রং পর্ব ৪০

রং পর্ব ৪০
তন্নী তনু

–স‍্যার একটা প্ল‍্যান আসছে মাথায়…
–বলে ফেলুন…
— “আপনি তো বললেন ওরা আমাদের মাইন্ড ডায়ভার্ট করে কোনো ক্রাইম করতে চাচ্ছে। এই মূহুর্তে প্রতিপক্ষ দলের মধ‍্যে দন্দ চলছে। এটাকেই কাজে লাগাতে চাই। সিনথিয়াকে বিয়েতে রাজি হতে বলুন। রাফিকে ব‍্যস্ত রাখতে বলুন। এইদিকে তাদের মাইন্ড ডায়ভার্ট থাকলে আমাদের সাইডটা চিন্তা করতে পারবে না। এই সময়ে বাকি খেলাটা ইজিলি শেষ করবেন…..”

সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠে শিশির। রান্না ঘরে কাজ করছে তার মা মার্জিয়া বেগম। পাশেই রুটি বেলছে তিথি। সংসারের সব কাজ-ই তার শেখা আছে। পাশাপাশি পড়াশুনাও ঠিক রাখে মেয়েটা। শিশির রান্না ঘরে ঢুকে গলা খাকারি দেয়। ফিরে তাকায় তিথি। রাতে বলা কথা মনে পড়ে। শিশির কি সব বলে দিতে এলো? বুকের মধ‍্যে ভয়টা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সব শান্তির অবসান ঘটার সময় বুঝি চলেই এলো। মার্জিয়া বেগম ফিরে তাকান। ভ্রু- উচিয়ে বলেন,– কিছু বলবি?
তিথির হাত চলেনা। সত‍্যি সত‍্যি শিশির সবটা বলতে এলো? মামি শুনেই জ্ঞান হারাবে নিশ্চিত । ভাবতেই ঝিম ধরে আসছে মাথা। রুটি বেলা আর হচ্ছে না। মামি তাড়া দেয়। –কিরে এতো সময় লাগে ক‍্যান?
তিথি হাতের জোর বাড়ায়। রুটি হয় মানচিত্র। শিশির খেয়াল করে। তারপর বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— তিথি! বাইরে যা তো…
তিথি শিশিরের দিকে তাকায়। মার্জিয়া বেগম রুটি উলটে পালটে দিচ্ছেন। তিথি একবার শিশির একবার মামির দিকে তাকায়। মার্জিয়া বেগম বলেন,
— ও থাকলে কি সমস্যা?
— সব ওর সামনে বলা যায় নাকি?
মামি চোখের ইশারা দেয়। বাধ‍্য মেয়ের মতো বেরিয়ে যায় তিথি। শিশিরের সামনে কয়েক সেকেন্ডের জন‍্য থামে। চোখের ইশারা যেনো বলে,” প্লিজ বোলোনা। কিচ্ছু বোলোনা।”
শিশির মিটিমিটি হাসে। তিথি আর দাঁড়ায় না। সোজা চলে যায়। শিশির ভেতরে আসে। দাঁড়িয়ে থাকে মায়ের পাশে। মার্জিয়া বেগমের শক্ত গলা,– দাঁড়িয়ে থাকতে আইছোস?
শিশির দম নেয়। মায়ের যে অবস্থা বলার পরে গরম খুন্তি না তার পিঠে চেপে ধরে। মার্জিয়া বেগম পেছন ফেরে। মুখে বিরক্তি,

— বলিস না ক‍্যান?
–এভাবে কথা বললে কিছু বলা যায়?
— কেনো? তোদের কি খেয়ে ফেলবো?
–মা”
— আরে বল…
–মানে ইয়ে…. আমি কাল একটু ঘুরতে যাবো।
পেছন ফেরে মার্জিয়া বেগম। ছেলের চোখ-মুখ দেখে বোঝার চেষ্টা করে। তারপর বলে,
— তোর কোনো ঠ‍্যাকা আছে আমার অনুমতি নেয়ার। তুই চলিস তোর মন মর্জি। এই দোকানে বসিস। এই কয়েকদিন লাপাত্তা, এই আছিস এই নাই। তুই আমার পারমিশন নিতে আসলি বাপরে….

— মা…
–শুনছি তো বল।
–আমি আসলে…
— বিয়ে করবি??
বাকি কথা আর বের হয় না। চুপচাপ দাঁড়ায় শিশির। মার্জিয়া বেগম বলেন,
— বিয়ের কথা তো কতোকাল-ই বললাম। এখন হাল ছেড়ে দিয়েছি। তুই তোর মতো চলিস। কতো করে বললাম অনার্সটা শেষ হলো মাস্টার্স টা কর। নাহ কিছুতেই করলি না। বাবার দোকানে বসলি। মাঝে মধ‍্যে থাকিস আবার নাই হয়ে যাস। মানে বিন্দাস….
আবার কি মনে হলো এতো বছর পর গ‍‍্যাপ দিয়ে মাস্টার্সে ভর্তি হলি।তাও আবার এমপি মন্ত্রীদের ছেলেদের সাথে। বুঝি না তোর মতিগতি। বিয়ের কথা বললে তো বলিস মাস্টার্স কমপ্লিট তো হোক। আমরা তো বিয়ের কথা বলেছিই….তুই করিস নি বিয়ে…

— আরে বিয়ে তো মেনটালি প্রিপেয়ারের ব‍্যাপার না?
— জব নে তাহলে..
— বিজনেস তো করছিই মা। জব এ কি এতো ফ্রিডম আছে?
— তোর সাথে আমি পারবো না। তোদের সব কয়টার সাথে এতো চিল্লাচিল্লিও আর ভালোলাগেনা। যা খুশি কর…
–মা”
— বলে ফেল…
— নিজের পছন্দ থাকলে কি তুমি খুব বেশী কষ্ট পাবে?
বলেই চোখ বন্ধ করে শিশির। কি যে আছে কপালে। সারাদিন চিৎকার চেচামেচিতে না আজ বাসায় থাকা কষ্ট হয়ে যায়। মার্জিয়া বেগম খানিকটা অবাক হয়। ছেলে তাকে এতোটাও মানে? মায়ের দিকটাও ভাবে। ছেলের দিকে এগিয়ে আসে মার্জিয়া বেগম। তারপর বলে,
— বিয়ে তাকেই করা উচিত যাকে অনুভব করা যায়। তবে দেখিস মানুষটা যেনো ভুল না হয়। জীবন সঙ্গী ভালো হলে কেবল দুনিয়াতেই জান্নাত খুঁজে পাওয়া যায়। সংসার তো আমি করবো না। সারাজীবন আমি থাকবোও না।
মায়ের এমন উত্তরে নিজেই অবাক হয় শিশির। তার মা এতোটাও বোঝে! কই এতদিনেও তো মা”কে বুঝতে পারলো না সে। চোখ খুলে তাকায় শিশির। বুকের উচ্ছাস যেনো উপছে পড়ে গলার স্বরে,
— সত‍্যি!

বড় একটা রুম। রুমের একপাশে বিছানা পাতা। অপর পাশে আছে একটা মেঝে পর্যন্ত থাই গ্লাস। তবে তাতে পর্দা টানা। তাই বোঝা যাচ্ছে না ঠিক তারা কোথায় আছে।কয়টা বাজে। জাবির বলে,
— স‍্যার কত সময় পেরিয়ে যাচ্ছে।প্ল‍্যান টা কি কাজে লাগানোর সময় এলো?
— ওয়েট ওয়েট!
–আর ওয়েট না স‍্যার! আমার টু-কোয়াটার শর্টসের সাথে একটা চাবির রিং লাগানো আছে। তার সাথে একটা ছোট্ট গিটার আছে। ওরা সব চেক করলেও এটা খুলে নেয় নি।
— সো হোয়াট!
— স‍্যার এটা লাইটার।
— দ‍্যাটস গ্রেট জাবির।
— জ্বি স‍্যার। আমাদের বাইরে যাওয়াটা জরুরি। ফাস্ট অফ অল সিনথিয়া ইবনা ঠিক আছে কি না। সেকেন্ড আমরা সেই কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছেছি কি না দেখা দরকার।
ইরফাদ চুপচাপ থাকে। কিছুক্ষণ ভেবে চিন্তে বলে, — ওকে! কাম….চেয়ার মেঝেতে স্লিপ করার ট্রাই করুন।অথবা চেয়ার শূন‍্য তুলে সামনের দিকে আসুন।
— ইয়াহ সিওর স‍্যার।

জাবির মেঝেতে পা রাখে। প্রথমে চেয়ার মেঝেতে ঘেঁষে ঘেঁষে ইরফাদের দিকে আগায়। ইরফাদ ও জাবিরের দিকে যায়। তারপর পায়ে ভর করে ধীরে ধীরে ইরফাদের পেছনের দিকে যায় জাবির।চেয়ার টানতে টানতে ইরফাদের হাতের পেছনে পৌঁছে যায় জাবির। তারপর বলে,
–স‍্যার। হাত বাড়ান।
ইরফাদ বাঁধা হাত দিয়েই লাইটার খোঁজে। তবে উপরে লুঙ্গি পড়া। তাই লাইটার খুঁজে পায় না ইরফাদ। জাবির বলে,
— টানুন। খুলে গেলেই কোমরের পাশেই আছে।
লুঙ্গি টেনে সরিয়ে লাইটার হাতের নাগালে পায় ইরফাদ। জাবির তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে,
— স‍্যার টান দিয়ে ছিড়ে ফেলুন।
ইরফাদ শক্ত করে ধরে টান দেয়।ছোট শেকলটা ছিড়ে যায়। পিছু ফিরে দেখার চেষ্টা করে ইরফাদ। কিন্তু চোখ সেই অবধি পৌঁছায় না। জাবির বলে,

— লাইটার আমার হাতে দিন।
–কেনো?
— আমি নিজের হাতের বাঁধন আগে খুলে নেই। তারপর আপনার হাত সেইফলি খোলা যাবে।
— হাত পুড়বে আপনার জাবির।
–আমার চেয়ে আপনার সুস্থ থাকাটা জরুরি। আমি চাইলেই সবাইকে মুক্ত করতে পারবো না। এতো বুদ্ধি আর গায়ের জোর কোনোটাই আমার নেই।সো….
জাবির আবার উল্টোদিক ঘোরে।ইরফাদের হাত থেকে লাইটার নিতে চায় জাবির। ইরফাদ দেয় না। ইরফাদ আদেশের গলায় বলে,
— আমি জ্বালাচ্ছি। আপনি হাত পিছনে সরিয়ে রাখুন। সাইডে আনুন। তাপ লাগলে হাত সরিয়ে নিবেন। ওকে?
–ওকে স‍্যার!
ইরফাদ লাইটার অন করে। জাবির পিছন ঘুরে লাইটার দেখার ট্রাই করে। তারপর পাশ ফিরে একবার লাইটার দেখে তার উপর মোটা দড়ির সাইডটা রাখে। ধীরে ধীরে জ্বলে ওঠে আগুন। হাতের উল্টোপিঠে তাপ লাগে। তবে দড়ি পোড়া অবধি জ্বলতে হবে তাকে। ইরফাদ পাশ থেকে জিজ্ঞেস করে,

–আর ইউ ওকে?
— আ”ম ওকে স‍্যার।
মোটা দড়ি পুড়তে থাকে। পুড়তে থাকে হাত। নিরবে সহ‍্য করে জাবির। আর বল প্রয়োগ করে দড়ির উপর। দড়ি অর্ধভাগ পুড়লেই যেনো বাকিটা ছিড়ে ফেলা যায়। এর মধ‍্যেও কয়েকবার জিজ্ঞেস করে ইরফাদ,” ঠিক আছে কি না? জাবির বলে — সব ঠিক আছে।
অতঃপর হাতের বাঁধন খোলে জাবির। নিজের পা। শরীরে বাঁধন মুক্ত করে। তারপর ধীরে ধীরে খুলে দেয় ইরফাদের বাঁধন। উঠে দাঁড়ায় দু”জন। ঠিক তখন-ই বাইরে মেঝেতে পায়ের শব্দ শোনা যায়। কেউ আসছে। দু”জন দুজনের দিকে তাকায়।

দু-বক্স খাবার। দুটো পানির বোতল। হাতে চাবি। রাফসানের অর্ডার। খাবার পানি ভেতরে দিয়ে কিছুক্ষণের জন‍্য হাত খুলে দিবে। খাওয়া শেষ হলে। দরজা বন্ধ করে বাইরে আসবে। বাকি কাজ খাবার-ই করবে। সারারাত ঘুমেই কাটবে তাদের। কথা অনুযায়ী কাজ। দরজা খোলে দানবীয় শরীরের লোকটি। দেখতে বিশালাকার। ফরেনার মনে হচ্ছে। লোকটি ভেতরে প্রবেশ করে। সব আগের মতোই ঠিকঠাক । জাবির বসে আছে চেয়ারে। ইরফাদ বসে আছে চোখ বন্ধ করে। দুজনের হাত পেছনে বাঁধা। পায়ের উপর দড়ি। তবে শরীরের বাঁধন নেই। লোকটি ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে চিন্তা করে। আগেও কি এভাবেই বাঁধা ছিলো? সাথে ভেতরে প্রবেশ করে দরজায় লক দেয়। চাবি পকেটে ঢুকাতেই পেছন থেকে শক্ত হাতে মুখ চেপে ধরে ইরফাদ। জাবির কেড়ে নেয় চাবি। লোকটাকে টেনে হিচড়ে বসায় চেয়ারে। মুখের মধ‍্যে ঢুকিয়ে দেয় বালিসের কভার। হাত পা বাঁধে। তারপর লাইট বন্ধ করে দেয়। সময় খুব অল্প।আবার ফিরতে হবে তাদের। প্ল‍্যান সাজাতে হবে সে ভাবেই। ইরফাদ আর জাবির বের হয়। খুব সাবধানে পা ফেলে। পর পর দুটো রুমে কান পেতে থাকে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। কোথায় তারা? সিনথিয়াই বা কোথায়? আন্দাজে কি তাকে খুঁজে বের করা সম্ভব?

একে একে কয়েকটা রুমে কান পাতে। কর্ণারের রুম থেকে ভেসে আসছে চিৎকার চেচামেচি। জাবির ইরফাদ সেদিকে পা ফেলে সাবধানে। যেনো কেউ না দেখে। শূন‍্য হাত। এই মূহুর্তে ধরা পরাই যাবে না। শুনতে পায় সিনথিয়ার গলা,
— আমি কোনোভাবেই ওকে বিয়ে করবো না। পাগল হয়ে নাকি? ও একজনের বর।
–বিয়ে আমি সেচ্ছায় করিনি সিনথিয়া। এক কথা বারবার বলতে হবে কেনো?
— আর ইউ ম‍্যাড?? বিয়ে তো বিয়েই।
–তুমি বাচ্চা মানুষ এতো বুঝবে না। আমার কথা রাফসান ভাই এর সাথে…
রাফসানের রক্তচক্ষুও রাফিকে থামাতে পারছে না। দলবল নিয়ে যখন তখন সিনথিয়ার রুমে ঢুকে পড়ছে। সে রীতিমতো ফোর্স করে যাচ্ছে-বিয়ের জন‍্য। রাফসান রাজি হচ্ছে না। তার শ্বাসের গতিআর রক্তচক্ষু শুধু বলে দিচ্ছে। “যা হয়ে যাক হবে। তবুও বিয়ে দিবে না।”
রাফি বলে আবার,

–কি চান তাই বলুন?
রাফসান চোখ তুলে তাকায়। ক্রুদ্ধ গলায় বলে,
–এক কথা আমি বারবার বলবো না।
— না কে কি করে হ‍্যাঁ তে কনভার্ট করতে হয় আমি তা জানি।
বিছানায় সিনথিয়ার পাশে বসা রাফসান ক্ষেপাটে হয়ে যায়। হুরমুরিয়ে উঠে আসে রাফসান। শার্টের কলার চেপে ধরে। তারপর হুংকার দিয়ে বলে,
— তুই কি করে বের হস দেখে নেবো।
দুইজনের বেঁধে যায় সামনাসামনি যুদ্ধ। রাফিও রাফসানর কলার চেপে ধরে। দুজনের চোখ যেনো কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে। রাফসান রাফির কলার ছেড়ে ধাক্কা দেয়। পিছিয়ে যায় রাফি। নিজেকে সামলে নিয়ে ছুটে আসে আবার। রাফির সাথে লেগে যায় দন্দ। রাফসান রাফির চোয়ালে ঘুষি দেয়। রাফি উল্টো রাফসানের পেটে বুকে ঘুষি দেয়। রাফির সাথে থাকা আরও দুজন এগিয়ে আসে। দল ভারী রাফির। হাত মুষ্টি করে রাফসানের চোয়াল বরাবর ধরতেই।সিনথিয়া উঠে যায় তখন। দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে দিকে এগিয়ে আসে। রাফি একহাতে থামানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সিনথিয়া এলোপাথাড়ি ঘুষি দেয়। রাফি নিজের চোখ মুখ বাঁচাতে চোখ মুখ ঢেকে ফেলে। বাকিরা এগিয়ে আসলে রাফি বাঁধা দেয় তারপর বলে,

–ভালোবাসি বলেই আঘাত করতে পারিনা।
–ভালোবাসা মানে শুধু আমাকেই ভালোবাসা। বড় ভাই আমার সে। তুই তাকৈ টাচ করিস। তোকে করবো বিয়ে।অমানুষ, জানোয়ার। গেট লস্ট।
রাফি পিছিয়ে যায়। রাফসানের দিকে আঙুল তুলে। তারপর ওয়ার্নিং দেয়,
— ফাইনাল এর আগের দিন পর্যন্ত টাইম। সিনথিয়া আমার নয়তো এ‍্যপস অটোমেটিক ডিসেবল হবে। আমাকে যতোই ধরে বেধে রাখিস সে সিস্টেম আমার করাই আছে।
রাফসান রক্তচক্ষুতে তাকায় আবার।
— তুই যা করার করিস।
সিনথিয়া রাফসানের দিকে তাকিয়ে বলে,
— কি বলছে ও??
রাফির ফোন বেজে ওঠে। তারপর রাফসানের দিকে তাকিয়ে বলে,
— বস ফোন দিয়েছে কথা বলুন।
রাফির ফোন ফিরিয়ে দেয়।নিজের ফোন বের করে ধরে রাফসান। তারপর বলে,

— জ্বী বলুন…
— কি শুনছি? তীরের কাছে এসে তরী ডুবাতে চাইছো?
— তরীতে কি আমার বোন বেশী হয়ে গেছে। তাকে ফেলে দিয়ে এখন সবাইকে বাঁচাবো?
— তুমি তো দেখছি জ্ঞান বুদ্ধি হারিয়ে বসে আছো। এমন তো ছিলেনা। আই নোউ সিচুয়েশন হ‍্যান্ডেল করার তীক্ষ্ম বুদ্ধি তোমার আছে।
— তাই বলে…
–মন দিয়ে কথা শোন…
সিনথিয়া রাফসানের দিকে তাকায়। কি এমন জিনিস? যার বিনিময়ে রাফি তাকে চায়। রাফসান মেঝেতে হাঁটছে। রাফি রাফসানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ফোন রাখে রাফসান। হঠাৎ করেই পালটে যায় সব। রাফসান সিনথিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
— আমার কিছু করার নেই আর। বিয়ের জন‍্য নিজেকে প্রিপেয়ার করে নে…..

–মানে?
রাফি দুষ্টু হাসি হাসে।
অজানা ভয়ে শরীর শিউরে ওঠে সিনথিয়ার। এতো গুলো শয়তানের ভীরে সে নিজেকে কি করে বাঁচাবে। শেষ পর্যন্ত তার নিজের ভাই এমন করলো। বুক ভারী হয়। চোখ ফেটে যেনো পানি টলমল করে ওঠে। ওদিকে
রাফসান রাফির দিকে তাকায়। তারপর বলে,
— এখন বের হ..বিয়ের আগে একটা কথাও বলবিনা। যাহ…
বলেই বাইরের দিকে পা বাড়ায়। বাকিরাও পিছন ফিরে বাইরের দিকে পা বাড়ায়। পায়ের শব্দ বুঝে
ইরফাদ আর জাবির পিছিয়ে আসে। রাফসান সিনথিয়াকে বলে,
–বস এখানে। আমি খাবার নিয়ে আসছি।
সিনথিয়া কেঁদে ফেলে। তারপর ডাকে,
— ভাইয়া!
– আসছি বলছি তো….
রাফসান দরজায় পেছন থেকে লাগিয়ে যায়। লক দেয় না। সিনথিয়া চাইলেও বের হতে পারবে না।

সিনথিয়ার ভেতরে সৃষ্ট দাবানলে পুড়তে থাকে শরীর। শরীরের শক্তি আর মনের বল ঝুরঝুরে বালির মতো ঝড়ে পড়ে। এভাবে কত দিন লড়বে সে? কয়েকদিনে শতচেষ্টাতেও সে রুম থেকে বের হতে পারেনি। এখানে সবসময় জান যেনো গলায় ঠেকে থাকে। হাঁসফাঁস করতে থাকে।কখন যেনো প্রাণটা বেড়িয়ে যায়। নিজেকে কতোক্ষণ একা সেইভ করে যাবে। এতো এতো এতো সমস‍্যা কেনো তার জীবনে।জীবন কি একটু সহজ হতে পারতো না। বাইরে থেকে শক্ত খোলস পড়ে থাকলেও ভেতরটাতো দূর্বল। ভিষণ দূর্বল।একটা সাধারণ মেয়ে কখনো এতো প্রতিপক্ষের সাথে ফাইট করে টিকে থাকতে পারে। কখন যেনো হেরে যায় সে। ইরফাদ কোথায়? ঠিক আছে তো? এই একটা কথা মনে হলে বুকটা ভার হয়ে আসে। দম ফুরিয়ে যেতে চায়। নিঃশ্বাসে যেনো আর প্রশান্তি নেই। অশান্ত হৃদয়, অশান্ত মন।ঢুকরে কেঁদে ওঠে সিনথিয়া। মিনিট পাঁচেক পর জাবির আর ইরফাদ আবার সিনথিয়ার দরজার দিকে আসে। দরজা বাইরে থেকে ছিটকিনি টানা।জাবির আলতো হাতে দরজা খোলে। তারপর ইরফাদকে ইশারা করে আর বলে,– আপনি যান স‍্যার।

ইরফাদ চোখের ইশারায় বলে, চলুন…
জাবির ফিসফিসিয়ে বলে,
— পাহারা না দিলে দুজনেই ধরা পড়তে পারি। আপনি যান স‍্যার। প্ল‍্যান বুঝিয়ে দিয়ে আসুন।
ইরফাদ ধীর গলায় সম্মতি দেয়। পা বাড়ায় ইরফাদ। জাবির আরেকবার ডাকে,
— স‍্যার! ইউ আর নট মাই ফ্রেন্ড। বাট ইউ আর অলওয়েজ ফ্রেন্ডলি উইথ মি। ঐ কর্ণার থেকে বলছি। সঠিক ভালোবাসা আর সঠিক মানুষ সবসময় সঠিক সময়ে জীবনে আসে না। আপনি একটা ভাঙা হৃদয় খুঁজতেন। যে আপনার ভাঙা হৃদয় জুরে দিবে।আমি মেয়েটার আপনার প্রতি সফট কর্ণার দেখেছি। যদি তা থেকেই থাকে তাহলে ভালোবাসায় বাড়িয়ে দেয়া হাত ফিরিয়ে দিবেন না। মেয়েটা নিজেকে প্রতিরক্ষা করতেও পারে। একজন এসপির এমন পার্টনার-ই দরকার “রাগীনি-বাঘীনি”। সো ভেবে দেখবেন।
ইরফাদ নিরব, নিস্তব্ধ। যেনো তলিয়ে থাকা অনুভূতি র সাথে বোঝা পড়া করছে। ইরফাদ চুপচাপ সিটকি খোলে। তারপর শব্দহীন পায়ে দরজা ঠেলে ভেতরে যায়। রুমে আলো কম। ড্রিম লাইটের মৃদু আলো জ্বলছে। বিছানা ঘেষে হাঁটুর ভাজে মুখ গুজে আছে। অন্ধকারে ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে শরীর। মেয়েটা কাঁদছে!!ইরফাদ ধীর গলায় বলে,
— সিনথি…

অসময়ে অপ্রত‍্যাশিত স্বর কানে প্রবেশ করা মাত্র সোনালী ধানে হাওয়া লেগে দুলে ওঠার মতো সিনথিয়ার কোমল হৃদয় দুলে ওঠে। চোখ তুলে তাকায় সিনথিয়া। শ্বাস টাও যেনো থমকে যায়। বন্ধ থাকে ন‍্যানো সেকেন্ড। টুপটুপ করা পড়া জলগুলোও যেনো দম নেয়।।মৃদু আলোতে স্বপ্নের মানুষটির মুখ স্পষ্ট তার চোখের সামনে। কি যে উচ্ছাস। শান্ত নদীর জল যেনো হঠাৎ করেই ঢেউ খেলে যায়। কতোগুলো দিন পার হয়ে গেছে তাদের দেখা হয়নি। ঘন নেত্রপল্লব বুঝে একটা শ্বাস টেনে নেয় সিনথিয়া। ভেতরটা তো এই মুখ দেখার তৃষ্ণায় তীব্র খড়ায় ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। লোকটা কি জানে? জানবে কোনোদিন?ভালোবাসা যেমন সুখ তেমন যন্ত্রণা।বুকের মধ‍্যে চেপে রাখা অনুভূতি ছিটকে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। মনে হচ্ছে এক সেকেন্ডের জন‍্য পৃথিবীর সব নিয়ম ভুলে সামনের মানুষটিকে জড়িয়ে ধরতে। ওখানেই যেনো সমস্ত শান্তি লুকিয়ে আছে। একবার বুকে মাথা রেখে সমস্ত শান্তি শুষে নিতে ইচ্ছে করছে। ইরফাদ ধীর শীতল গলায় বলে,

— কাঁদছো কেনো মেয়ে? ইউ নোউ ইউ আর আ স্ট্রং গার্ল?
সিনথিয়া চোখ তুলে তাকায়। মাথা ব্ল‍্যাঙ্ক। দু”চোখ বেয়ে পড়ছে জল। একদিকে এক রাক্ষুষে, লোভী পৃথিবীর সাথে লড়ছে সে। ফলাফল কি সে জানে না। একটু পরেও কি হবে জানা নেই। মন মানে না। অবাধ‍্য ইচ্ছেকে টেনে হিচড়ে বেঁধে রেখেও কাজ হচ্ছে না।বিপদ তার দিকে সমুদ্রের বিশালাকার ঢেউ এর মতো ধাওয়া করে আসছে । যেনো ইরফাদ নিরাপদ জায়গা। ঐখানেই সমস্ত কিছুর সমাধান। বণ‍্য হরিণের মতো দৌড়ে যায় সিনথিয়া। পাখির ডানার মতো হাত ছড়িয়ে ঝাপটে ধরে ইরফাদকে। দুহাতে খামছে ধরে ইরফাদের পিঠের শার্ট। তারপর ভাঙা গলায় বলে,
— ওরা আমাকে বাঁচতে দিচ্ছে না। আমি আর পারছি না….

খুলে যায় সিনথিয়ার মাথাভর্তী চুলের হাতখোপা। গড়িয়ে পড়ে চুল পিঠ জুরে। সিনথিয়ার হঠাৎ করে ছুটে এসে আকরে ধরায় ইরফাদ নিজেও নিশ্চল, নিস্তব্ধ, নিরব পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। যেনো লোহকঠিন হৃদয়ের আড়ালের মোড়কে বাঁধা জরাজীর্ণ রক্তিম বিষণ্নতা আর একাকিত্বকে ছুঁয়ে দিলো একটি শুভ্র ফুল।শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতবিক্ষত হৃদয় জুরে এখন সিনথিয়ার এলোকেশী মাথা।
আস্ত পাথর চাপা দেয়া হৃদয়টা কি আজ কম্পিত হচ্ছে।সচল হওয়ার আভাস দিচ্ছে কি? ইরফাদ শ্বাস টানে। শীতল গলায় বলে,

— কুল কুল… ডোন্ট ক্রাইং…
সে কি হিমশীতল গলা। সিনথিয়ার হৃদয়ে যেনো বরফ ঠান্ডা অনুভূতি হয়। পরম শান্তিতে বন্ধ হয়ে আসে আখিযুগল। প্রশান্তি ছড়িয়ে যায় শ্বাসে।সিনথিয়া জরানো গলায় বলে,
— ভাইয়া আমার বিপক্ষে চলে গেছে। এতো গুলো মানুষের সাথে আমি টিকতে পারছি না….
— ওরা যেমনটা চায় তেমন হতে দাও।
–মানে?
— বিয়ের ব‍্যবস্থা করতে বলো।

সিনথিয়া ইরফাদের বুকের মধ‍্যে সমানে মাথা নাড়ায়। এলোকেশী মাথার পেছনে ভরসার হাত রাখে ইরফাদ। সিনথিয়া তবুও বলতে থাকে,
–না না না!সিচুয়েশন খুব ক্রিটিক‍্যাল। আমি সত‍্যিই সাহস পাচ্ছি না। ভাইয়া আমার অপজিটে….
— অপজিটে না। তোমার ভাইয়াও এটাই চাচ্ছে। তুমিও রাফিকে কুল রাখবে। বাকিটা আমি দেখবো….
— রাফি উম্মাদ হয়ে গেছে। ভাইয়া মত পাল্টালে আমি শেষ….
— আমি আছি না!!পাগলি মেয়ে। অলওয়েজ বি স্ট্রং ওকে?
— যদি আপনাকে আটকে রাখে?
–ছিলাম বলেই রাখতে পেরেছে। এখন কি রাখতে পেরেছে? ডেভিলদের প্ল‍্যান যেখানে শেষ আমাদের প্ল‍্যান ঐখানেই শুরু।
— কিন্তু…
— আমি আছিতো সিনথি!!

রং পর্ব ৩৯

পাশ দিয়ে উপরে চলে গেছে সিঁড়ি। উপরের একটা বিশালাকার রুম। দরজা ভিড়িয়ে দেয়া। রুম জুরে কোনো লাইট নেই। শুধু সারি সারি ডেক্সটপ আর ল‍্যাপটপের আলো। অফিসের মতো রাতের আধারে সারি সারি চেয়ারে বসে ল‍্যাপটপ, ডেক্সটপের দিকে চোখ বসিয়ে মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে অল্প বয়সী তরুণেরা। স্ক্রিনের অর্ধভাগ জুরে চলছে ক্রিকেট, ফুটবল আরও বিভিন্ন ধরণের খেলা। নিচের সাইডে বা/জি ধরার চাল চালছে তরুণেরা। জাবির চাপিয়ে রাখা দরজার ফাঁকে চোখ রাখে। তারপর ইরফাদের দিকে তাকিয়ে বলে,
–স‍্যার!ঐ ছেলেটাকে চিনতে পারছেন? নিখোঁজ ছেলেদের মধ‍্যে একজন না?

রং পর্ব ৪১