রং পর্ব ২৭
তন্নী তনু
সিনথিয়া বাবার পাশে চুপ করে বসে। কি বলবে? তার জীবনের কি গল্প-ই বা লুকায়িত আছে? যা এতোকাল শোনা হয়ে ওঠেনি তা আজ শুনেই বা কি হবে।তবুও বাবার যখন ইচ্ছে হয়েছেই। এই মূহুর্তে একজন ভালো শ্রোতা হওয়াই যায়। সিনথিয়ার বাবার গলা গম্ভীর। তিনি বলেন,
— আমার সে সময় একান্নবর্তী পরিবার। জীবন নদীর স্বচ্ছ জলের মতো একদিকে চলছিলো। তবে একা আর কতো দিন। আমি একজন থেকে আমরা হলাম। তোর মা আর আমি খুনশুটিতে চলছিলো দিনকাল। জবের সুবাদে আমি অন্য জায়গায় থাকতাম।ছুটি পেলে বাসায় আসতাম। চলছিলো এভাবেই। কিন্তু জীবনের নিয়ম তো ভিন্ন। দুই জন থেকে তিন জন হতে হবে। জগতের মানুষের যে বড্ড তাড়া।
কিন্তু আল্লাহ্ না চাইলে দু”জন থেকে তিন জন হই কি করে। মানুষের কথা শুনতে শুনতে ছয় বছর পেরিয়ে গেলো। নতুন অতিথি এলো না। ঘরে বাইরে জীবন হলো যুদ্ধের মতো। কথা আর আড় চোখে প্রতিনিয়ত যেনো ভস্মীভূত হতে হতো। তোর মা মানষিক ভাবে বিধ্বস্ত। সাত বছরের মাথায় সিদ্ধান্ত নিলাম বাচ্চা এডপ্ট নিবো। অনেক খুঁজে বাচ্চার সন্ধান মিললো। আমার এক বন্ধুর ছিলেন ডক্টর। তার সাহায্য হাসপাতালে গেলাম। সদ্য জন্মানো বাচ্চার মা মেনটালি ডিজঅর্ডার। তার বাবা তখন জেলে। ফ্যামিলি ব্যাকরাউন্ড শুনে পিছু হটতে চাইলো সানজিদা।আমি বললাম বাচ্চার কি দোষ?? তোকে আমি এই দুহাতে আকড়ে ধরে বুকে নিলাম। সেদিন প্রথম বাবা হওয়ার অনুভূতি পেয়েছি। সেদিন থেকে তুই আমার মেয়ে। আমার মা। আমি বরাবর চেষ্টা করেছি তোকে ভালোরাখার। জানিনা কতোটুকু পেরেছি।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ঐ সময়ের কিছু ঘটনা তোর জানা উচিত। তোর বাবার নাম ছিলো শাহজাহান। সবাই তাকে সম্রাট শাহজাহান নামেই চিনতো। টাকার বিছানো সে ঘুমাতো। ঐসময়ের দেশব্যাপী তার নামডাক ছিলো তার। ছোট থেকে বড় সবাই এক নামে চিনতো। দরিদ্র মানুষজন দের প্রতি তার সহানুভূতি ছিলো। মানবতার ফেরিওয়ালাও বলা হতো তাকে। তার সুনামের কথা দেশব্যাপি জানতেন। একটা সময় আর্মির উধ্বতম কর্মকর্তা তার পিছু লাগেন। এবং তিনি অনেক প্রুফ বের করেন। একপর্যায়ে মুখোশের আড়ালের মানুষটাকে তিনিই সবার সামনে প্রথম বার এক্সপোজ করেন। মানবতার ফেরিওয়ালা শাহজাহানের নামের সাথে যুক্ত হয় ক্যাসিনো সম্রাট।
তিনি শহরের বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে ক্যাসিনো চালাতেন। এটার এভিডেন্স উঠে আসলেও সম্রাট শাহজানের সাথে পেরে ওঠেন না আর্মির কর্মকর্তা। শুরু হয় জয় পরাজয়ের যুদ্ধ। এবং তা চলে পাঁচ থেকে জয় বছর। ঐসময়ের কর্ণেল সম্রাট শাহজাহানকে জেল অবধি নিতে সক্ষম হন। শাহজাহানের হাত এতো লম্বা ছিলো তার সাথে পেড়ে ওঠা দুষ্কর। তিনি বরাবর কেসের বিপক্ষে প্রুভ দাঁড় করান। প্রায় সাত বছর লড়ার পর অসাধ্য সাধন করেন কর্ণেল। সম্রাট শাহজাহানকে জেলে নেওয়া হয়। তখন তুই তোর মায়ের গর্ভে।তোর মা তখন সহ্য করতে না পেরে মানষিক ভারসাম্য হারায়। ঐদিকে শাহজাহান বের হতে পারে না। বাধ্য হয়ে তোকে এডপ্ট দেয়।এর পরে অবশ্য সম্রাট শাহজাহান ক্ষমতার জোড়ে জেল থেকে বের হয়। তিনি তোকে দেখতে এসসেছিলেন। যেহেতু তোর মা নরমাল কন্ডিশনে ছিলেন না। ঐজন্য তোরে নেওয়ার জন্য জোর করেননি।
এরপরে ঐ কর্ণেল বাজে ভাবে একটা কেসে ফেসে যান। এবং তার চাকরিচ্যুত করা হয়। শুনেছিলাম এরপর কর্ণেলের ওয়াইফ তার দুই বাচ্চা রেখে অন্যের সাথে চলে গিয়েছিলেন।এর পরের ঘটনাগুলো স্বাধারণ মানুষের কাছে এখনো ধোঁয়াসা। এরপরে একটা সময় সম্রাট শাহজাহান সহ আরও কিছু বড় শিল্পপতীসহ এমপি মন্ত্রীরা ও হঠাৎ করে গুম হয়ে যায়।এই কেস গুলো এখনো ইনকমপ্লিট। কে বা কারা এই কাজ করেছে এখনো জানা যায়নি।
সিনথিয়া সবটা মনোযোগ দিয়ে শুনে বলে,
— সম্রাট শাহজাহান কি সত্যিই খারাপ লোক ছিলেন?
— এর সঠিক তথ্য এখনো আজানা।
ভরসন্ধ্যা বেলা পাখির কুহু কুহু শব্দে বেজে ওঠে কলিং বেল। সিনথিয়া কিচেনে চা করছিলো।মাথাটা টনটন করছে। এই মূহুর্তে কড়া লিকারের চা মন্দ হবেনা। চায়ের পাতিলে পানি বুদবুদ হয়ে ফুটছে। কলিং বেলের শব্দে নিজের মাথায় কাপড় টেনে নেয় সিনথিয়া। তারপর লুকিং গ্লাসে চোখ ফেলতেই পলাশের মতো টুকটুকে ফুরফুরে মনটা করলার মতো তেতো হয়ে আসে। দরজার ওপাড়ে জিসান দাঁড়িয়ে। সাথে আরও কেউ আছে।সিনথিয়া দরজার খুলেই দৌঁড়ে কিচেনে চলে যায়। পানির হিসহিসিয়ে ওঠা ধোঁয়ার মতো শরীর টা হিসহিস করছে।সে প্রয়োজনের চেয়েও বেশী লিকার ঢেলে দেয় ফুটন্ত পানিতে। চা হয়ে এলে সোজা ঘরে চলে যায়। আজকের মতো তার বাইরে বের হওয়া বারণ।
ড্রয়িং রুমে আদরে সবার গদগদ অবস্থা। আদুরে আপ্যায়নে ফেঁটে যাচ্ছে চার দেয়াল। সিনথিয়া মায়ের নাম্বারে ফোন দেয়। তারপর রেগে বিষধর সাপের মতো হিসহিস করে বলে,
— হাসো, কাঁদো, গড়াগড়ি খাও। আই ডোন্ট কেয়ার। তবে এতো আহ্লাদির সুর যেনো আমার ঘরে না আসে। না হলে বাইরে চলে যাবো বলে দিলাম।
সানজিদা বেগম নিরবে ফোন রেখে দেন। জিসান সহ সবাইকে তিনি বসতে বলেন। জিসান বসে সোফায়। পাশে তার মা। সিনথিয়ার বাবা বসেন সিঙ্গেল সোফায়। ঠিক তখন-ই জিসানের মা বলেন,
— সিনথিয়া কই??
সিনথিয়ার মা কথা লুকিয়ে মিষ্টি হেসে বলেন,
— ওর খুব মাথা ব্যাথা। একটু শুয়ে আছে..
— তাই বলে ভর সন্ধ্যা বেলায়। ডাকো তো ওকে।কতোদিন পর এলাম দেখা করবো না।
সানজিদা সব জানেন।মেয়েটা জিসানকে মোটেও পছন্দ করে না। এই মূহুর্তে ডাকতে গেলে কি হবে সেটা ভেবেই ভয় পাচ্ছেন তিনি। মেয়েটা এমনিই ট্রমার মধ্যে থাকে এর মধ্যে কোনো প্রেশার দেয়ার ইচ্ছে তার নেই। মেয়ে খেলা করুক প্রয়োজনে ঘুড়ির মতো খোলা আকাশে উড়ুক। ওর ভালো থাকাটাই এখন প্রথম প্রায়োরিটি। তবে জিসানের মাও যে ছাড়ার পাত্রী না। সানজিদা বেগম বলেন,
— আরে ভাবী বসুন না। ঘুম কাটলেই আসবে. আমি চা করে আনি…
সিনথিয়ার বাবাও সুর মেলায়। তবে জিসানের মা উঠে যায়। সিনথিয়ার দরজায় টোকা দিয়ে বলে,
— বাইরে আয়তো….
সিনথিয়ার মেজাজ চটে যায়।ঐদিকে দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হতে থাকে।সিনথিয়া বাইরে এসে দাঁতে দাঁত চেপে কুশল বিনিময় করে। জিসানের মা টেনে বাইরে নিয়ে যায়।সিঙ্গেল সোফায় বসে সিনথিয়া।অসহ্য অসহনীয় লাগছে। তবুও কিচ্ছু করার নেই। সিনথিয়ার মা সবার জন্য চা করে আনেন। শুরু হয় খোশগল্প। একপর্যায়ে সিনথিয়ার বাবা জিসানের উদ্দ্যেশ্য বলেন,
— পিঠের কি অবস্থা এখন। পেইন আছে??
জিসান বলে,
— আগের থেকে বেটার।
— ইনভেস্টিগেশন কতদূর।
— কোনো নিউজ নেই।
— ঐটা আসলে কি ছিলো বলতো?? আসলেই কি জন্তু??
— অনেকটা কালো ছায়ার মতো। কোনো জন্তুর পোশাকে ছদ্মবেশী কেউ। প্রথমে সে রাস্তায় সামনে ক্রস করে গেলো। প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম। এরপর আমার কলিগ আমাকে রেখে পালিয়ে গেলো। এরপর আমার পায়ে শিকলের মতো কিছু আটকে যায়। আমি মাটিতে পড়ে যাই।
এইটুকু বলেই জিসান উল্টো ঘুড়ে দাঁড়ায়। টিশার্ট খুলে ফেলে। এক আকাশ পরিমাণ ঘৃণায় গা গুলিয়ে আসে সিনথিয়ার। ঘৃণা থাকা সত্বেও মাথার মধ্যে চলা প্রশ্নের উত্তর মেলাতে সিনথিয়া চোখ তুলে তাকায়। জিসানের ফর্সা পিঠ। গোল গোল পাশাপাশি ছয়টা কামড়ের দাগ। যেনো পিঠের মাংস গোল গোল করে ছিড়ে ফেলেছে।সিনথিয়ার আত্মা কেঁপে ওঠে। অসংখ্য প্রশ্ন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।তার পিঠেও ছয়টা কামড়ের দাগ আছে। এটা ইরফাদ জানতো। সে অস্বীকার করলে তার ভেতর থেকে ঠেলে আসে একটা কথাই। এটা প্রতিশোধ নয়তো? তার হয়ে ইরফাদ আঘাত করেনিতো? জিসান পূর্বের মতো বসে। তার পর বলে,
— এই ছয়টা কামড় বিষাক্তের চেয়েও যেনো বিষাক্ত ছিলো। কামড় খেয়েই সেন্স ছিলো না আমার।
— ডক্টর কি বললো!
–তারা তো বললো জন্তু জানোয়ার নাকি মানুষের কামড় কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
ঠিক সে সময়ে জিসানের মায়ের কন্ঠ ধীর,
— ভাই কি বলবো। আমার ছেলে তো একটা ভুল করেছিলো অনেক আগে।সিনথিয়ার পিঠে কামড় দিয়ে আমার ছেলে ভুল করেছে।এর চেয়েও শতগুণ ব্যাথা দিয়ে কে আমার ছেলের পিঠ কামড়ালো জানিনা।সেদিনের ঘটনা কেনো ঘটলো তাও জানিনা। রূহের হায় বলতে নাকি একটা কথা আছে। আমার একটাই ছেলে। আমি চাইনা ওর উপর আর কোনো কালো ছায়া আসুক। সিনথিয়ার মনে ওকে নিয়ে ক্ষোভ থাকতেই পারে। কষ্ট থাকতেই পারে। আমি চাই ওকে আমার জিসানের বউ করে নিতে।
সিনথিয়ার মুখটা মেঘের মতো কালো হয়ে আসে। জিসানের মুখটা নিচু। হাটুর উপর ঠেকানো হাত। মাথা হাতে ভর করা। সে নিচু স্বরেই বলে,
— অনেক বড় ভুল করেছিলাম। আমি আমার ভুল শোধরানোর সুযোগ চাই।
সিনথিয়া একলাফে উঠে দাঁড়ায়। তার কন্ঠে তোলপাড় করা সুর,
— আমি সবাইকে মাফ করেছি। বিয়ে করে কারো ভুল শোধরানোর প্রয়োজন নেই।
বলেই হনহনিয়ে নিজের ঘরে যায় সিনথিয়া। তারপর খট করে দরজা লাগায়। শব্দে নড়েচড়ে বসে সবাই। ড্রয়িং রুমে একে অপরের চোখে চোখ রেখে আবার দৃষ্টি লুকায়।
ড্রয়িং রুমে আধবসা হয়ে ফোন স্ক্রল করছে শিশির। তিথির মামি আর কুটুস বসে টিভি দেখছে। তিথি সবার জন্যে চা আর স্ন্যাকস নিয়ে আসে। কুটুস আর মামির জন্যে টি টেবিলে ট্রে রেখে শিশিরের জন্যে চা নিয়ে যায়। শিশির আধশোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসে। চায়ের কাপ ধরার অযুহাতে আলতো করে স্পর্শ করে তিথির হাত। তিথি শিউরে উঠে। চোখ গোল গোল আকারের হয় আপনাআপনি। পেছন ফিরে একপলক দেখে নেয় মামিকে। ব্যাস লোড শেডিং। চোখের পলকে নিজের বউকে ঝাপটে ধরে শিশির। স্নিগ্ধ আলিঙ্গনে শিরশিরিয়ে ওঠে তিথির পায়ের তলা,হাতের তালু আর শূন্য হয়ে যায় পেট। বরফশিক্ত অনুভূতিতে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তিথি। মোবাইলে ফ্ল্যাশ জ্বলে ওঠে। কিঞ্চিৎ সময়ের মধ্যে ঘটে যাওয়া অনুভূতির রেশ বুকের মধ্যে চলমান থাকলেও দুজন মানুষ এখন দু”প্রান্তে। বুকের মধ্যে অনুভূতি গুলো সমান তালে শব্দ তুলে বাজছে। তিথি বুকের কাঁপুনিতে শ্বাস বন্ধ করে রাখে। তালমাতাল অনুভূতিতে বিভোর হয়ে বেসামাল হয়ে ডুবে যাচ্ছে তিথি।
বিকেলে সিনথিয়ার নামে একটা পার্সেল এসেছে। তবে খোলা বারণ ছিলো। কেনো? কি কারণ? জানা নেই। অপেক্ষা শুধু ইরফাদের কলের।
তুমুল শব্দে ভেঙ্গে চুড়ে বেজে ওঠে সিনথিয়ার ফোন। ইরফাদের আসা কোনো কল ই যেনো মিস না হয়। এই জন্যেই এমন ব্যবস্থা। ফোন ধরে সালাম বিনিময় করে পরের কথোপকথন,
— পার্সেল টা কিসের??
— খুলে দেখো এখন।
সিনথিয়া একহাতে পার্সেল খোলে। সাদা ব্যাগের মধ্যে থেকে কালো রঙের কিছু একটা। কাঁধ দিয়ে ফোন ঠেকিয়ে মেলে ধরে জিনিসটি। কালো রঙের বোরকা। সিনথিয়া বিস্মিত চোখে তাকায়।তারপর বলে,
— এসব কেনো পাঠালেন।আমি নিজেই কিনে নিতাম??
— পড়ে নাও…
–তাই বলে….
— বেশী কথা বোলো না।পড়ে সোজা বাইরে চলে আসবে। প্রবলেম??
— নাহ….
— স্নিকারস পড়ো এর সাথে। নিকাব আর সাথে কালো কোনো সানগ্লাস। আই মিন তোমাকে যেনো চেনা না যায়! সাথে তোমার ভাইয়ার দেয়া ফোনটা আনবে।ঐ রাস্তায় আজ সিসি ক্যাম লাগানো হয়েছে। বি কেয়ার ফুল। প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করবে ওকে??
সিনথিয়া ইরফাদের কথা মতো প্রস্তুত হয়। তারপর বেড়িয়ে যায়। রাস্তার মোরে গিয়ে গাড়ির অপেক্ষা করে। চোখ ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে ইরফাদকে খুঁজে বেড়ায়। না ইরফাদ কে দেখতে পায় আর না কোনো গাড়ি দেখতে পায় না। মনটা হঠাৎ কূ ডাক দেয়। ইরফাদ তো বরাবর আগে এসেই থাকে। আজ কেনো আসছে না। বুকের মধ্যে ভয় গুলো দানা পাকাতে থাকে। দূরে একটা গাড়ি দেখা যাচ্ছে। তবে মেরুন রঙের। ইরফাদের গাড়ি তো এই রঙের না।সিনথিয়া এই গাড়িটি চেনে না। সিনথিয়া ভ্রু তুলে অন্য গাড়ি আসছে কি না দেখে। মেরুন রঙের গাড়িটি ঝড়ের গতিতে তার সামনে এসে থামে। সিনথিয়ার শ্বাস কিছুক্ষণের জন্যে থেমে যায়।ভেতরের চেপে থাকা ভয় গুলো চেচিয়ে ওঠে। গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসা লোকটার বিধ্বস্ত মুখ,চোখে কালো রঙের গগলস, স্ট্রিয়ারিং এ রাখা হাত দুটোতে গ্লাভস,মাথায় হুডি টানা। সিনথিয়া ভয় চেপে অন্যদিকে পা বাড়ায়। তখন-ই গাড়ির দরজা ধাক্কা দিয়ে খোলে। সিনথিয়ার বুকটা ধুক করে ওঠে। শূন্য হয়ে যায় মাথা। তার মনে হয় বিপদসংকেত। তাকে পালাতে হবে।বাঁচতে হবে। শূন্য মস্তিষ্কে তালমাতাল হয়ে সামনের দিকে ছোটে সিনথিয়া।পেছনের গাড়িটি তার চেয়ে দ্বিগুন জোরে ছোটে তার পিছু পিছু।
তিথি বিছানায় শরীর মিলিয়ে দিয়ে শুয়ে আছে। বুকের মধ্যের কাঁপুনি দিরিম দিরিম করে এখনো বেজেই চলছে। তার সাথে বেড়েই চলছে শিশিরকে আরেকবার স্পর্শ করার সুপ্ত ইচ্ছা। তবে আজ রাত তো অপেক্ষায় অপেক্ষায় কেটে যাবে। সে কি কোনো দিন অধিকার নিয়ে সবার সামনে তার প্রিয় মানুষটির সাথে কথা বলার সুযোগ পাবে! কখনো কি এমন সুযোগ আসবে? কখনো কি মামি মেনে নিবে? কখনো কি অধিকার নিয়ে শিশিরের ঘরে একটা পূর্ণ রাত থাকতে পারবে?? তার বুকে মাথা রেখে কি কোনো দিন ভোরের সূর্য দেখা হবে?? নাকি গোপনে সাজানো সুখের আশ্রয় গোপনেই বিলিন হয়ে যাবে।
সিনথিয়ার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। কে তার পিছু নিলো? এমন তো হওয়ার কথা ছিলো না। তাহলে ইরফাদের কি কোনো বিপদ হলো! সিনথিয়া ঝড়ের গতিতে দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে দৌড়ায়। মাঝখানে একবার পেছন ফিরে চায়। গাড়িটি তার চেয়েও গতি নিয়ে ছুটছে।আর তার রক্ষা নেই। শ্বাসরোধ হয়ে আসে। ঠিক সে সময় গাড়িটি তার পাশাপাশি হয়। তারপর হাওয়ার গতিতে তার সামনে। চোখের পলক ফেলার আগে গাড়ির দরজা খুলে বাইরে আসে মুখোশধারী লোকটি। দীর্ঘদেহী লম্বা-চওড়া লোক। আপাদমস্তক কালো পোশাকে ঢাকা। কালো রঙের পোশাকটি পেছনের দিকের মাটি ছুঁয়েছে। অনেকটা গল্পের জগতের ভ্যাম্পায়ারের মতো। মুখে ভয়ানক মাস্ক পড়া। চোখে গগলস। সিনথিয়া কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
— কে আপনি?
বলা মাত্র-ই লৌহকঠিন হাতের মুষ্ঠিবদ্ধ হয় সিনথিয়ার হাত। সিনথিয়া নিজের রপ্ত করা কৌশল প্রয়োগ করে। নিজের একহাত মুখোশধারী লোকটির হাতের মধ্যে রেখেই অপর হাত দিয়ে লোকটির হাত সর্বশক্তি দিয়ে মুচড়িয়ে নিচের দিকে টেনে নামায়। যাতে শরীর হেলে পড়ে। তবে হাত একটু নরচড় করতে পারলেও লোকটির শক্তির সাথে পেড়ে ওঠে না সিনথিয়া। লোকটি হেলে গেলেই হাঁটু ভাজ করে বুকে আঘাত করা যেতো। কিন্তু তার কোনো নড়চড় ই নেই। কিছু বুঝে ওঠার আগেই লৌহকঠিন হাতে মুষ্ঠি বদ্ধ হয় সিনথিয়ার দু”হাত। সিনথিয়া পা দিয়ে হাঁটুতে আঘাত করতে চাইলে মুখোশধারী লোকটি পা সরিয়ে নেয়। এবং সিনথিয়া উপায় না পেয়ে নিজের ধারালো দাঁত বসিয়ে দেয় মুখোশধারীর গ্লাভস পড়া হাতে। তবে তাতে মনে হয় না কোনো কাজে আসে। মুখোশধারী লোকটি একটানে ধাক্কা দিয়ে গাড়িতে বসায়। দরজায় লক দিয়ে নিজেও গাড়িতে বসে। তারপর হিসহিসিয়ে সিনথিয়াকে বলে,
রং পর্ব ২৬
— গাঁধা কোথাকার!
গলার স্বরের গাম্ভীর্য আর ধমকের সুরে সিনথিয়া ভ্যাবাচ্যাকা খায়। পরিচিত গলার স্বরে নড়েচড়ে বসে। তারপর ধীর গলায় বলে,
— তো বলবেন না এটা আপনি?
— বলার সুযোগ পেলাম কই….
সিনথিয়ার ভেতর থেকে হাসি ফেঁটে পড়তে চায়। তারপর একটা চিন্তা মাথায় ভারী পাথরের মতো ঠাস করে লাগে। এভাবেই কি জিসানের উপর এট্যাক হয়েছিলো?