রং পর্ব ৪৪

রং পর্ব ৪৪
তন্নী তনু

জাবির উঠে এসে তপন চৌধুরীর মাথায় রিভলবার ঠেকায়। বাকিরাও ঘুরে দাঁড়ায় লেগে যায় ক্ষুদ্র যুদ্ধ।এর পরেই বাকিরা তপন চৌধুরীর ইশারায় অস্ত্র ফেলে। আরেকটি হেলিকপ্টার নেমে আসে ছাদে। সকল অপরাধিদের তোলা হয় হেলিকপ্টারে।
আকাশে তখন গভীর রাত্রির ছায়া নেমে এসেছে, চাঁদের পাশে ছুটে চলেছে খন্ড খন্ড মেঘেরা, নিচে সাদা বালুর সৈকত, নীল পানির উচ্ছাস, দমকা হাওয়া বইছে।
আলো আধারির খেলায় মাতোয়ারা হৃদয়স্পর্সী শীতল পরিবেশে নিচে বিশাল নীলচে বালুঝড়া সৈকত, বিশাল বিশাল গাছপালাকে উপেক্ষা করে,উপরে তারায় সাজানো আকাশের মাঝামাঝিতে, বিশ্বাস, ভরসা আর ভালোবাসার ভেলায় চড়ে, বলিষ্ঠ হাতের বাঁধনে রূপকথার রাজকন‍্যার বেশে সিনথিয়া ইরফাদের উষ্ণ ওমে ভেসে বেড়াচ্ছে সীমাহীন আকাশ জুরে।

মূহুর্ত্তের বিক্ষিপ্তভাবে ব্লাস্ট হয় টাইম বোমগুলো। এক… দুই…. তিন…. এভাবেই আগুনের আলোকদ‍্যুতি ভয়ানক রূপে ছড়িয়ে পড়ে। অতঃপর জ্বলতে থাকে অশুভ উপাখ‍্যানের একটি পাতা।
বাস্তব জগত রঙ মাখানো রিসোর্টে কত শত অশুভ কালো অধ‍্যায় চোখের অন্তরালে পড়ে আছে তার নাগাল পাওয়া যায় না, হদিস জানাও যায় না।
অতঃপর অশুভ পিচাশদের নিয়ে বাংলাদেশের দিকে ছুটে চলেছে অশুভশক্তির বিনাশকারী শুভশক্তিরা…….

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সময়ের আবর্তনে অল্প সময়ের ব‍্যবধানে রাফি, রাফসান, তপন চৌধুরীকে নেয়া হয় গুপ্তকক্ষে। তদন্তের প্রথম জিঙ্গাসা শুরু হয়। অন্ধকারাচ্ছন্ন আবছা আলোর বিশালাকার রুমে লম্বা পা ফেলে প্রবেশ করে ইরফাদ, জাবির, সারাফি। একই লম্বা টেবিলের অপর প্রান্তে হাত পিচমোড়া করে বাধা রাফসান, রাফি ও তপন চৌধুরী। অতঃপর প্রবেশ করে উক্ত দেশের ক্ষমতাধারী আইজিপি রুস্থান কবির। অতঃপর জিজ্ঞাসাবাদ……..
ইরফাদ নিজের রিভলভারের নল টান টান করে কপালে রাখে তপন চৌধুরীর। এরপর গমগমে গলায় বলে,
— শুধু সত‍্যটুকুই এক্সেপ্টেড, মিথ‍্যার আভাস পেলেই সোজা উপরে…..
তপন চৌধুরী ইরফাদের শক্ত, হিংস্র, বিধ্বংসী তীক্ষ্ণ অগ্নীশিখা চোখদুটির দিকে তাকিয়ে শক্ত ঢোক গেলে। এই মূহুর্ত্তে সে যা বলবে তা কি গ্রহণযোগ‍্য হবে?? নাকি আজকেই জ্বলন্ত অগ্নীর শক্তহাতে শেষ হবে জীবন নামক উপন‍্যাসের। ইরফাদের শক্ত গলায় ঝরে এক শক্তিশালী হুংকার,

— বল! আর কে কে এসবের পেছনে আছে?
তপন চৌধুরী একটানা কয়েকবার ঢোক গেলেন। তারপর বলেন,
–বাংলাদেশের একজন এর সাথে জড়িয়ে আছেন,সাথে বিদেশী কিছু বড় বড় বিত্তশালী মানুষেরা। তারা ফোনের মাধ‍্যমে যোগাযোগ রাখেন।
–তাদের নাম?
— আমি সত‍্যিই কাউকে চিনি না। বাংলাদেশী একজন মাঝে মধ‍্যে সেখানে যেতেন। তিনি সব সময় মুখোস পড়ে থাকতেন। তবে তার সম্পর্কে আমি সত‍্যিই কিছু জানিনা।শুধু ঐ রিসোর্টের সকল দায়িত্ব আমার উপর ছিল।
–সত‍্যি কথা বল!

–সত‍্যি বলছি!অনেক অনেক বছর আগে আমি প্রথম বিদেশী জু*য়ার এ‍্য*পের সাথে জড়িয়ে যাই। সেই এ*পস এ লাভবান হই। আমার স্কোর থাকে অলওয়েজ টপ। এরপর তারা আমাকে কল করেন। এরপর থেকেই আমি এসবে যুক্ত। বিদেশী এপস গুলোর এজেন্ট হিসেবে আমরা টাকা পেতাম। রিসোর্টের লাইভ ক‍্যাসিনো চালাতাম। তবে তাতে খুব অল্প পার্সেন্টেন্স আসতো। এই রিসোর্টের অধিপতি একদিন আমাকে কল করেন। এবং প্ল‍্যান জানান! তিনি চান একটা নতুন এ*পস ক্রিয়েট করতে, যেখানে বিদেশীদের কোনো হাত থাকবে না। এবং দেশের ফাইনাল খেলার আগে এটি তরুণ সমাজের কাছে পৌছে দিতে হবে। এই জন‍্য শুরু হয় কার্যক্রম। বে!টিং এর ওড দেয়ার জন‍্য গ্রামের ক্রিকেট খেলায় অভিঙ্গ ছেলেদের তুলে আনা হয়। আর ঐ এ*পসে ছেলেদের আকৃষ্ট করতে ভয়েজ দেয়ার প্রয়োজন পড়ে। মাঝে মাঝে কৌতুহল জাগাতে ছেলেদের নম্বরে কল দেয়ার প্রয়োজন পড়ে। কেউ কেউ হেরে গিয়ে এ*পস আনইনস্টল করে দেয়। এক্ষেত্রে তাদের সাপোর্ট দিয়ে আবার ডিপোজিট করার জন‍্য মেয়েলি ভয়েজের প্রয়োজন হয়। ঐজন‍্য একজন মাফিয়ার মাধ‍্যমে তুলে নেয়া হয় কিছু মেয়েদেরও। তবে সে প্ল‍্যান ফুলফিল হয় না।সে সময়ে কিছু মেয়ে হঠাৎ করেই মেডিসিনের কড়া ডোজে মারা যায়। এট দ‍্যা মিডটাইম আরও কিছু মেয়েকে কিডন‍্যাপ করা হয়। এরপরের ঘটনা আপনারা জানেন। কারণ আপনি নিজেই এই কেস সলভ করেছেন।

— গল্প শুনতে চাইনি! নাম বল….
–আমি সত‍্যিই জানিনা স‍্যার! তিনি কখনো সামনে আসেনি। শুধু ফোনে কথা হতো…আপনি যদি এখন শ‍্যুট করেও দেন তবুও এই কথার নড়চড় হবে না। শিশির বলনা বাবা! আমি মিথ‍্যা বলছি না।
শিশির শক্ত হয়ে দাড়ায়। দায়িত্বের জায়গায় দাঁড়িয়ে কড়া গলায় বলে,
— স‍্যার বলুন। এখানে আপনার কেউ আপনজন না।
তপন চৌধুরী চোখ নামিয়ে বলে– সরি স‍্যার। তবে আমি সত‍্য‍ি বলছি।
পুরো ক্রাইম জগতের মানুষ জানে ইরফাদের হাতের রিভলবার থাকার অর্থ। চোখ দেখে সত‍্যতা যাচাই এর ক্ষমতা তার আছে। সে যা আগেই গেস করেছিলো –তপন চৌধুরীর আড়ালে কলকাঠি নাড়ার মানুষ আছে।
ইরফাদ আদেশ সূচক গলায় বলে,
— জাবির ওনার ডেসক্রিপশন অনুযায়ী স্কেচ তৈরী করা হোক….বাকিটা দেখছি।

শিশিরের বাবা সাফিন আহমেদ বাসায় ফিরেছেন আজ। তিনি গোসলে গেছেন। মার্জিয়া বেগম দাপিয়ে কাজ করেছেন সারাদিন। এলোমেলো অগোছালো জিনিস তার পছন্দ না। ছেলে বাসায় থাকাকালীন তার রুম পরিষ্কার করা যায় না। আলমারি ছুঁতে দেয় না। আজ সমস্ত কিছু ধুয়ে মুছে তকতকে ঝকঝকে করে ফেলেছেন। আলমারিতে জামাকাপড় ভাজ করে রাখেন।এর মধ‍্যে তার চোখ আটকে যায় লকারের দিকে। একটা কাগজের কিছু অংশ লকারের বাইরে বেরিয়ে আছে। কৌতুহলবসত তিনি কাগজ ধরে টান দেন। হ‍্যাচকা টানে ছিড়ে আসে উপরের অংশ। উপরের কাগজ ছিড়ে একটা ছবি দেখতে পান। কৌতুহল বাড়ে। শিশির বলেছিলো — কাউকে পছন্দ করে। সেই মেয়ের ই কি ছবি!দেখার ইচ্ছে বাড়ে।

হাতল ধরে টানাটানি করে কিছুক্ষণ। চাবি খোঁজে ভাজ করা কাপড়ের নিচ থেকে। কাজ হয় না। মাথায় কৌতুহল বাড়ে। শক্ত রড খুঁজে এনে লকার এর হাতলে বাজিয়ে তালা খুলে ফেলে মার্জিয়া বেগম। ছেলের পারসোনাল জিনিস খুঁচিয়ে কখনো দেখা হয় নি তবে আজকাল ছেলেটাকে অদ্ভুত লাগে। কি করে বেড়ায় মা হিসেবে দেখা দরকার। লকার খুলে ছবিটা বের করে। তারপর থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ছবিটির বাকি অংশ দেখে নিজের কাজে নিজেই বুদ্ধুরাম হয় তার। ছবিটি গ্রুপ ফটো। স্কুল জীবনের সবাই মিলে তোলা। এই জন‍্য তিনি বোকার মতো লকার ভাঙলেন। শিশিরকে কি জবাব দিবেন তিনি!! থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। সহসাই একটা কথা মাথায় ঘুরপাক খায়। কোনো চিঠিপত্র থাকতেই পারে। একবার কি ছেলের প্রাইভেট জিনিস ঘেটে দেখলে তার পাপ হবে। সমস্ত কাগজপত্র বিছানায় তুলে আনেন তিনি। সমস্ত ফাইল চেক করে। কিছু না পেয়ে আবার লকারে তুলে রাখেন।ঠিক সে সময় তিথি মার্জিয়া বেগমের খোঁজে আসে।

— মামি!!
মার্জিয়া বেগম বলেন,
–বলে ফেল!!
— কাল আমি একবার রিমা দের বাসায় যেতে চাই।
— তো জাবি। তুই তোর ভাই শিশির, কুটুস আমার কথা শুনিস?? না করলে কি তুই জাবি না!
তিথি কোনো উত্তর দেয় না। বলার প্রয়োজন বলেছে। এখন কথা শুনতে গেলে কথা বাড়বে। তিথি পিছু ফেরে ঠিক তখন ই মামি ডাকে,
–শোনতো!!
–বলো!!
— দ‍্যাখতো এটা কি?
তিথি গুটিগুটি পায়ে রুমে এসে লকারের দিকে তাকায়। তার পর বলে,
— আল্লাহ্!তুমি লকার ভেঙ্গেছো?
— হুম!! তো কি হয়েছে। শিশির খাবে আমাকে?? প‍্যাচাল বাদ দিয়ে যা বলছি কর।
খামটা হাতে নেয় তিথি। এরপর খুলে ফেলে। চোখ বুলায় কাগজে। একটা এপয়েনমেন্ট লেটার। শিশির বরাবর বলতো তার জব ভালো লাগে না। তাহলে কিসের কাগজ এটি। সম্পূর্ণ কাগজ পড়ে দেখে থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তিথি। মার্জিয়া বেগম বলে,
–হলো কি??
— ছোট অক্ষর চোখে পড়বে না দেখে তোকে দিলাম। পড়তেও জানিস না। এতোদিন টাকা গুলো শুধু শুধু ফুরালাম।
তিথি থমথমে গলায় বলে,
— কষ্ট করে পড়ে দেখো!!! প্লিজ… আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।

কাজ শেষে বাইরে বের হওয়ার প্রস্তুতি নেয় ইরফাদ। ঠিক সে সময় পেছন থেকে ডাকে রাফসান,
— স‍্যার!
পিছু তাকায় ইরফাদ। রাফসান কাতর গলায় বলে,
— পৃথিবীর সকল পাপ আমি স্বীকার করে নিয়েছি। আমি আপনাকে যেমন ভাবে চিনি এর বাইরেও নাকি আপনার একটা রূপ আছে। একজন “মাফিয়া-পুলিশের” সম্পর্কের বাইরে গিয়ে যদি একজন বাবার অনুভূতি উপলব্দি করে- আমার মেয়েকে একবার ছুঁয়ে দেখতে দিতেন। আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকতাম।এরপরে আপনি আমার ফাঁসির রায় নিয়ে দিলেও আমি মাথা পেতে নিবো।
ইরফাদের কঠিন, লৌহশক্ত হৃদয় গললো কি না তার মুখের ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছে না। রাফসান তার লৌহশক্ত হাত দুটি প্রথমবারের মতো বিনয়ী ভঙ্গিতে তোলে। ভাঙা গলায় ফুটে ওঠে মেয়েকে একপলক দেখার আকাঙ্ক্ষা। হাতজোর করে রাফসান বলে,
— একবার! একপলক এর জন‍্য আমি আমার মেয়েকে দেখতে চাই।
ইরফাদের ভঙ্গিতে কিছু বুঝে ওঠা দুষ্কর। রাফসান আঁচও করতে পারলো না ইরফাদের লৌহশক্ত হৃদয়খানা গললো কি না। তার শক্ত চাহুনিতে মনে হলো এই হৃদয়ভাঙ্গার আর্তচিৎকার ইরফাদের হৃদয় তো দূর চোখেও ধরা পড়লো না।

সিনথিয়াকে গাড়িতে বসিয়ে কয়েকজন পুলিশকে পাহারায় রেখে ইরফাদ গুপ্তকক্ষে প্রবেশ করেছিলো।ফিরে এসে দেখে বিভোরে ঘুমাচ্ছে সিনথিয়া। গাড়িতে বসে ইরফাদ। স্ট্রিয়ারিং ঘুড়িয়ে গাড়ি ঘুড়ায় ইরফাদ। সিনথিয়া বিভোর ঘুমে আচ্ছন্ন। অনেকটা ধকল কাটিয়ে সে একটু নিরালায় ঘুমিয়েছে। শরীরের অবস্থা ভালো নয়। ফিরে এসে ড্রেস চেঞ্জ করানো হয়েছে। খাবার খাওয়ানো হয়েছে। এখন সে ঘুমাচ্ছে। অফিসিয়াল কার্যক্রম শেষ না হওয়ায় তার বাসায় এখনো নিউজ পাঠানো হয়নি। বিষয়টি সম্পর্কে সিনথিয়া অবগত। তবে খুব শীঘ্রই পাঠানো হবে। হাত খোপা করা চুল গুলো বেখেয়ালিভাবে উড়ছে সিনথিয়ার। আধভাঙ্গা হয়ে শুয়ে আছে মেয়েটি। কেস চলাকালীন অনেকবারই সিনথিয়া ইরফাদের পাশাপাশি বসেছে। তবে আজকের বিষয়টা ভিন্ন। আধভাঙা হওয়া সিনথিয়ার সিটবেল্ট একহাতে খুলে দেয় ইরফাদ। এরপর গাড়ি স্লো মশানে রেখে নিজের কোলের মধ‍্যে টেনে নেয় সিনথিয়ার ঘুমন্ত শিশুসুলভ মাথা। একহাতে গাড়ির স্ট্রিয়ারিং অন‍্যহাতের আঙ্গুল সিনথিয়ার মাথায় রাখে। ঘন কৃষ্ণকালো এলোকেশী মাথায় আঙুলি চালিয়ে শূন‍্য দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে থাকে ইরফাদ।

শিশির অফিস থেকে বেড়িয়ে একগুচ্ছ লাল গোলাপ কেনে। অর্ডারকৃত নীল রঙের গাউনটি হাতে তুলে নেয় শিশির। ডায়মন্ডের রিং টি একবার খুলে দেখে। তারপর হাসি মুখ করে বলে,–” কালকেই এক্সপোজ হবে তোর বাবার আসল রূপ। মায়ের ভুল ভাঙবে। আর কষ্ট দেবে না তোকে। আর আঘাত করবে না তিথি।
“তুই আমার সুহাসিনী। রাস্তায় গলিতে গলিতে গড়ে ওঠা ঠুনকো প্রেমের গল্পের প্রেমিকের মতো আমি কখনো বলবো না– হাসো একটু। তোর পাতলা ঠোঁটের আড়ালে ঝিলিক দিয়ে ওঠা হাসির কারণ হবো আমি। শুধুই আমি।”
ইরফাদ নিজের বাসার সামনে এসে গাড়ি থামায়। মৃদু হর্ণ বাজায়। বাসার দাঁড়ায়ান খুলে দেয় মেইন গেটের ভারি পাল্লা। ইরফাদ গাড়ি নিয়ে বাসায় ঢুকে যায়। গাড়ির শব্দে বিছানা থেকে দৌড়ে বাইরে আসে ইভা। বেলকনিতে দাড়িয়ে চেঁচিয়ে বলে,– ভাইয়া!
ইরফাদ গাড়ির সাইড গ্লাস নামিয়ে হাত নাড়ায়। তারপর গলা উচিয়ে বলে,–আসছি আসছি।
ইরফাদ সিনথিয়ার এলোকেশী মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদু স্বরে ডাকে,– সিনথি!!
এই মেয়ে!!
সিনথি!!
সিনথি!!
দূর্বল শরীরে ঘুমন্ত মেয়েটি নিভু নিভু চায়। টেনে তুলে বসায় ইরফাদ। তারপর বলে,
— ওঠো! শ্বশুরবাড়ি চলে এসেছো তো। ওঠো…
সিনথিয়া লাফিয়ে উঠে বসে। উদভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক তাকায়। যেনো কিছুই ঘটে ঢুকছে না। ইরফাদ দরজার বাইরে যায়। তারপর সিনথিয়াকে ইশারা দেয় বাইরে আসার জন‍্য। ইভা উপর থেকে ছুটে গেছে বাবাকে খবর দিতে। বাবা নামাজ পড়ছেন। তাই ফিরে আসে ইভা। তবে ইভা বণ‍্য হরিণের মতো খুশির উচ্ছাসে ছুটে বেড়াচ্ছে।মেয়েকে কোলে নিয়ে লাফিয়ে ছুটে যায় আবার বেলকুনিতে।
অজানা অচেনা বাসার সামনে নিজেকে দেখে… থমথমে মুখ করে আছে সিনথিয়া। অকারণেই হাত পা কাঁপছে। এভাবে একটা মেয়েকে হুট করে বিয়ে করলেই কি সবাই মেনে নিবে।ইরফাদের বাসায় কে কে আছে?? সবাই তাকে ভালোভাবে নিবে তো? মনে জমছে অজস্র প্রশ্ন। সেই সাথে একটা প্রশ্ন মাথা থেকেই যাচ্ছে না। ইরফাদ কখনো তাকে ভালোবাসেনি। তাহলে দায় থেকে বিয়ে করলো তাকে? এমনটা তো সে চায়নি কখনো! এসব ভাবছে আর পিপিলিকার মতো পায়ে হাঁটছে সিনথিয়া। ইরফাদ দৃষ্টি ফেলে একপলক দেখে। সিনথিয়া অপ্রস্তুত ভাবে হাঁটছে। ছোট করে একটা শ্বাস ফেলে ইরফাদ। সিনথিয়াকে থামিয়ে আস্ত মানুষটাকে কাঁধের উপর তুলে নেয়। আকষ্মিক এমন কাজে অপ্রস্তুত হয় সিনথিয়া। লজ্জা জড়ানো গলায় বলে,–আমি হাঁটতে পারি।
ইরফাদ কোনো কথা বলে না। যেনো তার কাজ, তার ভাবনা বরাবর ঠিক। সিনথিয়া আবার বলে,

— প্লিজ নামিয়ে দিন। মানুষ কি ভাববে….
ইরফাদ বলে,
— কে কি ভাববে?? তোমার হাঁটার যে গতি,,,, সকাল হয়ে যেতো।
ধাপধাপ করে পা ফেলে উপরের দিকে যাচ্ছে ইরফাদ। দরজা খুলে ড্রয়িংরুমে গিয়ে ধপাস করে সোফায় বসায় সিনথিয়াকে। ইভা দৌড়ে ভেতরে আসে।তারপর অনুভূতিশূন‍্য হয়ে যেনো দাঁড়ায়। এতো বছরে কখনো কোনদিন মেয়েদের ধারের কাছে দেখেনি সে তার ভাইকে। মূর্তির মতো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইভা। টুম্পা মায়ের কোল থেকে নেমে যায়। আর বলে,

— ইয়েএএএএএ….মামাই।
ইরফাদ হাত বাড়িয়ে শূন‍্যে দুলিয়ে কোলে তুলে নেয় টুম্পাকে। ইভা একবার ইরফাদের দিকে তাকাচ্ছে একবার মেয়েটির দিকে। তবে সত‍্যিই কিছু বুঝতে পারছে না সে। ইরফাদ ইভার দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে আসে। মাথায় টোকা দেয় দিয়ে বলে,
–কেমন আছিস!! বাবা কই?
ইভা থমথমে গলায় বলে,– মেয়েটি কে?
ছোট্ট টুম্পা সোফায় বসা মেয়েটির দিকে তাকায়।তারপর বলে– বন্ধু এনেছো মামনির জন‍্য???মামাই….!!!
ইরফাদ মৃদু হাসে। টুম্পাকে টুপটুপ করে দুটো হামি দেয় ইরফাদ। তারপর ইভাকে এক বাহুডোরে আগলে নিয়ে মাথায় ছোট্ট হামি দেয়। এরপর বলে,– বন্ধু নিয়ে এসেছি তোর!! তোর নাকি একা লাগে….
ইভা ইরফাদের বাহুডোরে থেকে বলে,– সত‍্যি করে বলোতো কে মেয়েটি?
— আরেএএএ দেখলাম বউ মেলা হচ্ছে, বউ মেলা থেকে বউ কিনে এনেছি। পছন্দ হয় নি?
বউ শব্দটা সিনথিয়া শুনে চোখ তুলে তাকায়। ইরফাদের বউ” সে এ কথাটা ভাবতেই বুকের গহীনে তোলপাড় শুরু হয়। উত্তাল সাগরের ঢেউ এর মতো ঢেউ খেলে যায় শব্দটি।
অপ্রত‍্যাশিত জিনিস টি চোখের সামনে বাস্তব হতে দেখে ইভা যেনো অন‍্য দুনিয়ায় হারিয়ে যায়। সে ছোট বাচ্চার মতো লাফাতে লাফাতে চিৎকার দিয়ে বলে—বাবা!! বাবা!! ভাইয়া বউ নিয়ে আসছে বাবা। তাড়াতাড়ি আসো বাবা!

রিদুয়ানুর রহমান আসেন ধীর পায়ে, এসব তিনি মোটেও বিশ্বাস করেননা। ইরফাদ বাবাকে দেখে এগিয়ে যায়। রিদুয়ানুর রহমান পায়ের গতি বাড়ান। ছেলেকে গালভোরে ডাক দেন– আব্বা।কেমন আছো আব্বা?
ইরফাদ ছোট্ট বাচ্চার মতো বাবার কাছে যায়। বহুদিন দূরে থাকার ক্ষতিপূরণ স্বরূপ রেদুয়ানুর রহমান ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন। ছেলে যত বড় হোক। বাবার কাছে সন্তান সবসময় ছোট্ট শিশুই রয়ে যায়। ইরফাদের পিঠ চাপড়ায় রিদুয়ানুর রহমান। ইভা এগিয়ে গিয়ে বলে,
— আমি কি বললাম ঐটা শোনার প্রয়োজন মনে করলে না বাবা। ভাইয়া বউ নিয়ে আসছে। তাকে দেখো আগে….
রিদুয়ানুর রহমান ভ্রু কুচকে ফেলেন। ইরফাদ আনবে বউ তাও আবার না বলে। পেছন থেকে সিনথিয়া মাথায় কাপড় টেনে নিয়ে সালাম দেয়– আসসালামু আলাইকুম।
রিদুয়ানুর রহমান সালামের উত্তর দিতে দিতে একবার ইরফাদের দিকে একবার সিনথিয়ার দিকে তাকান। তার চোখের ভঙ্গিমায় স্পষ্ট- তিনি যেনো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। ইরফাদ খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে টুম্পাকে নামিয়ে দেয়। তারপর বলে,

—অনেক টায়ার্ড লাগছে বাবা ফ্রেশ হয়ে আসছি।
বলেই রুমে চলে যায় ইরফাদ। রিদুয়ানুর রহমান খুশিতে নড়চড় ভুলে যান। ছেলে বিয়ে করবে তাও এভাবে সে তো ভাবতেও পারছে না। খুশিতে আত্মহারা হয়ে সিনথিয়ার কাছে যায়। মায়াবী মুখখানা দেখে মাথায় হাত দিয়ে বলেন,
— মাশাল্লাহ্ আম্মা মাশাল্লাহ্…

ইভা আলমারি থেকে বক্সটা নিয়ে আয়। তোর মা থাকলে আজ অনেক খুশি হতো। যা যা…
অপ্রত‍্যাশিত বিষয়গুলো নিজের চোখের সামনে ঘটতে দেখে খুশিতে টুপ করে জল পড়ে সিনথিয়ার।সব স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে।এতো টা আদর পাবে সিনথিয়ার কল্পনায়ও ছিলো না। ইভা দৌড়ে গিয়ে আলমারি থেকে গহনার বাক্স নিয়ে আসে। রিদুয়ানুর রহমান নিজে সিনথিয়ার হাতে দুটো স্বর্ণের মুখবালা পড়ান। ইভা খুশিতে মায়ের চেইনটা,মায়ের হারটা সিনথিয়ার গলায় পড়ায়। হাতে তুলে দেয় গহনার পাঁচটা বক্স।
সিনথিয়া অপ্রস্তুত হয়ে যায়। আসার পরে কি না কি হয় সে চিন্তায় পাগল হচ্ছিলো সে। আর এরা তো পুতুলের মতো গহনায় ঢেকে দিচ্ছে। না করলেও তার কথা যেনো কেউ শোনার প্রয়োজন ই মনে করছে না।সবশেষে ইভা নিজের তরফ থেকে নিজের হাতের একটা আধুনিক বাচ্চাদের স্টাইলে বানানো চুরি সিনথিয়ার হাতে পড়িয়ে দেয়।সিনথিয়া বাঁধা দেয়।– কি করছো আপু?

–শখ টা অনেক বড় তবে দেওয়ার মতো কিছু নেই। এটা তোমাকে নিতেই হবে। আমি আজ খুব খুশি….
তারপর বলে,
—তুমি বাচ্চা একটা মেয়ে তোমাকে কি বলে ডাকি বলোতো?? ভাবি বললে মোটেও মানাবে না। তোমাকে আমি বউ বলে ডাকবো।
সিনথিয়া কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কি বলবে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। রিদুয়ানুর রহমান তাড়া দেয়,
— ইভা যাও আম্মাকে ফ্রেশ করাও। যাও যাও….

ফ্রেশ হয়ে টাওয়েল কোমরে রুমে আসে ইরফাদ। ফোন বাজছে। এই নিয়ে আটটা কল ঢুকেছে প্রভাতরঞ্জনের। কল ধরে ইরফাদ,
— কি ব‍্যাপার ইরফাদ!!!! তুমি দেশে ফিরেছো আমাকে একটা কল দিলে না।
— আপনি কি করে জানলেন!!
–তুমি আমার ছেলের মতো। ছেলের খবর বাবার কাছে আসবেই।
–তাই নাকি?? নিজের খবর এক্সপোজ এর ভয়ে আছেন নাকি?
— কি বলছো বাবা বুঝতে পারছি না ত….
–কাল সকাল হোক সবটা নিজ দায়িত্বে জানিয়ে দিবো।
–ইরফাদ ক্লিয়ারলি বলো। আমার সাথে ডিসকাস করো….সব তো আমরা ডিসকাস করেই সলভ করি আমি তোমার সিনিয়র। আই হোপ আমি তোমাকে ইজি সলুশন দিতে পারবো।
— আপনি যদি মাইন্ড গেইমের মাস্টার প্ল‍্যানার হন আপনি ভুলে গেছেন আপনার অপজিটের মানুষটা সাইল‍্যান্ট কিলার। সো হ‍্যাপি কোল্ড ওয়ার। টাটা…..
বলেই ফোন কাটে ইরফাদ। তারপর ইভার রুমে নক করে।

— ইভা!!
–ভাইয়া বলো….
–সিনথি কই…
–এই তো রেডি করাচ্ছি। আর পাঁচ মিনিট…
— ও….কে!! পাঠিয়ে দে…
— না পাঠালে হয় না??
–নাহ…
টুম্পা মায়ের মুখের দিকে তাকায় একবার সিনথিয়ার মুখের দিকে তাকায় একবার। তারপর বলে,
— মামনি এটা আমাদের বউ না?
ইভা মাথা নেড়ে বলে– হুম
–মামাই যে বললো আমাদের জন‍্য এনেছে।আমাদের কাছে থাকবে না?
–না সোনা!
— তাহলে?

রং পর্ব ৪৩

–এটা মামাই এর বউ। মামাই এর কাছে থাকবে…
–তাহলে আমার বউ এনে দাও। আমি খেলা করবো…
— তোমার বউ কই পাবো মা। তবে বড় হলে বর এনে দিবো ওকে?
সিনথিয়া মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে– আজ এখানেই থাকি??
–তা কি করে হয় বউ। বরের কাছেই তো থাকতে হবে… চল চল…
–প্লিজ আপু… আমার ভয় করছে…
— আমার ভাই পৃথিবীর শ্রেষ্ট ভাই। ছেলে হিসেবে শ্রেষ্ঠ ছেলে। সৎ,আদর্শবান নম্র-ভদ্র একটা ছেলে। শুধু একটু রাগি। তবে বর হিসেবে ও বেষ্ট হবে। চলো চলো….
সিনথিয়ার বুকটা ধুকধুক করতে থাকে। ইরফাদের রুমের দরজা যতো কাছে আসে সিনথিয়া ততো ঘামতে থাকে। অতঃপর সিনথিয়াকে রুমে দিয়ে পেছন থেকে ইভা বলে– অল দ‍্যা বেস্ট বউ।
অতঃপর প্রগাঢ় নিরবতা……….

রং পর্ব ৪৫