যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ৬

যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ৬
মম সাহা

মাথার উপর এসি চলছে। ঘর জুড়ে তীক্ষ্ণ ঠান্ডার বিচরণ। কোনো কোলাহল নেই, বাহিরের ব্যস্ত শব্দ নেই। দরজা, জানালা বন্ধ বিধায় কোনো শব্দ ঘরে আসতে পারছে না। লিমন নামের ছেলেটির গালে হাত। চোখে এক আকাশ পরিমাণ বিস্ময়। কেবল লিমনের নয়, ওর বাবা-মা এবং সদ্য বিবাহিত স্ত্রীও অহির দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে।
নাতাশা বেগম মেয়ের চট করে চড় দিয়ে উঠার কাজে অতি রাগান্বিত হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন,
“অহি, কী করলে তুমি? অভদ্রতার চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেছো!”
অহি মায়ের রাগকে তোয়াক্কা করলো বলে মনে হলো না। বরং বেশ বিরক্তি নিয়ে বলল, “আপনি চুপ করুন।”
এবার লিমন ভাইয়ের বাবা ফারুক চাচ্চু ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বললেন,

“আরে ভাবি, দাঁড়ান দাঁড়ান, অহি মা হয়তো মজা করছে।”
এতক্ষণ অহি ঠান্ডা থাকলেও এখন আর ঠান্ডা থাকতে পারলো না। প্রচন্ড রাগে থরথর কাঁপতে কাঁপতে বলল,
“মজা করে কেউ কারো গালে চড় দিতে পারে তা আমার জীবনে আমি প্রথম শুনলাম। তবে চাচ্চু আপনি ভুল। আমি মজা করে উনার গায়ে হাত দেওয়ার মতন মেয়ে নই। চড়টা আমি ইচ্ছেকৃত দিয়েছি। এবং এটা উনি প্রাপ্য।”
“কিন্তু কেন, আম্মু? লিমন কী এমন খারাপ করেছে?”
অহি বাঁকা ঠোঁটে ভীষণ হেলায় তাচ্ছিল্য হাসলো। লিমনের পাশে বসে থাকা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে তার মায়াও হলো। নতুন বউ মুখ নামিয়ে আছে। অহি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল,
“কিছু মনে করবেন না, ভাবী। আপনার হাসবেন্ড একজন পটেনশিয়াল রেপিস্ট। তাই তার গালে চড়টা দিতে বাধ্য হলাম।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

লিমন এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও এখন মারাত্মক রেগে গেলো। হম্বিতম্বি করে সোফা ছেড়ে উঠে চেঁচিয়ে বলল, “অহি, বাড়াবাড়ি করছো। কোন কারণে তুমি আমাকে রেপিস্ট বলছো? তোমায় কিছু করেছি আমি? কোথাও ধরেছি?”
রেগে গেলেন লিমনের মা-ও। বললেন, “ঠিকই তো, অহি। তুমি আমার ছেলেকে রেপিস্ট কেন বলছো? কোন কারণে? তোমাকে ও কিছু করেছে?”
অহি এবার তপ্ত শ্বাস ফেললো। কতক্ষণ তাকিয়ে রইল ঘরের প্রতিটা মানুষের দিকে। মনে মনে বড়ো হাসি পেলো এরা শিক্ষিত ভেবে।

“পটেনশিয়াল রেপিস্ট মানে সম্ভাব্য ধর্ষক। আজকে আপনার ছেলের ভেতরেই একজন সম্ভাব্য ধর্ষক লুকিয়ে আছে, চাচাী। আপনার ছেলে পাশে বউ রেখে বলছে তার না-কি আমার জন্য অপেক্ষা করা উচিত ছিলো, বিয়ে করা ভুল। শুধু তা-ই না, সে আমাকে সোশ্যাল মিডিয়ায়ও এমন এমন মন্তব্য করে যে তার ঘরে বউ আছে কেউ ধরতে পারবে না। আমার ছবি দেখে ইনবক্সে সে বলে আমার গালের ডান দিকের তিলটা দেখে তার না-কি শিহরণ জাগে। এসবই একজন সম্ভাব্য ধর্ষকের লক্ষ্মণ। যার মেয়েদের দেখলে শরীরের অঙ্গ গুলো অসংযত হয়ে উঠে সে-ই একদিন কোনো এক মেয়েকে একা পেয়ে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারবে না। আমাদের সমাজের সমস্যা হলো কী জানেন? আমরা যতক্ষণ না প্র্যাক্টিক্যালি কিছু হচ্ছে ততক্ষণ কোনো কিছুকেই বড়ো ব্যাপার মনে করি না। বাজে আকার-ইঙ্গিতকে সামান্য মজা-ঠাট্টা ভেবে উড়িয়ে দিই। এবং এগুলোই একজন ধর্ষক তৈরি করতে সাহায্য করে। আমি ভেবে অবাক হই, আপনারা সবাই-ই না-কি শিক্ষিত অথচ একজন পটেনশিয়াল রেপিস্টের করা অন্যায়কে আপনারা নিতান্তই মজা হিসেবে রেখে দিচ্ছেন।”

অহির কথা থামলো। চোখের কোণা মেয়েটার লাল হয়ে এসেছে রেগে। অবনী বেগমের সাথে তার এই দিকে মিল৷ অতিরিক্ত রেগে গেলে চোখের কোণাটা লাল হয়ে যাবে। নাতাশা বেগম মেয়েকে আর কিছু বললেন না। অহি গটগট করে চলে গেলো ভেতরে। বেশ শব্দ করে আটকে দিলো ঘরের দরজাটা। অহি ঠান্ডা মেজাজের মেয়ে কিন্তু রেগে গেলে তার আচরণ খুবই হিংস্র হয়ে যায়। রাগ কমাতে সে কল দিলো অবনী বেগমকে। এখন এই মানুষটার সাথে কথা বলা খুব দরকার। এই একজন মানুষ যে এখন অহির মন শান্ত করতে পারবে।

চাঁদনীর আজ কোনো কাজ নেই। বুটিক হাউসেও যেতে ইচ্ছে করছে না। শরীরটা বেশ খারাপ লাগছে। ঘুম থেকে উঠার পরই মাথা ধরেছে যে সেটা আর কমছে না। বাহিরের আকাশে আজ রঙ নেই। ধূসর সাদা আস্তরণে বন্দী এই এক খন্ড সুন্দর দেশটি। তুলোর মতন চারপাশে যেন বরফ বিছিয়ে আছে।
ঘরে থাকতে থাকতে প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে অবশেষে সে ঠিক করলো একটু বাহিরে যাবে। লেক জেনেভার কাছটাতে গিয়ে বসবে। ভাবনা অনুযায়ী সে তৈরি হয়ে নিলো। মোটা একটা শীতের পোশাক, কালো টুপিটা পরে নিলো। শীতে গলাটাও বসে আছে। তবুও এই বরফের মাঝে বসে থাকার তার একটা লোভ জন্মেছে।
রাস্তায় তেমন জনমানস নেই। নিরিবিলি চারপাশটা। চাঁদনী হাঁটতে হাঁটতে এসে পোঁছালো লেকটার সামনে। কাঠের বেঞ্চি গুলোতে বরফ জমে জমে হাওয়ায় মিঠাইয়ের মতন দেখাচ্ছে যেন। চাঁদনী কিছু বরফ সরিয়ে বসলো। লেকটার চারপাশে কিছু সংখ্যক মানুষের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। চাঁদনীর মাথা ধরাটাও যেন কিছুটা কমে এসেছে। শান্তি শান্তি পরিবেশে শরীরটাও যে শান্তিতে ভরে গেছে। চাঁদনীর এক দৃষ্টিতে পরিবেশ দেখার মাঝে বাঁধা হলো পকেটের ফোনটা। বেশ শব্দ করেই রিং হলো ফোনটাতে। চাঁদনীর মোটেও ইচ্ছে হলো না ফোনটা ধরার কিন্তু অনবরত রিং হওয়ায় বাধ্য হয়েই ধরলো। যদিও তার মা ভিডিও কল করেছিলেন সে কেটে অডিও কল দিল।
চাঁদনীর কল দিতে দেরি অথচ অপরপাশ থেকে রিসিভ করতে দেরি হলো না রোজা সওদাগরের। রিসিভ করেই ক্রন্দনরত স্বরে বললেন,

“কিরে মা, তোর কি আমাদের কথা একটুও মনে পড়ে না?”
মায়ের এই করুণ কণ্ঠে আপাতদৃষ্টিতে সবারই মায়া হওয়ার কথা কিন্তু চাঁদনীর হলো না মায়া। বরং সে কাঠ কাঠ গলায় বলল, “কী বলবে সোজাসাপটা বলো।”
রোজা সওদাগরের কণ্ঠ এবার পাল্টে গেলো নিমিষেই। এতক্ষণের কান্না, মায়া-মমতার কণ্ঠ হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো যেন। কিছুটা গম্ভীর হয়েই বললেন, “তোর ভালো-মন্দ নিয়ে কি আমরা ভাবতে পারি না? তোরে জন্ম দিয়েছি আমরা। ভুলে যাচ্ছিস?”
“ভুলে যাইনি বলে এখন কলটা রিসিভ করলাম।”
রোজা সওদাগরের কণ্ঠে এবার আবার কোমলতা দেখা দিল, “দেখ মা, তোর বয়স তো কম হচ্ছে না। একত্রিশে পড়ে গেছে। আর কতদিন একা থাকবি?”
“যতদিন মানুষের কথা শুনলেই ভয় লাগবে, আতঙ্ক লাগবে ততদিন একা থাকবো। আর বিয়ের কথা বললে আমি ফোনই অফ করে দিবো, আম্মু।”

“মানুষের নাতি-নাতনি বড়ো হয়ে যাচ্ছে। আর আমার একটা মাত্র মেয়ে তার…..”
মাকে বাকি কথা আর সম্পন্ন করার সুযোগ দিলো না চাঁদনী। তার আগেই ফোনটা কেটে অফ করে দিলো। রোজ রোজ একই কথা তার আর ভালো লাগছে না। বিয়ে, বিয়ে আর বিয়ে। বিয়ে ছাড়াও তো জীবন চলে। মা জানেন যে তার মেয়ে কতটা ভেঙে গিয়ে এ দেশে চলে এসেছিলো তবুও কেন বার বার বিয়ের কথাই তুলেন? কেন একটু বুঝতে চান না মেয়েটার মনে কী চলে। কোনোদিন ফোন দিয়ে আগে জিজ্ঞেস করেছিলেন কি যে মেয়েটার শরীর ভালো আছে কি-না? করেননি। সবার আগে বলেছেন, বিয়ে কবে করবি। কেন? মেয়ে হয়েছে বলে কি এতই বোঝা হয়ে গিয়েছে সে? তার মনের মূল্য কি একটুও দেওয়া যায় না?

এতক্ষণ যেই ভালো লাগা অন্তরে জুড়ে বিস্তৃতি লাভ করে ছিলো সেই ভালো লাগাটা আর অবশিষ্ট নেই। বিরক্তিতে মুখটা ভোঁতা হয়ে এলো। কই গেলে যে একটু শান্তি মিলবে! চোখ বন্ধ করে কতক্ষণ বসে রইল সে এক ধ্যানে। চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই পুরোনো বাচ্চা মুখের ছেলেটার দুষ্টুমি। চাঁদনীকে পাওয়ার জন্য পাগলামি। আর সে-ই পাগলামি থেকে মস্ত বড়ো ভুল।
ভেসে উঠলো বহু আগের প্রেমিকের মুখ খানা। কতই না সুন্দর ছিলো সেই প্রেমের পথটা! অথচ…..
ভাবতে ভাবতেই বুক ভারি হয়ে উঠে। তপ্ত শ্বাস ফেলে চোখ খুলে তাকায় সে। পাশে কারো একটা অবয়ব দেখতে পেয়ে উঠে দাঁড়ায় বেঞ্চ থেকে। অপরিচিত মানুষের সাথে বসতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না কখনোই।
দু’ কদম এগিয়ে গিয়ে কী মনে করে যেন সে ধীরে ধীরে পেছন ফিরে তাকালো। তাকাতেই চমকে উঠল আত্মা। হৃদয়ের ধ্বনি থেমে গেলো অগোচরেই। শ্বাসটাও ঠিকঠাক নিতে পারলো না বোধহয়। দীর্ঘ আড়াইটা বছর পর সেই পরিচিত মুখটি দেখে কেমন ঘোর লেগে এলো।

চিত্রার ভার্সিটির কাজ শেষ হতে হতে সন্ধ্যা হলো আজ। শাহবাগের মোড়টায় তুমুল জ্যাম। তার উপর সারা বিকেল ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির কৃপায় রাস্তা হয়ে আছে কাঁদা চিপচিপে। চিত্রা ভাবলো আরেকটু সামনে গিয়ে রিকশা নিবে। ফুলের দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে তার ভীষণ ভালো লাগে।
সে হাঁটতে শুরু করল তাই।
চিত্রার সবুজ ওড়নার এক সাইডে ধরল কেউ। থেমে গেলো চিত্রার চঞ্চল পা। কাজল লেপ্টে এলোমেলো দেখানো আঁখিদ্বয় ঘুরিয়ে তাকালো সে পেছনে। বাহার ভাই দাঁড়ানো। ভোরের সদ্য উদিত সূর্যের মতনই ঝকঝকে হাসি ঝুলানো ঠোঁটে। নির্ভেজাল স্বরে বলল,
“বেলি ফুলের মালা নিবে না, রঙ্গনা?”
চিত্রা চোখ ঘুরিয়ে ফুলের দোকানে থাকা মহিলাটির দিকে তাকালো। মহিলা বড়ো বড়ো চোখ করে তাদের ওড়না ধরে রাখা দৃশ্যেই তাকিয়ে আছে৷

চিত্রা দাঁত কিড়মিড়য়ে বলল কেবল, “ওড়নাটা ছাড়ুন।”
বাহার ছাড়লো না ওড়না। বরং আরেকটু শক্ত করে ধরে বলল, “তুমি বেলিফুলের মালা না নিলে ছাড়বো না।”
চিত্রার এবার রাগ হলো না অভিমান হলো ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। তবে চেঁচালো ঠিক। ধমকে বলল,
“মামার বাড়ির আবদার পেয়েছেন? যা ইচ্ছে তা করবেন?”
এই অপ্রত্যাশিত চিৎকারের পর অনেকেরই দৃষ্টি তাদের দিকে পড়লো। বাহার ছেড়ে দিলো ওড়নার কোণাটা। মাথা নামিয়ে চলে গেলো সাথে সাথে। চিত্রার এবার বাড়াবাড়ি রকমের খারাপ লাগলো। মনে মনে আফসোস করলো এত বাজে আচরণের জন্য। সতেজ বেলিফুলের মালাগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হলো ছিঁড়ে ফেলতে সবগুলো।
চিত্রার চোখে তখন জল চিকচিক। রাস্তার কিনারায় হলুদ বাল্বের আলোয় অশ্রুগুলোকে লাগলো স্বর্ণের খন্ড। মনে মনে সে কী আফসোস হলো! লোকটা কষ্ট পেলে যে আজও তার বুক কাঁপে!
এক রাশ মন খারাপ নিয়ে যখন চিত্রা পা বাড়াতে নিবে তখনই আবার চনমনে কণ্ঠের বাহার ভাই হাজির হলো। হাতের আইসক্রিমটা এগিয়ে ধরে বলল,

“নাও তো, রঙ্গনা, আইসক্রিমটা খাও। মনে হয় প্রেশার বেড়ে গেছে তোমার। এজন্য রেগে যাচ্ছো। আইসক্রিমটা খাও, মাথা ঠান্ডা করে এরপর চিৎকার করো। ধরো।”
চিত্রার চোখে-মুখে বিস্ময়। তবে কি লোকটা যায়নি! বিস্ময়ে সে জিজ্ঞেসই করে বসলো,
“আপনি যাননি?”
বাহারের সহজ সরল উত্তর, “না তো, আইসক্রিম আনতে গিয়েছিলাম। তোমার তো পছন্দ!”
চিত্রার কী যেন হলো! বুকের ভেতর জমে থাকা পাহাড় যেন একটু গললো। হাত বাড়িয়ে সে আইসক্রিমটা নিলো। ভারি কণ্ঠে বলল, “ভেবেছিলাম চলে গেছেন। আপনার তো আবার ছেড়ে যাওয়ার স্বভাব আছে।”
বাহার আবারও হাসলো। লোকটা আজকাল কারণে-অকারণে হাসে।

যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ৫

বাহার হাসতে হাসতে একটা বেলিফুলের মালা চিত্রার বা-হাতে প্যাঁচিয়ে দিতে দিতে বলল,
“ছেড়ে যে যায় সে ফিরে আসার জন্য যায় না। আর যে ফিরে আসে সে আসলে ছেড়ে যেতে চায় না। এই ছোটো ছোটো পার্থক্য না বুঝলে প্রেমিকা হওয়া যায় না, রঙ্গনা। প্রেমের প্রধান শর্তই হলো অভিমানের উর্ধ্বে রাখতে হবে বিশ্বাস ও বোঝাপড়া। বোঝাপড়া না হলে প্রেম যে বাড়ে না, আমার ক্যানভাসের প্রেমময়, চিত্র।”

যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ৭