যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ১৩
মম সাহা
তুলোর মতন বরফ খন্ড ছড়িয়ে আছে চারদিকে। সন্ধ্যা নেমে যাওয়ায় চারপাশটায় শীতও যেন বেড়ে গিয়েছে। বরফের রাস্তাটায় তাই চাঁদনী বেশ গুটিশুটি মেরে হেঁটে যাচ্ছে। নীলাভ আকাশটার পুঁজি এক খন্ড চাঁদের টুকরোটা।
কোলাহলহীন নিস্তব্ধ রাস্তায় চাঁদনীর ফোনের শব্দ যেন ঝঙ্কার তুললো। জ্যাকেটের পকেট থেকে বেশ রয়েসয়েই ফোনটা বের করলো চাঁদনী। ভেবেছিলো মা কল দিয়েছেন। কিন্তু তার ভাবনাকে ভুল করে দিয়ে ফোনের স্ক্রিনে বাবা লিখাটা ভেসে উঠেছে। এই সময়ে কখনোই বাবা কল দেন না। তাই কিছুটা অবাক হয়েই ভিডিও কলটি রিসিভ করলো চাঁদনী। অপর পাশে অন্ধকার রুমটা দেখা গেলো কেবল।
চাঁদনী কিছুটা চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল, “আব্বু, কী হয়েছে? অন্ধকার রুমে যে! কিছু হয়েছে? শরীর ঠিক আছে তো?”
আফজাল সওদাগর মেয়ের নিবিড় চিন্তা দেখে হাসলেন। বললেন, “ঠিক আছি, আম্মা। ঘরটা অন্ধকার করে শুয়ে ছিলাম। এখনো বাসায় ফিরোনি, মা?”
“ফিরছি, আব্বু। কিন্তু তুমি তো রাত দশটাতেই আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ার মানুষ নও। কিছু কি হয়েছে?”
“না, মা। কিছু হয়নি। অকারণ চিন্তা করো না।”
বাবার কথায় আশ্বস্ত হলো চাঁদনী। শ্বাস ছাড়লো নীরবে। ওদিকে আফজাল সওদাগরও নিজেকে খুব বুঝিয়ে শুনিয়ে তৈরি করলেন। অতঃপর বিন্দু পরিমাণের নীরবতার পরে বললেন,
“দেশে আসার কথা কি কিছু ভেবেছো, মা?”
চাঁদনী ভিডিওতে তাকালো। হাঁটার গতি আরও কিছুটা ধীর করল। যেন গুনে গুনে পা ফেলছে।
মেয়ের নীরবতায় যেন বাবা উত্তর খুঁজে নিলেন। এক বুক হতাশার শ্বাস ছেড়ে বললেন, “জীবনকে কি আরেকটা সুযোগ দেওয়া যায় না, মা?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
চাঁদনীর ধীর পা এবারে থেমেই গেলো একেবারে। চঞ্চল চোখে তাকালো অন্ধকারে থাকা বাবাটার দিকে। মুখটা বুঝা যাচ্ছে না মানুষটার। কিন্তু কি ভেবে মানুষটা এই কথা বললেন! আরেকটা সুযোগ বলতে কী বুঝাতে চাইলে?
চাঁদনী নিভু নিভু স্বরে বলল, “আরেকটা সুযোগ মানে?”
“আরেকটা সুযোগ মানে আরেকবার কাউকে বিশ্বাস করে হাত কি ধরবে না, মা? ধরা যায় না? অনেক বাজে ভাবেই কি মনটা ভেঙেছে? আর কি জোরা নিবে না, মা? কোনো রকম ভাবেই কি সম্ভব নয়?”
বাবার একের পর এক প্রশ্ন। কিন্তু উত্তরের তাড়া নেই সেই প্রশ্নে। যেন নেহাৎই জানতে চাওয়া। যেন মেয়ের দুঃখের কিঞ্চিৎ ভাগ নিতে চাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা।
চাঁদনী এবার দাঁড়িয়ে গেলো। বরফে ঢেকে থাকা রাস্তার একটা কোণায় চুপ করে দাঁড়ালো। নিজেকে নিজেই হয়তো মনে মনে প্রশ্ন করল, এই জীবনে আরেকবার ভেঙে যাওয়ার মতন শক্তি আছে কি-না! ভেতর থেকে তখন ভগ্ন স্মৃতিরা আহাজারি করল। ওরা জানালো এই দুঃসহ যাতনা সইতে পারছে না। চোখের উপর ভেসে উঠল প্রথম প্রেমের কথা। হাত ধরে লুকিয়ে বিয়ের কথা। বছরের পর বছর অপেক্ষা করে যাওয়ার কথা। কত ছোটোবড়ো স্বপ্ন সাজিয়ে ছিলো মানুষটার সাথে! আহারে! কীভাবেই না সব ভেঙেচুড়ে তছনছ করে দিয়েছে মানুষটা। একবারও ভাবেনি যে মেয়েটা তার সাথে সংসার করবে বলে বছরের পর বছর অপেক্ষা করেছে সে মেয়েটা আদতে তাকে ছাড়া নতুন একটা সংসার গড়তে পারবে?
মেয়ের এই থম মেরে যাওয়া নিস্তব্ধতা যেন গ্রীষ্মের দুপুরের শূন্য বাতাসের মতন এসে বুকে লাগল বাবার। কী এমন যন্ত্রণা মেয়েটা পেয়েছে যে আরেকবার সুযোগ দিতে এত ভয়! এতটা দ্বিধা?
বাবা ডাকলেন, “মা, তুমি কি বাবার কথায় দুঃখ পেলে?”
চাঁদনীর স্মৃতির ঘর খসে খসে পড়ে। ধ্যান ভাঙে বাবার কথায়। দ্রুত সামলে নেয় নিজেকে। বিরাট এক প্লাস্টিকের হাসি ঠোঁটে টেনে জবাব দিল, “না তো, আব্বু। দুঃখ পেতে যাবো কেন?”
“তাহলে কিছু বলছো না যে! মা, আরেকবার সুযোগ দিবে না নিজেকে? আমায় কি বলা যায় না তোমার ভেতরের একটু কথা? বাবা হিসেবে না হোক, বন্ধু হিসেবে?”
চাঁদনী নরম চোখে তাকায় ফোনের স্ক্রিনে। এই জীবনটায় বর্তমানে তার সবচেয়ে কাছের মানুষ হলেন- বাবা। মাকেও সে ভালোবাসে কিন্তু মা এমন করে কখনো কাছের হতে আসেনি। সবসময় সমাজ, লোকের কথা ভাবতে ভাবতে মেয়ের কথা ভাবতেই ভুলে গিয়েছেন। অতঃপর সম্পর্কে তৈরি হয়েছে দেয়াল। বাবা তেমনটা করেননি। যদি তেমনটা করতেন তাহলে চাঁদনীর হয়তো বেঁচে থাকাটা খুব কষ্টের হয়ে উঠতো।
চাঁদনী বুক ভরে শ্বাস নিলো। আর কত একা একা বইবে এত কষ্ট? তাই ভাবলো একটু কিছু বলা যাক! ভঙ্গুর কণ্ঠে সে উত্তর দিল বাবাকে,
“জীবনকে আবার সুযোগ দিতে যে ভয় হয়, আব্বু!”
“কেন এত ভয়, মা? এত ভয় পেলে জীবন আগায়? হয়তো কেউ তোমায় কথা দিয়ে কথা রাখেনি। সে তোমার জীবনের সাথে খেলেছে, যন্ত্রণা দিয়েছে, তুমিও তাই বলে যন্ত্রণা দিবে?”
চাঁদনী হাসলো। কাঁদতে ভুলে গেছে আজ বহুবছর। তাই চোখ উপচে আর আগের মন জল এলো না। কেবল ক্লান্ত কণ্ঠে বলল,
“আব্বু, সে যে আমায় চিরস্থায়ী যন্ত্রণা দিয়েছে। তাই কাটিয়ে উঠতে পারছি না। তার সাথে আমার যে কেবল বর্তমান নয়, পুরো একটি ভবিষ্যতের স্বপ্ন সাজিয়ে ছিলাম। সম্পর্ক ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত, আব্বু। সম্পর্ক ভেঙে গেলে অনেকে স্বান্তনা দেয়— যে গিয়েছে চলে তাকে যেতে দাও, নিজেকে আবার নতুন করে তৈরি করো… আচ্ছা আব্বু, সত্যিই কি সব নতুন করে তৈরি করা এত সহজ! আমরা যারা সম্পর্কে থাকি তারা তো জানি তিলে তিলে কতটা স্বপ্ন জমে সেই সম্পর্কে। কতটা পরিকল্পনা জমে। একটা অদূর ভবিষ্যতের সংসারের শখ জমে। সম্পর্কের বিপরীত দিকে থাকা মানুষটা চলে যাওয়া মানে কেবল একটা বর্তমান নয় বরং গোটা জীবনের একটা ভবিষ্যতকেও এলোমেলো করে দেওয়া। আমরা ভেঙে পড়ি এই ভেবেই যে, যেই ভবিষ্যতে আমি তার সাথে প্রতিটা দিন কাটাবো ভেবেছিলাম সেই ভবিষ্যতে আমি তাকে ছাড়া থাকবো কীভাবে। কেবল বর্তমান নয়, গোটা ভবিষ্যতটা তাকে ছাড়া কাটাবো কীভাবে এই ভেবে ভেবে আর নিজেকে নতুন করে তৈরি করা হয় না। আচ্ছা বলো তো, যেই সংসারে আমার থাকার কথা ছিলো সেই সংসারে আরেকটা মেয়ে আধিপত্য খাটাচ্ছে। এইটা দেখার পরও জীবনকে আবারও নতুন করে সুযোগ দিতে ইচ্ছে করে বলো, আব্বু?”
শেষের দিকে মেয়েটার কণ্ঠ আর দৃঢ় রইলো না। একটি সাজানো ভবিষ্যতের পরিকল্পনা এলোমেলো হয়ে যাওয়ার ব্যর্থতায় কেঁপে উঠল। বাবা হিসেবে আমজাল সওদাগর চমৎকার। তাই মেয়ের যন্ত্রণায় বুক ভার হলেও প্রকাশ করলেন না। কেবল দারুণ একটা সমাধান দিলেন,
“যে তোমার ভবিষ্যতটা নিয়ে এভাবে ছেলেখেলা করলো, তাকে কি একবার এই প্রশ্ন গুলো করেছো, মা?”
চাঁদনীর পা কাঁপছে। কিছুটা অস্থির লাগছে ভেতর ভেতর। দুঃখ মনে পড়লে পাহাড়ও টলে। ও তো মানুষই! বলল, “না।”
“তাহলে তাকে এখুনি কল দাও। এসব তাকে জিজ্ঞেস করো। যে দুঃখ দিয়েছে তোমায় তাকে জানাও সে কতটা বাজে কাজ করেছে। তাকে অনুশোচনা করাতে হবে। জানাতে গিয়ে দুর্বল হবে না। তাকে বুঝতে দিবে না তার দেওয়া দুঃখ পেয়ে তুমি আর দাঁড়াতে পারোনি। বরং তাকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করো। সে যখন তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ভাববে কী উত্তর দেওয়া উচিত তখনই তার মস্তিষ্ক কাঁপবে। তখনই তার মনুষ্যত্বে আঁচ আসবে। কিছু মানুষদের মনে করিয়ে দিতে হয় তারা কী করেছে। নয়তো চিরজীবন সেই মানুষগুলো শান্তিতেই কাটিয়ে দিবে। অথচ অশান্তিতে ঘুম হবে না আমাদের। আমাদের তো দোষ নেই। ভালোবাসা তো দোষের নয়। তবে শাস্তি কেন আমাদের হবে? মা, শক্ত হওয়া ভালো কিন্তু উদার নয়। যারা মন ভাঙে তাদের প্রতি নির্লিপ্ত হয়ে যাওয়ার ভান করে আমরা ভাবি তারা হয়তো কোনো না কোনো এক দিন বুঝবে, অনুশোচনায় পুড়বে। অথচ আমরা ভুল। কিছু মানুষ কখনো অনুশোচনা করে না। দিব্যি একটা জীবন কাটিয়ে দেয় শান্তিতে। অথচ এই শান্তি তো তাদের প্রাপ্য নয়। আমি তোমায় সময় দিলাম, মা। তুমি বাবার কথা শুনে নাহয় একবার চলেই দেখো। আমায় এরপর জানিও, জীবন নিয়ে পরবর্তী ভাবনার কথা। কোনো চিন্তা নেই। তুমি যা চাইবে তা-ই হবে। আব্বু আছে তোমার সাথে। তোমার জীবন থেকে একটা ফুল ঝরে গেছে বলে গুটিয়ে যেও না। হয়তো তোমার জন্য পুরো একটা ফুলের বাগান অপেক্ষা করছে। ধৈর্য ধরো।”
মেয়ের ফোন কাটার অপেক্ষা করলেন না আফজাল সওদাগর। কেটে দিলেন নিজেই ফোনটা। বালিশে হেলান দিয়ে বসে রইলের বহুক্ষণ। তবে তিনি ভুল ছিলেন না! তার মেয়েকেই ভেতর ভেতর বিশ্বাসঘাতক নামক এক হায়েনা খেয়ে ফেলেছে। নয়তো মেয়ে কি তার এমন হতো? এমন নিস্তব্ধ হতো?
চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো বাবার। সন্তানের মনের রোগ সারাতে না পারার আফসোসে পুড়তে লাগলো অন্তর। যদি ক্ষমতা থাকো তবে ছোটোবেলার প্রিয় পুতুলটা কিনে দেওয়ার মতনই হয়তো মেয়ের বড়ো বেলার মানুষটাকে কিনে দিতো। বাবাদের কাছে মেয়ে সন্তান যে রাজকন্যা। তাই সেই রাজকন্যার সুখের জন্য বাবারা আকাশের চাঁদও আনতে প্রস্তুত।
শাহাদাতের নাম্বারটা আনব্লক করলো চাঁদনী। বুকের ভেতর কোনো সংশয় নেই আজ। নেই কোনো দ্বিধা, দ্বন্দ্ব। সবই বর্ষার জলের মতন স্বচ্ছ। পরাজয় যেহেতু ভালোবাসার হয়েছেই তবে শেষবেলার কথাগুলো কেন বাকি থাকবে? সব লেনাদেনা যেহেতু চুকে গিয়েছে তবে কেন গল্পের শেষ অংশের উত্তর মিলবে না?
হোয়াটসঅ্যাপে করা কলটি দ্বিতীয় বারের মাথায় রিসিভ করল শাহাদাত। কণ্ঠস্বর বেশ স্বাভাবিক। আনন্দের,
“কী খবর, চাঁদ?”
চাঁদনীর কণ্ঠ আজ কঠিন নয়। শান্ত। ঝড় আসার আগে যতটা শান্ত থাকে প্রকৃতি ততটাই শান্ত। এরপর সেই ঝড়ে সব ধ্বংস হয়ে যায়।
“বেশ ভালো। তোমার খবর কী?”
“আমারও বেশ ভালো। প্রমোশন পেয়েছি বুঝলে। এজন্য বেশ হ্যাপি। তা কী মনে করে কল দিলে?”
“কিছু প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছিলাম না। ভাবলাম তুমি যেহেতু প্রশ্ন তৈরি করেছো, উত্তরও তুমি জানবে।”
এবার শাহাদাত যেন ভড়কালো। সংশয় ভরা কণ্ঠে শুধালো, “হ্যাঁ, বলো না! কী জানতে চাও?”
চাঁদনীর স্বর আগের মতনই শান্ত, “আচ্ছা শাহাদাত, তোমার পাশবালিশে কে ঘুমায়?”
পৃথিবীর সবচেয়ে আশ্চর্যজনক প্রশ্নটিই বোধহয় শাহাদাত শুনলো। এমন ভাবে চমকালো যেন এত অদ্ভুত প্রশ্ন এর আগে কেউ কখনো জানতে চায়নি। নাকি ভুল শুনলো?
তাই কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বলল, “কী?”
চাঁদনী স্বাভাবিক স্বরেই আবার বলল, “বললাম, তোমার পাশবালিশটায় কে ঘুমায়?”
“এটা কেমন প্রশ্ন, চাঁদ! অবশ্যই আবার স্ত্রী ঘুমায়।”
“তোমার বারান্দাতেও কি ওর ভেজা কাপড় শুকোয় প্রতিদিন?”
শাহাদাত সম্মতি দিল, “হ্যাঁ।”
“তোমার ভেঁজা তোয়ালে, তোমার এলোমেলো আলমারি, তোমার অগোছালো সংসারটা সবই ও গুছিয়ে রাখে দেয় তাই না?”
“হ্যাঁ।”
“কেন গুছায়?”
শাহাদাতের হতবিহ্বল উত্তর, “কারণ এটা ওর সংসার!”
“অথচ সেই সংসারটা আমার হওয়ার কথা ছিলো তাই না? তুমি তো তা-ই কথা দিয়েছিলে। স্বপ্ন দেখিয়েছিলে। মনে আছে?” চাঁদনীর তাচ্ছিল্য ভরা কণ্ঠ। ওপাশে শাহাদাত নিশ্চুপ। সদ্য ঝড় হয়ে যাওয়া ধ্বংসাবশেষ প্রকৃতির মতনই স্থবির সে।
চাঁদনী আপন মনেই বলল,
“তোমার মনে আছে শাহাদাত? একবার বলেছিলে, আমাকে তুমি ততদিন ছাড়ছো না যতদিন না তোমার পাশবালিটায় আমার নিদ্রা হবে। আমায় কতই না স্বপ্ন দেখিয়ে ছিলে। বলে ছিলে সংসারের গল্প। আমাদের ছোটো একটা সংসার হবে। তোমার বারান্দায় আমার দৈনন্দিন কাপড় শুকানোর গল্প হবে। ঘুম থেকে উঠে বাসি মুখে একটি শুভ সকালের চুমু হবে। তোমার প্লেটের এক লোকমা ভাত আমার সবচেয়ে প্রিয় খাবার হবে। তোমার তোয়ালেতে আমার অধিকার হবে। বারান্দায় লাগাবো একটি নীলকণ্ঠ ফুলের গাছ। প্রথম ফুলটি এক গোধূলিতে আমার কানে গুঁজে দিয়ে সুন্দর একটা ছবি তুলে খাটের উপরে বড়ো করে বাঁধিয়ে রাখারও চুক্তি হয়েছিলো। এই যে এত-শত প্রতিশ্রুতি যে ভেঙে দিব্যি ভালো আছো, তোমার খারাপ লাগে না, শাহাদাত? ঘুম হয় রাতে? ঘুমাতে পারো শান্তিতে? এই যে আমার পুরো একটা ভবিষ্যত জুড়ে এত এত স্বপ্ন দেখিয়ে ছিলে সেগুলো তছনছ করে দিয়ে ভালো আছো? ভেতর ভেতর খারাপ লাগে না? আচ্ছা শাহাদাত, স্বপ্ন দেখানোর পর যদি পূরণই না করতে পারো তাহলে স্বপ্ন দেখাও কেনো তোমরা? আমাদের একটা জীবনের এত দুঃসহ স্মৃতি কেন তৈরি করে দাও বলো তো! হয়তো সময়ের সাথে সাথে আমরা ক্ষত গুলো সামলে নিই। মানিয়ে নিই নিজেদেরকে তোমাদের দেওয়া ক্ষতের বিশ্রী একটা দাগের সাথে। কিন্তু তোমাদের ক্ষমা করেন সৃষ্টিকর্তা?
তোমার বউকে বলেছো কখনো, তুমি যে ঠান্ডা মাথার খু নি? একদিন ওকে বলো, ওর সাথে তুমি যেই বিশেষ সময়গুলো উদযাপন করো সেগুলো আমার হওয়ার কথা ছিলো। যেই ভ্রুণটি ওর পেটে এসে দু’বার বিদায় নিয়েছে সেটাও আমাকেই মা ডাকার কথা ছিলো। ওর নামও আমাদের ঠিক করা ছিলো। এরপরে কোনো এক ভোরে যখন তোমার স্ত্রীকে কাছে ডাকবে তখন দেখো, বিদ্যুতের তারটিতে বসা কালো কাকটাও তোমায় বিদ্রুপ করছে। কারণ আর কেউ না জানলেও এই প্রকৃতি তো জানে, একটি চাঁদনীকে এক জীবন হাহাকার উপহার দিয়ে ছিলে তুমি। প্রকৃতি সব মনে রাখে। সব।”
কলটি বিচ্ছিন্ন হয়। শাহাদাত দাঁড়িয়ে থাকে তার বারান্দায়। চুপচাপ, শান্ত। ঝড় হয়ে গেছে। এই প্রলয়ঙ্কারী ঝড়ের পর চারপাশটা শান্ত। বুকের ভেতর যেই একটি অদৃশ্য সমুদ্র সেখানে বিশাল দানবীয় ঢেউ এসে আছরে পড়েছে। চারপাশ শান্ত থাকলেও অশান্ত বুকের সমুদ্র। হাঁসফাঁস করছে কেমন হৃদয়টা। ছেড়ে দেওয়া প্রেমিকাদের জমে থাকা প্রশ্নের ক্ষমতা বুঝি এতটাই!
চাঁদনীর বুকটা হালকা লাগছে। এত বছর যাবত শ্বাসকষ্টের রোগীর মতন যেই বুক ভারটা ছিলো আজ আর তা অনুভব হচ্ছে না। তার বুকের সমুদ্র আজ শীতল বইছে। অনেক প্রশ্নের উত্তর না পেয়েও শান্তি লাগছে। কখনো কখনো জমে থাকা প্রশ্ন গুলো বুকের ভেতর জমিয়ে রেখে আমরা নিজেদের ব্যথা বাড়াই। তাই সব জমলেও অভিযোগ জমতে দেওয়া যাবে না। অভিযোগ আমাদের শান্তি কেড়ে নেয়। আজ অনেকদিন পর চাঁদনীর ঘুম হবে। তৃপ্তির ঘুম। শাহাদাতের পাশবালিশটা পায়নি বলে আজ আর আফসোস হবে না। এই জীবনে কখনো কখনো কিছু মানুষকে বিছানা জুড়ে একলাই শুতে হয়। দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙলে একলাই সামলে নিতে হয়। সবার জন্য প্রসস্থ একটি বুক থাকে না। সবার জন্য গাঢ় আলিঙ্গন থাকে না। সবার জন্য ভরসার একটি কণ্ঠ থাকে না, যে কণ্ঠ বলবে— আমি আছি।
তাই নিজেকেই নিজের কণ্ঠ হতে হয়, ভরসা হতে হয়।
সারাদিনের বৃষ্টির পর থমকানো আকাশ। চাঁদ নেই সেখানে। মুখ ভার আকাশের কোথাও এক ফোটা আলো নেই। তার উপর মধ্য রাত। চিত্রা বসে আছে নিজের ঘরটাতেই। জ্বর এসেছে কাঁপিয়ে। সারাদিন এত বৃষ্টিতে ভিজলো যে জ্বর না এসে উপায় নেই। শরীরটা বড্ড খারাপ লাগছে তবুও বিছানার সাথে শরীর লাগালো না। বসে রইল ঠাঁই। একটু আগে ভাইজান বাড়ি ঢুকেছে। রাতে বাড়ি ফিরে প্রতিদিন গোসল করে ভাইজান। আজও হয়তো করছে। তাই সে সাথে সাথে ভাইজানের কাছে গেলো না। তাছাড়া আজ মানুষটা অনেক দেরিতে ফিরেছে। পুরো বাড়ির মানুষ এখন ঘুমে মগ্ন।
চিত্রা অসুস্থ শরীরটা টেনেহিঁচড়ে কোনোরকমে গিয়ে দাঁড়ালো ভাইজানের দরজার সামনে। দরজাটা আটকানো। চিত্রা খুব ধীর গতিতে টোকা দিলো দরজায়। সাথে সাথে ভাইজানের গমগমে গলার স্বর ভেসে এলো,
“কে?”
চিত্রা মিহি স্বরে জবাব দিলো, “আমি।”
বোনের কণ্ঠ পাওয়ার মিনিটের মাঝেই দরজা খুললো তুহিন। মাথার চুলগুলো তার ভেঁজা। গোসল করা শেষ। বোনকে এত রাতেও সজাগ দেখে কিছুটা ভ্রু কুঁচকালো। অবাক স্বরে বলল,
“তুই? ঘুমোসনি?”
চিত্রা সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে অনুমতি চাইল, “ভেতরে আসবো?”
তুহিন তৎক্ষণাৎ দরজা ছেড়ে দাঁড়ালো। ব্যস্ত কণ্ঠে বলল, “আয় না!”
ভেতরে গিয়ে বসলো চিত্রা। খাটের একটা কোনায় নিজে বসলো আরেকটা কোনায় ভাইকে বসার ইশারা করল। তুহিন এসে বসলো ঠিক।
বোনকে দেখে বেশ উদ্বিগ্ন হয়েই জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? শরীরটা কি তোর ভালো না? অসুস্থ লাগছে তো!”
চিত্রা সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়েই ভাইয়ের হাতে থাকা মোবাইলের দিকে তাকালো। মোবাইলে কিছু একটা হয়তো করতে নিয়ে ছিলো। চিত্রা প্রশ্ন করলো, “কিছু করছিলে ফোনে?”
তুহিন নিজের ফোনটার দিকে তাকালো। নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বলল, “হ্যাঁ। ফোন ধরে দেখি নিরু দশ বার কল দিয়েছে। এতগুলো কল দিলো কেন, কিছু হলো কি-না সেটা জানতেই কল দিচ্ছিলাম।”
ভাইজানের কথায় তাজ্জব বনে গেলো চিত্রা। তার মানে ভাইজান এত গুলো কলের একটা কলও ধরেনি এমনকি সারাটা দিন আর কলটা ব্যাক করার সুযোগও পায়নি! নিরু আপু তবে ঠিকই বলেছিল? সম্পর্ক পুরোনো হয়ে গেলে এমনটাই হয়? নিজের প্রেমিকার বিয়ে হয়ে গেছে এই খবরটা পাওয়ার পর ভাইজানের অনুভূতি কী হবে? সারাদিন কল না ধরার আফসোস কি হবে?
তুহিন নিরুর নাম্বার ডায়াল করল। কল দেওয়ার আগেই আটকালো চিত্রা।
“আর আজ কল দিও না, ভাইজান। আর কখনোই দিও না।”
বোনের কথায় কিছুটা বিস্মিত হলো বোধহয় তুহিন। বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে বলল, “কল দিবো না কেনোরে? পরে রাগ করবে আবার।”
যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ১২
” নিরু আপু আর তোমার উপর রাগ করবে না, ভাইজান। নিরু আপুর রাগ দেখার মানুষ হয়েছে যে!”
বোনের হেঁয়ালিপূর্ণ কথা বোধগম্য হলো না তুহিনের। কপালে ঘুচিয়ে বলল, “কী বলছিস!”
“কেন তুমি জানো না, নিরু আপুর যে বিয়ে হয়ে গিয়েছে?”