যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ৯
মম সাহা
বুটিক হাউজে আজ বেশ কাস্টমারদের আনাগোনা চলেছে। ব্যবসায়ের ঘর সামলাতে সামলাতে ক্লান্ত চাঁদনী। বুক ভরে শ্বাস নেয়। পিঠটা এলিয়ে দেয় আরাম কেদারায়। ঘাড়টা চিনচিন করছে বেশ। এই ঠান্ডায় জমে যাওয়া ক্লান্তিতে একটু চা কিংবা কফির বড়ো অভাববোধ করে। ঠিক তখনই তার কেবিনটায় হুড়মুড় করে কেউ প্রবেশ করল। চাঁদনী চোখ মেলে তাকাতেই দেখলো মৃন্ময় দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটে তার ঝুলানো হাসি। বিনা অনুমতিতে এগিয়ে এসেই চাঁদনীর বিপরীতে থাকা চেয়ারটায় বসে পড়লো।
মৃন্ময়কে এখানে দেখে সে তেমন চমকালো না। ঐ দিন লেকের সামনে দেখেই যা চমকানোর চমকে ছিলো। যেই মুখটাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বড্ড তোরজোর সেই মুখটাকে বহুদিন পর দেখে চাঁদনীর যেন বলার ভাষা হারিয়ে গিয়ে ছিলো। কেবল ড্যাবড্যাব করে কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলো নির্নিমেষ। এরপর মৃন্ময়ই আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো কেমন আছে চাঁদনী। মৃন্ময়ের করা বিরাট অন্যায়ের পর তার সাথে অন্য কেউ হলে হয়তো কথা বলতো না, ঘৃণা করতো কিন্তু চাঁদনী তা করেনি। বরং নিজেকে বেশ পটু হাতে সামলে উত্তর দিয়েছিলো, বিপরীতে জিজ্ঞেস করেছিলো মৃন্ময়ের হালচাল। মানুষের জীবনটাই এমন। একটা বয়সের পর আর কারো প্রতি রাগ করতে ইচ্ছে করে না। অভিমানে কারো থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার আগ্রহ জাগে না। চাঁদনী জীবনের ঠিক সেই পর্যায়ে চলে এসেছে। এই জীবনের প্রতি কিংবা এই জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকা কারো প্রতিই তার আর কোনো টান কাজ করে না।
মৃন্ময় চেয়ারটায় বসেই চেয়ার দোলানো শুরু করলো। অকপটে শুধালো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আপনি দেশে যাবেন কবে, ইন্দুবালা?”
চাঁদনীর কোনো ব্যস্ততা নেই, নেই কোনো কাজের অজুহাত তাই না চাইতেও মৃন্ময়ের দিকে তাকাতে হলো। এড়িয়ে যাওয়া যেতো চাইলেই কিন্তু সে এড়িয়ে গেলো না। এই জীবনে কত সে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াবে? কখনো কখনো একটু তারও তো দাঁড়িয়ে জিরিয়ে নিতে ইচ্ছে হয়!
চাঁদনী নিচু স্বরে উত্তর দিলো, “জানি না ঠিক।”
“জানেন না? আড়াই বছর যাবত নিজের মানুষদের রেখে এখানে পড়ে আছেন, একটুও মনে পড়ে না তাদের কথা?”
মৃন্ময়ের কথায় বুক চিরে বেরিয়ে আসতে চাইলো দীর্ঘশ্বাস কিন্তু চাঁদনী তা বের হতে দিলো না। বুকের ভেতর জোর করে চেপে রেখে বেশ সাবলীল ভঙ্গিতে বলল,
“আমি এখানে এটা জেনেই এসেছি যে আমার কাছের মানুষদের দীর্ঘদিন দেখা হবে না। তাই বাচ্চা বাচ্চা মন খারাপ আমার হয় না।”
“চা খাবেন, ইন্দুবালা?”
“তুমি আমার চেয়ে চার বছরের ছোটো, মৃন্ময়। তাই অন্তত নাম ধরে না ডেকে আপু ডেকো।”
“আপনার নাম তো চাঁদনী! ইন্দুবালা কবে থেকে হলো?”
চাঁদনী এবার থতমত খেলো। ইশ্ সত্যিই তো! ছেলেটা কেমন করে আজও তাকে প্রশ্নের বাণে জর্জরিত করলো!
চাঁদনীকে চুপ থাকতে দেখে মুচকি হাসলো মৃন্ময়। যেন কথার খেলায় জিতে গিয়ে বিরাট কিছু অর্জন করে ফেলেছে। চাঁদনী কতক্ষণ চুপ থেকে নিজের ভ্যাবাচেকা ভাব কাটিয়ে উঠে বলল,
“কোনো কাজ আছে এখানে, মৃন্ময়? নয়তো চলে যাও। এতক্ষণ কেউ এখানে বসে থাকলে ব্যাপারটা কেমন দেখাচ্ছে।”
“না কাজ নেই। ব্যথা করছিলো তো তাই ভাবলাম একটু এসে বসি।”
চাঁদনী ঠিক বুঝলো না মৃন্ময় কী ব্যথা করার কথা বলল! না-কি শুনতে পেলো না! তাই আবার জিজ্ঞেস করল,
“কী ব্যথা করছে? পা?”
মৃন্ময় বেশ স্বাভাবিক স্বরে উত্তর দিলো, “না তো। মন ব্যথা করছিলো। আড়াই বছর আপনাকে না দেখতে দেখতে আমার মনটার ভীষণ ব্যথা হয়েছে জানেন?”
চাঁদনী এবার গাঢ় চোখে তাকালো। মৃন্ময়ের ঠোঁটে চাপা হাসিটা তখনও দৃশ্যমান। মেয়েটার মনে মনে কিছুটা রাগ হলো। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো, আড়াই বছর পর বুক ব্যথার কথা মনে পড়লো কেন ছেলেটার। কিন্তু জিজ্ঞেস আর করলো না। জিজ্ঞেস করা মানেই যে উস্কানি দেওয়া, ছেলেটাকে বুঝানো যে সে খুব আগ্রহী ছেলেটাকে নিয়ে। অথচ চাঁদনী তো এটা বুঝাতে চায় না! তাই নিজের ভাবনা নিজের ভেতরই চাপা রাখলো। চেয়ারটা ঘুরিয়ে নিলো আলগোছে। স্বচ্ছ কাঁচের জানালাটা দিয়ে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে রাস্তাটা। চাঁদনী সেদিকে দৃষ্টি দিলো। বিড়বিড় করে বলল,
“তোমার বুক ব্যথা কমলে চলে যেও, মৃন্ময়। বার বার অন্য কারো অস্বস্তি হইও না।”
মৃন্ময়ের চাপা হাসিটা দমে গেলো। হতাশ শ্বাসের স্রোতে ভরে গেলো বুকের আঙিনা। লজ্জায় মাথাটা আরেকটু নামিয়ে নিলো।
সওদাগর বাড়িতে যেন বহু বহু দিন পর আনন্দের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। হাসছে প্রাচীর ঘেঁষা আঙিনা, কাঠের বাক্সটাও। ছাদের ফুলগুলোতে আজ বোধহয় ভ্রমরও এসেছে। চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে আনন্দ। শুধু কমতি বাড়ির বড়ো মেয়েটার। ও এলেই যেন ষোলোকলা পূর্ণ হয়ে যেতো।
অহি আসার সুবাদে বাড়িতে হরেক রকমের খাবার রান্না হয়েছে। খাবার সাজাতে ব্যস্ত বাড়ির বউরা। খাবার টেবিলে পা দুলিয়ে গল্প করছে বড়োরা। পোলাও আনতেই চিত্রা বহু পুরোনো অষ্টাদশীর মতন লাফ দিয়ে বললো,
“ছোটো মা, আমায় আগে দাও। পেটে সয় না।”
অবনী বেগম হেসে দিলেন। সত্যি সত্যি চিত্রার কাছেই আগে এলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে পোলাও দিলেন প্লেটে। নুরুল সওদাগর নিজের পাশের বেগুনি রাখা প্লেটটা থেকে মেয়ের প্লেটে বেগুনি দিলেন। সবসময়ের মতনই তিনি রইলেল গুরুগম্ভীর। তুহিন ফোঁড়ন কেটে বলল,
“আব্বু, আমাদেরও বেগুনি দেন।”
মিটমিটিয়ে হাসলো সকলে। নুরুল সওদাগর যথারীতি মুখ গম্ভীর করেই জবাব দিলেন, “নিজে নিয়ে নাও।”
তুহিন এবার হেসে দিলো। বোনকে চোখ টিপ দিয়ে বলল, “আজকাল চিত্রার ভাগ্যেই সব ভালোবাসা পড়েছে। আমাদের তো কেউ ভালোবাসবে দূর, বেগুনিও দেয় না।”
কথা শেষ করে সমস্বরে হেসে উঠলো সকলে। চিত্রাও হাসলো তার তালে অথচ চোখের কোণায় জল তখনও থৈ থৈ করছে। তার কত বছরের স্বাধ ছিলো বাবা তাকে এরকম যত্ন করবে! অবশেষে সেই স্বাধ পূরণ হচ্ছে। তার আনন্দ হবে না? আর আনন্দ হলে তো একটু চোখে জল আসবেই।
চিত্রার দিকে তাকিয়ে নুরুল সওদাগর বুক ভরে শ্বাস নিলেন। মেয়েকে যে কবে এতটা ভালোবেসে বুকের মাঝে পুষেছেন তার ঠিক খেয়াল ছিলো না। মেয়েকে যে এতটা তিনি ভালোবাসেন সেটাই অনুভব করেছেন বড্ড দেরিতে। মেয়েটা যখন তার পাগল পাগল হয়ে উঠেছিলো, মৃত্যুর জন্য ছিলো মরিয়া তখন তিনি বুঝেছেন মেয়েকে ছাড়া তিনি এক বেলাও ভালো থাকবে পারবেন না। সম্ভব না।
খাওয়া দাওয়া শেষে সোফায় বেশ আয়েস করে বসল অহি। চিত্রা আগে থেকেই বসা ছিলো বিধায় গায়ের সাথে গা লাগলো। অহিকে দেখে মিষ্টি হাসলো চিত্রা। রুগ্ন মুখে হাসিটা কেমন কঙ্কালসার লাগছে! অহি আপা গাঢ় চোখে বোনের দিকে তাকালেন। চোখের চশমাটা আঁটসাঁট করে চোখের সাথে লাগিয়ে বলল, “কিরে, আজকাল হাসছিস না-কি আগের মতন? ব্যাপার কী?”
“কই না তো, তেমন কিছু নয়।” চিত্রা চোরা উত্তর।
অহি আপা বিজ্ঞদের মতন মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “শুনলাম বাহার ভাই নাকি এসেছেন?”
চিত্রা এবার চোরা চোখে তাকালো। বিড়বিড় করে বলল, “জানি না।”
“জানিস না? আচ্ছা ঠিক আছে। বাই দ্য ওয়ে, দেখেছিস আজ বাহার ভাই কালো টি-শার্ট পরেছেন যে? কালোতে উনাকে দারুণ মানায়।”
চিত্রা সহমত পোষণ না করে ঘোর আপত্তি জানালো। কপাল কুঁচকে বলল,
“কই না তো! আজ তো উনি নীল রঙের শার্ট পরেছেন!”
“ও নীল রঙের? তাও শার্ট? বাহার ভাই এসেছেন নাকি সেটা জানিস না অথচ কী রঙের শার্ট পরেছেন সেটা জানিস। বাহ্! ইন্টেলিজেন্ট।”
হাতেনাতে এভাবে ধরা পরে যাওয়ায় জিব কাটলো চিত্রা। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেলো মিনিটেই। অহি আপা হেসে উঠলেন সেই গুটিয়ে যাওয়া দেখে। ঠাট্টা করে বলল, “প্রেমের মরা জলে ডুবে না….. এই গানটা আমরা সবাই জানি, চিতা বাঘ। আর এই গানটা যে তোর জন্য তৈরি সেটাও জানি। ভালোই তো বাসিস, লুকানোর কী আছে?”
চিত্রার হাসি হাসি মুখ এবার মিইয়ে গেলো। থেমে গেলো তার সমস্ত আনন্দের জোয়ার। বদ্ধ স্মৃতির দেয়ালে চিৎকার করে উঠলো বিচ্ছেদের শোক। ঐ যে সেদিনটা, যেদিনটার স্বপ্ন ছিলো চিত্রের বুকে বৃহৎ, আশা ছিলো রাজ্যসম, যেই দিনটায় বাহার ভাই নামক মানুষটা তার সব শখ ভেঙেচুরে একসার করে ফেললো, সেই দিনটার পর আর কি সে ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারে? সাহস করে ভালোবাসার আবদার করতে জানে?
অহি থম মেরে যাওয়া চিত্রার দিকে তাকালো। মেয়েটার চোখ-মুখ ভাবুক। অহি আর কিছু বলার আগে চিত্রা উঠে ধপধপ পা ফেলে চলে গেলো নিজের ঘরে। আটকে দিলো দরজা। বারান্দা থেকে তখন দেখা যাচ্ছে দুপুরের সূর্যটার নিচে দাঁড়িয়ে একটা লোক অনবরত গিটার বাজাচ্ছে। এই তো সামনের বিল্ডিং এর ছাদটায়। শার্টে যেন এই অন্য এক আকর্ষণীয় পুরুষের দর্শন পেলো। এই বাহার ভাই শুকনো প্রেমের পুকুরে যেন পদ্মার ঢেউ তুলতে জানে। চিত্রা তাকিয়ে রইলো সেদিকে। বাহার ভাই তখন গান তুলেছেন,
“তোমারে আমি যে কত ভালোবাসি গো,
বুঝাবো কেমনে, বুঝাবো…..”
যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ৮
ছাঁদের কিনারায় একটি মেয়েকেও লক্ষ্য করা গেলো। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। চিত্রার বুকে কাঁপন জাগালো। সে ছাড়াও ঐ ছাঁদটায় দাঁড়ানোর অধিকার কে পেলো ভেবে চিত্ত হলো বিচলিত। ওরম মুগ্ধ নয়ন সে ছাড়া আরও কেউ ধারণ করুক বাহার ভাইয়ের জন্য সেটা কি ও কখনো চেয়েছিলো?