, তখন নিশ্চয়ই উনি আমাকে অর্তিহাকে দিয়ে দিবেন?
সারফারাজ দাঁতে দাঁত চেপে বলেন,
— আহাম্মক! ওদের কি জায়গার অভাব পড়েছে? যে একটা জমির জন্য ওরা এমন মরিয়া? সেই জমি নিতে হলে ওরা নিজের মেয়েকেও তোমার হাতে তুলে দেবে?
— জায়গার অভাব নেই, কিন্তু অভাব আছে জেদর! এই জায়গাটা ওদের কাছে একধরনের বিজয়ের প্রতীক। ওরা মনে করে, এটা তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারলেই ওরা জিতবে। আমি সেই জেদটাই মিটিয়ে দিয়ে, আমাদের দুই পরিবারের দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাতে চাই।
সারফারাজ ক্ষোভে কাঁপতে কাঁপতে বলেন,
— তোমার লজ্জা করে না এই কথা বলতে? নিজের বাবাকে হারিয়ে অন্য কাউকে জিতিয়ে দিতে চাও? তোমার চোখে কি আমি এতটাই তুচ্ছ?
সাইহান শান্ত কিন্তু দৃঢ় গলায় বলে,

— এখানে তোমাকে ছোট করা না, বাবা। বরং এই দেয়ালটা ভাঙলে দুই পরিবারের ভাঙনটাই মেরামত হবে।
সারফারাজ রাগে গর্জে ওঠেন,
— না! এই ভাঙন কোনোদিন জোড়া লাগবে না! ওরা বিশ্বাসঘাতক! আমার বাবার সঙ্গে, এই রেজা পরিবারের সঙ্গে ওরা যা করেছে, সেটা আমি ভুলতে পারি না, ভুলবও না!
সাইহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
— আর কত দিন ধরে এই শত্রুতা টেনে নেব, বাবা? এবার থামো। আমার স্বপ্ন, আমার ভালোবাসাকে পূর্ণতা দিতে দাও।
সারফারাজ এবার শায়রার দিকে তাকায়।

— শুনছো? বাপ-দাদার সম্মান মাটিতে মিশিয়ে ও বিয়ে করবে!
শায়রা কিছুক্ষণ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলে,
— ভাইয়া ঠিক বলছে। জায়গাটা দিয়ে দাও, বাকিটা আমরা সামলে নেবো!
— না! কোনোদিনও না!
— আমি কিছু শুনছি না! কালই আঙ্কেলের সাথে কথা বলবো!
সারফারাজ হতভম্ব হয়ে বলে,
— শায়রা! তুমিও সাইহানকে সাপোর্ট করছো?
শায়রা মাথা নেড়ে শান্ত ভঙ্গিতে বলে,
— হ্যাঁ বাবা। যদি অর্তিহা ভাইয়ার হয়ে যায়, তাহলে আদ্রিক আমার হয়ে যাবে!
সারফারাজ দ্বিগুণ ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন,
— তোমরা দুই ভাই-বোন কারদারদের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে এমন কী দেখলে? চোখে এখন আর কোনো বাপ-দাদার সম্মান পড়ে না?

শায়রা সারফারাজের চোখে চোখ রেখে পাগলামি স্বরে বলে,
— আমার কাছে আদ্রিকের চেয়ে বড় কিছু নেই! তাকে পেতেই হবে, আর তার জন্য আগে অর্তিহাকে সরাতে হবে!
সারফারাজ হতাশ গলায় বলেন,
— দুই ভাই-বোনই একেবারে পাগল!
সাইহান জোর গলায় বলে,
— “হ্যাঁ, আমি পাগল! আর সেই পাগলামির নাম—অর্তিহা! এই প্রোপার্টির চেয়ে ও অনেক দামী!”
এই বলে সাইহান ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সারফারাজ রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন।
— বাবা, একটা কথা বলি। কাল তুমি নিজেই সেই প্রপার্টি কারদার পরিবারকে দিয়ে দাও, এবং নিজেদের মধ্যকার ঝামেলা মিটিয়ে পুত্রবধূ ঘরে তোলো। না হলে ভাইয়া যদি তোমার বিরুদ্ধে চলে যায়, তাহলে রেজা বাড়ির সম্মান বলে কিছু অবশিষ্ট থাকবে না!

বলেই শায়রা চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই, হঠাৎ থেমে সারফারাজের কথায়।
— আচ্ছা মা, তুমি একবার বল, ঐ আদ্রিকের মধ্যে এমন কী আছে যে তুমি ওর জন্য এত পাগল?
শায়রা ঘুরে দাঁড়ায়। চোখে চোখে ভেসে ওঠে আদ্রিকের মুখ। ঠোঁটে পাগলামি হাসি খেলে যায়—যা বুঝিয়ে দেয় সে কতটা উম্মাদ আদ্রিকের জন্য।

— “ওর মধ্যে যা আছে, তা আর কারও মধ্যে নেই! ওর চোখে এক অদ্ভুত নেশা আছে, রঙ আছে। একবার তাকালে চোখ ফেরানো যায় না। ওর অভ্যাসগত হাসিটা, ব্যক্তিত্ব, প্রতিটা নিঃশব্দ নিখুঁত চাল… সব কিছু আমাকে পাগল করে দেয়! আমি ওকে চাই— যে কোনো মূল্যে। তাতে যদি আমাকে দুনিয়ার সবচেয়ে জঘন্য নারী হতে হয়, তবুও আমি রাজি! তবুও আদ্রিক কারদার—তাকে আমি চাই। সে কেবল আমার হবে!”
এই কথা বলে শায়রা রুম থেকে বেরিয়ে যায়।সারফারাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার তিন সন্তানের মধ্যে দুটোই এখন তার আয়ত্তের বাইরে। দুজনই তার শত্রুর সন্তানদের জন্য পাগল হয়ে গেছে।
শায়রা রুমে ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে। গালটা লাল হয়ে আছে। গালে হাত রেখে হিংস্র চোখে তাকিয়ে বলে,

— “আদ্রিক, তুমি আমাকে বারবার অপমান করেছো, ফিরিয়ে দিয়েছো। সেই সব অপমানের প্রতিশোধ আমি নেবো, অর্তিহার থেকে! তার জীবনটা আমি নরক বানিয়ে ছাড়বো! দ্যাটস শায়রা ইশরার রেজার প্রমিজ টু ইউ, মাই জান! তুমি অর্তিহার হতে পারো না, তুমি কেবল আমার! তোমার বউ হওয়ার একমাত্র অধিকার আমার! তোমার পদবি কেবল আমার নামের সাথেই মানায়—শায়রা আদ্রিক কারদার—দ্যাটস দ্য বেস্ট নেম! আমি সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেবো, তাও তোমাকে আমার করবো!“

সকালের খাবার টেবিলে সাজানো হরেক রকম নাস্তা। কারদার পরিবারের সবাই বসেছে একসাথে ব্রেকফাস্ট করতে—শুধু দুইজন ছাড়া। মেহজা ও অর্তিহা। মেহজা গেছে অর্তিহাকে আনতে। সবাই তাদের অপেক্ষায়।
ওদের আসতে দেখে আভীর কারদার হাসিমুখে বলেন,
— এই তো, ওরা চলে এসেছে!
মেহজা গিয়ে বসে আরভিদের পাশে, আর অর্তিহা গিয়ে নিজের বাবার পাশে বসে। দু’দিন পর মেয়েকে খাবার টেবিলে দেখে আভীর কারদার একটু অবাক হয়ে বলেন,
— ইশশ! চোখ-মুখের কী হাল করেছে!
সবার দৃষ্টি গিয়ে পড়ে অর্তিহার দিকে। সত্যিই, তার চেহারা শুকিয়ে গেছে। নিষ্প্রাণ চোখ, মুখে কোনো উজ্জ্বলতা নেই। অপার সৌন্দর্যের এই মেয়েটি আজ যেন একেবারে ফ্যাকাশে। আরভিদ চুপচাপ তাকিয়ে থাকে অর্তিহার দিকে, তার চোখে স্পষ্ট উদ্বেগ।
তাহিয়া বলেন,

— হবে না? গত দু’দিন ধরে কিছু খেতে চায় না। জোর করে খাইয়াতে হয়েছে!
আভীর কারদার মেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে নরম স্বরে বলেন,
— প্রিন্সেস, এখন শরীর কেমন?
অর্তিহা আস্তে করে জবাব দেয়,
— ভালো, ড্যাড।
আভীর কারদার হেসে বলেন,
— আজ ড্যাড নিজে খাওয়াবে তার প্রিন্সেসকে। দেখি, তখনও খেতে না চায় কীভাবে!
সবাই খাওয়া শুরু করে। আভীর কারদার চামচে করে অর্তিহাকে খাওয়াতে থাকেন। অর্তিহা কিছুটা খায়, তারপর আর খেতে চায় না। অনেক জোড়াজুড়ি তেও সে রাজি হয় না। শেষে উঠে দাঁড়ায়।
আরভিদ তাকে থামিয়ে নরম স্বরে বলে,

— অর্তি, আমার রুমে গিয়ে অপেক্ষা কর। তোর সঙ্গে আমার কথা আছে। খাওয়া শেষ করেই আসছি।
অর্তিহা ভয়ে কেঁপে ওঠে। মনে মনে ভাবে—তাহলে কি ভাইয়া কিছু টের পেয়ে গেছে? সে কিছু না বলে মাথা নেড়ে চলে যায়। মেহজা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে আরভিদের দিকে। কিছু না বললেও তার কৌতূহল স্পষ্ট। আরভিদ খাওয়া শেষ করে রুমে গেলে দেখে, অর্তিহা চুপচাপ সোফায় বসে আছে। সে পাশে গিয়ে বসে, অর্তিহার মাথায় হাত রাখে।
— তুই জানিস না, তুই আমার কত আদরের? শুধু আমার না, সবার! তোর একটু কষ্ট হলে আমরা কেউ শান্তি পাই না।
অর্তিহা মাথা তুলে আরভিদের দিকে তাকায়।
আরভিদ আবার বলে,

— ভাইয়া নিজের কাজ নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম, বুঝতেই পারিনি আমার ছোট্ট বোনটা একা হয়ে পড়েছে। আমি খুব খারাপ ভাই, তাই না?
অর্তিহা তড়িঘড়ি করে বলে,
— না ভাইয়া! তুমি অনেক ভালো!
আরভিদ স্নেহভরে বলে,
— তাহলে বল, আমার বোনের মুখে হাসি নেই কেন? সেই উজ্জ্বলতা কোথায় হারিয়ে গেছে?
অর্তিহার মন আতঙ্কে কেঁপে উঠে। সে আগে থেকেই আশঙ্কা করছিল আরভিদ তাকে এই প্রশ্ন করতে পারে আর সেটাই হলো। তবুও ভয় চাপা রেখে, নিচু স্বরে বলে,
— পড়াশোনা নিয়ে একটু চাপ ছিল, তাই হয়তো এমন হয়েছে। আমি একদম ঠিক আছি ভাইয়া।
আরভিদ নরম স্বরে বলে,
— ভাইয়ার সাথে মিথ্যে বলবি?
একটু থামে। তার কন্ঠস্বর দৃঢ় হয়ে উঠে,
— তুই ভয় পাবি না। আমাকে বল, কারণটা কী? আমি সেটা দূর করবো, যত বড় কারণই হোক না কেন!
অর্তিহা ভিতু কন্ঠে আস্তে করে বলে,
— সত্যিই বলছি ভাইয়া।
আরভিদ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হালকা হেসে বলে,

— ঠিক আছে, বিশ্বাস করলাম। তবে মনে রাখিস, কোনো কিছু হলে প্রথমে ভাইয়াকে বলবি।
— আচ্ছা। আমি এখন যাই?
আরভিদ মাথা নাড়ে। অর্তিহা রুম থেকে বেরিয়ে গেলে তার মুখের হাসিটা মিলিয়ে যায়। বোঝাই যায়, সে একটুও বিশ্বাস করেনি অর্তিহার কথা। সে বুঝে গেছে, কিছু একটা ঘটেছে, আর সেটা নিজেকেই খুঁজে বের করতে হবে। ঠিক তখনই মেহজা রুমে ঢোকে। অর্তিহার যাওয়ার অপেক্ষায় ছিল সে।
মেহজা সোজা প্রশ্ন করে,
— অর্তিকে কেন ডেকেছিলেন?
আরভিদ ড্রেসিং টেবিলের দিকে যেতে যেতে বলে,
— কিছু কথা ছিল।
মেহজা একটু চুপ থেকে বলে,
— আপনার মনে হয় না, অর্তি কিছু নিয়ে ডিপ্রেসড?
আরভিদ একবার তাকিয়ে বলে,

— হুম!
— আচ্ছা, ধরুন অর্তির এই ডিপ্রেশনের জন্য যে ব্যক্তি দায়ী, আপনি যদি তাকে খুঁজে পান — আপনি কি করবেন?
আরভিদের স্বাভাবিক চেহারা রাগে রূপ নেয়।
— তাকে জীবন্ত কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলবো! আমার বোনের হাসি কেড়ে নেওয়ার এমন অপরাধ আমি কোনোভাবেই ক্ষমা করবো না।
মেহজা ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করে,
— কিন্তু যদি সেই ব্যক্তি আপনার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু হয়, তাহলেও?
আরভিদ চোখ কুঁচকে ঘুরে তাকায়। কণ্ঠস্বর কঠিন করে বলে,

— যা বলার সোজাসুজি বলো।
— ধরুন, যদি সেই মানুষটা আদ্রিক ভাইয়া হয়?
মেহজার কথা শুনে আরভিদের কুচকে যাওয়া ভ্রু টা ঠিক হয়ে যায়। গম্ভীর চোখে তাকায়,
— তোর কেন মনে হচ্ছে কারণটা আদ্রিক?
— আমি বলিনি যে উনি-ই। শুধু বলছি, যদি হয়?
আরভিদ চুপ করে থাকে। তার কপালে ভাঁজ পড়ে, চোখে-মুখে দেখা যায় চিন্তা।
ঠিক তখন দরজায় কড়া নাড়ে এক মেইড।
— স্যার, নিচে এসপি সাহেব এসেছেন। উনি বললেন, অর্তিহার সাথে কিছু কথা বলার জন্য এসেছেন।
আরভিদ ও মেহজা, দুজনেরই অবাক হয়।
আরভিদ গম্ভীর স্বরে বলে,
— আমি আসছি, তুমি যাও।
মেইড চলে যায়।
মেহজা আরভিদের দিকে তাকিয়ে বলে,

— এসপি অফিসার? অর্তির সঙ্গে কথা বলতে? কেন?
— আমি জানি না। নিচে গেলেই সব বোঝা যাবে।
আরভিদ ও মেহজা নিচে নেমে আসে। লিভিং রুমে তখন সবাই উপস্থিত—আভীর, আফির, তাহিয়া ও নাজনীন। সবাই বেশ রাগ ও অস্বস্তিতে ভুগছে। পুলিশের উপস্থিতি কারও ভালো লাগছে না, বিশেষ করে যখন তারা কারদার পরিবারের একজন মেয়েকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে এসেছে।
আভীর ও আফির দুজনেই চোখেমুখে রাগের ছাপ নিয়ে বসে আছেন। তবে মেহরাব কিছুটা উদাসভাবে দাঁড়িয়ে, যেন এসবের কিছুই তার ওপর প্রভাব ফেলছে না।
আভীর জিজ্ঞেস করলেন কঠোর কণ্ঠে,
— আপনি জানেন, আপনি কোন বাড়ির মেয়েকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এসেছেন?
মেহরাব ঠান্ডা স্বরে উত্তর দেয়,
— আমি এসেছি অর্তিহা কারদারের সাথে কিছু কথা বলার জন্য। আমি কি ভুল বাড়িতে এসে পড়েছি?
আফির ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে ওঠেন,

— মাত্র দুই মিনিট লাগবে আপনার চাকরি উড়িয়ে দিতে!
মেহরাব কিছু বলার আগেই সিড়ি দিয়ে নামতে দেখা যায় আরভিদকে, পেছনে মেহজা। নিচে নেমে এসে আরভিদ মেহরাবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলেন,
— আপনি?
মেহরাব নিজের পরিচয়পত্র বের করে দেখিয়ে বলেন,
— এসপি মেহরাব মাহমুদ কাজি।
আরভিদ গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন করেন,
— কিন্তু আমার বাড়িতে কেন?
মেহরাব গম্ভীরভাবে বলে,
— অর্তিহা কারদার যেই কোচিং-এ পড়েন, সেই কোচিংয়ের উচ্চতর গণিতের শিক্ষক তাহমিদ নিখোঁজ। আমি সেই বিষয়ে কথা বলতে এসেছি।
আরভিদ ভ্রু কুচকে বলে,

— তো? এর সঙ্গে আমার বোনের কোনো সম্পর্ক নেই!
মেহরাব শান্তভাবে উত্তর দেয়,
— সম্পর্ক আছে কি না, সেটা তদন্তের মাধ্যমেই জানা যাবে। আমাকে বাধা না দিয়ে সহযোগিতা করুন, স্যার।
আরভিদ কর্কশ গলায় বলে,
— কারদার বাড়ির মেয়েকে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের নিয়ম নেই!
মেহরাব দৃঢ় কন্ঠে বলে,
— আইন কিন্তু কারদার পরিবারের নিয়ম দেখে তৈরি হয়নি, স্যার।
আরভিদ কণ্ঠ চড়িয়ে বলে,
— আপনি বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন, আপনার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে, সে সংসদীয় আইন তৈরি করে!
মেহরাব ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
— তাহলে আপনি কি একজন আইনমন্ত্রী হয়ে আমাকে আইন ভাঙতে বলছেন?
আরভিদ দৃঢ়ভাবে বলে,
— হ্যাঁ!
মেহরাব ঠান্ডা গলায় বলে,

— দুঃখিত, স্যার। আমি চলমান সংসদীয় আইনই মানবো। পরে আপনি যদি আইন পরিবর্তন করেন, তখন সেটা মানবো।
আরভিদ রেগে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই, পেছন থেকে ভেসে আসে কোমল কণ্ঠ,
— আপনি এখানে কি করছেন?”
সবাই ঘুরে তাকায় সিড়ির দিকে। নামছে অর্তিহা। তাঁকে দেখে আভীর উদ্বিগ্ন হয়ে বলেন,
— প্রিন্সেস, তুমি এখানে এসেছো কেন?
অর্তিহা শান্ত গলায় বলে,
— মেইড বললো, কেউ একজন আমার সাথে দেখা করতে এসেছে।
মেহরাব অর্তিহার দিকে তাকিয়ে বলে,
— আমি এসেছি।
অর্তিহা কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করে,
— কেন?
মেহরাব এবার আরভিদের দিকে তাকিয়ে সংক্ষেপে জিজ্ঞেস করেন,
— আমি কি কিছু প্রশ্ন করতে পারি?

আরভিদ কোনো উত্তর না দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। মেহরাব অনুমতির অপেক্ষা না করেই অর্তিহার দিকে এগিয়ে আসে। অর্তিহার মুখোমুখি দাঁড়ায়। তার চোখে পড়ে, অর্তিহার মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। মায়াবী চেহারায় জমে আছে বিষণ্নতা। মেহরাব কণ্ঠস্বর কঠোর করতে চেয়েও পারে না।
সে অর্তিহাকে জিজ্ঞেস করে,
— সেদিন কি তাহমিদ আপনাকে কোনোভাবে অস্বস্তিতে ফেলেছিলেন?
অর্তিহা থমকে যায়। তারপর বলে,
— আমি বুঝতে পারছি না আপনি কী বলতে চাইছেন।
— আপনার ক্লাসমেটদের কাছ থেকে শুনেছি, সেদিন তাহমিদ আপনাকে মিস অপরূপা বলে বারবার ডাকছিলেন। এতে আপনি অস্বস্তিতে পড়েছিলেন। এটা কি সত্যি?
অর্তিহা অস্বস্তিতে একবার চারপাশে তাকিয়ে নিয়ে আস্তে করে বলে,

— জি… সত্যি। তবে এর সঙ্গে উনার নিখোঁজ হওয়ার কী সম্পর্ক? আপনি কি বলতে চাইছেন, আমি দায়ী?
মেহরাব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে,
— কে জানে! প্রমাণ কিন্তু আপনার দিকেই বেশি ইঙ্গিত করছে। তাহমিদ নিখোঁজ হন যেদিন, সেটা ছিল আপনার কোচিং-এ প্রথম দিন। তারপরে আপনি দুইদিন কোচিং-এ যাননি।
অর্তিহা প্রতিবাদ করে বলে,
— আমি অসুস্থ ছিলাম! সেদিনই আপনাকে জানিয়েছি।
— আপনি নন, আপনার কাজিন আদ্রিক কারদার জানিয়েছিলেন।
তারপর চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে বলে,
— উনি এখন কোথায়?
মেহজা বলে,

— আদ্রিক ভাইয়া কাল রাতে দুবাই গেছেন।
মেহরাব ভ্রু কুচকে বলে,
— পালিয়ে গেলেন নাকি?
আফির রেগে গিয়ে বলেন,
— আমার ছেলে ওখানে এয়ারলাইন্সের পাইলট! আপনি সাহস কোথা থেকে পান কারদার পরিবারের কাউকে এভাবে বলার?
আভীর ধৈর্যহীন হয়ে বলেন,
— আপনার এই বাজে প্রশ্নপত্র শেষ হলে এখন আপনি যেতে পারেন!
আরভিদ ধীর কণ্ঠে, কিন্তু তীক্ষ্ণ চোখে প্রশ্ন করে,
— সামান্য একজন কোচিং টিউটরের নিখোঁজের কেসে এসপি নিজে তদন্ত করছে, এটা অদ্ভুত না?
মেহরাব আরভিদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে,
— কোনো প্রাণই সামান্য নয়, স্যার। আপনার প্রাণের যত দাম, একজন কোচিং টিউটরের প্রাণেরও ততটুকুই মূল্য!
আরভিদ কটাক্ষ করে বলে,

মোহশৃঙ্খল পর্ব ৭

— সত্যিই কি সবার প্রাণের মূল্য এক? নাকি এটা কারদার ম্যানরের সাথে সম্পর্কিত বলেই এত সিরিয়াস?
মেহরাব সরাসরি চোখে চোখ রেখে বলে,
— কেন? আমার কি আপনার সাথে কোনো পুরনো শত্রুতা আছে? যে আমি প্রতিশোধ নিতে এই কেসে নেমেছি?

মোহশৃঙ্খল পর্ব ৯

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here