রং পর্ব ২৩

রং পর্ব ২৩
তন্নী তনু

ফাঁকা জানালার পর্দা গুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে। তিথি মেঝেতে দাঁড়িয়ে আছে। পাথরের মতো শুয়ে আছে শিশির। তাকে দেখে মনে হচ্ছে না আজ সে উঠবে। তিথির ছোট বেলা থেকে এই অবধি জীবন সুখকর ছিলো না।জীবনকে সে এমন জায়গায় সে নিতে চায় না যাতে তার সন্তানের জীবন তার মতো অবহেলায় বেড়ে ওঠে। বাবা মা-হীন সন্তান খোলা আকাশের তলায় নিজের মাথার উপর ঝড়-ঝাপ্টা নিয়ে বড় হয়। তাই নিজের ভুলের মাসুল কখনোই সন্তানের উপর আসতে দিবে না। নিজের জন্মদাতা পিতা-মাতার ভুলের ফল সে নিজেই। তাই কোনো সিদ্ধান্ত সে কিছুতেই এতো সহজে নিবে না। তিথি দাঁড়িয়ে থাকে মূর্তির মতো শক্ত হয়ে। এতো সহজে হার মানার মেয়ে সে নয়। বৃষ্টির ঝাপটায় জানালার কাছকায় অল্প অল্প করে ভিজে যাচ্ছে। বিদ‍্যুতের ঝলকানিতে ঘরে চলছে আলো আধারির খেলা। তিথির বুকের ভেতর শব্দ হচ্ছে ধুকধুক করে। শিশিরের ওঠার নাম নেই। তিথি চোখ মুখ শক্ত করে বলে,

— যাবে তুমি…
শিশির আরেকটা বালিশ নিজের কানের উপর চেপে ধরে। তারপর বলে,
— কেবল সম্মতি দিলেই আমি তোর সব কথা শুনবো।
— মামি”কে তুমি চেনো না?? এসব জানলে নিজেই গলায় দঁড়ি দেবে। আমাকে কোনো দিন মেনে নিবে না।
শিশির কানে থেকে বালিস সরিয়ে বলে,
— ওসব ভুয়া কথা। বিয়ের পর কিচ্ছু করার থাকে না। সবাই মেনে নেয়।
— আমার বিষয় টা ভিন্ন ভাইয়া। আমি পিতৃ পরিচয়হীন।
— অবশ‍্যেই না। আর হয়ে থাকলেও আমার অসুবিধা নেই। আমি বিয়ে করবো তোকে। তোর মা-বাবা দিয়ে আমার কি???
–পাগলামি কোরো না ভাইয়া!
–কিসের ভাইয়া? নিজের হবু বর কে ভাইয়া ডাকতে লজ্জা করে না!
— প্লিজ যাওতো….

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

শিশির নিজের ফোন থেকে একটা টেক্সট পাঠায়। কুটুস বাইরে এসে তিথিকে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়। চুপিচুপি পা ফেলে বাকিরা রুমে প্রবেশ করে। দরজা ভেতর থেকে লাগিয়ে সবাই বিছানায় উঠে বসে সবাই। বিদ‍্যুৎ নেই – পুরো রুমজুরে পিনপতন নিরবতা। কখনো রুমে ঘন অন্ধকার কখনো আকাশ থেকে নেমে আসা আলোয় অলোকিত। তিথি নিজের ভেতরে ভেতরে থেকে জমে বরফের মতো শিক্ত হয়। গায়ের জ্বর কোথাও যেনো মিলিয়ে যায়। কি হচ্ছে তার সাথে। ঠিক হচ্ছে নাকি ভুল? ভুল পথ একটা বারের জন‍্যেও সে ধরতে চায় না। তবে ভালোবাসাহীন জীবনে ভালোবাসার অদৃশ‍্য স্পর্শ তাকে চৌম্বকের মতো টানছে। আগুন জ্বেনেও ঝাপিয়ে পড়ার প্রবল ইচ্ছা তাকে তোলপাড় করে দিচ্ছে। মস্তিষ্ক তাকে জানান দিচ্ছে- ভুল পথে যাস না। আর মন বলছে- ঝাপিয়ে পড় যা হওয়ার পরে দেখা যাবে। কোনটার কথা শুনবে তিথি?

এদিকে মোবাইলের আলো জ্বেলে তার উপর পাতলা কাপড় দেয় শিশির। ঘর জুড়ে অল্প অল্প আলো। চাদর দিয়ে মাঝখান দিয়ে একটা পর্দা তৈরী করে নেয় শিশির। কুটুস তিথির পিঠে হাত বুলিয়ে সাহস দেয়।তিথি চোখ মুখ নিচু করে থাকে। তার এই মূহুর্তে কি করা উচিৎ এই প্রশ্ন তার মাথা শূন‍্য করে দেয়। সে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। নড়চড় নেই। কুটুস ওয়াসরুমে জোর করে নতুন কাপড় পড়ায় তিথিকে। তারপর ওযু করায়।তারপর মেঝেতে জায়নামাজ পেতে মাথায় কাপড় দিয়ে দেয়। চাদরের ওপাশে কেউ একজন খুতবা পাঠ করছেন। তা কানে পৌছানো মাত্রই তিথির ভেতর থেকে কেঁপে ওঠে। পায়ের তলায় শিরশির করে ওঠে। মেরুদন্ড দিয়ে বয়ে যায় বরফ শিক্ত অনুভূতি। তিথি বসে থাকতে পারে না। শ্বাস ভারী হয়ে আসে। কি হচ্ছে তার সাথে। এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কি? কি হবে মামি জানলে। ওপাশ থেকে ভেসে আসে একটি সুন্দর হৃদয়স্পর্শী বাক‍্য,

— বলুন কবুল!
তিথি জড়সড় হয়ে বসে। বুকের মধ‍্যে অস্থিরতা বাড়ে। শিশিরের ভেতরে এক পূর্ণতার সুভাস স্পর্শ করে যায়। মন বলে “অবশেষে।”
তিথি চোখ বন্ধ করে থাকে। বসে থাকলেও তার ভেতরে চলেছে ঝড়ের তান্ডপ। সে তান্ডবে নিভে যাচ্ছে তার ভেতরের অগ্নিশিখা। মোমের মতো গলে গলে পড়তে চাইছে তার অনুভূতি। ঝড়-তুফান পেরিয়ে মন ছুটে যেতে চাচ্ছে শিশির নামক ভালোবাসার কাছে। সে কি আজ সত‍্যিই পারবে ভালো না বেসে? ওপাশ থেকে আরেক বার তাড়া আসে। “বলুন আলহামদুলিল্লাহ্ কবুল।”
তিথি চোখ খোলে না। আরোও শক্ত হয়ে বসে। বিছানায় বসা শিশির আলতো হাতে চাদর সরায়। তিথির পড়নে সাদা রঙের সালোয়ার কামিজ। মাথায় নতুন বউদের মতো কাপড় টানা।চোখ দুটো বন্ধ। যেনো অন‍্য জগতে চলে গেছে। শিশির ডাকে,

— এই!! তিথি…..
তিথি মৃদু কেঁপে উঠে চোখ তুলে তাকায়। শিশির এক হাতের ইশারায় বলে তার চোখের দিকে তাকাতে। তিথি শিশিরের চোখের দিকে তাকায়। বড় বড় ড‍্যাপ ড‍্যাপ করা দুটো চোখ। চোখ জুড়ে অসীম মায়া। তিথি প্রথমবারের মতো নিজেকে হারিয়ে ফেলে। ওপাশ থেকে কেউ বলে,” বলুন- আলহামদুলিল্লাহ্ কবুল।” শিশির শব্দহীন ভাবে মুখ নাড়ায়। তিথি শিশিরের শব্দহীন ঠোঁটের কথাটা মুখে উচ্চারণ করে,” আলহামদুলিল্লাহ্ কবুল।”
পরপর আরোও দুবার বলে তিথি সম্বিত ফেরে। চোখ থেকে চুইয়ে পড়ে নোনা জল। শিশির তিথির চোখের জল দেখে। তারপর নিজের বুকের বা পাশে হাত রাখে। আর মাথা নাড়িয়ে বারণ করে। যার অর্থ -” আর একফোটা চোখের জল নয়।”

ওপাশ থেকে শিশিরের উদ্দেশ্য তার বন্ধু বলে– “বল কবুল। ”
সে চোখ বন্ধ করে আল্লাহ্ কে স্বরণ করে। মনের অন্তরস্থল থেকে সৃষ্টিকর্তার কাছে একটা ক্ষুদ্র চিরকুট পাঠায়। “হে আমার রব!আমি যেনো তিথিকে একটা শান্তিপূর্ণ জীবনের ছায়াতলে রাখতে পারি। আপনি আমাকে সাহায্যে করুন।” তারপর পরপর নিজেই তিনবার বলে,
— আলহামদুলিল্লাহ্ কবুল।
তিথির মন জুড়ে বসন্তের হাওয়া বয়।এক অদ্ভুত শিহরণে তার হাত-পা কাঁপতে থাকে। চোখ থেকে প্রথম বারের মতো আদন্দ অশ্রু ঝড়ে।

বাকিরা ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। কুটুস নিজের ভাই ভাবীকে সময় দিতে ওয়াশরুমে চলে যায়। আর মনে মনে ভাবে,” কতো কালের জন‍্য তার জন‍্যে ওয়াশরুম আর বারান্দা বরাদ্দ হলো কে জানে?”
পুরো রুম জুরে পিনপতন নিরবতা। বাইরে ভারী- বর্ষণ কমে আসছে। রুমের মৃদু আলোতে শিশির আর তিথি নফল নামাজ সেরে নেয়। দোয়া পড়ে তারপর পাশ ফিরে তিথির কপালে আলতো করে চুমু খায়। আর ফিসফিসিয়ে বলে,
— আজ থেকে তোমার সমস্ত কষ্টের ভাগ নিলাম।

তিথি মুখ তুলে তাকায় না। সব স্বপ্ন মনে হচ্ছে। যেনো চোখ খুললেই সব নাই হয়ে যাবে। শিশির উঠে এসে মুখোমুখি বসে। দুহাতের আজল ভরে তিথির মুখটা ধরে। তারপর আবারও ফিসফিসিয়ে বলে,
–আমি কখনো ভালো প্রেমিক হতে চাইনি। চায়নি তুমি কখনো প্রেমিকা হও। আমি তোমাকে বউ রূপে পার্মানেন্টলি চেয়েছি। বাকিটা পথ যেনো তোমার ভালো থাকার কারণ হতে পারি।
বউ শব্দটা শুনে তিথির শ্বাস আটকে যায়। বুকের মধ‍্যে ধুকপুক করে ওঠে। সাগরের ঢেউয়ের মতো প্রবল উচ্ছাসে সমস্ত কষ্ট ধুয়ে মুছে সুখ যেনো পায়ের কাছে ঠিকরে পড়ে। শিশির এগিয়ে আসে। তিথির হাতে কাটা জায়গায় আলতো করে হাত বুলায়। তারপর কানের কাছে এসে বলে,
— ভালোবাসি বউ…..

সকাল বেলা একসঙ্গে খেতে বসে শিশির সহ তার বন্ধুরা। সকাল সকাল ভুনা খিচুড়ি আর হাঁসের মাংস রান্না করেছেন শিশিরের মা। সকলকে নিজের হাতে খাওয়াচ্ছেন। ভেতরের রুমে খাচ্ছে কুটুস আর তিথি। শিশিরের মা সকলের চোখের ফোলা ফোলা ভাব গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। শিশির বিষয়টি খেয়াল করে বলে,
— “কিছু বলবা?” বলেই আরেক লোকমা তোলে শিশির। সাথে সাথে শিশিরের মা হাঁকডাক করে বলে ওঠেন,
— কি ব‍্যাপার রে…. তোদের সব গুলোর চোখ ফোলা ফোলা ক‍্যান? রাতে কি চুরি করতে গিয়েছিলি?
শিশির সাথে সাথে বিষম খায়। বাকিরা একে অপরের দিকে তাকায়।

সকাল থেকে সিনথিয়া ছুঁতো খুঁজতে থাকে ইরফাদকে ফোন দেয়ার জন‍্য। কিন্তু কোনো ছুতো না পেয়ে বিকেল বেলার দিকে সিনথিয়া ইরফাদকে ফোন দেয়। সালাম দেয়। ওপাশ থেকে ইরফাদের গলা,
— কোনো নিউজ?
— নাহ…
— তাহলে? …
সিনথিয়া জানতো এমন শক্ত কথাই শুনতে হবে তাকে। তাই উত্তর রেডি। সে বলে,
— এখনো তো কোনো ফোন এলো না।
— আসেনি আসবে…ওয়েট করো।
সিনথিয়া কথা বাড়াতে চায়। কথা যদিও গোছানো নেই। এই কাঠখোট্টা মানুষের সাথে কথা চালিয়ে যাওয়া দুষ্কর। তবুও চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কি। তার বলার আগেই ওপাশ থেকে বলে,

— আর কিছু?
সিনথিয়া তড়িঘড়ি করে বলে,
— জিসান ভাইয়ার উপর এট‍্যাক হয়েছিলো জানেন?
— কোন জিসান?
মনটা খারাপ হয়ে এলো তার। তার জীবনের এতো কষ্টের কথাগুলো তাকেই তো বলেছিলো সে। অথচ তিনি ভুলে গেলেন। মুখটা ছোট করে সিনথিয়া বলে,

রং পর্ব ২২

— জিসান কে ভুলে গেছেন?এই যে কিছুদিন আগে নিউজে দেখালো। রাতে যে ছেলেটার উপর এট‍্যাক হয়েছিলো….
–তো??
— না মানে…. আমার…থাক কিছু না।
–“না মানে…. আমার…থাক কিছু না।” এটা কেমন কথা।
— আমি ভেবেছিলাম যে আমার ঐ ঘটনা শুনে আপনি ওকে পানিসম‍্যান্ট দিয়েছেন।
— “জীবন কি সিনেমা?

রং পর্ব ২৩ (২)