রং পর্ব ১৮
তন্নী তনু
“ভালোবাসি..ভালোবাসি..ভালোবাসি..ভালোবাসি
ভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসিভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসিভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসিভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসি
ভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসি
ভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসি”
রাত গভীর থেকে গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে। দুটো মানুষ নিশাচরের মতো নির্ঘুমে কাটিয়ে যাচ্ছে রাত। একজন এখনো নিরবে চোখের জল ফেলছে অপর জন এখনো শান্তনা দিয়েই যাচ্ছে। কিন্তু ফলাফল একই। নানা রকম স্মৃতিচারণ করে রিমা নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। ঐদিকে তিথির ফোনে মেসেজ থামছেই না। কোথা থেকে কোন পাগলের আবির্ভাব যে ঘটলো তা কে জানে। বিরক্ত হয়ে শেষের তিন ঘন্টায় আসা মেসেজ সে দেখেও নি। রিপ্লাই ও করেনি। তবে ফোনটা মেসেজের শব্দে কিছুক্ষণ পরপর মৃদু কেঁপে উঠছে। তিথি ফোনটা তোলে। অসংখ্য মেসেজ। এত পড়ার ধৈর্য্য নেই। শেষের একটা মেসেজে তার চোখ আটকায়,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— নিজের উপর কি তোমার কনট্রোল নেই সুহাসিনী?
কথাটা শুনে তিথির মাথা আগুনের মতো গরম হয়। তিথি ফোনের কি বোর্ডে টাইপ করে,
— মাথা খারাপ?
–নাহ! মনটা ভিষণ খারাপ। আমার “সপ্নে আঁকা পরী” প্লিজ কথা বল….
–আচ্ছা! আপনি কি করে জানলেন?আমি মেয়ে! এতো কনফিডেন্স নিয়ে কি করে কথা বলছেন?
–তোমার সীমটা “তানজিলা তিথি” নামে রেজিস্ট্রি হয়েছে। বাকি খোঁজ খবরও নিয়েছি!
–মানে! আমি তো মেসেজটা এসপি” সিনহার নম্বরে দিয়েছিলাম। আপনি কে?
–আমি সিনহা নই এতটুকু সিউর….
–কে আপনি!
–এসে দেখে যাও….
–মানে?
–মানে কাল এসো!মিট করি….
— পাগল নাকি?
–হুম….. তোমার জন্য…
–আজব প্রাণী…. আপনি কি চান?
–ভালোবাসতে চাই!
–আপনি কি পাগলাগারদ থেকে কথা বলছেন!
— যেখান থেকেই বলি! তবে আমার “ভালোবাসা” সত্য।
–ওয়েট… মেসেঞ্জার আছে আপনার?
–হুম
— “তিথি প্রীতি” এই আইডিতে রিকুয়েস্ট দেন…
ছেলেটি রিকুয়েস্ট দেয়। ছেলেটির আইডি নাম লিখতে কোন জগতের অক্ষর ব্যবহার করা হয়েছে। শত চেষ্টায় উচ্চারণ করতে পারলো না তিথি। আইডিতে নেই কোনো ছবি। তিথি নিজের ফোন থেকে বহু আগের রাখা একটি মেয়ের ছবি দিলো তিথি। আল্লাহর সৃষ্টি কোনো কিছুই অসুন্দর নয়। তবে একটা কুৎসিত ছবি তিথি ছেলটিকে দিলো। তারপর তিথি টাইপ করলো,
–এইটা আমি…পছন্দ হয়েছে?
ওপর পাশে দেখার পর ছেলেটি বললো,
— এর চেয়ে ভোটার আইডি কার্ডের পিক বেশী খারাপ ছিলো। তাতে কি পালিয়ে গেছি।ভালোবাসা সুন্দর-অসুন্দর বিচার করে হয় নাকি। পাগলি মেয়ে। আর এটা তুমি নও তিথি….. তোমার একটা মেজেস আমার মনে এতোটা দাগ কেটেছে।যে একটা নম্বরের সূত্র ধরে তোমার সব নিউজ নিয়ে ফেলেছি!
— কিন্তু কেনো?
— ভালোবাসতে চাই। তোমার দুঃখগুলোর ভাগ নিতে চাই। শুষে নিতে চাই তোমার সমস্ত যন্ত্রণা….
— কিন্তু কেনো!
–ভালোবাসি!
–এভাবে কি করে ভালোবাসা হয়?
–ভালোবাসা কারণ দেখে হয় না। ভালোবাসা শুধুই ভালোবাসা।
–কিন্তু আমাকে ভালোবাসবেন কেনো?
–কারণ ছাড়া ভালোবাসি!ভালোবাসি তাই ভালোবাসি।
–উফফ
–ব্যাথা পেলে…..
–এতো বিরক্ত কেউ করে?
–বিরক্ত হও কেনো?
–আপনি প্লিজ মেসেজ দিবেন না।
–দিবো….একশো বার দিবো….
–হাজার বার দেন। কোটি বার দেন। আই ডোন্ট কেয়ার!
— “আমার ভালোবাসা তোমাকে পৃথিবী ভুলিয়ে দিবে সুহাসীনি। আমার জন্যে তুমি একদিন সব ছাড়বে….”
এরপরেই ওপাশ থেকে একটা ভয়েজ মেসেজ আসে। তিথি ওপেন করে না। ওপাশের ছেলেটি মেসেজ দেয়।
–একবার অন করো প্লিজ….
তিথি সিন করে রেখে দেয়। এরপর আরও অসংখ্য মেসেজ আসে। কিন্তু তিথি না দেখে ফোনটা উল্টা করে রেখে দেয়।
——-
চারদিকে নিরব,গভীর রাত ঘুমের ভারে চোখের পাতা ভার। কিন্তু অজানা ব্যাথায় চোখ বন্ধ করে থাকার পরও ঘুম আসছেনা সিনথিয়ার। কাল তার মুক্তি।শুনে তো তার খুশি হওয়ার কথা।কিন্তু সে কেনো যেনো সে খুশি হতে পারছে না। ভালোবাসা অদ্ভুত জিনিস। যে গারদে বসে একদিন মুক্তির জন্যে ছটফট করতো। আজ সে গারদ থেকে মুক্তির সময়ে সে কাঁদছে। একজন মানুষের ব্যাথা কাটিয়ে ওঠার আগেই আরেক ব্যাথায় বুক ভারী হচ্ছে তার।
দীর্ঘশ্বাসে ভরে উঠছে গারদের চার দেয়াল।
ফজরের আযান হয়। তিথি উঠে নামাজ আদায় করে। দু”টো বান্ধবিকে দুয়া”য় রেখে নামাজ শেষ করে -বিছানায় এসে বসে। রিমা ঘুমিয়ে গেছে। তিথি”র সেই ভয়েজ মেসেজটার কথা মনে পড়ে। ফোনটা হাতে নেয় তিথি। ফোনের সাইড বাটন চেপে সাউন্ড কমিয়ে নেয়। তারপর অন করে। একটা নরম শান্ত গলায় বেজে ওঠে,
–“ভালোবাসি”।
তিথি বহু ছেলের সাথে কথা বলেছে। বহুবার ঘুরেছে। বহু ছেলের সাথে ফ্লার্ট করেছে। তবে এই ছেলের ভয়েস মারাত্বক সুন্দর।”ভালোবাসি” চার অক্ষরের শব্দটি একদম হৃদয় পর্যন্ত ঢুকে একটা টুং করে শব্দ বাজিয়ে দেয়। তিথি স্তব্ধ হয়ে বসে । তার এতো অস্থির কেনো লাগছে। ভয়েজে কি মেশানো ছিলো? “মধু নাকি সুপার গ্লু”। কোনটার জন্যে এতো মোহনীয় লাগছে ছেলেটির গলা।নিচে আরোও কিছু ভয়েস মেসেজ দেয়া। তিথি কেনো যেনো কন্ঠ শোনার লোভ সামলাতে পারলো না। পরের টা ওপেন করলো। সেই লোভনীয় গলায় ছেলেটি এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো,
লাভ ইউ..লাভ ইউ..লাভ ইউ..লাভ ইউ..লাভ ইউ
লাভ ইউ..লাভ ইউ..লাভ ইউ..লাভ ইউ..লাভ ইউ
লাভ ইউ..লাভ ইউ..লাভ ইউ..লাভ ইউ..লাভ ইউ
লাভ ইউ..লাভ ইউ..লাভ ইউ..লাভ ইউ..লাভ ইউ
এক নিঃশ্বাসে বলা শব্দগুলো শুনে পাথরের মতো শক্ত হয়ে বসে তিথি। কেনো যেনো অশান্ত করে দিচ্ছে শব্দগুলো তাকে।তিথি আরেকটা ভয়েজ মেসেজ অন করে। সেখানেও সেই মধুর মতো গলায় এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হলো সবচেয়ে দামী শব্দটি,
–ভালোবাসি..ভালোবাসি..ভালোবাসি..ভালোবাসি
ভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসিভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসিভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসিভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসি
ভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসি
ভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসি
শব্দগুলো একদমে বলতে থাকে ছেলেটি। শেষের শব্দগুলোতে দম ফুরিয়ে আসে। শব্দগুলো অস্ফুট হয়ে যায়। তবুও বলতে থাকে,”ভালোবাসি..ভালোবাসি..ভালোবাসি..ভালোবাসি
ভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসিভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসিভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসিভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসি
ভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসি
ভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসি।
দম ফুরানোর আগে অবধি নিঃশ্বাস চেপে থাকা ছেলেটির গলা শুনে তিথির নিজের দমটাই বন্ধ হয়ে আসছে। পরের মেসেজ আর অন করার সাহস হলো না তিথির। নিজেকে এই প্রথম বারের মতো দূর্বল লাগছে। বুকের ভিতরটা পরিবেশের নিস্তব্ধতার বিপরীতে ধিরিম ধিরিম বাজছে। যেনো এই শব্দে এখুনি রিমার ঘুম ছুটে যাবে। উঠে বলবে কিরে, বুক কাঁপছে কেনো তোর! তিথি চোখ মুখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। হাত পা কেনো যেনো বরফ শীতল হয়ে ওঠে ক্রমেই। বুকের কাঁপন কেনো যেনো তরতরিয়ে বাড়তেই থাকে।
পরেরদিন..
রিজভী শিকদারের সাহায্যে যেমন এফআইআর হয়। সে তার সকল অপরাধ স্বীকার করে নেয়। ইরফাদ সব প্রমাণ নিয়ে সিনথিয়ার জামিন করায়। সিনথিয়া মুক্ত। তবে তার ছলছল চোখ দুটোতে মুক্তির ইচ্ছে নেই। ইচ্ছে শুধু বন্দি হওয়ার। এই মুক্তি তার হৃদয়কে আরও যন্ত্রণা দিচ্ছে। তার জীবণ যেনো অভিশপ্ত। একটা সমস্যা থেকে উঠে আরেকটা সমস্যায় কখনো পিছলে পড়ে কখনো লাফিয়ে পড়ে কখনো অসাবধানতা”য় পড়ে। আর এবার মনে হয় না জেনেই পড়লো। কপাল খারাপ হলে যা হয় “অভাগা যেদিকে যায় সাগর শুকিয়ে যায়।”
সিনথিয়ার যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসে। চোখদুটো একজন”কে দিশাহারা হয়ে খুঁজছে। কোথায় সে? তাকে না দেখেই চলে যেতে হবে? আর কখনো দেখা হবে না? আর কখনো কথা হবে না? হলেও কতোদিন অপেক্ষা করতে হবে। সিনথিয়ার বাবা এসেছে তাকে নিতে। তার যাওয়ার ইচ্ছে নেই। পা উঠছে না। কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে না দেখলে তার তো মন শান্ত হবে না। কিন্তু তাকে আশেপাশে,সামনে পিছনে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। সিনথিয়ার বাবা হাত ধরে বাইরে নিয়ে যায়। অশান্ত সিনথিয়া বারবার পিছনে তাকায়। কিন্তু সে কোথাও নেই আজ।থানার বাইরে দাঁড়িয়ে সিনথিয়া আর তার বাবা। ঠিক তখন ই কয়েক হাত দূরে একটা গাড়ি থামে। দরজা ঠেলে বের হয় সেই স্বপ্নের মানুষ। গায়ে সাদা শার্ট জড়ানো।সময়ের অভাবে কাটতে না পারা চুলগুলো কপাল ছুঁয়ে দিচ্ছে। ক্লান্তিতে বড় বড় চোখ গুলো ছোট দেখাচ্ছে। ইরফাদ গাড়ি থেকে নামে। গাড়ির দরজা বন্ধ করে। আশেপাশে কিচ্ছু যেনো তার দৃষ্টিতে নেই। আস্ত সিনথিয়া”কে তার যেনো চোখের কোণেও ধরা দিলো না। তড়িঘড়ি করে থানার ভেতরে চলে গেলো ইরফাদ। সিনথিয়া”র বুকটা ধুক করে উঠলো।
ইভা ঘর গোছাচ্ছে। আচারের কৌটাগুলো মুখ খুলে ছাদে দিয়ে এলো মাত্র”ই।ব্যলকনি”র গাছ গুলোর যত্ন নেওয়া হয়েছে।বাকি আছে ইরফাদের ব্যলকনিতে যাওয়া। হাতের কাজ সেরে ইরফাদের ঘরে যায় ইভা। ঘরটা খুব অগোছালো হয়ে আছে।যদিও ইরফাদ নিজেই সব গুছিয়ে রাখে। তবে সময়ের অভাবে আজকাল ছেলেটা খাওয়ার সময়- ই পাচ্ছে না। ইভা সব ঠিকঠাক করে। সাইড টেবিলের উপর কাগজপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ইভা কাগজ গুলো গুছিয়ে ড্রয়ারে রাখার জন্যে ড্রয়ার টানে। ড্রয়ারে রাখা আছে ডায়েরি। সচরাচর হাতের নাগালে এই ডায়েরি পাওয়া যায়না। ডায়েরি বহুবার ইরফাদে”র হাতে দেখেছে ইভা। তবে কখনো খুলে দেখা হয়নি। ভাই এর পারসোনাল জিনিস বলে কথা। তবে আজ কেমন যেনো মনটা অন্যরকম হলো ইভার। মাথায় শয়তান চেপে বসলো। ইভা ডায়েরি খুললো। ডায়েরির প্রথম পাতা খুললো সে। ইরফাদের লেখার ধরণ তাকিয়ে থাকার মতো। তবে লেখার অর্থটা খুব করুণ,
রং পর্ব ১৭
— “পৃথিবীতে সব মানুষ-ই কোনো না কোনো ভাবে দুঃখী। দুঃখ-কষ্ট নিয়েই জীবন তবে নিজের বউকে অন্যের সাথে নিজ দায়িত্বে বিয়ে দেওয়ার মতো যন্ত্রণা কেউ না পাক।”