রং পর্ব ২২

রং পর্ব ২২
তন্নী তনু

খোলা জানালা আর ড্রিম লাইটের মৃদু আলো। গ্রিলে টিং টিং আওয়াজ। কাচা ঘুম ভেঙ্গে যায় উঠে বসে সিনথিয়া। নিঃশ্বাসের অস্বাভাবিক ওঠানামা। গলা শুকিয়ে আসছে। বুক ধরফর করছে। জীবনটা এতো অশান্তির কেনো? না জেগে শান্তি পায় আর না ঘুমিয়ে। সাইড টেবিলের উপর ওয়াটার পট টা হাতে নেয়। এক দমে পানি খেয়ে শূন‍্য করে ছাড়ে। তারপর খোলা জানালায় উকি দেয়। একটা ছোট্ট ব‍্যাগ চিকন দড়ির অবলম্বনে শূন‍্যে দূলছে। মাঝে মাঝে এসে জানালার গ্রিলে বারি খাচ্ছে। সিনথিয়া ফোস করে দীর্ঘশ্বাস শ্বাস ছাড়ে। জানালার ওপারে দুলতে থাকা ব‍্যাগ হাতে নেয়। মনের মধ‍্যে অনেক গুলো প্রশ্ন উকিঝুকি দিচ্ছে।” এই ব‍্যাগ জানালায় কেনো ঝুলছে? কে দিলো? কি তার কারণ? ব‍্যাগে কি-ই বা আছে?” সিনথিয়া হাত বাড়িয়ে ব‍্যাগ টা ভিতরে আনতে চাইলে তা আসে না। ব‍্যাগ ছেড়ে দেয় সিনথিয়া। দৌড়ে বিছানা থেকে নামে। লাইট অন করে দিয়ে আবার পূর্বের জায়গায় ফেরে। ব‍্যাগ জানালার ওপাশেই রেখে ব‍্যাগে কি আছে দেখার চেষ্টা করে।

বেলা বারোটা পেরিয়ে যাচ্ছে। ইভা টুম্পাকে নিতে যাওয়ার জন‍্যে রেডি হচ্ছে। টুম্পাকে বাসার পাশের একটি বিশ্বস্ত ডে-কেয়ারে পাঠানো হয়।মেয়েটা বাসায় সারাদিন একা একা থেকে মনমরা হয়ে থাকে। তার চেয়ে ভালো থাকে সব বাচ্চাদের সাথে খেলাধুলা পাশাপাশি পড়াশুনা করলে। ইভা সকালে খাবার খাইয়ে টুম্পাকে তার নানুর সাথে পাঠিয়ে দেয়। দুপুরে গিয়ে নিয়ে আসে। গোসল-খাবার সেরে আবার বিকেলে কিছুক্ষণের জন‍্যে রেখে আসে। আবার সন্ধ্যায় নিয়ে আসে। ইভা বের হতে নিবে এই সময় বৃষ্টি চলে আসে। বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় ঘন্টা খানিক দেরিও হয়ে যায়। বৃষ্টি একটু ছাড়া ছাড়া হতেই সে বেরিয়ে পড়ে।
রুমের দরজায় একা দাঁড়িয়ে আছে টুম্পা। মনটা ভাড়, ফর্সা মুখটায় মেঘের কালো আধার। চোখ দুটো টলমল করছে।ইভা মেয়ের ভার মুখ দেখে কোলে তুলে নেয়। যদিও পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে কোলে নিতে একটু কষ্টই হয়। বাবাহারা মেয়ের শখ মেটানো তো তারই উপর নির্ভর করে। ইভা মেয়ের কাঁদো কাঁদো মুখে হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— একটুই তো দেরি হয়েছে মা। তাই বলে এভাবে কাঁদে?
টুম্পা চোখ নামিয়ে রাখে।মুখটা থমথমে আর গম্ভীর। ইভা মেয়েকে কোলে নিয়ে রুমে যায়।রুমে সবাই খেলা করছে। আপাদত একটা মিস তাদের দেখাশোনাও করছে। ইভা ঢোকা মাত্রই তিনি এগিয়ে আসেন। তিনি বলেন,
— ম‍্যাম! টুম্পাকে অনেক ডেকেও ভেতরে রাখা যাচ্ছিলো না। ও খুব জেদ করছে। কারো সাথে খেলবে না।
ইভা কপাল, চোখ কুচকে নেয়। কোলে থাকা টুম্পার মুখের দিকে তাকায়। গম্ভীর গলায় বলে,– “কি শুনছি! দুষ্টুমি কেনো করেছো?ওরা তোমার-ই তো বন্ধু।”
ইভা টুম্পাকে কোল থেকে নামিয়ে দেয়। তারপর বলে,
— যাও ভাব করে নাও।
ঠিক সে মূহুর্তে বাচ্চাদের মধ‍্যে একজন বলে উঠে,
— না ওর সাথে আমরা খেলবো না।
বাকিরাও একই কথা বলে।ইভা এগিয়ে যায়। নরম হাত বাড়িয়ে মেয়েটির থুতনিতে রাখে। তারপর আদুরে গলায় বলে,

— কেনো বেইবি!
মেয়েটি ইভার হাত সরিয়ে দেয়। চোখ মুখ কালো করে বলে,
— ছুঁবে না আমাকে। মাম্মাম বলেছে টুম্পার সাথে না মিশতে।
ইভার গলা আরও নরম। সে আরেকবার আদুরে গলায় বলে,
— কেনো সোনা!
মেয়েটি দু”পা পিছিয়ে ভেঙচি কাটে। তারপর বলে,
— ও দুষ্টু বেইবি। তাইতো ওর পাপা ওকে ছেড়ে গেছে।

এই ছোট্ট কথা টা ইভার আত্মা কাঁপিয়ে দেয়। আত্মচিৎকার যদি শব্দে পরিণত হতো তাহলে তার ভেতরে আত্মচিৎকারের শব্দে আকাশ আজ কেঁপে উঠতো।এত পিচ্চি বাচ্চা কখনো এসব বুঝবে না। এদের মাথায় মানুষরূপী অমানুষগুলো ভেদাভেদ করাটা ঢুকিয়ে দিয়েছে। ইভার পায়ের তলার মাটি সরে গেছে। পৃথিবী চারদিকে দুলছে। একটা ভুলের পরিণাম এতো ভয়াভহ। মানুষ তাকে তো ছাড়েইনি। তার আবুঝ বাচ্চাটাকেও ছাড়ছে না। কি দুনিয়া! শিক্ষিত নামক মুখোশের আড়ালে কেবল অমানুষ দিয়ে ভরা। শিক্ষিত হয়ে কি লাভ যদি মানুষ-ই না হতে পারে। জীবনের উথানপতনে বহু কষ্ট সে সহ‍্য করেছে। তবে আজ পিচ্চি অবুঝ বাচ্চাকে দিয়ে বাচ্চার মা যেই এসিড তার দিকে ছুড়লো তা ইভার হৃদয় ঝাঝড়া করে দিয়েছে।

পায়ের তলায় শক্তি ফুরিয়ে আসছে। মেয়ের মুখের দিকে তাকানোর সাহস তার নেই। নেই সামনে দাড়ানো মিস এর মুখ পানে চাওয়ার শক্তি। বাচ্চা মেয়েটাকে বকা দেওয়ার সৎ সাহস হয়তো মিস” এর নেই। জগতের নিয়ম পাল্টেছে বলে কথা। আগে অভিভাবকদের কথা ছিলো, বাচ্চা দিয়ে গেলাম মানুষ করার দায়িত্ব আপনাদের। হার কয়টা বাঁচিয়ে রাখলেও হবে। আর এখন সবার আদরের বাচ্চা বলে কথা। একটা ধমক দিলে চাকরি থাকবেনা।” মূর্খদের দেশে আসলে কিসের শিক্ষা, কিসের বিশ্ববিদ্যালয়।” ইভা পুড়তে পুড়তে লোহায় পরিণত হয়েছে। মনকে লৌহ কঠিন করে মেয়েকে কোলে নেয়। মেয়েকে নিয়ে ছাদখোলা জায়গায় দাঁড়ায়। বৃষ্টিতে ভেজে মা মেয়ে।চোখের জল আড়ালের ভিষণ প্রয়োজন ভিষণ।

কাল রাত থেকে দুপুর পর্যন্ত পানি ছাড়া কিচ্ছু পেটে পড়েনি রিমার। পেটের মধ‍্যে ক্ষুদা মেঘের মতো গর্জন শুরু করেছে। আর সহ‍্য হচ্ছে না। খাবার টেবিলে বসে একপ্লেট সাদা ভাত নিয়ে বসে। পেটের ক্ষুদার চেয়ে চোখের ক্ষুদা বেশী লেগেছে। আলু ভাজি সাথে পাতলা মসুর ডাল দিয়ে ভাত মেখে নেয় রিমা। মনে হচ্ছে কতো কাল ভাত খায় না সে। পরপর দু”লোকমা ভাত মুখে পুড়ে নেয়। বাম হাত বাড়িয়ে গরুর গোস এর দুটো পিছ থালায় নিতে নেয়। তখন ই দেখে সামনে তার মা। দুচোখ ভর্তি আগুন। যেনো খাওয়ার অপরাধে তাকে মৃত‍্যুদন্ড দেয়া হবে। রিমার মা চেচিয়ে ওঠে,

— পাপ সব ধুয়ে এসেই কেবল এসব খাবার পাবি। এর আগে না।
রিমা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। ভুল এমন ই এক জিনিস। একবার ভুল করলে আপনজন ও পর হয়ে যায়। তার চোখ থেকে টুপটুপ করে জল পড়ে। প্লেটের ডাল আর চোখের জল একাকার হয়ে মেশে। ক্ষুদার্ত পেট ভরাতে নিজের কান্নাটুকু ডাল-ভাতে মিশিয়ে খেয়ে ফেলে।
পড়ন্ত বিকেল তিথি ঘরের কাজ করছে। দুপুরে সবার সকল জামা-কাপড় তিনটা বিছানার চাদর ধুয়ে শরীর খুব ক্লান্ত লাগছে। ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিয়ে আছে। তার মামী বোরকা পড়ে বের হচ্ছেন। কোথায় যাচ্ছেন বলেননি। তার মামি যাওয়ার পর দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়ে তিথি। রিমার খোঁজ নেওয়া প্রয়োজন। সে কল দেয় রিমার নম্বরে।
–কেমন আছিস?
— ভালো।
— তুই?
— আলহামদুলিল্লাহ্। কি করিস? কি অবস্থা? সব ঠিক আছে?
রিমা ছোট্ট করে বলে,” হুম”। মন যে খারাপ তা ফোনের এপাড়ে থেকে ঠিকই বোঝে তিথি। তিথি বলে,” পুচকু কেমন আছে রে?”
দিনের বেলায় আধার নামানো ঘরে নিজের পেটে আলতো করে হাত রাখে রিমা। বুকের মধ‍্যে জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে ফোস করে। ভেজা গলায় রিমা বলে,

— ভুল দিয়ে শুরু কোনো কিছুর ফলাফল ভালো হয় না।ভুল করেছি আমি ফল ভোগ করছে এই বাচ্চাটা।
— কি হয়েছে?
— মা সহ‍্য করতে পারছে না। আশেপাশে খুব কানাঘুষা হয়। অনেক কথা শুনতে হয়।সেই রাগ আমার উপর ফলায়।
— সহ‍্য করে যা একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
— দোয়ায় রাখিস!
— সিনথিয়ার কি খবর? গতকাল ফোন দিলাম ফোন অফ?
— আমাকে কল দিয়েছিলো ধরতে পারিনি। ফোনে টাকা নেই তাই কল ও দিয়ে পারিনি।
— আচ্ছা!আমি কল দিবোনে। দুপুরে খেয়েছিস?
–হুমম….
–এই সময়ে না খেয়ে থাকা যাবে না একদম। একদম কষ্ট পাবিনা।
— আর কষ্ট! খুব গরুর গোস খেতে ইচ্ছে করছিলো রে। মা মুখের উপর থেকে কেড়ে নিলো।

তিথির শক্ত খোলসের আড়ালের নরম মনটা শিউরে ওঠে। “ইসস! জীবন এক ভয়াবহ সংগ্রামের নাম। সবাই যেনো যুদ্ধ করে টিকে আছে।” তবে এই সময়ে শত্রুও মুখের খাবার কেড়ে নিতে পারবে না। মা হয়ে কি করে পারলো। মানুষ মাত্র-ই ভুল। তাই বলে এতো বড় শাস্তি। তিথি ফোন রাখে। মামির অনুপস্থিতিতে জীবনের প্রথম এক অসাধ‍্য সাধন করতে যাচ্ছে। ফ্রিজ খুলে শিশির এর জন‍্যে রান্না করা মাংস বের করে তিথি। গরম পানি করে মাংসের বক্সটা ভিজিয়ে রাখে। তারপর চুলা লো টেম্পারেচারে রেখে ভেজে নেয়। গরম গরম মাংস এয়ার টাইট বক্সে তুলে রিমার বাসায় যায়। “ইসস! মেয়েটার খেতে ইচ্ছে না করলে কি অমন করে বলতো?” নিজ হাতে রিমাকে খাইয়ে তবেই বাড়ি ফেরে। বাড়ি ফিরে দেখে তার মামি চলে এসেছে। সে চুপচাপ নিজের রুমে যায়। প্রায় ত্রিশ মিনিট পর তার মামি আসে। বক্সে মাংস ছাড়া ছাড়া দেখে প্রথমেই তিথির কাছে আসে। তারপর বলে,

— এইটা তো এমন ছিলো না।
তিথি না বোঝার ভান করে বলে,
— আমি কি করে বলবো মামি?
–বাড়িতে তুই ছাড়া আছে টা কে?
— কবে তোমাকে না বলে কিছু ছুঁয়েছি?হাত দিয়ে দেওয়া জিনিসগুলোও তিথি খায় না। চুরি করা অভ‍্যাস আমার নেই….
— কে জানে নতুন নাগোর জুটেছে কি না? আমার অনুপস্থিতে ঘরে ঢুকিয়ে খাইয়ে দাইয়ে পাঠালে কে বা দেখবে?
— মামি! সব সময় কি এত কথা সহ‍্য হয়?
— মুখে মুখে কথা? তুই ছাড়া কে আছে বাসায়।চোরের মায়ের বড় গলা!
— মা”কে তুলে কিছু বলবে না। তোমার মা”কে নিয়ে বললে তোমার কেমন লাগবে? তোমার মা কি খুব ভালো মানুষ?

এমন কথা শুনেই তিথির মামি হাতে থাকা খুন্তি দিয়ে আঘাত করে তিথিকে। কোথায় লাগছে! বাঁচা মরা যেনো কিচ্ছু যায় আসে না। তিথি হাত দিয়ে ঠেকায় না। ভুল করা বারণ তার। ছোট থেকে মার খেয়ে খেয়ে অভ‍্যস্ত সে। তবে আজ চোখের জল গুলো বাধ না মেনেই বের হচ্ছে। একপর্যায়ে তার মামি-ই ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে। কলিং বেল বেজে ওঠে। তিথি চোখ মুখ মুছে দরজা খোলে। ফাকা দরজায় মুখোমুখি তিথি শিশির। রক্ত লাল হয়ে আসা চোখ, ভেজা পাপড়ি আর প্রিয় মানুষের ভেতরের হাহাকার কি তার চোখ এড়াতে পারে? শিশির ধীর পায়ে ভিতরে ঢোকে। তিথি পিছিয়ে যায়। তার মা সোফায় বসে আছে। হাতের খুন্তি মেঝেতে পড়ে আছে। খুন্তির ধারালো প্রান্ত লেগে কেটে গেছে হাত।তিথির পড়নে শর্ট স্লিভ টি-শার্ট আর স্কার্ট। হাতের ক্ষত স্পস্ট। শিশির অনেক আগে থেকেই চেষ্টা করে গেছে এসব থামাতে। তবে সে পেরেছে কি? তার চোখের আড়ালে কত কি ঘটে যায় সে জানতেও পারে না। শিশির ধীর গলায় তার মাকে বলে,

— কি হয়েছে?
— কি হবে? মহারানি গরুর গোস অর্ধেক খেয়ে রেখে দিয়েছে। রাতে সবাই খাবে কি?
— তাই বলে তুমি মারবে?
— খাওয়ার জন‍্যে মারিনি। মেরেছি মুখে মুখে তর্ক করছে বলে!
— তোমার মেয়েকে কোনো দিন এভাবে মেরেছো? তর্ক করার কারণে?
— আমার মেয়ে তর্ক করলে জ‍্যান্ত পুতে রাখবো।
— তিথি তর্ক করে না মা। কথার পৃষ্ঠে সত‍্য কথা বলা কি তর্ক? তাই যদি হয় তাহলে আমাকে মারো!
শিশিরের মা রেগে আগুন হয়ে যায়। আজকাল তার পেটে ধরা সন্তান তার বিরুদ্ধে কথা বলে। রাগে ফুসতে ফুসতে বলে,
— তোরা কেউ মা ডাকবি না। মরে গেলেও কাছে আসবি না। সবাই ওর পক্ষ নে।
বলেই তিনি নিজের ঘরে যান। শিশির অবাক হয়ে যায়। কেমন মানুষ তিনি। ঠিক ভুল বিচার না করে একতরফা কথা কি করে বলে মানুষ।

সকাল থেকে প্রচুর চিন্তা হচ্ছে সিনথিয়ার। ব‍্যাগে থেকে যা পেয়েছে তা হলো একটা ফোন।এখন কথা হলো ফোনটা কে পাঠালো? ব‍্যাগটা ছাদে থেকে দড়িতে ঝুলিয়ে ফেলা হয়েছে। তাও আবার তার জানালার ঠিক মাঝখানে। জানাশোনা না থাকলে নিশানা বরাবর তীর কি করে ছুড়লো?এতো এতো প্রশ্ন আর উত্তর খোঁজা যাচ্ছে না। বিষয়টা ইরফাদকে জানানো উচিত। তবে এর পেছনে বড় জাল পেতে কেউ কুমিরের মতো হা করে বসে আছে। এই জালে ইরফাদকে ফেলতে যে তার ভয় হচ্ছে। আবার না বললেও সমাধান আসবে না। সিনথিয়া অনেক ভেবে চিন্তে ইরফাদকে ফোন করে। সালাম দিয়ে বলে,
— একটা অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে।
ইরফাদ হাতের কাজের ফাঁকে বলে,

— বলে ফেলো…
–মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে দেখি একটা ব‍্যাগ জানালার কাছে ঝুলছে। ওর ভেতরে একটা ফোন ছিলো।
ইরফাদ একটু কড়া গলায় ধমকে বলে,
— তোমাকে না বলেছি যা হবে সাথে সাথে ইনফর্ম করবে?সকালে কেনো বললে না?
সিনথিয়া আমতা আমতা করে। তার কাছে দেওয়ার মতো উত্তর নেই। যা আছে তা বলা যাবে না। সে ধীর গলায় বলে,
— ভয় পেয়েছিলাম।
–তুমি মোটেও ভয় পাওয়ার মেয়ে নও।
–কি বলছেন?
— যে একা এতোগুলো মানুষের সাথে লড়তে পারে সে ভয় পায় আমাকে বিলিভ করতে হবে?
— মানুষের মনের দূর্বলতা হলো বড় দূর্বলতা। আমি মনের দিক দিয়ে খুব দূর্বল।
— বাদ দাও। সীমকার্ড উঠাও। যেই কল করুক টাইম টু টাইম আমাকে জানাবে।
–ওকে

— “রাখছি।” বলেই নির্দয়, পাষাণ, কঠিন হৃদয়ের মানুষের মতো ফোনটা কেটে দেয় ইরফাদ। সিনথিয়ার মনটা খারাপ হয়ে যায়।
এদিকে শিশির তার মায়ের দরজায় টোকা দেয়। ভেতর থেকে কেউ বলে,
— কি বলবি বল?
— খেতে এসো মা!
— তোরা খেলেই হবে। আমার কথা চিন্তা করতে হবে না।
— মা! আসো প্লিজ। আমার বন্ধুরা এসেছে।
— তোকে না কতো বার বলেছি কোনো ছেলেকে রাতে বাসায় আনবি না।দিন কাল ভালো না। দু”টো বড় মেয়ে আছে এই বাসায়।
— আস্তে বলো ওরা শুনে ফেলবে তো….

আকাশ কাপিয়ে শুরু হয়েছে তুমুল বর্ষন। তিথির জ্বর আর ব‍্যাথায় আগুনের মতো গরম হয়ে উঠছে শরীর। তার কেউ নেই! কেউ ছিলো না।ছোট থেকে এভাবেই বড় হয়েছে সে। মাঝে মধ‍্যে কুটুস পাখি তার একটু একটু যত্ন নিয়েছে। এছাড়া কেউ নেই তার। কেউ না। প্রায় মাঝ রাত সে অনুভব করে তার আশে পাশে কুটুস বাদ দিয়েও কেউ আছে। তিথি বিছানায় হাত রেখে দেখে কুটুস নেই। নিজের ওড়না ঠিক করে নেয় তিথি। তারপর মোবাইলের ফ্ল‍্যাস অন করে। চোখের সামনে হঠাৎ শিশিরকে দেখে লাফিয়ে উঠে দাড়ায় তিথি। শিশির নিজের ওষ্ঠের মাঝখানে আঙ্গুল ছুঁয়ে মুখ দিয়ে শব্দ করে,

— “শশশ”।
তিথি বিষ্মিত চোখে তাকিয়ে থাকে। এতো রাতে শিশির কেনো এসেছে!মামি যদি ভুল করেও বুঝে ফেলে আজ-ই হবে তার জীবনের শেষ দিন। সে জ্বরের মধ‍্যে ঘামতে থাকে। শিশির এগিয়ে আসে। তিথি ভয় পায়। আশেপাশে কুটুসকে দেখা যাচ্ছে না। চোখ ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে কুটুসকে খোজে সে। শিশির বলে,
— কুটুস ওয়াসরুমে।
আমি তোকে আজকেই বিয়ে করতে চাই।
–কিইইই!
–হুম।আমার ফ্রেন্ড হাফেজ। আর দরকার দুজন সাক্ষী। দুজন ফ্রেন্ড রেডি। আর কুটুস তো আছেই। আজ রাতেই বিয়ে হবে।
তিথি দু”পা পিছিয়ে যায়। কোনো ভাবেই সম্ভব না। সে সমানে মাথা নাড়ায়। “সম্ভব না সম্ভব না সম্ভব না।” শিশির অনুরোধ করে বলে,

— মা কোনো দিন মেনে নিবে না।এছাড়া আমার আর পথ খোলা নেই। প্লিজ না করে আমার যন্ত্রণা বাড়াস না।
— না তা হয় না। প্লিজ ক্ষমা করো।
— এই বাসায় থেকে অনেক আঘাত, ক্ষত হয়েছে তোর। কোনোটিই আমি নিজ চোখে দেখিনি। তবে আজকের ক্ষত আমি দেখেছি। সেখানে স্পর্শ করার জন‍্যে সম্পর্ক পবিত্র করে নেয়া দরকার।
তিথি আপাদমস্তক কেপে ওঠে। এতো চিন্তা তার জন‍্যে কেউ করে? এর চেয়ে কত বড় বড় আঘাত সে সয়ে নিয়েছে। জীবনে কষ্টের শেষ তার নেই। শিশিরকে বিয়ে করে জলন্ত আগুনে ঝাপ সে কিছুতেই দিবে না। তিথি চোখ মুখ বন্ধ করে বলে,

রং পর্ব ২১

— বেড়িয়ে যাও…
শিশির ঘর থেকে বের হয় না। বরং বিছানায় উঠে শুয়ে পড়ে। তিথি অবাক হয়ে সরে দাঁড়ায়। কি চাইছে শিশির। শিশির ফিসফিস করে বলে,
— কাল সকালে মা যখন দেখবে আমি তোর কাছে ছিলাম। সেই বিয়ে দিবে। এতো চাপ নিয়ে আমার কাজ নাই।
তিথি সকালের কথা ভেবে ভয়ে কেঁপে ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে পড়বে সে জীবনেও ভাবেনি। তিথি হাত জোড় করে,
— প্লিজ যাও… প্লিজ…
শিশিরের নাকোচ গলা,
— বিয়ে না করে শিশির এইখান থেকে যাবে না।

রং পর্ব ২৩